০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর থেকেই মন ভাল নেই ক্যাপ্টেন মারসিনের। জেনের চিন্তা করে প্রায় সারাক্ষণই। কিন্তু মনে-প্রাণে সৈনিক সে। কাউকে বুঝতে দিল না, মনের ভেতরে তার কি চলছে।
একটানা নদিন চলে সিগৌসিকোর পৌঁচেছে বাইশে ফেব্রুয়ারি রাতে। পরের দিনই কর্নেল সেন্ট অবানের আদেশপত্র দেখাল এখানকার সেনাধিপতি কর্নেল সারজাইন্সকে।
মনোযোগ দিয়ে তিনবার আদেশপত্রটা পড়লেন কর্নেল। অবাক হলেন। কিছুই বোধগম্য হলো না তার। আশ্চর্য তো। টিম্বাকটুতে পাঠানোর জন্যে বারজাক মিশন থেকে সৈন্য তলব করেছে!
আমার আসার কথা তাহলে জানা নেই আপনার? অবাক হল মারসিনেও।
বিন্দুমাত্র না।
লেফটেন্যান্ট ল্যাকোরের মুখে শুনলাম, টিম্বাকটুতে গোলমাল শুরু হয়েছে!
তাই নাকি? কই, শুনিনি তো! লেফটেন্যান্ট ল্যাকোরের নামও শুনিনি। গতকাল এখান দিয়েই গেছে পিরোলিজ টিম্বাকটু হয়ে ডাকার যাবে। সেও তো কিছু বলল না।
অথচ দেখতেই পাঁচ্ছেন, আমাকে যাবার হুকুম দেয়া হয়েছে।
হুকুম যখন হয়েছে, যেতেই হবে। কিন্তু মাথামুন্ডু কিছুই বুঝছি না আমি।
সিগৌসিকোরা থেকে রওনা দিতে দেরি হয়ে গেল ক্যাপ্টেন মারসিনের। পথশ্রমে ক্লান্ত সিপাইরা। তার ওপর রসদপত্র ঠিকঠাক করে জোগাড়ের ব্যাপার আছে। সময় কিছু লাগবেই।
২ মার্চ দলবল নিয়ে রওনা হয়ে পড়ল ক্যাপ্টেন মারসিনে।
টিম্বাকটুর বন্দর কাবারাতে পৌঁছুল ১৭ মার্চ। কর্নেল অবানের আদেশপত্র দেখাল কর্নেল আলিগ্রেকে। সারজাইন্সের মতই হাঁ করে থাকলেন কর্নেল আদেশপত্র দেখে! আকাশ থেকে পড়লেন যেন। টিম্বাকটুতে তো গোলমালের নামগন্ধও নেই। তাহলে অমন সৃষ্টিছাড়া আদেশ দিতে গেলেন কেন অবান?
এবারে সত্যিই খটকা লাগল মারসিনের। জাল সই নয় তো? কিন্তু কেন? উদ্দেশ্য? একটাই উত্তর আছে। বারজাক মিশন ভন্ডুল করে দেয়া। কিন্তু তাই বা কেন? জেনের জন্যে উদ্বেগে ভরে উঠল ক্যাপ্টেনের মন। উদ্বেগটা পরিণত হলো ভয়ে, আশঙ্কায়, যখন শুনল লেফটেন্যান্ট ল্যাকোরের নাম কেউই শোনেনি।
কর্নেল অবানের সই পরীক্ষা করে দেখা হলো। কিন্তু জাল বলে প্রমাণ করা গেল না! বোঝা যাচ্ছে, কর্নেল অবানের কাছে না যাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
দশ মাইল সাংঘাতিক জঙ্গল ঠেঙিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে মারসিনে, এমন সময় হঠাৎ করেই তার এক পুরানো বন্ধু এসে হাজির টিম্বাকটুতে। সেনাবাহিনীতেই আছে, ক্যাপ্টেন। এঞ্জিনীয়ার। বিজ্ঞান পাগল। ছোটখাট অনেক আবিষ্কার আছে তার। এই তো মাত্র দুমাস আগে একটা রেডিও রিসিভার আবিষ্কার করেছে।
খবর পেয়ে গিয়ে হাজির হলো মারসিনে। কর্নেল অবানের ওখানে চলে যাবে, তাই পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখাটা করেই যাবার ইচ্ছে। সেই আগের মতই আছে পেরিগনি। সঙ্গে নতুন আবিষ্কৃত রেডিও রিসিভারটাও আছে।
আদর অভ্যর্থনা শেষ হবার পর প্রথমেই মারসিনেকে রিসিভারটা দেখাল পেরিগনি; দুটো ইলেকট্রিক ব্যাটারি, কিছু ইলেকট্রিক ম্যাগনেট, ধাতুর কুঁচো ভর্তি একটা ছোট কাঁচের নলকে ঘিরে কয়েক গজ খাড়াই একটা তামার দত্ত, এই নিয়ে রিসিভার।
কিন্তু যন্ত্রটা দেখে মুচকে হাসল মারসিনে বলল, এটা আবার কিরে বাবা! বই পড়ে পড়ে এবারে সত্যি সত্যিই তোর মাথাটা গেছে দেখছি।
নাহে, খুনে নেকড়ে, তা না। ডাকিনী বিদ্যের প্র্যাকটিকাল সংস্করণ এটা। বেতার টেলিগ্রাফী বলতে পারিস এটাকে।
এ ধরনের যন্ত্রের কথা আজকাল প্রায়ই শুনছি। কিন্তু কাজ কিছু হয়? খুব একটা আগ্রহ দেখাল না মারসিনে।
হবে না কেন? নিশ্চয় হয়। থাকিস তো জঙ্গলে জঙ্গলে, আর মানুষ খুন করে বেড়াস। পৃথিবীর কোথায় কি উন্নতি হলো জানিস কিছু? একটু থেমে বন্ধুকে বোঝানোর জন্যে বলল, এই সঙ্গে দুটো আশ্চর্য আবিষ্কার করে বসে আছেন দুজন বিজ্ঞানী। একজন ইটালির মানুষ, মার্কনি। শূন্যে হার্জিয়ান ওয়েভ পাঠানোর পদ্ধতি বের করে ফেলেছেন তিনি। অন্যজন ফ্রান্সের লোক। নাম ডক্টর ব্রানলি। সেই ওয়েভকে পাকড়াও করার রিসিভার তৈরি করে ফেলেছেন। সেটার উন্নতি করে করে বেশ চমৎকার একটা জিনিস বানিয়েছি আমি।
এই হ-য-ব-র-লটা! মারসিনের কণ্ঠে ব্যঙ্গ।
ব্যঙ্গটা গায়ে মাখল না পেরিগনি। বলেই চলল, ব্লানলি দেখেছেন, লোহার কুঁচোর তড়িৎ পরিবাহিতা খুবই কম, কিন্তু হার্জিয়ান ওয়েভসের সংস্পর্শে এলেই উৎকৃষ্ট পরিবাহী হয়ে দাঁড়ায়। তখন কুঁচোগুলো নিজেরাই নিজেদের টানাটানি করে সম্পৃক্তি-প্রবণ হয়ে যায়। গায়ে গায়ে আটকে এক হয়ে যায় নতুন শক্তির জোরে। যন্ত্রটা দেখিয়ে বলল, ছোট্ট এই নলটা দেখছিস তো? এর মধ্যেই চলে সম্পৃক্তি প্রবণতার খেলা। সোজা কথায় এই টিউব হয়ে দাঁড়ায় একটা ভালব টিউব, কিংবা বলতে পারিস ওয়েভ ডিটেক্টর। ওয়েভের সংস্পর্শে এলেই লোহার কুঁচোগুলো গায়ে লেগে যায়। মোটা মাথায় ঢুকছে তো?
বলে যা। কৌতুহলী হয়ে উঠছে মারসিনে আস্তে আস্তে।
ব্যাটারি সার্কিটে লাগানো রয়েছে টিউবটা। কিন্তু কারেন্ট চলছে না ভেতর দিয়ে। বুঝতে পারছিস তো কেন?
ওয়েভের সংস্পর্শে আসেনি।
বা-বা! খুলির ভেতরের হলুদ পদার্থগুলো খোলাসা হতে আরম্ভ করেছে। দেখছি। হ্যাঁ, এই যে তামার অ্যানটেনা দেখছিস, এর সঙ্গে টিউবের যোগ রাখা হয়েছে। কেন জানিস? শূন্য পথে ওয়েভস এসে তামার দন্ড বেয়ে টিউবে ঢুকবে। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ পরিবাহী হয়ে যাবে টিউবের ভেতরের লোহার কুঁচো। ব্যাটারি থেকে কারেন্ট এসে বইতে শুরু করাবে পুরো সার্কিটে।
ভারি মজা তো!
আরে শালা, বিজ্ঞানের আশ্চর্য ব্যাপার স্যাপারে তুইও মজা পাস!
একবার কায়দা মত পড়লে মানুষ খুন করার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবি তুইও। কারণ এছাড়া নিজেকে বাঁচাবার আর কোন পথই খোলা থাকবে না তখন তোর জন্যে। তা হ্যাঁ, বলে যা। শুনতে সত্যিই ভাল লাগছে।
সার্কিটে কারেন্ট বইতে শুরু করলেই একটা মোর্স রিসিভার চালু হয়ে যায়। ছাপা হয়ে একটা কাগজের ফিতে বেরিয়ে আসে। একই সঙ্গে ছোট্ট একটা হাতুড়ি পেটায় ওয়েভ-ডিটেক্টর এই টিউবটাকে। ঠোক্কর খেলেই ঝাকুনির চোটে লোহার কুঁচোগুলো ছড়িয়ে পড়ে, বন্ধ হয়ে যায় তড়িৎ-প্রবাহ। কাগজের ফিতের ছাপাও বন্ধ হয়ে যায়।
হয়তো বলবি এবারে, তাহলে কাগজে তো মাত্র একটা অক্ষরই ছাপা হলো। তা কিন্তু নয়। হার্জিয়ান ওয়েভ আসতে থাকলে ছড়িয়ে যাবার পর পরই আবার এক হয়ে যাবে কুঁচোগুলো। আবার চালু হয়ে যাবে সার্কিট। আবার অক্ষর ছাপা হবে। লোহার হাতুড়ির বাড়ি খেয়ে আবার ছড়িয়ে যাবে কুঁচো। এমনি চলতেই থাকবে। ওয়েভ আসা বন্ধ হলেই থেমে যাবে স্বয়ংক্রিয় ভাবে। আবার এলেই আবার চালু হয়ে যাবে। ব্যাটারি কানেকশন কেটে না দেয়া পর্যন্ত এটা চলতেই থাকবে।
যদি সত্যিই কাজ করে, মজার যন্ত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা সঙ্গে সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?
আরে, অমন একটা যন্ত্র বয়ে বেড়াব না? ঠিক এই মুহূর্তেই যে কোন বিজ্ঞানী প্রেরক যন্ত্র তৈরি করে নিজেরই বানানো রিসিভারে ধরার পরীক্ষা চালাচ্ছেন না, কে বলল? সারা পৃথিবীতেই তো এখন এই যন্ত্র নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন বিজ্ঞানীরা। কে জানে, কখন যন্ত্র খুলেই শুনতে পাব, ডাক পাঠাচ্ছেন কোন বিজ্ঞানী।
হু! তোর মত গাধা তো ডজন ডজন মেলে কিনা, পাগলামি করতে যাবে।
যাবে, যাবে। আর এটাকে পাগলামি বলছিস কেন? জানিস, যদি ব্যাপারটায় পুরোপুরি সাসেসফুল হওয়া যায়, কি অসামান্য এক কান্ড ঘটবে? মানুষের উন্নতি কোথায় গিয়ে উঠবে এক লাফে?
কিন্তু যদি সাকসেসফুল হওয়া যায়, তবে তো? একটু কি যেন ভাবল মারসিনে, এক কাজ কর না। মেশিনটা একটু চালিয়ে দেখা না।
ব্যাটারি সংযোগ করে দিল পেরিগনি। সঙ্গে সঙ্গে শো শো আওয়াজ উঠল।
চালু হয়ে গেল যন্ত্র। যদি কেউ ওয়েভ পাঠায়…। আচমকা থেমে গেল পেরিগনি। চোখ বড় বড় করে তাকাল রিসিভারটার দিকে। বিচিত্র একটা খড় খড় আওয়াজ বেরোচ্ছে যন্ত্রটা থেকে। একি! স্বপ্ন দেখছি না তো! এযে সত্যিই ওয়েভ পাঠাচ্ছে কেউ।
অ্যাঁ।
শুনতে পাঁচ্ছিস না, খড় খড় করছে যন্ত্রটা?
তোর যন্ত্র খারাপ হয়ে গেছে। আফ্রিকায়, এই অঞ্চলে অমন যন্ত্র আর কারও কাছে থাকতে পারে না। ইউরোপ হলে কথা ছিল।
চুপ!
রিসিভারটার ওপর একেবারে ঝুঁকে পড়ল পেরিগনি। কান ঠেকাল যন্ত্রটার গায়ে। দুই সেকেন্ড ভেতরের আওয়াজ মনোযোগ দিয়ে শুনল, তারপর ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসা কাগজের ফিতেটার দিকে চাইল। পরক্ষণেই হাত বাড়িয়ে টান মেরে ছিড়ে নিল লেখা অংশটুকু। মোর্সের অনুবাদ জোরে জোরে পড়ল,ক্যাপ… টেন.. মার…সিনে?
আরে! তোর নামই যে!
ধাপ্পা দেবার আর জায়গা পাসনি, শালা। এটা কোন এক ধরনের ছাপার যন্ত্র বানিয়েছিস। আর বলছিস রেডিও রিসিভার। গাধা পেয়েছিস আমাকে? প্রায় খেপেই উঠল মারসিনে।
চুপ! ধমক লাগাল পেরিগনি। আবার ঝুঁকে পড়ল যন্ত্রের উপর।
আর টিটকিরি মারতে পারল না মারসিনে। বুঝল, ধোঁকা দিচ্ছে না পেরিগনি।
আবার ছাপা কাগজের ফিতে বেরিয়ে আসতেই প্রায় ছোঁ মেরে ছিড়ে তুলে নিল পেরিগনি। এক নজর চোখ বুলিয়েই চেঁচিয়ে উঠল, মারসি… মারসি… এবারে তোর ঠিকানা বলছে। টিম্বাকটু।
টিম্বাকটু! অবাক হলো মারসিনেও। কে খবর পাঠাচ্ছে তাকে? পনেরে সেকেন্ড থেমে ছিল, আবার চালু হলো রিসিভার। ছাপা ফিতে বেরিয়ে আসতেই পড়ল পেরিগনি, আমি মার্সেল ক্যামারেট।
চমকে উঠল মারসিনে। তারপরই হাঁফ ছাড়ল। বলল, ওই নামে কাউকে চিনি না। পেরি, আমাদের নিয়ে মজা করছে কেউ।
কিন্তু তা কেন করতে যাবে? কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো, তার কাছেও একটা অতি উন্নতমানের প্রেরক যন্ত্র আছে। আরে… আবার শুরু করেছে।
ছাপা হয়ে যথারীতি বেরিয়ে এল কাগজ। এবারে অনেকখানি বেরোল।
জোরে জোরেই পড়ল পেরিগনি, ব্ল্যাক..ল্যান্ডে… বন্দিনী…মিস… ব্লেজন… তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার… অনুরোধ… জানানো… হচ্ছে ক্যাপ্টেন… মারসিনেকে।
জেন ব্লেজন! আঁতকে উঠল মারসিনে। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল কোমরের খাপে রাখা পিস্তলের ওপর।
একটু থেমেছে মেশিন। মারসিনের আকস্মিক পরিবর্তনে অবাক হলো পেরিগনি। বন্ধুর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, মারসি, অমন করছিস কেন?
সে অনেক কথা। বলে আপনমনেই বলল, কিন্তু ব্ল্যাকল্যান্ড জায়গাটা কোথায়?
হঠাৎই আবার চালু হয়ে গেল যন্ত্র। তাড়াতাড়ি আবার রিসিভারের ওপর ঝুঁকে পড়ল পেরিগনি।
চলতে চলতে যেন মাঝপথে থেমে গেল যন্ত্র। কাগজের ফিতে ছিড়ে নিল পেরিগনি। পড়ল, অক্ষাং.. পনেরো… ডিগ্রী…পঞ্চাশ… মিনিট… দ্রাঘিমা… ! কাগজটা হাতে রেখেই মারসিনের মুখের দিকে চাইল, পুরো শেষ হয়নি সংবাদ। যে কোন কারণে থেমে গেছে মাঝপথে।
আবার মেশিন চালু হওয়ার অপেক্ষায় রইল দুবন্ধু। কিন্তু পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পরও আর কোন খবর এল না। ব্যাটারি কানেকশন না কেটেই কথা বলল পেরিগনি, আফ্রিকার এই দুর্গম অঞ্চলে আমারটার চাইতেও উন্নত এক রেডিও টেলিগ্রাফ নিয়ে কেউ বসে আছে। বন্ধুর দিকে চেয়ে বলল, কিন্তু জেন ব্লেজন কে? ভালমতই চিনিস তাকে মনে হচ্ছে?
সংক্ষেপে বারজাক মিশনের কথা শোনাল পেরিগনিকে মারসিনে। পরিষ্কার বুঝল, যে করেই হোক, কর্নেল অবানের সই জাল করে তাকে বারজাক মিশন থেকে বের করে নিয়ে এসেছে ল্যাকোর নামধারী লোকটা। তারপর বারজাক মিশনের লোকজনকে হয় হত্যা করে কিংবা জেনের সঙ্গে বন্দী করে নিয়ে গেছে। কিন্তু কারা?
যে করেই হোক জেনকে উদ্ধার করতে যাবেই মারসিনে, বদ্ধপরিকর সে। পেরিগনিও সায় দিয়ে বলল, আমিও যাব। তোর ভাবী বউকে উদ্ধার করতেই হবে, যে করেই হোক।
কিন্তু কোথায় যাব ভালমত জানিই না যে। অবস্থানটা পরিষ্কার করে জানাতে পারলেন না তো সংবাদ প্রেরক।
সে যে করেই হোক খুঁজে বের করব। আগে কর্নেল অবানের কাছে চল। তাকে জানাতে হবে আগে সব। তারপর সৈন্যসামন্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়ব।
সেই দিনই কর্নেল অবানের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে পড়ল দুই বন্ধু।
সব শুনলেন কর্নেল অবান। জাল করা নিজের সই দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। জাল যে করেছে তার প্রশংসা না করে পারলেন না। চিঠিও পড়লেন। তারপর মোর্স কোড ছাপা ফিতেগুলো পড়ে বললেন, কিন্তু এতে তো মঁসিয়ে বারজাকের কথা কিছু লেখা নেই।
কিন্তু মিস ব্লেজন ওঁর সঙ্গেই ছিলেন, বলল পেরিগনি। পরে দলছাড়া হতে পারেন। বারজাক মিশনের গন্তব্যস্থান জানা আছে আমার। এত উঁচু ল্যাটিচিউডে নয়।
একেবারে ভুল বলেননি আপনি, স্যার। বলল মারসিনে, উত্তরে একলা যাবেন, বলেছিলেন মিস ব্লেজন।
তাই-ই হবে! মাথা নেড়ে বললেন কর্নেল, বারজাক মিশন সরকারী অভিযান। তারা বিপদে পড়লে সৈন্য পাঠানো যায়। কিন্তু বেসরকারী কারও জন্যে… ।
মিথ্যে আদেশপত্র দেখিয়ে আমাকে সরিয়েছে শয়তানেরা। বারজাক মিশন নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে কিনা কে জানে। তাদের শাস্তি দেবার জন্যেও অন্তত যাওয়া দরকার আমার। জোর দিয়ে বলল মারসিন।
বারজাক মিশনের ক্ষতি হয়েছে জানলে নিশ্চয় সেনাবাহিনী পাঠাব আমি। কিন্তু শুধু মিস ব্লেজনের জন্যে…।
যাবার আদেশ নেবার জন্যেই আপনার কাছে এসেছিলাম কর্নেল অবান, স্যার।
কিন্তু আমি নিরুপায়, ক্যাপ্টেন। তাছাড়া ব্ল্যাকল্যান্ড জায়গাটা কোথায়? যে ল্যাটিচিউডের কথা বলা হয়েছে ওটা তো সাহারার একেবারে ভেতরে। ওই ধু ধু মরুভূমিতে একটা শহর বা জনবসতি থাকে কি করে? সৈন্য পাঠানোর ঝুঁকি নেয়া কি উচিত হবে অমন জায়গায়? আরও একটা ব্যাপার আছে। ব্ল্যাকল্যান্ড শব্দটা ইংরেজি। যে ঠিকানা পাওয়া গেছে, তার খুব কাছাকাছিই ব্রিটিশ কলোনি সোকারটা। শেষকালে না ইংরেজ বসতি আক্রমণের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি। সবচে বড় কথা কিছুদিন ধরেই একটা অদ্ভুত খবর কানে আসছে। মরুভূমির মাঝে কোথায় নাকি একটা আশ্চর্য রাজ্য গড়ে উঠেছে। ওটার নাগরিকরা নাকি সব চোরছাচোড়-দাগী আসামী। কে জানে, ওটাই ব্ল্যাকল্যান্ড কিনা? ল্যাটিচিউড দেখে কিন্তু এই সন্দেহই হচ্ছে আমার। নাহ ক্যাপ্টেন, তোমাকে সৈন্য দেয়া কিছুতেই আমার উচিত হবে না।
ঠিক আছে, আপনার এখান থেকে নাই-ই দিলেন, কিন্তু আমার সঙ্গে যারা এসেছে, তাদের তো নিতে পারি?
না। কারণ তারাও সরকারী সৈন্য। তাছাড়া এখনই অত অধীর হচ্ছ কেন? একবার যখন পাঠিয়েছেন আবার খবর পাঠাতে পারেন মিস ব্লেজন।
কিন্তু একটা অনিশ্চিত অবস্থায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব?
আমি নিরুপায়, ক্যাপ্টেন।
বেতারবার্তার মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়াকে বিপদ সঙ্কেতই ধরে নেয়া যেতে পারে।
“তবু আমি নিরুপায়!
আমি তাহলে একাই যাব, কর্নেল।
একা?
আমাকে ছুটি দিন।
না। এরকম ঝুঁকির মধ্যে আমার একজন দায়িত্ববান অফিসারকে যেতে দিতে পারি না।
বেশ, তাহলে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি আমি।
হাঁ করে কয়েক মুহূর্ত মারসিনের দিকে চেয়ে রইলেন কর্নেল। তারপর নরম সুরে বললেন, কিন্তু তোমার পদত্যাগপত্র নেয়ার অধিকার আমার নেই, জানো নিশ্চয়। আমি শুধু রেকমেন্ড করে হাই লেভেলে পাঠাতে পারি। ঠিক আছে, আমাকে আর একটু ভাববার সময় দাও। কাল সকালে কথা হবে।
স্যালুট করে বেরিয়ে এল দুই ক্যাপ্টেন। বন্ধুকে নানা রকমে আশ্বাস দিয়ে নিজের ব্যারাকে ফিরে গেল পেরিগনি। চিন্তিতভাবে নিজের সৈন্যদের কাছে ফিরল মারসিনে।
আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে
০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
পরের পর্ব :
০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে
১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা
১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি
১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
১৩. কিসের এত শব্দ
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন