২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
এত বড় বিজয়ের গৌরবে সবাই যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু জীবন্ত বিশ্বকোষ-জ্ঞানের ভান্ডার ডক্টর বোনি যেখানে থাকেন সেখানে চুপ করে বোবা হয়ে বসে থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
সবার নীরবতা ভঙ্গ করে ডক্টর বলে উঠলেন, জনসন, তুমি কি জান, এখানে তুমি একদম নড়ছ না?
জনসন ডক্টরের কথা ঠিক ধরতে পারল না। জ্বি! মানে আমি ঠিক বুঝলাম না, ডক্টর।
মানে তো খুবই সোজা। পৃথিবীর সঙ্গে পৃথিবীর লোকেরাও বনবন করে ঘুরছে। কিন্তু এ অংশ অর্থাৎ মেরুবিন্দু ঘুরছে না, তাই তুমিও স্থির থাকছ। দুই মেরুই সবসময় স্থির থাকে।
ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস রাশভারী বেরসিক হলেও মাঝে মাঝে গম্ভীরভাবে এমন দুএকটা কথা বলেন যা শুনে সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন বলে উঠলেন, কথাটা কিন্তু একেবারে ঠিক নয়, ডক্টর। আমরা অল্প হলেও নড়ছি বৈকি! কেননা মেরুবিন্দু আরও পৌনে এক মাইল দূরে। ওখানে গেলেই আর সত্যি নড়ব আমরা।
ওই একই কথা, হাসতে হাসতে বললেন ডক্টর।
এভাবেই নানা বিষয়ে গল্পগুজব করতে করতে রাত নেমে এল। খাবারের পাট চুকিয়ে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়ল অভিযাত্রীরা। চোখে ঘুম নেই শুধু ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের। সারারাত জেগে রইলেন তিনি। এত বড় অসাধ্য সাধন করে এখনও কেন জানি শান্ত হয়নি তাঁর মন। মূর্তির মত একদৃষ্টে তিনি তাকিয়ে রয়েছেন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের দিকে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সবাই অবাক হয়ে দেখল, ক্যাপ্টেন তাঁবুতে নেই। কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন? তাঁবু থেকে ছুটে বের হয়ে এল ওরা। দেখল, কিছুদূরে একটা পাথরের ওপর যন্ত্রপাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তিনি আগ্নেয়গিরির দিকে।
ডক্টর কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে ক্যাপ্টেনকে ডাকলেন। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই, যেন শুনতেই পাননি তিনি। এবার বেশ জোরে ডাকতেই ক্যাপ্টেনের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। দেখলেন ডক্টর, আলটামন্ট, বেল ও জনসন তার সামনে দাঁড়িয়ে। ওদের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন বলে উঠলেন, আপনারা আমার সঙ্গে যে সহযোগিতা আজ পর্যন্ত করে চলেছেন তার জন্যে আমি আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। মেরু বিজয়ের গৌরব শুধু আমার একার নয়, এ গৌরব আপনাদের সবার। এমনকি যারা বিশ্বাসঘাতকা করে মাঝপথে আমাদের ফেলে পালিয়ে গেছে তাদেরও। যদি তারা ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে পারে তাহলে আমি আমার প্রতিশ্রুতি মত তাদের পাওনা ঠিকই মিটিয়ে দেব। যার যা পাওনা তা সে পাবেই।
জনসন মুচকি হেসে ক্যাপ্টেনকে বলল, ক্যাপ্টেন, মনে হচ্ছে আপনি যেন উইল করে যাচ্ছেন!
হয়ত তাই।
কিন্তু আপনি তো এখন দিব্যি সুস্থ। মৃত্যু তো আর মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে। নেই, যে এখনই উইল করতে হবে?
কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারে সেকথা? একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টেনের এই উত্তরের পর কারও কিছু বলার রইল না। ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ক্যাপ্টেন যেন কিছু একটা ইঙ্গিত দিতে চাইছেন। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর ক্যাপ্টেন বললেন, আমরা মেরুদ্বীপে পা রাখলেও মেরুবিন্দু কিন্তু এখনও অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে।
মেরুদ্বীপ আর মেরুবিন্দু-সে তো একই কথা। বললেন আলটামন্ট। ডক্টরও তার কথায় সায় দিলেন।
না। মেরুদ্বীপ আর মেরুবিন্দু এক কথা নয়! রেগে গেলেন ক্যাপ্টেন।
মেরুবিন্দুতে প্রথম যে পতাকা উড়বে সেটা হবে বৃটিশ পতাকা। আর সেই পতাকা ওড়ানো হবে আমার হাত দিয়ে-এই সঙ্কল্প নিয়েই ইংল্যান্ড থেকে বের হয়েছি আমি। আমরা মেরুদ্বীপে পৌঁছলেও মেরুবিন্দু এখনও পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড দূরে। আমাকে পা রাখতেই হবে মেরুবিন্দুতে!
আপনি কি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পা রাখবেন? জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর।
আমি যাবই। উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস।।
ওখানে যাবেন কি করে? লাভাস্রোতের জন্যে ওই পাহাড়ে ওঠা যায় না। আলটামন্ট বললেন।
আমাকে যেতেই হবে।
কিন্তু জ্বালামুখ দিয়ে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে যে! ডক্টর তার শেষ অস্ত্র ছুঁড়ে দিলেন।
আমি যাবই যাব! গমগমে গলায় বলে উঠলেন ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টেনের জন্যে এখন কোন বাধাই আর নয়। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তিনি যাবেনই মেরুবিন্দুতে। মেরু বিজয়ের উম্মত্ততা যেন পেয়ে বসেছে ক্যাপ্টেনকে। ডক্টর এবং অন্যেরা অনেক বোঝালেন, কিন্তু তাঁর সেই একই কথা, আমাকে যেতেই হবে।
ডক্টর দেখলেন, এখন বাধা দিলে ক্যাপ্টেন মানবেন না, তাই অন্য ফন্দি বের করলেন তিনি। বললেন, আমরাও যাব আপনার সঙ্গে।
বেশ। মাঝপথ পর্যন্ত আপনারা যেতে পারেন। তারপর আর নয়। মেরু বিজয়ের সংবাদ নিয়ে আপনাদের ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হবে।
কারও আর বুঝতে বাকি রইল না ক্যাপ্টেন কি বোঝাতে চাইছেন। এ কেমন উন্মাদনায় পেয়ে বসল ক্যাপ্টেনকে! মৃত্যু অবধারিত জেনেও যেতে চাইছেন তিনি জ্বালামুখে!
ডক্টর বুঝলেন, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এখন আর কোন কথা বলে লাভ হবে না। তাই সবাইকে নিয়ে তিনি পাহাড়ে ওঠার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন।
কিছুক্ষণ পর অভিযাত্রীদের যাত্রা শুরু হল। এবার আর বরফ বা সমুদ্রে নয়। জীবন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত জ্বালামুখে; যেখান থেকে বেরুচ্ছে উত্তপ্ত লাভাস্রোত। দাউ দাউ করে থেকে থেকে জ্বলে উঠছে আগুনের হলকা।
প্রথমে ডাক, তারপর ক্যাপ্টেন এবং পেছনে অন্যরা। এভাবেই লাইনবদ্ধভাবে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগল অভিযাত্রীরা।
পাহাড়ে উঠতে ডক্টর বললেন, এই পাহাড় একদমই নতুন সৃষ্টি হয়েছে। ভূতাত্ত্বিকরা দেখলেই বলে দিতে পারতেন এটার বয়স কত। আলগা পাথর আর লাভাস্রোত জমে হয়েছে এই পাহাড়। কোথাও ঘাস কিংবা ছত্রাকের জন্ম হয়নি। কীট পতঙ্গও নেই কোথাও। জ্বালামুখ দিয়ে বের হওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে হাইড্রোজেন অথবা মেঘের এমোনিয়া মিশে গিয়ে সূর্য-কিরণের প্রভাবে জৈব পদার্থ সৃষ্টি হতে যে সময় প্রয়োজন সেই বয়সও হয়নি এই পাহাড়ের। ডক্টর আরও বললেন-অগ্নুৎপাত থেকে এভাবে অনেক পাহাড়ের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর বহু জায়গায় ভূগর্ভে প্রস্তর রাশি জমে ওঠে। ভৌগলিক কারণে সৃষ্ট আগ্নেয়গিরি এসব পাথরের স্তুপ বের করে দেয় জ্বালামুখ দিয়ে। বিক্ষিপ্ত পাথর জমে সৃষ্টি হয় পাহাড়। এভাবেই মাউন্ট এটনার জন্ম হয়েছে। নেপলস্-এর কাছে মঁনুয়াভো পাহাড় মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে শুধু আগ্নেয় ছাই জমে সৃষ্টি হয়েছিল।
পৃথিবীকে একটি বর্তুলাকার বয়লার বলা যেতে পারে। বাষ্পের চাপ ক্রমাগত ভেতর থেকে বাইরে বের হতে চায়। এই চাপই যেখানে প্রবল সেখানে ভূ-ত্বক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে আগুন, লাভাস্রোত, ছাই। বাস্পের এই বেরিয়ে যাবার মুখগুলোই হচ্ছে আগ্নেয়গিরি। চাপ কমে গেলে কখনও মুখ বন্ধ হয়ে থেমে যায় অগ্ন্যুৎপাত। আবার আরেক জায়গায় জেগে ওঠে নতুন জ্বালামুখ।
ক্যাপ্টেন নতুন দ্বীপের নাম দিয়েছেন কুইনসল্যান্ড। ডক্টর বললেন-এই দ্বীপটি যদি শতাব্দীর পুরানো হত তাহলে দেখা যেত দ্বীপের নানান জায়গায় গরম জলের ফোয়ারা আছে। পুরানো আগ্নেয়গিরির আশেপাশে এ ধরনের ফোয়ারা প্রায়ই দেখা যায়।
ক্যাপ্টেন ও তার সঙ্গীরা যতই উপরে উঠছে ততই পথশ্রমে কাহিল হয়ে পড়ছে ওরা; এখনও অনেকটা পথ বাকি। পা যেন আর চলতে চাইছে না। ওপরে ওঠা রীতিমত কঠিন হয়ে পড়ছে। জ্বালামুখ থেকে ছিটকে বের হয়ে আসা উত্তপ্ত পাথরের টুকরো শিলাবৃষ্টির মত চারদিকে ঝরে পড়ছে। ধোঁয়া আর ছাইয়ের জন্যে সামনের কোন কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। তারপরেও আছে সাপের মত বেয়ে আসা লাভাস্রোত। যে-কোন মুহুর্তে একটু অসাবধান হলেই ঘটে যাবে মারাত্মক দুর্ঘটনা। ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের এদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি সোজা উঠে চলেছেন পাহাড়ের গা বেয়ে। আরও অনেকটা উঠে এক শিলাচত্বরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। প্রায় দশ ফুট চওড়া পাথুরে চাতাল ঘিরে বয়ে যাচ্ছে লাভাস্রোত। এই দশ ফুট চওড়া লাভাস্রোত পার হলে সরু একটা পথ আছে উপরে ওঠার। কিন্তু পুরোটা পথই যথেষ্ট বিপদসঙ্কুল। ক্যাপ্টেন একটু থেমে ভেবে নিচ্ছেন কিভাবে পার হবেন এই পথ।
এদিকে ডক্টর, আলটামন্ট, বেল ও জনসনের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। ক্যাপ্টেন একটানা তিন ঘণ্টা পাহাড়ে উঠেও ক্লান্ত হননি। কিন্তু অন্যেরা আর পারছে না। ক্লান্তিতে ওদের হাঁটু ভেঙে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে ওরা।
ডক্টর ভাবলেন, এবার কিছু একটা করা দরকার। ক্যাপ্টেন যেখানে যেতে চাইছেন সেই জ্বালামুখে যেতে হলে আগুনের স্রোত পেরিয়ে যেতে হবে; সেখানে হেঁটে যাওয়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ক্যাপ্টেন তার কথার নড়চড় করতে নারাজ। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও একটানা তিনি উঠেই চলেছেন উপরের দিকে। যতই উপরে উঠছেন ততই তার বুদ্ধি বিবেচনা যেন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক উন্মাদনায় পেয়ে বসেছে তাঁকে। কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠছেন ক্যাপ্টেন। মানসিক ভারসাম্যও যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছেন তিনি।
ডক্টর এবার চড়া গলায় বলে উঠলেন, ক্যাপ্টেন, আমরা আর উপরে উঠব না। চলুন ফিরে যাই। কেন জেনেশুনে বিপদে পা দিচ্ছেন? আমরা তো মেরুবিন্দুতেই আছি।
না, ডক্টর! আমি ফিরে যেতে পারি না। মেরুবিন্দু আরও উপরে; অনেক উপরে! আমি সেখানে যাবই! আপনারা যেতে না চাইলে এখানেই বসে থাকুন। অবিচল কণ্ঠে জবাব দিলেন হ্যাটেরাস।
ক্যাপ্টেন! এবারে অনুনয়ের সুর ডক্টরের কণ্ঠে।
কোন কথা নয়! খেপে উঠলেন ক্যাপ্টেন।
এবার ডক্টর বললেন, আমাদের কথা না শুনলে আমরা জোর করে হলেও–
ডক্টরের কথা শেষ হল না; ক্যাপ্টেন বুঝে ফেলেছেন কি বলতে চান তিনি। কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই অতি মানবিক প্রচেষ্টায় একলাফে তিনি পার হয়ে গেলেন লাভাস্রোত। ডাকও একই ভাবে লাফ দিয়ে তাকে অনুসরণ করল। আশ্চর্য ব্যাপার! আগুনের ছিটেফোঁটাও তার কিংবা ডাকের শরীরে লাগল না। একমাত্র বিশ্বস্ত সাথীকে সঙ্গে নিয়ে দিব্যি তিনি পার হয়ে গেলেন লাভাস্রোত। চলে গেলেন সঙ্গীদের নাগালের বাইরে।
আগুনের ধোঁয়া আর ছাইয়ের ভেতর হারিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু তার চিৎকার ঠিকই শোনা যাচ্ছে। উম্মাদের মত চিৎকার করে তিনি বলে চলেছেন, আমি যাচ্ছি মেরু বিন্দুতে! মাউন্ট হ্যাটেরাসের মাথায়! তোমরা এই বিজয় সংবাদ পৌঁছে দিয়ো ইংল্যান্ডবাসীদের কাছে। পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়ো…
আস্তে আস্তে ক্যাপ্টেনের গলার স্বর মিলিয়ে যেতে লাগল। ছুটে গিয়ে ক্যাপ্টেনকে জোর করে ফিরিয়ে আনার মত সাহস বা শক্তি এখন আর কারও নেই। পথচলায় সবাই ক্লান্ত। লম্বা লাফে পার হতে হবে লাভাস্রোত। অতবড় লাফ দেয়া যেমন সহজ নয় তেমনি লাফ ফসকালে সোজা লাভাস্রোতে পড়তে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে শরীর। তবুও বুকে সাহস সঞ্চয় করে লাফ দিতে চেয়েছিলেন আলটামন্ট। খামোকা ফোস্কা পড়ে গেল শরীরে। ডক্টর, বেল ও জনসন কোনমতে টেনে ধরাতে বড় ধরনের বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেলেন তিনি।
ক্যাপ্টেনের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন ডক্টর। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না। শুধু ডাকের ক্ষীণ ঘেউ ঘেউ মাঝে মাঝে শোনা যেতে লাগল। এভাবে চরম উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ সময়। কখনও ক্যাপ্টেনকে একটু আধটু দেখা যায়। আবার কখনও একদমই দেখা যায় না। ক্যাপ্টেন যে কি দ্রুতগতিতে উঠে চলেছেন উপরের দিকে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি যেন ভোর বেলায় সমতলভূমির ওপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন! অল্প সময়ের ভেতরেই এত উপরে উঠে গেছেন যে তার আকৃতি এখন অর্ধেক দেখাচ্ছে।
অগ্ন্যুৎপাতের বিকট আওয়াজ, চারদিকে অগ্নিস্রোতের নহর, মাঝে মাঝেই পাহাড় থেকে খসে পড়ছে বড় বড় পাথর। যে-কোন মুহূর্তে মৃত্যু ছোবল মারতে পারে। ক্যাপ্টেনের সেসব খেয়াল নেই। পাহাড়ে ওঠার লাঠিতে ইংল্যান্ডের পতাকা। বেঁধে সেটা নাড়াতে নাড়াতে উঠে চলেছেন উপরে, আরও উপরে। পাহাড়ের শিখরে-জ্বালামুখের দিকে!
নিচ থেকে ডক্টররা দেখলেন, কিভাবে ক্যাপ্টেন অসম্ভবকে সম্ভব করে চলেছেন। কখনও ছাইয়ের ভেতর তার কোমর পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে আবার কখনও বা চোখা পাহাড় ধরে ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে যাচ্ছেন। হাত ফসকালেই কয়েক শো গজ নিচে লাভাসমুদ্রে পড়তে হবে। প্রায় একঘণ্টা এভাবে প্রতি মুহুর্তে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে অবশেষে পৌঁছুলেন জ্বালামুখের শীর্ষে। মাউন্ট হ্যাটেরাসের চূড়ায়।
ক্যাপ্টেনের করুণ পরিণতির কথা ভেবে ডক্টরের দুচোখ পানিতে ভরে গেল। দুঃখ-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি ডাকলেন, ক্যাপ্টেন! হ্যাটেরাস।
কিন্তু যার প্রতি এই আহ্বান, তিনি তখন অন্য জগতের বাসিন্দা। উদভ্রান্তের মত জ্বালামুখের ধার ঘেঁষে হেঁটে চলেছেন ক্যাপ্টেন। চারপাশে বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে জ্বলন্ত শিলা। কোন কোনটা ক্যাপ্টেনকে প্রায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। তবুও একই গতিতে এগিয়ে চলেছেন হ্যাটেরাস। নির্বিকার, অকুতোভয় ক্যাপ্টেন মেরুবিন্দুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন।
ক্যাপ্টেনের সম্ভাব্য পরিণতি আলটামন্ট কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। ডক্টর বাধা দেবার আগেই একলাফে পার হয়ে গেলেন ১০ ফুট লাভাস্রোত। ক্যাপ্টেনকে বাঁচানোর এক প্রবল কর্তব্যবোধ ও নৈতিক দায়িত্ব জেগে উঠেছে তার মনে। যেভাবেই হোক হ্যাটেরাসকে বাঁচাতেই হবে। আলটামন্টও যেন এক অলৌকিক শক্তি পেয়ে গেছেন। তীরবেগে তিনি ছুটে চললেন ক্যাপ্টেনের দিকে।
ইংল্যান্ডের ফ্ল্যাগ হাতে ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস হেঁটে চলেছেন একটা ঝুলন্ত পাথরের উপর দিয়ে। যে-কোন মুহূর্তে খসে পড়তে পারে পাথরের বিরাট চাঙরটা। পাথরটা ঝুলে আছে জ্বালামুখের সঙ্গে-যেখান থেকে বের হচ্ছে লাভাস্রোত; ছিটকে বেরিয়ে আসছে উত্তপ্ত শিলা। ক্যাপ্টেন যেন ঠিক ওখানেই যেতে চান। পা রাখতে চান মেরুবিন্দুর উপর-হোক সেটা জ্বালামুখ কিংবা অন্যকিছু!
জ্বালামুখ লক্ষ্য করে নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছেন ক্যাপ্টেন। এমন সময় হঠাৎ নড়ে উঠল সেই ঝুলন্ত পাথর। সঙ্গে সঙ্গে ঝুর ঝুর করে পাথরের কুচি খসে পড়তে লাগল জ্বালামুখের গহ্বরে। অজানা ভয়ে আপনা থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে এল সবার। সবই বুঝি শেষ হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসকে আর বোধহয় বাঁচানো গেল না। হ্যাটেরাসের দেহ নির্ঘাত গিয়ে পড়ছে জ্বলন্ত জ্বালামুখে।
ঈশ্বর যার সহায় তার মৃত্যু এত সহজ নয়! ঠিক সময়মত পৌঁছে গেলেন আলটামন্ট। টেনে ধরে তুললেন পতোন্মুখ ক্যাপ্টেনকে। এ যাত্রা বেঁচে গেলেন ঈশ্বরের অশেষ কৃপায়। আলটামন্টের পৌঁছতে যদি আর এক সেকেন্ডও দেরি হত তাহলে ক্যাপ্টেনকে আর বাঁচানো সম্ভব ছিল না। আলটামন্ট ফিরে এলেন ক্যাপ্টেনের সজ্ঞাহীন দেহ নিয়ে।
কিন্তু এ কাকে নিয়ে এলেন আলটামন্ট!
আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
পরের পর্ব :
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা