রহস্যের দ্বীপ: ২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে

রহস্যের দ্বীপ: ২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে

২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে

একটু দূরে জঙ্গলের ধারে ওরাং ওটাং এর লাশগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলা হলো! সহজেই পোষ মানিয়ে ফেলা গেল জাপকে। কখনও বেয়াড়াপনা করে না, যা শেখানো হয় চুপচাপ শিখে নেবার চেষ্টা করে।

এবার কয়েকটা কঠিন কাজে হাত দিল অভিযাত্রীরা। একটা ব্রিজ তৈরি করে ফেলল মার্সি নদীর ওপর। ব্রিজের মাঝখানটা ইচ্ছে করলে খুলে রাখা যায়। এতে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে যাতায়াতের বেশ সুবিধে হয়ে গেল।

মার্সি নদী আর লেক গ্রান্টের মাঝামাঝি একটা পরিখাও খুঁড়ে ফেলল ওরা। নাইট্রোগ্লিসারিন দিয়ে গ্রানাইট পাথর উড়িয়ে দেবার পর সহজেই খোঁড়া গেল পরিখা। পরিখার নাম রাখা হলো ক্রীক গ্লিসারিন। এবার চারদিক থেকেই সুরক্ষিত হয়ে গেল গ্রানাইট হাউস। রেড ক্রীকের কাছাকাছি একটা খোঁয়াড়ও তৈরি করে ফেলল ওরা। মার্সি নদীর ওপারের পাহাড় থেকে মুশমন আর অন্যান্য লোমশ জন্তু ধরে এনে আটকে রাখতে হবে খোঁয়াড়ে। এদের লোম দিয়ে তৈরি হবে শীতকালের জন্যে গরম সোয়েটার।

গ্রানাইট হাউসের কাছেই তৈরি হলো পোলট্রি ফার্ম। কাঠ দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট খোপ তৈরি করা হলো পাখি পোষার জন্যে। পোলট্রির প্রথম বাসিন্দা হলো দুটো টিনামু পাখি। এরপর এল ছয়টা হাঁস। পেলিক্যান, মাছরাঙা, জল মোরগ আর বুনো পায়রাদেরকে ধরে আনতে হলো না। আপনা আপনি এসে বাসা বাঁধল কাঠের খোপে।

শাকসব্জি আর ফসলের চাষ হবে প্রসপেক্ট হাইটে। শক্ত কাঠের বেড়া দিয়ে দেয়া হলো খেতের চারদিকে। হাস্যকর চেহারার একটা কাকতাড়ুয়া পুতুল বানিয়ে খেতের মাঝখানে পুতে দিল পেনক্র্যাফট। এসব কাজে প্রচুর সাহায্য করেছে জাপ। ট্রেনিং শেষে ছেড়ে দেয়ার পর পালাবার চেষ্টা করেনি সে। ভারি ভারি জিনিস বয়ে আনা থেকে শুরু করে ওর পক্ষে যা যা করা সম্ভব সবই করছে সে।

পোর্ট বেলুন থেকে বিশাল বেলুনটাকে নিয়ে আসা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল একটা ঠেলা গাড়ি না হয় বানিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু এটা টানবে কিসে? গরু-ঘোড়া কিছুই তো নেই ওদের। হঠাৎ অলৌকিক ভাবেই যেন সমাধান হয়ে গেল সমস্যার সেদিন ২৩ ডিসেম্বর। হঠাৎ ভীষণ চেঁচামেচি জুড়ে দিল টপ। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অভিযাত্রীরা হতবাক। মার্সি নদীর পুল পার হয়ে ওপারের জঙ্গল থেকে এসে ওদের এলাকায় ঢুকে পড়েছে দুটো চতুস্পদ জানোয়ার। ওনাগা। এক জাতের ঘোড়া আর জেব্রার সংমিশ্রণ। ধোঁয়াটে শরীর, মাথায় কালো ডোরা, সাদা লেজ আর পা নিয়ে অপূর্ব সুন্দর প্রাণী দুটো।

ওগুলোকে দেখেই চিনল হার্বার্ট, ওনাগা! ওনাগা!

ওনাগা? গাধা বললেই হয়। বলল নেব।

গাধা বলবে কি করে? কান দুটো দেখছ না? গাধার মত লম্বা না ওগুলো, চেহারাটাও বিশ্রী না।

প্রাণী গবেষণার ধার দিয়েও গেল না পেনক্র্যাফট বলল, ওনাগা হোক আর গাধাই হোক কিছুই এসে যায় না। ওদেরকে দিয়েই গাড়ি টানাব। বলেই আর দাঁড়াল না সে। লম্বা ঘাসের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল ব্রিজের দিকে। কাছাকাছি পৌঁছেই এক লাফে উঠে দাঁড়াল। দৌড়ে গিয়ে মাঝের অংশটা খুলে ফেলল। চতুর্দিক পানিবেষ্টিত অঞ্চলে বন্দী হলো ওনাগা দুটো। ঘাসের অভাব নেই এখানে। এখন ওদেরকে বিরক্ত না করে আস্তে আস্তে পোষ মানিয়ে নেয়া যাবে।

পোলট্রির কাছেই তৈরি হলো আস্তাবল। গাড়িতে জোড়ার জন্যে লাগাম পর্যন্ত বানিয়ে ফেলল পেনক্র্যাফট। আস্তাবল থেকে পোর্ট বেলুন পর্যন্ত একটা রাস্তা তৈরির কাজ শেষ হবার পর ওনাগা দুটোর পেছনে লাগল ওরা। কিন্তু লাগাম পরতে চাইল না ওনাগারা। বহু কষ্টে শেষ পর্যন্ত পরানো হলো লাগাম।

নতুন রাস্তায় এবার গাড়ি চালানোর পালা। গাড়োয়ান হলো নাবিক পেনক্র্যাফট। গাড়িতে উঠে বসে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল অভিযাত্রীরা। এ রহস্যময় নির্জন দ্বীপে গাড়ি হাঁকাবে এ কি ভাবতেও পেরেছিল ওরা? লাগাম ধরে ওনাগার পিঠে চাবুক মারল পেনক্র্যাফট। ছুটে চলল গাড়ি। ঝোপঝাড় কেটে কোনমতে তৈরি করা এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথ। ঝাঁকুনির চোটে স্থির হয়ে বসতে পারছে না কেউ। শেষ পর্যন্ত বেলুন নিয়ে ওই গাড়িতে করেই নিরাপদে গ্রানাইট হাউসে ফিরে এল সবাই।

দেখতে দেখতে কেটে গেল নতুন বছরের জানুয়ারি। ফেব্রুয়ারিও প্রায় শেষ। ইতিমধ্যে বেলুনের কাপড় কেটে প্রত্যেকের জামা-কাপড় তৈরি হয়ে গেল। পিপে বাধা সিন্দুকেই পাওয়া গিয়েছিল সূচ আর সুতা। কাজেই শার্ট প্যান্ট বানিয়ে নিতে কোন অসুবিধে হলো না। আগেই শুকিয়ে রাখা সীলের চামড়া দিয়ে তৈরি হলো জুতো!

বন জঙ্গল থেকে শাকসব্জি এনে খেতের উর্বর মাটিতে লাগানো হলো। খরগোশের মাংস তো আছেই, তাছাড়াও বড়শি দিয়ে নদী থেকে প্রচুর মাছ ধরছে পেনক্র্যাফট। ম্যান্ডিবল অন্তরীপ থেকে আসে কচ্ছপ, পেটে করে নিয়ে আসে ডিম। কাঠ আর কয়লার কোন অভাবই নেই। কাজেই শাকসব্জি-মাছ-মাংস-ডিম দিয়ে রান্না খাবার খেয়ে খেয়ে আর দ্বীপের খোলা হাওয়ায় চেহারা খুলে গেল সবার। কিন্তু এতসব খাওয়া থাকা সত্ত্বেও একটা জিনিসের অভাব কিছুতেই ভুলতে পারছিল ওরা-রুটি।

এটা ওটা বিভিন্ন কাজ করার পর রান্নাঘরেই স্থায়ী চাকরি পেল মাস্টার জাপ। নেবের অ্যাসিস্ট্যান্ট সে। রান্নাঘরে নেবকে সাহায্য করা থেকে শুরু করে খাবার টেবিলে খাবার পরিবেশন করা, হাতের কাছে পানির গেলাসটা, জগটা এগিয়ে দেয়া, সবই নিপুণ ভাবে করে সে। পথে বেরিয়েও সবাইকে সাহায্য করে। গাড়ির চাকা মাটিতে বসে গেলে কাঁধ দিয়ে ঠেলে তুলে দেয়, গাছে উঠে ফল পেড়ে আনে। আর অভিযানে বেরোলে হাতে একটা লাঠি নিয়ে দারোয়ানের মত সবার আগে আগে পথ চলে। মনে হচ্ছে এই জীবনটা তার পছন্দ হয়েছে বেশ। অন্য সব কাজের ফাঁকে ফাঁকে খোঁয়াড়টাকে মজবুত করে ফেলল পেনক্র্যাফট। উঁচু কাঠের খুঁটি দিয়ে তৈরি হলো খোঁয়াড়ের মজবুত বেড়া। খুঁটির আগাগুলো চেঁছে বর্শার মত চোখা করে ফেলল সে। মোটা মোটা ডাল কেটে এনে ঠেকা দিয়ে দিল বেড়ার গায়ে। বড়সড় কোন জানোয়ারও এ বেড়া ভাঙতে পারবে না এখন।

ফেব্রুয়ারির শেষে শুরু হলো পশু ধরার কাজ। মুশমনের চারণ খেতে পৌঁছল ওরা এক সকালে। চারণ খেতের দুদিকে পাহারায় রইল পেনক্র্যাফট, হার্ডিং, নেব আর জাপ। খোঁয়াড়ের দিকটা খোলা রেখে বাকি এক দিক থেকে তাড়া লাগাল হার্বার্ট আর স্পিলেট। তাড়া খেয়ে খোলা দিকে ছুট লাগাল মুশমনের দল। খোঁয়াড়ের খোলা গেট দিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে পড়ল বেশ কয়েকটা বাকিগুলো পালিয়ে গেল এদিক ওদিক। খোঁয়াড়ের গেট বন্ধ করে দিয়ে প্রাণীগুলোকে গুণে ফেলল ওরা। মোট তিরিশটা মুশমন আটকা পড়েছে খোঁয়াড়ে। দশটা পাহাড় ছাগলও ঢুকে পড়েছে ওদের সাথে সাথে। মহাখুশি অভিযাত্রীরা পশম, চামড়া আর ভাল জাতের মাংসের বন্দোবস্ত হয়ে গেল। চাই কি ছাগলগুলো বাচ্চা দিলে দুধ পাওয়া যাবে। খুশি মনে গ্রানাইট হাউসে ফিরে গেল ওরা।

এবার কৃষিকাজে মন দিল সবাই। খুঁজে পেতে বন থেকে এক ধরনের বীজ নিয়ে এল হার্বার্ট। চাপ দিলেই তেল বেরোয় ওগুলো থেকে। এই বীজ জমিতে বুনে দেয়া হলো। তেলের চিন্তাও নেই আর। একরকম গাছের শিকড় থেকে তৈরি হলো বীয়ার জাতীয় মদ।

একদিন হাঁসজাতীয় দুটো বাস্টার্ড পাখি এসে আস্তানা গাড়ল পোলট্রিতে আর এল দুটো বনমোরগ।

গরমের দিনে বসে বিশ্রাম নেবার জন্যে লতাপাতা দিয়ে ঘিরে একটা বারান্দা মত তৈরি হলো প্রসপেক্ট হাইটের কিনারায়। দিনের শেষে এখানে বসে নিজেদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা আর গল্প করে অভিযাত্রীরা। চুপচাপ সবার কথা শুনে যান ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং। কাজের কথা ছাড়া একটা কথাও বলেন না। ভাবেন দ্বীপের রহস্য নিয়ে। ওরা এখানে আসার পর থেকে অনেকগুলো রহস্যময় ঘটনা ঘটে গেল পর পর। কিন্তু কোনটারই সমাধান পাওয়া গেল না আজও।

আগের পর্ব :
০১. ওপরে কি উঠছি আমরা
০২. গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে
০৩. কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন
০৪. বিকেল নাগাদ নদীর জল কমে গিয়ে
০৫. চেঁচিয়ে বললেন স্পিলেট
০৬. বেলুন থেকে নামার পর
০৭. সকাল থেকে কোথাও পাওয়া গেল না নেবকে
০৮. ওরা ঢুকলেও ফিরে চাইল না নেব
০৯. হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেনক্র্যাফট
১০. ধোঁয়া, মানে আগুন
১১. ভোর হলো
১২. পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই
১৩. পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর
১৪. মাপজোকের কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন
১৫. গহ্বরের মুখ
১৬. জুনের শুরুতেই শীত নামল
১৭. যেন ভূত দেখছে এমন ভাবে
১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা
১৯. দ্বীপের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে চলা শুরু হলো
পরের পর্ব :
২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি
২২. আবার এল শীত
২৩. এখনও কি বাধা দেবেন
২৪. মার্সি নদীর মুখে এসে
২৫. জঙ্গলে আর ফিরে গেল না আগন্তুক
২৬. ভোর হতেই খোঁয়াড়ের দিকে রওনা দিল
২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা
২৮. চোখের সামনে ভোজবাজীর মত
২৯. আস্তে আস্তে সেরে উঠতে লাগল হার্বার্ট
৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়
৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ
৩২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন নিমো
৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত