০৪. অদ্ভুত প্রবন্ধটা
অদ্ভুত প্রবন্ধটা লা এক্সপ্যানসন ফ্রাঁসে পত্রিকায় ছাপা হলো পহেলা জানুয়ারি। লিখেছেন পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা আমিদী ফ্লোরেন্সঃ
বারজাক মিশন
(বিশেষ সংবাদদাতা প্রেরিত)
ডিসেম্বর ১। জঙ্গল। আগেই জানিয়েছি, আজ ভোর ছটায় যাত্রা শুরু করবে বারজাক মিশন। মিশনের আটজন সদস্য ছাড়াও আমাদের সঙ্গে আছেন দুজন স্বেচ্ছা অভিযাত্রী। এদের মধ্যে একজন ইংল্যান্ডে শিক্ষিতা সুন্দরী ফরাসী তরুণী মিস জেনব্লেজন। অন্যজন তার মামা (বোনপোও ডাকে মাঝে মাঝে, বড় গোলমেলে সম্পর্ক—ঠিক রাখতে পারছি না) এজনর দ্য সেন্ট বেরেন। মাথায় ছিট আছে ভদ্রলোকের, কিন্তু দারুণ ভাল মানুষ আর হাসিখুশি। আশা করছি যাত্রাপথে আমাদের আনন্দেই রাখবেন তিনি।
দুজন নিগ্রো চাকর এনেছেন তারা সঙ্গে, গাইডের কাজ করবে। আর দোভাষীর কাজটা বেশ ভালমতই চালাতে পারবেন মামা-ভাগ্নী। বামবারা আর স্থানীয় অনেক ভাষাই নিখুঁত বলতে পারেন দুজনে। এই তো, আজই সকালে, আমাকে দেখে গুড মর্নিং না বলে ইনিতি বলেছেন মিস ব্লেজন। শুনে শুনে ভাষাটা শিখে ফেলার চেষ্টা করছেন মঁসিয়ে বারজাক। কিন্তু তার মুখে কেমন যেন হাস্যকর ঠেকে ভাষাটা।
ভোর সাড়ে পাঁচটা। রেসিডেন্সির সামনের চত্বরে জড়ো হলাম আমরা।
সৈন্য দেখিয়ে জঙলীদের ভড়কে দেয়ার ইচ্ছে নেই মসিয়ে বারজাকের। মিস ব্লেজনও এসবের পক্ষপাতী নন। দুজনেই চান শান্তির বাণী বয়ে নিয়ে যেতে, হাতে তাদের শান্তির অলিভশাখা। ওদিকে বেঁকে বসেছেন মিশনের ডেপুটি চীফ মসিয়ে বদ্রিয়াস। গভর্নরও তার দলে। তারা চান, সৈন্য সঙ্গে থাকতেই হবে। নইলে ফরাসী সরকারের মান থাকে না। তাছাড়া বছর দশেক ধরেই, বিশেষ করে নাইজার অঞ্চল থেকে রহস্যময় সব অভ্যুথানের খবর আসছে। লুটতরাজ, খুন-জখম অবাধে চালাচ্ছে ডাকাতের দল। গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে লোকে। কাজেই অভিযাত্রী দলের সঙ্গে সৈন্য থাকা একান্ত দরকার।
সুতরাং দুশো সৈন্য নিয়ে আমাদেরকে পাহারা দেবেন ক্যাপ্টেন মারসিনে। ব্যবস্থা করলেন গভর্নর। এতে দারুণ খুশি হয়েছেন বদ্রিয়াস। অন্যদিকে বারজাকের মুখ গোমড়া।
আমাদের পথপ্রদর্শক একজন নিগ্রো। এককালে সেনাবাহিনীতে নেটিভ অফিসার ছিল। মলিন ইউনিফর্মটা ফেলে দিতে পারেনি চাকরি ছাড়ার পরেও, রেখে দিয়েছে। বিশেষ কোন অনুষ্ঠান কিংবা কাজ পড়লেই পরে ওটা। মাথায় সুতোর টুপি। সামনে বসানো পালকগুলো ঝরে গেছে অনেক আগেই। বুটজোড়া নিশ্চয়ই নষ্ট হয়ে গেছে। হাতে একটা কাঠের গদা। আগে অধীনস্থ সৈন্যদের পেটাত, এখন আর সৈন্য পাবে কোথায়, এখন গদা পড়বে কুলি-কামিনদের পিঠে। বেয়াড়াপনা করলে ঘোড়াগুলোও রেহাই পাবে না। লোকটার নাম মোরিলিরে।
মজার ব্যাপার, মিস্ ব্লেজনের একেবারে সঙ্গে সঙ্গেই আছেন মসিয়ে বারজাক আর ক্যাপ্টেন মারসিনে তাঁর সুখ-সুবিধের দিকে নজর রাখছেন। এই নিয়ে দলপতি আর সেনাপতির মধ্যে মন কষাকষি শুরু হলো বলে।
ওদিকে মসিয়ে বদ্রিয়াসের ব্যাপারটা একেবারেই উল্টো। মহিলাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না তিনি। মুখ কালো করে প্রথম দলের অগ্রভাগে বসে আছেন। তার ঠিক পেছনেই ড. চাতোন্নে। ভূগোল বিশারদ আছেন ডাক্তারের পাশেই। মানবজাতির ভবিষ্যৎ সমন্ধে তুমুল তর্ক জুরে দেবার তালে আছেন ডাক্তারের সঙ্গে। ভৌগলিক কারণেই যে এই অতি উন্নত জাতিটার পতন অবশ্যম্ভাবী তা বোঝাতে চাইছেন। হাঁ-হুঁ করে সেরে দিচ্ছেন ডাক্তার।
এঁদের পেছনে আছে বিশাল কনভয়টা। পঞ্চাশটা গাধা, পঁচিশটা ঘোড়া -এর মধ্যে দশটা ঘোড়া এনেছেন মিস ব্লেজন। দুপাশে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেনের অশ্বারোহী বাহিনী। এ রকম অবস্থানে থেকেই অভিযাত্রীদের পাহাড়া দিয়ে এগোবে। সবাইকে ঘিরে টহল দিয়ে আমি, খবরের সন্ধানে। কে কখন আবার কি মূল্যবান কথাটা বলে ফেলেন আমার অজান্তে, তাই খুব ব্যস্ত রেখেছি নিজেকে।
সবার পেছনে রয়েছে মিস ব্লেজন দুই চাকর, টোনগানে আর চৌমৌকি।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবাই। কাটায় কাটায় ছটায় যাত্রা সংকেত হলো তোপধ্বনির মাধ্যমে। এত বড় একটা অভিযানে চলেছে ফরাসী সরকারের প্রতিনিধিরা, তোপধ্বনি না করলে মান থাকে? তিনরঙা পতাকা উত্তোলিত হলো রেসিডেন্সির ছাদে। সেই সঙ্গে ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা আর অন্যান্য পতাকাও উত্তোলিত হয়ে তির তির করে কাঁপতে লাগল বাতাসে।
জমকালো পোশাক পরে রেসিডেন্সির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিদায় অভিনন্দন, জানালেন গভর্নর। টুপি তুলে অভিনন্দনের উত্তর নিলাম আমরা। প্রত্যাভিবাদন জানালাম। গুরুগম্ভীর নাদে বেজে উঠল সেনাবাহিনীর ড্রাম আর বিউগল। বললে হয়তো হাসবেন, চোখে পানিই এসে গেল আমার।
এমন সময় হঠাৎ সবার টনক নড়ল।
আরে! সেন্ট বেরেন কোথায়? তাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম সবাই।
কিন্তু আশ্চর্য! বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন মিস ব্লেজন। বরং উল্টো চটে গেছেন। বললেন, আমি দেখছি, আমার পাশে এসে বললেন, একটু আমার সঙ্গে আসবেন, মসিয়ে ফ্লোরেন্স?
গেলাম। ঘোড়ায় চড়েই। উনিও ঘোড়ায় চেপেই চললেন। অন্য কোনদিকে না গিয়ে সোজা সাগর-তীরের দিকে চললেন। গিয়ে দেখি ঠিকই। বালির ওপরে আরাম করে বসে আছেন মসিয়ে এজনর দ্য সেন্ট বেরেন। সরকারী অভিযানের তিনিও যে একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি তার অবস্থা দেখে আদৌ বোঝার উপায় নেই। একজন নিগ্রোর সঙ্গে জোর তর্ক চলছে তাঁর, তর্কের বিষয়বস্তু, কয়েকটা নতুন ধরনের বড়শি। আমরা পৌছানোর আগেই তর্কে হেরে গেছেন তিনি! তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। নিগ্রোটার সঙ্গে নৌকায় চেপে কোথাও যাবেন-হয়তো মাছ ধরতেই। আমরা আসতে আর সামান্য দেরি করলেই চলে গিয়েছিলেন তিনি।
কড়া গলায় ধমক দিলেন মিস ব্লেজন, এ-জ-ন-র!
চমকে ফিরে চাইলেন সেন্ট বেরেন। খালার রাগত চেহারা দেখে থতমত খেয়ে গেলেন। হঠাৎই মনে পড়ে গেল অভিযানে তাকেও যেতে হবে। দ্রুত বড়শিগুলো ঝোলা শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একমুঠো খুচরো পয়সা বের করে নিগ্রোটার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। তারপরই ছুটলেন রেসিডেপির দিকে আমাদের দিকে যেন আর খেয়ালই নেই তার। পেছন থেকে হেসে ফেললেন মিসব্লেজন, পাগল! আমিও হাসলাম।
ঘোড়া ছোটালেন মিস ব্লেজন। আমিও চললাম। বেরেনের পাশে এসে বললেন, অত জোরে ছুটছ কেন, মামা, ঘেমে যাবে যে!
একবার বোনপো সম্পর্ক হিসেবে ধমকাচ্ছেন, একবার মামা ডাকছেন। নাহ, মাথাটা খারাপই হয়ে যাবে আমার।
সেন্ট বেরেনকে ওভাবে উর্ধশ্বাসে ছুটে আসতে দেখে দলের সবাই হেসে ফেলল। অত যে রাশভারী বদ্রিয়াস তিনিও মুখ টিপে না হেসে থাকতে পারলেন না। অবশ্য দেখল না কেউ, অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন মুখ সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু অত হাসাহাসির কোন কিছুই খেয়াল করলেন না সেন্ট বেরেন। নিতান্ত নিরীহ গলায় মঁসিয়ে বারজাককে বললেন, ইস, দেরি করিয়ে দিলাম আপনাদের।
হো হো করে আরেক প্রস্থ হাসির ধূম পড়ল। এবারে নিজেও হেসে ফেললেন সেন্ট বেরেন। সত্যিই, অমন লোককে পছন্দ না করে পারা যায় না।
আরেক ফ্যাসাদ বাঁধালেন ঘোড়ায় ওঠার আগে বেরেন। হেঁট হয়ে জিন পরীক্ষা করতে গিয়ে পিঠে চোঙায় রাখা ছিপের খোঁচা লাগালেন পাশের এক গাধার পেটে। আচমকা বিচ্ছিরি খোঁচা খেয়ে ভড়কে গেল গাধাটা; লাফিয়ে হটতে গিয়ে পেছনের পায়ের লাথি লাগাল বেরেনের পায়ে, ছিটকে পড়ে গেলেন তিনি।
তাকে টেনে তোলার জন্যে হৈ হৈ করে এগিয়ে গেলাম আমরা কয়েকজন। কিন্তু তার আগেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বেরেন। পায়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে আগে ছিপ পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন, ভেঙে-টেঙে গেল কিনা। নাহ, ভাঙেনি। নিশ্চিন্ত হলেন বেরেন।
মুখ টিপে হাসল টোনগানে। বলল, কপাল ভাল আমাদের। রওনা দেবার আগে বোলতায় কামড়ালে কিংবা গাধায় লাথি মারলে শুভযাত্রা।
কোন উত্তর দিলেন না সেন্ট বেরেন। টোনগানের কথা যেন শোনেননি, এমনিভাবে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলেন।
সূর্য উঠেছে। গাছপালার মাথায় আর সামনের রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে সোনালী রোদ। বোঝাই যাচ্ছে, বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। আবহাওয়া ভাল থাকবে।
যাত্রা শুরু হলো আমাদের। একটা ছোট নদী পার হলাম বেলা দশটা নাগাদ। এই অঞ্চলে নদীর কোন সীমা-সংখ্যা নেই। রোজই দুটো একটা নদী পড়বে পথে। সুতরাং বার বার নদী পার হবার কথা বলে বিরক্ত করব না।
কোনাক্রি থেকে সোজা সড়ক ধরে চলেছি। পথের পাশে পাহাড়ের ঢালে ঢালে জঙ্গল পরিষ্কার করে ভুট্টাকলা আর তুলোর চাষ করা হয়েছে। আশে পাশে অসংখ্য গ্রাম। ইচ্ছেমত গ্রামগুলোর নামকরণ করে চলেছেন মঁসিয়ে তাসিন।
এই সকাল বেলাতেই বেশ গরম লাগছে। যাত্রা করে এ পর্যন্ত মাইল বারো পথ এসেছি। ঠিক হলো, একনাগাড়ে চলব আময়া। খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হবে চলা। পরিশ্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত এগিয়েই যাব, রাত যত হয় হবে। এভাবে চলবে রোজ।
দুপুর নাগাদ ছোটখাট এক বনের ধারে এসে দাঁড়ালাম। এবারে থামব। মনোরম পরিবেশ। বিশ্রামের জন্যে চমৎকার জায়গা। এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল সৈন্যরা। গাছপালায় ঘেরা ছোট্ট একটু খোলামত জায়গায় চলে এলাম আমি, মিস ব্লেজন, সেন্ট বেরেন আর ক্যাপ্টেন এবং আমাদের দেখাদেখি দলের অনেকেই।
ঘোড়ার পিঠ থেকে একটা গদি নিয়ে মাটিতে পেতে দিলাম, মিস ব্লেজনের বসার জন্যে। ওদিকে ছোট ছোট দুটো টুল এনে হাজির করেছেন ক্যাপ্টেন আর বারজাক। বিপদে পড়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। কার পেতে দেয়া আসনে বসে কাকে অসন্তুষ্ট করবেন। শেষ পর্যন্ত আমার পেতে দেয়া গদিতেই বসে পড়লেন। বললেন, আপনারা দুজন কিছু মনে করবেন না। এতক্ষণ ঘোড়ার পিঠে থেকে থেকে শরীরে ব্যাথা হয়ে গেছে। মাটিতে, এই গদিতে হাত-পা ছড়িয়ে একটু আরাম করে বসতে পারব।
ক্যাপ্টেন আর বারজাক চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। শেষে আমার দিকে এমন ভাবে চাইলেন যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেবেন।
পা ছড়িয়ে ঘাসের ওপর বসলেন মসিয়ে বদ্রিয়ার্স, কুইরো, হেইরো আর পসি। শেষের তিন ব্যক্তি নির্দলীয়। সঙ্গে আসার হুকুম হয়েছে, এসেছেন। রওনা হওয়ার পর থেকে ফাঁক পেলেই খাতায় কি সব লিখছেন মঁসিয়ে পসি। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে আমার, লোকটা হয় অসাধারণ মেধাবী, নয়তো অকাট মূর্খ। এখন কোনটা যে তা আল্লাই জানেন। অপেক্ষা করা যাক, হয়তো আমিও জানতে পারব।
সারাক্ষণই জোড় বেঁধে আছেন ডক্টর চাতোন্নে আর মঁসিয়ে তাসিন। এখন বসেছেন একটা ডুমুর গাছের ছায়ায়। বসেই ম্যাপ বিছিয়েছেন তাসিন। দুজনেরই খাওয়া চুলোয় গেল, এতই তন্ময় হয়ে পড়লেন ম্যাপ নিয়ে।
আবার কোথায় গায়েব হয়ে গেছেন সেন্ট বেরেন। ওঁর ছায়াও নজরে পড়ছে না।
আগুন জেলে রান্নার আয়োজন করছে গাইড মোরিলিরে, তার সঙ্গে হাত লাগিয়েছে চৌমৌকি আর টোনগানে।
এগিয়ে গেলাম। কি খাওয়া হবে এ বেলা জানতে চাইলাম। কোনাক্রি থেকে আনা মাংস দেখাল আমাকে মোরিলিরে, হাসল। বলল, দারুণ জিনিস, মসিয়ে ? ভেড়াটা একদম কচি।
দেখেশুনে এ বেলার খাওয়াটা ভালই হবে মনে হলো। মাখন দিয়ে ভাজা ভেড়ার মাংস, ভুট্টার কেক, বন থেকে জোগাড় করা ডুমুর, কলা, নারকেল। সবশেষে তালের রস গ্যাঁজান তাড়ি, অবশ্যই ঝর্নার ঠান্ডা, পরিষ্কার পানি মেশানো। নইলে এই ভর দুপুরে মাতলামি শুরু করবে সবাই।
এই সময় আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন ডক্টর চাতোন্নে। মাখনটা দেখে খুশি হলেন খুব। এতক্ষণে জানলাম যে, গরুর দুধ থেকে নয়, এটা তৈরি হয়েছে একজাতের গাছের ফল থেকে। এই গাছের দুই নামঃ কেউ বলে সি, কেউ বলে ক্যারাইট।
ডাক্তারের কথা শুনছি, হঠাৎ কে যেন প্ৰাণপণ চিৎকার করে উঠল।
বিন্দুমাত্র দেরি না করে ছুটলাম শব্দ লক্ষ্য করে! আগে আমি, পেছনে ক্যাপ্টেন আর বারজাক। বনের প্রান্তে একটা ছোট্ট ডোবার ধারে পৌঁছে দেখলাম, কাদাপানিতে কোমর ডুবিয়ে দাড়িয়ে আছেন সেন্ট বেরেন।
ভয় পেয়ে গেলাম। নিশ্চয়ই চোরাকাদা। ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ক্যাপ্টেন, জলদি একটা দড়ির ব্যবস্থা করুন। চোরাকাদায় পড়েছেন উনি।
আরে না, না। চোরাকাদা নয়। এমনি কাদা, তবে সাংঘাতিক আঠালো। পা তুলতে পারছি না। পিছলে পড়ে গেছি।
কি করছিলেন এখানে?
মাছ ধরছিলাম।
ছিপ, ছিপটা কোথায়?
ছিপ কেন! অবাক হলেন যেন বেরেন, হাত দিয়েই তো ধরা যায় এই কাদায়।
তা পেয়েছেন?
মাছ না, তবে তোফা জিনিস পেয়েছি, বলে প্যান্টের ভেতরে নিচের দিক ঢুকিয়ে দেয়া জ্যাকেটটা দেখালেন, এর ভেতরে আছে।
কি আছে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
আরে, সাহেব, আছে, আছে, রহস্যটা ভাঙলেন না সেন্ট বেরেন। দেখলেই জিভে পানি এসে যাবে। কিন্তু আগে তুলুন তো আমাকে।
তিনজনে মিলে টেনেহিঁচড়ে কোনমতে বেরেনকে ডোবা থেকে তুলে আনলাম।
আরে বেশি টানাটানি করবেন না। জ্যাকেটের ভেতর থেকে ব্যাটারা পালাবে যে! হাঁ হাঁ করে উঠলেন সেন্ট বেরেন।
আরে কোন ব্যাটারা পালাবে, বলবেন তো? অধৈর্য হয়ে উঠলাম আমি।
ব্যাঙ, সাহেব, ব্যাঙ।
বুঝুন কান্ড। রোদে গরমে অস্থির হয়ে এসে হাত-পা ছড়িয়ে জিরিয়ে কুল পাচ্ছি না আমরা, আর বেরেন কাদার মধ্যে মাছ ধরতে এসে মাছ না পেয়ে ব্যাঙ ধরছেন, আবার লোভ দেখাচ্ছেন যে দেখলে নাকি আমাদের জিভে পানি এসে যাবে।
তা, ভাল করেছেন। ভেরি গুড, বললেন বারজাক, খাইনি কখনও, তবে ব্যাঙের মাংস খেতে ভালই শুনেছি। কিন্তু যে রকম চেঁচাচ্ছে ওগুলো, খাদ্য হবার ইচ্ছে আছে বলে মোটেই মনে হচ্ছে না।
হবে, হবে, না হয়ে যাবে কোথায়?
কেটেকুটে নিজেই ব্যাঙের রোস্ট বানালেন সেন্ট বেরেন। সত্যিই চমৎকার লাগল খেতে। সবাই তারিফ করল মাংস আর রান্নার।
সবশেষে কফি খেয়ে ঘাসের ওপরই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল অভিযাত্রীরা। মেয়েমানুষ, সবার সামনে তো আর শুতে পারেন না মিস ব্লেজন, খানিক দূরে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে শুলেন।
বিকেল পাঁচটায় আবার রওনা হবার কথা। কিন্তু রোজি করানো গেল না কুলিদের। আজব সমস্যা। চাঁদ ওঠার আগে। রওনা দেবে না ওরা, অমঙ্গল নাকি হয়।
কুলিদের সঙ্গে সায় দিয়ে বললেন মঁসিয়ে তাসিন, ঠিকই বলছে কুলিরা। আমাদের আগের অনেক আফ্রিকা- অভিযাত্রীই এ বিষয়ে লিখে গেছেন। সত্যিই নাকি অমঙ্গল হয়।
এতে আরও পেয়ে বসল কুলিরা। যারা এতক্ষণ নিমরাজি ছিল, তারাও একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে বসল। কয়েকজন তো শুয়েই পড়ল আরও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেবার জন্যে।
বোকার হদ্দগুলোর জন্যে পুরো দুটো ঘন্টা খামোকা নষ্ট হলো আমাদের।
এক সময় চাঁদ উঠল। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল কুলির দল। আবার চলা শুরু হলো আমাদের।
আরেকটা জঙ্গলের ধারে এসে পৌঁছলাম রাত নটা নাগাদ। জঙ্গলে ঢোকার পথেই একটা কুঁড়েঘর। ভেতরে উঁকি মেরে দেখলেন ক্যাপ্টেন। খালি কুঁড়ে। মিস ব্লেজনের রাত কাটাতে সুবিধে হবে বলে এখানেই থামার প্রস্তাব করলেন ক্যাপ্টেন। সবাই রাজি হলো।
তাঁবু ফেলা হলো। রাতের খাবারের পর শোবার পালা। যার যার তাঁবুতে গিয়ে শুয়ে পড়লেন অভিযাত্রীরা। মিস ব্লেজন গেলেন কুঁড়েঘরে। ক্যাপ্টেন আর সৈনিকেরা পালা করে রইল পাহারায়।
দশ মিনিটও পেরোয়নি, হঠাৎ কুঁড়েঘরের ভেতর থেকে তীক্ষ চিৎকার শোনা গেল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। তাঁবু থেকে বেরিয়েই ছুটলাম সেদিকে। আমার আগেই ঘরের দরজার কাছে চলে গেছেন ক্যাপ্টেন। ভেতরে ঢুকে দেখলাম এককোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাপছেন মিস ব্লেজন। তাঁর মুখে আতঙ্ক।
কি হয়েছে, আমরা জিজ্ঞেস করতেই আঙুল দিয়ে মেঝের দিকে নির্দেশ করলেন। দেখলাম এক ধরনের কুৎসিত সাদা পোকা শয়ে শয়ে কিলবিল করছে। মাটিতে অসংখ্য গর্ত। গর্তের ভেতর থেকেই বেরিয়ে এসেছে পোকাগুলো। মিস ব্লেজনের দোষ দেব কি, দেখে আমারই গা ঘিনঘিন করে উঠল। শিউরে উঠলাম নিজের অজান্তেই।
অন্যদের সঙ্গে টোনগানেও এসে দাঁড়িয়েছে কুঁড়ের ভেতরে। কিন্তু পোকাগুলোকে দেখে তার সে কি আনন্দ! আমরা তার অত খুশির কারণ জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, খুশি হব না! এমন দারুণ জিনিস সব সময় জোটে নাকি? ওগুলো মচমচে কবে ভাজলে খেতে যা লাগে না? বলেই বেরিয়ে গেল সে। বোধহয় পোকাগুলোকে তুলে নেবার জন্যে ঝুড়িটুড়ি কিছু আনতে।
ওয়াক, ওয়াক করে বমি করে ফেললেন মিস ব্লেজন, টোনগানের কথা শুনেই আমারও অবস্থা বিশেষ ভাল নয়।
এরপর আর ওই ঘরে মিস ব্লেজনের থাকা চলে না। নতুন তাঁবু খাটাতে হবে। বেরিয়ে এলাম।
নতুন তাঁবু খাটানোর কথা শুনেই প্রস্তাব করল গাইড মোরিলিরে; কাছেই, বড়জোর পঞ্চাশ গজ দূরে, একটা গ্রাম আছে, সেখানে এক নিগ্রো চাষা তার চেনা। লোকটার বৌয়ের কুঁড়েঘরে ইচ্ছে করলে থাকতে পারেন মিস ব্লেজন। বললেই ঘর ছেড়ে দেবে নিগ্রো-বৌ, কিন্তু কিছু পয়সা দিতে হবে।
কি ভেবে রাজি হয়ে গেলেন মিস ব্লেজন। আসলে বোধহয় তাঁবুতে থাকতে ভাল লাগছিল না তার।
দল বেঁধে মিস জেন ব্লেজনকে এগিয়ে দিতে গেলাম। কোথায়, কেমন জায়গায় থাকতে যাচ্ছেন তিনি, সেটাও আমাদের দেখা কর্তব্য।
বৌটার বয়েস মাত্র বছর পনেরো হবে। মোরিলিরের ডাক শুনে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। ছোট্ট এক টুকরো কাপড় পেঁচিয়ে রেখেছে শুধু কোমরে।
আমাদের দেখেই হাঁসল মেয়েটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরিষ্কার ফরাসী ভাষায় অভ্যর্থনা জানাল। ভাষা কোথায় শিখল জিজ্ঞেস করতেই বলল, এক ফরাসী সাহেবের বাড়িতে অনেক দিন ঝি-গিরি করেছি। ওই সাহেবই আমাকে স্কুলে কয়েক ক্লাস পড়িয়েছিলেন।
মিস জেনের থাকার ব্যবস্থা হবে কিনা মোরিলিরে ওকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, হবে, নিশ্চয়ই হবে। আর বিছানা কি করে পাততে হয়, আমি ভাল করেই জানি। আপনার কোন অসুবিধে হবে না, মা। আসুন
মিস ব্রেজনের হাত ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল বৌটা। আমরাও সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে এলাম।
কিন্তু আধঘণ্টা যেতে না যেতেই মিস ব্লেজনের তীক্ষ্ম চিৎকার শোনা গেল আবার। ক্যাপ্টেনকে ডাকছেন। ক্যাপ্টেন মারসিনে জলদি আসুন! আ-সু-ন!
আবার ছুটলাম। এবারেও আমাদের আগেই পৌঁছে গেছেন ক্যাপ্টেন। ঘরের দরজায় ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন মিস ব্লেজন।
আমরা কাছে যেতেই আঙুল দিয়ে ঘরের ভেতরে নির্দেশ করলেন। উঁকি দিলাম। এক বীভৎস দৃশ্য। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে কাতরাচ্ছে নিগ্রো মেয়েটা। তার সারা পিঠ রক্তাক্ত। পাশে দাঁড়িয়ে এক ভয়ঙ্কর চেহারার নিগ্রো। হাতে লিকলিকে একটা বেত। টকটকে লাল চোখ তুলে চাইল আমাদের দিকে, হাতের বেতটা বাতাসে নাচাল।
ফিরে মিস ব্লেজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি? খেপেছে কেন নিগ্রো দানব?
বিছানা পেতে দিয়েছে মালিক, হাত তুলে নিগ্রো মেয়েটাকে দেখালেন মিস ব্লেজন। সবে শুয়েছি, ঘুমও এসেছে, এমন সময় কোথেকে ঘুরে এসে ঢুকল দানবটা। হাত ধরে টান মেরে মেয়েটাকে বিছানা থেকে তুলেই কিলঘুসি মারতে আরম্ভ করল। তারপর মাচা থেকে ওই বেতটা পেড়ে নিয়ে সমানে চাবকাতে শুরু করল ওকে।
বদ্রিয়ার্স আর বারজাকও এসে দাঁড়িয়েছেন। বারজাকের দিকে চেয়ে মুখ বাঁকালেন বদ্রিয়াস। বললেন, এই অসভ্যগুলোকেই ভোটাধিকার দিতে চাইছেন আপনি!
বদ্রিয়াসের কথায় মোটেই দমে গেলেন না বারজাক। পাস্টা জবাব দিলেন, বৌ ঠেঙালেই লোক অসভ্য হয়ে যায় নাকি? ফরাসীরা যে এত সভ্য। তারাও তো বৌ পেটায়।
বলেই নিগ্রোটার দিকে ফিরে ধমক লাগালেন বারজাক, এই হতভাগা? মেয়েটাকে অমন বেধড়ক পেটাচ্ছিস কেন? ভাল চাস তো, থাম। নইলে পিটিয়ে তক্তা করে দেব।
কিন্তু মোটেই ভয় পেল না নিগ্ৰো। দাঁত খিচিয়ে বলল, থামব, তোমার কথায়? ও আমার বৌ নয়, বাঁদী, বাঁদী। উচিত দামের চেয়ে বেশি দিয়ে কিনেছি। ওকে খাটানোর কিংবা পেটানোর পুরো অধিকার আমার আছে। তুমি কথা বলতে আসার কে, শুনি?
অমন পাল্টা আক্রমণ আশা করেননি বারজাক। একটু দমে গেলেন। কিন্তু পরমুহুর্তেই মনস্থির করে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে, মালিককে কিনব আমরা। কত চাস?
একটা গাধা, বন্দুক একটা, আর পঞ্চাশ ফ্রাঁ।
হারামজাদা রাজ্য বিক্রি করছিস নাকি? এবারে কথা বললেন ক্যাপ্টেন। হাতের মিলিটারি বেতটা দোলাতে দোলাতে এগিয়ে এলেন, বেশি তেড়িমেড়ি করলে পিটিয়ে ভূত ভাগাব। তারপর ধরে নিয়ে গিয়ে ঝোলাব ফাঁসিতে।
ভয় পেয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত দর কমাতে রাজি হলো নিগ্রো দানব। রফা হলো, মান্ধাতার আমলের একটা গাদা বন্দুক, এক টুকরো কাপড় আর বিশ ফ্রাঁয়ের বিনিময়ে বেঁচে দেবে মালিককে।
ওদিকে কথাবার্তা চলাকালীনই মালিকের শুশ্ৰষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মিস ব্লেজন। ক্যারাইট মাখন ঘসে দিয়েছেন ইতোমধ্যেই ওর পিঠে। বাদী হাত বদল হয়ে গেলে তাকে তুলে তাঁবুতে নিয়ে এসে কিছু টাকা আর কাপড় দিয়ে বারজাক বললেন, যা, আজ থেকে তুই মুক্ত।
কেঁদে ফেলল মালিক, তাঁবু থেকে বেরোবার নামও করল না। বরং মিস ব্লেজনের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, কোথায় যাব, মা? আবার কেউ ধরে নিয়ে গিয়ে বাঁদীই বানাবে। ওই শয়তানগুলোর বাঁদী হওয়ার চেয়ে আপনার কাছে থাকা অনেক ভাল। দয়া করে আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না।
মেয়েটার কাকুতি মিনতিতে গলে গেলেন সেন্ট বেরেন। ভাগ্নীকে বললেন, কি আর করা. রেখে দে। কাজে লাগবে।
থাক তাহলে, বললেন মিস ব্লেজন।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সেন্ট বেরেনকে জড়িয়ে ধরল মালিক। চপাচপ কয়েকটা চুমো খেয়ে ফেলল বেরেনের দুই গালে।
আরে করিস কি, করিস কি, ছাড় ছাড়! বলে জোর করে মালিককে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দরজার দিকে ছুটলেন বেরেন। বার বার পেছনে ফিরে চাইছেন। আবারও আসছে কিনা মালিক। কৃতজ্ঞতা স্বীকারের এই অভূত রীতি দেখে রীতিমত ভড়কে গেছেন তিনি।
কান্ডটা আমরা দেখছিলাম। হাসির হুল্লোড় উঠল।
মালিককে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন মিস ব্লেজন। তার জন্যে তাঁবু খাটানোর হুকুম দিলেন ভৃত্যদের। দরকার হলে বাইরে রাত কাটাবেন, তবু আর কোন কুঁড়েতে থাকবেন না তিনি, আমাদের সামনেই শপথ নিলেন।
প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা এখানেই শেষ। – আমিদী ফ্লোরেন্স
আগের পর্ব:
০১. শহরের সবকটা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায়
০২. ফেঞ্চগিনির রাজধানী মানে কোনাক্রি অঞ্চলে
০৩. দেহমন দুইই ভেঙে পড়েছে বৃদ্ধ লর্ডব্লেজনের
পরের পর্ব :
০৫. বারজাক মিশন
০৬. লা এক্সপ্যানসন ফ্রাঁসে পত্রিকায়
০৭. আমিদী ফ্লোরেন্সের নোট বই থেকে
০৮. সিকাসো থেকে রওনা দেবার পর
০৯. পাহারাদারদের জিজ্ঞেস করে
১০. পরিষ্কার বুঝতে পারছি বিপদে পড়েছি
১১. স্তব্ধ হয়ে বসে রইল বারজাক মিশনের সদস্যরা
১২. কাদৌ গ্রামের মোড়লের সাহায্যে