মরুশহর: ১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা

মরুশহর: ১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা

১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা

নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা। হাজারো ফন্দী-ফিকির করল সবাই বসে, কিন্তু দেশে ফিরে যাবার কোন সত্যিকারের সুরাহা করতে পারল না।

দুর্ভাবনায় পড়লেন মারসেল ক্যামারেটও। নতুন প্লেন তৈরি হতে কমপক্ষে দুমাস লাগবে। এদিকে খাবার রয়েছে মাত্র পনেরো দিনের।

আরও কিছু বেশি খাবার আছে কিনা জানার জন্যে হিসেব করতে নির্দেশ দিলেন সহকারীদের ক্যামারেট। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিসেব করা হলো। হায় ঈশ্বর। খাবার যে আরও কম, টেনেটুনে দিন দশেক চলতে পারে। উপায়?

কঠোর রেশনিং-এর ব্যবস্থা করে দিলেন ক্যামারেট। যতদিন বেশি চালানো যায়, লাভ।

তেরোই এপ্রিল সারাটা সকাল আর দুপুর গেল খাবারের হিসেব নিকেশ করতেই। এদিকে ডক্টর চাতোন্নের চেষ্টায় অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছে বোমার আঘাতে আহত লোকটা। বিকেলের দিকে তাকে নিয়ে পড়লেন ক্যামারেট। কথা আদায় করতে হবে।

কে তুমি? প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন ক্যামারেট।

জবাব নেই।

আবার প্রশ্ন করা হলো। কিন্তু বন্দী এক্কেবারে চুপ।

চুপ করে থেকে লাভ নেই। নরম গলায় হুঁশিয়ার করলেন ক্যামারেট, কথা বলিয়ে ছাড়ব আমি।

কিন্তু মারসেল ক্যামারেটের চেহারায় ভয়ের কিছুই দেখল না লোকটা। ব্যঙ্গের
হাসি হাসল।

হাসলেন ক্যামারেটও। সামনের টেবিলে রাখা নিজের ব্যাগটা খুললেন। পাতলা চারটে ধাতুর পাত বের করে বন্দীর হাত পায়ের চার বুড়ো আঙুল টেপ দিয়ে আটকালেন। তামার তার লাগালেন চারটে পাতের সঙ্গেই। তারপর পাশে দাঁড়ানো দুই সহকর্মীকে আদেশ দিলেন, ওর হাত-পাগুলো চেয়ারের হাতল আর পায়ার সঙ্গে বেল্ট দিয়ে আটকে দাও।

আদেশ পালন করল সহকারীরা।

মুচকে হাসলেন ক্যামারেট। ছোট একটা বাক্সের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে তারগুলো। বাক্সটার এক দিকের একটা সুইচ টিপে দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ধনুষ্টঙ্কার রোগীর মত বাঁকা হয়ে গেল বন্দীর শরীর। বার বার আক্ষেপে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। দড়ির মত ফুলে উঠল ঘাড়ের শিরা। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে ফর্সা মুখ। তীব্র যন্ত্রনায় গোঙাচ্ছে। বন্দীর দেহে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিয়ে দিয়েছেন ক্যামারেট।

পাঁচ সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন ক্যামারেট। তারপর সুইচ বন্ধ করে দিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কথা বলা হবে?

জবাব নেই।

আবার সুইচ টিপে দিলেন ক্যামারেট। আবার শরীর দোমড়াতে লাগল লোকটা। এবারে আরও বেশি। ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। ফুলে ফুলে উঠছে বুক। হাঁপানী রোগীর মত হাঁপাচ্ছে লোকটা।

সুইচ বন্ধ করলেন ক্যামারেট, আশা করি এবারে সুবুদ্ধি হয়েছে?

হ্যাঁ…হ্যাঁ…প্লীজ…আর না! কথাই বলতে পারছে না লোকটা। জোরে জোরে শ্বাস টানছে।

গুড। খামোকা কষ্ট পেলে। তা কি নাম তোমার?

ফারগুস ডেভিড।

নাম হলো নাকি এটা? এ তো দুটো ডাক নাম।

এই নামেই ডাকা হয় আমাকে ব্ল্যাকল্যান্ডে। আসল নাম জানার দরকার মনে করে না কেউ।

কিন্তু আমি মনে করছি।

ডানিয়েল ফ্রাসনে।

জাত?

ইংরেজ।

ব্ল্যাকল্যান্ডে কি কাজ করো?

কাউন্সিলর।

মানে বুঝলাম না পদটার?

ক্যামারেটের কথায় যেন অবাক হলো লোকটা, বলেন কি প্রফেসর? ব্ল্যাকল্যান্ডে আছেন, অথচ এদেশে কাউন্সিলর কাকে বলে জানেন না? হিজ ম্যাজেস্টিস হ্যারি কিলারের গভর্নর, যারা তার হয়ে দেশটা চালায়, তাদের বলে কাউন্সিলর।

তাহলে তুমি ব্ল্যাকল্যান্ড সরকারের একজন উচ্চপদস্থ লোক?

হ্যাঁ।

কবে চাকরিতে ঢুকেছ?

শহরের সৃষ্টির শুরু থেকে।

এর আগেই চিনতে হ্যারি কিলারকে?

হ্যাঁ।

এখানে আসার আগে কোথায় ছিলে, কি কাজ করতে?

ক্যাপ্টেন ব্লেজনের দলে।

নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল জেন। আর একজন লোক পাওয়া গেল, যে হ্যারি কিলার এবং তার ভাইকে চেনে।

ব্লেজনের দলে? জেরা চালিয়ে গেলেন ক্যামারেট। কিন্তু আমি চিনি না কেন তোমাকে?

কি জানি তা তো বলতে পারছি না। তবে আগের চেয়ে অনেক মোটা হয়েছি। চেহারারও কিছু পরিবর্তন হয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই।

মঁসিয়ে ক্যামারেট, কথা বলে উঠল জেন। কয়েকটা প্রশ্ন না করে আর থাকতে পারছে না সে, আমি কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

বেশ তো করুন।

হ্যারি কিলার এসে যোগ দেবার সময়ও ক্যাপ্টেন ব্লেজনের দলে আপনি ছিলেন? জিজ্ঞেস করল জেন।

ছিলাম। জবাব দিল ফ্রাসনে।

আপনি সব দেখেছেন?

দেখেছি।

ক্যাপ্টেন ব্লেজন নাকি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন হ্যারি কিলারকে? কেন?

তা তো জানি না।

ক্যাপ্টেনের দলে যোগ দেবার পরই কমান্ডার সেজে বসে ছিল হ্যারি কিলার, ক্যাপ্টেন ব্লেজনের পরিবর্তে, তাই না?

অনেকটা তাই। অবাক হলো ফ্রাসনে। অত কথা এই পুঁচকে মেয়েটা জানল কি করে?

খুন জখম, লুটতরাজ, গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা, ইত্যাদি সমস্ত অত্যাচার অনাচার হ্যারি কিলারের হুকুমে ঘটেছিল?

তাই-ই।

এতে কোন হাত ছিল না ক্যাপ্টেন ব্লেজনের?

না।

শুনেছেন তো আপনারা? সঙ্গীদের দিকে ফিরে বলল জেন, পরে কিন্তু সাক্ষ্য দিতে হবে। আবার বন্দীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, নিজের কর্তৃত্ব হ্যারি কিলারের হাতে ছেড়ে দিলেন কেন ক্যাপ্টেন ব্লেজন?

সেটা আমার জানার কথা নয়। প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে অধৈর্য হয়ে উঠেছে ফ্রাসনে।

কি করে মারা গেছেন ক্যাপ্টেন ব্লেজন, জানেন আপনি? আবার জিজ্ঞেস করল জেন।

যুদ্ধ করতে করতে।

চেপে রাখা শ্বাসটা ফেলল জেন। এভাবে প্রশ্ন করে লাভ নেই, বুঝল।

আমার কথা শেষ। ক্যামারেটের দিকে ফিরে বলল জেন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞেস করলেন ক্যামরেট, এ শহরে হাজার হাজার নিগ্রো গোলামি করছে। কোথেকে আনা হয়েছে এদের?

কেন, গ্রাম থেকে? ক্যামারেটের প্রশ্নটা যেন নেহাতই বোকামি হয়েছে, এভাবে জবাব দিল ফ্রাসনে।

এল কেন ওরা?

আসতে কি চায়! জোর করে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে।

এসব কান্ডই তাহলে করছে হ্যারি কিলার। মুখ কালো হয়ে গেছে। ক্যামারেটের, এই শহরে হাজার হাজার বিদেশী মেশিনপত্র আছে। কোন দেশের?

এ আবার কি প্রশ্ন! আপনি কি মনে করছেন চাঁদ থেকে আনা হয়েছে?

যা জিজ্ঞেস করছি, জবাব দাও। একটাও ফালতু কথা নয়, ইউরোপ থেকে?

হতে পারে।

কি করে এল?

ঠাট্টা করছেন? জানেন না কিছু? আরে সাহেব, জাহাজে এসেছে, জাহাজে।

এদিকে তো মাইলের পর মাইল মরুভূমি। এই পথটা জাহাজে আসেনি। তাহলে কোন বন্দরে মাল খালাস করা হয়েছে?

কোটানৌতে।

কোটানো থেকে ব্ল্যাকল্যান্ডে কারা বয়ে আনল?

নিগ্রোরা। উট আর ঘোড়ার সাহায্য নিয়েছে। ধৈর্য একেবারে শেষ। এসব বেহুদা প্রশ্নের জবাব দিতে আর ভাল লাগছে না ফ্রাসনের।

নিগ্রো, না? তাহলে পথে নিশ্চয় অনেক নিগ্রো মারা গেছে। যা দুর্গম পথ।

তা তো মরবেই। হাজার হাজার কালো কুত্তা মরেছে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। ডিম থেকে মাছির বাচ্চার মত কোটি কোটি জন্মায় ওরা।

রাগে জ্বলে উঠলেন ক্যামারেট। কিন্তু কণ্ঠস্বরটা আশ্চর্য রকম স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করলেন, মেশিনগুলো কিনে আনা হয়েছিল নিশ্চয়?

এ তো মহা মুশকিল দেখছি। ওরা কি আমাদের বাপ লাগে যে মুফতে দিয়ে দেবে?

তাহলে তো প্রচুর টাকা হ্যারি কিলারের?

তো? আপনার কি ধারণা? এত টাকা আছে, কোনদিন ফুরাবে না।

এল কোত্থেকে এত টাকা?

আর ধৈর্য রাখতে পারল না ফ্রাসনে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ন্যাকামি হচ্ছে? হেলিপ্লেনগুলো কেন বানিয়েছিলেন, জানেন না? ওই প্লেনে করেই আমাদের নিয়ে বিশাগো আইল্যান্ডস-এ যায় মাস্টার। সেখান থেকে জাহাজে করে ইউরোপ। তারপর আর টাকার চিন্তা। শুধু বুদ্ধি আর সাহস থাকলেই হলো। বড়লোকগুলোর ট্যাক আর ব্যাঙ্কের আয়রন সেফ খালি করতে কতক্ষণ? ইংল্যান্ডের প্রায় ব্যাঙ্কেই, হানা দিয়েছি আমরা।

লজ্জায় কারও দিকে চোখ তুলে চাইতে পারছেন না যেন ক্যামরেট। অমন একটা ডাকাতের সাগরেদী করেছেন এতদিন, ভাবতেই মাথা কাটা যাচ্ছে তাঁর। বন্দীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বছরে কবার যাও?

নাহ্, জালালেন! তা তিন চারবার তো যেতেই হয়।

শেষ কবে গেছ?

মাস চারেক আগে।

এবারে কোন ব্যাঙ্ক?

আমি যাইনি। শুনেছি ইংল্যান্ডের একটা ব্যাঙ্ক।

মাথা নিচু করে কি ভাবছেন ক্যামারেট। মনে হচ্ছে এক ধাক্কায় দশ বছর বয়েস বেড়ে গেছে। হঠাৎই মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, আপাতত কতজন নিগ্রোকে খাটানো হচ্ছে?

চার হাজারের ওপরে।

এদেরকে নিশ্চয় হাঁটিয়ে আনা হয়েছে?

না। এখন আর অত ঝামেলা করার দরকার হয় না। সোজা হেলিপ্লেনে করে তুলে নিয়ে আসা হয়।

লম্বা করে শ্বাস ফেললেন ক্যামারেট, ফ্যাক্টরিতে ঢুকলে কি করে কাল?

দ্বিধায় পড়ল ফ্রাসনে। জবাব দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে টেবিলে রাখা আজব বাক্সটার দিকে চোখ পড়ল। আর দ্বিরুক্তি না করে জবাব দিল, রিজারভয়েরের মধ্যে দিয়ে।

রিজারভয়েরের মধ্যে দিয়ে? অবাক হলেন ক্যামারেট।

গত পরশুর আগের দিন ওয়াটার গেট বন্ধ করা ছিল; পানি তুলতে পারেনি পাম্প এবং এতে পাম্পের পিস্টনের ক্ষতি হবার কথা। হয়তো হয়েছিলও, নাকি?

ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন ক্যামারেট।

এতে প্যালেসের রিজারভয়ের খালি হয়ে যায়। কারণ প্যালেস রিজারভয়েরে পানি আসে এসপ্ল্যানেডের ওয়াটার পাইপ দিয়ে। এটার যোগাযোগ আছে ফ্যাক্টরির সাথেও। কারেন্ট বন্ধ করে দিতেই পানি আসা বন্ধ হয়ে গেল প্যালেসে আপনার পাম্পও বন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে, পিস্টন নষ্ট হয়ে ফলে শুকিয়ে গেল ওয়াটার পাইপ। এর ভেতর দিয়ে তখন আমার আর চৌমৌকির আসতে কোন অসুবিধেই হয়নি।

হু? আর প্রশ্ন করলেন না ক্যামারেট।

১৪ এপ্রিল। ফ্যাক্টরি ঘিরে পাহারা দিচ্ছে মেরি ফেলো।

এসপ্ল্যানেড় আর সার্কুলার রোডে গিজ গিজ করছে ওরা। ফ্যাক্টরির ভেতরের লোকেদের খাবার না ফুরানো পর্যন্ত থাকবে, বোঝাই যাচ্ছে।

সাঁঝের দিকে একটা মতলব এল আমিদী ফ্লোরেন্সের মাথায়। টোনগানের সঙ্গে পরামর্শ করল। তারপর সঙ্গীদের নিয়ে গেল ক্যামারেটের কাছে। জরুরী আলোচনা করবে।

ফ্রাসনেকে জেরা করার পরই যে নিজের ঘরে চলে গিয়েছেন ক্যামারেট, আর বেরোননি। একটা কথাই বার বার খেচাচ্ছে তাকে, তারই জন্যে ব্ল্যাকল্যান্ড সৃষ্টি হয়েছে। হয়েছে অত অনাচার। লুট হয়েছে ব্যাংক। খুন হয়েছে হাজার হাজার লোক। নিপীড়িত হয়েছে, হচ্ছে অগুনতি নিগ্রো।

ঘরে ঢুকেই বেয়ারার কাছে জানল ফ্লোরেন্স, ফ্রাসনেকে জেরা করে আসার পর থেকে একটা দানাও মুখে তোলেননি ক্যামারেট। তাই আগে খাবার আনিয়ে জোর করে খাওয়াল তাকে। তারপর বলল, এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাবার একটা উপায় বের করেছি।

কি?

আমাদের হাতেও প্রচুর সৈন্য আছে।

আঁ! কিছুই বুঝতে পারলেন না ক্যামারেট।

কেন চার হাজার নিগ্রো দাস? মেয়ে দাসের সংখ্যাও দেড় হাজার।

কিন্তু ওদের হাতে অস্ত্র কোথায়? কথা বললেন এবারে বারজাক।

ওদের সঙ্গে আগে কথা বলতে হবে। তারপর অস্ত্র চালান দিতে হবে।

বলা সোজা।

কাজেও সোজাই।

যেমন?

যেমন আগে যোগাযোগ করতে হবে। টোনগানেকে দিয়েই করাতে হবে। কাজটা।

কিন্তু টোনগানে যাবে কি করে? ফ্যাক্টরি তো ঘিরে রেখেছে মেরি ফেলোরা?

সদর দরজা দিয়ে তো আর বেরোচ্ছে না। যাবে সার্কুলার রোড আর পাঁচিলের তলা দিয়ে। বলে ক্যামারেটের দিকে তাকাল ফ্লোরেন্স।

গভীর চিন্তায় মগ্ন বিজ্ঞানী।

ডাকল ফ্লোরেন্স, একটা সুড়ঙ্গ বানিয়ে দিতে পারবেন না, মঁসিয়ে ক্যামারে? ফ্যাক্টরি আর টাউনের তলা দিয়ে সার্কুলার রোড পেরিয়ে গিয়ে খোলা মাঠে উঠবে সুড়ঙ্গের মুখ?

সোজা কাজ। মাথা তুললেন ক্যামারেট।

কয় দিন লাগবে?

এটাই ভাবছিলাম এতক্ষণ। আবার কি ভাবলেন ক্যামারেট। মেশিনের সাহায্যে কাটতে সুবিধে হবে। সময়ও লাগবে কম। অমন মেশিন বানিয়ে নিয়ে সুড়ঙ্গ কাটতে… তা, দিন পনেরো তো লাগবেই।

তার মানে এমাস শেষ হবার আগেই হয়ে যাবে?

যাবে।

আবার চাঙা হয়ে উঠেছে ক্যামারেটের মস্তিষ্ক। সমাধান পেয়ে গেছেন। আবার কমে আসছে যেন বয়েস।

আরেকটা ব্যাপার, বলল ফ্লোরেন্স, সুড়ঙ্গ খুঁড়তে নিশ্চয়ই সব লোক দরকার নেই আপনার?

অনেককে দরকার।

বাকি যারা থাকবে তাদের সাহায্যে পনেরো দিনে তিন চার হাজার অস্ত্র বানানো যাবে?

আগ্নেয়াস্ত্র সম্ভব না।

ছুরি, তরোয়াল, কুঠার, গদা, বল্লম?

সম্ভব।

নিগ্রোদের কোয়ার্টারে এসব অস্ত্র পাঠানো সম্ভব হ্যারি কিলারের চোখ এড়িয়ে?

শক্ত কাজ। আবার কি ভাবলেন ক্যামারেট, তবে অসম্ভব নয়। রাতের অন্ধকারে পাঠাতে হবে।

চেপে রাখা শ্বাসটা বড় করে ফেলল ফ্লোরেন্স, তাহলে বেঁচে গেলাম। আমার প্ল্যান শুনুন। সুড়ঙ্গ পথে মাঠে বেরিয়ে যাবে টোনগানে। ভোর হলে, নিগ্রোরা মাঠে আসতে শুরু করলেই দলে ভিড়ে যাবে ও। সেই রাতেই শহরে ঢুকবে অন্যদের সঙ্গে। হ্যারি কিলারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলবে নিগ্রোদের। এমনিতেই বারুদ হয়ে আছে ওরা। আগুনের ফুলকির ছোঁয়া লাগলেই বিস্ফোরণ ঘটবে। এর পর আমাদের দায়িত্ব শুধু ওদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া।

আর কোন কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করলেন না ক্যামারেট। সামনের টেবিলে গিয়ে নকশা আঁকতে বসে পড়লেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাটি খোড়ার মেশিন তৈরি করতে হবে।

ঘর থেকে বেরিয়ে এল অভিযাত্রীরা। আবার হাসি ফুটেছে মুখে। চমৎকার পরিকল্পনা করেছে সাংবাদিক।

নতুন করে হেলিপ্লেন তৈরির কাজে লেগেছিল ফ্যাক্টরি ওয়ার্কাররা। সে-কাজ বাদ দিয়ে দিল। অন্য কাজে হাত লাগাল এবার। একদল হাত লাগাল অস্ত্র তৈরির কাজে। অন্যদল মাটি খোঁড়ার মেশিন তৈরিতে।

দ্রুত এগিয়ে চলল কাজ।

অদ্ভুত এক মেশিন তৈরি করে নিল তারা প্রফেসর মারসেল ক্যামারেটের সহায়তায়। ইস্পাতের এক বিশাল শংকু। পনেরো ফুট লম্বা, চার ফুট চওড়া। সারা শরীরে পেঁচানো খাজ কাটা, ঠিক যেন একটা অতিকায় স্ক্রু। ভেতরে বসানো একটা মোটর বন বন করে ঘোরাবে স্কু-র সামনের দিকটা। মাটি কেটে ঢুকে যাবে চোখা মাথাটা। আলগা মাটি স্কু-র দেহের ভেতরের পাইপ দিয়ে পেছনে চলে আসবে। কেঁচোর মলত্যাগ করার মত বেরিয়ে যাবে বাইরে। ফলে দ্রুত মাটির আরও গভীরে এগিয়ে যাবে বিশাল স্ক্রুটা। প্রফেসরের অকল্পনীয় ক্ষমতাশালী ব্রেনের আরেকবার তারিফ করল অভিযাত্রীরা।

ফ্যাক্টরির পাঁচিলের ধার ঘেঁষে গাঁইতি কোদালের সাহায্যে বিশাল এক কুয়ো খুঁড়ে ফেলা হয়েছে আগেই। ওই কুয়োর ভেতরে এবারে নামিয়ে দেয়া হলো যন্ত্রটা। মোটর চালু করতেই মাটিতে কামড় বসাল অতিকায় যন্ত্র দ্রুত ঢুকে যেতে লাগল মাটির গভীরে।

সাংঘাতিক দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল কাজ।

তিরিশ তারিখ নাগাদ মাঠের তলায় এসে গেল স্ক্রু। এবারে মাটি খুঁড়ে বের করতে হবে। কাজটা করা হবে রাতের অন্ধকারে। যেন কারও চোখে না পড়ে। খোলা মাঠে নয়, একটা ছোট ঝোপের ভেতর দিয়ে খোলা হবে সুড়ঙ্গ মুখ, ঠিক করা হলো। ওদিকে অস্ত্র তৈরির কাজও প্রায় শেষ।

আরেকটা জিনিস শেষ হয়েছে তিনদিন আগেই। খাবার। ক্ষুধার জ্বালা সবচেয়ে বড় জ্বালা। মানুষের পাথর কঠিন বিশ্বাসে চিড় ধরাতে যথেষ্ট। মারসেল ক্যামারেটকে যারা দেবতাজ্ঞানে পুজো করত এতদিন, তাদের অটল বিশ্বাসেও চিড় ধরতে আরম্ভ করেছে। সংশয় দেখা দিয়েছে মনে। সত্যিই কি তাদের বাঁচাতে পারবেন অসামান্য প্রতিভাশালী লোকটা?

জেনের ওপরই বেশি চটে গেল ফ্যাক্টরির ওয়ার্কাররা। ভালই তো ছিল তারা। এই জেন হ্যারি কিলারকে বিয়ে করতে না চাওয়ায়ই তো এত বিপত্তি। বাচ্চাকাচ্চাগুলো পর্যন্ত ক্ষুধায় মৃতপ্রায় হয়ে গেছে।

জেনের কানেও এসে পৌঁচেছে কানাঘুসো। ওয়ার্কারদের হাবভাব, বাঁকা চাহনি, চাপা কথা শুনে পরিষ্কার বুঝতে পারছে, তাদের দুরবস্থার জন্যে তাকেই দায়ী করছে ওরা।

ঠিক করল জেন, হ্যারি কিলারের কথাই শুনবে। অন্তত এই নিরপরাধ লোকগুলো তো বাঁচবে এতে। কিন্তু শুনেই চেঁচিয়ে উঠল সেন্ট বেরেন। রেগে উঠে চেঁচাতে লাগল আমিদী ফ্লোরেন্স। খেপে গেলেন বারজাক। এই হারে ভাবনা চিন্তা করলে ঠিক কতদিনে জেন ব্লেজনের শরীরে আর এক ছটাক মাংসও থাকবে না, হিসেব করে বার করে ফেললেন পঁসি। কথাটা ডাক্তারকে শোনাতে যেতেই সোজা হাঁকিয়ে দিলেন চাতোন্নে, যান তো, মঁসিয়ে। দেখুন গিয়ে, অঙ্ক দিয়ে নিজের পেট ভরাতে পারেন কি না।

রাগ করলেন না পঁসি। কিন্তু বুঝতেও পারলেন না, হিসেব শুনিয়ে এমন কি অন্যায় করেছেন তিনি। জেনের প্রতি সহানুভূতি দেখাতেই হিসেবটা তিনি করেছেন। তাতে অমন কি দোষ হলো? মনে মনে স্থির নিশ্চিত হলেন, দুনিয়ার তাবৎ ডাক্তারগুলোর মাথা খারাপ।

জেনকে যেতে দেয়া হলো না কিছুতেই! সুড়ঙ্গও খোঁড়া হয়ে গেছে। এখন আর নিজেকে আহুতি দেয়ার কোন মানেই হয় না।

সাঁঝ হলো। আবার চালু করা হলো স্ক্রু। বন বন করে মাটি কেটে উপরের দিকে উঠে গেল যন্ত্রটা ঠিক যেখানে অনুমান করা হয়েছিল একটা ঝোপের ভেতরে বেরিয়ে এল মাটি খুঁড়ে।

সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পালা শেষ। এবারে আসল কাজ। সেই রাতেই যথারীতি কর্তব্য কর্ম বুঝিয়ে দিয়ে নিগ্রোদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে পাঠানো হলো টোনগানেকে।

১ মে সকাল থেকেই আরম্ভ হলো প্রতীক্ষ। কোন খবর নেই। সংকেত এল না ২ মে-ও। ধরা পড়ে গেল না তো টোনগানে? দমে গেল সবাই। কিন্তু আশা ছাড়ল না। আকাশে এখন শুক্লপক্ষের চাঁদ। হয়তো অন্ধকারের আশায় আছে টোনানে?

৩ মে সকাল থেকেই আকাশে মেঘ। রাতে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল চাঁদ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবাই আশা করল, আজ সাড়া দেবে টোনগানে। কিন্তু বৃথাই।

দুশ্চিন্তা আরও চেপে বসল ফ্যাক্টরিবাসীর মনে। ভেগে গেল না তো টোনগানে? নাকি ধরাই পড়ল।

৪ মে। সময় আর কাটতেই চায় না। ক্ষুধায় স্কুলে যাচ্ছে পেট। টোনগানেরও সাড়া নেই।

৫ মে। অবস্থা আরও শোচনীয়। না খেয়ে থেকে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে ফ্যাক্টরিবাসী। সারাক্ষণই কাঁদছে বাচ্চারা। অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাচ্চারা কাঁদার শক্তিও হ্যারিয়েছে। ছুটোছুটি করছে মায়েরা। পুরুষদের কাছে জানতে চাইছে, খাবার পেতে আর কত দেরি। এখানে সেখানে জটলা করছে শ্রমিক-কর্মচারীরা। ওয়ার্কশপে কেউ নেই। কাজকর্ম বন্ধ। আর বড়জোর আটচল্লিশ ঘণ্টা এই। পরিস্থিতিতে কাটলে আত্মসমর্পণ করে বসবে ওরা। কিন্তু তাহলেও কি রক্ষা আছে? ধরে ধরে জবাই করবে সব কজনকে হ্যারি কিলার। যত নষ্টের মূল ওই জেন মেয়েটা। আহা, রূপের কি গুমোর! কেন বাপু, এমন কি খারাপ হ্যারি কিলার? তাছাড়া ব্ল্যাকল্যান্ডের মত অমন একটা শহরের সম্রাট সে। অনেক মেয়েই তাকে স্বামী হিসেবে পেলে বর্তে যাবে।

শুনিয়ে শুনিয়েই জেনকে গালাগালি করতে লাগল শ্রমিকেরা। অনুশোচনায়, লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো জেনের।

সকাল থেকেই টোনগানের সিগন্যালের প্রতীক্ষায় আছে ফ্যাক্টরিবাসী। এক একটা মুহূর্ত এ একটা যুগ বলে মনে হচ্ছে। সময় আর কাটতেই চায় না। ধুকে ধুকে শেষ পর্যন্ত গেল দিনটা। রাত এল। আকাশে ঘন মেঘ আজও। সাতটা বাজল, আটটা। কিন্তু কই, কোনরকম সাড়া তো দিচ্ছে না টোনগানে?

সাড়া এল শেষ পর্যন্ত। নিবিড় আঁধারে টিমটিম করে জ্বলে উঠল একটা লণ্ঠনের আলো। নিগ্রো কোয়ার্টারের পাঁচিলে বসে সিগন্যাল দিচ্ছে টোনগানে। আনন্দে দুলে উঠল সবার মন। দুঃখের দিন শেষ হতে চলেছে।

টাওয়ারে আগেই একটা বিচিত্র কামান তুলে রাখা হয়েছে। এখন সেটা দাগা হলো। একটা বিশাল কাঠের গোলা উড়ে গেল নিগ্রো কোয়ার্টার লক্ষ্য করে। পেছনে লেজের মত লম্বা দড়িটাও ছুটল টান টান হয়ে। নিগ্রো কোয়ার্টারের পাঁচিলে আটকে ফ্যাক্টরির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে দড়ির সেতু তৈরি হবে। কিন্তু জায়গামত গিয়ে পড়বে তো গোলাটা?

এই দড়ির সেতুর ওপরই নির্ভর করছে সব। তাই কামান দাগার ভার নিয়েছেন মারসেল ক্যারেট নিজে। কত কোণ করে, কতখানি হাওয়ার চাপে কামান দাগলে ঠিক জায়গায় গিয়ে পড়বে গোলা, আগেই হিসেব করে বের করে রেখেছেন।

পাঁচিলের ওপারে গিয়ে পড়ল গোলা। ঢিল হয়ে গেল দড়ি। তবে কি ঠিক জায়গা মত পড়েনি? হতাশ হলেন ক্যামারেট। আবার কামানে গোলা পুরে তৈরি হচ্ছেন, এমনি সময়ে টান টান হয়ে গেল দড়ি। নাহ ঠিক জায়গা মতই পড়েছে। পাঁচিলের ওপাশে নিশ্চয় মাটিতে গাড়া কোন খুঁটির সঙ্গে দড়ির মাথা বেঁধে দিয়েছে টোনগানে।

এই দড়িকে নির্ভর করেই বানানো হলো অপেক্ষাকৃত সরু দড়ির কপিকল! ওপাশ থেকে টানলে মালের বোঝা নিয়ে চলে যাবে সরু দড়িতে বাঁধা জালের ঝোলা। এপাশ থেকে টানলেই আবার ফিরে আসবে। প্রথমেই পাঠানো হলো বিশাল এক বান্ডিল বারুদ। তারপর একে একে গেল চার হাজার বল্লম, তরোয়াল, কুঠার, গদা। খুবই দ্রুত কাজ সারতে হলো। কখন আবার হ্যারি কিলারের লোকের চোখে পড়ে যায়। রাত এগারোটা নাগাদই অস্ত্র পাঁচার শেষ হয়ে গেল।

নিজেরা তৈরি হতে শুরু করল এবার ফ্যাক্টরিবাসীরা। যে যা অস্ত্র পেল, হাতে তুলে নিল। মেয়েরাও বাদ গেল না। ফ্যাক্টরির সদর দরজার সামনে এসে হাজির হলো সবাই।

বারজাক, চাতোন্নে, সেন্ট বেরেন, আমিদী ফ্লোরেন্স, এমনকি পঁসি পর্যন্ত হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। এমন সময় খেয়াল হলো সবার, তাই তো, জেন কই?

ফ্যাক্টরির সমস্ত জায়গায় তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো তাকে। কিন্তু কোথাও নেই মেয়েটা।

যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে জেন ব্লেজন।

আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে
০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে
পরের পর্ব :
১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি
১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
১৩. কিসের এত শব্দ
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত