০৭. আমিদী ফ্লোরেন্সের নোট বই থেকে
(জানুয়ারি ১২। সমুদ্র উপকূল থেকে বারোশো মাইল দূরে সিকাসোতে এসে পৌঁছেছে বারজাক মিশন। চৌমৌকির হাত দিয়ে খবর ঠিকই পাঠিয়েছেন কিন্তু পত্রিকা অফিসে আর পৌঁছাচ্ছে না আমিদী ফ্লোরেন্সের খবর। এই কথা কিন্তু কিছুই জানতে পারছেন না রিপোর্টার।)
আমিদী ফ্লোরেন্সের নোট বই থেকে :
নিরাপদেই সিকাসো এসে পৌঁছেছি। নতুন আর কোন ঘটনা ঘটেনি পথে?
সিকাসোতে তো এসে পৌঁছলাম। কিন্তু নিগ্রো ওঝার কথা সত্যি তো হলো না। এখন বুঝতে পারছি, আসলে খামোকাই ভেবেছি আমি।
আস্তে আস্তে টোনগানের কাছ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে চৌমৌকি। ওদিকে তার বন্ধুত্ব নিবিড় হচ্ছে মোরিলিরের সঙ্গে।
খানকয়েক মাটির ঘরের সমষ্টি সিকাসোসা গ্রাম। গ্রামের বাইরে একপাশে চাষাবাদের জমি, অন্যপাশে ফরাসী সৈনিকদের ছাউনি। আমাদের দেখে অত্যন্ত খুশি হলো সৈনিকেরা। হবেই, অনেকদিন পর দেশের লোকের সান্নিধ্য পেয়েছে।
অফিসাররা কার আগে কে মিস জেন ব্লেজনের সঙ্গে পরিচিত হবে তা নিয়ে যেন উঠে পড়ে লেগেছে।
একদিনেই সমস্ত ছাউনির লোকেদের পরিচিত হয়ে গেছেন সেন্ট বেরেন। মঁসিয়ে বারজাকও পরিচিত হচ্ছেন সবার সঙ্গে।
সমস্ত অফিসারের সঙ্গেই সমানভাবে মিশেছেন মিস ব্লেজন, শুধু এক ক্যাপ্টেন মারসিনে ছাড়া। তাঁর দিকে যেন একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব।
এই সিকাসো থেকেই দুদলে ভাগ হয়ে যাবে বারজাক মিশন। একদল মঁসিয়ে বারজাকের অধীনে যাবে সিধে পুবে, অন্য দল বদ্রিয়ার্সের নেতৃত্বে দক্ষিণে। প্রথম দল নাইজারের দুর্গম অজ্ঞাত অঞ্চল পেরিয়ে পৌঁছবে দাহোমে। গ্র্যান্ড বাজামে যাবে দ্বিতীয় দল।
বারজাকের দলে থাকব আমি, পসিঁ আর ডক্টর চাতোন্নে; বদ্রিয়ার্সের সঙ্গে যাবেন হেইরো, কুইরো আর তাসিন। আমি কিন্তু ইচ্ছে করেই বারজাকের সঙ্গী হলাম। বদ্রিয়ার্সের চাইতে অনেক বেশি পেরোতে হবে তাকে। দেখার সুযোগ পাব অনেক, লেখার উপাদান পাব বেশি।
সমান দুভাগে ভাগ হয়ে দুই দলের সঙ্গে যাবে সৈন্যেরা। একশো জন ক্যাপ্টেন মারসিনের নেতৃত্বে বারজাকের সঙ্গে, বাকি একশো একজন লেফটেন্যান্টের নেতৃত্বে বদ্রিয়ার্সের সঙ্গে।
এখন কথা হলো মিস জেন ব্লেজন আর তার বোনপো যাবেন কার সঙ্গে? নিজেই যেচে মত দিলেন মিস, মঁসিয়ে বারজাকের দলের সঙ্গ নেবেন তিনি। আড়চোখে লক্ষ করলাম, উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ক্যাপ্টেন মারসিনের মুখ।
কিন্তু পরক্ষণেই মিস ব্লেজনের কথা শুনে মুখ শুকিয়ে গেল তার। আমরাও উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলাম।
আমাদের সঙ্গে হোমবোরি পেরিয়ে নাইজার বাঁকের গাঁও অঞ্চলে যাবার পরই সেন্ট বেরেন আর তাঁর কুলি-গাইডদের নিয়ে উত্তরে চলে যাবেন মিস ব্লেজন। ওই অঞ্চলে আজ পর্যন্ত এমন কি ফরাসী সৈন্যেরা পর্যন্ত পা দেয়নি, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা। কি আছে সেখানে কেউ জানে না। শোনা যায়, ওদিকেই নাকি অতি ভয়ঙ্কর, দুর্ধর্ষ তোয়ারেগ উপজাতির বাস; ডাকাতিই ওদের পেশা।
মিস ব্লেজনকে বাধা দিয়েও কোন লাভ হবে না, জানি আমরা। ওখানে যাবেন বলেই তিনি ইউরোপ ছেড়েছেন।
ওদিকে কিন্তু গোল বাধাল মোরিলিরে। মঁসিয়ে বারজাকের সঙ্গে কিছুতেই যেতে চাইল না সে। তার ইচ্ছে মঁসিয়ে বদ্রিয়ার্সের সঙ্গে যায়। এর ওপর আবার আরেক সমস্যা। কুলিদের সঙ্গে শর্ত ছিল যে তারা সিকাসো পর্যন্ত আসবে, তাই এসেছে ওরা; এখন আর এক পা-ও সামনে এগোবে না।
কুলিরা যখন কিছুতেই রাজি হলো না তখন নতুন গাইড আর কুলির সন্ধানে গ্রামে গেলেন ক্যাপ্টেন মারসিনে। কপাল ভাল আমাদের, একজন দক্ষ গাইড পাওয়া গেল। তবে টাকা বেশি—তা হোক। পয়সা দিতে কার্পণ্য করবে না বারজাক মিশন। কুলিও পাওয়া গেল।
আশ্চর্য! খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এসে বারজাকের কাছে প্যানর প্যানর করতে লাগল মোরিলিরে। অন্যায় হয়ে গেছে তার, এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে, মঁসিয়ে বারজাকের সঙ্গেই যেতে চায় সে। সুর পাল্টাল কুলিরাও, জাহান্নামে নিয়ে গেলেও যাবে ওরা এখন। বোঝা গেল, কুলি ধর্মঘট ঘটিয়েছিল এই মোরিলিরেই। তাকে এখন আদৌ কাজে রাখা উচিত হবে কিনা ভাবতে লাগলাম আমরা।
শেষ পর্যন্ত অনেক মাফটাফ চেয়ে চাকরি বজায় রাখল মোরিলিরে। অভিজ্ঞ লোক সে, তাই আবার সঙ্গে নিতে অরাজিও হলেন না মঁসিয়ে বারজাক। নতুন গাইড যাবে মঁসিয়ে বদ্রিয়ার্সের সঙ্গে।
জানুয়ারি ২১। আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হলো আমাদের। ছাউনির সৈনিকেরা ব্যান্ড-বিউগল বাজিয়ে, নিশান উড়িয়ে, কুচকাওয়াজ করে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিল দুই দলকে।
মোরিলিরের দেখানো পথে আফ্রিকার অতি দুর্গম, অজ্ঞাত অঞ্চলে চললাম আমরা।
আগের পর্ব:
০১. শহরের সবকটা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায়
০২. ফেঞ্চগিনির রাজধানী মানে কোনাক্রি অঞ্চলে
০৩. দেহমন দুইই ভেঙে পড়েছে বৃদ্ধ লর্ডব্লেজনের
০৪. অদ্ভুত প্রবন্ধটা
০৫. বারজাক মিশন
০৬. লা এক্সপ্যানসন ফ্রাঁসে পত্রিকায়
পরের পর্ব :
০৮. সিকাসো থেকে রওনা দেবার পর
০৯. পাহারাদারদের জিজ্ঞেস করে
১০. পরিষ্কার বুঝতে পারছি বিপদে পড়েছি
১১. স্তব্ধ হয়ে বসে রইল বারজাক মিশনের সদস্যরা
১২. কাদৌ গ্রামের মোড়লের সাহায্যে