মরুশহর: ০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য

মরুশহর: ০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য

০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য

অতি তুচ্ছ সৌজন্য। কিন্তু শত্রু এলাকায় এটুকুও আশা করেনি অভিযাত্রীরা। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল তারা। নির্বাক, নিঃশব্দে সিড়ি ভেঙে এগিয়ে চলল মারসেল ক্যামারেটের পিছু পিছু।

বিশ ধাপ পেরিয়ে একটা হলঘরে এসে দাঁড়াল তারা। এগিয়ে গিয়ে ওপাশের একটা দরজা খুলে ফিরে চাইলেন ক্যামারেট। ডাকলেন, আসুন।

আরেকটা বড় ঘরে এসে দাঁড়াল অভিযাত্রীরা। কিন্তু একেবারেই অগোছাল ঘরের জিনিসপত্র। মাঝখানে বিশাল এক টেবিল। তিন দিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ছাদছোঁয়া বিশাল সব আলমারি। সব বইয়ে ঠাসা। টেবিল আর কোন কোন আলমারির সামনে রাখা মোট বারোটা কাঠের চেয়ার। সবগুলোর ওপর ফেলে রাখা হয়েছে রাশি রাশি বই। এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারের ওপর থেকে মাটিতে বই নামিয়ে রাখলেন ক্যামারেট! তারপর ধুলো না ঝেড়েই ধপ করে বসে পড়লেন। অভিযাত্রীরাও নিজেরাই কয়েকটা চেয়ার থেকে মাটিতে বই নামিয়ে রেখে বসল। টোনগানে আর মালিক বসল না। ইচ্ছে করেই! হাজার হোক, অত বড় বড় লোক। তাদের সামনে চেয়ারে বসে অসম্মান দেখাবে নাকি!

তা কি করতে পারি, বলুন? সহজ শান্তভাবে জানাতে চাইলেন ক্যামারেট। কিন্তু একবারও জানতে চাইলেন না, এই দুর্যোগের রাতে বলা নেই, কওয়া নেই আটজন অচেনা মানুষ কোথা থেকে কি করে, কি কাজে হঠাৎ উদয় হয়েছে এসে।

সঙ্গে সঙ্গেই ক্যামারেটের কথার জবাব দিল না কেউ। বুঝে নেবার চেষ্ট! করছে বিচিত্র এই লোকটিকে বিশ্বাস করা যায়, কি যায় না। কিন্তু কেউই অবিশ্বাস করতে পারল না তাকে। সহজ ব্যবহার। চোখে-মুখে শিশুর সরলতা। বিশাল ললাট দেখলেই অসামান্য প্রতিভা আঁচ করা যায়। ভদ্র, বিনয়ী লোকটাকে কিছুতেই হ্যারি কিলারের সমগোত্র বলে মানতে পারল না অভিযাত্রীরা। ব্ল্যাকল্যান্ডে এই লোক একেবারেই বেমানান। কিন্তু তবু কি করে এখানে এসে পড়লেন মানুষটি বুঝতে পারল না তারা।

ক্যামারেটকে বিশ্বাস করা যায় বুঝতে পেরে কথা বললেন বারজাক, আপনার কাছে আশ্রয় চাইছি আমরা, মঁসিয়ে ক্যামারেট। আমাদের সাহায্য করবেন?

মনে হচ্ছে কেউ আপনাদের ক্ষতি করতে চাইছে। কে? একটু অবাক মনে হলো ক্যামারেটকে।

এই ব্ল্যাকল্যান্ডের অত্যাচারী মাস্টার হ্যারি কিলার।

হ্যারি কিলার। অত্যাচারী! যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না ক্যামারেট।

জানেন না? ক্যামারেটের মতই অবাক হলেন এবার বারজাক।

না তো!

এই শহরটার নাম ব্ল্যাকল্যান্ড, তা নিশ্চয় জানেন! ক্ষীণ ব্যঙ্গ বারজাকের কণ্ঠে।

কিন্তু টেরই পেলেন না ক্যামারেট। সহজ গলায়ই বললেন, না। বিশ্বাস করুন, এই প্রথম শুনলাম আপনার মুখে। তাছাড়া কোথায় কোন শহর কি নাম অত খবর রেখে আমার দরকারই বা কি?

বেশ, বেশ, পরিষ্কার শ্লেষ এবার বারজাকের গলায়, শহরের খবর না হয় নাই রাখলেন। কিন্তু যে কোন শহরে লোকের বাস থাকে, এটা নিশ্চয় জানেন?

লোক তো থাকবেই।

আর লোক থাকলেই এ যুগে শাসন ব্যবস্থা থাকে, থাকে সরকার। নাকি?

থাকবেই। খুব স্বাভাবিক।

বেশ। এই ব্ল্যাকল্যান্ডেরও সরকার আছে। আর তার শাসক হ্যারি কিলার। পিশাচ, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী মাতাল এবং পাগল।

এমন ভাবে কথা বলছেন আপনি…। বলতে গিয়েও থেমে গেলেন ক্যামারেট বাঁধা পেয়ে।

খেপে গেছেন বারজাক। ওর মত একটা রক্তলোলুপ পশুর উদ্দেশে অনেক ভদ্র ভাষা ব্যবহার করছি। ও যা করেছে, তার তুলনায় কিছুই না। তার আগে আমাদের পরিচয়টা জানানো দরকার।

একে একে চেয়ারে বসা সবার পরিচয় দিয়ে গেলেন বারজাক। আসল পরিচয়ই, শুধু জেন ব্লেজনেরটা ছাড়া। এসব শোনার যেন কোন আগ্রহই নেই ক্যামারেটের, এমনি উদাসীন হয়ে রইলেন।

টোনগানের দিকে ফিরে বললেন বারজাক, একে তো চেনেনই।

চিনি… চিনি…।

আপনার দেশ কোথায়? যা মনে হচ্ছে ফ্রান্সেই, ঠিক বলিনি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। কোন ভাব পরিবর্তন নেই বিজ্ঞানীর গলায়।

নাইজার বেন্ডে একটা মিশন এসেছে ফরাসী সরকারের নির্দেশে। বারজাক মিশন। এবং সেই মিশনের নেতা আমি; আমার সহযোগী এঁরা। পদে পদে আমাদের বাঁধা দিয়ে এসেছে পিশাচ হ্যারি কিলার। ফলে অশেষ কষ্ট পেতে হয়েছে আমাদের। অথচ ওর কিছুই করিনি আমরা। এখানে আমাদের নিয়ে আসার আগে তার নামও শুনিনি!

কিন্তু কেন? বাধা দেবে কেন? প্রতিবাদ করতে চাইলেন যেন কামারেট। এই প্রথম সামান্য আগ্রহ প্রকাশ পাঁচ্ছে তার কথায়।

যাতে তার শয়তানীর রাজত্বের খোঁজ না পায় বাইরের দুনিয়া।

হোয়াট? বলছেন কি? সোজা হয়ে বসেছেন ক্যামারেট। বাইরের দুনিয়া মানে ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মত দেশ এই শহরের খবর জানে না বলছেন। হতেই পারে না। আমার কারখানার দেশে ফিরে যাওয়া কর্মচারীরা নিশ্চয় বলেছে।

না। বলেনি। আসলে দেশে যেতেই পারেনি তারা! ফিরিয়ে নিয়ে যাবার নাম করে খুন করে তাদের লাশ মরুভূমিতে ফেলে দেয়া হয়েছে হ্যারি কিলারেরই আদেশে।

আঁ! এমন একটা শহরের খবর বাইরের দুনিয়ার কেউ জানে না? কেউ শোনেনি মরুভূমিতে চাষাবাদের খবর? বলছেন কি আপনি? ক্যামারেটের উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছে ক্রমেই।

বললাম তো কেউ শোনেনি। জানে না।

শোনেনি না?

না।

উঠে দাঁড়ালেন ক্যামারেট। পায়চারি করতে শুরু করলেন ঘরের এদিক থেকে ওদিক। গভীর হয়ে উঠেছে মুখ চোখ। বিড় বিড় করছেন, কিন্তু অমন তো হবার কথা ছিল না কেন করল সে অমন…

কয়েক মিনিট পরেই সামলে নিলেন ক্যামারেট। আবার গিয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে। বারজাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তারপর?

পথে আমাদের ওপর সে কত ধরনের অত্যাচার করেছে, তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে আপনাকে বিরক্ত করার ইচ্ছে নেই আমার। শুধু শুনে রাখুন, পদে পদে বাধা দিয়েও যখন কিছুতেই ঠেকাতে পারল না, একদিন রাত দুপুরে ডাকাতের মত ঝাপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর। আজ চোদ্দদিন হলো এই শহরে ধরে নিয়ে এসে বন্দী করে রেখেছে আমাদের। হুমকি দিয়েছে, আর ষোলো দিন পরেই ফাঁসী দেবে।

লাল হয়ে উঠেছে ক্যামারেটের মুখ। শক্ত হয়ে উঠেছে চোয়াল।

এমন কাজ করবে হ্যারি কিলার?

শুধু করবে নয়, এর চেয়েও সাংঘাতিক কাজ ইতিমধ্যে আমাদের চোখের সামনেই করে বসে আছে। বলে একে একে কি করে জেনের ওপর মানসিক অত্যাচার চালিয়েছে হ্যারি কিলার, কি করে নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্যে নিরীহ দুজন নিগ্রোকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করেছে জানালেন বারজাক।

শুনে বোবা হয়ে গেলেন যেন ক্যামারেট। এই প্রথম চিন্তার জগৎ ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এসেছেন তিনি। রক্তজমাট করা নিষ্ঠুরতার বর্ণনা শুনে শিউরে উঠলেন। তাঁর মত একজন সরল লোক একটা ভয়ঙ্কর খুনীর সংস্পর্শে কাটিয়েছেন দশ দশটা বছর, জেনে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। প্রচন্ড বিবেক দংশন শুরু হয়ে গেছে।

এই শহরে এসেই অন্যায় অত্যাচার শুরু করেনি হ্যারি কিলার। আগেও নিশ্চয় করেছে। জানেন কিছু আপনি? জিজ্ঞেস করলেন বারজাক।

আমি, আমি জানব কি করে? জানলে তার সঙ্গে আসতাম নাকি? প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন ক্যামারেট। ফ্যাক্টরি নিয়ে থাকি দিনরাত। বাইরের কোন খবরই রাখার সময় হয়ে ওঠে না। কোনদিন হ্যারি কিলারের কান্ডকারখানার কিছু দেখিনি, শুনিনি, জানি না।

তাহলে একটা প্রশ্নের জবাব দিন দয়া করে। এখানে আসা অবধি ব্ল্যাকল্যান্ডের ব্যাপার-স্যাপার দেখে মাথা ঘুরে গেছে আমাদের। দশ বছর আগেও যেখানে ভয়ঙ্কর মরুভূমি ছিল, সেখানে আজ শ্যামল মাঠ। হয়তো এককালে ব্রেন ছিল হ্যারি কিলারের, কিন্তু এখন বিন্দুমাত্রও নেই। মদে খেয়েছে। তাহলে এই বিস্ময়ের স্রস্টাটি কে?

এমন একজন, হ্যারি কিলারের সঙ্গে যার তুলনা চলে না। আঁতকে উঠে বললেন যেন ক্যামারেট।

কে?

আমি, আবার কে? অহঙ্কারে ফুলে উঠলেন বিজ্ঞানী। এ সমস্তেরই স্রষ্টা আমি। মরুর আকাশে অঝোর কালো মেঘ সৃষ্টি করেছি, বৃষ্টি ঝরিয়েছি ধু-ধু বালির বুকে করে তুলেছি ফসল সৃষ্টির উপযুক্ত। মহাকাশে বসে ঈশ্বর যেমন দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন, এই ফ্যাক্টরিতে বসে আমিও ব্ল্যাকল্যান্ডকে সৃষ্টি করেছি।

উপরের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন ক্যামারেট। যেন নিজের সমকক্ষ কেউ আর আছে কিনা, চ্যালেঞ্জ করছেন। অভিযাত্রীদের এই প্রথম আশঙ্কা হতে লাগল, আরেক পাগলের পাল্লায় এসে পড়েছে। উসখুস করে উঠল সবাই। নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

এই প্রথম কথা বললেন ডক্টর চাতোন্নে। কণ্ঠস্বর ধারাল, নিজের হাতে এতসব সৃষ্টি করে কোন আক্কেলে সব সঁপে দিলেন খুনী হ্যারির হাতে? আপনার সৃষ্টিকে সে কোন কাজে লাগাবে ভাবেননি কেন একটুও?

সৃষ্টি করার আগে জগতের কি হবে, ভেবেছিলেন ঈশ্বর?

নিশ্চয় ভেবেছিলেন। কারণ শাসন আর বিচারের ভারটা তিনি নিজের হাতেই রেখে দিয়েছেন।

আমারও আছে। হ্যারি কিলারের পাপের সাজা আমি দেব, চোখ দুটো জ্বলে উঠল ক্যামারেটের। অসুস্থ দ্যুতি। রীতিমত ঘাবড়ে গেল অভিযাত্রীরা। প্রতিভাবান ঠিকই, কিন্তু মানুষটা পাগল, বুঝে নিল তারা। এমন লোকের ওপর ভরসা করা কি ঠিক হবে?

চিরকালই বাস্তববাদী আমিদী ফ্লোরেন্স। প্রথমবারেই কাজের কথায় চলে এল, হ্যারি কিলারের সঙ্গে কি করে পরিচয় আপনার? আর এই ব্ল্যাকল্যান্ড সৃষ্টির পরিকল্পনাই বা মাথায় ঢুকল কি করে?

পরিকল্পনা হ্যারি কিলারের। রূপ দিয়েছি আমি। আস্তে আস্তে আবার শান্ত হয়ে এসেছেন ক্যামারেট। একটা ইংলিশ সৈন্যবাহিনী এদিকে এসেছিল জর্জ ব্লেজন নামে এক ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে। আমি ছিলাম সেই দলে।

নামটা শুনেই সব চোখ এসে পড়ল জেনের ওপর। কিন্তু মুখের ভাব একটুও বদলায়নি মেয়েটার।

ওই সেনাবাহিনীতেই ছিল সার্জেন্ট টোনগানে। দেখলেন না, দেখেই চিনেছি। আমি ছিলাম এঞ্জিনিয়ার। পর্বত সম্বন্ধীয় ভূগোল অরগ্রাফি, পানি সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান হাইড্রোগ্রাফি আর খনিজ বিজ্ঞান মিনারোলজী নিয়ে গবেষণায় এসেছিলাম। আশান্তিল্যান্ডের আসিরা থেকে রওনা দেবার দুমাস পরে একদিন আমাদের দলে এসে যোগ দিল হ্যারি কিলার। কোখেকে কে জানে! আশ্চর্য! তাকে সাদরে দলে ডেকে নিলেন ক্যাপ্টেন ব্লেজন।

আর সেই দিন থেকে আস্তে আস্তে ক্যাপ্টেন ব্লেজনের জায়গা দখল করে নিল হ্যারি কিলারই, না? ব্যাপারটা খেয়ালও করেনি নিশ্চয়ই দলের কেউ? জিজ্ঞেস করল জেন।

ঠিক বলতে পারব না। নিজের কাজে মশগুল থাকতাম তো! কিন্তু একদিন আটচল্লিশ ঘণ্টা বাইরে থেকে ফিরে আসার পর দেখলাম, আমার ক্যাম্প, যন্ত্রপাতি কিছুই নেই। ক্যাপ্টেন ব্লেজন নেই। আছে শুধু বিশজন লোক নিয়ে হ্যারি কিলার। তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ক্যাপ্টেন নাকি সমস্ত লোকলস্কর নিয়ে উপকূলের দিকে রওনা হয়ে গেছেন। আমাকে তার সঙ্গে যাবার অনুরোধ জানাল কিলার। কি আর করা! চললাম তার সঙ্গে। কয়েক দিন ধরেই একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। একদিন আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম হ্যারি কিলারকে। মরুভূমিতে কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানো যায়। শুনে তো একেবারে লাফিয়ে উঠল সে। বলল, টাকাপয়সা যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা সেই করে দেবে। আমি শুধু একমনে কাজ করে যাব। এরপরই চলে এলাম সাহারার এই এলাকায়। সৃষ্টি করলাম ব্ল্যাকল্যান্ড, অবশ্যই, হ্যারি কিলারের প্ল্যান মাফিক।

আসলে কি করেছে সে জানেন? বলল জেন, কোনক্রমে ক্যাপ্টেন ব্লেজনকে কব্জা করে সেনাবাহিনীকে তার হয়ে আদেশ দিয়ে গেছে হ্যারি কিলার। খুন-জখম- রাহাজানি চালিয়ে গেছে। সেনাবাহিনীটিকে পরিণত করেছে দস্যুবাহিনীতে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়েছে, সমানে মানুষ জবাই করেছে।

অসম্ভব। আমার চোখে পড়েনি কেন তাহলে? প্রতিবাদ জানালেন ক্যামারেট।

কোন জিনিসটাই আপনার চোখে পড়েছে? এখানে তো দশ বছর ধরে আছেন কিন্তু শহরের নামটা জানেন না আজও। অথচ বলছেন এই শহর আপনারই সৃষ্টি।

তা… তা…ঠিকই বলেছেন। আসলে বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না আমার। আমতা আমতা করে বললেন ক্যামরেট।

হ্যা, যা বলছিলাম, আবার আগের কথার খেই ধরল জেন, ক্যাপ্টেন জর্জের সেনাবাহিনীর কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সারা ইউরোপে। খবর পৌঁছল ইংল্যান্ডে, বিদ্রোহী হয়েছেন ক্যাপ্টেন জর্জ। তাকে দমন করার জন্যে সৈন্য পাঠানো হলো। তারা তাঁর দলবলকে ঠান্ডা করে ফিরে গেল দেশে। ঘোষণা করল গিয়ে, গোলাগুলিতে মারা গেছেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু আসলে তা নয়। যুদ্ধ চলার সময়েই তাকে খুন করা হয়েছে।

খুন!

খুন। ছুরি মেরে পেছন থেকে। ছুরি মেরে?

হ্যাঁ, ছুরি মেরে। জানেন আমি আসলে কে? ক্যাপ্টেন জর্জের ছোট বোন আমি। সারা ইউরোপে ভাইয়ার নাম শুনলে এখন নাক সিটকায় লোকে। লজ্জায় অপমানে হেঁট হয়ে গেছে বাবার মাথা। তাই আমি এসেছি, ভাইয়া যে নির্দোষ এটা প্রমাণ করতে। আমার ভাই দেশদ্রোহী হয়েছে, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি আমি কথাটা। এসে দেখলাম, ঠিকই ভেবেছি।

ছুরি মেরে খুন করা হয়েছে। আপন মনেই বিড় বিড় করছেন ক্যামারেট।

যে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছে ভাইয়াকে, তার ফলাটা লাশের গায়ে বেঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে। বাটটা পাওয়া গেছে ভাঙা অবস্থায়। গায়ে খোদাই করা দুটো অক্ষর শুধু পড়া যায়। হত্যাকারীর নামের দুটো অক্ষর। তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন জানি। হত্যাকারী হ্যারি কিলার।

হোয়াট? উত্তেজনায় আবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন ক্যামারেট।

ঠিকই বলছি আমি, মঁসিয়ে ক্যামারেট।

অথচ দেখুন, একেবারে সঙ্গে সঙ্গে থেকেও এর বিন্দুবিসর্গ জানি না আমি। আবার বেসামাল চাহনি ফুটে উঠেছে ক্যামারেটের চোখের তারায়।

কিন্তু আসল কথা জানতে চাইছি আমরা। সাহায্য করবেন তো আমাদের? জানতে চাইছেন বারজাক।

করব না মানে? এটা আবার জিজ্ঞেস করছেন? জ্বলে উঠলেন ক্যামারেট। ব্যাপারটা তার স্বভাবের একেবারে উল্টো। আপনারা ভেবেছেন, এত কথা জানার পরও হ্যারি কিলারের গুণগান গাইব আমি? ভয়ঙ্কর সাজা আমি দেব তাকে। ভয়ঙ্কর।

শুনে সুখী হলাম, ফস করে বলে বসল বাস্তববাদী ফ্লোরেন্স, সাজা পরে দেবেন। আগে পিশাচটার খপপর থেকে তো বাচান আমাদের।

সহজভাবে হাসলেন ক্যামারেট। আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন।

আমার কাছে যখন এসে পড়েছেন, একটা চুলও আর ছুঁতে পারবে না আপনাদের হ্যারি কিলার। সে এখনও জানে না আপনারা এখানে, আর জানলেও কোন ক্ষতি নেই।

আবার চেয়ারে বসে টেবিলে বসানো একটা বোতাম টিপলেন ক্যামারেট।

ঘরে এসে ঢুকল একজন নিগ্রো চাকর।

জ্যাকো, এঁদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করো, আদেশ দিলেন ক্যামারেট। তারপর অতি স্বাভাবিক ভাবে চেয়ার থেকে উঠে অভিযাত্রীদের গুড নাইট জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল জ্যাকো। খাওয়ার ব্যবস্থা যা হোক করতে পারবে, কিন্তু ফ্যাক্টরির ভেতরে অতিথি থাকার নিয়ম নেই। তাছাড়া শোবার মত ঘরও নেই। অত রাতে কর্মচারী বা শ্রমিকদের ডেকে তোলা সম্ভব?

জ্যাকোর মুখ দেখেই ব্যাপারটা আঁচ করে নিলেন বারজাক। বললেন, থাক, থাক, আমাদের থাকা নিয়ে অত ভাবতে হবে না তোমাকে। ভাবছ যে মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। রাতটা চেয়ারে বসে এ ঘরেই কাটিয়ে দিতে পারব। শুধু কয়েকটা চাদর এনে দিতে পারবে?

ঘাড় কাত করল জ্যাকো। পারবে।

সকাল বেলা এসে অভিযাত্রীদের এঘরে দেখে মোটেই অবাক হলেন না ক্যামারেট। রাতটা কোথায় কাটিয়েছে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। জ্যাকোর ওপর দায়িত্ব দিয়েই সন্তুষ্ট তিনি। রাতে যাবার আগে যেমন জানিয়েছেন, এখন এসেও তেমনি স্বাভাবিকভাবেই গুড মর্নিং জানালেন। তারপর চেয়ারে বসেই কথা শুরু করলেন, জেন্টলমেন, এখুনি এই পরিস্থিতির একটা বিহিত করতে হবে।

বলেই বোতাম টিপলেন ক্যামারেট। সমস্ত ফ্যাক্টরিতে বেজে উঠল এলার্ম বেল। উঠে দাঁড়ালেন বিজ্ঞানী। অভিযাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে।

অসংখ্য গলিখুঁজি আর আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে একটা বিশাল হলঘরে এসে পৌঁছল অভিযাত্রীরা। সারি সারি মেশিনের কোনটাই চলছে না। সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বেল শুনেছে ওরা। ক্যামারেটেরই অপেক্ষা করছে।

সবাই এসেছে তো, রিগড? সামনে দাঁড়ানো একজনকে জিজ্ঞেস করলেন ক্যামারেট।

ঘাড় নেড়ে সায় দিল রিগড়।

বেশ। রোলকল করো।

রোলকল করে দেখা গেল সবাই হাজির।

আটজন নবাগতের পরিচয় দিলেন ক্যামারেট নিজের লোকদের কাছে। তারপর একে একে বলে গেলেন কাল রাতে শোনা হ্যারি কিলারের পৈশাচিকতার, কাহিনী। অভিযাত্রীদের মুখে যা যা শুনেছেন, একটা কথাও বাদ দিলেন না। স্তম্ভিত, বিমূঢ় হয়ে সব কথা শুনে গেল ফ্যাক্টরির লোকেরা। প্রতিটি কথা বিশ্বাস করল। ডিরেক্টর ক্যামারেটকে দেবতার মত শ্রদ্ধা করে তারা। অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে।

সব কথা গুছিয়ে বলার পর ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিলেন ক্যামারেট, তাহলে দেখা যাচ্ছে, না জেনে একটা খুনে ডাকাতের সাগরেদি করে এসেছি এতদিন আমরা! জান দিয়ে খাটছি আমরা লোকের উন্নতি হবে বলে, অথচ আমাদের শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে হ্যারি কিলার। এর বিহিত করতেই হবে। তাছাড়া বারজাক মিশনের কোন সদস্যকেই আটকে রাখার ক্ষমতা বা অধিকার ওই খুনে হ্যারিটার নেই। যে করেই হোক বারজাক মিশনের সদস্যদের নিরাপদে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করতেই হবে আমাদের।

অবাক বিস্ময়ে মার্সেল ক্যামারেটের কথা শুনছে শ্রমিক কর্মচারীরা। একটা কথাও বলছে না কেউ। নীরব সম্মতির লক্ষণ।

আসল খবরটা দিলেন ক্যামারেট সবার শেষে, সবচেয়ে আশ্চর্য এবং দুঃখের কথা কি জানেন? ইউরোপ বা বাইরের দুনিয়ার কেউ জানে না, এমন একটা শহর আছে মরুভূমির বুকে। অথচ এতদিন কি অহংকারই না করেছি মনে মনে, আজব এক শহর বানিয়ে তাজ্জব করে দিয়েছি দুনিয়াকে। অথচ ভেবে দেখুন, কেউ শোনেইনি আজ পর্যন্ত। এদিক দিয়ে এমনিতেই কোন সদাগরী কাফেলা যায় না। কালেভদ্রে যদিও বা কোন ভ্রমণকারী ভুল করে এসে পড়ে তো আর ফিরে যেতে পারে না। খুন করে, কিংবা ধরে এনে যাবজ্জীবন কারাগার দেয় তাকে হ্যারি কিলার। হয়তো ভাবছেন, বাইরের লোক না-ই এল, আমাদের অনেক শ্রমিক কর্মচারী বা বিজ্ঞানী তো দেশে ফিরে গেছে? তাদের মুখে তো এই বিস্ময়কর খবর প্রচার হবার কথা? হতে পারত, কিন্তু হয়নি। কারণ? কারণ তাদের একজনও দেশে ফিরে যেতে পারেনি। কাল এঁদের কাছে সব শোনার পর হিসেব করে দেখলাম, মোট সাইতিরিশজন লোক এই ফ্যাক্টরি থেকে চলে গেছে। না, দেশে ফিরে যায়নি তাদের কেউ। এখানেও কোথাও নেই। কোথায় আছে জানেন? সাহারার কোন অঞ্চলের ধু-ধু বালির তলায়। মৃত। হ্যাঁ, খুন করা হয়েছে তাদের। হ্যারি কিলারের নির্দেশে। বলেই সবার মুখের দিকে চাইতে লাগলেন ক্যামারেট।

এতক্ষণ শুধু বিস্মিত হয়েছিল ফ্যাক্টরির লোকেরা। এবার বজ্রাহত হলো যেন। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে সব কজনেরই।

অতি সুন্দরভাবে কথা শেষ করলেন খেপা বিজ্ঞানী, আমাদের পরিণামটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আর কেউ কোনদিন দেশে ফিরে যেতে পারছি না, এর কোন বিহিত না করতে পারলে। সুতরাং একটাই উপায় আছে। হ্যারি কিলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই করব। আপনি যা বলবেন তাই করব। দরকার হলে জীবনের বিনিময়ে। সমস্বরে চিৎকারে ফেটে পড়ল ঘরের সবাই।

গুড। ভেরি গুড। বললেন ক্যামারেট, আমি জানতাম, আমার কথা অবিশ্বাস করবেন না কেউ। এখন যান, যে যার কাজ করতে যান। হ্যারি কিলারের বিরুদ্ধে যা করার আমিই করব। আপনারা শুধু সাহায্য করে যাবেন আমাকে।

আশ্চর্য! আর একটা টু শব্দও না করে একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লোকগুলো। এ থেকেই বোঝা যায় মার্সেল ক্যামারেটর ওপর তাদের আস্থা কি অপরিসীম।

রিগড়কে থাকতে বললেন ক্যামারেট। আর সবাই চলে যেতে তাকে নিয়ে অন্য দরজা দিয়ে ঘর থেকে বেরুলেন তিনি। দুজনের পিছু পিছু এল অভিযাত্রীরা।

রিগড আর অভিযাত্রীদের নিয়ে নিজের ঘরে এলেন ক্যামারেট। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বেজে উঠল টেলিফোন।

এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুললেন বিজ্ঞানী, মার্সেল ক্যামারেট!

ওপাশ থেকে কি কথা শুনে প্রথমে বললেন, হ্যা তারপর না, এবং সবার শেষে, আপনার ইচ্ছে! বলে রিসিভার রেখে দিলেন।

কোনরকম উত্তেজনাই নেই ক্যামারেটের মধ্যে। অভিযাত্রীদের দিকে ফিরে স্বাভাবিক ভাবেই জানালেন, হ্যারি কিলার। এখানে এসেছেন আপনারা, জেনে গেছে ইতিমধ্যেই।

আঁ! আঁতকে উঠলেন যেন বারজাক। কি করে?

চৌমৌকি নামে একটা লোককে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে। আপনারাই নাকি বেঁধে ফেলে রেখে এসেছেন। নদীতে একটা নৌকা ভাসতে দেখা গেছে, ফ্যাক্টরির কাছাকাছি। শহরের বাইরে আপনারা নেই। ভেতরেও না। সুতরাং একটা জায়গায়ই থাকবেন, ফ্যাক্টরি। হ্যারি কিলার জিজ্ঞেস করতে স্বীকার করলাম, আছেন। ফিরিয়ে দিতে বলল। অস্বীকার করলাম। গায়ের জোরে ধরে নিয়ে যাবে বলল। যা ইচ্ছে করতে পারে বললাম। ঠিক বলেছি তো? হাসলেন ক্যামারেট।

ঠিকই বলেছেন, বললেন বারজাক, একটা কাজ করবেন? বন্দুক আছে? দেবেন?

বন্দুক নেই। হাসলেন ক্যামারেট। ওসবের দরকারও নেই।

মানে? বাধা দিলেই গোলাগুলি ছুঁড়বে ওরা! রুখবেন কি করে? তাছাড়া প্যালেসের ছাদ থেকে কামান দাগলে?

সব কিছু রোখার ক্ষমতা আছে আমার। ইচ্ছে করলে চোখের পলকে গোটা শহরটাকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারি আমি। কিন্তু অতটা করার কোন ইচ্ছে নেই। আর প্যালেস থেকে কামান দাগবে না হ্যারি কিলার, নিশ্চিন্ত থাকুন। সে জানে, তার শহরের প্রাণকেন্দ্র এই ফ্যাক্টরি। এটাকে ধ্বংস করার মত বোকা সে নয়। কৌশলে কাজ সারতে চাইবে। কিন্তু আমার ক্ষমতার কাছে সে তুচ্ছ।

রিগড়ের দিকে ফিরে কি একটা আদেশ দিলেন ক্যামারেট। সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল ফোরম্যান। মিনিটখানেক পরেই পায়ের তলা থেকে একটা চাপা গুম গুম শব্দ ভেসে এল।

ভুরু কুঁচকে ক্যামারেটের দিকে চাইলেন বারজাক।

হাসলেন বিজ্ঞানী, না, রিগড় কোন কিছু করেনি এখনও। শব্দটা আসছে নিচতলা থেকে। ফ্যাক্টরিতে ঢোকার লোহার কবাট ভাঙতে চাইছে কেউ। হ্যারি কিলারেরই লোক আর কি। কিন্তু ক্ষমতা নেই।

কামান নিয়ে আসে যদি? কিছুতেই যেন আশ্বস্ত হতে পারছেন না বারজাক।

খামোকাই বোঝা বওয়ার কষ্ট করবে। এবং ভীষণ কষ্ট। কারণ প্রাসাদ থেকে এখান পর্যন্ত কামান আনার মত কোন সোজা পথ নেই। কাজেই নাকের পানি চোখের পানিতে এক হবে বেচারার। তাই প্রথমেই ওকাজ না করে কবাট ভাঙতে চাইবে এবং আগামী একশো বছরেও একচুল নড়বে না কবাট। বলেই ডাকলেন ক্যামারেট, আসুন আমার সঙ্গে।

ক্যামারেটের পিছু পিছু চলল অভিযাত্রীরা। উত্তেজনা আর কৌতুহলে ফেটে পড়তে চাইছে। নিষ্ঠুর দুর্ধর্ষ হ্যারি কিলার খেপেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে কি পারবেন এই প্রতিভাবান সহজ সরল মানুষটি?

মেশিন ঘরে কাজ বন্ধ। জোট বেঁধে আলোচনায় মশগুল কর্মচারী শ্রমিকেরা। ওদের দিকে ফিরেও চাইলেন না ক্যামারেট। এগিয়ে চললেন।

অসংখ্য ছোট-বড়, সোজাবাঁকা করিডর পেরিয়ে একটা ঘোরানো সিড়ি বেয়ে ফ্যাক্টরি টাওয়ারের প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছল অভিযাত্রীরা ক্যামারেটের পিছু পিছু। এই ধরনের টাওয়ারে চড়েছেন আগেও তাঁরা। প্রাসাদের টাওয়ার। কিন্তু এটা আরও অনেক বেশি উঁচু। এখানেও একটা সাইক্লোসকোপ আছে, হ্যারি কিলারেরটার চাইতে বড়।

এই সাইক্লোসকোপ দিয়ে শুধু দূরে নয়, কাছেও দেখা যায়। ফ্যাক্টরির পাঁচিলের তলা পর্যন্ত এক্কেবারে পরিষ্কার দেখা যায়। কিছুই না কিন্তু ব্যাপারটা। গোটা কয়েক বিশেষ ধরনের আয়নার কারসাজি।

ক্যামারেটের কথা ঠিকই। এসপ্ল্যানেড, জেটি আর ফ্যাক্টরির পাঁচিল বরাবর রাস্তায় লোকজন ছুটোছুটি করছে। আকারে ছোট ছবিগুলি, কিন্তু স্পষ্ট! ফ্যাক্টরির প্রধান কবাটের গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে শুধু-শুধু ঘাম ঝরাচ্ছে জনা বিশেক লোক। মেরি ফেলো।

বলিনি? অভিযাত্রীদের দিকে ফিরে চাইলেন ক্যামাৱেট, দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে ওরা।

আরও প্রায় মিনিট দশেক চেষ্টা করে অন্য পথ ধরল লোকগুলো। উঁচু উঁচু মই নিয়ে এল। ফ্যাক্টরির পাঁচিলের গায়ে ঠেকিয়ে তর তর করে বেয়ে উঠতে লাগল।

আর ঠেকানো যাবে না ভাবলেন বারজাক। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন ক্যামারেটের দিকে; মুচকে হাসলেন বিজ্ঞানী। ফোনে ফোরম্যানকে কি নির্দেশ দিলেন। তারপর শান্তভাবে নামিয়ে রাখলেন রিসিভার।

পাঁচিলের মাথায় উঠে এসেছে কয়েকজন লোক। কিন্তু পাঁচিলের মাথায় হাত ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতে তান্ডব নৃত্য শুরু হলো। আঠার সাথে আটকে গেছে যেন, এমনিভাবে পাঁচিলের মাথায় ঝুলে থেকে পা ছুঁড়তে লাগল ওরা। যেন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা একদল পুতুল।

বুদ্ধর দল। বললেন ক্যামারেট। অভিযাত্রীদের বোঝালেন, তামার চাইতে একশোগুণ বেশি বিদ্যুৎ-পরিবাহক একটা কৃত্রিম ধাতু আবিষ্কার করেছি আমি। ওই ধাতু দিয়েই মোড়ানো আছে পাঁচিলের মাথা। ধাতুর পাতের মধ্যে দিয়ে অল্প ভোল্টের অলটারনেটিং কারেন্ট চালু করে দেয়া হয়েছে। ফলটা দেখতেই পাচ্ছেন। তৃপ্তির হাসি হাসলেন বিজ্ঞানী।

ওদিকে আরেক কান্ড ঘটেছে! ঝুলে থেকে পা ছুড়ন্ত লোকগুলোর কান্ড বুঝতে না পেরে ঠিক নিচের লোকগুলো পা চেপে ধরেছিল তাদের। ব্যাস, আঠার মত লেগে গেল ওদের হাত ওপরের লোকগুলোর পায়ের সঙ্গে। মুখ বিকৃত করে মইয়ের ওপরই নাচ শুরু হলো ওদেরও।

হাঁ হাঁ করে হাসল সেন্ট বেরেন? বলল, বোকাগুলোর মাথায় কিছু নেই নাকি? হাত ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে পড়ছে না কেন ব্যাটারা?

পারলে তো? বললেন ক্যামারেট, যতক্ষণ পর্যন্ত আটকে রাখছি ওদের, একচুল নড়াতে পারবে না হাত। আরও খেল দেখাচ্ছি। মজা দেখুন।

একটা সুইচ টিপলেন ক্যামারেট। সঙ্গে সঙ্গেই যেন কয়েকটা অদৃশ্য হাত ঠেলে দিল মইগুলোকে। ছিটকে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল ওগুলো, লোকসুদ্ধ। এ-ওর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল মইয়ের নিচের দিকের হানাদার মেরি ফেলোরা। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট লোকগুলো কিন্তু ঝুলেই থাকল পাঁচিলের মাথায়।

ওদের হাত-পা ভাঙার জন্যে ওরাই দায়ী, সহজ গলায় বললেন ক্যামারেট, আগে আক্রমণ করেছে ওরাই। তা মইগুলো পড়ল কি করে শুনবেন?

সবাই একসঙ্গে চাইল ক্যামারেটের মুখের দিকে।

আমার থিওরি হলো, সব শক্তিই ইথারের ভেতরে এক ধরনের কম্পন ছাড়া আর কিছুই না। যেমন, আলো এক বিশেষ ধরনের কম্পন। বিদ্যুৎও তাই। শুধু তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলাদা। আমার বিশ্বাস, তাপের সঙ্গে এই বিদ্যুৎ তরঙ্গের কোন যোগাযোগ আছে। কারণটা ঠিক ধরতে পারিনি, তবে ইচ্ছেমত কম্পনটা সৃষ্টি করতে পারি ইথারের মাঝে। ওই কম্পনই মইগুলোকে ঠেলে ফেলে দেয়ার জন্য দায়ী।

ওদিকে পাঁচিলের মাথায় ঝুলে থেকে নেচেই চলেছে লোকগুলো।

আর আটকে রেখে লাভ নেই বোকাগুলোকে, বলেই আরেকটা সুইচ টিপলেন ক্যামারেট।

তিরিশ ফুট ওপর থেকে কংক্রিটের পথের ওপর খাড়া পড়ল লোকগুলো। পড়েই থাকল। অত ওপর থেকে পড়ে হাড়গোড় বোধহয় আর একটাও আস্ত নেই ওদের। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে পড়ে থাকা সঙ্গীদের দূরে নিয়ে গেল মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা মেরি ফেলোরা।

ক্যামারেটের ওপর অবিশ্বাস রইল না আর অভিযাত্রীদের কারোই। সবারই মুখে হাসি। মেরি ফেলোদের ভোগান্তি দেখে হেসেই খুন সেন্ট বেরেন আর টোনগানে।

এগিয়ে এসে আবার দরজা ভাঙার দিকে মন দিল মেরি ফেলোরা।

এবার ওদের একটু শিক্ষা দেয়া দরকার, বললেন ক্যামারেট। রিসিভার তুলে নিয়ে আবার কি নির্দেশ দিলেন রিগড়কে।

অদ্ভুত একটা শব্দ উঠল টাওয়ারের গোড়ার দিকে। পরক্ষণেই চোঙার মত দেখতে আজব একটা বস্তু বেরিয়ে এল টাওয়ারের গা থেকে। ছুঁচোল মুখটা নিচের দিকে খাড়াই রেখে টাওয়ারের কাছে সরে গেল চোঙটা। এবারে দেখা গেল, চোঙের পেছনে চারটে প্রপেলার। একটা খাড়া আর তিনটে আনুভূমিক অবস্থায়। বন বন করে ঘুরছে। মাটি থেকে কয়েকগজ শুন্যে দাঁড়িয়ে পড়ল চোঙটা। তারপর আনুভূমিক অবস্থায়ই প্রচন্ড গতিতে উড়ে গেল পাঁচিলের প্রায় গা ঘেঁষে।

ওদিকে আরেকটা চোঙ বেরিয়ে এসেছে টাওয়ারের একই জায়গা থেকে। তারপর আরেকটা। তার পেছনে আরেকটা। মোট বিশটা চোঙ-পাখি উড়ে গেল প্রথমটাকে অনুসরণ করে। একই লাইনে।

ওয়াম্প আর্মি, মানে আমার বোলতা বাহিনী। বোলতা শব্দটার ওপর জোর দিলেন ক্যামারেট। কি করে কাজ করে পরে বোঝাব। মজা দেখুন আগে!

আবার রিসিভার তুলে নিয়ে রিগডকে আদেশ দিলেন ক্যামারেট, রিগড, শুধু হুঁশিয়ার করে দাও ওদের। এখন পর্যন্ত তো কোন ক্ষতি করেনি আমাদের। তাই খুব বেশি কিছু কোরো না।

ফ্যাক্টরির বাইরে এসপ্ল্যানেডে এসে ক্রমেই আরও বেশি লোক জড় হচ্ছে। আরও কয়েকজন এসে যোগ দিয়েছে কবাটগুঁতানো মেরি ফেলোদের সঙ্গে। বোলতা বাহিনীকে দেখে ক্ৰক্ষেপ করল না তারা। ব্ল্যাকল্যান্ডে আজব জিনিস দেখে দেখে এখন আর কৌতূহল নেই ওদের। বড় বড় গাছের গুঁড়ির সাহায্যে সমানে কবাট ধাক্কিয়ে চলল।

সার বেঁধে মেরি ফেলোদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল বোলতা বাহিনী। এসপ্ল্যানেডের ওপর দিয়ে একবার চক্কর মেরে এনে থামল কাবাটের একশো গজ দূরে, শূন্যে। তারপরই গর্জে উঠল সামনের বোলতাটা; এক বাঁক মেশিনগানের গুলিতে মেরি ফেলোদের কয়েকগজ পেছনে ধুলো উড়ল। পরণেই সরে গেল বোলতাটা। তার জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেল দ্বিতীয় বোলতাটা। এটাও গুলি বর্ষণ করল। তারপর সরে গিয়ে জায়গা করে দিল, তৃতীয়টাকে।

জনা তিনেক মেরি ফেলো মারা গেল গুলি খেয়ে। কয়েকজন আহত হলো। অন্যেরা পড়িমরি করে ছুটল নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। চতুর্থ বোলতাটার আর গুলী করার দরকার হলো না। চোখের পলকে নির্জন হয়ে গেছে জায়গাটা।

গুলি বর্ষণ করেই টাওয়ারে নিজের বাসায় ফিরে এসেছে প্রথম তিনটে বোলতা। গুলি ভরে নিয়েই ফিরে এসে অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। অন্য সতেরোটা বোলতার পেছনে। একেবারে পাকা ট্রেনিং পাওয়া যেন!

নিজের চোখকেও যে বিশ্বাস করতে পারছে না অভিযাত্রীরা। একবার নিচের দৃশ্যের দিকে একবার ক্যামারেটের দিকে তাকাচ্ছে ওরস। চোখ বড় বড় করে আজব এই মানুষটার সৃষ্ট বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক কান্ড-কারখানা দেখে স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে গেছে তারা।

বোকা পাঁঠাগুলোকে নিয়ে আর মাথা ঘামানোর দরকার নেই, অভিযাত্রীদের দিকে ফিরে বললেন ক্যামারেট, চলুন, ফ্যাক্টরি ভেতরটা ভাল করে দেখাই আপনাদের। তবে তার আগে ফ্যাক্টরির নকশাটা দেখে নিন।

আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে
০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
পরের পর্ব :
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে
১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা
১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি
১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
১৩. কিসের এত শব্দ
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত