১৬. জুনের শুরুতেই শীত নামল
জুনের শুরুতেই শীত নামল। প্রথমেই মোমবাতির প্রয়োজন বোধ করল অভিযাত্রীরা। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে আবার গোটা ছয় সীল মেরে আনল পেনক্র্যাফট। প্রথমে চুন আর চর্বি দিয়ে তৈরি হলো সাবান। সালফিউরিক অ্যাসিডের সাহায্যে আলাদা করে ফেলা হলো ক্যালশিয়াম সালফেট। বাকি রইল তিনটে ফ্যাটি অ্যাসিড-লিক, মারগারকি আর স্টিয়ারিক। শেষ দুটোকে কাজে লাগিয়ে মোমবাতি বানিয়ে ফেললেন হার্ডিং, শাকসব্জির আগা পাকিয়ে হলো মোমের সলতে।
বেশি শীত পড়তে শুরু করলে গরম জামাকাপড় দরকার হবে। ভেড়ার মত লোমওয়ালা অসংখ্য মুশমন আছে ফ্র্যাঙ্কলিন হিলে। কিন্তু উলের কাপড় বোধ হয় এ শীতে আর হচ্ছে না। পরে জুতো বানাবার জন্যে সীলের চামড়া শুকিয়ে রাখা হলো। দুঃসময়ের জন্যে প্রচুর মাছ আর খরগোশ নুন দিয়ে শুকিয়ে ভাঁড়ারে মজুদ করল নেব। কয়েকটা নতুন যন্ত্র—যেমন কাঁচি, করাত তৈরি করা হলো। কাঁচি দিয়ে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল কেটে চেহারাটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করল অভিযাত্রীরা। পুরানো যন্ত্রপাতিগুলোও ঘষে মেজে সাফ করা হলো।
বিদঘুটে একটা করাতের সাহায্যে তৈরি হয়ে গেল চেয়ার, টেবিল, খাট, টুল, তাক ইত্যাদি। তৈরি হলো দুটো কাঠের পুল। গ্রানাইট হাউস থেকে দ্বীপের উত্তর প্রান্তে যেতে একটা ছোট্ট খাল পেরোতে হয়। একটা পুল খালের ওপর বসিয়ে দেয়া হলো। পানি ভাঙার ঝামেলা নেই বলে এবার যখন তখন যাওয়া যাবে সাগর তীরে। সাগর সৈকতে পড়ে থাকা রাশি রাশি ঝিনুক আর শামুক কুড়িয়ে এনে ভাঁড়ারে রাখল নেব-পেনক্র্যাফট। টক শরবৎ তৈরির জন্যে এক জাতের গাছের শিকড়, চিনি তৈরির জন্যে ম্যাপল গাছ, চায়ের বিকল্প হিসেবে এক প্রকার ঘাস, সবই আছে দ্বীপে। নেই শুধু রুটি। সময় পেলেই ব্রেডফুট জাতীয় গাছ খুঁজে বেড়ালেন ক্যাপ্টেন কয়েক দিন। হঠাৎ একটা জিনিস পেয়ে ওই গাছ আর খুঁজতে হলো না।
রিচমন্ডে থাকাকালীন হার্বার্টকে কয়েকটা পায়রা কিনে দিয়েছিল পেনক্র্যাফট। পায়রাগুলোকে রোজ গমের দানা খাওয়াত হার্বার্ট। একটা দানা কিভাবে যেন ঢুকে গিয়েছিল ওর কোটের সেলাইয়ের ফাঁকে। ওই দানাটাই সেদিন খুঁজে পেল হার্বার্ট। আর তাই দেখেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন।
রুটির অভাব তাহলে মিটল।
ওই একটা দানাতেই রুটি? আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল হার্বার্ট।
ওই দানাটাই মাটিতে পুঁতে ফেল। ওটা থেকে প্রথম বছরে পাওয়া যাবে আটশো দানা, আটশো দানা পুঁতলে দ্বিতীয় বছরে ছলক্ষ চল্লিশ হাজার দানা, তার পরের বছরে পুরোপুরি গমের চাষই শুরু করে দেয়া যাবে।
গ্রানাইট হাউসের ছাদের এক জায়গার মাটি সাফ করা হলো। জায়গাটা কুপিয়ে নিয়ে তাতে চুন মিশিয়ে পানি ঢালা হলো। তারপর দানাটি রোপণ করে বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হলো। দানা রোপণকে কেন্দ্র করে এক উৎসবের আয়োজন করল অভিযাত্রীরা। জাকজমকের সাথে অতিবাহিত হলো উৎসব। সেদিন বিশে জুন।
সবচেয়ে খুশি হলো পেটুক পেনক্র্যাফট। সেদিন থেকে নিয়মিত শস্যক্ষেত্রটি দেখাশোনা আর আশপাশের কীট-পতঙ্গ মেরে ফেলার ভার নিল সে। জুনের শেষ নাগাদ জেঁকে নামল শীত। এত ঠান্ডা পড়ল যে জমে গেল হ্রদের পানি।
তবে গ্রানাইট হাউসের ভেতরে আরামেই রইল অভিযাত্রীরা। ঘরের ভিতরে ফায়ার প্লেসে জ্বলে গনগনে আগুন, কাজেই চিন্তা কি? সরাসরি ভাঁড়ার ঘর পর্যন্ত হ্রদের পানি টেনে আনার বন্দোবস্ত করেছিলেন ক্যাপ্টেন! ঘর গরম থাকায় বরফের তলা দিয়ে আসা পানিও জমতে পারল না।
মার্সি নদীর দক্ষিণ পাড় আর ক্ল কেপ এর মধ্যবর্তী জলাভূমিটায় যায়নি এখনও ওরা। শীতের সময় জলাভূমির পানি কমে গেল। সেটাই একদিন দেখতে যাবার সিদ্ধান্ত নিল সবাই।
সেদিন পাঁচই জুলাই। ভোর ছটা। সঙ্গে খাবার আর শিকারের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা। আগে আগে চলল টপ। মার্সি নদীর ওই পাড়টাও ঝোপঝাড়ে ঠাসা। টপের তাড়া খেয়ে এ ঝোপ থেকে বেরিয়ে এদিকের ঝোপে গিয়ে লুকাল কয়েকটা শেয়াল। পালাবার সময় ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া বলে চেঁচাতে চেঁচাতে গেল। ভড়কে গেল টপ। কুকুরের মতও ডাকছে কয়েকটা শিয়াল।
ওগুলো মেরু শেয়াল, বললেন ক্যাপ্টেন।
আরও পরে, বেলা প্রায় আটটার দিকে সাগর তীর ঘেঁষা অনুর্বর জায়গা দিয়ে হাঁটতে লাগল ওরা। পাহাড় নেই এদিকে। পেছনে ফিরে চাইলেন একবার ক্যাপ্টেন। প্রায় মাইল চারেক পথ পেরিয়ে এসেছে ওরা।
হাঁটতে হাঁটতেই একসময় ক্যাপ্টেন বললেন, গড়ন আর ভূ-প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে এককালে মহাদেশেরই অংশ ছিল দ্বীপটা। হয়তো কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাগরের তলায় তলিয়ে গেছে মহাদেশ। প্রশান্ত আর আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় সব দ্বীপই কোন না কোন মহাদেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে সন্দেহ করা হয়।
তাই নাকি, ক্যাপ্টেন? আশ্চর্য হয়ে বলল পেনক্র্যাফট, তাহলে তো লিঙ্কন আইল্যান্ডও যে-কোন সময় পানির তলায় চলে যেতে পারে।
অসম্ভব কিছুই নয়, তবে তার আগেই হয়তো এখান থেকে চলে যেতে পারব আমরা।
কথা বলতে বলতে বিশাল জলাভূমিটার কাছে পৌঁছে গেল ওরা। জলাটা দৈর্ঘ্যে পাঁচ মাইল, প্রস্থে মাইল চারেক হবে। কিনারায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আগ্নেয়শিলা। জলাটা পুরু ঘাসের চাপড়া, জলজ উদ্ভিদ, শ্যাওলা আর দুর্গন্ধময় পঁচা ঘাসে ঠাসা। মশার ডিপো ওটা। আর আছে অগুনতি হাঁস, টিল আর স্নাইপ। আরও যে কত জাতের পাখি আছে তার সীমাসংখ্যা নেই। মানুষ দেখেও ভয় পেল নস পাখির দল। এরাও মানুষ দেখেনি তাহলে।
ইস! একটা বন্দুক থাকলে…। বাকি কথাটা আঙুলের তুড়ি মেরে বুঝিয়ে দিল নাবিক পেনক্র্যাফট।
শেষ পর্যন্ত তীর ধনুক দিয়েই কয়েকটা পাখি মারা হলো। এক নজর দেখেই মন্তব্য করল হার্বার্ট, ট্যাডরন পাখি ওগুলো। সেদিন থেকেই জলাটার নাম হয়ে গেল ট্যাডরন জোন। রাত আটটায় ফিরে এল সবাই গ্রানাইট হাউসে।
শীত কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পেল ওরা আগস্টের মাঝামাঝি। আর যদি বাতাস বইতে শুরু করে তাহলে তো কথাই নেই। হাড় ভেদ করে মজ্জায় গিয়ে ঢোকে যেন প্রচন্ড ঠান্ডা। ঠাট্টা করে একদিন নেবকে বলেই ফেলল পেনক্র্যাফট, অন্তত একটা ভালুক পেলেও চামড়ার কোট বানিয়ে দিতে পারতাম তোমাকে। কিন্তু ভালুক পাওয়া গেল না দ্বীপে।
প্রসপেক্ট হাইটের ওদিকের জঙ্গলে রোজ ফাঁদ পাতে পেনক্র্যাফট আর নেব। শেয়াল ছাড়া আর কিছু ফাঁদের ধারে কাছেও আসে না। দুএকটা শেয়াল মাঝে মাঝে আটকা পড়ে ফাঁদে। স্পিলেটের পরামর্শ মত মরা শেয়ালের টোপ দিয়ে ফাঁদ পাতা হতেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। একটার পর একটা পেকারি (এক জাতের শুয়োর) ধরা পড়তে লাগল ফাঁদে। কিছু খরগোশও ধরা পড়ল।
এরমাঝেই হঠাৎ একদিন আঁধার হয়ে এল আকাশ বরফ পড়া শুরু হলো। সাদা হয়ে গেল সবুজ বনভূমি। নিরুপায় হয়ে গ্রানাইট হাউসে আবদ্ধ থাকতে হলো অভিযাত্রীদের। অবশ্য বেকার বসে থাকল না ওরা। তক্তা কেটে আরও চেয়ার টেবিল বানিয়ে নিল। বেত পাকিয়ে ঝুড়ি বানাল। ম্যাপলের রস জাল দিয়ে হলো প্রচুর মিছরি।
বরফ পড়া থামল আগস্টের শেষ নাগাদ। লিঙ্কন দ্বীপকে আর চেনা যাচ্ছে না এখন। যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ।
গ্রানাইট হাউস থেকে বেরিয়ে এল অভিযাত্রীরা। প্রথমেই গেল ফাঁদের কাছে। নখযুক্ত থাবার চিহ্ন দেখা গেল ফাঁদের আশেপাশে। বেড়াল গোষ্ঠীর চতুস্পদ প্রাণী। প্রচন্ড ঠান্ডায় হয়তো পশ্চিমের বন ছেড়ে চলে এসেছে। চিন্তিত হলো ওরা।
কয়েকদিন পর আবার বরফ পড়া শুরু হলো। আবার গ্র্যানাইট হাউসে আটকে থাকতে হলো ওদের। একটা অবাক কান্ড ঘটতে দেখা গেল এসময়। মাঝে মাঝে কুয়োটার কাছে ছুটে গিয়ে গজরায় টপ।
মনে হয় কোন জলজন্তু এসে আশ্রয় নেয় কুয়োর তলায়। কুকুরটার রকম সকম দেখে বললেন ক্যাপ্টেন।
এর কিছুদিন পরই এমন একটা ঘটনা ঘটল যে রীতিমত শঙ্কিত হলো অভিযাত্রীরা। সেদিন ছাব্বিশে অক্টোবর। শীত কমে যাওয়ায় বরফ গলতে শুরু করেছে। একটা বেশ বড়সড় পেকারি-সাথে একটা কয়েক মাসের বাচ্চা সহ ফাঁদে আটকা পড়েছে। তাই দেখে দারুণ খুশি পেনক্র্যাফট যত্ন করে রাঁধতে বসে গেল সে। সেদিন খাবার টেবিলে এল বাচ্চা পেকারির রোস্ট, ক্যাঙ্গারুর ঝোল, শুয়োরের গোশত, সোনপাইন বাদাম আর ওসবেগো ঘাসের চা। বাচ্চা পেকারিটার একটা অংশ কেটে নিয়ে মুখে পুরল পেনক্র্যাফট পরক্ষণেই চেঁচিয়ে উঠে হাত চাপা দিল মুখে।
হলো কি? আঁ, কি হলো তোমার? উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করলেন ক্যাপ্টেন।
একটা দাঁতই শেষ হয়ে গেছে।
দাঁত গেছে? মানে ভেঙেছে? পেকারির গোশতে পাথর ছিল নাকি?
মুখ থেকে শক্ত জিনিসটা বের করে টেবিলে রাখল পেনক্র্যাফট। পাথর না জিনিসটা, সীসার টুকরো। চেপ্টে যাওয়া একটা বুলেটের অংশ।
আগের পর্ব :
০১. ওপরে কি উঠছি আমরা
০২. গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে
০৩. কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন
০৪. বিকেল নাগাদ নদীর জল কমে গিয়ে
০৫. চেঁচিয়ে বললেন স্পিলেট
০৬. বেলুন থেকে নামার পর
০৭. সকাল থেকে কোথাও পাওয়া গেল না নেবকে
০৮. ওরা ঢুকলেও ফিরে চাইল না নেব
০৯. হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেনক্র্যাফট
১০. ধোঁয়া, মানে আগুন
১১. ভোর হলো
১২. পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই
১৩. পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর
১৪. মাপজোকের কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন
১৫. গহ্বরের মুখ
পরের পর্ব :
১৭. যেন ভূত দেখছে এমন ভাবে
১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা
১৯. দ্বীপের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে চলা শুরু হলো
২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে
২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি
২২. আবার এল শীত
২৩. এখনও কি বাধা দেবেন
২৪. মার্সি নদীর মুখে এসে
২৫. জঙ্গলে আর ফিরে গেল না আগন্তুক
২৬. ভোর হতেই খোঁয়াড়ের দিকে রওনা দিল
২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা
২৮. চোখের সামনে ভোজবাজীর মত
২৯. আস্তে আস্তে সেরে উঠতে লাগল হার্বার্ট
৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়
৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ
৩২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন নিমো
৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে