মরুশহর: ১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি

মরুশহর: ১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি

১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি

ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি জানাই আছে জেনের। গত কয়েক দিন ফ্যাক্টরিতে থেকে থেকে অনেক কিছুই জেনে নিয়েছে সে। তাই বেরোতে কোন অসুবিধেই হলো না। অন্ধকার রাত। তাছাড়া ক্ষুধা তৃষ্ণা-উত্তেজনায় জেনের কথা মনেই নেই কারও। তাই অন্ধকার নামার পর, টোনগানের কাছ থেকে সিগন্যাল পাবার আগেই বেরিয়ে এল জেন।

মনস্থির করে নিয়েছে জেন, হ্যারি কিলারের কাছেই যাবে সে। আশা করছে বোঝাতে পারবে কিলারকে। জেনের কথা শুনবে হয়তো খুনেটা এবং তাহলেই ফ্যাক্টরির লোকগুলোকে না খাইয়ে মরার কবল থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।

ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে এসে দশ গজ এগোতেই মেরি ফেলোদের চোখে পড়ে গেল জেন। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল লোকগুলো। জেনকে চেনে ব্ল্যাকল্যান্ডের সবাই। স্বয়ং মাস্টারের হবু বধূ। সোজা কথা?

সোজা হ্যারি কিলারের কাছে নিয়ে যাবার আদেশ দিল জেন, মেরি ফেলোদের। সসম্মানে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে প্যালেসে।

নবরত্ব নিয়ে তখন মদের আসর বসিয়েছে হ্যারি কিলার। জেনকে ঢুকতে দেখে দশজনেরই চোখ ছানাবড়া। ব্যাপারটা কি?

নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না হ্যারি কিলার। জেনের পিছনে চাইল, পুরুষ সঙ্গীগুলোও আছে কিনা। না, নেই।

সংবিৎ ফিরে পেয়ে একলাফে উঠে দাঁড়াল নবরত্ন। কপালে হাত ঠেকিয়ে সম্মান জানাল।

তা একলা কেন? ঝুঁকে বসে জিজ্ঞেস করল হ্যারি কিলার।

বিয়ে তো একলাই করব। অন্যদের দিয়ে কি হবে? গলা কাঁপছে জেনের। না খেয়ে খেয়ে শরীর দুর্বল। উত্তেজনার চরমে পৌঁছেছে স্নায়ুমন্ডলী। দশজন লোকের রক্ত পানি করা লোলুপ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রথম ভাবল, ফ্যাক্টরি ছেড়ে এসে কাজটা ভাল করেনি সে।

তা ফ্যাক্টরি থেকেই তো এলে? জিজ্ঞেস করল হ্যারি কিলার।

হ্যাঁ।

কেন? রুক্ষ কর্কশ কণ্ঠ হ্যারি কিলারের। বুঝল জেন, আত্মাহুতি দিয়েও সঙ্গী এবং ফ্যাক্টরির লোকজনদের বাঁচাতে পারবে না।

রুদ্ধ স্বরে বলল, বললামই তো। নিজেকে সঁপে দিতে।

আঁ! চমকে উঠল যেন, হ্যারি কিলার। তাই নাকি? চমৎকার! নবরত্নের দিকে ফিরে বলল,তোমরা যেতে পারো এখন!

নোংরা হাসি হাসল নবরত্ন। টলতে টলতে বেরিয়ে গেল সব কজন।

চৌমোকি তো খন্ডবিখন্ড। নিজের চোখে দেখেছি টুকরোগুলো। আমাকে দেখানোর জন্যেই বুঝি পাঁচিলের এপারে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে? ভাল, ভাল। তা অন্য লোকটাকে কি করা হয়েছে?

চিকিৎসা করছেন তার ডক্টর চাতোন্নে।

যেটা বানিয়েছিল ক্যামারেট, হেলিপ্লেনটার কি অবস্থা?

ডিনামাইট মেরে ধ্বংস করে দিয়েছে চৌমৌকি।

গুড।… তারপর? তুমি এসেছ নিজেকে সঁপে দিতে? কারণ?

অন্যদের বাঁচাতে।

অসম্ভব। অর্থাৎ, সবকটার অবস্থা কাহিল হয়ে এসেছে? হাসল হ্যারি কিলার।

সবাই মরার পথে। চোখ নামিয়ে নিল জেন।

গুড! ভেরি গুড! এই তো চাইছিলাম! বিশাল এক গেলাসে মদ ঢেলে নিল হ্যারি কিলার। এক চুমুকে শেষ করল সবটুকু। চোখে-মুখে ঝরে পড়ছে বীভৎস আনন্দ।

এরপর? বলে যাও।

আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন? আমি রাজি। তবে এক শর্তে। আমার বন্ধুদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে। বলছে বটে, কিন্তু লজ্জায় অপমানে লাল হয়ে গেছে মুখ।

শর্ত আবার কিসের? তুমি না এলেও গাধাগুলোকে বের করে আনার ক্ষমতা আমার আছে। শুধু খেলা দেখছিলাম এতদিন। আগামীকালই ধরে এনে জবাই করতাম। বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল হ্যারি কিলার। অহংকারে ফেটে পড়তে চাইছে। টলতে টলতে জেনের দিকে কয়েক পা এগিয়ে এল, ওদের কথা বাদ দাও। তোমাকে কে বাঁচাবে এখন?

আস্তে আস্তে পিছু হটে গেল জেন। দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকতেই আঁতকে উঠল। একেবারে গায়ের উপরে এসে পড়েছে হ্যারি কিলার। নাক-মুখ দিয়ে ভক ভক করে মদের বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোচ্ছে! চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে জেনের কপালে।

হঠাৎই কি মনে করে দাঁড়িয়ে গেল কিলার। জেনের চোখে চোখে চাইল। ভয়ে কাঁপছে মেয়েটা, দেখে মজা লাগছে তার।

হাঁ হাঁ করে হাসল হ্যারি কিলার, বিয়ে করতে এসেছ। হবু স্বামীকে দেখে ভয় কি? এসো, কাছে এসে।

কিন্তু, কিন্তু এভাবে অপমান করছেন কেন? সাংঘাতিক কাপছে জেনের গলা।

অপমান! হঠাৎই যেন চৈতন্য হলো হ্যারি কিলারের। আচ্ছা ঠিক আছে। বিয়ে করব কিনা, ভেবে দেখব কাল। এখন এসো একটু ফুর্তি করা যাক।

এগিয়ে গিয়ে সিংহাসনে বসল হ্যারি কিলার। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল জেন। গেলাসে মদ ঢেলে দিতে শুরু করল। মাত্র পনেরো মিনিট। তারপরেই নাক ডাকাতে শুরু করল হ্যারি কিলার।

খুনেটার বুকে ছুরি বসিয়ে দেবার অদম্য ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রোধ করল জেন। এখনও সময় আসেনি। তার চেয়ে আগে বরং কিছু খেয়ে নেয়া যাক।

পাশের ঘরে চলে এল জেন। টেবিল ভর্তি প্লেটে প্রচুর খাবার। হ্যারি কিলারের রাতের খাবার পরও এখনও অন্তত দশজনের খাবার অবশিষ্ট আছে। গোগ্রাসে গিলতে লাগল জেন।

ক্ষুধা প্রশমিত হতেই আবার হ্যারি কিলারের বসার ঘরে ফিরে এল জেন। ঘুমের ঘোরে গড়িয়ে চেয়ারের উপরেই কাত হয়ে গেল হ্যারি কিলার। ঠং করে কি যেন একটা পড়ল মেঝেতে।

এগিয়ে গিয়ে দেখল জেন, একটা চাবি। হঠাৎই পেছনের দরজা দিয়ে ওই ঘরটায় হ্যারি কিলারের যাবার কথা মনে পড়ে গেল, রহস্যময় কাতরানি শোনা যায় যে ঘর থেকে।

কোনরকম ভাবনা চিন্তা না করেই মেঝে থেকে চাবিটা কুড়িয়ে নিল জেন। পেছনের দরজা খুলে ভেতরে পা দিল। প্রথমে একটা চাতাল, তারপর সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। পেছনে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আলোকিত সিঁড়ি বেয়ে আরেকটা চাতালে নেমে এল জেন। আরও গোটা কয়েক সিড়ি বেয়ে পাতাল-অলিন্দে। একটা দরজার সামনে বসে আছে একটা নিগ্রো গোলাম। জেনকে দেখেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। জানে সে, এই-ই তাদের ভাবী সম্রাজ্ঞী।

ইঙ্গিতে দরজা খুলে দিতে বলল জেন। একটু ইতস্তত করল নিগ্রো গোলাম। এই ঘর অন্য কারও জন্যে খোলা মানা। তারপর ভাবল, দরজা খুলে যখন এতদূরে এসেই পড়েছে জেন, নিশ্চয় হ্যারি কিলারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই এসেছে। নইলে চাবি পেল কি করে?

আর দ্বিধা না করে কোমর থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে দিল নিগ্রো। ভেতরে উকি দিল জেন। অন্ধকার।

আলো জ্বেলে দিতে বলল নিগ্রোকে জেন। সুইচ টিপতেই হঠাৎ আলোর ঝলকানি, ধড়মড়িয়ে খাটের ওপর উঠে বসল লোকটা। কংকালসার দেহ। মুখে, দেহে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা মুখ। আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে দুই চোখ।

কিন্তু তবু লোকটাকে চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না জেনের। তার ভাই, লুই ব্লেজন! পাঁচ মাস আগে ব্যাংক ডাকাতির পর নিরুদ্দেশ হয়েছিল।

ভাইয়া! দারুণ অবাক হয়ে ডাকল জেন।

জেন? লুইও কম অবাক হয়নি।

খাটের কাছে ছুটে গেল জেন। দুর্বল দেহ নিয়েও এক লাফে খাট থেকে নামল লুই। জড়িয়ে ধরল দুজনে দুজনকে। ফুপিয়ে কাঁদছে জেন। লুইয়ের চোখেও পানি।

কান্নার বেগ প্রশমিত হলে আলিঙ্গনমুক্ত হলো দুজনেই।

তুমি এখানে এলে কি করে, ভাইয়া? জিজ্ঞেস করল জেন।

পাঁচ মাস আগে। সেদিন তিরিশে নভেম্বর। ছুটির সময় হয়েছে। ব্যাংকে বসে আছি। এই সময়ই আমার রূমে এসে ঢুকল একজন আজব লোক। এসেই অতর্কিতে রদ্দা মারল ঘাড়ে। অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি, একটা বাক্সের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে আমাকে। হাত-পা বাঁধা। মুখে কাপড় গোঁজা।

কতদিন ছিলাম বাক্সের ভেতর জানি না। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর হয়ে গেলাম। তারপর একদিন বাক্স খোলা হলে দেখলাম, এই ঘরে আনা হয়েছে আমাকে। তারপর থেকেই রোজ অমানুষিক অত্যাচার করা হচ্ছে আমার ওপর।

কে, কে অত্যাচার করে?

ফ্যাল ফ্যাল করে জেনের পেছন দিকে তাকিয়ে রইল লুই। আতঙ্ক এসে আবার ভর করেছে দুই চোখে। ফিরে তাকাল জেন।

দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে লালজিহ্বা, কদাকার, রক্ত চক্ষু, কশ বেয়ে লালা গড়ানো এক নরদানব। স্বয়ং হ্যারি কিলার।

আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে
০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে
১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা
পরের পর্ব :
১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
১৩. কিসের এত শব্দ
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত