২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে কিছুদিন শিকার বন্ধ রাখলেও আবার একদিন শিকারে বের হলেন ডক্টর, আলটামন্ট ও ক্যাপ্টেন। সঙ্গে আছে ক্যাপ্টেনের প্রিয় সাথী ডাক। বেশ কিছুদূর যাবার পর ডাক দূরে দুটি জন্তুর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওদের। মাটির খাঁজে শেওলা খেতে থাকা জন্তু দুটিকে ডক্টর দূর থেকেই চিনে ফেললেন, ওগুলো হচ্ছে কস্তুরী-ষাঁড়। দেখতে ভারি অদ্ভুত এই চারপেয়ে জন্তু দুটো। ছোট্ট চ্যাপটা মুখ। মাথায় বেঢপ সাইজের গোড়া মোটা শিং। লেজটাও বেশ ছোটই। সারা শরীর ঘন লোমে ঢাকা। আর চুলগুলি হল বাদামী রঙের। এদের মাংসে কস্তুরীর সৌরভ। দেখতে মনে হয় এরা দুটো প্রাণীর সংমিশ্রণে কিছু একটা।
ডক্টর বললেন, এদের মাংস খেতে দারুণ মজা। একবার খেলে সারাজীবন জিভে স্বাদ লেগে থাকে।
ডক্টরের কথা শুনে সবাইকে নতুন করে শিকারের নেশায় পেয়ে বসল। এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনজনেই ওই ষাঁড় দুটোকে মারার জন্যে ডাকের পিছন পিছন ছুটে গেলেন। প্রাণী দুটোও তিনজনকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে এমন ভোঁ দৌড় লাগাল যে কিছুতেই ওদের বাগে আনতে পারলেন না ওঁরা। তখন ক্যাপ্টেন, আলটামন্ট ও ডক্টর ঠিক করলেন, তিনজন তিনদিক থেকে ঘিরে না ধরলে ষাঁড় দুটোকে কাবু করা যাবে না। তাই আস্তে আস্তে তিনদিক থেকে জন্তু দুটোকে ঘিরে এগোতে লাগলেন ওরা। যখন তিনজনই ষাঁড় দুটোর বেশ কাছাকাছি চলে এসেছেন তখন ক্যাপ্টেন একাই হঠাৎ এগিয়ে গেলেন ভয় দেখিয়ে ওই দুটোকে তাড়িয়ে আনতে। কিন্তু ফল হল উল্টো-দুটো ষাড়ই ক্যাপ্টেনকে তাড়া করল এবার। বিপদ বুঝে তিনি গুলি ছুঁড়লেন। একটার কপালে গুলি লাগা সত্ত্বেও দুটোই একই গতিতে ক্যাপ্টেনের দিকে তেড়ে এল। আবার গুলি করলেন ক্যাপ্টেন। এবার অন্যটা খেপে গিয়ে তীরবেগে ছুটে এসে প্রচন্ড ধাক্কায় তাকে মাটিতে ফেলে দিল। এই বুঝি শিংয়ের গুতোয় ক্যাপ্টেনকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় খ্যাপা জন্তু দুটো! ডক্টর দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললেন। এ দৃশ্য তিনি সইবেন কি করে!
আলটামন্ট তক্ষুণি তীরবেগে ছুটে গেলেন ক্যাপ্টেনকে বাঁচাতে। ক্যাপ্টেন আলামন্টের যত বড় শত্রুই হোন না কেন এ বিপদে তাকে সাহায্য করা অবশ্য কর্তব্য। ষাঁড় দুটো যেইমাত্র পায়ের ক্ষুর আর মাথার শিং দিয়ে ক্যাপ্টেনকে আঘাত করতে যাবে অমনি আলামন্টের গুলিতে একটা ষাঁড় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এতে দ্বিতীয়টা আরও খেপে গিয়ে শিংয়ের গুঁতোয় হ্যাটেরাসকে মাটির সঙ্গে বিদ্ধ করার জন্যে মাথা ঝাঁকিয়ে তেড়ে এল। দারুণ বিপদের ঝুঁকি নিয়েও আলটামন্ট তক্ষুণি জন্তুটার ওপর লাফিয়ে পড়ে কুঠারের এক আঘাতে সেটার মাথা দুফাঁক করে ফেললেন।
সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে আলামন্টের প্রতি কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন। আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, আলটামন্ট, আপনাকে যে কি কৃতজ্ঞতা জানাব, সে ভাষা আমার জানা নেই। বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছেন আপনি।
আপনিও একদিন আমার প্রাণরক্ষা করেছিলেন, ক্যাপ্টেন। আর আমি তো শুধুমাত্র মানবিক কর্তব্যই পালন করেছি।
ক্যাপ্টেনকে অক্ষত পাবার আনন্দে ছুটে এসে দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন ডক্টর।
এই ঘটনার পর দুজনের শত্রুতা হাওয়ায় উবে গেল। দুজনেই দুজনের পরম বন্ধুতে পরিণত হলেন। এখন দুজনকে দেখে বোঝাই যায় না যে খানিকক্ষণ আগেও এঁরা একজন আরেকজনের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলেন। ডক্টর সুযোগ পেয়ে বলে উঠলেন, আমাদের সবারই লক্ষ্য অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা। কি লাভ জাতিগত বিদ্বেষ মনে পুষে রেখে? আমরা তো সবাই এই পথের পথিক। কে ইংরেজ আর কে আমেরিকান সেই খোঁজ না করে বন্ধুর মত, ভাইয়ের মত আনন্দে হুল্লোড়ে অনাবিষ্কৃতকে আবিষ্কার করাই সবচেয়ে ভাল নয়?
ডক্টরের কথায় আলটামন্ট ও হ্যাটেরাস দুজনেই প্রথমে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন, তারপর দুজন দুজনকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেন দুই সহোদর বহুদিন পর মিলছে একে অপরের সঙ্গে। আলটামন্ট ও ক্যাপ্টেনের বন্ধুত্বে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হলেন ক্লবোনি। ডক্টর হাউসে ফিরে এসে হৈ-চৈ করে বেল আর জনসনকে জানালেন সবকিছু। ওরাও কম আনন্দিত হল না। এ উপলক্ষে ডক্টর চমৎকার এক ভূরিভোজের ব্যবস্থা করলেন।
সময় বয়ে যাচ্ছে অতি দ্রুত। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ এসে গেছে। ক্যাপ্টেন আর অপেক্ষা করতে চান না। বরফ পুরোপুরি গলে যাবার আগেই রওনা হতে চান তিনি। মোটামুটি প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। স্লেজ মেরামত করে তাতে জিনিসপত্র উঠানো হয়েছে। পরপয়েজের কাঠে তৈরি নৌকাও তোলা হল স্লেজে। খাবারদাবার, গোলা-বারুদ, তাবু ইত্যাদি মিলে জিনিসপত্রের ওজন প্রায় দেড় হাজার পাউন্ডে গিয়ে ঠেকল !
এবার বিদায়ের পালা। বিদায় মানে ডক্টরের এত সাধের দৈব-দুর্গ থেকে বিদায়ের পালা। ২৪ জুন সকালে ডক্টর হাউস থেকে বেরিয়ে পড়ল অভিযাত্রীরা। এই কদিনে বরফ প্রাসাদের ওপর একটা মায়া জন্মে গিয়েছিল সবার। তাই যেতে যেতে সবাই বার বার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, আস্তে আস্তে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যাচ্ছে বরফ প্রাসাদ।
পথ চলতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। পথ বেশ মসৃণ আর সমতল। স্লেজ তাই স্বচ্ছন্দ গতিতেই টানা যাচ্ছে। ডক্টর পথ নির্ণয়ে কিছুটা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছেন। কম্পাস ধরে উত্তরের কোন একটা কিছুকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেন। সেখানে পৌঁছে আবার দূরে অন্য কোন লক্ষ্যবস্তু নির্দিষ্ট করে চলতে থাকেন। এভাবেই সোজা সরল রেখায় উত্তর দিকে এগিয়ে চলেছে অভিযাত্রীরা।
তিনদিন চলার পর অভিযাত্রীদের সামনে পড়ল বরফ জমা এক হ্রদ। গ্রীষ্মের তাপ এখানে পৌঁছয় না। তাই বরফও গলে না। ডক্টর এবার বুঝতে পারলেন আলামন্টের নিউ আমেরিকার বিস্তৃতি মেরু বিন্দু পর্যন্ত নয়। ওটার অবস্থান ছোট্ট একটা দ্বীপের মত।
আবার প্রকৃতির পরিবর্তন শুরু হয়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ৪৫ ডিগ্রিতে ঠেকেছে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টি হওয়াতে ভালই হল কারণ এতে কুয়াশা কেটে যাবে! বৃষ্টির পানিতে পথ ধুয়ে পরিষ্কার হওয়ায় স্লেজ টানা আরও সহজ হল। মাসের শেষদিন অর্থাৎ ৩০ জুন শুরু হল ঝড়ের প্রচন্ড তান্ডবলীলা। বরফের বড় বড় চাঙর ভেঙে পড়ছে। ভেসে যাচ্ছে সেগুলো দূরে কোথাও! বরফ পাহাড় ভেঙে গিয়ে সমতল ভূমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এত ঝড় ঝাপটা সত্ত্বেও নেহাতেই ভাগ্যগুণে ক্যাপ্টেন ও তার সঙ্গীরা তেমন কোন বিপদের সম্মুখীন হলেন না।
জুলাই মাসের তিন তারিখে ওদের জন্যে নতুন এক অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল। পথ চলতে চলতে ওরা এমন এক এলাকায় এসে উপস্থিত হল যেখানে কয়েক মাইল জুড়ে তুষারের রঙ রক্তজবার মত লাল ! তুষার গলে গিয়ে পানির যে স্রোত বয়ে যাচ্ছে তা দেখে মনে হয় যেন রক্তের নহর বইছে। ডক্টর বোনি আর একবার তার বিশ্বকোষ খুলে বসলেন, বললেন, বিশেষ এক ধরনের ছত্রাকের জন্যে এই এলাকার পানি বা বরফের রঙ লাল হয়। প্রতি কিউবিক সেন্টিমিটারে এই ছত্রাকের সংখ্যা প্রায় তেতাল্লিশ হাজার।
পরদিন ঘন কুয়াশায় পথ চলাই দুষ্কর হয়ে উঠল। চারদিকের কোন কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। বারবার কম্পাস দেখে চলার পথ ঠিক রাখতে হচ্ছে। কুয়াশার জন্যে তেমন কোন দুর্ঘটনা না ঘটলেও বরফ-পাথরে হোঁচট খেয়ে বেলের জুতো ছিড়ে গেল।
কুয়াশার জন্যে গত তিনদিন দৈনিক মাত্র ৮ মাইল পথ চলা সম্ভব হয়েছে। তাই ৬ জুলাই কুয়াশা কিছুটা হালকা হয়ে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জলদি বের হয়ে পড়লেন। আলটামন্ট ও বেল ডাককে নিয়ে খানিকটা আগে আগে চলল। বেশ কিছুদূর যেতেই প্রায় আধ মাইল পেছন থেকে ডক্টর দেখলেন, ওরা হঠাৎ কি যেন দেখতে পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেছে। মাটিতে ঝুঁকে কি যেন দেখে নিয়ে দিগন্তের দিকে কিছু খুঁজছে। এবার ডক্টর দ্রুত ছুটে গেলেন ওখানে। ওদের কাছাকাছি পৌঁছে ডক্টর নিজেও ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন।
ওদের চারপাশের বরফ প্রান্তরে ইউরোপীয় বুটের ছাপ। এই ছাপ কোথা থেকে এল! তাহলে কি ওদের আগেই অন্য কেউ এ জায়গায় এসেছিল। দেখে বোঝা যাচ্ছে বুটের ছাপগুলো একদম নতুন। দুএকদিনের মধ্যেই কেউ এপথ দিয়ে গিয়েছে। ছাপ অনুসরণ করে তারা দেখল মাইলখানেক গিয়ে এ ছাপ পশ্চিম দিকে মোড় নিয়েছে।
অভিযাত্রীরা মুষড়ে পড়ল। হয়ত তারা মেরু বিন্দুতে গিয়ে দেখবে, তাদের আগেই অন্য কেউ সেখানে পৌঁছে গেছে! ক্যাপ্টেন আর দেরি করতে রাজি নন। পায়ের ছাপের রহস্য পেছনে পড়ে রইল। আবার উত্তরের পথে চলা শুরু হল। কিন্তু অজানা অভিযাত্রীর কথা ভেবে সবার মন এক বিশ্রী অস্বস্তিতে ভরে গেল।
সেদিন রাতেই প্রচন্ড ঝড় শুরু হল। সারারাত চলল ঝড়ের প্রলয়-নাচন। ক্যাপ্টেন ও তার সাথীরা কোনমতে একটা খাদের মধ্যে তাঁবু গেড়ে রাতটা ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে দিল। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই ঝড় গেল থেমে। আকাশও পরিষ্কার হয়ে গেল। ডক্টর, জনসন ও ক্যাপ্টেন একটা উঁচু পাহাড়ে উঠলেন ঝড় কি ক্ষতি করে গেছে তা দেখবার জন্যে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে অবাক হয়ে গেল ওরা। মেরু প্রকৃতির এত দ্রুত পট পরিবর্তন চোখে না দেখলে যেন বিশ্বাসই করা যায় না। কুয়াশার কোন চিহ্নই নেই। বিদায় নিয়েছে শীত। এসেছে বসন্ত। বরফ নেই বললেই চলে। সমতল প্রান্তরে মাটি আর পাথরের কুচি দেখা যাচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে খোলা সমুদ্র। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কালচে বাষ্প।
ওরা পাহাড় থেকে নেমে এসেই হৈ-চৈ করে স্লেজে মালপত্র উঠিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ছুটে চলল সমুদ্রের দিকে।
খোলা সমুদ্র। যতদূর চোখ যায় শুধু অথৈ সমুদ্র। স্থলভাগের কোন চিহ্নই নেই। কমলা লেবুর মত পৃথিবীর মানচিত্রে মেরুবিন্দুটা টেপা দেখানো আছে। আর এই সমুদ্রেই হচ্ছে সেই টেপা অংশটুকু।
সমুদ্র-সৈকতে এসে চারদিক ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন ডক্টর। সমুদ্রের ডানে আর বায়ে দুটো অন্তরীপ। দুটোই সরু হয়ে মিশে গিয়েছে সমুদ্রে। মজার ব্যাপার হল দুই অন্তরীপের মাঝে যে পানিটুকু, তা একদম শান্ত। ঠিক যেন একটা উপসাগর। ঢেউয়ের গর্জন নেই। জেটির মত দেখতে বিরাট একটা পাথরের স্তুপও আছে সেখানে। ডক্টর আলটামন্টের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে জেটিটার নাম। দিলেন আলটামন্ট বন্দর! আলটামন্ট এখন ক্যাপ্টেনদেরই একজন। সুতরাং নামকরণে কোন বিপত্তি হল না।
সারাটা দিন ওদের কেটে গেল সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি নিতে। স্লেজ তোলা হয়েছে নৌকায়। সমস্ত মালপত্রও তোলা হয়েছে। পরদিন সকালেই রওনা হবে অভিযাত্রীরা।
জুলাইয়ের ৮ তারিখ। ভোরবেলায় উঠে পড়েছেন ডক্টর। যাত্রার প্রস্তুতি প্রায় শেষ। তাবু এবং রাতে শোবার সবকিছু তোলা হয়েছে নৌকায়। একটু পরেই যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু ডক্টর কেন জানি কি চিন্তা করে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অন্যেরা যাত্রার আগে পাথরের ওপর বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছে আর এই ফাকে কেউ কেউ চা খাচ্ছে। ডক্টর চিন্তিত মনে এসে বসে পড়লেন ওদের সামনের একটা পাথরে। তারপর বেলকে লক্ষ্য করে বললেন, আমাকে এক কাপ চা দাও তো।
বেল চা নিয়ে ডক্টরের সামনে এসে দাঁড়াল।
নিন।
ডক্টর মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। বেল যখন নিন বলল তখন হঠাৎ তার চোখ এক ঝলকের জন্যে ওর পায়ের উপর পড়েছিল। বেলের জুতো লক্ষ্য করে ডক্টর এক লাফ দিলেন যে ওর হাত থেকে চায়ের কাপ ছিটকে পড়ে ভেঙে গেল। ভাগ্য ভাল, গরম চা কারও গায়ে পড়েনি। সবাই অবাক চোখে তাকাল ডক্টরের দিকে। ডক্টরের চোখেমুখে আনন্দের ছটা। তিনি হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, আমরা বুটের ছাপ দেখে খুব চিন্তিত ছিলাম, তাই না? সেই বুটপরা। লোকটাকে আমি খুঁজে পেয়েছি!
সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, কে সে? কোথায় সে? কে সে? কোথায় সে?
এই যে এখানে সে! বলেই বেলের দিকে আঙুল উঠালেন ডক্টর।
কুয়াশায় পথ চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে তুষার-জুতা ছিড়ে ফেলেছিল বেল। বুটের ছাপ ওরই বুট জুতোর।
এবার নিশ্চিন্ত মনে সবাই নৌকায় গিয়ে বসল। না, ভয়ের কোন কারণ নেই। ওদের কেউ অনুসরণ করছে না। সমুদ্র খুবই শান্ত। টলটলে স্বচ্ছ জল। এতই স্বচ্ছ যে নিচের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নানা রঙের নানা আকৃতির নাম না জানা মাছ তরতর করে সাঁতরে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে। যেন এক বিরাট অ্যাকোয়ারিয়াম-আর তাতে মাছেরা সব খেলা করছে!
মেরুযাত্রীদের নৌকা বাতাসের টানে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। নৌকার সঙ্গে সঙ্গে বিরাটাকৃতির পেঙ্গুইন, বিশাল ডানাওয়ালা অ্যালট্রেস, আরও কত নাম না জানা পাখি আকাশের বুক চিরে উড়ে চলেছে।
আকাশের পাখি, জলের মাছ-এসব দেখতে দেখতে বেশ কেটে গেল একটা দিন। সন্ধ্যা নেমে আসতেই পাখিরা সব হাওয়া হয়ে গেল। রাত নামল। চারদিকে নিস্তব্ধ অন্ধকার। শুধু এগিয়ে চলেছ ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের পালতোলা নৌকা। মেরুবিন্দু জয় করতেই হবে-অভিযাত্রীদের লক্ষ্য একটাই।
আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
পরের পর্ব :
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা