১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
তাই তো বলি, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন! দরজা জুড়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে হ্যারি কিলার, জিজ্ঞেস করলাম বলে কিনা, বন্ধুদের বাঁচাতে আমার কাছে এসেছে। আমাকে বিয়ে করার বিনিময়ে ছেড়ে দিতে হবে ওদের। তখনই সন্দেহ হলো। সিংহাসন ঘরের পেছনের দরজাটার দিকে হাঁ করে অনেকদিন চেয়ে থাকতে দেখেছি ওকে। ভাবলাম, দেখি টোপ ফেলে। ইচ্ছে করেই দিলাম চাবি ফেলে। ভাব দেখালাম যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। আর যা ভেবেছি, তাই-ই। কুৎসিত হাসি হাসল সে।
তোমার সঙ্গে বিয়ে! অবাক হলো লুই।
ঘরে এসে ঢুকল হ্যারি কিলার। জেনের দিকে তাকিয়ে বলল, অত সহজেই আমার চোখে ধুলো দেবে?
এক টানে পোশাকের ভেতর থেকে ছুরি বের করল জেন। হ্যারি কিলারের দিকে উঁচিয়ে ধরে চাপা হিসহিসে গলায় বলল, কাছে এসেছ কি মরেছ?
হাঁ হাঁ করে হাসল হ্যারি কিলার। গুড! ভেরি গুড! গোলাপ তুলতে গেলে কাঁটা ফুটবেই হাতে। কিন্তু কাটার ভয় আমি করি না, সুন্দরী।
কথা বলছে বটে, কিন্তু আর কাছে এগিয়ে আসছে না হ্যারি কিলার।
বাঁ হাতে ভাইকে জড়িয়ে ধরে দরজার দিকে এগোল জেন। হ্যা, হ্যারি কিলার, কাছে এলেই মরবে তুমি। কলজে বরাবর ছুরির একটা খোঁচা পাওনা হয়ে গেছে তোমার অনেক আগেই। যেদিন কৌবৌতে নিরপরাধ মানুষটিকে তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে হত্যা করেছ…।
কৌবৌ! চমকে উঠল যেন লুই, জর্জ যেখানে..
মারা গিয়েছেন। কথাটা শেষ করল জেন। বন্দুকের গুলিতে মারা যাননি তিনি। পেছন থেকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে। ছুরির বাটটা তাঁর কবরের ভেতরেই খুঁজে পেয়েছি আমি। তাতে হত্যাকারীর নাম খোদাই করা। জানো কে? এই শয়তান, পিশাচ হ্যারি কিলার।
নিজের অজান্তেই পিছিয়ে গেছে হ্যারি কিলার। ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে।
জানিস, জেন, বলল লুই, ওর আসল নাম কিন্তু হ্যারি কিলার নয়। নাম শুনলে চিনতে পারবি। তুই তখন খুব ছোট, আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ও। এ তোর ভাই, উইলিয়াম ফার্নি।
কি বললে? প্রায় একই সঙ্গে বলল জেন আর হ্যারি কিলার। হ্যাঁ, তাই। উইলিয়াম, এ তোমার ছোট বোন, জেন।
মাতলামি উধাও হয়েছে উইলিয়ামের চেহারা থেকে। আস্তে আস্তে ছুরি ধরা হাতটা নামিয়ে নিল জেন।
এক পা এগিয়ে এল উইলিয়াম, আমাকে ক্ষমা কর, বোন। প্রথম দিনই কেন নিজের পরিচয় দিসনি? কেন বলিসনি তুই লর্ড ব্লেজনের শেষের পক্ষের স্ত্রীর মেয়ে? তাহলেই তো আর খামোকা অপমান হতিস না। যাকগে, যা হবার হয়ে গেছে। আয়, আর কোন ভয় নেই তোর। আমার রাজত্বে আমারই মত সম্মানে থাকবি।
খবরদার! ধমকে উঠল জেন। আবার উঠে গেল ছুরি ধরা হাতটা এগোলেই ছুরি মারব। আমার ভাই নও তুমি। তোমার মত নরকের কীট আমার ভাই হতে পারে না। এসব মিথ্যে, সব মিথ্যে।
থমকে দাঁড়াল উইলিয়াম। তাহলে তুই আমাকে ভাই বলে স্বীকার করিস না?
ভাই! তোমাকে! ওয়াক থু করে মেঝেতে থু থু ফেল জেন, তোমাকে ভাই ডেকে দুনিয়ায় ভাই-বোনের সম্পর্কের সম্মান নষ্ট করব নাকি? আমার কাছে তুমি কিলার, স্রেফ হ্যারি কিলার। খুনে, শয়তান, পিশাচ, দানব, অমানুষ!
বটে! দাঁত কিড়মিড় করে বলল উইলিয়াম, আমার রাজত্বে দাঁড়িয়ে আমাকেই এত বড় কথা! দেখাচ্ছি মজা! রাগে ফুলছে সে। ধন ঘন ওঠানামা করছে বুক। কিন্তু তার আগে শোন, পুরো ব্লেজন পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়েছি আমি। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, জর্জকে আমিই খুন করেছি। কেন করব না? আমাকে কুকুরের মত বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার সময় তো তোর বাবার একটুও বাধেনি। তবে তার প্রতিশোধ আমি নিয়েছি। জর্জকে শুধু খুনই করিনি। সঙ্গে সঙ্গে তোদের পরিবারের সুনামও ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি। লোকে জানে, একভাই সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ করেছে। তারপর মরেছে। আরেক ভাই ব্যাংক লুট আর গার্ডকে খুন করে পালিয়েছে। এরপর ব্লেজন পরিবারের নামে ছি ছি করছে না লোকে?
কুৎসিত আনন্দ উইলিয়ামের চোখে-মুখে। ফেটে পড়ছে উল্লাসে।
আমি তো তাদের প্রাসাদ ছেড়ে চলেই এসেছিলাম। এখন? এখন তো আমার কাছে মরতে এসেছিস!
হা হা করে প্রাণখোলা হাসি হাসল উইলিয়াম। এক পা এগিয়ে এল। এখনও লুইকে জড়িয়ে ধরে আছে জেন। ছুরি ধরা হাতটা তেমনি উদ্যত।
আমাকে বাড়ি থেকে খেদিয়ে দেবার পর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, টাকা রোজগার করব। কোটি কোটি টাকা। তারপর প্রতিশোধ নেব তোর বাপের ওপর। ইউরোপের তাবৎ বড় বড় লোকের কোষাগার খালি করে দিলাম ডাকাতি করে। ব্যাংকের আয়রন সেফ লুট করলাম। এরপর তৈরি হলাম প্রতিশোধ নিতে।
খুঁজে বের করলাম জর্জ গাধাটাকে। এমন ভান করলাম, যেন অনুতাপে জ্বলে যাচ্ছি। আমার কথায় ভুলে গেল সে। তার খাবারে একটু একটু করে আফিম মিশিয়ে দিতে লাগলাম। তাই খেয়ে টং হয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকে জর্জ। এই সুযোগে তারই সেনাবাহিনীর সাহায্যে লুটপাট চালালাম। অবশ্যই কয়েকজন বাঁধা দিল। ওরা সব কজন খুন হলো। অন্যেরা মোটা টাকা খেয়ে বশ্যতা স্বীকার করল।
জর্জের নামে ছি ছি পড়ে গেল। তাকে দমন করার জন্যে সেনাবাহিনী এল। বুঝলাম, আর দেরি করা যায় না। সকলের অজান্তে ছুরি বসিয়ে দিলাম তার পিঠে। গোপনে নিজের হাতে কবর দিলাম। প্রচার হয়ে গেল, সেনাবািহনীর গুলিতে মারা গেছে জর্জ
জর্জের দলে থাকতেই পরিচয় হলো গাধা ক্যামারেটটার সাথে। তবে হ্যাঁ, লোকটার প্রতিভা আছে স্বীকার করতে হবে। তাকে নিয়ে চলে এলাম এই মরুভূমিতে। মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরাল সে ঊষর মরুতে। গোড়াপত্তন করলাম এই শহরের।
জর্জকে হত্যা করেই কিন্তু প্রতিশোধের আগুন কমেনি আমার। মাস পাঁচেক আগে আবার গেলাম লন্ডনে। ছদ্মবেশে। একটা ব্যাংক লুট করলাম। গার্ডকে খুন করলাম। ধরে নিয়ে এলাম লুইকে। আবার ছি ছি পড়ে গেল। লোকে ছি ছি করতে লাগল ব্যাংক লুট করে পালিয়েছে লুই ব্লেজন। খুনও করে গেছে একটা। ব্যস, একেবারে মেরুদন্ড ভেঙে গেল তোর বাবার।
অনেকদিন বাঁচিয়ে রেখেছি, আর না। কালই খুন করব লুইকে। আর তোকে কি করব জানিস? আমার সবচেয়ে নিচু জাতের নিগ্রো গোলামটার সঙ্গে বিয়ে দেব তোর। ছবি তুলব। সেই ছবি পাঠাব তোর বাবার কাছে। ইউরোপের সমস্ত খবরের কাগজে ছাপা হবে যুগল ছবি। এর পর সোজা আত্মহত্যা করবে তোর বাপ। পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ব্লেজন পরিবার। হা হা করে হেসেই চলল উইলিয়াম।
শুধু আজ, আজ রাতটা অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। তারপরই প্রতিশোধ নেয়া হবে। কালই…
ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দে থমকে থেমে গেল উইলিয়াম। কান পাতল।
আবার শোনা গেল বিস্ফোরণের শব্দ। এরপর তুমুল হৈ-চৈ-এর রব উঠল। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে যেন জনতা থেকে থেকেই। এরপর রাইফেল আর রিভলভারের গুলির শব্দ হতে লাগল।
কান খাড়া করে শুনছে উইলিয়াম ফার্নি। জেন বা লুইয়ের দিকে যেন কোন খেয়ালই নেই।
এই সময় দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল নিগ্রো গোলামটা। আতঙ্কে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ, মাস্টার! হাঁপাচ্ছে লোকটা। মাস্টার, শহরে আগুন লেগেছে।
বিচ্ছিরি গালাগাল দিতে দিতে ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। উইলিয়াম ফার্নি।
আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে
০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে
১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা
১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি
পরের পর্ব :
১৩. কিসের এত শব্দ
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন