রহস্যের দ্বীপ: ৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়

রহস্যের দ্বীপ: ৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়

৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়

মনে হয় ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায় লুকিয়ে আছে হারামখোরেরা, বললেন স্পিলেট।

এবার খোঁয়াড়ের দিকে এগিয়ে চলল অভিযাত্রীরা। খোঁয়াড়কে ঘাটি বানিয়ে ফ্র্যাঙ্কলিন হিলে অনুসন্ধান চালানোর ইচ্ছে ক্যাপ্টেনের। কে জানে খোঁয়াড়েই আড্ডা গেড়েছে কিনা ডাকাতেরা। তাহলে জোর করে খোঁয়াড় দখল করতে হবে। কিন্তু যাওয়ার আগে জেনে নেয়া দরকার ব্যাটারা সত্যিই ওখানে আছে কিনা। থাকলে দিনের বেলা হামলা করা আত্মহত্যারই সামিল হবে।

দিনের বেলা তাই খোঁয়াড়ের কাছের জঙ্গলে আত্মগোপন করে রইল অভিযাত্রীরা। দিন গড়িয়ে সাঁঝ হলো। হঠাৎ করেই অন্ধকার নামল জঙ্গলের বুকে। আটটা বাজতেই পেনক্র্যাফটকে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন স্পিলেট। বাকি সবাই আগের জায়গায়ই অপেক্ষা করে রইল।

নিঃশব্দে বন পেরিয়ে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল দুজনে। প্রায় ত্রিশ ফুট ফাকা মাঠের পর খোঁয়াড়ের গেট। এ জায়গাটুকু পেরোনোই সবচেয়ে বিপজ্জনক।

মাটিতে শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটে গেটের দিকে এগোল দুজন। গেটের কাছে পৌঁছে আস্তে করে ঠেলা দিলেন স্পিলেট। খুলল না গেট। ভেতর থেকে বন্ধ। অর্থাৎ খোঁয়াড়েই আড্ডা গেড়েছে ডাকাতরা।

যেমন গিয়েছিল তেমনি নিঃশব্দে ফিরে এল দুজনে। কথাটা শুনলেন ক্যাপ্টেন। সবাই চলল এবার খোঁয়াড়ের দিকে। পুরু ঘাসের উপর দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ওরা। নির্বিঘ্নে গেট পর্যন্ত পৌঁছে গেল অভিযাত্রীরা। পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল। হাঁ হয়ে খুলে আছে গেটের পাল্লা।

অবাক কান্ড! ফিস ফিস করে বললেন স্পিলেট।

অবাক হবার কিছু নেই। কেউ হয়তো কোন কাজে বাইরে বেরিয়েছে। ফিস ফিস করেই বললেন ক্যাপ্টেন।

পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকে পড়ল হার্বার্ট মিনিট খানেক পরই ফিরে এল আবার। ক্যাপ্টেনকে বলল, আলো জ্বলছে ভেতরে।

জাপ আর টপকে গাড়ির কাছে রেখে ভেতরে ঢুকে পড়ল সবাই। ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে এসে পড়েছে আলোর রেখা।

ভেতরেই আছে বদমাশগুলো। শুয়োরগুলোকে খতম করার এই সুযোগ, বলল পেনক্র্যাফট।

দুভাগ হয়ে গেল অভিযাত্রীরা। বেড়ার ধার ঘেঁষে এগিয়ে চললেন ক্যাপ্টেন, নেব আর হার্বার্ট। উঠানের ওপর দিয়ে কোণাকোণি এগোলেন স্পিলেট আর পেনক্র্যাফট।

নিঃশব্দে ঘরের কাছে পৌঁছে গেলেন ক্যাপ্টেন। উঁকি মেরে দেখলেন টেবিলের ওপর রাখা আছে বাতিটা। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে একজন লোক।

লোকটাকে দেখেই অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন ক্যাপ্টেন। আয়ারটন। বিছানায় শোয়া লোকটা আয়ারটন।

ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে পড়ল পাঁচজনেই। সাংঘাতিক নির্যাতনের চিহ্ন আয়ারটনের কজিতে, পায়ের গাটে। ঘা হয়ে গেছে জায়গাগুলোতে। অভিযাত্রীদের পায়ের শব্দে চোখ মেলে চাইল আয়ারটন, বিড় বিড় করে বলল, আপনারা, আপনারা এসেছেন?

হ্যাঁ, আয়ারটন।

আমি কোথায়?

কেন, খোঁয়াড়ে।

দস্যুরা কোথায়?

আশপাশে তো দেখছি না।

এখুনি এসে পড়বে। তৈরি হয়ে যান। বলেই অজ্ঞান হয়ে গেল আয়ারটন।

গাড়িটাকে খোয়াড়ের ভেতর নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। গাড়িটা ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে খোঁয়াড়ের গেট বন্ধ করে দেয়া হলো। হুশিয়ার থাকতে হবে এখন। কোথায় লুকিয়ে আছে ডাকাতেরা, কে জানে।

হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল টপ। পরক্ষণেই লাফিয়ে উঠে ছুটল খোঁয়াড়ের পেছন দিকে। জাপও দৌড়াল সেদিকে। পেছন পেছন বন্দুক বাগিয়ে ছুটল অভিযাত্রীরা।

আকাশে চাঁদ ওঠায় অন্ধকার কেটে গেছে। কৃষ্ণপক্ষের ঘোলাটে চাঁদের আলোয় আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে খোঁয়াড়ের পেছনে ঝর্নাটা। ঝর্নার পাড়ে শুয়ে আছে পাঁচজন লোক কাঁধে বন্দুক তুলে নিয়ে আর একটু এগিয়ে গেল অভিযাত্রীরা। কিন্তু বিন্দুমাত্র নড়ল না লোকগুলো। হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন ক্যাপ্টেন। সবাইকে বন্দুক নামাবার নির্দেশ দিলেন তিনি।

আসলে ঝর্নার পাশে পড়ে আছে পাঁচটা লাশ।

অবাক কান্ড! কি করে মারা গেল পাঁচজন দুর্ধর্ষ ডাকাত? যেভাবেই মারা যাক দিনের বেলায় বোঝা যাবে। রাতের মত ঘুমাতে গেল সবাই। তার আগে স্পিলেট একবার আয়ারটনের নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলেন। ঠিকই আছে। আসলে অত্যাচারে অতিমাত্রায় কাহিল হয়ে পড়েছে আয়ারটন।

পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরলে নিজের দুর্ভোগের কাহিনী সবাইকে শোনাল আয়ারটন। খোঁয়াড়ে আসার পরদিনই আয়ারটনকে বন্দী করে ফ্র্যাঙ্কলিন হিলের এক গুহায় নিয়ে যায় ডাকাতেরা। ওর কাছ থেকে কথা আদায়ের পর মেরে ফেলাই ওদের ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা ডাকাত ওকে বেন জয়েস বলে চিনতে পারে। তারপরই ডাকাতরা ওকে দলে টানার চেষ্টা করে। এদের ইচ্ছে ছিল আয়ারটনের সাহায্যে অভিযাত্রীদের হত্যা করে দ্বীপটার মালিক হয়ে বসবে। কিন্তু রাজি হয়নি আয়ারটন। শুরু হলো ওর ওপর অকথ্য নির্যাতন। দীর্ঘ চারমাস ধরে নির্যাতন চালাবার পর ওকে পাহাড়ের গুহায় ফেলে রেখে চলে আসে ডাকাতেরা। তারপর ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাহিল হয়ে এক সময় জ্ঞান হারায় আয়ারটন। তারপর আর কিছু মনে নেই ওর! খোঁয়াড়ে সে কি করে এল বলতে পারবে না। সংক্ষেপে এই হলো আয়ারটনের কাহিনী।

কিন্তু পাঁচটা দস্যুই যে মরে আছে ঝর্নার ধারে কি করে মরল ওরা? প্রশ্ন করলেন ক্যাপ্টেন।

মরে পড়ে আছে। উত্তেজনায় উঠে বসার চেষ্টা করল আয়ারটন। ধরাধরি করে বাইরে ঝর্নার ধারে নিয়ে আসা হলো ওকে। দিনের আলোয় লাশগুলো পরীক্ষা করে দেখলেন ক্যাপ্টেন। লাশগুলোর দেহের কোথাও কোন ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেল না। তবে সবকটা দেহে একটা করে দগদগে লাল ঘায়ের মত দাগ দেখা গেল। দাগটা শরীরের কোন নির্দিষ্ট জায়গায় নয়। কারও বুকে, কারও পিঠে, কারও কাঁধে। ভালমত দাগগুলো পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ক্যাপ্টেন, বুঝেছি।

কি বুঝলেন, ক্যাপ্টেন? কি করে মারা গেল ডাকাতগুলো? জিজ্ঞেস করলেন স্পিলেট।

ইলেকট্রিক রাইফেল জাতীয় কোন অস্ত্রের সাহায্যে মারা হয়েছে ওদের।

ইলেকট্রিক রাইফেল! স্তম্ভিত হয়ে বললেন স্পিলেট, কিন্তু এই অদ্ভুত কাজটা কে করল?

সেই রহস্যময় ত্রাণকর্তা ছাড়া আর কে? আয়ারটনের দিকে ফিরে বললেন, আয়ারটন, ফ্রাঙ্কলিন হিলের গুহা থেকে তিনিই তোমাকে খোঁয়াড়ে পৌঁছে দিয়ে গেছেন।

লাশগুলোকে কবর দেবার ব্যবস্থা করতে লাগল অভিযাত্রীরা। ওদের একটা প্রতিজ্ঞা পূরণ হলো।

ট্যাবর দ্বীপে গিয়ে নোটিশটা রেখে আসতে হয় এবার, মনে করিয়ে দিল পেনক্র্যাফট। নইলে ডানকান এসে ফিরে যেতে পারে।

কি করে যাবেন? মৃদু হেসে প্রশ্ন করল আয়ারটন।

কেন, বন-অ্যাডভেঞ্চারে চড়ে

এটা এখন পানির তলায় বন-অ্যাডভেঞ্চারে চড়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল হারামজাদা ডাকাতেরা চোরা জাহাজে ধাক্কা লেগে ভেঙে তলিয়ে গেছে নৌকোটা।

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল পেনক্র্যাফটের হার্বার্ট সান্তনা দিল ওকে, দুঃখ কোরো না, পেনক্র্যাফট। আর একটা নৌকো বানিয়ে নেব আমরা, বন-অ্যাডভেঞ্চারের চেয়েও বড়।

কিন্তু ওতে তো কয়েক মাস লেগে যাবে।

কি আর করা যাবে এ বছর আর ট্যাবর আইল্যান্ডে যাওয়া হলো না। শান্তভাবে বললেন স্পিলেট।

তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ত্রাণকর্তার আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেল না। উনিশে ফেব্রুয়ারি, যে আগেয় পাহাড়টার মাথায় চড়ে লিঙ্কন আইল্যান্ডকে দ্বীপ বলে চিনেছিলেন ক্যাপ্টেন, সেই পাহাড়টার এক বিশাল গহ্বরে অভিযাত্রীরা হানা দিল। সুড়ঙ্গের অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছে সবাই, এমন সময় গুরু গুরু মেঘ গর্জনের মত শব্দ হলো আগ্নেয়গিরির পেট থেকে।

সর্বনাশ চমকে উঠে বললেন স্পিলেট, আবার দেখছি জেগে উঠছে আগ্নেয়গিরি!

তাড়াতাড়ি সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সবাই। কিন্তু অনুৎপাত করল না আগ্নেয়গিরি। এলাকাটা আবার চষে ফেলল অভিযাত্রীরা। কিন্তু পাওয়া গেল না রহস্যময় ত্রাণকর্তার আস্তানা। হতাশ হয়ে পঁচিশে ফেব্রুয়ারি গ্র্যানাইট হাউসে ফিরে এল সবাই।

ডাকাতেরা খেত খামার, পোলট্রি, উইন্ডমিলের চুড়ান্ত ক্ষতি করে গেছে। সেগুলো ঠিক করার দিকে মন দিল এবার ওরা। দেশে ফিরে যাবার জন্যে ওদের আর মন খারাপ হয় না এখন। লিঙ্কন দ্বীপেই জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে দিতে চায় ওরা।

একদিন মন্তব্য করল হার্বার্ট, একবার দেশ থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়? প্রস্তাবটায় সায় দিল সবাই। কিন্তু যেতে হলে একটা ছোটখাট জাহাজের দরকার। ঠিক হলো জাহাজ বানিয়ে নেয়া হবে। বানাতে সময় লাগবে সাত-আট মাস।

কাজে লেগে গেল পেনক্র্যাফট। একটা তিনশো টন জাহাজের নক্সা একে ফেলল সে। জাহাজের তক্তার জন্যে গাছ কাটা শুরু হলো এরপর।

আগের পর্ব :
০১. ওপরে কি উঠছি আমরা
০২. গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে
০৩. কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন
০৪. বিকেল নাগাদ নদীর জল কমে গিয়ে
০৫. চেঁচিয়ে বললেন স্পিলেট
০৬. বেলুন থেকে নামার পর
০৭. সকাল থেকে কোথাও পাওয়া গেল না নেবকে
০৮. ওরা ঢুকলেও ফিরে চাইল না নেব
০৯. হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেনক্র্যাফট
১০. ধোঁয়া, মানে আগুন
১১. ভোর হলো
১২. পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই
১৩. পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর
১৪. মাপজোকের কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন
১৫. গহ্বরের মুখ
১৬. জুনের শুরুতেই শীত নামল
১৭. যেন ভূত দেখছে এমন ভাবে
১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা
১৯. দ্বীপের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে চলা শুরু হলো
২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে
২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি
২২. আবার এল শীত
২৩. এখনও কি বাধা দেবেন
২৪. মার্সি নদীর মুখে এসে
২৫. জঙ্গলে আর ফিরে গেল না আগন্তুক
২৬. ভোর হতেই খোঁয়াড়ের দিকে রওনা দিল
২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা
২৮. চোখের সামনে ভোজবাজীর মত
২৯. আস্তে আস্তে সেরে উঠতে লাগল হার্বার্ট
পরের পর্ব :
৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ
৩২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন নিমো
৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত