রহস্যের দ্বীপ: ১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা

রহস্যের দ্বীপ: ১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা

১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা

পরদিন ভোরে, জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা দেখার জন্যে নৌকোয় চেপে রওনা দিল অভিযাত্রীরা। জোয়ার এসেছে তখন মার্সি নদীতে। মাঝ নদীতে নৌকোটা নিয়ে গিয়ে হাল ধরে বসে রইল পেনক্র্যাফট। জোয়ারের টানে আপনি ভেসে চলল নৌকো।

একজায়গায় তীরের খুব কাছাকাছি চলছিল নৌকো। ওই সময়েই রাই সরষের গাছ খুঁজে পেল হার্বার্ট। দেখে রেগে গেল পেনক্র্যাফট। সবই পাওয়া যাচ্ছে এই দ্বীপে, শুধু শালার তামাক গাছ ছাড়া, বিড় বিড় করে বলল সে।

অনেকক্ষণ পর দেখা গেল ফাঁকা হয়ে আসছে গাছপালা। এখানে অত্যন্ত লম্বা, প্রায় একশো ফুটের কাছাকাছি, এক জাতের গাছ দেখা গেল।

ওগুলো ইউক্যালিপটাস, বলল হার্বার্ট।

এ গাছকে অস্ট্রেলিয়ায় কি বলে জানো? প্রশ্ন করলেন ক্যাপ্টেন।

না তো।

ফিভার ট্রি।

সেরেছে, জ্বর হয় নাকি এ গাছের?

হয় না, তবে পালায়। অর্থাৎ যেখানে এ গাছ থাকে সেখান থেকে পালায় জ্বর। এর হাওয়া লাগলেও জ্বর সেরে যায়।

নদীর দুতীরে শুধু আকাশ-ছোঁয়া ইউক্যালিপটাস। আরও মাইল দুয়েক এগোবার পর নদীর গভীরতা কমতে শুরু করল। গাছের ডালে লাফালাফি করছে অসংখ্য বানর। আরও কিছুটা যাওয়ার পর নৌকোর তলা মাটিতে ঠেকে গেল। আর এগোবে না নৌকো। টেনে নৌকোটাকে তীরে তুলে একটা গাছের গুড়িতে বেঁধে রাখল পেনক্র্যাফট।

অপূর্ব সুন্দর জায়গাটা। গাছে ছাওয়া নির্জন বুনো এলাকা। ঠিক হলো এখানেই রাত কাটাবে অভিযাত্রীরা। রান্নার আয়োজন করা হলো। সকাল সকাল সেরে ফেলল ওরা রাতের খাওয়া। মশাল জ্বালিয়ে পাহারায় রইল নেব আর হার্বার্ট। নির্বিঘ্নে কেটে গেল রাতটা।

পরদিন ভোরে নাস্তা সেরে নিয়ে রওনা দিল সবাই। লতাপাতা, ঝোপঝাড় কেটে, লম্বা ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে চলল ওরা। উর্বর জমি আর ঘন জঙ্গল এদিকটায়।

সকাল সাড়ে নটায় বিশাল এক ঝর্নার ধারে পৌঁছাল অভিযাত্রীরা। ঝর্নাটা পেরোনোই এক সমস্যা। হঠাৎ কি দেখে হাঁটু পানিতে নেমে গেল পেনক্র্যাফট পানিতে হাত ডুবিয়ে একটার পর একটা তুলতে থাকল গলদা চিংড়ি। পাঁচ মিনিটেই ভরে ফেলল বড়সড় এক থলে। ওগুলো দেখে খুশিতে আত্মহারা নেব। কিন্তু যতই নতুন নতুন জিনিসের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে ততই বিমর্ষ হয়ে পড়ছে পেনক্র্যাফট। হতচ্ছাড়া এই দ্বীপে সবই আছে, নেই শুধু ওর তামাক।

ঝর্নাটা পেরোতে হলো না। ওটার তীর ধরে আধঘন্টা মত হাঁটতেই সাগর দেখা গেল। দ্বীপের পূর্ব তীর পাথুরে অথচ পশ্চিম তীরে দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল। সাগর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে বনভূমি। দূর থেকে মনে হয় সবুজ লাইনিং দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে নীল সাগর। মাইল দুয়েক এভাবে গিয়ে বিরল হয়ে এসেছে গাছপালা। এরপর বহুদূর এগিয়ে গেছে তীরভূমি।

এতটা এসেও তো জাহাজডুবির কোন চিহ্ন পেলাম না! বলল হার্বার্ট, সত্যিই কি আছে কেউ দ্বীপে?

চিহ্ন সত্যিই পেলাম না, উত্তর দিলেন স্পিলেট, কিন্তু দ্বীপে যদি কেউ নাই থাকে, পেকারির বাচ্চাটাকে গুলি করল কে?

একটু থেমে দুপুরের খাওয়া সেরে আবার শুরু হলো চলা। অন্তত সার্পেন্টাইন পেনিনসুলার শেষ পর্যন্ত দেখতেই হবে। পাঁচটা পর্যন্ত হেঁটেও পৌঁছানো গেল না জায়গামত। রাত কাটাবার জন্যে একটা জায়গা খুঁজতে গিয়ে বাঁশঝাড়টা চোখে পড়ল হার্বার্টে। উৎসুক ভাবে ওকে বাঁশঝাড়ের দিকে চাইতে দেখে জিজ্ঞেস করল পেনক্র্যাফট, বাঁশ দিয়ে কি হবে?

কি হবে? ঝুড়ি হবে, ঘরের বেড়া হবে। চাই কি ভারতীয়দের মত বাঁশের কোড় খাওয়াও যেতে পারে।

তীরের কাছেই, ঢেউয়ের আঘাতে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে একটা গহ্বর। ওর ভেতরই থাকা যায় কিনা দেখার জন্যে ভেতরে ঢুকতে গেল হার্বার্ট আর পেনক্র্যাফট। সাথে সাথে গুহার ভেতর থেকে ভেসে এল ক্রুদ্ধ গর্জন। এক লাফে হার্বার্টকে নিয়ে একটা পাথরের আড়ালে লুকাল পেনক্র্যাফট।

গর্জনটা স্পিলেটও শুনেছেন। আওয়াজ শুনে মনে হলো কোন বড় জানোয়ার। বন্দুক হাতে ছুটে এলেন তিনি। আরেকবার কলজে কাঁপানো ডাক ছেড়ে গুহার মুখে বেরিয়ে এল একটা জানোয়ার বিশাল বুনো বেড়ালের মত জানোয়ারটার হলদে গায়ে কালো ছোপ। জাগুয়ার।

বন্দুক তুলে গুলি করলেন স্পিলেট। দুচাখের ঠিক মাঝখানে লাগল গুলি। সেখানেই গড়িয়ে পড়ল জাগুয়ারটা। চামড়াটা দেখে দারুণ খুশি হলো নেব। সাথে সাথেই জাগুয়ারের চামড়া ছাড়াতে বসে গেল সে।

গুহার ভেতর জাগুয়ারের উচ্ছিষ্ট বহু হাড় পাওয়া গেল। দেখে শুনে মনে হলো মাত্র একটা জানোয়ারই ছিল গুহাটায়। মধ্য এশিয়ার তাতারদের জীবন যাত্রার অনেক খুঁটিনাটিই তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিখে গেছেন মার্কোপোলো। কথাটা সেখানেই পড়েছিলেন ক্যাপ্টেন। গাঁট শুদ্ধ বাঁশের টুকরো আগুনে ফেলে দিলে নাকি প্রচন্ড শব্দ করে ফাটে। বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে এনে তাই করলেন ক্যাপ্টেন। সত্যিই, বন্দুকের আওয়াজের মত শব্দ করে ফাটতে শুরু করল বাঁশের গাট। সে আওয়াজে শুধু বুনো জন্তু কেন ভুত প্রেতও বোধহয় ত্রিসীমানা থেকে পালাবে। এভাবে বেশ কিছু বাঁশের গাঁট ফাটিয়ে, জন্তু জানোয়ারদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে সে রাতটা গুহাতেই কাটাল সবাই। ভোর পর্যন্ত একটানা জ্বলতে থাকল গুহার মুখে পুতে দেয়া কাঠের মস্ত মশাল।

আগের পর্ব :
০১. ওপরে কি উঠছি আমরা
০২. গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে
০৩. কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন
০৪. বিকেল নাগাদ নদীর জল কমে গিয়ে
০৫. চেঁচিয়ে বললেন স্পিলেট
০৬. বেলুন থেকে নামার পর
০৭. সকাল থেকে কোথাও পাওয়া গেল না নেবকে
০৮. ওরা ঢুকলেও ফিরে চাইল না নেব
০৯. হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেনক্র্যাফট
১০. ধোঁয়া, মানে আগুন
১১. ভোর হলো
১২. পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই
১৩. পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর
১৪. মাপজোকের কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন
১৫. গহ্বরের মুখ
১৬. জুনের শুরুতেই শীত নামল
১৭. যেন ভূত দেখছে এমন ভাবে
পরের পর্ব :
১৯. দ্বীপের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে চলা শুরু হলো
২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে
২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি
২২. আবার এল শীত
২৩. এখনও কি বাধা দেবেন
২৪. মার্সি নদীর মুখে এসে
২৫. জঙ্গলে আর ফিরে গেল না আগন্তুক
২৬. ভোর হতেই খোঁয়াড়ের দিকে রওনা দিল
২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা
২৮. চোখের সামনে ভোজবাজীর মত
২৯. আস্তে আস্তে সেরে উঠতে লাগল হার্বার্ট
৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়
৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ
৩২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন নিমো
৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত