মরুশহর: ০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে

মরুশহর: ০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে

০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে

বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে নিজেই বিপদে পড়ল হ্যারি কিলার। বন্ধ হয়ে গেল চাষের মেশিন, পাইলনের চুড়ো থেকে আর ছুটছে না ওয়েভ। বন্ধ হয়ে গেল পানির পাম্প। দুটো পাম্পের একটা ফ্যাক্টরির ভেতরে। পাম্প বন্ধ হতেই দেখতে দেখতে খালি হয়ে গেল রিজারভয়ের। কিন্তু নদী থেকে পানি এসে খালি জায়গা পূরণ হচ্ছে না। রাতের বেলা অন্ধকার হয়ে রইল ব্ল্যাকল্যান্ড।

বাধ্য হয়ে ১০ এপ্রিল ফের কারেন্ট চালু করে দিল হ্যারি কিলার। ফোন করল মারসেল ক্যামারেটকে। অনেক বলে কয়ে একটা রফা করে লি। বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখবে হ্যারি কিলার, বিনিময়ে শহরের সমস্ত কলকব্জা চালু রাখার ভার ক্যামারেটের।

দুপুর নাগাদ আরও কিছু চাইল হ্যারি কিলার। অবশ্যই অতি বিনয়ের সঙ্গে। বন্দীদের ফেরত চাইল সে। সোজা না করে দিলেন ক্যামারেট। চল্লিশটা হেলিপ্লেনের জন্যে তরল বাতাস চাইল কিলার। ফুরিয়ে গেছে নাকি। আবার না করলেন ক্যামারেট। নিজেরই দরকার এখন তার তরল বাতাস। তাছাড়া বাতাস দিয়ে বিপদে পড়বেন নাকি? উড়ে এসে ফ্যাক্টরির ওপর বোমা ছুঁড়তে শুরু করবে কিলারের লোকেরা। ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করবে বন্দীদের।

ক্যামারেটের না না শুনে আর রাগ দমিয়ে রাখতে পারল না হ্যারি কিলার। খেপে গিয়ে টেলিফোনেই চেঁচাতে লাগল, তার কথা না শুনলে ফ্যাক্টরিসুদ্ধ লোককে উপোস করিয়ে রাখবে। প্রাণখোলা হাসি হেসে লাইন কেটে দিলেন ক্যামারেট।

তাঁর সঙ্গে কিন্তু হাসিতে যোগ দিতে পারল না বন্দীরা। বাইরে থেকে হ্যারি কিলার ফ্যাক্টরি অবরোধ করিয়ে রাখলে একদিন তো জমানো খাবার শেষ হয়েই যাবে। তখন? বোলতা বাহিনী হয়তো ফ্যাক্টরির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেবে না মেরি ফেলোদের, কিন্তু খাবার তো জোগাড় করতে পারবে না।

ক্যামারেটকে জিজ্ঞেস করলেন বারজাক, কতদিনের খাবার মজুত আছে ফ্যাক্টরির গুদামে?

ঠিক জানি না, জবাবটা এড়িয়ে গেলেন ক্যামারেট, তবে দুতিন সপ্তার বেশি।

সর্বনাশ! তাহলে? ঘাবড়েই গেলেন বারজাক।

অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? অভয় দিলেন ক্যামারেট, আগামী দুদিনের মধ্যে একটা হেলিপ্লেন তৈরি হয়ে যাবে। তারপর বারো তারিখে রাতেই মহড়া দেয়া হবে।

তা না হয় হলো। আশঙ্কা একটুও কমল না বারজাকের। কিন্তু একটা প্লেনে করে ফ্যাক্টরির সমস্ত লোককে নিরাপদ জায়গায় চালান করতে পারবেন? লোকসংখ্যা কত ফ্যাক্টরির?

মেয়েদের আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শদেড়েক, বললেন ক্যামারেট। একবারে দশজনের জায়গা হবে এই প্লেনটায়। এখান থেকে আকাশপথে সায়ের দূরত্ব দুশো মাইল, টিম্বকটু চারশো। পনেরো বারে মোট দেড়শো লোককে-সায়ে পৌছাতে হেলিপ্লেনের লাগবে পাঁচদিন। যদি টিম্বাকটু যেতে চান, দিন আটেক।

একটু স্বস্তি পেলেন বারজাক। খুব একটা খারাপ প্ল্যান নয়।

মাত্র দুটো দিনই যেন কাটতে চায় না আর। সবাই নানা রকম চিন্তায় চিন্তিত, একজন ছাড়া। মঁসিয়ে পঁসি। সারাক্ষণই বাগানের ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলোর মাপ নিচ্ছেন ভদ্রলোক, আর কি সব হিসেব লিখছেন ডায়ারিতে। চাতোন্নে আর ফ্লোরেন্স জিজ্ঞেস করে জানল, পরিসংখ্যানবিদ অঙ্ক কষে দেখছেন, ওইটুকু জায়গায় যদি অত সব্জী ফলে তো গোটা নাইজারে কতটা জন্মানো যাবে এবং তাহলে কত লোকের ঠাই হওয়া সম্ভব। পুরো হিসেবটাই শুনতে হলো ডাক্তার আর সাংবাদিককে। পঁসির হিসেব মতে, প্রতিদিন বারো কোটি বারো হাজার টন সব্জী ফলবে নাইজারে। জন পিছু কত সব্জী লাগবে জানা থাকলে এই পরিমাণ খাবারে কতজন লোকের চলবে, হিসেবটা খুব সোজা। হিসেবটা শুনিয়েই দিতে চাইলেন পঁসি। কিন্তু গম্ভীর মুখে সরে এলেন ডাক্তার আর সাংবাদিক। আড়ালে এসেই ফেটে পড়লেন অট্টহাসিতে।

ব্যাটা ভাড়া, বললেন চাতান্নে।

এদিক ওদিক তাকিয়ে জিভ কাটল ফ্লোরেন্স, আস্তে বলুন, ডাক্তার। মঁসিয়ে পঁসি না আবার শুনে ফেলেন। তাহলে কজন ভাড় থাকা সম্ভব পৃথিবীতে, শুরু করে দেবেন হিসেব।

খুব ধীরে কাটছে বন্দীদের সময়। ইতোমধ্যেই একটা ঘটনা ঘটল। হঠাৎই খারাপ হয়ে গেল পাম্প। খুব খারাপ সংবাদ। পাম্প খারাপ হয়ে গেলে পানি পাওয়া যাবে না। ব্যাপার কি? শোনা গেল, পানি টেনে তোলার ক্ষমতা হ্যারিয়েছে পাম্প।

পিস্টন খারাপ হয়ে গেছে হয়তো। খুলে দেখার আদেশ দিলেন ক্যামারেট। খোলা হলো। সত্যিই ৷ পিস্টনই। তবে এমন কিছু নয়। সামান্য জখম হয়েছে। অল্প সময়েই সারিয়ে নেয়া যাবে।

পরদিন সকালে বাগানে এসে জমায়েত হলো বন্দীরা। কথা রেখেছেন ক্যামারেট। ঠিক সময় মত তৈরি হয়ে গেছে হেলিপ্লেন।

ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল এঞ্জিনীয়ার। এঞ্জিন চালু করল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ভর করে শূন্যে উঠে পড়ল আকাশযান। ক্রমেই উঠে গেল আরও উঁচুতে। ফ্যাক্টরির আকাশে বার কয়েক চক্কর মেরে আবার নেমে এল ধীরে ধীরে। দশজন। লোক নিয়ে আবার উঠল। আবার নেমে এল নিরাপদে। আর ভাবনা নেই। এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল।

আজ রাত নটায় যাত্রা করবে প্রথম ফ্লাইট। ঘোষণা করলেন ক্যামারেট।

একটা বিশাল পাথর যেন নেমে গেল বন্দীদের বুকের উপর থেকে। স্বস্তির শ্বাস ফেলল সবাই। হাসি ফুটেছে মুখে। আগামী সকালেই হয়তো টিম্বাকটু চলে যেতে পারবে তারা।

ওদিকে পাম্প সারানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে শ্রমিকেরা। পালাতে হবে। ঠিক। কিন্তু তাই বলে ফ্যাক্টরির কাজকর্ম বন্ধ রাখার কোন মানে হয় না। কে জানে, আবার নতুন কোন বিপদ দেখা দিতে পারে। হয়তো আর যাওয়াই হলো না, ফ্যাক্টরি ছেড়ে।

পিস্টন ঠিকঠাক করে আবার লাগানো হলো।

সাড়ে আটটা বাজতে বাগানে এসে হাজির হলো বন্দীরা। চাঁদ ওঠেনি। চারদিক অন্ধকার। গা ঢাকা দিয়ে উড়ে যাবে হেলিপ্লেন। প্রথম ফ্লাইটে যাবে বন্দীরা আটজন আর দুজন ফ্যাক্টরি কর্মচারীর স্ত্রী। সবাই হাজির।

ফ্লাইট টেস্টের পর আবার ছাউনিতে ভরে রাখা হয়েছিল হেলিপ্লেন। বের করে আনার হুকুম দিলেন ক্যামারেট। বারোজন শ্রমিক গিয়ে দরজা খুলল ছাউনির।

বিপর্যয়টা ঘটল ঠিক এই সময়ই।

ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম সকলের। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাটিতেই বসে পড়ল কেউ কেউ।

সংবিৎ ফিরে পেয়ে ছাউনির দিকে এগিয়ে গেল সবাই।

মাটির সঙ্গে মিশে গেছে ছাউনি। সেই সঙ্গে হেলিপ্লেন।

কি করে ঘটল অঘটনটা?

মুখ আঁধার হয়ে গেছে বন্দীদের। ফ্যাক্টরির লোকেরাও চিন্তিত। কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না একজন লোক।

মারসেল ক্যামারেট !

রাবিশ সরাও। হুকুম দিলেন তিনি। কি করে ঘটল এটা, জানতে হবে।

রাবিশ সরিয়ে পরিষ্কার করতে করতে রাত এগারোটা বেজে গেল। যেখানে হেলিপ্লেনটা ছিল, মাটিতে বিশাল এক গর্ত।

ডিনামাইট। শান্ত স্বরে বললেন ক্যামারেট, কিন্তু উড়ে আসেনি নিশ্চয়। তাহলে?

পাওয়া গেল উত্তর খুঁজতে খুঁজতে একটা ছেড়া হাত পাওয়া গেল। কোন এক নিগ্রোর। থেঁতলে যাওয়া মুন্ডু আর শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গেরও কিছু কিছু হদিস মিলল।

মুন্ডুটা থেঁতলে গেলেও চেহারাটা তুলনামূলকভাবে বিকৃত হয়েছে কম। জোরাল আলোয় ভাল করে দেখে নিয়ে থমথমে গলায় বলল ফ্লোরেন্স, চৌমৌকি বিশ্বাসঘাতক, শয়তান।

কিন্তু ঢুকল কি করে চৌমৌকি? রহস্যটা বার করতে না পারলে আরও মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারে।

আরও খোঁজা হলো রাবিশের মধ্যে। আরও গভীরে যেতে আর একটা দেই পাওয়া গেল। শ্বেতকায়। অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো দেহের সঙ্গে জোড়া লাগানোই আছে তার। শুধু কাধের কাছে হাড় ভেঙেছে। পাজরের হাড়ও ভেঙেছে গোটা তিনেক। অজ্ঞান।

শত্রু হোক মিত্র হোক, আগে জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে হবে লোকটার। কথা বার করতে হবে পেট থেকে। সুতরাং বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা আরম্ভ করে দিলেন ডক্টর চাতোন্নে।

রাবিশ একেবারে সরিয়ে ফেলার হুকুম দিলেন ক্যামারেট। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও আর কিছু পাওয়া গেল না।

যার যার কোয়ার্টারে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন লোকজনদের ক্যামারেট।

বন্দীরাও ভাঙা মন নিয়ে ফিরে যাচ্ছে, পেছন থেকে ডাকলেন ক্যামারেট।

শুনুন আপনারা, একটা হেলিপ্লেন গেছে বলেই বেশি ভাববেন না।

মানে? জিজ্ঞেস করল আমিদী ফ্লোরেন্স।

সহজ। আরেকটা বানিয়ে নেব।

সময় তো লাগবে?

তা লাগবে। এটার পার্টসগুলো তৈরিই ছিল। কিন্তু স্টকে আর নেই। পার্টস বানিয়ে জোড়া দিয়ে আরেকটা হেলিপ্লেন তৈরি করতে দুমাস লেগে যাবে।

দুমাস! চোখ কপালে তুলল ফ্লোরেন্স।

এছাড়া আর উপায় নেই যখন, কি করা? গাল চুলকালেন, তা হ্যাঁ, আপনারাও পালানোর এক আধটা বুদ্ধি বার করার চেষ্টা করুন। একটা মগজের চেয়ে নটা মগজ অনেক বেশি কাজ করবে। রাত হয়েছে। যান, শুতে যান।

আরও দুমাস। কিন্তু খাবার আর আধ মাসেরও নেই। চিন্তার ঝড় বইছে আমিদী ফ্লোরেন্সের মাথায়।

আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে
০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
পরের পর্ব :
১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা
১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি
১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
১৩. কিসের এত শব্দ
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত