০২. গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে
গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে তখন সমস্ত আমেরিকা জুড়ে। রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার সংকল্প নিয়ে ১৮৬৫ সালের মার্চের মাঝামাঝি রিচমন্ড শহর অবরোধ করে বসলেন জেনারেল গ্র্যান্ট। জোর লড়াই করেও কিন্তু তিনি রিচমন্ড দখল করতে পারলেন না। শহরের মধ্যেই বন্দী হয়ে আছেন জেনারেলের কয়েকজন ঝানু অফিসার। ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং এদের অন্যতম। ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের এই ক্যাপ্টেনের বয়স পঁয়তাল্লিশ। পাথর খোদাই করা চেহারা। প্রখর বুদ্ধি আর তীব্র মনের জোর ভদ্রলোকের। কদমছাট চুল, ধূসর পুরু গোঁফ, সুগঠিত করোটি, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় ওঁর মাঝে আছে দুর্জয় সাহস, অদম্য মনোবল আর তীব্র ইচ্ছাশক্তি। গাইতি আর হাতুড়ি চালিয়ে হাতেখড়ি নিয়েছেন তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায়—শুধু কাগজ-কলমে নয়।
সাইরাস হার্ডিং-এর সাথেই গ্রেফতার হয়েছেন নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডের চীফ রিপোর্টার গিডিয়ন স্পিলেট। বিশাল শরীরের অধিকারী এই সাংবাদিকের বয়স চল্লিশ। ঠান্ডা মাথা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, প্রচন্ড সাহস, অপরিসীম উদ্যোগ আর উৎসাহ এঁকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে উন্নতির শিখরে। যুদ্ধক্ষেত্রে এক হাতে পিস্তল ধরে অন্য হাতে খবর লেখায় অভ্যস্ত বলে খ্যাতি আছে তার।
ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং আর সাংবাদিক গিডিয়ন স্পিলেট পরস্পরকে না চিনলেও দুজনের নামডাকই দুজনের কানে গিয়েছিল। শহরের বাইরে যাবার নির্দেশ নেই, তবে শহরের চৌহদ্দির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারতেন দুজনেই। এভাবেই হঠাৎ একদিন আলাপ হয়ে যায় ওদের। এরপর থেকে উভয়েই পালাবার ফিকির খুঁজতে শুরু করলেন।
এরই মাঝে একদিন চালাকি করে শহরে ঢুকে পড়ল ক্যাপ্টেন হার্ডিং-এর পূরানো ভৃত্য নেব—অর্থাৎ নেবুশ্যাডনেজার। অত্যন্ত প্রভুভক্ত নেবকে বহু আগেই দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন হার্ডিং। কিন্তু ভূতপূর্ব মনিব শত্রুদের হাতে পড়েছেন শুনে জান বাজী রেখে ছুটে এসেছে নেব। সাথে করে নিয়ে এসেছে হার্ডিং-এর প্রিয় কুকুর টপকেও।
মহা ফাঁপরে পড়লেন রিচমন্ডের শাসনকর্তা জেনারেল লী। জেনারেল এ্যান্ট শহর অবরোধ করে বসে থাকায় তিনি বাইরে থেকে খবর আনা নেয়া করতে পারছেন না। হুকুম পাঠাতে পারছেন না অন্যান্য সেনাপতিদের কাছে। কাজেই, অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে একটা বেলুন বানালেন জেনারেল লী। তাঁর জনাকয়েক লোককে বেলুনে করে পাঠিয়ে দেবেন অন্যান্য সামরিক অফিসারদের কাছে। বেলুনের তলায় বাধা বিশাল দোলনায় বসবে তারা।
কিন্তু বেলুন ওড়ানোর দিনই ঘটল অঘটন। মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল সারা আকাশ। তার উপর বাতাসের ঝাপটা। প্রচন্ড ঝড়ের পূর্বাভাস এসব।
রিচমন্ড ছেড়ে পালাবার কথা মনে মনে ভাবছিল আরও একজন নাবিক -পেনক্র্যাফট। ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং-এর সাথে পরিচয় আছে পেনক্র্যাফটের। বেলুনের কাছে দাঁড়িয়ে সেদিন অদ্ভুত আকাশ যানটাকে দেখছিল পেনক্র্যাফট। এমন সময় কথাটা কানে গেল ওর। ক্যাপ্টেন ফরেল্টারকে বলছেন জেনারেল লী, এই আবহাওয়ায় তো আকাশে ওড়ানো যাবে না বেলুন।
অবস্থা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন ক্যাপ্টেন ফরেল্টার, এ ঝোড়ো হাওয়ায় না বেরিয়ে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখা যাক।
ঠিক হলো, পরদিন সকালে হাওয়ার জোর কমলে রওনা হওয়া যাবে। রাতে বেলুনের কাছে খুব একটা কড়া পাহারার দরকার হবে না। এই ঝড়-তুফানের ভেতর বেলুনের কাছে কারও আসার সম্ভাবনা নেই। কথা শুনে মনে মনে হাসল পেনক্র্যাফট। এক্ষুণি ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিংকে কথাটা জানানো দরকার। পালাবার এই সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না ভেবে তক্ষুণি ক্যাপ্টেনের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল সে।
রাস্তায়ই পাওয়া গেল ক্যাপ্টেনকে।
পালাবার সুযোগ এসে গেছে, ক্যাপ্টেন, বলল পেনক্র্যাফট।
সুযোগ। এর মাঝে কি ব্যবস্থা করে ফেললে তুমি, পেনক্র্যাফট।
বেলুন।
তাইতো! আরে, কি বোকা আমি! জেনারেলের বেলুনের কথা শুনেও এতদিন প্ল্যানটা আমার মাথায় ঢোকেনি!
কথা বলতে বলতে গিডিয়ন স্পিলেটের কাছে চলে গেলেন দুজনে। ঠিক হলো রাত দশটায় পালাবেন ওঁরা। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালেন ক্যাপ্টেন, হে খোদা, তুফান যেন আজ না কমে।
যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হলো। নিজেদের জিনিসপত্র গোছগাছ করতে চলে গেল সবাই। জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করলেন হার্ডিং, কিরে, আকাশে উড়তে ভয় করবে নাতো তোর? উত্তরে শুধু ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে চেয়ে লেজ নাড়ল কুকুরটা।
একটু পরই জিনিসপত্র নিয়ে সেখানে এসে পৌঁছলেন স্পিলেট আর দেরি না করে কুকুরটা সহ বেরিয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন হার্ডিং, স্পিলেট আর নেব। বেলুনের কাছে পৌঁছে দেখলেন পাহারার চিহ্ন মাত্র নেই কোথাও। বাতাসের ঝাপটায় কাত হয়ে উড়ছে বেলুন। যে কোন মুহুর্তে খুঁটি উপড়ে আকাশে উড়ে যেতে পারে।
অন্ধকারে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উৎকণ্ঠিত পেনক্র্যাফট সাথে বিশ বছরের একটা ছেলে। ওর প্রাক্তন মনিবের ছেলে-হার্বার্ট। ব্যবসার উদ্দেশ্যে রিচমন্ডে এসেছিল দুজনে। ক্যাপ্টেনের দেরি দেখে ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে পেনক্র্যাফট, এমন সময় ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল টপ। এসে গেছেন ক্যাপ্টেন। হার্বার্টকে নিয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে দৌড়ে গেল পেনক্র্যাফট। হার্বার্টের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
আমার মনিবের ছেলে-হার্বার্ট। বাবার মৃত্যুর পর বাজে লোকের পরামর্শে পড়ে ব্যবসা বাণিজ্য সব খুইয়ে প্রায় পথে বসেছে ও, বলল পেনক্র্যাফট। এখন আছে আমার সাথে আমার সহকারী হিসেবে।
আশেপাশে আর একবার ভাল করে দেখে নিল সবাই। নাহ, পাহারাদারের চিহ্নও নেই। একে একে দোলনায় উঠে বসল অভিযাত্রীরা। একটা একটা করে খুঁটির দড়িগুলো কেটে দেয়া হলো। এদিক ওদিক দুলতে দুলতে তীরবেগে শূন্যে উঠে গেল বিশাল বেলুন।
সেদিন ছিল আঠারোশো পঁয়ষট্টি সালের বিশে মার্চ। রাত দশটা।
আগের পর্ব :
০১. ওপরে কি উঠছি আমরা
পরের পর্ব :
০৩. কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন
০৪. বিকেল নাগাদ নদীর জল কমে গিয়ে
০৫. চেঁচিয়ে বললেন স্পিলেট
০৬. বেলুন থেকে নামার পর
০৭. সকাল থেকে কোথাও পাওয়া গেল না নেবকে
০৮. ওরা ঢুকলেও ফিরে চাইল না নেব
০৯. হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেনক্র্যাফট
১০. ধোঁয়া, মানে আগুন
১১. ভোর হলো
১২. পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই
১৩. পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর
১৪. মাপজোকের কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন
১৫. গহ্বরের মুখ
১৬. জুনের শুরুতেই শীত নামল
১৭. যেন ভূত দেখছে এমন ভাবে
১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা
১৯. দ্বীপের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে চলা শুরু হলো
২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে
২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি
২২. আবার এল শীত
২৩. এখনও কি বাধা দেবেন
২৪. মার্সি নদীর মুখে এসে
২৫. জঙ্গলে আর ফিরে গেল না আগন্তুক
২৬. ভোর হতেই খোঁয়াড়ের দিকে রওনা দিল
২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা
২৮. চোখের সামনে ভোজবাজীর মত
২৯. আস্তে আস্তে সেরে উঠতে লাগল হার্বার্ট
৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়
৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ
৩২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন নিমো
৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে