মরুশহর: ০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে

মরুশহর: ০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে

০২. বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে

(আমিদী ফ্লোরেন্সের নোটবই থেকে)

২৫ মার্চ। বন্দী হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে। মোটামুটি শান্তিতেই কেটেছে গত রাতটা। সকালবেলা, এখন একটু ভাল লাগছে। তাই লিখতে বসেছি। কিন্তু এ কোথায় এলাম? চাঁদে?

বললে বিশ্বাস করবেন? উড়ে এসেছিলাম। না, বেলুন নয়, উড়োজাহাজ। রীতিমত এঞ্জিন লাগানো আকাশযান। সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেনের চাইতে কয়েকগুণ বেশি জোরে ছুটতে পারে।

সেন্ট বেরেন ছাড়া আমাদের সবারই শরীর ভাল। কোমরের বাতে শুয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক। আকাশযানের মেঝেতে একটানা বেকায়দাভাবে শুইয়ে রাখার ফলেই এই অবস্থা হয়েছে তাঁর।

বন্দী হবার কথাটা তো মনেই আছে আপনাদের। সেই বিকট আওয়াজের পর সার্চলাইটের আলো। তারপর কয়েকজন মশালধারীর ঘিরে ধরা।

আমাদের ধরে শক্ত পিছমোড়া করে বাঁধল মশালধারীরা। ধরে তুলে ইয়া বড় বড় থলের ভেতর ঢোকাল। আচ্ছা করে কষে বাঁধল থলের মুখ। ময়দার বস্তার মত ফেলে রাখল মাটিতে।

পড়ে আছি তো আছিই। কতক্ষণ পেরিয়ে গেছে, বলতে পারব না। হঠাৎ কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠস্বর, সব কটাকে ভরা হয়েছে?

চমকে উঠলাম। লেফটেন্যান্ট ল্যাকোর।

এক সঙ্গে উত্তর দিল কয়েকটা কণ্ঠ, হয়েছে।

ঠিক আছে, নিয়ে চলো তাহলে।

অনুভব করলাম, বস্তার দুদিক থেকে তুলে ধরে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল ওরা আমাকে। প্রায় বিশ মিনিট পর একটা জায়গায় এনে দড়াম করে মাটিতে ফেলে দিল। মনে হলো, কোমরটা ভেঙে গেছে। ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম। হেঃ হেঃ করে বিচ্ছিরি ভাবে হেসে উঠল কেউ।

এই যে, নিচে নেমে এসো তোমরা। সবাই। কাঁদের যেন আদেশ দিল ল্যাকোর।

কিন্তু এখানে তো পারব না, ক্যাপ্টেন! বড্ড বেশি গাছপালা। এঞ্জিনের কর্কশ গর্জন ছাপিয়ে কানে এল জার্মান ভাষায় জবাব।

অবাক লাগল। না, জার্মান ভাষা শুনে নয়। কণ্ঠস্বরটা এসেছে শূন্য থেকে। গাছের মাথার উপর থেকে যেন কথা বলছে লোকটা।

ঠিক আছে, ওই যে, ওদিকেই খোলা জায়গাটায় নেমে পড়ো জলদি। আবার আদেশ দিল ল্যাকোর। তারপর অন্য কাঁদেরকে আবার আদেশ দিল, এই হতচ্ছাড়াগুলোকে জঙ্গলের বাইরে নিয়ে যাও।

আবার চ্যাংদোলা করে তুলে নেয়া হলো আমাকে। অনুমানেই বুঝলাম, আমার সঙ্গীদেরকেও একই ভাবে বয়ে নেয়া হচ্ছে।

হঠাৎই প্রচন্ড গর্জন উঠল। কানের পর্দা ফেটে যাবার উপক্রম। এই আওয়াজই গত কয়েকদিনে বার বার শুনে এসেছি। একটু আগেও এই আওয়াজই শুনেছি।

কিছুদূর এসে আবার ধপাস করে ফেলে দেয়া হলো আমাকে। মাথার ওপরে শোনা যাচ্ছে প্রচন্ড গর্জন।

কি হলো, নাছ না কেন? জিজ্ঞেস করল ল্যাকোর।

জমি খারাপ। নাম যাবে না। আবার আকাশ থেকেই উত্তর এল। এবার ইটালিয়ান ভাষায়।

ব্যাপার কি? ভাষাবিদদের রাজত্বে এসে পড়লাম নাকি!

তাহলে কোথায় নামতে চাও?

অন্তত বিশ কিলোমিটার দূরে। এর আগে নামার জায়গা একেবারেই নেই। উত্তর দিল আকাশচারী।

তার মানে কৌরকৌসৌর সমতল জায়গায় নামতে চাও? জিজ্ঞেস করল ল্যাকোর।

হ্যা, ক্যাপ্টেন!

ঠিক আছে। যাও। আমরাও শিগগিরই পৌঁছে যাচ্ছি। আবার গর্জন উঠল। ক্রমেই বাড়ছে। পড়ে থেকে অনুভব করলাম, দেহের তলায় থরথর করে কাঁপছে মাটি, আওয়াজের প্রচন্ডতায়। বস্তার ভেতর থেকে কিছুই দেখতে পাঁচ্ছি না! ঈশ্বরই জানেন এ কিসের আওয়াজ!

হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কি? নিয়ে চলো বোকা পাঁঠাগুলোকে। ধমকে উঠল ল্যাকোর।

আবার চ্যাংদোলা করে তুলে নেয়া হলো আমাকে। কিছুদূর নিয়ে ফেলা হলো আবার। কিন্তু এবারে মাটিতে নয়। বুঝলাম, ঘোড়ার পিঠে। বোধহয় জিনের সঙ্গেই আলুর বস্তার মত বাঁধা হলো আমাকে। চটাস করে চাটি পড়ার শব্দ হলো। লাফিয়ে উঠে ছুটল ঘোড়া।

মাজেপ্পাস রাইড কবিতায় পড়েছি, মাজেপ্পাকে বুনো ঘোড়ার পিঠে বেঁধে ছেড়ে দিয়েছিল এক খেপা জমিদার। অসমতল পাহাড়ী উপত্যকা অধিত্যকা পেরিয়ে ছুটেছিল ঘোড়া। ঝাঁকুনির চোটে পটপট করে ভেঙেছিল মাজেপ্লার হাড়গোড়। শেষ পর্যন্ত কিন্তু মরেনি মাজেপ্পা। কসাকরা বাঁচায় তাকে এবং একদিন কসাকদের কমান্ডার হয়েছিল সে-ই। কিন্তু আমারও মাজেপ্লার অবস্থা হবে, ভাবিনি। কিন্তু এটা ঠিক জানি, এই অঞ্চলে কসাক নেই। সুতরাং আমাকে বাঁচাবারও কেউ নেই।

প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে মনে হচ্ছে, শরীরের একটা হাড়ও আর আস্ত থাকবে না। একটু নড়েচড়ে উঠতে গেলাম। বস্তার ভেতরে সুবিধে করতে পারলাম না। কিন্তু এটুকু নড়াচড়াই টের পেয়ে গেল লোকটা। আমার ঘোড়ায়ই চড়েছে। বীভৎস কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, সাবধান, ব্যাঙের বাচ্চা। বেশি নড়লে খুলি ফুটো করে দেব।

গলা শুনেই বুঝতে পারলাম, যা বলছে তাই করবে লোকটা। তাই আর নড়াচড়া করলাম না।

প্রচন্ডগতিতে ছুটছে ঘোড়া। মাঝে মাঝেই আমার পাশে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে মানুষের গোঙানির আওয়াজ আসছে। আমারই মত সঙ্গীদেরও বস্তায় ঢুকিয়ে ঘোড়ার পিঠে বাঁধা হয়েছে, বুঝলাম।

প্রায় এক ঘণ্টা উন্মত্তের মত ছুটল ঘোড়া। তারপর থামল, হঠাৎ করেই। বাঁধন খুলে বস্তায় পোরা অবস্থায়ই মাটিতে ফেলে দেয়া হলো আমাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে। চেঁচিয়ে উঠলাম। অসাড় হয়ে গেছে যেন দেহটা।

আশপাশেও চিৎকার উঠল। সেন্ট বেরেনের চিৎকারটা পরিষ্কার চিনলাম। বারজাকও চেঁচালেন। কিন্তু জেনের কোন সাড়া নেই।

কিরে, মেয়েটা মরে গেল নাকি? অশুদ্ধ ইংরেজিতে এক ডাকাত আরেক ডাকাতকে জিজ্ঞেস করছে।

ধক করে উঠল আমার হৃৎপিন্ড। ঠিকই আমিও জেনের সাড়া পাঁচ্ছি না গত এক-দেড় ঘণ্টা যাবৎ।

খুলে দেখ তো বস্তাটা। বলল আরেকজন।

অপেক্ষা করে রইলাম। বুকের ভেতর বেড়ে গেছে ধুকপুকানি।

নাহ, বলল তৃতীয় একজন, মরেনি। বেঁহুশ হয়ে গেছে। হবেই। যা খেল দেখিয়েছে না শালার ঘোড়াটা আমার, বলে খিক খিক করে হাসল লোকটা।

হঠাৎই থেমে গেল সবার হাসি। শব্দ পেলাম, আরেকটা ঘোড়া এসে দাঁড়িয়েছে। লাফ দিয়ে নামল কেউ। বুটের শব্দ হলো। তারপর আদেশ হলো, সবকটা বস্তার মুখ খুলে দেখ তো। ল্যাকোরের গলা। মরে গেলে ঠ্যাং ধরে নিয়ে গিয়ে ওই খাদটায় ফেলে দাও।

আমার বস্তাটার মুখ খোলা শুরু হতেই মরার ভান করে পড়ে থাকলাম। খুলে গেল মুখ। মরে গেছি কিনা বোঝার জন্যে আমার চুল ধরে হ্যাচকা টান মারল কেউ। নিজের অজান্তেই উহ করে উঠলাম।

আহাহা, ঘুম ভেঙে গেছে। একটু চাও তো, বাছা। ল্যাকোরের গলা।

মিট মিট করে চাইলাম। সোজা আমার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে ল্যাকোর। রাগে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত জ্বলে উঠল আমার।

এই সময়েই ল্যাকোরের আসল নাম জানতে পারলাম। তার একজন অনুচর এসে ডাকল ক্যাপ্টেন কুফুজ।

আমার দেহতল্লাশী করার আদেশ দিল রুফুজ। বস্তা থেকে বের করে আনা হলো আমাকে। বুক ভরে শ্বাস নিলাম। শরীরটাকেও একটু নড়াবার সুযোগ পেলাম।

দ্রুত আমার দেহতল্লাশী হয়ে গেল। টাকা পয়সা, ছুরি, রিভলভার সব কেড়ে নিল ডাকাতেরা। কিন্তু নোটবইটা একবার খুলেও দেখল না। বের করে মলাটটার দিকে একবার চোখ বুলিয়েই আবার রেখে দিল আমার পকেটে। ব্যাটারা একেবারেই মূর্খ, বুঝতে পারলাম।

আমার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। আহ! কি আরাম! দড়ির দাগ বসে যাওয়া জায়গাগুলো হাত দিয়ে ডলতে লাগলাম। আবার রক্ত চলাচল শুরু হতেই তীব্র শিরশিরে একটা অনুভূতি টের পেলাম। কোন কিছু না ভেবেই ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকালাম। স্থির হয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গেই।

এসব কি! জীবনে এমন জিনিস দেখা তো দূরের কথা নামও শুনিনি।

কি করে বর্ণনা দেব, বুঝতে পারছি না। স্নেজগাড়ির তলায় আটকানো লোহার পাত, মানে স্কেট, ওরকম দুটো বিশাল স্কেট জাতীয় জিনিসের মস্তবড় এক প্ল্যাটফর্ম। স্কেটের সামনেটা নাগড়া জুতোর শুড়ের মত ওপর দিকে বাঁকানো। প্ল্যাটফর্মের ওপর জাফরি দিয়ে তৈরি একটা পাইলন-ইস্পাতের কাঠামো, বারো থেকে পনেরো ফুট উঁচু। পাইলনের মাঝামাঝি জায়গায় দুই ব্লেডের প্রপেলার, তবে স্টীমারের চেয়ে অনেক বড়। মাথায় দুটো..দুটো…নাহ, গুলিয়ে ফেলছি..হ্যাঁ, দুটো হাত…না, তাও না…তবে দুটো ডানা বলা যেতে পারে। বকের মত এক ঠ্যাঙের ওপর দাঁড়িয়ে দুপাশে ছড়িয়ে ডানা মেলে দিয়েছেঃ আঠারো ফুট লম্বা ডানা দুটো ধাতুর তৈরি। চকচকে।

মোট দশটা একই ধরনের জিনিস দাঁড়িয়ে আছে। এগুলোর কি কাজ, ধারণাই করতে পারলাম না।

ল্যাকোরকে দেখলাম। কিন্তু ফরাসী সেনাবাহিনীর পোশাক খুলে ফেলেছে। তার পরিবর্তে চমৎকার অন্য পোশাক পরেছে। কিন্তু এই ইউনিফর্ম কোন দেশের সেনাবাহিনী পরে, জানি না। কাঁধের ব্যাজ ক্যাপ্টেনের। ব্রিটিশ পদ্ধতিতে লাগানো। দুই পাশে পুতুলের মত দাঁড়িয়ে সেই দুজন সার্জেন্ট। বিশজন নিগ্রো, সৈন্যকেও দেখলাম। এদেরকে চিনি আমি। কিন্তু চিনি না আরও দশজন নতুন লোককে। সবাই শ্বেতাঙ্গ। কিন্তু চেহারা দেখেই বলে দেয়া যায়, সব কটা ফাসীর আসামী ! খুনী।

আমাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে মিস ব্লেজনের মুখ। চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। চোখ বন্ধ। স্থির। দুই পাশে বসে আছে ডক্টর চাতোন্নে আর মালিক। একনাগাড়ে কাঁদছে নিগ্রো মেয়েটা। ডাক্তার নাড়ী দেখছেন। ওদিকে ইটরঙা হয়ে গেছে সেন্ট বেরেনের টাক। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বয়েস বেড়ে গেছে যেন এক রাতেই।

তুলনামূলক ভাবে ভাল মঁসিয়ে বারজাক আর পঁসির চেহারা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত-পা বাঁকাচ্ছেন বেদম। আড়ষ্টতা ভাঙছেন।

আশপাশে কোথাও কিন্তু টোনগানেকে দেখলাম না। মেরে ফেলেনি তো? ওর জন্যেই কি কাঁদছে আসলে মালিক? লোকটার জন্যে সত্যিই দুঃখ হলো। অনুমান করলাম, নেই যখন, মেরেই ফেলেছে টোনগানেকে খুনীগুলো।

পায়ের খিল এখনও পুরোপুরি ছাড়েনি। খোঁড়াতে খোঁড়াতে মিস ব্লেজনের কাছে এগিয়ে গেলাম। কেউ বাধা দিল না।

কিন্তু পাশে পাশে হেঁটে গেল রুফুজ।

মিস ব্লেজন কেমন আছেন এখন? ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল রুফুজ।

একটু ভাল এখন। রুফুজের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন ডাক্তার।

রওনা হওয়া যাবে?

আরও অন্তত ঘণ্টাখানেক পরে। এভাবে বর্বর জানোয়ারের মত বয়ে নিতে গেলেন কেন? আমরা তো পালিয়ে যেতাম না। ডাক্তারের গলায় ঝাঁঝ।

ভেবেছিলাম, খেপে গিয়ে অনর্থ ঘটাবে রুফুজ। কিন্তু কিছুই করল না। বরং ফিরে গেল নিজের সঙ্গীদের কাছে।

মিনিট পনেরো পরেই চোখ মেললেন মিস ব্লেজন। আগেই ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তার।

চোখ মেলে চারদিকে একবার চাইলেন মিস ব্লেজন। তারপর আবার চোখ মুদলেন। খুললেন পাঁচ মিনিট পর। উঠে বসলেন। ব্যায়াম ছেড়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বারজাক আর পঁসি।

আমাদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেললেন মিস ব্লেজন। বললেন, আমাকে মাপ করে দেবেন আপনারা। আমার, আমার জেদের জন্যেই…

আরে থাক, থাক, বাধা দিলেন বারজাক, কাঁদছেন কেন? আর নিজেকে বা অত দোষ দিচ্ছেন কেন? আমরা তো আর কচি খোকা নই, যে ভুলিয়ে ভালিয়ে আনবেন।

বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করলাম ব্লেজনকে। এরপর এই পরিস্থিতিতে কি করা যায়, ফিসফাস করে পরামর্শ করতে লাগলাম আমরা।

ওদিকে আবার সার্জেন্ট দুজনকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছে রুফুজ।

আবার আমাদের বাঁধার আদেশ দিল শয়তান ক্যাপ্টেন। সর্বনাশ! আবার মাজেপ্পার হাল করে ছাড়বে না তো? তাহলেই গেছি।

এক এক করে সবাইকে বেঁধে ফেলা হলো। মিস ব্লেজনও বাদ গেলেন না। তারপর চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে আজব জিনিসগুলোর ভিতর ঢোকান হলো আমাদের। কিন্তু সবাইকে এক জায়গায় নয়, একেক জনকে একেকটার ভেতর।

ধাতব মেঝের ওপর দড়াম করে আছড়ে ফেলল আমাকে দুই ডাকাত। প্রচন্ড জোরে নাক ঠুকে গেল মেঝেতে। ব্যথায় আঁধার হয়ে এল পৃথিবী।

প্রচন্ড গর্জনে জ্ঞান ফিরে এল আমার। মৃদু দোলা অনুভব করলাম। জাহাজে চড়লে যেমন লাগে, অনেকটা তেমনি। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম। ওদিকে ক্রমেই বাড়ছে গর্জন। এই গর্জনই শুনে এসেছি গত কয়েকদিন ধরে। কিম্ভুতকিমাকার জিনিসগুলো কোন ধরনের মেশিন ঠিক বুঝতে পারলাম না।

মনে হচ্ছে লিফটে করে প্রচন্ড বেগে উপরে উঠে যাচ্ছি। অদ্ভুত সুড়সুড়ি জাতীয় অনুভূতি হচ্ছে পেটের ভেতর। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দ্রুতগতিতে ট্রেন নামতে থাকলে আরোহীর যেমন লাগে, তেমনি, কিন্তু আরও বেশি তীব্র অনুভূতি। আরও কটা জিনিস টের পাচ্ছি। প্রচন্ড যান্ত্রিক গর্জনকে ছাপিয়ে বাতাসের শাঁ শাঁ আওয়াজ।

প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে চলল কান, মন আর শরীরের ওপর বিচ্ছিরি অত্যাচার। তারপর সয়ে এল। যেন ভারসাম্য ফিরে পেয়েছে শরীর। এমন কেন হচ্ছে?

বাইরে কি ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। হাত-পা বাঁধা। নইলে দেখার চেষ্টা করতাম।

চুপচাপ পড়ে রইলাম। এই সময় দুজন লোকের কথার শব্দ শুনলাম। অর্থাৎ এই আজব মেশিনে আমি একা নই।

লোক দুজনের একজন ইংরেজ। গলার স্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে, প্রচুর মদ টেনেছে। অন্যজন নিগ্রো। ইংরেজি বলতে বলতে বামবারা ভাষায় কথা বলে উঠছে মাঝে মাঝেই।

আর এভাবে ছাগলের মত পড়ে থাকতে ভাল লাগছে না। হাতের বাঁধন টেনেটুনে পরীক্ষা করে দেখলাম। খুব একটা আঁটো মনে হলো না। আরও বার কয়েক জোরাজুরি করতেই অনেক খানি ঢিল হয়ে এলঃ বাঁধা হাত দুটো দাঁতের কাছে নিয়ে আসতে পারলাম।

প্রায় পনেরো মিনিটের চেষ্টায় খুলে ফেললাম বাঁধন। আরও পাঁচ মিনিট পড়ে থাকলাম চুপচাপ। তারপর সাবধানে হাত বাড়িয়ে বুটের ভেতরে লুকিয়ে রাখা চার ইঞ্চি ব্লেডের ছুরিটা বার করে আনলাম। শক্ত করে চেপে ধরলাম হাতের মুঠোয়।

এক ইঞ্চি করে ক্রল করে সামনে এগিয়ে চললাম। পৌঁছে গেলাম জাফরির কাছে! বাইরে উকি দিয়েই চমকে উঠলাম। থ হয়ে গেলাম একেবারে। স্বপ্ন দেখছি, না সত্যি !

শুন্য দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মেশিন। আমার পাঁচশো গজ নিচে মাটি। এক্সপ্রেস ট্রেনের অন্তত দশগুণ বেশি জোরে, হু হু করে ছুটছে আজব উডুক্কুযান। এতক্ষণে বুঝলাম, আঁধার রাতে মাথার উপরে আজব গর্জন কেন শোনা যেত। কেন অত চেষ্টা করেও দেখতে পেতাম না জিনিসটাকে। আসলে মেঘের উপর দিয়ে উড়ে যেত তখন ফ্লাইং মেশিন।

শুধু যে অবাক হয়েছি তাই নয়, ভয়ে, আতঙ্কে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড়। এ কাঁদের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা! পৃথিবী ছাড়িয়ে আমাকে অন্য কোন গ্রহে নিয়ে চলল নাকি ব্যাটারা? তাই হবে। নাহলে পৃথিবীতে ফ্লাইং মেশিন আবিষ্কৃত হয়েছে কই শুনিনি তো!

আবোল তাবোল ভাবছি, কিন্তু দৃষ্টি নিচেই আমার। দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে এখন। জমির চেহারা। গাছপালা শেষ হয়ে গেছে কবেই, তৃণভূমিও পাতলা। দূরে মরুভূমি দেখা যাচ্ছে।

দেখতে দেখতে মরুভূমির ওপর চলে এল ফ্লাইং মেশিন। দিগন্ত বিস্তৃত শুধু বালি আর বালি। কোথাও পাথর আর বালির পাহাড় উঠে গেছে যেন আকাশ ফুড়ে।

জাফরির ছোট ফাঁক দিয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে না।

কেটে গেল সময়; ঘড়ি দেখলাম, প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। দূরে একটা মরুদ্যান চোখে পড়েছে! গাছপালাও আছে।

মরুদ্যানটা কাছে আসতেই কিন্তু ফ্লাইং মেশিন দেখার চাইতে অবাক হয়ে গেলাম। নিচে বিশাল এক শহর। সাহারা মরুভূমিতে অত বড় শহর আছে, কস্মিনকালেও শুনিনি। আর অত আধুনিক শহরের কল্পনাও করতে পারেনি আমাদের চেনা পৃথিবী। এ যেন অন্তত একশো বছর ভবিষ্যতের পৃথিবী দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।

বিশাল সব খুঁটি দেখে অনুমান করলাম টেলিগ্রাফ টেলিফোনের তার। আর বিরাট উঁচু উঁচু সব অ্যান্টেনা। কিসের কে জানে! বাওবাব, বাবলা, ক্যারাইট গাছের ছড়াছড়ি চারদিকে। বৃষ্টি প্রধান অঞ্চলের গাছপালাও আছে প্রচুর। আর দেখলাম মাইলের পর মাইল বিস্তৃত সব্জী আর গম খেত।

ফ্রাইং মেশিন আরও কয়েক মাইল উড়ে বিশাল প্রাচীর ডিঙিয়ে শহরে ঢুকে পড়ল। আঁতকে উঠলাম। আকাশছোঁয়া সব অট্টালিকায় না আবার ধাক্কা খায় মেশিন। তাহলে গেছি।

চমৎকার শহর। আধখানা চাঁদের মত। দূর থেকে অতটা বোঝা যায়নি। এখন শহরের ওপর এসে দেখেশুনে আরও তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি।

শহরে লোকজন কিন্তু তেমন নেই। আধজন পথচারী শুধু ব্যস্তভাবে এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছে। যেন কাজের অনেক তাড়া। তবে খেতে খামারে শত শত লোককে কাজ করতে দেখে এসেছি।

একটা নদী পেরিয়ে এলাম। টিলার চূড়ায় শহরের সবচেয়ে বড় আর আধুনিক প্রাসাদের মাথায় এসে থামল ফ্লাইং মেশিন। প্রাসাদের পাশে বিশাল চত্বরে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকজন লোক। আস্তে আস্তে নামতে শুরু করল মেশিন। দেখতে দেখতে নেমে পড়ল চত্বরে। কিন্তু থামল না। প্রচন্ড বেগে ঘসটে ঘসটে ছুটে গেল সামনে। সেরেছে রে। বিকল হয়ে গেছে বুঝি মেশিন! আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

কিন্তু খামোকাই ভয় পেয়েছি। আস্তে আস্তে থেমে দাঁড়াল মেশিন। এঞ্জিনের শব্দও কমতে কমতে একেবারে থেমে গেল।

মাঝখানের দরজা খুলে আমার কেবিনে এসে ঢুকল একজন শ্বেতাঙ্গ। আমাকে হাতখোলা অবস্থায় জাফরির কাছে উকি ঝুঁকি মারতে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, আরে, এই ব্যাটা দেখছি সব দেখছে! অত ঢিলে করে বেঁধেছে কে?

কিছু বললাম না।

এগিয়ে এসে আমাকে ঠ্যাঙ ধরে হিড় হিড় করে মাঝে টেনে নিয়ে এল লোকটা। পায়ের বাঁধন খুলল। তারপর কর্কশ কণ্ঠে আদেশ দিল, ওঠো।

উঠতে গিয়েও পড়ে গেলাম। আসলে হাত যাই হোক, পায়ে ঠিকই কষে বেঁধেছিল হতচ্ছাড়ারা। এখন হঠাৎ বাঁধন মুক্ত হতেই রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে, অথচ বোধশক্তি তেমন আসেনি পায়ে।

একটু সুস্থির হয়ে নিয়ে উঠলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। কিন্তু ওপাশের কিছু দেখা গেল না। চোখের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশাল এক প্রাচীর। একপাশে তাকিয়ে আকাশছোঁয়া এক পাইলন চোখে পড়ল। এ ধরনের আজব পাইলনের কি দরকার বুঝলাম না।

ডানের দৃশ্য কিন্তু অন্যরকম। অপরূপ সুন্দর এক প্রাসাদ। আকাশ থেকে এটাই দেখেছিলাম। রাজার বাড়ি নাকি? ফ্রান্সের মস্ত মস্ত ধনীরাও অমন বাড়ি বানাবার কল্পনাও করতে পারবে না।

ধাক্কা দিয়ে আমাকে বাইরে বেরোবার নির্দেশ দিল শ্বেতাঙ্গ লোকটা? বেরিয়ে এলাম।

একে একে আরও কয়েকটা আকাশযান থেকে নেমে এল আমার সঙ্গীরা। কিন্তু মালিক আর টোনগানে অনুপস্থিত। ব্যাপার কি? ফ্লাইং মেশিন চড়ার আগেও তো মেয়েটাকে দেখেছি। ও, বুঝেছি। টোনানেকে তো আগেই শেষ করে দিয়েছে। আসার আগে বোধহয় মেয়েটারও পেট ফেড়ে রেখে এসেছে নরপিশাচগুলো।

সঙ্গীদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, অসম্ভব রকম অবাক হয়ে গেছে সবাই। মনে মনে একটু কৌতুক অনুভব করলাম এত বিপদের মাঝেও। আসলে বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে ওরা। বুঝতে পারছে না, কিসে চড়ে কোথায় এসেছে। আসলে ওরা তো আর আমার মত বাঁধন খুলতে পারেনি, দেখেওনি কিছু। তাই জানতেও পারেনি, উড়ে এসেছি আমরা অতটা পথ! নিজের চোখে না দেখলে, আমিও বুঝতে পারতাম ন ব্যাপারটা। ওদেরই মত অবাক হতাম।

সামনে চলার নির্দেশ পেলাম।

একবার ফিরে চেয়েই এগিয়ে চললাম।

কি আর করা!

আগের পর্ব :
০১. ভূপৃষ্ঠের তিনলক্ষ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে
পরের পর্ব :
০৩. কয়েদখানায় বসে লিখছি
০৪. হ্যারি কিলারের নৃশংসতায়
০৫. সত্যিই বেঁচে আছে টোনগানে
০৬. অতি তুচ্ছ সৌজন্য
০৭. চওড়ায় আড়াইশো গজ কারখানা এলাকা
০৮. বারজাক মিশন ছেড়ে আসার পর
০৯. বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে
১০. নিঃসীম হতাশায় ভেঙে পড়ল অভিযাত্রীরা
১১. ভেতর থেকে সদর দরজা খোলার পদ্ধতি
১২. হঠাৎ শ্ৰীমতীর আগমন
১৩. কিসের এত শব্দ
১৪. পরিষ্কার বুঝল জেন

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত