ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

ডক্টরের সেবা শুশ্রুষায় সংজ্ঞাহীন ক্যাপ্টেনের জ্ঞান ফিরে এল। কিন্তু এ কি দশা হয়েছে তার? ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে সবাই যেন হতবাক হয়ে গেছে! জ্ঞান ফিরে পেয়ে অবোধ শিশুর মত বোকা চোখে তাকিয়ে আছেন হ্যাটেরাস। নিষ্পলক চোখ। যেন সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। ক্যাপ্টেনের চোখে চোখ রাখলেন ডক্টর। কিন্তু ডক্টরের উপস্থিতি তিনি টের পেলেন বলে মনে হল না। ক্যাপ্টেন অন্ধ হয়ে গেলেন কিনা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়ল জনসন। ডক্টর তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ক্যাপ্টেন অন্ধ হননি ঠিকই তবে তারচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে তাঁর। হ্যাটেরাস মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। চেতনা শক্তি লোপ পেয়েছে তাঁর। ক্যাপ্টেন পাগল হয়ে গেছেন! একদম পাগল! ডক্টর নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না। শিশুর মত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তারই সবচেয়ে বেশি হৃদ্যতা ছিল। এতদিনের অভিযানে বন্ধুত্ব আরও নিবিড় হয়েছিল। বন্ধুর এই দুঃখজনক পরিণতি কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারছেন না।

ডক্টর ক্লবোনি কাজের মানুষ। বন্ধুর দুঃখে মন ভেঙে পড়লেও ভাবাবেগে চলার লোক তিনি নন। ক্যাপ্টেনকে ধরে ধরে সবাইকে নিয়ে পাহাড় থেকে নিচে নামা শুরু করলেন তিনি। প্রায় তিন ঘণ্টা লেগে গেল নিচে পৌঁছতে। পাহাড়ের পাদদেশে নেমে বিশ্রাম নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা স্থির করলেন ডক্টর। রাতটা কোনমতে এখানে কাটিয়ে দিয়ে কাল ভোরে রওনা হবেন দৈব-দুর্গের পথে। শীতকালটা দৈব-দুর্গে কাটিয়ে গরম পড়তে শুরু করলেই ইংল্যান্ডের পথে রওনা হওয়া যাবে।

পরদিন অর্থাৎ ১৩ জুলাই খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠল অভিযাত্রীরা। মাউন্ট হ্যাটেরাস ছেড়ে যাবার আগে, যেখানে ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন, সেখানে একটি স্তম্ভের মত তৈরি করে তাতে লেখা হল।

জন হ্যাটেরাস

১৮৬১

অর্থাৎ প্রথম মেরু বিজয়ীদের স্মৃতি। অভিযানের বিশদ বিবরণ একটা টিনের বাক্সে ভরে রেখে দেয়া হল সেই স্তুপের ভেতর। ভবিষ্যতে যদি কোন অভিযাত্রী দল এতদূর পৌঁছতে পারে তাহলে জানতে পারবে, তাদের আগেই ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস ও তার সঙ্গীরা এই অজেয়কে জয় করে গেছেন। জানতে পারবে, ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস শেষ পর্যন্ত পাগলই হয়ে গিয়েছিলেন এই অসাধ্য সাধন করতে গিয়ে।

আবার নৌকায় চড়ে যাত্রা শুরু হল। আবহাওয়া অনুকূলে হওয়ায় নৌকা তরতরিয়ে চলল। মাত্র দুদিনে অভিযাত্রীরা পৌঁছল আলটামন্ট বন্দরে। সেখান থেকে সমুদ্রের উপকূল ঘেঁষে সমুদ্রপথেই তারা রওনা হল দৈব-দুর্গের পথে। পালের অনুকূলে হাওয়া থাকায় পনেরো দিনের পথ মাত্র সাতদিনে পাড়ি দিল ওরা; পৌঁছল ভিক্টোরিয়া বে হয়ে দৈব-দুর্গে।

দৈব-দুর্গে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল এক দুঃসংবাদ। বরফ প্রাসাদ গলে মিশে গেছে! কোথায় ভাড়ার ঘর আর কোথায়ই বা বারুদঘর। সব গলে মিশে সমতল ভূমির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। খাবার-দাবার যা ছিল সব লুটেপুটে খেয়েছে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের দল। এখন উপায়! মহা দুশ্চিন্তায় পড়ল সবাই। দারুণ হতাশায় পেয়ে বসল সবাইকে। কিন্তু ডক্টর কখনই আশার হাল ছাড়েন না। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উচ্ছিষ্টের মধ্যে থেকে যেটুকু খাবার-দাবার তিনি উদ্ধার করলেন তা দিয়ে সপ্তাহ দুয়েক অনায়াসে চলে যাবে।

ডক্টর দেখলেন, আর দেরি না করে এখনই রওনা হয়ে পড়লে এই ছয় সপ্তাহে পৌঁছে যাওয়া যাবে বাফিন উপসাগরে। সেখান থেকে তিমি শিকারিদের জাহাজ বা অন্য কোন উপায়ে ডেনিশ উপনিবেশে পৌঁছানো যাবে।

আবার শুরু হল যাত্রা। শীতে বরফ জমা শুরু হবার আগেই পৌঁছতে হবে পরবর্তী লক্ষ্যে। তাই ডক্টরের হুকুমে দিনরাত একটানা ছুটে চলল নৌকা। বিশ্রামের জন্যে কোথাও নৌকা ভেড়ানো হল না। আরাম হারাম হয়ে গেল সবার। এত দ্রুতবেগে চলার পরেও দেখা গেল আস্তে আস্তে তাপমাত্রা কমে আসছে। এদিক-সেদিক ছোট ছোট হিমশিলা সাগরের বুক চিরে বারে বারে উঁকি দিচ্ছে। চলার পথ ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। বরফ ঠেলে চালাতে গিয়ে অসংখ্যবার ভাঙতে ভাঙতে বেঁচে গেল ওদের নৌকা। শেষ পর্যন্ত চারদিক থেকে হিমবাহ এমনভাবে পথ আটকে দিল যে নৌকা আটকে গেল বরফে। অগত্যা নিরুপায় অভিযাত্রীরা স্লেজে করে পথ পাড়ি দিতে লাগল। আস্তে আস্তে সবাই দুর্বল হয়ে পড়ছে। পেটে খাবার নেই। পথ চলার শক্তিও যেন ফুরিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে দুএকটা পাখি যা পাওয়া যাচ্ছে তাই মেরে কোনরকমে পেটের ক্ষুধা মিটাচ্ছে ওরা। এভাবে আর কদিনই বা চলে! একদিন সবাই এতই কাহিল হয়ে পড়ল যে উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলল, কিন্তু এর একমাত্র ব্যতিক্রম আলটামন্ট। অসম্ভব মনের জোরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন; তারপর ডাককে নিয়ে বের হলেন শিকারে।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আলটামন্টের যে মূর্তি দেখা গেল তা কেউ আশা করেনি। দুচোখে রাজ্যের ভয়, চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছেন ওদের দিকে। কাছে এসে ওদেরকে ডেকে নিয়ে আবার ছুটলেন-যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে।

কি ব্যাপার!

উত্তেজনায় সবাই দেহে কিছুটা শক্তি ফিরে পেল। ছুটে গেল ওরা আলটামন্টের পেছন পেছন। কিন্তু ওরা জানত না, ওদের জন্যে কি বীভৎস দৃশ্য অপেক্ষা করছে। সবাই দেখতে পেল, বরফে পড়ে আছে বেশ কয়েকটি লাশ। লাশগুলো চিনতে ডক্টর বা অন্য কারও বেশি কষ্ট হল না। এ লাশ শ্যানডন ও তার বিশ্বাসঘাতক সঙ্গীদের। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, মরবার আগে ওরা কামড়াকামড়ি করে একে অন্যের মাংস খেয়েছে। তবুও মৃত্যু এড়াতে পারেনি ওরা। একেই বোধহয় বলে ঈশ্বরের অমোঘ বিধান। বিশ্বাসঘাতকতার যোগ্য শাস্তি!

এর পরের দিনগুলো যে কি কল্পনাতীত দুঃখ কষ্টের মধ্যে কেটেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ডেভিন দ্বীপের প্রান্তে পৌঁছতে লেগে গেল সেপ্টেম্বরের নয় তারিখ। দুদিন আগে শেষ বারের মত খেয়েছে সবাই। কিন্তু কি খেয়েছে ওরা।

কিই বা আছে খাবার? শেষমেষ এস্কিমো কুকুরটাই ওদের আহারে পরিণত হল। একটা কুকুর এতজন ক্ষুধার্তের জন্যে কিছুই নয়। জনসন, বেল দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কেউই আর চলতে পারছে না।

মৃতপ্রায় অবস্থায় ওরা পড়ে রইল বাফিন উপসাগরের তীরে। অপেক্ষায় রইল যদি বা কোন তিমি শিকারের জাহাজ দেখতে পাওয়া যায়! প্রথমদিন কিছুই নজরে পড়ল না কারও। পরদিন দূরে দেখা গেল জাহাজের পাল। আশায় বুক বেঁধে সবাই ছুটল সমুদ্রের দিকে। অনেকভাবে চেষ্টা করল ওই জাহাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার, কিন্তু না; জাহাজের কেউই ওদের দেখতে পেল না। আস্তে আস্তে জাহাজ মিলিয়ে গেল দিগন্ত রেখায়।

হতাশায় একেবারে ভেঙে পড়ল সবাই। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু ডক্টর। আর একবার কেরামতি দেখালেন তিনি। একটা বড় হিমবাহে উঠলেন সবাইকে নিয়ে। স্লেজের তলা থেকে লোহার পাত খুলে নিয়ে মাস্তুলের মত গাঁথলেন হিমশালায়। তাঁবু ছিড়ে পাল বানালেন। বাতাসের ছোঁয়া লাগতেই পাল ফুলে উঠল। হিমশিলা ছুটে চলল নৌকার মত।

একটি ডেনিশ তিমি জাহাজ দেখতে পেল ওদের। জীবন্ত কঙ্কালের মত মানুষগুলো। নাবিকেরা তুলে নিল জাহাজে। সেবা-শুশ্রুষা করে ওদের দেহে শক্তি ফিরিয়ে দিল।

তেরোদিনে জাহাজ এসে পৌঁছল লন্ডনে। মেরু অভিযাত্রার ১৭ জনের আলটামন্টসহ ফিরে এল মাত্র পাঁচজন। অভিযাত্রীদের মনে এখন এক মিশ্র অনুভূতি। একটি আনন্দের আরেকটি দুঃখের।

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস আর ভাল হয়ে উঠলেন না; পাগলই রয়ে গেলেন। বাকশক্তিও আর ফিরে পেলেন না। চিকিৎসার জন্যে লিভারপুলের এক মানসিক হাসপাতালে তাকে ভর্তি করে দিলেন ডক্টর। কিন্তু এতেও কোন পরিবর্তন হল না।

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস প্রতিদিন ডাককে নিয়ে হেঁটে যান বিশেষ একদিকে। সেখানে গিয়ে দূরপানে চেয়ে থাকেন, আবার ফিরে আসেন। এই আসা-যাওয়ার কোন শেষ নেই। যেন অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে শান্তির খোঁজে।

পাঠক জানেন কি–কিসের পানে আজও হ্যাটেরাস চেয়ে থাকেন দূর-দিগন্তে?

আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত