রহস্যের দ্বীপ: ২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা

রহস্যের দ্বীপ: ২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা

২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা

এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা। ক্রমে এগিয়ে আসছে। কোন দেশী জাহাজ, কাদের জাহাজ ওটা? হার্বার্ট বলল, ডানকান নয় তো?

অসম্ভব নয়, জবাব দিলেন স্পিলেট, আয়ারটনকে ডেকে আনা দরকার।

টেলিগ্রাফে খবর পেয়ে বিকেলের দিকে এল আয়ারটন। ওটা ডানকান কিনা। জিজ্ঞেস করতেই আঁতকে উঠল সে, অসম্ভব। অত তাড়াতাড়ি আসতে পারে না ডানকান। বলেই টেলিস্কোপটা নিয়ে চোখে লাগাল। একটু দেখেই মন্তব্য করল, না, ডানকান না ডানকানের এঞ্জিন আছে, এটার নেই।

আয়ারটনের হাত থেকে টেলিস্কোপটা নিয়ে জাহাজটার গতিবিধি দেখতে লাগল পেনক্র্যাফট। হঠাৎ জাহাজের মুখটা একটু অন্যদিকে বেঁকে গেল। দ্বীপ পেরিয়ে চলে যাবে নাকি জাহাজটা? পেনক্র্যাফট কথাটা বলতেই অস্থির হয়ে উঠলেন স্পিলেট। আগুন জ্বালিয়ে সঙ্কেত দেয়া দরকার। কিন্তু রাজি হলেন না ক্যাপ্টেন। হঠাৎ এই জাহাজের আবির্ভাবটাকে কেন যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি।

হঠাৎ আবার দ্বীপের দিকে মুখ ফেরাল জাহাজটা।

জাহাজটা বেশ মজবুতই মনে হচ্ছে, টেলিস্কোপ দিয়ে দেখতে দেখতে বলল পেনক্র্যাফট। ফ্লাগটা আমেরিকানও না, ব্রিটিশও না। ফরাসী, জার্মান, রাশিয়া এমন কি স্পেনেরও না। তাহলে কোন… হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে, সর্বনাশ! কালো ফ্ল্যাগ!

চমকে উঠল অভিযাত্রীরা। কালো ফ্ল্যাগের মানে জানা আছে ওদের। জলদস্যুদের পতাকার রঙ কালো—মানে জলদস্যুদের জাহাজ ওটা। সাবধান হয়ে গেল সবাই। লিঙ্কন দ্বীপে মানুষ আছে এটা জলদস্যুদের বুঝতে দেয়া চলবে না। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে, আয়ারটন আর নেব গিয়ে উইন্ডমিলের পাখাগুলো খুলতে লেগে গেল। দূর থেকে ওগুলোই আগে চোখে পড়ে। গ্রানাইট হাউসের দরজা জানালা লতাপাতা দিয়ে ভাল করে ঢেকে দিতে লাগল হার্বার্ট আর পেনক্র্যাফট।

নৌকোটা, মানে, বন-অ্যাডভেঞ্চারের কি হবে? জিজ্ঞেস করল হার্বার্ট।

কিছু হবে না। জবাব দিল পেনক্র্যাফট, বন্দরটা খুঁজেই পাবে না ওরা।

ক্যাপ্টেনের কথামত অল্প সময়েই সব কাজ শেষ করে ফেলল ওরা। দ্বীপে মানুষ আছে এটা বাইরে থেকে জলদস্যুরা সহজে বুঝতে পারবে না।

সবাইকে ডেকে জরুরী মীটিংয়ে বসলেন ক্যাপ্টেন। যদি লিঙ্কন দ্বীপ দখল করতে চায় ওরা, কি করবে? জানতে চাইলেন তিনি।

যুদ্ধ করব, একসাথেই জবাব দিল সবাই। প্রাণ থাকতে জলদস্যুদের হাতে দ্বীপ ছেড়ে দেব না।

ঠিক, যুদ্ধই করব আমরা। ক্যাপ্টেনও সবার সাথে একমত হলেন। রাত নামতে অন্ধকারে দেখা গেল না জাহাজটাকে। সবাই আশা করছে হয়তো শেষ পর্যন্ত লিঙ্কন দ্বীপে নোঙর ফেলবে না পাইরেট শিপ! ঠিক সেই সময় সবাইকে চমকে দিয়ে সাগরের দিক থেকে ঝলকে উঠল উজ্জ্বল আলো। এর প্রায় ছয় সেকেন্ড পরে ভেসে এল কামান দাগার বিকট আওয়াজ। কামান দেগে যেন হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে জলদস্যুরা—যদি কেউ থেকে থাকো দ্বীপে, লাগতে এসো না আমাদের সাথে। আলো আর শব্দের ব্যবধান ছয় সেকেন্ড, মানে তীর থেকে সোয়া এক মাইল দূরে আছে জাহাজটা। আরও কিছুক্ষণ পর লোহার শেকলের ঝনঝনানি শোনা যেতেই বুঝল অভিযাত্রীরা, গ্রানাইট হাউসের কাছেই সাগরতীরে নোঙর ফেলছে পাইরেট শিপ।

যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে শুরু করলেন ক্যাপ্টেন। গ্রানাইট হাউসটা সুরক্ষিত, কিন্তু পোলট্রি, শস্যক্ষেত্র, খোয়াড়ের কি ব্যবস্থা করা যায়? তাছাড়া জলদস্যুরা সংখ্যায় কত তা না জেনে যুদ্ধে নামাটাও উচিত হবে না। বড় কথা হলো কামানের বিরুদ্ধে অভিযাত্রীদের নটা বন্দুক কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে?

একটা কথা বলব, ক্যাপ্টেন? হঠাৎ ক্যাপ্টেনের সামনে এসে বলল আয়ারটন।

কি কথা?

জাহাজে কজন লোক আছে, একবার গিয়ে দেখে আসতে চাই।

বাধা দিয়ে আয়ারটনকে নিরস্ত করা যাবে না বুঝে অনুমতি দিলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু আয়ারটন একা যাবে না, ওর সাথে পেনক্র্যাফট ও যাবে। যেতেই যখন হবে দেরি করে লাভ নেই। কাজেই রওনা হয়ে গেল দুজনে। সাগর পাড়ে পৌঁছে গায়ের সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলে গায়ে ভাল করে চর্বি মেখে নিল আয়ারটন। এতে শীতটা কম লাগবে। এই ফাঁকে মার্সি নদীর তীর থেকে ছোট নৌকোটা নিয়ে এল পেনক্র্যাফট।

আয়ারটন উঠে বসতেই নৌকো ছেড়ে দিল পেনক্র্যাফট। দ্বীপের অন্যপ্রান্তে পৌঁছেই নৌকো থেকে পানিতে নেমে পড়ল আয়ারটন। কাছেই একটা পাহাড়ের ফাটলে আত্মগোপন করল পেনক্র্যাফট।

মিটমিটে একটা আলো জ্বলছে পাইরেট শিপের মাথায়। সেদিকেই নিঃশব্দে সাঁতরে চলল আয়ারটন। আধঘন্টার মধ্যেই জাহাজের কাছে পৌঁছে নোঙরের শিকল ধরে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল। তারপর শিকল বেয়ে উঠে গেল ডেকে ডেকের একধারে। রশিতে ঝুলানো কিছু শার্ট-প্যান্ট শুকোতে দিয়েছে খালাসীরা, অন্যধারে আড্ডা মারছে কয়েকজন জলদস্যু। কান পেতে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগল আয়ারটন। একটু পরই ওদের কথাবার্তা থেকে আবিষ্কার করল, জাহাজটার নাম স্পীডি। ক্যাপ্টেনের নামটা কানে যেতেই দারুণভাবে চমকে উঠল আয়ারটন। ভাল করেই চেনে সে ক্যাপ্টেন বব হার্ডিকে। আয়ারটনেরই সহকারী ছিল বব হার্ডি। তাহলে আয়ারটন দস্যুদল ছেড়ে চলে আসার পর বব হার্ডিই ওদের সর্দার হয়েছে।

মাতালগুলোর আলোচনা থেকে আরও অনেক কথাই পরিষ্কার হলো আয়ারটনের কাছে। অস্ট্রেলিয়ার নরফোক আইল্যান্ডের কাছে এই জাহাজটা দখল করেছে বব হার্ডি। অস্ত্রশস্ত্রের অভাব না থাকায় প্রশান্ত মহাসাগরে সাঙ্ঘাতিক রকম লুটতরাজ করছে হার্ডি। হঠাৎ করেই প্রথমবারের মত লিঙ্কন আইল্যান্ডে হার্ডির আগমন। পছন্দ হলে এখানেই একটা গোপন ঘাঁটি বানিয়ে নেবার ইচ্ছে।

মনস্থির করে ফেলল আয়ারটন। যেভাবেই হোক হার্ডির পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে হবে। জনা পঞ্চাশেক দস্যু আছে স্পীডিতে, এটা ওদের কথা থেকেই জানতে পেরেছে আয়ারটন। এত লোকের বিরুদ্ধে ওরা মাত্র ছজন! এতগুলো দস্যু, তার ওপর কামানের বিরুদ্ধে কি করতে পারবে অভিযাত্রীরা? সাঙ্ঘাতিক পরিকল্পনাটা ওর মাথায় ঢুকল ঠিক এই সময়। না, এতে আর দ্বিধা করবে না সে, তাতে মরতেও যদি হয় কুছ পরোয়া নেই।

উড়িয়ে দিতে হবে জাহাজটা, কোনমতে বারুদ ঘরে আগুন ধরিয়ে দিতে পারলেই হলো। বাঁচবে না আয়ারটনও, কিন্তু এতবড় পাপী হিসেবে বেঁচে থেকেই বা কি লাভ! এতে অন্তত পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হবে।

সাধারণত বারুদঘর থাকে জাহাজের পেছন দিকে। মাতাল জলদস্যুরা ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল আয়ারটন। তারপর পা টিপে টিপে এগোল। নানা ধরনের বন্দুক আর পিস্তল স্তুপ করে রাখা মাস্তুলের গোঁড়ায়। দেখেশুনে একটা পিস্তল হাতে তুলে নিল সে। বারুদঘরটা উড়াতে পিস্তলের একটা গুলিই যথেষ্ট। কিন্তু ঘরটার সামনে গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হলো ওকে। বিশাল এক তালা ঝুলছে ঘরের দরজায়! পিস্তলটা আস্তে করে নিচে নামিয়ে রাখল আয়ারটন। দুহাতে মুঠো করে ধরল তালাটা। গায়ের জোরে মোচড় দিতে লাগল তালায়। দর দর করে পিঠ বেয়ে নামছে ঘামের ধারা। কিন্তু ভাঙছে না দরজার তালা লাগানোর আংটা। দাঁতে দাঁত চেপে আবার তালায় মোচড় দিল সে। কট করে শব্দ করে ভেঙে গেল আংটা। চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেলে পিস্তলটা তুলে নিতে যাবে এমন সময় কাঁধ খামচে ধরল কেউ। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল আয়ারটন। আবছা অন্ধকারেও পরিষ্কার চিনল সামনে দাড়ানো লোকটাকে। বব হার্ডি।

কিন্তু আয়ারটনকে চিনল না। হার্ডি। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, কে তুই? কি করছিস এখানে? বলেই আয়ারটনের চুল মুঠো করে ধরল সে।

উত্তরে ঝাঁকুনি দিয়ে চুলগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে প্রচন্ড জোরে হার্ডির নাকে ঘুলি মারল আয়ারটন। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল হার্ডি, ডাকাত, ডাকাত পড়েছে জাহাজে! নিজেই যে ডাকাত সে কথা বেমালুম ভুলে গেছে সে।

ধুপ ধাপ পায়ের আওয়াজ তুলে ছুটে এল জলদস্যুরা। পিস্তল তুলে গুলি করল আয়ারটন। ডেকের ওপর গড়িয়ে পড়ল দুজন ডাকাত। আবার গুলি করতে যেতেই একটা ছুরি এসে বিঁধল আয়ারটনের ডান কাঁধে। ব্যথায় কুঁচকে গেল ওর চোখ মুখ পিস্তলটা পড়ে গেল হাত থেকে। ওদিকে জেগে উঠেছে পুরো জাহাজ। কিন্তু মাথা গরম করল না আয়ারটন।

উবু হয়ে বাঁ হাতেই তুলে নিল সে পড়ে যাওয়া পিস্তলটা। পরমুহুর্তেই হাত তুলে গুলি করল একমাত্র লণ্ঠনটা লক্ষ্য করে। গুলি লেগে ছাতু হয়ে গেল লণ্ঠনটা! বিন্দুমাত্র দেরি না করে সিঁড়ির দিকে ছুটল আয়ারটন। পেছন পেছন আসছে তিনজন ডাকাত। আবার গুলি করল আয়ারটন। পড়ে গেল তিনজনের একজন। বাকি দুজন ভয় পেয়ে যেদিক থেকে আসছিল সেদিকেই ছুটে পালাল। সিঁড়ি বেয়ে একছুটে ডেকে উঠে এল আয়ারটন। অনেকগুলো দস্যু ডেকে দাঁড়িয়ে হট্টগোল করছে। ওদের বুঝে উঠার আগেই রেলিংয়ের দিকে ছুটে গেল সে। এক লাফে রেলিং টপকে এসে পড়ল সাগরের পানিতে। ডুব সাঁতার দিয়ে এগিয়ে চলল পানির তলা দিয়ে। বেশ কিছুদূর গিয়ে পানির ওপর মাথা তুলতেই শুনল পাইকারী গোলাগুলির আওয়াজ। ওর আশে পাশেও এসে পড়ল কয়েকটা বুলেট। আবার ডুব দিল সে। এভাবেই ডুব দিয়ে দিয়ে পৌঁছে গেল নৌকোর কাছে। পেনক্র্যাফট তখন উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে।

রাত দুপুরে গ্রানাইট হাউসে পৌঁছল দুই দুঃসাহসী অভিযাত্রী।

সব শুনে হার্বার্ট বলল, সেরেছে! এবার নির্ঘাত মারা পড়ব। পঞ্চাশজনের বিরুদ্ধে আমরা মাত্র ছজন!

সাতচল্লিশ জনের বিরুদ্ধে। ভুল সংশোধন করে দিল আয়ারটন, তিনজনকে খতম করে এসেছি আমি।

প্রচন্ড উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে কাটল রাতটা। ভোর হতে কুয়াশার ভেতর দিয়ে আবছা দেখা গেল স্পীডিকে। কুয়াশা না কাটা পর্যন্ত আক্রমণ করবে না জলদস্যুরা। এর আগেই যা করার করতে হবে। গায়ের জোরে ওদের সাথে পারা যাবে না। কাজেই কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। জলদস্যুদের বিশ্বাস করাতে হবে, সংখ্যায় ওদের চেয়ে দ্বীপবাসীরা অনেক বেশি।

চার দলে ভাগ হয়ে গেল ছজনে। হার্বার্ট আর হার্ডিং চিমনিতে, মার্সি নদীর মুখে থাকল নেব আর স্পিলেট। উপদ্বীপের দুজায়গায় লুকিয়ে রইল পেনক্র্যাফট আর আয়ারটন। প্রত্যেকের হাতেই বন্দুক।

ছটার পর ফিকে হতে শুরু করল কুয়াশা। টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেন ক্যাপ্টেন, স্পীডির চারটে কামানের মুখ দ্বীপের দিকে ফেরানো। ডেকের ওপর ছুটাছুটি করছে পঁচিশ তিরিশ জন দস্যু। চোখে টেলিস্কোপ লাগিয়ে লিঙ্কন দ্বীপকে পর্যবেক্ষণ করছে আরও দুজন। আরও কিছু পরে একটা নৌকো নামানো হলো জাহাজ থেকে। নৌকোটা সাগরে নামতেই বন্দুক হাতে সাতজন দস্যু তাতে উঠে বসল। চারজন পাটাতনের ওপর বন্দুক রেখে দাঁড় বাইতে লাগল। সীসা বাঁধা দড়ি দিয়ে পানির গভীরতা মাপছে একজন। বাকি দুজন বন্দুক হাতে যে কোন আক্রমণের জন্যে তৈরি হয়ে বসে থাকল। উপদ্বীপের দিকেই এগোচ্ছে নৌকোটা।

নৌকোটা তীরে পৌঁছতেই উঠে দাঁড়াল একজন বন্দুকধারী। তীরে নামতে যাবে এমন সময় গুলি করল পেনক্র্যাফট আর আয়ারটন। দাঁড়ানো আর পানি মাপা, দুজন দস্যুই একসাথে লুটিয়ে পড়ল নৌকোর পাটাতনে।

পরমুহুর্তে কামান দাগার আওয়াজ হলো। আয়ারটন আর পেনক্র্যাফটের মাথার ওপরের পাহাড়-চূড়া উড়ে গেল গোলার আঘাতে। বন্দুকের ধোঁয়া লক্ষ্য করে কামান দাগছে বব হার্ডি।

নৌকোর মুখ জাহাজের দিকে ঘুরিয়ে দ্রুত দাঁড় বেয়ে চলল বাকি পাঁচজন জলদস্যু! আবার গুলি করল পেনক্র্যাফট-আয়ারটন। আরও দুজন দস্যু মারা গেল। কার্তুজের খোসা দুটো ফেলে বন্দুকে গুলি ভরতে লাগল পেনক্র্যাফট আর আয়ারটন। ততক্ষণে বন্দুকের আওতার বাইরে চলে গেছে বাকি তিনজন জলদস্যু। আবার গর্জে উঠল কামান। আরও কিছু পাথর ভেঙে গড়িয়ে পড়ল পেনক্র্যাফট আর আয়ারটনের আশেপাশে।

স্পীডির গায়ে নৌকোটা ঠেকতেই আরও ডজনখানেক দ্স্যু লাফিয়ে নামল ওতে। আটজন দস্যু নিয়ে আরও একটা নৌকো ভাসানো হলো পানিতে। একটা নৌকো উপদ্বীপের দিকে অন্যটা মার্সি নদীর মুখ লক্ষ্য করে এগিয়ে এল। এবার জায়গা ত্যাগ করতে হবে পেনক্র্যাফট-আয়ারটনের, নাহলে বিপদে পড়বে। কিন্তু আরও অন্তত দুটোকে ঘায়েল না করে জায়গা ছেড়ে নড়ার ইচ্ছে নেই ওদের।

বন্দুকের আওতায় আসতেই আরও দুটো দস্যুকে গুলি করে মারল পেনক্র্যাফট-আয়ারটন। তারপর একলাফে আড়াল থেকে বেরিয়ে এঁকে বেঁকে দৌড় দিল খালের দিকে। বুলেট বৃষ্টি শুরু হলো ওদের আশে পাশে। কিন্তু লাগল না ওদের গায়ে। নিরাপদেই খাল পেরিয়ে চিমনিতে ঢুকে গেল ওরা।

মার্সি নদীর মুখের দিকে আসা আটজনের নৌকোটা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলেন এবার স্পিলেট আর নেব। হালধারী আর একজন মাল্লা মারা গেল। সাঁই করে ঘুরে গেল অনিয়ন্ত্রিত নৌকোর মুখ। কিন্তু এতেও রেহাই পেল না, একটা চোরা পাথরে ধাক্কা লেগে উল্টে গেল নৌকো। কোনমতে আছড়ে পাছড়ে তীরে উঠল বাকি ছজন। উঠেই ছুট লাগাল ফ্লোটসাম পয়েন্টের দিকে। এক ছুটে একেবারে বন্দুকের নাগালের বাইরে।

নৌকো নিয়ে আর আসবে না ওরা, ব্যাপার দেখে বললেন ক্যাপ্টেন। জাহাজ নিয়েই খাড়ির ভেতরে ঢুকবে। আসল বিপদ দেখা দেবে তখন।

ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হওয়া মাত্র চেঁচিয়ে উঠল পেনক্র্যাফট, ঠিকই বলেছেন, ক্যাপ্টেন। ওই যে নোঙর তুলছে হারামজাদারা। গ্রানাইট হাউসে চলে যাওয়া উচিত আমাদের।

পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল নেব আর স্পিলেট। জাহাজ থেকে দেখা যাবে না ওদের। ওরা দুজনও গিয়ে চিমনিতে ঢোকার পর উঠে দাঁড়াল আর সবাই। পাহাড়ের আড়ালে আড়ালে পৌঁছে গেল গ্রানাইট হাউসে।

জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ টের পেল অভিযাত্রীরা, কত বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। খাড়িতে ঢুকেই সোজা চিমনির ওপর কামান দাগতে শুরু করল জলদস্যুরা। গোলার আঘাতে গুড়িয়ে যাচ্ছে চিমনিটা। হঠাৎ চিমনিতে গোলাবর্ষণ বন্ধ করে দিল ওরা। বোধহয় বুঝতে পেরেছে ওরা কেউ নেই ওখানে। টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে গ্রানাইট হাউসের দিকেই তাকিয়ে আছে একজন।

হঠাৎ আবার গর্জে উঠল কামান। গ্রানাইট হাউসের জানালার কাছে এসে পড়ল গোলাটা।

সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল পেনক্র্যাফট, আমরা কোথায় আছি টের পেয়ে গেছে। হারামজাদারা।

আসলেও তাই। লতাপাতা দিয়ে গ্রানাইট হাউসের দরজা জানালা ঢেকে দেয়া হয়েছিল। ক্যাপ্টেন ভেবেছিলেন জানালা দরজা দেখা না গেলে কিছু বুঝতে পারবে না ডাকাতেরা। কিন্তু সন্দেহ করে বসল ধুরন্ধর বব হার্ডি। পাথরের গায়ে সবুজ লতাপাতা জন্মাতে পারে না। কাজেই দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে সে।

পরিষ্কার বুঝল দ্বীপবাসীরা, আর রক্ষা নেই। লিঙ্কন দ্বীপে এসে জলদস্যুর গোলা খেয়েই ওদের পরমায়ু শেষ হতে চলেছে। একেবারে নিরাশ হয়ে পড়েছে সবাই।

হঠাৎ প্রচন্ড কান ফাটানো আওয়াজে কেঁপে উঠল আকাশ-পাহাড়-বনভূমি। এ তো কামানের শব্দ নয়। প্রায় সাথে সাথেই শোনা গেল বহুকণ্ঠের মিলিত আর্তচিৎকার। ব্যাপার কি? দৌড়ে জানালার কাছে এল অভিযাত্রীরা। কিন্তু যা দেখল, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারল না যেন। চৌচির হয়ে ভেঙে এদিকওদিক ছিটকে পড়েছে বিশাল জাহাজটার তলা আর এক পাশের কাঠ কাত হয়ে গিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে জাহাজটা। মাত্র দশ সেকেন্ডের ভেতরই জলদস্যুদের নিয়ে পানির তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল স্পীডি।

আগের পর্ব :
০১. ওপরে কি উঠছি আমরা
০২. গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে
০৩. কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন
০৪. বিকেল নাগাদ নদীর জল কমে গিয়ে
০৫. চেঁচিয়ে বললেন স্পিলেট
০৬. বেলুন থেকে নামার পর
০৭. সকাল থেকে কোথাও পাওয়া গেল না নেবকে
০৮. ওরা ঢুকলেও ফিরে চাইল না নেব
০৯. হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেনক্র্যাফট
১০. ধোঁয়া, মানে আগুন
১১. ভোর হলো
১২. পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই
১৩. পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর
১৪. মাপজোকের কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন
১৫. গহ্বরের মুখ
১৬. জুনের শুরুতেই শীত নামল
১৭. যেন ভূত দেখছে এমন ভাবে
১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা
১৯. দ্বীপের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে চলা শুরু হলো
২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে
২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি
২২. আবার এল শীত
২৩. এখনও কি বাধা দেবেন
২৪. মার্সি নদীর মুখে এসে
২৫. জঙ্গলে আর ফিরে গেল না আগন্তুক
২৬. ভোর হতেই খোঁয়াড়ের দিকে রওনা দিল
পরের পর্ব :
২৮. চোখের সামনে ভোজবাজীর মত
২৯. আস্তে আস্তে সেরে উঠতে লাগল হার্বার্ট
৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়
৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ
৩২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন নিমো
৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত