রহস্যের দ্বীপ: ২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি

রহস্যের দ্বীপ: ২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি

২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি

মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি। বাইরে দুর্যোগ হলেও ঘরের ভেতর বসে নেই কেউ। এই সময়ই সবাই ধরে বসল ক্যাপ্টেনকে—একটা লিফটের বড় দরকার। সিঁড়ি বেয়ে ভারি জিনিস গ্রানাইট হাউসে তোলা বড় কষ্টকর।

তা বানিয়ে নেয়া যাবে। কখন থেকে শুরু করতে চাও? জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।

এখন থেকেই। কিন্তু লিফট চলবে কিসের শক্তিতে? প্রশ্ন করল পেনক্র্যাফট।

পানির শক্তিতে।

একটা চোঙার একপ্রান্তে কয়েকটা প্রপেলার লাগালেন ক্যাপ্টেন, অন্যদিকে একটা চাকা। একটা লম্বা দড়ির একপ্রান্ত বেঁধে দেয়া হলো চাকায়। গ্রানাইট হাউসের ভেতরের ছোট্ট ঝর্নাটার ওপর বসানো হলো চোঙাটা, চোঙার প্রপেলার বসানো অংশটা রইল পানিতে। হ্রদ থেকে খাবার পানি ভেতরে আনার জন্যেই ঝর্নাটা কেটেছিলেন ক্যাপ্টেন। এখন সেটাকে আরও একটু বাড়িয়ে নিতেই চোঙার প্রপেলারের ওপর জলপ্রপাতের মত প্রচন্ড বেগে ঝাপিয়ে পড়ল পানি। সুন্দর অথচ সহজ পদ্ধতি। হ্রদ থেকে ছুটে আসছে পানি, সাগরে বেরিয়ে যাচ্ছে কুয়োটা দিয়ে। আর ওই পানির ঝাপটায় বন বন করে ঘুরতে শুরু করেছে প্রপেলার লাগানো চোঙা—সেই সাথে চোঙার অন্য মাথার চাকা। ঘূর্ণায়মান চাকার গায়ে জড়াতে শুরু করল দড়ি। চোঙাটা উঠানো নামানোর ব্যবস্থাও করলেন ক্যাপ্টেন—ওপরের দিকে উঠালেই পানির স্রোত থেকে বেরিয়ে আসে প্রপেলার, কাজেই থেমে যায় ঘূর্ণন তখন চাকায় আটকানো দড়ির অন্য মাথায় একটা কাঠের বাক্স লটকে দিতেই তৈরি হয়ে গেল লিফট। গ্রানাইট হাউসের দরজার পাশে কপিকল লাগিয়ে তাতে বসিয়ে দেয়া হলো লিফটের দড়ি।

সতেরোই মার্চ চালু হলো ওয়াটার লিফট। ভারি বোঝা তো ওপরে তুলছেই, নিজেরাও এর পর থেকে লিফটে করে ওঠানামা শুরু করে দিল ওরা। সবচেয়ে মজা পেল টপ। দিনের মধ্যে অন্তত একশোবার ওঠে আর নামে।

এরপর কাঁচের জিনিস তৈরিতে হাত দেন ক্যাপ্টেন। কাচ তৈরির সমস্ত উপকরণই পাওয়া গেল দ্বীপে। বালি, খড়িমাটি, সোডা আর অন্যান্য মালমশলা একসাথে মিশিয়ে তন্দুরে জ্বাল দিয়ে তরল করা হলো। লোহার একটা নল বানিয়ে নিয়ে সেই নলের ভেতর ফু দিয়ে তৈরি হয়ে গেল গেলাস, প্লেট, কাপ। আরও তৈরি হলো জানালার শার্সি। যদিও খুব মসৃণ হলো না জিনিসগুলো, কাজ চলে যাওয়ার মত হলো।

জঙ্গলের মধ্যে সাইকাস গাছ খুঁজে পেল হার্বার্ট এর বোঁটায় ময়দার মত দেখতে একরকম গুড়ো পাওয়া যায়। ওগুলো দিয়ে চমৎকার কেক আর পুডিং তৈরি করে ফেলল নেব।

সেদিন পয়লা এপ্রিল। বারান্দায় বসে গল্প করছে সবাই। হঠাৎ ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলেন স্পিলেট, আচ্ছা, ক্যাপ্টেন, আমাদের দ্বীপটা প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক কোন জায়গায় আছে, সেক্সট্যান্ট দিয়ে বের করা যায় না?

কি দরকার তা জেনে? ক্যাপ্টেনের আগেই প্রশ্ন করে বসল পেনক্র্যাফট, বেশ আরামেই তো আছি আমরা এখানে।

তবুও, লিঙ্কন দ্বীপের কাছে পিঠে অন্য কোন দ্বীপ আছে কিনা জানা উচিত?

ঠিকই বলেছেন। জেনে নিচ্ছি এখুনি, বললেন ক্যাপ্টেন।

সিন্দুক থেকে ম্যাপ বের করে আনল হার্বার্ট। অন্যান্য জিনিসের সাথে ওটাও ছিল সিন্দুকের ভেতর। ম্যাপের প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর মন দিলেন ক্যাপ্টেন। সেক্সট্যান্টের সাহায্যে অংক করে বের করে ফেললেন মহাসাগরের ঠিক কোন বিন্দুতে আছে লিঙ্কন দ্বীপ। কিন্তু ঠিক ওই বিন্দুতে কোন দ্বীপের চিহ্ন নেই ম্যাপে। তবে লিঙ্কন দ্বীপ ম্যাপের যেখানে থাকার কথা তার থেকে দেড়শো মাইল উত্তর-পুবে ট্যাবর নামে একটা দ্বীপ আছে। কথাটা সবাইকে বললেন ক্যাপ্টেন।

ওই ট্যাবর দ্বীপেই যাব। ডেকওয়ালা একটা বড় নৌকো বানিয়ে নেবখন। ঠিকমত হাওয়া পেলে দুদিনেই পৌঁছে যাব ট্যাবর দ্বীপে, বলল পেনক্র্যাফট।

রাজি হলো সবাই। আবহাওয়া ভাল থাকে অক্টোবরে। তার আগেই নৌকো তৈরির কাজ শেষ করতে হবে।

হাতে মাত্র দুমাস আছে আর। এর মধ্যেই বানাতে হবে নৌকো। কাজে লেগে গেল পেনক্র্যাফট। উদয়াস্ত কঠোর পরিশ্রম শুরু করল সে। সকালে কাজে বেরোবার সময়ই সারাদিনের খাওয়া সাথে নিয়ে যায় সে।

চিমনি আর প্রসপেক্ট হাইটের মাঝখানে তৈরি হলো ডকইয়ার্ড। ভাল গাছ কেটে তক্তা করে সারি দিয়ে রাখা হলো পাহাড়ের গায়ে। পয়ত্রিশ ফুট লম্বা করতে হবে নৌকোটা। পেনক্র্যাফটকে সাহায্য করতে লাগলেন ক্যাপ্টেন! শিকার নিয়ে মত্ত রইল স্পিলেট-হার্বার্ট। আর ওই শিকারকে ভালমত রেঁধে পরিবেশন করা হলো নেবের কাজ।

শিকার করতে গিয়েই সেদিন মস্ত আবিষ্কারটা করে বসল হার্বার্ট আর স্পিলেট। গাছটার সোজা ডালে বড় বড় থ্যাবড়া পাতা। থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙ্গুরের মত ফল। সাথে সাথেই চেঁচিয়ে উঠল হার্বার্ট, কাজের কাজ হয়েছে একটা! পেনক্র্যাফট জানতে পারলে খুশিতে হার্টফেলই না করে বসে।

কি গাছ? তামাক নাকি?

ওই জাতীয়ই।

তাহলে কপাল খুলল পেন্যাফটের!

পেনক্র্যাফটকে কথাটা এখন জানাব না আমরা কি বলেন? এক্কেবারে তামাক বানিয়ে পাইপে পুরে তুলে দেব ওর হাতে।

ঠিক। তাই করব আমরা।

প্রচুর তামাক পাতা নিয়ে গ্রানাইট হাউসে ফিরল দুজনে। ক্যাপ্টেন আর নেবকে জানানো হলো খবরটা। পেনক্র্যাফটকে লুকিয়ে তামাক পাতা শুকিয়ে, কেটে তামাক বানাতে প্রায় দুমাস লেগে গেল। এরই মাঝে একদিন লিঙ্কন দ্বীপের চারপাশের সাগরের পানিতে একটা তিমিকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল। তিমিটাকে দেখে হাত নিশপিশ করতে লাগল পেন্যাফটের। পারলে হারপুন ছুঁড়ে তখনই মেরে ফেলে সে তিমিটাকে। কিন্তু তিমি শিকারের উপযুক্ত হারপুন আর নৌকো না থাকায় কাজটা করতে পারছে না সে। হঠাৎ একদিন ফ্লোটসাম পয়েন্টের কাছে কেন যেন আটকে গেল তিমিটা। ব্যাপারটা প্রথম দেখল নেব। আর সবাইকে খবরটা জানাতেই উর্ধ্বশ্বাসে ছুটল ওরা সাগরতীরে।

হাজার হাজার মাংসাশী পাখি উড়ছে ফ্লোটলাম পয়েন্টের আকাশে! মড়ার গন্ধ পেয়েছে ওরা। মারা গেছে তিমিটা। বাঁ পাশের পাজরে গেঁথে আছে একটা হারপুন।

দ্বীপের কাছে পিঠেই তাহলে তিমি শিকারী আছে। বললেন স্পিলেট।

তা নাও হতে পারে, মিস্টার স্পিলেট। হারপুন নিয়েও অনেক সময় হাজার হাজার মাইল ছুটে চলে যায় তিমি। এটাও যে তা করেনি কি করে বুঝব? তিমিটার দিকে তাকিয়ে বলল পেনক্র্যাফট।

একসময় তিমি শিকারী জাহাজে চাকরি করেছে পেনক্র্যাফট। এ ব্যাপারে তার জ্ঞান তাই আর সবার চাইতে বেশি। তিমিটার কাছে গিয়ে হারপুনটা পরীক্ষা করল সে। মেরিয়া স্টেলা, ভিনিয়ার্ড কথাটা পরিষ্কার লেখা আছে হারপুনের হাতলে। সাথে সাথেই একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল পেনক্র্যাফট। ভিনিয়ার্ড তার জন্মস্থান। মেরিলা স্টেলা জাহাজটাও চেনা।

পচন ধরার আগেই তিমির গায়ের সবচেয়ে দরকারী অংশ চর্বির স্তর কেটে আনল পেনক্র্যাফট। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে বলে রেখে দিল দরকারী কিছু হাড়। তিমির বিশাল দেহের বাকি অংশটা পড়ে রইল ওখানেই। অল্পক্ষণেই ওটা খেয়ে শেষ করবে শিকারী পাখির দল।

আড়াই ফুট পুরু চর্বির স্তর বড় বড় টুকরোয় কেটে জ্বাল দেয়া হলো মাটির পাত্রে। শুধু জিভ আর নিচের ঠোঁট থেকেই বেরোল হাজার পাউন্ড তেল! স্টিয়ারিন আর গ্লিসারিন তৈরি করতে কাজে লাগবে এই তেল। আলোও জ্বালানো যাবে।

তিমির কিছু হাড় সমান মাপে ছোট ছোট করে কেটে একটা দিক চোখা করে নিলেন ক্যাপ্টেন। তিমির হাড় এভাবে কেটে নিয়ে বাঁকা করে বরফের তলায় চাপা দিয়ে রাখে রাশিয়া-আমেরিকার অ্যালুইসিয়ান শিকারীরা! কয়েকদিন পর ওগুলো তুলে নিয়ে চর্বি মাখিয়ে টোপ হিসেবে ফেলে রাখে জঙ্গলের ধারে। ওগুলো দেখলেই গিলে ফেলে ক্ষুধার্ত জানোয়ার। পাকস্থলীর তাপে ছিটকে সিধে হয়ে যায় বাকা হাড়। অল্পক্ষণের মধ্যেই নাড়ীভুড়ি ছেদা হয়ে মারা যায় হতভাগ্য জানোয়ার। ওই পদ্ধতিটাই ব্যবহার করতে যাচ্ছেন ক্যাপ্টেন।

দেখতে দেখতে এসে গেল একত্রিশে মে। সেদিন রাতের খাওয়ার পর উঠতে যাচ্ছিল পেনক্র্যাফট। কাঁধে চাপ দিয়ে বসিয়ে দিলেন ওকে স্পিলেট।

আমার কাজ আছে, মিস্টার স্পিলেট, গল্প করার সময় নেই, বলল পেনক্র্যাফট।

আর এক কাফ কফি খাবে না?

না।

তামাক চলবে?

কি বললেন? বিমূঢ়ের মত সবার মুখের দিকে চাইতে লাগল পেনক্র্যাফট। মিটিমিটি হাসছে নেব। একটা তামাক ঠাসা পাইপ ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন স্পিলেট ।

ছোঁ মেরে পাইপটা নিয়ে নিল পেনক্র্যাফট। পরক্ষণেই মুখে পুরে টানতে শুরু করল। কিন্তু ধোঁয়া বেরোল না। আমাকে আগুন না দিয়েই টানতে শুরু করেছে। সে। হেসে উঠে ওর দিকে আগুন এগিয়ে দিল হার্বার্ট।

তামাকে আগুন দিয়ে মিনিট খানেক চুপচাপ পাইপ টানল নাবিক। আশ্চর্য এক তৃপ্তি ফুটে উঠল ওর চেহারায়। তারপর মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে বলল, চমৎকার তামাক! তুলনা হয় না। এতবড় আবিষ্কার কে করল শুনি?

মিস্টার স্পিলেট, উত্তর দিল হার্বার্ট।

তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পেনক্র্যাফট, একটানে চেয়ার থেকে তুলেই জড়িয়ে ধরল স্পিলেটকে।

আরে ছাড়ো, ছাড়ো, করছ কি? জোর করে পেনক্র্যাফটের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হলেন স্পিলেট, আমি শুধু গাছটাই দেখেছিলাম হার্বার্ট না চিনলে আর ক্যাপ্টেন তামাকটা তৈরি না করে দিলে তো কোন কাজেই আসত না ওই গাছের পাতা। ওদিকে কথাটা অ্যাদ্দিন তোমাকে জানাতে না পারায় পেট ফুলে তো প্রায় মারাই যাচ্ছিল নেব। কাজেই ধন্যবাদটা সবাইকে দাও।

আগের পর্ব :
০১. ওপরে কি উঠছি আমরা
০২. গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে
০৩. কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন
০৪. বিকেল নাগাদ নদীর জল কমে গিয়ে
০৫. চেঁচিয়ে বললেন স্পিলেট
০৬. বেলুন থেকে নামার পর
০৭. সকাল থেকে কোথাও পাওয়া গেল না নেবকে
০৮. ওরা ঢুকলেও ফিরে চাইল না নেব
০৯. হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেনক্র্যাফট
১০. ধোঁয়া, মানে আগুন
১১. ভোর হলো
১২. পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই
১৩. পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর
১৪. মাপজোকের কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন
১৫. গহ্বরের মুখ
১৬. জুনের শুরুতেই শীত নামল
১৭. যেন ভূত দেখছে এমন ভাবে
১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা
১৯. দ্বীপের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে চলা শুরু হলো
২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে
পরের পর্ব :
২২. আবার এল শীত
২৩. এখনও কি বাধা দেবেন
২৪. মার্সি নদীর মুখে এসে
২৫. জঙ্গলে আর ফিরে গেল না আগন্তুক
২৬. ভোর হতেই খোঁয়াড়ের দিকে রওনা দিল
২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা
২৮. চোখের সামনে ভোজবাজীর মত
২৯. আস্তে আস্তে সেরে উঠতে লাগল হার্বার্ট
৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়
৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ
৩২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন নিমো
৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত