১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল। একদিনেই তাপমাত্রা উঠে গেল শূন্য তাপাঙ্কের পনেরো ডিগ্রি উপরে। বরফ অল্প অল্প করে গলতে শুরু করেছে। পাখিদের কলকাকলিতে প্রাণহীন মেরু অঞ্চলে আবার প্রাণের স্পন্দন ফিরে এসেছে। নাম না জানা কত পাখি উড়ছে আকাশে জমির উপরও দেখা যাচ্ছে অনেক মেরুপ্রাণী। এমনকি নেকড়ের দল ও কোথা থেকে যেন এসে হাজির হয়েছে। এরা কুকুরের গলার স্বর নকল করে ডাকে আর সুযোগ পেলেই অন্য প্রাণীদের ঘাড় মটকে দেয়।
জীবনধারা একদম পাল্টে গেল অভিযাত্রীদের। সারাদিন হৈ-চৈ আর শিকার। তারপর ডক্টরের সুস্বাদু রান্না। বেশ কেটে গেল কটা দিন। তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। শীতের প্রকোপ নেই বললেই চলে। এমন সুন্দর আবহাওয়ায় সপ্তাহ দুই, পার হতে না হতেই উত্তরে হাওয়ার প্রকোপে হঠাৎ তাপমাত্রা নেমে গেল শূন্য তাপাঙ্কের ৮ ডিগ্রি নিচে। হঠাৎ করেই যেন থেমে গেল পাখিদের কলকাকলি আর পশুদের হাঁক ডাক। আবার বরফে ঢেকে গেল চারদিক।
প্রকৃতির এই পরিবর্তনে অভিযাত্রীদের চোখেমুখেও বিষাদের ছায়া নেমে এল। আবার শুরু হল শীতের কষ্ট পোহানর দিন!
ডক্টর সবার মনোভাব বুঝতে পারলেন। তবুও ওদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, মন খারাপ করার কিছু নেই। প্রতি বছরই এমন হয় ! ১১, ১২ ও ১৩ মে, বছরের এই তিনদিনে আচম্বিতে শীত ফিরে আসে। সম্ভবত এই দিনগুলিতে সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে এক ঝাঁক গ্রহ-নক্ষত্র চলে আসে অথবা বরফ গলতে থাকায় তাপমাত্রা শুষে নিয়ে শীত ডেকে আনে। তবে মজার কথা হল, এই শীত কিন্তু বেশি দিন থাকে না। অল্প কদিনেই চলে যায়!
আবার কিছুদিনের একঘেয়েমি জীবন। ঘরে বন্দী থাকতে হল সবাইকে। এর মাঝেই বেলের, হঠাৎ ডিপথেরিয়া হল। শুনলে অবাক লাগে, ডক্টর বেলের মুখে একটানা বরফ পুরে দিয়ে টনসিলের ফোলা কমিয়ে দিলেন। কয়েক ঘন্টার বরফ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠল সে। এ অঞ্চলে কারও ডিপথেরিয়া হলে এভাবেই চিকিৎসা করা হয়।
বরফ-বন্দী জীবন অসহ্য লাগছে সবার। আবারও আলসেমিতে পেয়ে বসেছে সবাইকে। এরই ফাকে একদিন সুযোগ পেয়ে ডক্টর পরপয়েজের কাঠ দিয়ে নৌকা বানাবার ব্যাপারে ক্যাপ্টেনকে রাজি করানর চেষ্টা করলেন। প্রথমে ডক্টরের কথা শুনেই ক্যাপ্টেন রেগে টং হয়ে গেলেন।
ডক্টর ক্যাপ্টেনকে বুঝালেন, ক্যাপ্টেন, আপনি কিন্তু ছেলেমানুষের মত কথা বলছেন! কাঠের কি কোন জাত আছে? আপনার রাগ তো আলটামন্টের উপর। কাঠের উপর নয়। তাহলে পরপয়েজের কাঠ দিয়ে নৌকা বানাতে বাধা কোথায়? তাছাড়া আপনিও জানেন বরফ গললেই সামনে পড়বে সমুদ্র! নৌকা ছাড়া আমরা কিছুতেই সামনে এগোতে পারব না।
ডক্টরের কথায় কিছুটা শান্ত হলেন ক্যাপ্টেন। বললেন, ওই আমেরিকানটাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। ওর যা হাভভাব-ও কি আমাদের কাঠ দেবে?
সে ভাবনা আমার। আলটামন্টের কাছ থেকে কাঠ ব্যবহারের অনুমতি আমি নেব।
ডক্টর পেয়ে গেলেন ক্যাপ্টেনের সম্মতি। আনন্দে ঝিলিক দিয়ে উঠল তাঁর চেহারা। যাক, শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেনকে রাজি করানো গেল-মনে মনে ভাবলেন তিনি।
মে মাসের শেষ নাগাদ শীত কমে আসতে লাগল। পশুপাখিরা আবার ফিরে আসা শুরু করেছে। বরফগলা শুরু হয়েছে। নোনা জলের সঙ্গে বরফগলা পানি মিলে বিশ্রী এক ধরনের কাদায় অভিযাত্রীদের চলার পথ দুৰ্গম করে তুলেছে। এ কাদার আবার বাহারি একখানা নামও রয়েছে—স্লাশ।
বেল আর জনসন যথেষ্ট পরিশ্রম করে তৈরি করছে নৌকা। টাটকা খাবারের কোন অভাব নেই। প্রতিদিনই কিছু না কিছু শিকার করা হচ্ছে। এমনকি এই কদিনে বেশ কয়েকটা বল্গা হরিণও শিকার করল জনসন।
একদিন শিকার করতে গিয়ে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল সবার। এতে শিকারের নেশা অনেকটা কমে গেল অভিযাত্রীদের। শিকার করতে গিয়ে ওরা দেখল, খরগোস পায়ের কাছে লুকোচুরি খেলছে, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ওদের গায়ে কিংবা মাথায় বসছে, হরিণের দল একবার মাথা তুলেই আবার নির্ভয়ে পাতা খাচ্ছে-অর্থাৎ পশু পাখিরা ওদেরকে শত্রু মনে করতে পারছে না। এ দৃশ্য অভিযাত্রীদের মনকে প্রচন্ড নাড়া দিল -কি হবে খামোকা নিরীহ প্রাণী হত্যা করে? তাছাড়া প্রচুর মাংস মজুদ আছে। অহেতুক শিকারে কারও মন সায় দিল না। তারচেয়ে মন খুলে প্রাণীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে আনন্দ করাই ভাল।
সময় এমনিতে ভালই কাটছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন ক্যাপ্টেন ও আলটামন্টের মধ্যে আবার ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। ঘটনাটা এরকম, সেদিন অভিযাত্রীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল পরবর্তী অভিযান নিয়ে। আটামন্ট হঠাৎ বলে উঠল, আমরা যেখানেই যাই না কেন, কোন পথে আবার ফিরে আসব সেটা আগেই ঠিক করে নিতে হবে।
আলটামন্ট এবং পরপয়েজ জাহাজের উদ্দেশ্য কি ছিল এই এক কথাতেই তা প্রকাশ পেয়ে গেল। হ্যাটেরাস সোজা প্রশ্ন করে বসলেন, যেখানেই যাই না কেন” বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন।
আলটামন্টও কথায় কম যান না। তিনিও সোজা উত্তর দিলেন না। বললেন, আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেখানকার কথাই বলছি। তবে ফিরবার সময় আমাদের ফিরতে হবে অনাবিষ্কৃত নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ দিয়ে।
নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ-অনাবিষ্কৃত। একথাটির প্রতিবাদ করতে চাইছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস। কিন্তু আলটামন্ট সঙ্গে সঙ্গেই ইতিহাসের নজির তুলে প্রমাণ করে দিলেন, আজ পর্যন্ত নর্থওয়েস্ট প্যাসেজে মানবজাতির কাছে অজানাই রয়ে, গেছে। তারপর আলটামন্ট যে কথা বললেন তা শুনে ডক্টর ক্লবোনি পর্যন্ত রেগে আগুন হয়ে গেলেন।
পরপয়েজের কাঠ দিয়ে তৈরি নৌকা নিয়ে নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ আবিষ্কার করার অধিকার একমাত্র আমারই রয়েছে।
ডক্টর প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, আলটামন্ট, এ কিন্তু আপনার অন্যায় আবদার।
এ তো অন্যায় হবেই! কেননা আমি যে একা আর আপনারা তো চারজন।
তাহলে সেটা বুঝেই এখন থেকে সেভাবে কথাবার্তা বলুন, বললেন ক্যাপ্টেন।
আমাকে কি আপনার হুকুম মেনে চলতে হবে?
অবশ্যই! ক্যাপ্টেনের দৃঢ় উত্তর।
আলটামন্ট আর কোন কথাই বললেন না। আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত ইয়াঙ্কি ডুডল শিস দিয়ে গাইতে গাইতে শুয়ে পড়লেন তিনি। কারও বুঝতে বাকি রইল না আলটামন্ট কি বোঝালেন শিস দিয়ে!
আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
পরের পর্ব :
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা