ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা

২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা

মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা উত্তর দিকে এগিয়ে চলেছে। শান্ত সমুদ্র। সেইসঙ্গে নৌকার গতিও মন্থর। চলার গতি এতই ধীর যে তা সবার কাছেই বিরক্তিকর ঠেকছে। যতদূর চোখ যায় শুধু খোলা আকাশ আর সমুদ্রের অথৈ জল। ডাঙার চিহ্নমাত্র নেই। ক্যাপ্টেনের কোন ভাবান্তর নেই। একমনে তাকিয়ে আছেন উত্তর দিকে। সন্ধ্যার কিছু আগে বহুদূরে কি যেন আবছা কুয়াশার মত দেখা গেল। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন। নিশ্চয়ই ডাঙা হবে। ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলেন আরও কিছুক্ষণ। তারপর চিৎকার করে উঠলেন, ওই যে ডাঙা!

ডক্টর ও জনসনও সায় দিলেন ক্যাপ্টেনের কথায়। কিন্তু আলটামন্ট বললেন, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে মেঘ।

ক্যাপ্টেন আলটামন্টের কথার প্রতিবাদ করে আবার বললেন, ওটা ডাঙাই হবে।

নৌকা আরও কিছুদূর যাবার পর দেখা গেল আগুনের স্ফুলিঙ্গের সঙ্গে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। কোথায় ডাঙা! নৌকা আর একটু কাছে যেতেই চমকে উঠলেন ডক্টর, এ কি! এ যে দেখছি আগ্নেয়গিরি!

বরফের রাজ্যে আগ্নেয়গিরি? আলটামন্টও কম অবাক হলেন না।

ডক্টর বলে উঠলেন, সুমেরুতে আগ্নেয়গিরি দেখে অবাক হবার কি আছে? জেমস রস কুমেরু অভিযানে এরেবাস ও টেরর নামে দুটো আগ্নেয়গিরি আবিষ্কার করেছিলেন। তাছাড়া, আইসল্যান্ড যে বরফের দেশ সেটাও তত আগ্নেয়গিরি দিয়েই তৈরি!

সমুদ্রের ফুরফুরে বাতাস। দোলনার মত ঢেউয়ের মৃদু দুলুনি। নৌকার আরোহীরা, এমন কি ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের মত নিদ্রাহীন লোকের চোখেও ঘুম নেমে এল। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে যেন একখন্ড ধোঁয়াটে মেঘ এসে শান্ত আবহাওয়া বদলে দিয়ে গেল। শুরু হল ঝড় আর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। মোচার খোলার মত লম্বাটে নৌকা ঝড়ের তোড়ে তীরবেগে ছুটে চলল উত্তর দিকে। সারারাত চলল এই তান্ডবলীলা। ভোর হয়ে আসতেই থেমে গেল ঝড়ের দাপট। দমকা বাতাসও বন্ধ হয়ে গেল। পালে যেন বাতাস ধরছেই না। নৌকার গতি আবারও ধীর হয়ে পড়ছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস ধীরে চলার লোক নন। দাঁড় টেনে নৌকা চালানোর আদেশ দিলেন তিনি। কম্পাস দেখে ঠিক করে নিলেন পথ।

বাতাসের গতি পরিবর্তন হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, উপকূলের কাছাকাছি চলে এসেছে নৌকা। কুয়াশার আবরণে দূরের জিনিস একদমই দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় একমুহূর্তের জন্যে কুয়াশার আবরণ সরে গেল আর সেই মুহূর্তমাত্র সময়ে অভিযাত্রীরা অবাক চোখে চেয়ে দেখল আগ্নেয়গিরির লেলিহান অগ্নিশিখার মাতম। আবার কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল বুক কাঁপানো আগুনের শিখা।

হঠাৎ করেই আবার শুরু হল ঝড়। প্রকৃতির ওই ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানোতে অসহায় হয়ে পড়ল অভিযাত্রীরা। মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতি-দেবতা নানাভাবে বার বার বাধা দিচ্ছেন মেরু অভিযাত্রীদের। তিনি বোধহয় প্রকৃতির অনাবিষ্কৃত অংশটুকু আর মানব জাতির কাছে উন্মোচিত করতে চান না !

এবার ক্যাপ্টেন ও তাঁর সাথীরা পাগলা ঝড়ের পাল্লায় পড়ল। এই ডোবে এই ভাসে অবস্থায় ঝড়ের ঝাপটা নৌকাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। কিন্তু উত্তরে ডাঙা মাত্র তিন মাইল দূরে। হ্যাটেরাস ভীষণ হতাশ হলেন। তিনি দাঁড় টেনে উপকূলের দিকে নৌকা টেনে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু ঝড়ো হাওয়ার প্রবল টানে খরকুটোর মত ভেসে চলল নৌকা। কিছুতেই নৌকার দিক পরিবর্তন করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই বুঝি ডুবে যাবে!

একে তো নৌকা ডোবার ভয়ে সবাই অস্থির, তার ওপর ওদের বুকের রক্ত জমিয়ে দিল একটি দৃশ্য। নৌকার কয়েক শ গজ সামনেই একটা হিমবাহ ভেসে চলেছে। ওটারও ডুবু ডুবু অবস্থা। তবে ভয়ের কারণ কিন্তু হিমবাহের সঙ্গে সংঘর্ষ নয়। হিমবাহের ওপর একদল হিংস্র ভালুক। ভালুকগুলোও প্রকৃতির তান্ডবলীলায় ভয় পেয়ে গেছে। ভালুকগুলোর মতিগতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে হিমবাহ ডুবলেই তারা নৌকায় উঠে বসবে। মাঝে মাঝে স্রোতের টানে সেই হিমবাহের একদম কাছে চলে আসে নৌকা। অভিযাত্রীরা তখন মনে মনে ঈশ্বরের জপ করে। ইচ্ছে করলে ভালুকগুলো লাফ দিয়েই উঠে আসতে পারে নৌকায়। আবার সরে যায় নৌকা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অভিযাত্রীরা। এভাবে চলল বেশ কিছুটা সময়। তারপর একসময় দূরে মিলিয়ে গেল হিমবাহ। ভালুকের হাত থেকে এ যাত্রাও বেঁচে গেল ওরা।

এক বিপদ যেতে না যেতেই আর এক বিপদ এসে হাজির। স্রোতের টানে নৌকা গিয়ে পড়ল এক মারাত্মক ঘূর্ণির ভেতরে। লাটিমের মত ঘুরতে লাগল নৌকা। ক্যাপ্টেন ও তার সঙ্গীদের অবস্থা শোচনীয়। মাথা ঘুরে সবাই বুঝি উল্টে পড়ে ঘূর্ণিজলে! ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নৌকা। তারপরই নৌকাসহ ওরা কামানের গোলার মত ছিটকে বেরিয়ে পড়ল ঘূর্ণিবৃত্ত থেকে। নৌকা সমেত সবাই আছড়ে পড়ল ডাঙায়। মাটিতে ছিটকে পড়লেন ডক্টর, জনসন, বেল ও আলটামন্ট। কিন্তু ক্যাপ্টেন কোথায়?

চারদিকে খোঁজাখুঁজি করল ওরা, ডাকল উচ্চস্বরে। ডক্টর বেশ কয়েকবার গুলিও ছুঁড়লেন, কিন্তু না, ক্যাপ্টেনের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

সবার মন খারাপ। শেষমেষ এ কি হল? মেরুবিন্দু আবিষ্কারের জন্যে যিনি এত পাগলামো করলেন; সইলেন এত ত্যাগ ও তিতীক্ষা; সেই বিন্দুর এত কাছে এসেও শেষটায় তিনি কিনা চিরদিনের মত হারিয়ে গেলেন! সাঁতরে ডাঙায় উঠবেন সে শক্তিও নেই। ক্যাপ্টেনের এ করুণ পরিণতিতে সবাই ভেঙে পড়ল। মেরু বিজয়ের কোন উৎসাহই আর রইল না ওদের মাঝে। সবার চোখেমুখে বিষাদের কালো ছায়া নেমে এল।

রাত শেষ হয়ে আসতেই ঝড়ের দাপাদাপিও থেমে এল। ভোরের আলো ফুটে উঠতেই দেখা গেল কিছুদূরে আকাঙ্ক্ষিত সেই মেরুবিন্দু বা আগ্নেয়গিরি! সমুদ্রের ভেতর থেকে যেন ফোয়ারার মত ভেসে উঠেছে অগ্নি-পাহাড়। তীর বা পাদদেশ বলে কিছু নেই। দ্বীপটা আট থেকে দশ বর্গমাইল। প্রায় পুরোটাই জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ক্রমাগত অগ্নুৎপাত হচ্ছে। লাভাস্রোত বয়ে গিয়ে মিশছে সমুদ্রের জলে। সমুদ্রের জল ফুটছে টগবগ করে। জ্বালামুখ থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে টকটকে লাল পাথরের টুকরো। কালো ধোঁয়া আর আগুনের লকলকে শিখা অদ্ভুত এক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে।

অভিযাত্রীদের ভাগ্য ভাল, ঝড়ের তোড়ে আছড়ে পড়লেও তাদের নৌকার কোন ক্ষতি হয়নি। তাই নৌকা নিয়েই ওরা আগ্নেয়গিরির আরও কাছে এগিয়ে গেল। অল্পদূরে যেতেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটা খাঁজ দেখতে পেল ওরা। নৌকা ভেড়ানর জন্যে চমৎকার জায়গা। সেদিকেই ওরা টেনে নিয়ে চলল নৌকা। খাজের। কাছে আসতেই ডাক নৌকা থেকে এক লাফে নেমে ছুটে গেল সেই পাহাড়ের দিকে। অনেক চেষ্টা করেও ডাককে ফেরানো গেল না।

আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
পরের পর্ব :
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত