মরুশহর: ১৩. কিসের এত শব্দ

মরুশহর: ১৩. কিসের এত শব্দ

১৩. কিসের এত শব্দ

কিসের এত শব্দ বুঝতে পারছে না লুই বা জেন কেউই। প্রাসাদের বাইরে থেকে আসছে শোরগোলের আওয়াজ। থেকে থেকেই বন্দুক গর্জাচ্ছে, বিস্ফোরণের শব্দ হচ্ছে। বাড়ছে ক্রমেই।

হঠাৎই ব্যাপারটা অনুমান করতে পারল জেন। ভাইকে জিজ্ঞেস করল, হাটতে পারবে?

চেষ্টা করব।

চলো তাহলে।

ধরে ধরে অতিকষ্টে লুইকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল জেন। এক ছটাক শক্তি অবশিষ্ট নেই লুইয়ের শরীরে। সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ধরে রেখেছে জেন।

বাইরে নিগ্রো গোলামটাকে আশা করছিল জেন, কিন্তু নেই। প্রায় টেনে হিচড়ে সিঁড়ি দিয়ে চাতালে তুলে আনল জেন লুইকে।

ঠেলা মেরে দেখল দরজা ভেজানোই আছে। সিংহাসন ঘরে এসে ঢুকল দুজনে। সেখানেও নেই কেউ।

একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল জেন লুইকে। একাই চলল গোলমালের কারণ অনুসন্ধান করতে।

পথ চেনাই আছে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে লাগল। পুরো বাড়িটাকে নির্জন মনে হচ্ছে।

না, নির্জন নয়। সিড়ির একেবারে মাথায় এসে ছাদে উঁকি দিতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল জেন। কারা যেন কথা বলছে ছাদে। সিড়ি ঘরে উঠে এল সে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। ছাদে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে নবরত্নের সঙ্গে কথা বলছে উইলিয়াম ফার্নি। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কজন ব্ল্যাকগার্ড আর নিগ্রো দাস। সব কজন গার্ডের কোমরে এক জোড়া করে রিভলভার, হাতে রাইফেল।

আঙুল তুলে দূরের কি যেন দেখাচ্ছে উইলিয়ামকে নবরত্ন। আচমকা ঘুরে দাঁড়াল ফার্নি। গলা ফাটিয়ে গার্ডদের কি হুকুম দিল। তারপর নবরত্নকে নিয়ে এগোল সিঁড়ি ঘরের দিকে।

ফিরে যেতে পারবে না জেন, বুঝতে পারল। তার আগেই ধরা পড়ে যাবে। উপায়ান্তর না দেখে হ্যাচকা টানে সিঁড়ি ঘরের লোহার দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল গার্ডের দল। রাইফেলের বাট দিয়ে দমাদম পিটাতে লাগল।

এক চুল নড়ল না লোহার পাল্লা। নিশ্চিন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে এল জেন। ছাদ থেকে নিচের তলা পর্যন্ত একই রকম মজবুত আরও পাঁচটা দরজা আছে। নামার পথে একে একে সবকটা দরজা বন্ধ করে দিল জেন। পথে যে কটা ঘর পড়ল, সবকটার লোহার পাল্লা লাগানো জানালাগুলোও বন্ধ করে দিল। এক দুর্ভেদ্য কেল্লার ওপর বন্দী করে এল উইলিয়াম ফার্নি, তার নবরত্ন আর কিছু দুর্ধর্ষ গার্ডকে।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে লুই। অতগুলো ভারি পাল্লা বন্ধ করতে গিয়ে কাহিল হয়ে পড়েছে জেন। হাত-পা কাঁপছে থর থর করে। পরিশ্রম আর স্নায়ুছেড়া উত্তেজনায়।

কি হলো, জেন, অমন করছিস কেন? জেনকে ভীষণভাবে হাঁপাতে দেখে প্রশ্ন। করল লুই।

উইলিয়ামকে ছাদে বন্দী করে এলাম। হাঁপাতে হাঁপাতেই জবাব দিল জেন। আপাতত আমাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই তার।

ছাদ থেকে নেমে আসার আর কোন পথ নেই তো? লুইয়ের কণ্ঠে সন্দেহ।

নাহ। থাকলেও জানি না। অনিশ্চিত স্বর জেনের।

অত গোলমাল কিসের বাইরে?

বুঝতে পারছি না। চল তো দেখি।

ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল লুই আর জেন। পাল্লা ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিয়েই বুঝল, অমন অস্থির হয়ে পড়েছে কেন উইলিয়াম। রেড রিভারের ডান পাড়ে আগুন লেগেছে। এসপ্ল্যানেড অন্ধকার। নিগ্রোদের প্রতিটা কুঁড়ের মাথায় নাচছে আগুনের লেলিহান শিখা। জ্বলছে টাউনের মাঝ বরাবর।

সিভিল বডির কোয়ার্টারেও ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। এগোচ্ছে মেরি ফেলোদের কোয়ার্টারের দিকে। চারদিকে ভীষণ হট্টগোল, চিৎকার, গালাগাল, হুংকার, ইত্যাদি ছাপিয়ে ক্রমাগত উঠছে রাইফেল বন্দুকের বজ্রনির্ঘোষ। এক এলাহিকান্ড।

বিদ্রোহ করেছে নিগ্রো দাসরা, বলল জেন। কাজ হাসিল করতে পেরেছে। তাহলে টোনগানে।

কি বলছিস? কিছুই তো বুঝতে পারছি না আমি। অবাক লুই।

অল্প কথায় সব কথা ভাইকে খুলে বলল জেন। বাড়ি থেকে রওনা হবার পর। আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সব!

এখন কি করবি? জিজ্ঞেস করল লুই। আপাতত কিছুই করার নেই।

হঠাৎ কি মনে হতে লুইকে বলল জেন, তুমি একটু বসো, দেখি কোন অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায় কিনা। নিগ্রোদের কিছুটা সাহায্য করতে পারলেও লাভ হবে।

খুঁজে পেতে পাশের একটা ঘরে একটা রাইফেল, দুটো রিভলভার আর কিছু কার্তুজ পেল জেন! ফিরে এসে দেখল, পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কাতারে কাতারে এসে এসপ্ল্যানেডে জড় হচ্ছে নিগ্রোরা। চেহারা ভয়ংকর। প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলছে যেন ওরা দাউ দাউ করে। আরও ছড়িয়েছে আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে চল্লিশটা হেলিপ্লেনের শেড। গত দশ বছরে অকল্পনীয় যন্ত্রণা সয়েছে নিগ্রোরা, শোধ তুলছে আজ। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে ব্লাকল্যান্ড। কচুকাটা করছে ব্ল্যাকগার্ডদের নির্মমভাবে। সমানে ওদের ওপর গুলি চালাচ্ছে উইলিয়াম ফার্নির অনুচরেরা, ছাদ থেকে। কিন্তু হাজার হাজার নিগ্রোর বিরুদ্ধে মাত্র কয়েকটা বন্দুক পিস্তল কিছুই না।

হঠাৎ নতুন করে একসঙ্গে অনেক বন্দুক গর্জে উঠল। রেড রিভারের দিক থেকে। মেরি ফেলোরা আসছে। একজোট হতে পেরেছে ওরা হয়তো এতক্ষণে। ক্রমেই এগিয়ে আসছে এসপ্ল্যানেডের দিকে। কাতারে কাতারে লুটিয়ে পড়ছে নিগ্রো দাসরা, কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই। জানে ওরা, ধরা পড়লে গরুছাগলের মত জবাই হবে। তার চেয়ে যুদ্ধ করে মরা ভাল। কে জানে, দুর্ভাগ্যের দিন শেষ হয়ে থাকলে জিতেও যেতে পারে ওরা।

কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে তীর-ধনুক-বল্লম যা করতে পারে, এক্ষেত্রেও তার বেশি কিছু হচ্ছে না। নিগ্রোদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। মরতেই চলেছে তারা। ক্রমেই আরও এগিয়ে আসছে মেরি ফেলোরা। আরও বেশি করে মারা যাচ্ছে নিগ্রো দাসের দল।

হঠাৎই শোনা গেল প্রলয়ংকরী বিস্ফোরণের শব্দ। চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে আকাশে উঠে গেল সিভিল বডির কোয়ার্টারের পাঁচিলের একটা অংশ। সেই সঙ্গে কিছু ঘরবাড়ি।

কি করে ঘটল এই রহস্যজনক বিস্ফোরণ জানার দরকার নেই নিগ্রো দাসেদের, পথ খোলা পেয়ে সোজা ছুটে গেল মাঠের দিকে, পাঁচিলের ভাঙা অংশ ডিঙিয়ে। হাজারে হাজারে। একেবারে একা হয়ে গেল এসপ্ল্যানেডে মেরি ফেলোরা। নিগ্রোদের তাড়া করার কথা ভুলেই গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। ওরা এই হঠাৎ বিস্ফোরণে।

এই সময় আবার ঘটল বিস্ফোরণ। তারপর আর একবার। প্রথম ধ্বংসস্তুপের ডাইনে এবং বায়ে। যে-ই ঘটাচ্ছে বিস্ফোরণ, ঘটাচ্ছে প্ল্যামাফিক, একেবারে ঘড়ি ধরে ধরে।

মিনিট পাঁচেক পরে আবার ঘটল বিস্ফোরণ! আবার। সবই সিভিল বডিদের কোয়ার্টারে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মেরি ফেলোরা। ক্রমেই এসপ্ল্যানেডের পেছনে প্যালেসের দিকে পিছিয়ে যেতে লাগল ওরা। ওদিকে ক্রমাগত বিস্ফোরণ ঘটেই চলেছে। দ্রুত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে সিভিল কোয়ার্টার। ঘটনাটা কি?

রাত ভোর হলো। এসপ্ল্যানেডে ভয়াবহ দৃশ্য। শত শত মানুষের লাশ পড়ে আছে মাটিতে। সাদা কালোয় মেশানো।

দাসেরা সব পালাচ্ছে। কাতারে কাতারে এগিয়ে চলেছে পশ্চিমে, আরও পশ্চিমে, একেবারে নাইজারের দিকে। বালির সাগর পেরিয়ে কি করে পৌঁছুবে, ভাবছে না। এগিয়েই চলেছে। পানি নেই, খাবার নেই। কিছু কিছু অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান আবার খেতে বসে জটলা পাকাচ্ছে। ওরা বুঝতে পেরেছে, এভাবে মরুভূমি পাড়ি দেবার চেষ্টা করা নির্ঘাত মৃত্যুর সামিল। তার চেয়ে দেখাই যাক, কিছু খাবার আর পানি নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।

ধোঁয়ার মেঘে কালো হয়ে গেছে শহরের উপরের আকাশ। নিজের নাম সার্থক করার জন্যেই যেন মরার আগে কালো হয়ে গেছে ব্ল্যাকল্যান্ড ! বিস্ফোরণ কিন্তু বন্ধ হয়নি। এখন অপেক্ষাকৃত বেশি সময়ের ব্যবধানে ঘটেই চলেছে। ক্রমেই আরও বেশি করে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে একদা জমজমাট অতি বিস্ময়কর শহরটা।

ক্রমেই প্যালেসের দিকে এগিয়ে আসছে বিস্ফোরণ। বোনের হাত চেপে ধরল লুই ব্লেজন। দুচোখে আতঙ্ক।

ওদিকে দমাদম ঘা পড়ছে লোহার দরজায়। দরজা ভাঙার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে উইলিয়াম ফার্নির লোকেরা। ওরা বুঝতে পারছে, ছাদ থেকে নামতে না পারলে নিশ্চিত মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না।

হঠাৎ প্রচন্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ হলো ছাদের ওপরে। থর থর করে কেঁপে উঠল ঘর।

কি, কি হলো? চোখ বড় বড় করে বোনের দিকে তাকাল লুই।

বোধ হয় কামান দেগে দরজার পাল্লা ভাঙার চেষ্টা করছে ব্ল্যাকগার্ডেরা।

সর্বনাশ! তাহলে!

মাত্র একটা ভেঙেছে। আরও পাঁচটা ভাঙতে হবে ওদের।

ঠিকই অনুমান করেছে জেন, কামানই ব্যবহার করছে ফার্নির লোকেরা। ঘড় ঘড় আওয়াজ শুনে বুঝল, ছাদ থেকে সিড়ি দিয়ে নিচে নামানো হচ্ছে কামান।

ওদিকে ক্রমেই আরও এগিয়ে আসছে রহস্যজনক বিস্ফোরণ। ভোর রাতের পর থেমে গিয়েছিল, আবার হট্টগোল উঠল হঠাৎ। এগিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিল জেন। ফ্যাক্টরির দরজাটা খুলে গেছে। পিলপিল করে লোক বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। শ্রমিক কর্মচারীর দল। ওদের ভিড়ে নিজের সঙ্গীদেরও দেখল জেন। কিন্তু ফ্যাক্টরির নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে মেরি ফেলোদের বন্দুকের মুখে কেন আসছে ওরা, বুঝতে পারল না।

দেখতে পেয়েছে মেরি ফেলোরাও। রাইফেল তুলে বিকট হুঙ্কার ছেড়ে ছুটে গেল ওরা শ্রমিক কর্মচারীদের দিকে।

কিন্তু নিরস্ত্র নয় ফ্যাক্টরির লোকেরাও। রাইফেল বন্দুক আছে ওদেরও। আবার শুরু হলো যুদ্ধ! লাশের পর লাশ গড়িয়ে পড়ল এসপ্ল্যানেডে। আবার রক্তনদী বইল।

দুহাতে চোখ ঢেকে জানালার কাছ থেকে সরে এল জেন। এ দৃশ্য দেখা যায় না।

সমরবিদ্যায় শিক্ষিত মেরি ফেলোরা। ওদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারল না ফ্যাক্টরির যন্ত্রবিদের দল ! ক্রমেই ওদের লাশের সংখ্যা বাড়তে লাগল। কিন্তু গুলি চালানো বন্ধ হলো না।

মরিয়া হয়ে ফ্যাক্টরির লোকজন আর সঙ্গীদের বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করল জেন। টলতে টলতে বোনকে সাহায্য করতে কোনমতে এগিয়ে গেল লুইও।

প্যালেসে ঢোকার প্রধান গেটটা খুলে দিল জেন। পেছনে পাল্লার আড়ালে থেকে সমানে গুলি চালিয়ে গেল মেরি ফেলোদের ওপর। মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে গুলি চালাতে লাগল লুই। যত সামান্যই হোক পেছন থেকে আক্রান্ত হয়ে একটু ঘাবড়ে গেল মেরি ফেলোরা। এই সুযোগে বেশ কয়েকজনকে শেষ করে দিল ফ্যাক্টরিবাসীরা।

হঠাৎই বুঝতে পারল মেরি ফেলোরা, ইস্পাতের পাল্লার ওপারে বড়জোর দুই কি তিনজন মানুষ আছে। ঘুরে দাঁড়িয়েই কয়েকজন ছুটে এল পাল্লার দিকে।

কিন্তু ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে আবার ইস্পাতের পাল্লা।

আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে
০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে
১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা
১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি
১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
পরের পর্ব :
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত