নাইজারের বাঁকে: ০৮. সিকাসো থেকে রওনা দেবার পর

নাইজারের বাঁকে: ০৮. সিকাসো থেকে রওনা দেবার পর

০৮. সিকাসো থেকে রওনা দেবার পর
(আমিদী ফ্লোরেন্সের নোটবই থেকে)

জানুয়ারি ২২। সিকাসো থেকে রওনা দেবার পর থেকেই আবার ওঝার চিন্তাটা মনে এসে ভর করেছে। ধীরে ধীরে যেন ফলতে চলেছে তার কথা। দেখছি, অল্পেতেই কাহিল হয়ে পড়ছে কুলিরা, বার বার জিরিয়ে নিতে চাইছে। চলার কোন উদ্যমই যেন আর নেই ওদের মধ্যে।

জানুয়ারি ২৩। চলার গতি অতি ধীর আমাদের। পথের অবস্থা খুবই খারাপ, বেশি চড়াই উৎরাই। মন ভাল যাচ্ছে না কুলিদের।

জানুয়ারি ২৪। আজ সন্ধ্যায় কোফেনে পৌঁছলাম। চারদিনে তিরিশ মাইল, দিনে মোটে আট মাইল। আশঙ্কাজনক।

জানুয়ারি ৩১। আমাদের চলার গতি আরও ধীর। ছদিনে মাত্র তিরিশ মাইল। কোকোরো নামে একটা গ্রামে এসে পৌঁছেছি।

কোকোরোর পর থেকে শুরু হলো বোবো উপজাতির দেশ। অকল্পনীয় নোংরা আর পেটুক এরা। খায় না এমন কিছু নেই, পোকায় ধরা পচা গোশত পর্যন্ত খায়। এদের মনও নোংরা।

গতকাল রাতে লিখতে পারিনি, একটা গোলমাল হয়েছিল। আজ যখন সময় পেয়েছি, লিখে ফেলিঃ

ঙগাগা নামে একটা গ্রামে পৌঁছেছিলাম সন্ধেবেলা। নাম যেমন, তেমনি গ্রামের ছিরি। ডাইনে, বায়ে, পেছনে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সামনে অবশ্য অনেক দূর পর্যন্ত সমভূমি, কিন্তু তাও কাঁটাঝোপে ভরা।

কাছে পৌঁছতেই গ্রাম ভেঙে তেড়ে এল নিগ্রোরা। শআটেকের কম হবে না, হাতে তীর-ধনুক-গদা ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র; প্রমাদ গুণলাম।

ভাবনায় পড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন মারসিনে। সৈন্যদের রাইফেল হাতে তৈরি থাকতে আদেশ দিলেন।

ওদিকে আমাদের চেয়ে বেশি ভয় পেয়ে বসল সেন্ট বেরেনের অশ্বপ্রবর। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটোছুটি শুরু করল জানোয়ারটা। পরে বেরেনের মুখেই শুনেছি, ঘোড়াটার কোন দোষ ছিল না। জঙলীদের দেখে এর আগের বারে ঢিল খাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যায় বেরেনের। তাড়াতাড়ি পিঠ থেকে খুলে ছিপের খাপটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে গেলে ছিপের চোখা মাথার আচমকা গুঁতো লেগে যায় ঘোড়ার পেটে। এতেই ভড়কে যায় ঘোড়াটা।

ঘোড়াটাকে সামলাবার অনেক চেষ্টা করলেন বেরেন, কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে গিয়ে পড়লেন জঙলীদের মাঝে। আর রক্ত পানি করা হুঙ্কার ছেড়ে বেরেনকে ঘিরে ধরল জঙলীরা। আমরা একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম।

কিন্তু সাহস আছে বলতে হবে মিস ব্লেজনের। ঘোড়া ছুটিয়ে একেবারে জঙলীদের মাঝে গিয়ে ঢুকলেন। ভয়ঙ্কর গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, মান্টো! নটে আমি সৌবা! (খবরদার! আমি ডাইনী!)।

বলেই পকেট থেকে টর্চ বের করে জঙলীদের মুখের ওপর ঘুরিয়ে আনলো। জীবনে টর্চ কি জিনিস দেখেনি এই জঙলীরা। আকাশের বিদ্যুৎ জেনের হাতের মুঠোয় দেখে ভড়কে গেল ওরা। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে দাঁড়াল। নইলে কোন সময় আবার মুখ দিয়ে রক্ত বের করে ছাড়ে সুন্দরী ডাইনী!

ভয়ে ভয়ে হাত জোড় করে মিস ব্লেজনের সামনে এগিয়ে এল জঙলীদের সর্দার পিনতিয়েবা। কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলেন মিস ব্লেজন। ওদিকে মাটিতে স্থির পড়ে আছেন সেন্ট বেরেন। আচমকা পড়ে ঘাড় মটকে মরেই গেলেন কিনা কে জানে।

অবস্থা বুঝে ধীরেসুস্থে ভিড় ঠেলে বেরেনের কাছে এসে দাঁড়ালেন ডক্টর চাতোন্নে। ঝুঁকে বসে পরীক্ষা করে দেখলেন।

চোখা একটা পাথর বিশ্রীভাবে বিঁধে গেছে সেন্ট বেরেনের পাছার সামান্য উপরে, বড়শির ক্ষতগুলোর কাছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। চমকে উঠলাম। ওঝার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলো না তো! হঠাৎই খেয়াল হলো, আমার খবরগুলো জায়গামত পৌঁছেছে তো? অজানা আশঙ্কায় ভরে গেল মন।

দ্রুত হাত চালালেন ডক্টর। বেরেনের ক্ষতস্থান সেলাই করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। অবাক চোখে ব্যাপারটা দেখল জঙলীরা।

ওদিকে সর্দার কিন্তু তাকিয়ে আছে বেরেনের ছিপের খাপের দিকে। চকচকে খাপটা দেখে লোভ সামলাতে পারল না সে। শেষ পর্যন্ত মিস ব্লেনের দিকে চেয়ে আবদারই করে বসল, জিনিসটা তার চাই।

ব্যথায় কোকাচ্ছিলেন, কিন্তু বেঁকে বসলেন সেন্ট বেরেন। যায় যাবে জান, কিন্তু অত শখের খাপ কিছুতেই হাতছাড়া করবেন না তিনি।

সামান্য একটা ছিপের খাপের জন্যে অতগুলো লোকের জীবন সংশয় দেখা দেবে, কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না মিস ব্লেজন। খাপটা দিয়ে দেবার জন্যে অনেক বোঝালেন বেরেনকে। কিন্তু কিছুতেই তাকে রাজি করানো গেল না। রেগে গেলেন মিস ব্লেজন, কড়া ধমক দিলেন, এজনর!

ঠিক আছে, ঠিক আছে, এই নে কাফ্রী ভূত! বলে ছিপের খাপটা পিনতিয়েবার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন সেন্ট বেরেন।

ছোঁ মেরে খাপটা নিয়ে নিল পিনতিয়েবা। খুশির চোটে নিজের গ্রামে নিমন্ত্রণই করে বসল অভিযাত্রীদের।

নিমন্ত্রণ রাখতে নয়, দেখার জন্যে গিয়ে ঢুকলাম আমরা গ্রামের ভেতরে। নোংরা, দুর্গন্ধে টেকা, দায়! ওয়াক থু করে বমিই করে ফেললেন সেন্ট বেরেন। গ্রামের ঠিক মাঝখানে এক উঠানে জঞ্জালের পাহাড়। যেন অতি যত্নে টিকিয়ে রেখেছে জঙলীরা। এর আশেপাশেই চরছে গবাদিপশু, হতচ্ছাড়ারা আবার পশুও পালে, নিজেরাই তো একেকটা পশু। উঠানের চারপাশে পায়রার খুপরীর মত সারি সারি কুঁড়েঘর। ভেতরে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না, এত দুর্গন্ধ আর নোংরা।

পিনতিয়েবার ঘরের সামনে গিয়ে থামলাম আমরা। আমাদের বসতে বলল সর্দার। মাটিতেই বসে পড়লাম। কিছু উপহারও দিলাম তাকে। উপহার মানে কয়েক টুকরো ছেঁড়াকাপড়, অকেজো তালা, ভাঙা চকমকি পিস্তল, সুঁইসুতো ইত্যাদি। এই পেয়েই বর্তে গেল পিনতিয়েবা। তিড়িং তিড়িং লাফাতে লাফাতে নাচ শুরু করার হুকুম দিল।

বেজে উঠল হরিণের শিং-এ তৈরি বোদোতো বাঁশী। ফাঁপা গাছের গুঁড়িতে তৈরি বিশাল ঢাকে ঘা পড়ল কাঠের গদার। দি-দ্দিড়িম! দি-দ্দিড়িম! দি-দ্দিড়িম!

বিচিত্র পোশাক আর রঙচঙ মেখে নাচতে নাচতে এগিয়ে এল নাচিয়েরা। যার যেভাবে খুশি লাফাচ্ছে, ইচ্ছে হলেই সামনের জনের গায়ে পেছনের জন কিলঘুসি মারছে, ফিরে দাঁড়িয়ে সামনের লোকটাও পাল্টা প্রতিশোধ নিচ্ছে, এই হলো নাচ। কিন্তু এই নাচই তন্ময় হয়ে দেখতে লাগল জঙলীরা। মাঝে মাঝে ইয়া হো, ইয়া হো বলে বিকট স্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে বাহবা দিতে লাগল সর্দার।

একে একে নাচের দলে গিয়ে যোগ দিল ছেলে বুড়ো-মেয়েরা। টলতে টলতে সর্দারও উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে গদা একটা দিয়ে যাকে খুশি বেদম পেটাতে আর লাফাতে লাগল। হেসে গড়িয়ে পড়ল জঙলীরা। মার খাওয়া লোককেও জোর করে মুখের হাসি ঠিক রাখতে হলো, নইলে পিটিয়ে একদম মেরেই ফেলবে পিনতিয়েবা।

মাঝরাতে থামল নাচ। খাবার তৈরি করার হুকুম হলো। আগেই ভেড়া মেরে চামড়া ছিলে রাখা হয়েছিল, আগুনে সেঁকা হতে লাগল এখন ওগুলো। একটু সেঁক লেগেছে কি লাগেনি, অমনি রাক্ষসের মত গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর পিনতিয়েবা। সমানে আধসেঁকা মাংস ছিড়ে ছিড়ে মুখে পুরতে লাগল। দেখাদেখি এগিয়ে এল দলের অন্যরাও। এই বিশ্রী দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। তাঁবুতে ফিরে এলাম আমরা।

জঙলীদের হৈ-হুল্লোড় চলল সারা রাত ধরে।

ফেব্রুয়ারি ২। ক্ষতস্থানের অসহ্য যন্ত্রণায় ককাচ্ছেন সেন্ট বেরেন। ঘোড়ার পিঠে বসা তাঁর পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। কাজেই এখনও কোকোরাতেই রয়েছি আমরা।

ফেব্রুয়ারি ৩। আজও থেকে গেলাম কোকোরাতে।

ফেব্রুয়ারি ৪। আর থাকা নয়। যেভাবে হোক যেতেই হবে। ভোর ছটায়ই রওনা দিলাম। কিন্তু সন্ধেবেলায় আবার আমরা সেই আগের জায়গায়ই ফিরে। এলাম।

পিনতিয়েবা দলবল নিয়ে আমাদেরকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকেই শয়তানি শুরু করল কুলিরা। ইচ্ছে করেই ঘন ঘন থামতে লাগল। গাধার পিঠ থেকে খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে বস্তাগুলো সব। দশটা নাগাদ থামতে আদেশ দিলেন ক্যাপ্টেন মারসিনে। বুঝলেন সবই, কিন্তু ধৈর্য ধরে দেখে গেলেন।

দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা দিয়ে বড়জোর আধমাইল গিয়েছি, হঠাৎ থেমে পড়ল মোরিলিরে। কি ব্যাপার? ভুল পথে নাকি এসে পড়েছে। বাধ্য হয়েই আবার পিনতিয়েবার গ্রামে ফিরে আসতে হলো। পরদিন সকালে আবার ঠিক পথে রওনা হব। আশ্চর্য! সকালে কুলিরা চার ঘণ্টায় যেটুকু পথ অতিক্রম করেছিল, এখন মাত্র এক ঘন্টায় সে পথ পাড়ি দিল।

ফেব্রুয়ারি ৫। রওনা দেবার আগে ক্যাপ্টেনের সামনে এসে হাজির মোরিলিরে। কি ব্যাপার? জিভ কেটে বলল সে, ভুল করে ফেলেছি, মঁসিয়ে। গতকাল আসলে ঠিকই এগোচ্ছিলাম, চৌমৌকিও তাই বলছে। সারাটা রাত এ নিয়ে ভেবেছি তো।

কি আর করা। পথ যখন চিনি না, ওর নির্দেশিত পথেই চলতে হবে। রওনা হলাম। আজও এগিয়ে দিল পিনতিয়েবা আর তার দলবল। নষ্টামি করেই চলল কুলিরা।

অতি ধীরে এগোচ্ছি আমরা।

মারাত্মক ঘটনাটা ঘটল দুপুর নাগাদ। হঠাৎ ঢলে পড়ে মরে গেল একটা গাধা। আঁতকে উঠলাম আমরা। বিষ?

বিকেলের দিকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল একজন কুলি।

সন্ধের পর আবার আরেক ঘটনা। মদ খেয়ে বেঁহুশ হলো কয়েকজন কুলি। আমাদের দীর্ঘ পথযাত্রায় কুলিদের মদ খাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মদ এদের সরবরাহ করল কে?

কিন্তু শাসন করা যাচ্ছে না। এই গহীন অঞ্চলে ওরা বেঁকে বসলেই তো গেছি।

তাঁবুতে মীটিং ডাকলেন ক্যাপ্টেন মারসিনে। মীটিংয়ে থাকলাম শুধু আমি, মিস ব্লেজন, সেন্ট বেরেন, উক্টর চাতোন্নে আর মঁসিয়ে বারজাক।

কিন্তু কোন সিদ্ধান্তই নেয়া গেল না কুলিদের বিরুদ্ধে। অগত্যা ওদেরকে নিজস্ব পথে চলতে দিতেই হলো।

কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত হলেন মঁসিয়ে বারজাক। এই হতচ্ছাড়াদের হাতে ভোটাধিকার দেয়ার কোন মানেই হয় না।

সুতরাং ফিরে যাওয়া যায় এখন। কিন্তু তাও যে পারব কে জানে? সেক্ষেত্রেও তো কুলিদের ওপরই নির্ভর করতে হবে।

যা থাকে কপালে, এগিয়ে যাওয়াই স্থির হলো।

ফেব্রুয়ারি ৬। গতরাতে পালা করে পাহারা দিয়েছি আমরা। সৈন্যদের দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করতে পারতাম, কিন্তু তাতে ভড়কে যেত ওরা। হয়তো কুলিদের ধরে পিটুনীই দিয়ে বসত। তাতে ফল হত উল্টো। এই দুর্গম অঞ্চলে বেঘোরে প্রাণ হারাতাম সবাই।

সকালে রওনা দিতে দেরি হয়ে গেল। এদিনও আবার সেই ঢিমে তেতলা চলা।

সন্ধেয় থেমে তাঁবু ফেলা হলো। আজও গতরাতের মতই পালা করে পাহারা দেব আমরা। অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ রকম পাহারা দিয়ে যাব, এই-ই স্থির হয়েছে মীটিংয়ে।

আমার পালা আসতেই আমাকে তুলে দিয়ে শুতে গেলেন ক্যাপ্টেন। তাঁবুগুলোর চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিতে লাগলাম। হালকা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ায় অদ্ভুত ঘোলাটে আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ। খোলা জায়গায়ই চিত হয়ে পড়ে আছে মোরিলিরে। মুখ ছাড়া বাকি শরীর চাদরে ঢাকা। কিন্তু টুপি ঢাকা দিয়ে রাখায় দেখতে পেলাম না মুখও।

হঠাৎই শুনলাম শব্দটা। চিনতে এতটুকু ভুল হলো না; কানকানে এই আওয়াজই শুনেছিলাম। তাড়াতাড়ি হাতঘড়ি দেখলাম, রাত দেড়টা।

পুবদিক থেকে আসছে শব্দটা। মাথার ওপর দিয়ে না এসে দূর দিয়ে মিলিয়ে গেল দক্ষিণে। আর ফিরে এল না।

সোয়া দুটোয় সেন্ট বেরেনকে তুলে দিয়ে আবার ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু ঘুম এল না। কেবলই ঘুরে ফিরে মনে আসতে লাগল রহস্যজনক শব্দটার কথা। শেষ পর্যন্ত দুত্তোরি ছাই বলে আবার বেরিয়ে এলাম তাঁবুর বাইরে।

মিনিটখানেক পরেই কানে ভেসে এল আবার সেই শব্দ। দক্ষিণ দিক থেকে এসে পুবে মিলিয়ে গেল আওয়াজটা। গা ছমছম করে উঠল আমার! এ কি রহস্য?

আশেপাশে খুঁজলাম সেন্ট বেরেনকে। কিন্তু কোথাও দেখলাম না। আগেরই মত একভাবে পড়ে ঘুমাচ্ছে মোরিলিরে। বেরেনের তাঁবুতে গিয়েও তাঁকে পেলাম না। কোথায় গেলেন লোকটি? কাছেই নদী, ওখানে মাছ ধরছেন না তো?

গিয়ে দেখলাম, আমার অনুমানই ঠিক। মাছ ধরছেন। তবে তীরে বসে নয়। নদীর মাঝখানে-ভেলাতে। কি আশ্চর্য! ওই ভেলা আবার বানালেন কখন? পরে শুনেছি, সন্ধেয় আমরা যখন তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত ছিলাম, লুকিয়ে গিয়ে তখন শুকনো কাঠ বেঁধে বেঁধে ভেলা বানিয়েছেন বেরেন।

ডাকলাম, র্মসিয়ে বেরেন?

কে? ও সঁসিয়ে ফ্লোরেন্স?

হা, কি করছেন?

মাছ। মাছ ধরছি।

কিন্তু মাঝ নদীতে কেন?

বিকেলে মাঝ নদীতেই মাছ ঘাই মারতে দেখেছিলাম।

কিন্তু আপনাকে তো পাহারা দিতে বলেছিলাম।

পাহারা আর কাকে দেব। সব তো আমাদেরই লোক।

বুঝলাম, ওই লোকটাকে বোঝানো আমার কাজ নয়। তবু একটু চড়া গলায়ই ডাকলাম, এই অত রাতে মাঝ নদীতে ভেলায় বসে থাকা নিরাপদ নয়। কুমীর আছে। জলদি ফিরে আসুন।

কুমীরের ভয় দেখাতেই তাড়াতাড়ি লগি ঠেলে ফিরে এলেন সেন্ট বেরেন।

তাঁবুর কাছে ফিরে এলাম দুজনে।

হঠাৎ নদীর দিক থেকে কার আর্তচিৎকার ভেসে এল। আবার ছুটলাম। ছুটতে গিয়ে কোমরে দারুণ ব্যথা পাচ্ছিলেন বেরেন, কিন্তু তবু হাঁচড়ে-পাঁচড়ে এলেন আমার পিছু পিছু। দেখি, তীরের কাছেই পানিতে পড়ে চেঁচাচ্ছে একটা লোক। উঠতে চেষ্টা করছে, কিন্তু বার বারই কিসের টানে তলিয়ে যাচ্ছে।

আরও এগিয়ে দেখলাম লোকটা মোরিলিরে। আমাদের দেখেই ককিয়ে কেঁদে উঠল, দোহাই, মঁসিয়ে, বাঁচান! কুমীরে ধরেছে।

অত রাতে নদীতে নেমেছিলি কেন, হতভাগা? কুমীরে তো ধরবেই। ধমকে উঠলেন বেরেন।

একেবারে হাঁটু পানিতে নেমে গেলাম আমি। হাত বাড়িয়ে মোরিলিরের বাড়ানো হাতটা চেপে ধরলাম। টানাটানির চোটে ভুস করে পানির ওপর ভেসে উঠল কুমীরটা। মোরিলিরের একটা পা কামড়ে ধরে রেখেছে। সেন্ট বেরেন লোকটা সহজ সরল হলেও করিৎকর্মা। তীরের কাছে পড়ে থাকা কয়েকটা বড় বড় পাথর দ্রুত তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলেন কুমীরের মাথায়। বেয়াড়া আক্রমণে ভড়কে গিয়ে মোরিলিরের পা ছেড়ে দিল জানোয়ারটা; হ্যাচকা টানে তাকে তীরে তুলে আনলাম আমি।

অবাক লাগল! এই মাত্র তো মোরিলিরেকে পড়ে ঘুমাতে দেখলাম। সে যখন কুমীরের খপ্পরে পড়ে চিৎকার করছিল তখনও তো চাদর গায়ে দিয়ে…। হঠাৎই কথাটা মনে পড়ে যেতে চমকে উঠলাম। মোরিলিরেকে চেপে ধরে টানতে টানতে ছুটলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য! এখনও তো শুয়ে আছে মোরিলিরে! এগিয়ে গিয়ে টান মেরে চাদরটা পড়ে থাকা মূর্তির গা থেকে সরিয়ে দিতেই ফাঁকিটা ধরতে পারলাম। গাছ আর পাথর দিয়ে মানুষের কাঠামোর মত বানিয়ে তার ওপর চাদর ঢাকা দিয়ে রেখেছে মোরিলিরে। একটা প্রমাণ সাইজের পাথর মাথার কাছে রেখে তার ওপর কায়দা করে নিজের টুপিটা ফেলে রেখেছে। কাছে দিয়ে গিয়েও চালাকিটা ধরতে পারিনি আমি।

রেগে গেলেন সেন্ট বেরেন। প্রচন্ড এক চড় কষালেন মোরিলিরের গালে। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলি, বল হারামজাদা! তারপরই বিশ্বাসঘাতক গাইডের হাতের দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন, হাতের মুঠোয় কি যেন লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে মোরিলিরে। ছোঁ মারলেন সেন্ট বেরেন। কিন্তু হাত থেকে কেড়ে নেবার আগেই জিনিসটা সোজা মুখে পুরে দিল মোরিলিরে। একটা কাগজের টুকরো।

আবার থাবা মারলেন সেন্ট বেরেন। খানিকটা কাগজ ছিড়ে চলে এল তাঁর, হাতে, কিন্তু বেশির ভাগটাই থেকে গেল মোরিলিরের মুখে। কোঁৎ করে কাগজটা। গিলে ফেলল সে।

এত কিছুর পর আর মোরিলিরেকে মুক্ত রাখার ঝুঁকি নিতে চাইলাম না। আমার তাঁবুতে এনে দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে ওর হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে সেন্ট বেরেনকে নিয়ে ক্যাপ্টেন মারসিনের তাঁবুতে চললাম। আমাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই সেই ভাষা পড়তে পারেন।

লণ্ঠনের আলোয় কাগজটা দেখলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু লম্বালম্বিভাবে ছিড়ে যাওয়া কাগজটায় লেখা টুকরো টুকরো শব্দের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলেন না। মোরিলিরের মুখ থেকে কথা আদায় করে নিলে কাজটা সহজ হবে। আমার তাঁবুতে নিয়ে চললাম ক্যাপ্টেনকে। সেন্ট বেরেনও সঙ্গে চললেন।

কিন্তু তাঁবুতে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালাম! কাটা দড়ির টুকরোগুলো শুধু ছড়িয়ে পড়ে আছে মেঝেতে, মোরিলিরে নেই!

আগের পর্ব:
০১. শহরের সবকটা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায়
০২. ফেঞ্চগিনির রাজধানী মানে কোনাক্রি অঞ্চলে
০৩. দেহমন দুইই ভেঙে পড়েছে বৃদ্ধ লর্ডব্লেজনের
০৪. অদ্ভুত প্রবন্ধটা
০৫. বারজাক মিশন
০৬. লা এক্সপ্যানসন ফ্রাঁসে পত্রিকায়
০৭. আমিদী ফ্লোরেন্সের নোট বই থেকে
পরের পর্ব :
০৯. পাহারাদারদের জিজ্ঞেস করে
১০. পরিষ্কার বুঝতে পারছি বিপদে পড়েছি
১১. স্তব্ধ হয়ে বসে রইল বারজাক মিশনের সদস্যরা
১২. কাদৌ গ্রামের মোড়লের সাহায্যে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত