মরুশহর: ০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়

মরুশহর: ০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়

০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়

২৬ মার্চ-৮ এপ্রিল।

হ্যারি কিলারের নৃশংসতায় দমে এতটুকু হয়ে গেল অভিযাত্রীদের মন। কখন আবার কি অনর্থ ঘটায় নিষ্ঠুর পাগলটা, তাই ভয়ে ভয়ে রইল তারা।

অভিযাত্রীদের অবাক করে দিয়ে কিন্তু পরদিন থেকে তাদের সঙ্গে অন্যরকম ব্যবহার শুরু করল হ্যারি কিলার। বোধহয় জেনের মন জয় করার জন্যেই গ্যালারির ছাদে ওঠার অনুমতি দিল। অভিযাত্রীদের কয়েদখানার ওপরেই এই গ্যালারি। ছাদে ওঠার সিঁড়ি আছে। গ্যালারির বাইরেই কিন্তু সকাল-বিকাল সিপাই-সান্ত্রীদের কর্কশ গলা আর অস্ত্র ঠোকাঠুকির আওয়াজ পাওয়া যায়।

দিনের বেলা চড়া রোদে ছাদে বসা সম্ভব নয়। তাই বেলা শেষে রোদ পড়ে এলে সবাই গিয়ে ছাদে ওঠে। চেয়ার নিয়ে বসে শহরের দৃশ্য দেখে আর গল্প করে। বেশির ভাগ সময়েই, কি করে পালানো যায় এই নিয়ে ফন্দি আঁটে তারা। কিন্তু বৃথা। পালানোর কোন উপায়ই বের করতে পারে না এত ভেবেও।

খাবার নিয়ে আসে চৌমৌকি। ও এলেই একেবারে চুপ মেরে যায় অভিযাত্রীরা। বিশ্বাসঘাতকটাকে বিশ্বাস নেই। কান পেতে সব শুনে গিয়ে হয়তো লাগাবে হ্যারি কিলারের কাছে। আর সোজা ওদের নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাবে খুনেদের সর্দারটা।

গ্যালারির ছাদ অনেকটা বুরুজের মত। দুদিকে ছড়ানো। পুব দিকে প্যালেসটা। মাঝে মাঝে চত্বর। এই চত্বর পেরিয়েই সাইক্লোসকোপ মেশিনের কেরামতি দেখতে গেছে অভিযাত্রীরা। এসপ্ল্যানেড়ের ওপর গিয়ে শেষ হয়েছে একদিকের ছাদ। তারপরেই উঁচু পাঁচিল, এবং তারপরে রেড রিভার। ছাদ থেকে নব্বই ফুট নিচে অন্য প্রান্ত চলে গেছে প্যালেস ছাড়িয়ে ফ্যাক্টরির ওপর। তারপরে আবার পাঁচিল। সুতরাং পালানোর আশা করাই ভুল।

এসপ্ল্যানেজের দিক দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অনবরত যাওয়া আসা এদিকে কাউন্সিল মেরি ফেলো আর নিগ্রো গার্ড-দাসদের। তাছাড়া আছে উচু পাঁচিল। ডিঙানো অসম্ভব।

অন্যদিকে তো রেড রিভারই। তাও নব্বই ফুট নিচে। নিচের দিকে চাইলেই মাথা ঘুরে ওঠে। তবে সাংঘাতিক রকম দুঃসাহস থাকলে এদিক দিয়েই পালানোর চেষ্টা করা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে বেশ কিছু উপকরণ দরকার। যেমন লম্বা দড়ি, নৌকা ইত্যাদি। তা তো আর পাচ্ছে না, কাজেই পালানোও আর হচ্ছে না অভিযাত্রীদের।

কি আর করা। বিকেল বেলা ছাদে বসে শহরের দৃশ্য দেখাই সার। রেড রিডারের দুপাশে বিশাল সব মহীরূহের সমাবেশ। মাত্র দশ বছরে গাছগুলো এতবড় হলো কি করে, বুঝতে পারে না অভিযাত্রীরা। ব্ল্যাকল্যান্ডের ভাগ করা তিনটে অংশও পরিষ্কার দেখা যায় এখান থেকে। দেখা যায় শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণকায়দের কর্মব্যস্ততা।

ফ্যাক্টরির দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায় অভিযাত্রীদের। রীতিমত তাক লেগে যায়। আজব মরু শহরের মধ্যে যেন আরেকটা শহর। একদম আলাদা। পাঁচিল দিয়ে চারদিক ঘিরে রাখা হয়েছে। বেরনোর কোন পথ দেখা যায় না। কেন?

রীতিমত সুরক্ষিত এই শহরের বাচ্চাটা। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেন নিজেরাই করে নিয়েছে। বাইরের শহরের সঙ্গে ভেতরের যোগাযোগ বলতে কিছু নেই। বিশাল কারখানার বিশাল চিমনিও আছে। কিন্তু ধোঁয়া বেরোয় না কেন ওই চিমনি দিয়ে? প্যালেস টাওয়ারের মতই ওখানেও টাওয়ার আছে একটা। কিন্তু বেমক্কা রকমের উঁচু আর পাইলনে ঠাসা। ওই শখানেক গজ উচু টাওয়ারের প্রয়োজনীয়তাটা কি? ঘুরে ফ্যাক্টরির ধার ঘেঁষেই চলে গেছে রেড রিভার। পাড়ে বিশাল সব ইমারত। কেন? অনেকগুলো বাড়ির দেয়ালে সবুজ রঙের কিসের যেন প্রলেপ। সবচেয়ে বড় বাড়িটায় রয়েছে অত্যাধুনিক বিপণী কেন্দ্র। একপাশে ফলের বাগান। ঘেরা পাঁচিলের মাথায় ধাতুর তৈরি অদ্ভুত সব কি যেন। কেন? পাঁচিলের ওদিকে দুরে ধু-ধু মরুভূমি। সবকিছু দেখে শুনে একটাই ধারণা হলো অভিযাত্রীদের, বাইরের সাহায্যের খুব একটা দরকার নেই ফ্যাক্টরি শহরের। নিজেদের প্রয়োজন নিজেরাই মেটাতে পারে এর অধিবাসীরা। এটা আবার আরেক রহস্য।

এসব ব্যাপারে চৌমৌকিকে অনেক জিজ্ঞেস করল অভিযাত্রীরা। কিন্তু উত্তর পেল না। বরং জিজ্ঞেস করলেই কেমন যেন আতঙ্কে কাঠ হয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে বলে, কারখানা… কারখানা… শয়তানের কারখানা! ব্যস, এইটুকুই। কিন্তু অত ভয় কেন খুদে ওই শহরটাকে? কি লুকিয়ে আছে বিশাল সব অট্টালিকার ভেতর? কুসংস্কার, না সত্যিই আতঙ্কিত হওয়ার মত আছে কিছু?

আজব শহরের আজব ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে অভিযাত্রীরা।

জেনকে সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা দিয়েছে হ্যারি কিলার। প্যালেস আর এসপ্ল্যানেডের যেখানে খুশি যাওয়ার অনুমতি আছে তার। অন্যদের সে-স্বাধীনতা নেই। কিন্তু রেড রিভার পেরোনোর অনুমতি নেই জেনেরও। ক্যাসল ব্রিজে সারাক্ষণই পাহারায় থাকে সশস্ত্র সান্ত্রি।

স্বাধীনতা পেয়েও ভোগ করে না জেন। বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করতে রাজি নয় সে।

জেনের এই ব্যবহারে অবাক হয়েছে চৌমৌকি। চোখ কপালে তুলে বলেছে, আরে মেমসাব! দুদিন পরে না মাস্টারের বেগম হবেন। কত সোনাদানা, হীরে জহরৎ পাবেন, তাছাড়া সম্রাজ্ঞী হবেন এই ব্ল্যাকল্যান্ডের। সব কিছু দেখে শুনে নিচ্ছেন না কেন?

জবাব দেয়নি জেন। পাত্তাও দেয়নি চৌমৌকির কথা।

এই সাংঘাতিক পরিস্থিতিতেও কিন্তু হাসিঠাট্টা চলে অভিযাত্রীদের নিজেদের মধ্যে। সুযোগ পেলেই লম্বা চওড়া বক্তৃতা দিয়ে বসেন বারজাক। তাছাড়া বার বার মহড়া দিচ্ছেন একটা বিশেষ বক্তৃতার, অভিযাত্রীদের সামনেই। হ্যারি কিলারের সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ হলেই ঝাড়ার ইচ্ছে।

লেখা রিপোর্টগুলো বার বার পড়ে দেখে আমিদী ফ্লোরেন্স। আরও উন্নত করে তোলে। বারজাক মিশনের সাড়া জাগানো কাহিনী ছেপে তাক লাগিয়ে দেবার ইচ্ছে পৃথিবীবাসীকে।

সেন্ট বেরেন আর ডক্টর চাতোন্নের সময় কিন্তু আর কাটতে চায় না। রোগী পাঁচ্ছেন না ডাক্তার। মুখ গোমড়া করে রাখা ছাড়া করার কিছুই নেই। ওদিকে মাছ ধরতে পারছে না সেন্ট বেরেন। শরীর সুস্থ হয়ে উঠেছে তো, আবার মাছের নেশায় পেয়েছে। লোভাতুর দৃষ্টিতে রেড রিভারের দিকে তাকিয়ে থাকে আর আপন মনে বিড় বিড় করে।

ডিকশনারির মত মোটা নোট বইয়ে সারাক্ষণই মাথা গুঁজে কি যেন লেখেন পঁসি। ক্রমেই কৌতূহল বাড়ছে ফ্লোরেন্সের। এত কি লেখে লোকটা?

শেষে একদিন থাকতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে বসল, সারাক্ষণ এত কি লেখেন, মঁসিয়ে?

ধাঁধা। জবাব চাই। সংক্ষিপ্ত উত্তর। ভীষণ গম্ভীর গলা পঁসির।

ধাঁধা?

তাই। এই যে শুনুন না এটা… বলে একটা ধাঁধা শুনিয়ে দিল ফ্লোরেন্সকে পঁসি। মাথামুন্ডু কিছুই বুঝল না রিপোর্টার। টের পেয়ে হে হে করে হাসল পঁসি। বলল, অত সহজেই কি আর বুঝবেন? এটা চাইনীজ ধাঁধা যে।

আসলে পাগলিজ ধাঁধা, তাই না?

হোয়াট? কি নাম বললেন?

পাগলিজ, পাগলিজ। নিছক পাগলামি তো, তাই থেকে নামটার উৎপত্তি। অত মনোযোগ দিয়ে কি এসবেরই জবাব খোঁজেন?

নিশ্চয়ই। তাছাড়া ধাধা তো শুধু একটাই নয়। প্রশ্নও অনেক আছে। যেমন এগারোশো সাতানব্বই নম্বরটার জবাব একটু আগে পেয়ে গেছি।

সঠিক সমাধান তো?

তাছাড়া কি? কি মনে হয় আপনার?

জঙ্গলে থাকতে, মানে আমি বলতে চাইছি জঙ্গল ঠেঙিয়ে আসার সময় অনেক কিছুই লিখেছেন নোট বইয়ে। কতগুলো দুর্বোধ্য সংখ্যা। মানে বের করতে পেরেছেন?

মানে বের করেই লিখেছি।

ওই এলোমেলো মাথামুন্ডু ছাড়া সংখ্যার?

দেখুন আমি স্ট্যাটিসটিশিয়ান। ওই এলোমেলো সংখ্যাই আমার কাছে কাহিনী।

যেমন?

নোট বইয়ে পরিসংখ্যানের হিসেব লিখেছি।

মানে?

মানে? সোজা। যেমন জঙ্গলে কটা চোখা শিংওলা হরিণ দেখেছিলাম তার হিসেব। লিখে রেখেছি ফেব্রুয়ারির ষোলো তারিখে। হিসেবটা বলছি। ক্ষেত্রফল যদি পঁচিশ হাজার বর্গমাইল হয়, তাহলে সেখানে ওই রকম হরিণের সংখ্যা হলো পাঁচ লক্ষ ছাপান্ন হাজার পঞ্চান্নটা। অবাক হচ্ছেন তো?

নিশ্চই, নিশ্চই। না হয়ে উপায় আছে।

উৎসাহ বেড়ে গেল পঁসির। বলল, দেখছেন নিশ্চয়, এই অঞ্চলের নিগ্রোদের হাতে, উল্কি দিয়ে রেখা আঁকা হয়েছে। শুধু নাইজার অঞ্চলের নিগ্রোদের সমস্ত উল্কিরেখা একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া দেয়া গেলে মোট এক লক্ষ তিন হাজার পাঁচশো উননব্বই বার বেড় দেয়া যাবে পৃথিবীকে।

হুমম! এই না হলে স্ট্যাটিসটিশিয়ান!

ঠিক ধরতে পেরেছেন আপনি। আরও হিসেব জানাচ্ছি আপনাকে। ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে নাইজার বেন্ডের মোট জনসংখ্যা ছিল চোদ্দ লক্ষ ঊনআশি হাজার একশো চোদ্দ জন।

কিন্তু নোট বইয়ে দেখলাম ষোলোই ফেব্রুয়ারি জনসংখ্যা লিখেছেন আরও অনেক কম। মাত্র চার লাখ সত্তর হাজার ছশো বায়ান্ন জন?

ঠিকই দেখেছেন। আমার কথাও ঠিক, আপনার দেখাও।

অর্থাৎ? মড়ক লেগে হুড় হুড় করে মরে শেষ হয়ে গেছে নিগ্রোগুলো?

দেখুন মঁসিয়ে, স্ট্যাটিসটিকস একটা আশ্চর্য বিজ্ঞান। একেক দিন এর হিসেব একেক রকম হয়ে যায় এবং সামান্য দশ লক্ষের পরিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামান না। কাজেই দুটো তারিখের দুটো হিসেব দুরকম হবেই। হিসেব করার মত মেজাজ তো আর সবদিন থাকে না। এই মেজাজটাকে প্রাধান্য দেয় বলেই বিজ্ঞানটা নিয়ে পড়েছি আমি। এই দেখুন না, মানুষের মাথার চুল বৃদ্ধির সঙ্গে জোয়ার-ভাটার সম্পর্কটা অঙ্কের হিসেবে লিখে রেখেছি…।

আর শোনার কৌতূহল নেই আমিদী ফ্লোরেন্সের। কায়দা করে সরে পড়ল সে।

ওদিকে হ্যারি কিলারকে নিয়ে গভীর গবেষণা শুরু হয়েছে।

লোকটাকে কোন দেশী মনে হয়? জিজ্ঞেস করলেন বারজাক।

ভাষা আর উচ্চারণ শুনে ইংরেজ বলেই মনে হয়। বলল জেন।

অসাধারণ ইংরেজ। মাত্র দশ বছরে সাহারার মত মরুভূমির বুকে শস্য ফলাতে পারে, ক্ষমতাটা ভেবে দেখার মত! বিরাট বৈজ্ঞানিক প্রতিভা দরকার। মন্তব্য করলেন বারজাক।

আমার কিন্তু মনে হয়, এসবের পেছনে অন্য কোন ব্রেন কাজ করছে। হ্যারিটা তো বদ্ধ উন্মাদ। যোগ দিল ফ্লোরেন্স।

অর্ধবদ্ধ। বললেন ডাক্তার।

অর্ধবদ্ধ? অবাক হয়ে সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করল।

বুঝলেন না? মানে আধ পাগল। বুঝিয়ে দিলেন ডাক্তার। বাকি অর্ধেকটা মাতাল। এবং সেজন্যেই বদ্ধ পাগলের চাইতে অনেক বেশি বিপজ্জনক। বদ্ধ পাগল বা বদ্ধ মাতাল না বলে বদ্ধ উন্মাতাল বলা যায় তাকে।

ডাক্তারের কথায় হো হো করে হেসে উঠল সবাই, বারজাক ছাড়া।

হ্যারি কিলারের মত চরিত্র আরও আছে আফ্রিকায়, গম্ভীর গলায় বললেন বারজাক। কথার কথায় মানুষ খুন করে এরা। যে কোন ধরনের নিষ্ঠুরতা কিছুই না এদের কাছে।

আপনারা যে যাই বলুন, বলল ফ্লোরেন্স, আমি কিন্তু বদ্ধ উন্মাদই বলব ওকে। এক্কেবারে পাগল। এই রাগছে, এই ঠান্ডা হচ্ছে। হয়তো এখন আমাদের কথা মনেই নেই। মনে হলেই ধরে নিয়ে গিয়ে হয়তো ফাঁসিতে ঝোলাবে।

বিচিত্র পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সাতটা দিন কেটে গেল। কিন্তু পালানোর কোন উপায়ই করতে পারল না অভিযাত্রীরা।

পর পর দুটো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটল তেসরা এপ্রিল। এ দিন বিকেল তিনটা নাগাদ অভিযাত্রীদের অবাক করে দিয়ে এসে পৌঁছল মালিক। এসেই আছড়ে পড়ল একেবারে জেন ব্লেজনের পায়ের কাছে।

পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে এসেছে মালিক। পায়ে হেঁটে। পথে ওর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে বিশজন নিগ্রো সৈন্য। সার্জেন্ট দুজন আরও বাড়া।

জিজ্ঞেস করে জানা গেল, টোনগানের কোন খবর জানে না মালিক।

দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল বিকেল পাঁচটা নাগাদ! হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল চৌমকি। ভীষণ উত্তেজিত। কি ব্যাপার? জেনকে নিতে পাঠিয়েছে হ্যারি কিলার।

মারমুখো হয়ে তেড়ে উঠল অভিযাত্রীরা! চুপচাপ বসে বসে দেখতে লাগল জেন।

কাকুতি মিনতি করতে লাগল চৌমোকি। বলল, দোহাই আগনাদের, অমন করবেন না। সর্বনাশ হয়ে যাবে তাহলে। মাস্টার রেগে গেলে একজনকেও অন্ত রাখবে না।

কিন্তু চৌমোকির কথায় কানই দিল না কেউ। সোজা হাঁকিয়ে দিল তাকে।

চৌমোকি চলে যেতেই আলোচনা আরম্ভ হলো। হঠাৎ এই তলব কেন হ্যারি কিলারের? এক মাসের তো এখনও অনেক দেরি। মত পাল্টে ফেলেছে খুনেটা? আসলে উন্মাদটার কপায় বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে অভিযাত্রীদের। সে যাই হোক, প্রাণ থাকতে কিছুতেই জেনকে একা হ্যারি কিলারের কাছে যেতে দেয়া হবে না, ঠিক করল সবাই।

এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি জেন। সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেই উঠে দাঁড়াল সে, খামোকা ভয় পাঁচ্ছেন আপনারা? বলল সে। পোশাকের ভেতর থেকে একটা ছুরি বের করে সবাইকে দেখাল, এই দেখুন। নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আমার আছে।

আবার আগের জায়গায় ছুরিটা লুকিয়ে ফেলে দেন। প্রায় তখন আবার এসে হাজির হলো চৌমোকি। উদভ্রান্ত চেহারা। আতঙ্কে ঠেলে বেরিয়ে আসছে দুই চোখ। কাঁপছে থর থর করে বলল, দোহাই আপনাদের। খেপে গিয়ে পাগলের মত চেঁচাচ্ছে মাস্টার। এখুনি মিস ব্লেজনকে যেতে না দিলে আপনাদের দুজনকেই ফাসী দেবে মেরি ফেলোরা।

দিক। একসঙ্গে বুক ফুলিয়ে দাড়াল পাঁচজন পুরুষ!

কিন্তু চৌমোকি কিছু বলার আগেই তাদের সামনে এসে দাঁড়াল জেন। বলল, আমার জন্যে আপনাদের ফাঁসীতে ঝুলতে দেব না কিছুতেই। এমনিতেই আপনাদের বিপদে ফেলার জন্যে সরমে মরে যাচ্ছি আমি। চৌমোকির দিকে ফিরে বলন, চল! আমি যাব।

সঙ্গীদের বিমুঢ় দৃষ্টির সামনে দিয়ে চৌমৌকির পেছনে পেছনে সহজ ভঙ্গিতে চলে গেল জেন।

ঠিক তিন ঘণ্টা পরে, আটটায় ফিরে এল জেন। সাংঘাতিক উদ্বেগের মধ্যে কাটিয়েছে তার সঙ্গীরা। দেখেই একযোগে প্রশ্ন করল, কি, কি হলো? খারাপ কিছু নয়তো?

কি আবার হবে? গলা কাঁপছে জেনের।

মানে, মানে কেন ডেকেছিল খুনেটা? জিজ্ঞেস করল সেন্ট বেরেন।

বড়াই করার জন্যে। সারাক্ষণই বেহায়ার মত শুধু নিজের প্রশংসা। শেষে বলল, আমার মত ছোট্ট একটা মেয়েকে যে বিয়ে করতে চেয়েছে সে, এতেই কৃতার্থ হয়ে যাওয়া উচিত আমার সামাজ্যের সম্রাজ্ঞী করে রাখবে। মনে করিয়ে দিলাম, ভাববার জন্যে একমাস সময় দেয়া হয়েছে আমাকে। তার আগেই এসব বলার জন্যে মেজাজ দেখলাম। কিন্তু আশ্চর্য! একটুও রাগল না হ্যারি কিলার। বরং হাসল। বলল, এক মাস সময়ের কথা মনে আছে তার। কিন্তু একটা ব্যাপারে মত পাল্টেছে। রোজ বিকেলে গিয়ে সঙ্গ দিতে হবে তাকে।

রাজি হলি তুই? উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে এল সেন্ট বেরেন।

হ্যাঁ। হলাম। ভেবে দেখলাম, তার ওপর প্রভাব খাটাতে পারব আমি। সুতরাং সুযোগটা হাতছাড়া করা বোকামি হবে। ঝুঁকিও নেই। আমি গিয়ে তো দেখি, বসতেই পারছে না ঠিকমত। পাড় মাতাল। গিয়েই গেলাসে মদ ঢেলে দিলাম। হ্যারি তো ভারি খুশি। তারপর থেকে সারাক্ষণই মদ ঢেলে আর পাইপ ধরিয়ে দিলাম খুনেটার। এই তো, খানিক আগে টেবিলের ওপরেই ঢলে পড়ে নাক ডাকাতে শুরু করল সে! চলে এলাম।

এরপর থেকে রোজই তিনটের দিকে হ্যারি কিলরের কাছে যেতে লাগল জেন। ঠিক আটটায় ফিরে আসে।

কোন কোন দিন গিয়ে দেখে, সাংঘাতিক চরিত্রের কাউন্সিলরদের নিয়ে মীটিঙে বসেছে, হ্যারি কিলার। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পরামর্শ দিচ্ছে কর্মচারীদের, হুকুম করছে, এই সময় দেখলে কেউ বলবে না, সামান্যতম মদ ছোঁয় হ্যারি কিলার। নিঁখুত পরামর্শ দিচ্ছে সঙ্গীদের। রাজ্য চালনায় বিন্দুমাত্র ভুল নেই। মাঝে মাঝে এক আধজন কাউন্সিলরকে কাছে ডেকে কানে কানে কি সব বলে হ্যারি কিলার। ব্যাপারটা দুর্বোধ্য জেনের কাছে।

ঘটাখানেক পরেই চলে যায় কাউন্সিলররা। তারপর থেকে হ্যারি কিলারের সঙ্গে একেবারে একলা থাকে জেন। আরেকটা ব্যাপার নিয়মিত ঘটে রোজ। ঠিক সাড়ে চারটের দিকে জেনকে বসতে বলে কোমর থেকে চাবি নিয়ে পেছনের একটা দরজার তালা খুলে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যায় হ্যারি কিলার। আধ ঘন্টা মত থাকে। এই সময়টুকুতে মানুষের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ ভেসে আসতে থাকে ছোট্ট দরজার ওপাশ থেকে। কে কাতরায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে জেনের, এগিয়ে গিয়ে উকি দেয়, কিন্তু সাহস হয় না।

পাঁচটা নাগাদ খুশিতে প্রায় লাফাতে লাফাতে ফিরে আসে হ্যারি কিলার।

এসেই হুকুম দেয় মদ আর তামাকের। গেলাসে মদ ঢেলে দেয় জেন, পুরানোটা ফেলে নতুন তামাক ঠেসে পাইপ ধরিয়ে দেয়। সাতটার পর পরই নাক ডাকানো শুরু হয় হ্যারি কিলারের। ফিরে আসে জেন।

ফিরে আসার আগে একটা কাজ করার খুবই লোভ হয়। কিন্তু কয়েকটা কথা জেনে কাজটা করবে না সে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে, তাদের ছয় অভিযাত্রীদের বাঁচতে হলে এখন হ্যারি কিলারের একান্তই দরকার। একমাত্র তাকেই যমের মত ভয় করে ব্ল্যাকল্যান্ডবাসীরা। যেই সে মরবে মেরে ফেলা হবে অভিযাত্রীদের। সুতরাং, পালাবার উপায় ঠিক না করে হ্যারি কিলারকে মারা একেবারেই বোকামি হবে।

অবশ্য জামিন হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধে হবে বলে মনে হয় না। বরং অভিযাত্রীদের সঙ্গে বন্দী হ্যারি কিলারকে খুন করে নিশ্চিন্ত হবে মেরি ফেলোরা। সাম্রাজ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে। কার আগে কে রাজা হবে, এই নিয়ে চলবে খুনোখুনি। কাজেই এই চিন্তাটাও বাদ দিল জেন।

রোজই নিয়মিত হ্যারি কিলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায় জেন। মহাখুশি কিলার। মেরি ফেলো আর ব্ল্যাকগার্ডেরা জেনে গেছে, জেনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে সে। তাই জেনকে অত্যন্ত সমীহ করে চলে তারা। কে জানে, আবার কোন্ জিনিসটা পছন্দ করবে না বিদেশী মেয়েটা, লাগাবে গিয়ে হ্যারি কিলারের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে গর্দান যাবে অপরাধীর। কাজ কি বাবা গোলমাল করে। কোনমতে জানটা টিকিয়ে রাখতে পারলেই যথেষ্ট।

গেল আরও পাঁচটা দিন।

৮ এপ্রিল। যথারীতি হ্যারি কিলারকে সঙ্গ দিয়ে এসেছে জেন। খাওয়া দাওয়া শেষ। রাত সাড়ে নটা। চৌমৌকি এঁটো বাসনপত্র গোছগাছ করতে ব্যস্ত। ছাদে এসে উঠল অভিযাত্রীরা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল এক প্রান্তে। এদিকেই রেড রিভার।

অন্ধকার আকাশ। ঘন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাদ। বাতাস ভারি স্যাঁতস্যাঁতে। বর্ষণের দেরি নেই।

ছাদেও অন্ধকার। রেড রিভারের দুই তীরে লম্বা লম্বা লাইটপোস্টে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। কিন্তু সে অনেক নিচে। অত উপরে ছাদে আলো পৌঁছায় না।

সবে বিকেল বেলা হ্যারি কিলারের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতার কথা সঙ্গীদের বলতে যাচ্ছে, পায়ের কাছে ঠক করে এসে পড়ল একটা কি যেন। চমকে উঠল সবাই। স্থির হয়ে গেল চকিতে।

কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল। তার পরেই নিচু হয়ে জিনিসটা কুড়িয়ে নিল ফ্লোরেন্স। তেমন কিছু না। বেশ বড়সড় একটা নুড়ি পাথর। কিন্তু নুড়ির সঙ্গে বাঁধা একটা দড়ি না! তাই তো!

টান লাগল দড়িতে। তালে তালে টানছে কেউ! কে? কি ইঙ্গিত করছে? শত্রু বন্ধু? হ্যারি কিলারের ফাঁদ? নাকি সত্যিই কোন বার্তা পাঠাল বন্ধু কেউ? কিন্তু এই ব্ল্যাকল্যান্ডে অমন বন্ধু ওদের কে থাকতে পারে?

সাত পাঁচ ভেবে দেখার সিদ্ধান্ত নিল ফ্লোরেন্স। দড়ি ধরে টানতে লাগল। পরিষ্কার বোঝা গেল পাঁচিলের ওপাশে দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে উঠে আসছে কেউ। একা পারল না ফ্লোরেন্স। সাহায্য করার জন্যে ডাকল ডাক্তারকে। এবারে আর টেনে তুলতে কোন অসুবিধে হলো না।

ফুট তিরিশেক তোলার পরই আটকে গেল দড়ির অন্যমাথা। আর উঠছে না। উঁকি মেরে নিচের দিকে তাকাল ফ্লোরেন্স। পাঁচিলের মাথায় উঠে বসেছে একটা ছায়ামূর্তি। ঝুঁকে কি যেন করছে। একটা পিলারের বেরিয়ে থাকা মাথার সঙ্গে বাঁধছে দড়িটা, বুঝল ফ্লোরেন্স।

ছাদ ফুড়ে বেরিয়ে থাকা একটা শিকের সঙ্গে দড়ির এদিকের মাথাটা বাঁধল ফ্লোরেন্স। ছাদের ওপরে আরও তলা হবে, শিকটা তার প্রমাণ।

এগিয়ে গিয়ে আবার উঁকি মারল নিচে ফ্লোরেন্স। দড়ি ধরে ঝুলে পড়েছে ছায়ামূর্তিটা। একটু একটু করে উঠে আসছে। লোকটার দুঃসাহস অবাক করল ফ্লোরেন্সকে। কে?

কয়েকবার পিছলে পড়তে পড়তেও বেঁচে গেল ছায়ামূর্তিটা, দেখল ফ্লোরেন্স। কিন্তু উঠে এল শেষ পর্যন্ত।

কার্নিসের কাছে এসে একটা হাত বাড়াল লোকটা সাহায্যের জন্যে। ফ্লোরেন্স আর ডক্টর চাতোন্নে, বাড়ানো হাতটা চেপে ধরে তুলে আনলেন লোকটাকে।

তারপরই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল সবাই। অন্ধকারেই চিনতে পেরেছে ওরা লোকটাকে। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না কিছুতেই।

টোনগানে!

আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে
০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
পরের পর্ব :
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে
১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা
১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি
১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
১৩. কিসের এত শব্দ
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত