০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
(আমিদী ফ্লোরেন্সের নোটবই থেকে)
২৬ মার্চ। কয়েদখানায় বসে লিখছি। মাজেপ্পার পর এখন সিলভিও পেলিকোর অবস্থায় পড়েছি। গুপ্ত সমিতির কারবোনারির সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে দশ বছর জেল হয়েছিল যার এবং এর কাহিনী নিয়ে নাটক লিখেছিলেন লর্ড বায়রনের এক ইটালিয়ান নাট্যকার বন্ধু। কিন্তু আমার জেল হলো কি অপরাধে বুঝতে পারছি না। আর আমার কাহিনীই বা লিখবে কে? তাই নিজের নাটক নিজেই লেখার চেষ্টা করছি।
ফ্লাইং মেশিন থেকে নামানোর পরে আমাদের ঘাড় ধরে এনে এই কয়েদখানায় রেখে গেছে তিনজন মুলাটো, মানে শ্বেতাঙ্গ আর নিগ্রোর দোআঁশলা আর কি। অনেক সিঁড়ি, অনেক অন্ধকার গলিপথ পার করিয়ে নিয়ে এসেছে একটা লম্বা গ্যালারিতে। এর দুপাশে সারি সারি কারাকক্ষ। এরই একটিতে ভরে রাখা হয়েছে আমাকে। কয়েদখানার দরজা তো বন্ধ করেছেই, বাইরে থেকে পাহারা দিচ্ছে বন্দুকধারী গার্ড।
কয়েদখানা ঘরটায় মাত্র একটাই জানালা। তাও বারো ফুট উঁচুতে! মজবুত গরাদ লাগানো।
একলা ঘরে বসে আছি আমি। ঘরে আসবাব বলতে একটা টেবিল, একটা চেয়ার আর একটা চারপায়। তাতে খড় বিছিয়ে ওপরে বাজে একটা চাদর পেতে রাখা হয়েছে। কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে ইলেকট্রিক আলো।
ভাগ্যিস ডাকাতেরা আমার নোটবই আর কলম কেড়ে নেয়নি। লিখতে পেরে খানিকটা হলেও সময় কাটাতে পারছি।
বসে বসে ভাবছি, হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে মুখ তুলে চাইলাম। লোকটাকে দেখেই ভুরু কুঁচকে উঠল।
চৌমৌকি!
বিশ্বাসঘাতকটাকে দেখেই রক্ত চড়ে গেল মাথায়। কোন ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই লাফিয়ে উঠে তাড়া করলাম ব্যাটাকে। দড়াম করে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল সে।
চেয়ারে ফিরে এসে বসে বসে ফুলতে লাগলাম। আস্তে আস্তে রাগ কমে আসতেই তলিয়ে ভাবতে পারলাম আবার নতুন বুদ্ধি ঢুকল মাথায়। তাই তো, চৌমৌকির ওপর রাগ দেখিয়ে এখন আর কোন লাভ নেই। ওর কিছু করতে পারব না আমি এখন। তার চেয়ে বরং ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে খবরাখবর নেয়া উচিত।
আমার মনের কথা শুনতে পেয়েই যেন আবার দরজা খুলল চৌমোকি। কিন্তু একবারে নয়। সামান্য একটু ফাঁক করল পান্না; উকি দিল। কিন্তু আমি নড়লাম না।
সাহস পেয়ে দরজা আর একটু ফাঁক করল চৌমৌকি। তবু নড়লাম না। দেখে – কবাট দুটো পুরোই ফাঁক করল সে এবার।
কেন এসেছ? প্রথম চোটেই ভাব না দেখিয়ে একটু রাগতঃস্বরে বললাম।
আপনার খাবার, ভয়ে ভয়ে বলল চৌমেীকি।
ভেতরে এসো। ডাকলাম।
এল চৌমৌকি। কিন্তু আবার আমি তাড়া করলেই ছুটে পালাবার জন্যে প্রস্তুত।
আমি কিছুই করলাম না দেখে এগিয়ে এসে সামনের টেবিলে খাবার জন্যে ট্রেটা সাজিয়ে রাখল চৌমৌকি।
দারুণ খিদে পেয়েছে। তাই কোনদিকে না তাকিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে চৌমৌকি।
খেতে খেতেই জানলাম, হ্যারি কিলার নামে এক দোর্দন্ড প্রতাপ রাজার বন্দী হয়েছি আমরা। ব্ল্যাকল্যান্ড শহরের কথাও অনেক কিছুই শুনলাম। একটা কথাও অবিশ্বাস করলাম না। কারণ ফ্লাইং মেশিনে তো চড়েই এসেছি আমরা। যার এ ধরনের যান তৈরির ক্ষমতা থাকে, সে আরও অনেক কিছুই করতে পারে।
বারজাক মিশন অভিযানে রওনা দেয়ার আগে কায়দা করে মিস ব্লেজনের কাজে চৌমৌকিকে নিযুক্ত করিয়েছে হ্যারি কিলারঃ আগেই খবর পেয়েছে সে, মিশনটা তার শহরের কাছাকাছিই আসবে। যদি কোনক্রমে ব্ল্যাকলাভের খোঁজ পেয়ে যায় অভিযাত্রীরা, তাই এই হুঁশিয়ারি। কিন্তু কেন? আমরা ব্ল্যাকল্যান্ডের কঙ্কা জেনে ফিরে গেলে হ্যারি কিলারের ক্ষতি কি?
হ্যারি কিলারেরই লোক মোরিলিরে। তাকে দিয়েই চৌমৌকির সঙ্গে ভাব জমায় কিলার। পক্ষ বদলাবার জন্যে অবশ্য অনেক সোনার মোহর দেয়া হয়েছে চৌমৌকিকে।
পক্ষ বদলিয়েছে ঠিকই, চৌমৌকি জানাল, কিন্তু এখনও মিস ব্লেজনের প্রতি একবিন্দু শ্রদ্ধা কমেনি নাকি তার।
টেনিগানের কথা জিজ্ঞেস করতেই কিন্তু মুখ কালো করে ফেলল চৌগোকি। উসখুস করতে করতে বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। যেতে হবে আবার আমাকে। বেশি দেরি করলে মেরে ফেলবে।
কে মেরে ফেলবে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেলাম না। টোনগানের ব্যাপারেও যা অনুমান করেছিলাম, ঠিকই। মেরেই ফেলা হয়েছে ওকে।
আরও জানলাম ফ্লাইং মেশিনে চড়ে গিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ক্যাপ্টেন রুফুজ। তাই তো বলি শত শত মাইল দুর্গম জায়গা ঘোড়ায় চড়ে পেরিয়ে গিয়ে কি করে লোকের জামা-কাপড়-চেহারা অত ফিটফাট থাকে?
সার্জেন্ট দুজন কিন্তু বারোজন নিগ্রো সৈনিককে নিয়ে ঘোড়ায় চড়েই গিয়েছে। তাই ওদের জামাকাপড় অত নোংরা আর ছেঁড়া-খোঁড়া ছিল। যাবার পথে মাঝে মধ্যে নিছক মজা করার জন্যে গ্রাম লুট করেছে, আর খুন করেছে নিরপরাধ লোকগুলোকে। তাই কাঁধে মারাত্মক আঘাত পাওয়া নিগ্রোটি দুজনকে দেখে অমন আঁতকে উঠেছিল।
ফ্লাইং মেশিনে চড়েই ব্ল্যাকল্যান্ডে ফিরে এসেছে চৌমৌকি আর মোরিলিরে! মনে পড়ল, ওরা পালানোর রাতে অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছিলাম।
প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই শুনলাম। ইচ্ছে করেই ভাব জমালাম চৌমৌকির সঙ্গে। প্রচুর টাকার লোভ দেখালাম। এখান থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যেতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করলাম।
কিন্তু দারুণভাবে মাথা নেড়ে বলল চৌমৌকি, তা সম্ভব নয়, মঁসিয়ে। একবার বন্দী হলে কেউ বেরোতে পারে না এখান থেকে। দেয়ালের পর উঁচু দেয়াল যদি কেউ পেরোতে পারেন, যদিও তা অসম্ভব, বন্দুকধারী পাহারাদারের চোখে কঁকি, দিতে পারবেন না কিছুতেই। হয়তো বা নেহায়েত কপালগুণে ফাঁকি দিলেনই ওদের, কিন্তু মরুভূমি? ওটা পেরোবেন কি করে? কাজেই পালাবার আশা ছেড়ে দিন।
খাওয়া শেষ হলো। এঁটো বাসনপত্র নিয়ে চলে গেল চোমৌকি।
আগের চেয়ে বেড়ে গেছে দুশ্চিন্তা। তবে কি সারাটা জীবন এই কারাগারে হ্যারি কিলারের বন্দী হয়েই কাটাতে হবে?
বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। করার আর আছেই বা কি? বদ্ধ কারাগারে শুয়ে বসেই তো কাটাতে হবে।
২৬ মার্চ, সন্ধ্যা। হিজ ম্যাজেস্টি দুর্ধর্ষ হ্যারি কিলারকে দেখার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য হয়েছে। শুয়ে ছিলাম। হয়তো একটু তন্দ্ৰামত এসেছিল। দরজা খোলার শব্দে চোখ খুলে ফিরে চাইলাম। না, এবারে চৌমৌকি নয়। শয়তান মোরিলিরে। আমাকে বাইরে বেরনোর ইশারা করল জানোয়ারটা।
বেরোলাম। দেখি সেই বিশজন নিগ্রো সৈনিকও আছে। মোরিলিরেকেই তাদের সর্দার বলে মনে হলো।
আমার সঙ্গীসাথীদের ঘিরে দাঁড়িয়ে সৈনিকেরা। সবাই আছে সেন্ট বেরেন ছাড়া। বাতে কাঁবু হয়ে গেছেন নিশ্চয়ই ভদ্রলোক।
সার বেঁধে মার্চ করিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। অনেক সিড়ি অনেক গলিপথ পেরিয়ে এক বিশাল ঘরে এসে পৌঁছলাম। আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দলবল নিয়ে বাইরেই রইল মোরিলিরে।
বিশাল ঘরে আসবাব বলতে মাত্র একটা চেয়ার, একটা টেবিল আর একটা টুল। টুলে রাখা একটা অর্ধেক ভরা মদের বোতল। পাশে গেলাস; বাতাসে মদের তীব্র গন্ধ।
টেবিলের ওপাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে একটা পিশাচ। নররূপী। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া জটা দেখলে মনে হয় আলগা এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। জুলফির কাছে একটা রোমও নেই। ঢ্যাঙা ! বিশাল শরীর। ফুলে ফুলে আছে পেশী। গায়ে অমানুষিক শক্তি ধরে দানবটা, একনজরেই বোঝা যায়।
ঝাঁকড়া চুলে পাক ধরেছে। উন্নত কপাল-তীক্ষ্ণশক্তির লক্ষণ। হাড় ঠেলে বেরিয়ে আসা চোয়াল সাংঘাতিক উগ্র প্রকৃতি প্রকাশ করছে। ব্রোঞ্জ রঙের হনুর নিচে ভেঙে তুবড়ে বসা গাল। গালের আধ ইঞ্চি নিচে দলা হয়ে ঝুলছে চামড়া। তাতে ফুটকি ফুটকি লাল ব্রণ। ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। বিচ্ছিরি রকম মোটা ঠোঁট, বিশেষ করে নিচেরটা। ওজন সামলাতে না পেরে ঝুলে আছে। হলদেটে নোংরা দাঁতের সারির দিকে চাইলে পাকস্থলী মোচড় দিয়ে বমি বেরিয়ে আসতে চায়। খোঁচা খোঁচা পাঁপড়ি। চোখ জোড়া কোটরে বসা। নীলচে রঙ। কিন্তু মনে হয় নীল আগুনের শিখা বেরিয়ে আসছে। চাওয়া যায় না।
আপাদমস্তক, এত শ্রীহীনতা আর বীভৎসতা এর আগে কোন মানুষের মাঝে দেখিনি। হতে যে পারে, তাও কল্পনা করিনি কোনকালে। কদাকার, ভয়াবহ লোকটার শরীরের অণুতে-পরমাণুতে মহাপাপ যেন স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে আছে।
প্রচন্ড দাম্ভিক দৃষ্টি দেখে কাউকে বলে দিতে হলো না, এই-ই হিজ ম্যাজেস্টি হ্যারি কিলার।
ধূসর হান্টিং পোশাক পরে আছে হ্যারি কিলার। টেবিলে ফেলে রেখেছে একটা উলের হ্যাট। হ্যাটের পাশে রাখা ডান হাতটা কাপছে। বদ্ধ মাতাল হয়ে আছে।
আমাদের দেখেও একেবারে নির্বাক রইল হ্যারি কিলার কিছুক্ষণ। পিচ্ছিল চোখের দৃষ্টি দিয়ে বার বার দেখল আমাদের আপাদমস্তক। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রইলাম আমরা। যেন দয়া করে মহাবাণী শোনাবেন আমাদের দেবতা।
মুখ খুলল অবশেষে হ্যারি কিলার। খ্যাড়খ্যাড়ে গলায় ফরাসীতেই কথা বলল সে, ছজন না ছিলেন? তাই তো শুনেছি। কিন্তু এখন যে দেখছি পাঁচ?
অবস্থা কাহিল একজনের। অবশ্যই আপনাদের অত্যাচারে। সোজাসাপ্টা জবাব দিলেন ডক্টর চাতোন্নে।
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর আচমকা প্রশ্ন, কি মতলবে আমার দেশে?
রক্ত জমাট করা থমথমে পরিবেশেও হাসি পেল। কিন্তু হাসলাম না! জবাব দিলাম না কেউ।
স্পাইগিরি করতে? না? জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ধমকে উঠল হ্যারি কিলার। দেখুন মঁসিয়ে, মাপ করবেন… শুরু করলেন,বারজাক।
কিন্তু এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিল হ্যারি কিলার। দড়াম করে কিল মারল টেবিলে। চেঁচিয়ে উঠল, খবরদার! মঁসিয়ে নয়, মাস্টার বলবেন। এখানে সবাই তাই বলে আমাকে।
খেপে গেলেন বারজাক। কঠিন হয়ে উঠল চেহারা। বুক ফুলিয়ে বললেন, সতেরোশো উননব্বই সালের পর থেকে কাউকে আর মাস্টার ডাকে না ফরাসীরা।
বারজাকের নাটকীয়তা দেখে অন্য সময় হলে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। কিন্তু হ্যারি কিলার নামক জানোয়ারটার সামনে হাসলাম না। কখন আবার পানি থেকে চুন খসলেই প্রাণদন্ডের আদেশ দিয়ে বসে। বারজাকের কথায় বিচলিত হয়ে উঠলাম। অথচ লেজ জুড়লেন পঁসি, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে?
ভেবেছিলাম, সাংঘাতিক খেপে গিয়ে একটা যাচ্ছেতাই কান্ড করে বসবে হ্যারি কিলার। কিন্তু শ্রাগ করে আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল সে। বুঝে গেছে, দাবড়ানিতে কাজ হবে না।
চোখ বুজে কি যেন ভাবতে লাগল দানবটা, নাকি মদের নেশায় ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে। হঠাৎই আবার চোখ খুলল সে। যেন আমাদের এই প্রথম দেখছে, এমনিভাবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আবার দৃষ্টি বুলিয়ে চলল। সবার ওপরে কয়েক দফা বুলিয়ে এসে দৃষ্টিটা থেমে গেল বারজাকের ওপর। চোখের দৃষ্টি পাল্টে যাচ্ছে। তীব্র হচ্ছে নীল আগুনের শিখা। শিউরে উঠলাম। কিন্তু সামান্যতম বিচলিত হলেন না বারজাক। এতদিনে বুঝলাম, কেন সাফল্যের শিখরে উঠতে পেরেছেন তিনি। এই না হলে পাবলিক লীডার?
আচমকা প্রশ্নটা ছুঁড়ে মারল হ্যারি কিলার, ইংরেজি জানা আছে?
ক্যাম্ব্রিজ স্ট্যান্ডার্ড। চলবে এতে? পাল্টা প্রশ্ন করলেন বারজাক।
সবাই বোঝে?
বোঝা তো উচিত। আমার সঙ্গী যখন। বাঁকা উত্তরই দিলেন বারজাক।
তা হলেই ভাল। ফরাসী বলতে ঘেন্না হয় আমার। মদের নেশায় জড়িত গলায় টেনে টেনে ইংরেজিতে বলল এবার হ্যারি কিলার।
ভাষার প্রতি ঘৃণা থাকা বদ লোকের লক্ষণ। শান্ত গলায় বললেন বারজাক।
চো-ও-প! ঘর কঁপিয়ে ধমকে উঠল হ্যারি কিলার। তারপর স্বর নামিয়ে বলল, তা এখানে আসার মতলবটা কি?
আমরাই বরং করতে চাই প্রশ্নটা। কি কারণে ধরে আনা হয়েছে আমাদের?
চালাকিটা ধরে ফেলেছি বলে। আমার সামাজ্যের আশপাশে বিদেশী কারোর ঘুর ঘুর পছন্দ করি না আমি।
সাম্রাজ্য। বলে কি লোকটা! কিন্তু কিছু বললেন না বারজাক। আমরাও চুপ – থাকলাম।
আমাদের এই নীরবতা পছন্দ হলো না হ্যারি কিলারের। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সে। প্রচন্ড জোরে জোরে টেবিলে গোটা তিনেক কিল মেরে বলল, হ্যাঁ, পছন্দ করি না। ভেবেছেন, আপনাদের মতলব আমি কিচ্ছু টের পাইনি? টিম্বকটু থেকে নাইজারে অহরহ লোক পাঠাচ্ছে ফরাসীরা। চুপচাপ দেখে গেছি শুধু আমি, কিছু বলিনি। কিন্তু আমার রাজ্যে স্পাই পাঠানোর পরও চুপ করে থাকব? না, কিছুতেই না। জানেন, কাঁচের এই গেলাসের মত আছড়ে ভাঙতে পারি আমি আপনাদের?
হাতের গেলাসটা গায়ের জোরে মেঝেতে আছাড় মারল হ্যারি কিলার, ঝনঝন করে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল জিনিসটা।
আর একটা গেলাস! জলদি! পাশের দরজার দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল হ্যারি কিলার।
কশ বেয়ে ফেনা গড়াচ্ছে দানবটার। পশুর চাইতেও অধম করে তুলেছে ওকে। উন্মত্ত ক্রোধ। পরিবর্তিত হয়ে নীলচে-লাল হয়ে গেছে চোখের রঙ।
পড়িমরি করে গেলাস নিয়ে ঢুকল নিগ্রো পরিচারক; ফিরেও তাকাল না হ্যারি কিলার। ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন এমনিভাবে দমাদম কিলঘুসি মারতে লাগল টেবিলে। হঠাৎই থেমে গিয়ে বারজাকের অবিচল মূর্তির দিকে তাকিয়ে বলে চলল, বারবার হুঁশিয়ার করেছি আপনাদের, কিন্তু পাত্তা দেননি আপনারা। ডোঔং-কোন বিশেষ ব্যাপার কায়দা করে আপনাদের জানিয়েছিলাম আমিই। আমার ফাস্ট ওয়ার্নিং মানেননি আপনারা। ওঝাকে শিখিয়ে পড়িয়ে, আপনাদের ভবিষ্যদ্বাণী শোনালাম। শুধু আপনাদের দোষেই তার কথা সত্যি হলো। শেষ পর্যন্ত কি আর করি? কায়দা করে ক্যাপ্টেন মারসিনেকে সরিয়ে দিলাম। তার বদলে আমার ক্যাপ্টেন রুফুজকে ঢুকিয়ে দিলাম আপনাদের দলে। সময় বুঝে দুর্গম জায়গায় আপনাদের ত্যাগ করল রুফুজ। কিন্তু তবু টনক নড়ল না আপনাদের। ফিরে গেলেন না। না খাইয়ে রাখলাম। তবু কেয়ার করলেন না। একটু একটু করে ঢুকেই চললেন নাইজারে। কিছু বলার আছে?
কিছুই বললাম না। ঘরময় দাপাদাপি লাফালাফি করে বেড়াল হ্যারি কিলার। প্রচন্ড রাগে।
হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেল এক জায়গায়। আশ্চর্য শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,সায়ে যাচ্ছিলেন আপনারা, না?
যাচ্ছিলাম! উত্তর দিলেন বারজাক।
হঠাৎ উল্টোদিকে ফিরলেন কেন তাহলে? মানে কৌহোতে গেলেন কেন?
বারজাককে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে চাইছে যেন দৃষ্টি দিয়ে হ্যারি কিলার।
কারণ টিম্বাকটু যাচ্ছিলাম। একটুও দ্বিধা না করে জবাব দিলেন বারজাক।
সিকসো তো আরও কাছে। সেখানে যাননি কেন?
টিম্বাকটু গেলেই বেশি সুবিধে হত আমাদের।
হুমম, কিছুতেই সন্দেহ যেতে চাইছে না হ্যারি কিলারের। তাহলে নাইজারের পুবে যাবার মতলব ছিল না? ঠিক বলছেন?
মিছে বলার অভ্যেস নেই!
আগে জানলে এখান পর্যন্ত আসার কষ্ট করতে হত না আপনাদের। লোকটার ধৃষ্টতায় গা জ্বলে গেল আমার।
আর কথা না বলে থাকতে পারলাম না। শান্ত স্বরেই জিজ্ঞেস করলাম, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কৌতূহল মেটাবেন? এখানে আমাদের বয়ে আনার কষ্ট করতে গেলেন কেন? খতম করে দিলেই হত।
তা হত। কিন্তু ফরাসী সরকারের টনক নড়ত তাহলে।
এখনও তো নড়বে?
আনতে তো চাইনি সেজন্যেই। ফিরিয়েই তো দিতে চেয়েছিলাম।
এখনও তা করা যায়। মানে যেখান থেকে ধরে এনেছেন…
হ্যাঁ, দেশে গিয়ে খবরটা ছড়ান। আজব এক নগর দেখে এসেছি সাহারায়। না, না, তা হবে না। ব্ল্যাকল্যান্ডে একবার ঢুকলে জ্যান্ত বেরোতে পারে না কেউ। আমার রাজ্যের খবর জানে না বাইরের দুনিয়া, জানবেও না কোনদিন।
কিন্তু আমরা রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছি শুনলে তদন্ত কমিশন আসবেই।
আসুক। মরবে। একটু থেমে বলল হ্যারি কিলার, কিন্তু এসে যখন পড়েছেন অন্যভাবেও কাজ হাসিল করতে পারব আমি।
যেমন?
জামিন থাকছেন আপনারা। ফরাসী সরকার বেশি বাড়াবাড়ি করতে চাইলে বলব, তার দেশের কয়েকজন অতি গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আয়ত্তাধীনে আছে?
একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম, আমাদের শেষ করে ফেলার আপাতত কোন ইচ্ছে নেই হ্যারি কিলারের।
আবার গিয়ে চেয়ারে বসল হিজ ম্যাজেস্টি। খামোকাই রাগে ফুসছে, কয়েক সেকেন্ডেই আবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
কথা বলল আবার হ্যারি, এসে যখন পড়েছেন, রাজ্যের যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারেন। আমারই মত স্বচ্ছন্দে। কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।
রাজ্য শব্দটার ইমেজ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেল নরকের শয়তানের মুখ থেকে বেরিয়ে।
কিন্তু এর বিনিময়ে অবশ্যই জামিনে থাকতে রাজি হতে হবে আপনাদের। একটু থেমে বলল হ্যারি কিলার, কিংবা…
কিংবা? প্রশ্ন করলেন বারজাক।
অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল হ্যারি। আমার সহযোগী হয়ে যান।
স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হারামজাদা শয়তানটা একথা ভাবতে পারল কি করে? বলেই চলল হ্যারি কিলার। ঠান্ডা শীতল স্বর। আমার রাজ্যের সন্ধান একদিন না একদিন পাবেই ফরাসী সরকার। সৈন্য পাঠাবে। আমার সঙ্গে যুদ্ধে হারবে তারা। খামোকা এই খুনোখুনি করে লাভ কি? আমি আমার রাজ্য নিয়ে আছি। কি করে আরও বেশি করে ফসল ফলানো যায় মরুভূমিতে, চেষ্টা করছি। আর নাইজারে কলোনি স্থাপনের তালে আছে ফরাসী সরকার ! থাকুক। দুজনের কারও ব্যাপারেই আমরা কেউ মাথা ঘামব না। দুই দেশের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব চুক্তি স্থাপিত হতে পারে। শুধু ঠিকমত আলোচনা চালানো দরকার।
আপনার সঙ্গে? বারজাকের কণ্ঠে বিদ্রুপ।
ফেটে পড়ল হ্যারি কিলর। কোনরকম জানান না দিয়েই যেন আচমকা ফেটে পড়ল আগ্নেয়গিরির চূড়া, তাচ্ছিল্য, আঁ? ঘর কাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে। তারপরই আবার ঠান্ডা হয়ে গেল, ঠিক আছে, কিছু নমুনা দেখাচ্ছি। কথা বলতে এরপর থেকে সাবধানে বলবেন।
বাইরের প্রহরীদের ডাকল হ্যারি কিলার।
আবার অনেক সিড়ি, গলিপথ, ছোট ছোট ছাদ ইত্যাদি পেরিয়ে এক বিশাল ছাদের ওপর এনে হাজির করা হলো আমাদের। আগেই পৌছে গেছে হ্যারি কিলার। দেখে মনে হয়, তার চেয়ে ঠান্ডা স্বভাবের লোক আর হয় না।
প্রহরীদের চলে যেতে বলে আমাদের দিকে ফিরল হ্যারি কিলার,মাত্র একশো বিশ ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছেন আপনারা। দিগন্ত এখান থেকে পনেরো মাইল দূরে। দেখতেই পাচ্ছেন, শহর আর দিগন্তের মাঝের জায়গায়, ফসল ফলছে। অথচ এককালে শুধু বালির সাগর ছিল এখানে। সব মিলিয়ে আমার রাজ্যের ক্ষেত্রফল বারোশো বর্গমাইল। এই এলাকার মধ্যে বাইরের কেউ পা দিলেই তিন সারি গার্ডপোস্ট থেকে খবর আসবে আমার কাছে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
খামোকাই বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করল হ্যারি কিলার। তারপর আবার বলে চলল, খবর পাওয়ার পরে সাথে সাথেই কিছু বলব না আমি। এগিয়ে আসতে থাকল হয়তো অনুপ্রবেশকারী। ব্ল্যাকল্যান্ডের পাঁচিলের পাঁচ ফার্লং দূরের আধমাইল জায়গা পেরোতে পারবে না সে কিছুতেই। থেমে যেতে হবে। কারণ বাঁধা দেয়া হবে তাকে। ওকে দেখবে কি করে আমার লোকেরা জানেন?
ছাদের মাঝামাঝি এক জায়গায় লাইটহাউসের মত দেখতে, কিন্তু আরও অনেক বেশি উঁচু একটা মিনারের দিকে ইঙ্গিত করল হ্যারি কিলার। বলল, ওখান থেকে জোরাল প্রোজেক্টরের আলো ফেলা হয় রাতের বেলা। দিন হয়ে থাকে তখন শহরের বাইরের পাঁচ ফার্লং দূরের ওই আধমাইল জায়গা, শহরকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে। আর ওই অঞ্চলের দিকে নজর রাখা হয় টেলিস্কোপের একটা অকল্পনীয় উন্নত সংস্করণ, সাইক্লোসকোপের সাহায্যে। আসুন, যন্ত্রটা দেখাই আপনাদের, নইলে ক্ষমতা বুঝতে পারবেন না।
হ্যারি কিলারের পিছু পিছু গিয়ে ওই বিশাল মিনারের চূড়ায় উঠলাম। একটা দরজা ঠেলে চূড়ার ঘরটার ভেতরে ঢুকল হ্যারি। আমরাও ঢুকলাম তার পিছু পিছু! আশ্চর্য! ঢুকে ঘরের বৃত্তাকার দেয়ালের দিকে চাইবার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল, বাইরের পৃথিবী। আসলে ঘরের দেয়ালটা একটা অদ্ভুত লেন্স।
একটা উঁচু বিরাট পাঁচিল দেখতে পেলাম লেন্সের মধ্যে দিয়ে। পাঁচিলের ওপর কালো লাইন টেনে ভাগ করা অনেকগুলো আলাদা আলাদা চতুষ্কোণ বর্গক্ষেত্র; পাঁচিলের মাথা থেকে শুরু হয়েছে মেঘের রাজত্ব। পাঁচিলের বর্গক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অগণিত দাগ, অসংখ্য ছায়া আর আবছা নকশা। কিছু কিছু দাগ আর ছায়া আবার নড়ছে। এ কি অদ্ভুত ব্যাপার। আর একটু খুঁটিয়ে দেখেই বুঝে গেলাম ব্যাপারটা। আসলে পাঁচিল নয় ওটা। অদ্ভুত লেন্সের মধ্যে দিয়ে পুরো ফসলের খেতটাকে একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে বলে অমন মনে হচ্ছে। চতুষ্কোণ দাগগুলো আসলে ভাগ ভাগ করা খেত! ফুটকি আর দাগগুলোর কোনটা মানুষ কোনটা গাছ, কোনটা চাষের যন্ত্র। আর পাঁচিলের ওপরের মেঘ হলো খেতের ওপারের মরুভূমি।
অনেক দূরে দুটো দাগ দেখাল হ্যারি কিলার। নড়ছে ওদুটো।
দুজন নিগ্রো! বলল হ্যারি কিলার, ধরুন, পালাচ্ছে ওরা। কিন্তু বেশিদূর যাওয়ার ক্ষমতা ওদের নেই। ঘরের মাঝখানে বসানো রেডিও টেলিফোনের রিসিভার তুলল হ্যারি কিলার! বলল, একশো এগারো নম্বর সার্কেল। ব্যাসার্ধ, পনেরোশো আটাশ।
আরেকটা রিসিভার তুলে বলল, চোদ্দ নম্বর সার্কেল। ব্যাসার্ধ পনেরোশো দুই।
রিসিভার রেখে দিয়ে আমাদের দিকে ফিরল হ্যারি কিলার। বলল,দারুণ একটা খেলা দেখবেন এখন।
কয়েক মিনিট কিছুই ঘটল না। তারপরই একটা দাগের ওপর ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা গেল। ধোয়া মিলিয়ে যেতেই আর দেখা গেল না দাগটাকে।
গলা কেঁপে উঠল মিস ব্লেজনের, গেল কোথায় লোকটা?
জাহান্নামে। শান্ত গলা হ্যারি কিলারের।
আঁ! একসঙ্গেই বলে উঠলাম সবাই, খামোকা মেরে ফেললেন লোকটাকে? কি দোষ করেছিল?
মেরেই ফেললাম। বিন্দুমাত্র কাঁপল না হ্যারি কিলারের গলা, কিন্তু তাতে কি হয়েছে? ও ব্যাটা তো নিগ্রো। একটা গেলে অমন দশটা আসবে। শুধু আমি চাইলেই হলো। কিন্তু আমার স্কাই টর্পেডোর খেলাটা কেমন দেখলেন বলুন? পনেরো মাইল রেঞ্জ? অব্যর্থ লক্ষ্য, এক ইঞ্চি এদিক ওদিক হবে না। ভয়ঙ্কর স্পীড। আশা করি এ পথে পালাতে চাইবেন না?
বিহ্বল ভাবে দ্বিতীয় দাগটার দিকে চেয়ে রইলাম। এই হতভাগ্য লোকটার ভাগ্যে আবার কি আছে, কে জানে!
লেন্সের ভেতর দিয়ে আচমকাই দেখলাম বস্তুটাকে। কিন্তু কি, বুঝতে পারলাম না। তীব্রবেগে ধেয়ে গেল দ্বিতীয় দাগটার দিকে। কয়েক সেকেন্ড পরেই অদৃশ্য হয়ে গেল দাগটা।
মেরে ফেললেন এই লোকটাকেও? উত্তেজনায় থরথর করে কাপছেন মিস ব্লেজন।
আরে না, না। এখনি দেখবেন ওকে। চলুন বাইরে চলুন।
আমাদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল হ্যারি কিলার। লিফটে চড়ে নিচে নেমে এলাম। বেরিয়ে এলাম বিশাল ছাদের মত প্ল্যাটফর্মে। আঙুল তুলে আকাশের এক দিকে দেখাল আমাদের হ্যারি। চাইলাম। প্রচন্ড গতিতে এদিকেই উড়ে আসছে একটা ফ্লাইং মেশিন। কি যেন ঝুলছে মেশিনটার তলায়।
ওটা হেলিপ্লেন। এই প্রথম ফ্লাইং মেশিনের নাম শুনলাম হ্যারি কিলারের মুখে।
দেখতে দেখতে কাছে চলে এল হেলিপ্লেন। তলার ঝুলন্ত জিনিসটা চিনতে পেরে শিউরে উঠলাম। অতিকায় চিমটের মাঝে ধরা মানুষটা ছটফট করছে। একজন নিগ্রো।
মাথার ওপরে চলে এল হেলিপ্লেন। প্ল্যাটফর্মের ওপর এসে আকাশে স্থির হয়ে দাঁড়াল মেশিনটা। ধীরে ধীরে খুলে গেল চিমটের দাড়া। প্রায় দুশো ফুট ওপর থেকে কঠিন পাথরের প্ল্যাটফর্মে আছড়ে পড়ল হতভাগ্য নিগ্রোটা; টাশ করে তীক্ষ্ণ শব্দ উঠল। খুলি ফেটে গেছে লোকটার। ছিটকে এসে আমাদের নাকে মুখে লাগল তাজা রক্ত মেশানো ঘিলু।
আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন মিস ব্লেজন। তারপরই হিস্টিরিয়াস্তের মত ছুটে গিয়ে, গলা টিপে ধরলেন হ্যারি কিলারের। রুদ্ধস্বরে চেঁচাতে লাগলেন, খুনে…শয়তান.. নরপিশাচ!
অনায়াসে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল হ্যারি কিলার। ভোজবাজির মত প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হলো একদল নিগ্রো গার্ড! চারদিক থেকে ঘিরে ধরল আমাদের। মিস ব্লেজনের দুহাত চেপে ধরল দুইজন ভীষণদর্শন গার্ড।
আতঙ্কে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি আমরা। মিস ব্লেজনের ভাগ্যে কি আছে, ঈশ্বরই জানেন।
কিন্তু রাগল না হ্যারি কিলার। বরং দানবীয় উল্লাস ফুটল তার চোখে মুখে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিস ব্লেজনের দিকে।
দারুণ তেজী মেয়ে! মন্তব্য করল হ্যারি কিলার।
পরমুহূর্তেই ধাই করে এক লাথি মারল আকাশ থেকে ফেলে দেয়া নিগ্রোর থেঁতলানো মাংসপিন্ডে। বলল, আরে বুদ্ধ মেয়ে, এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা গরম করলে চলে না কি?
গার্ডদের ইশারা করে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল হ্যারি কিলার। অনেক গলিঘুঁজি পেরিয়ে আবার সেই বিশাল হল ঘরটায় এসে ঢুকলাম। কয়েদখানা থেকে এ ঘরেই আমাদের নিয়ে আসা হয়েছিল প্রথমে।
আমরা ঢোকার আগেই তার চেয়ারে এসে বসে আছে হ্যারি কিলার।
আমাদের কারও দিকে আর নজর নেই এখন হ্যারির। হাঁ করে চেয়ে আছে মিস ব্লেজনের দিকে। দুই চোখে নোংরা দ্যুতি। অশুভ ছায়াপাত। দৃষ্টি দেখে হিম হয়ে এল আমার হাত-পা। শির শির করে উঠল শিরদাঁড়াটা।
একটানা মিনিট পাঁচেক একইভাবে কাটাল হ্যারি কিলার। তারপর আচমকাই কথা শুরু করল, আমার ক্ষমতা তো দেখলেন? আমার কথায় নাক সিটকালে কি করতে পারব আমি, তাও আন্দাজ করতে পারছেন এখন। আর একটা প্রস্তাব করব এবং এই-ই শেষ। জানি, আমি আপনাদের একজন রিপোর্টার, একজন দক্ষ পলিটিশিয়ান, একজন ডাক্তার এবং আর দুজন বোকা পাঁঠা..।
বোকা পাঁঠা বলে সেন্ট বেরেন আর পঁসির ওপর সাংঘাতিক অবিচার করল হ্যারি কিলার। তাই মনে হলো আমার।
হ্যাঁ, ফরাসী সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালানোর ভার বারজাকের। বলেই চলল হ্যারি কিলার, কথা দিচ্ছি, একটা অতি আধুনিক হাসপাতাল বানিয়ে দেব ডক্টর চাতোন্নেকে। ব্ল্যাকল্যান্ড থান্ডারবোল্টের ভারটা আপনি, মানে আমিদী ফ্লোরেন্সকেই দিয়ে দিতে চাই। যত বোকাই হোক পাঁঠা দুটোকেও মোটামুটি ভাল কাজই দিতে পারব আমি। বাকি থাকল এই মেয়েটা। বয়েস এক্কেবারে কম। কিন্তু মেয়েদের বয়েস কমে কিছু আসে যায় না। আর আমার বয়সই বা এমন কি বেশি? নাহ, ওকে আমি বিয়ে করলে মোটেই বেমানান হবে না।
হাঁ হয়ে গেলাম। এই বদ্ধ পাগলটার সঙ্গে বিয়ে!
এর কোনটাই হবে না। দৃঢ় গলায় বললেন বারজাক, গায়ের জোরে যদি পারেন। কিন্তু তাও পারবেন কিনা সন্দেহ আছে আমার। আর মিস ব্লেজনের সম্পর্কে বলা কথাটা তো…
হোয়াট? মিস ব্লেজন? ভুরু কুঁচকে গেছে হ্যারি কিলারের, পুরো নাম কি?
জেন ব্লেজন। বললেন জেন।
জেন ব্লেজন! ব্লেজন! আপন মনেই বিড় বিড় করল হ্যারি কিলার।
অবাক হলেন জেন। তার নাম শুনে অমন করছে কেন খুনেটা? জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না, নামটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে নাকি?
হবে না? ব্লেজন পরিবারের সঙ্গে আমার যে চিরশত্রুতা! বলতে বলতে রাগে লাল হয়ে উঠল হ্যারি কিলারের মুখ।
সতর্ক হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন জেন, কেন ব্লেজনের সঙ্গে? কাকে চেনেন আপনি?
কাকে চিনি? দুই চোখে আগুন জ্বলছে হ্যারি কিলারের চিনি লর্ড ব্লেজনকে। চিনতাম ক্যাপ্টেন জর্জ ব্লেজনকে। চিনি লুই… হঠাৎই থেমে গেল সে। কিন্তু আপনি? লর্ড ব্লেজন কি হয় আপনার?
কোথাকার লর্ড ব্লেজন? কথা বের করতে চাইছেন জেন। দরকার হলে নিজের পরিচয় গোপন করবেন।
জর্জ ব্লেজনের বাপ লর্ড ব্লেজন একজনই আছে। আইরিশ! কি হয় আপনার?
আড়চোখে নিজের সঙ্গীদের মুখের দিকে চাইলেন একবার জেন। সবাই পাথরের মত স্থির, মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। বিপদ আঁচ করে ফেলেছে ওরা সবাই।
কি হলো, কথা বলছেন না কেন? প্রায় গর্জে উঠল হ্যারি কিলার।
আমি আইরিশ নই, মিছে কথা বললেন জেন, আমরা সাত পুরুষ ধরে স্কচ। বাপের নাম রিচার্ড ব্লেজন। বাপের একমাত্র সন্তান আমি। কোন ভাইবোন নেই।
ওহ! পনেরো সেকেন্ড একটানা পায়চারি করল হ্যারি কিলার। আস্তে আস্তে রাগ ঠান্ডা হয়ে এল। হঠাৎই ঘুরে দাঁড়াল। চাইল জেনের দিকে। মুখে ক্রুর হাসি, তাহলে আপনি জেন ব্লেজন? জেন, না? চমৎকার নাম! বৌকে অমন নামে ডাকতে ভালই লাগবে।
অপমানে রাগে প্রায় অন্ধ হয়েই চেঁচিয়ে উঠলেন মিস ব্লেজন, আপনার মত পাষন্ডের গলায় মালা পরাচ্ছি না আমি কিছুতেই। তারচেয়ে একটা শুয়োরের গলায় পরাব, সেও অনেক ভাল। খুনে, শয়তান…
কথা আটকে গেল তার গলায়।
কিন্তু মোটেই রাগল না কিলার। হা হা করে অট্টহাসি হাসল।
দারুণ! চমৎকার! এই না হলে সম্রাট হ্যারি কিলারের, বউ…
হঠাৎই হাসি থামিয়ে দিল সে, ঠিক আছে, তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই। এক মাস সময় দিলাম। ভাল করে ভেবে নিন আপনারা সবাই।
হঠাৎই আবার স্বমূর্তি ধারণ করল হ্যারি কিলার। ভয়ঙ্কর গলায় চেঁচিয়ে উঠল গার্ডদের উদ্দেশে, নিয়ে যাও এদের!
জোর করে গার্ডদের হাত ছাড়িয়ে ঘুরে চাইলেন বারজাক, একমাস পরে যদি মানি, কি করবেন?
মদের গেলাস ঠোঁটে ছুঁইয়ে ফেলেছে ততক্ষণে হ্যারি কিলার। ঢক ঢক করে গেলাসের মদটুকু শেষ করে বারজাকের দিকে চাইল। তারপর, কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবিনি এখনও। ফাঁসি দেয়াতে আজকাল আর কোন মজা পাই না আমি। তবে কষ্টদায়ক মৃত্যুর অনেক উপায়ই জানা আছে আমার।
আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে
পরের পর্ব :
০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে
১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা
১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি
১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
১৩. কিসের এত শব্দ
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন