১৮. সময় আর কাটতে চায় না
সময় আর কাটতে চায় না। প্রচন্ড শীত। বাইরে বের হওয়া যায় না। ঘরেও করার কিছু নেই। বসে থাকতে থাকতে আলসেমিতে পেয়ে বসল সরাইকে। ডক্টর ভাবছিলেন এই বিরক্তি দূর করার জন্যে কিছু একটা করা দরকার। পূর্ববর্তী অভিযাত্রীরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে কি করে সময় কাটাতেন সেই কথাটাই তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। ডক্টর প্রস্তাব করলেন, আমরা যেভাবে শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছি, এটা কিন্তু মোটেও ভাল হচ্ছে না। তারচেয়ে কিছু একটা করে সময় কাটানো যাক।
আলটামন্ট জিজ্ঞেস করলেন, কিছু একটা-টা কি?
যেমন ধরুন খবরের কাগজ বের করা, কিংবা নাটক অভিনয়।
ডক্টরের কথায় অন্যেরা তো অবাক! কি পাগলের মত কথা বলছেন ডক্টর ! এখানে শীতের প্রকোপে সবাই অস্থির, আর তিনি কিনা খবরের কাগজ বের করতে চান, নাটক করতে চান! ডক্টরের মাথাটা খারাপ হয়ে গেল না তো?
না, ডক্টরের মাথা খারাপ হয়নি। শীতের একঘেয়েমি ও বিরক্তি কাটানর জন্যে পূর্ববর্তী অভিযাত্রীরা নিত্য নতুন বুদ্ধি বের করতেন। নানান মজাদার ও কৌতকপূর্ণ খবর লিখে বের করতেন খবরের কাগজ। সেটা সবাই গোল হয়ে বসে পড়তেন। বেশ কিছুটা সময় কেটে যেত আনন্দ আর হৈ হুল্লোড়ে। তারপর সবার জানা নাটকের অংশ বিশেষ অভিনয় করত। এভাবেই তারা বরফ-বন্দী জীবনের একঘেয়েমি দূর করতেন।
ডক্টরের কথা জনসনের তেমন মনঃপূত হয়েছে বলে মনে হল না। নীরস ভঙ্গিতে হাই তুলে সে বলল, এরচেয়ে ঘুমই অনেক ভাল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নাটক আর সংবাদপত্রের স্বপ্ন দেখলেই চলবে। রাত অনেক হয়েছে-আমি চললাম ঘুমাতে।
জনসনের কথায় ডক্টর ক্লবোনি কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হলেও মুখে কিছু বললেন না।
পরের দুদিন ঝড়ের তান্ডবলীলায় অভিযাত্রীরা বেশ ভয় পেয়ে গেল। ঝড় থামল ২৭ এপ্রিল। পরদিন সকালে ঘরের বাইরে এসে ডক্টর বেশ খুশি হয়ে উঠলেন। মেরু আবহাওয়া সম্পর্কে যথেষ্ট ভাল জ্ঞান রাখেন তিনি। তিনি বুঝলেন, শীতকাল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আর মাস খানেকের মধ্যেই ঋতু রাজ বসন্তের আগমন ঘটবে এই মেরু অঞ্চলে।
গত দুদিনের ঝড় বরফ প্রাসাদের উপর দিয়ে কি প্রলয়ঙ্কারী কান্ড ঘটিয়ে গেছে, তা দেখল অভিযাত্রীরা। অবিরাম তুষারপাতে প্রায় পনেরো ফুট উঁচু বরফস্তর জমে গেছে। আগের এবড়োখেবড়ো জায়গাগুলোও বরফে ঢেকে গিয়ে সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। সবাই মিলে গাঁইতি কোদাল দিয়ে বরফ কেটে দুর্গের পাঁচিলটা আবার ঠিক করে দিল। ভাড়ার ঘর থেকে কিছু খাবার-দাবার এনে মজুদ করল ওরা রান্নাঘরে। বিপদ-আপদের কথা কিছুই বলা যায় না, আবার কখন ঝড় শুরু হয়ে যায় কে জানে!
আবহাওয়া একটু ভাল হওয়াতে ডক্টর, আলটামন্ট ও বেল শিকারে বের হলেন। বেশ কিছুদূর গিয়ে তারা দেখতে পেলেন ভালুকের অসংখ্য পায়ের ছাপ। অভিজ্ঞ ক্লবোনি ভাল করে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলেন, গোটা পাঁচেক ভালুক দৈব-দুর্গের চারপাশ দিয়ে ঘুরেফিরে চলে গেছে। যেন আক্রমণের আগে রেকি করে গেছে।
বিপদের গন্ধ টের পেয়েছেন ডক্টর। সত্যি সত্যিই ভালুকগুলো দৈব্য-দুর্গ প্রদক্ষিণ করেছে কিনা সেটা বোঝার জন্যে তিনি সমস্ত পায়ের ছাপ মুছে দিলেন। তারপর বললেন, কালকেও যদি এখানে পায়ের ছাপ দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে। ভালুকদের লক্ষ্য এই দৈব্য-দুর্গ।
পরদিন সকালে উঠে আবারও দেখা গেল ভালুকের পায়ের ছাপ। এবারে আরও কাছে এগিয়ে এসেছে ছাপ। ভালুকরা যেন আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। তবুও শেষবারের মত নিশ্চিত হবার জন্যে পায়ের ছাপগুলো আবারও মুছে দেয়া হল। পরদিন আর ভালুকের ছাপ আশেপাশে কোথাও পাওয়া গেল না। তবুও ঝুঁকি নিতে চাইলেন না ডক্টর। লাইট হাউসে গিয়ে পালা করে পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। প্রথমে ছিল বেলের পালা। বেলের পালা শেষ হতে আলটামন্ট পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে ওকে ছুটি দিলেন।
বেল ফিরে আসতেই ক্যাপ্টেন সবাইকে নিয়ে বসলেন শলাপরামর্শে। বহুদিন ধরেই ক্যাপ্টেন সুযোগ খুঁজছিলেন তিন সঙ্গীকে নিয়ে আলোচনা করার ! কিন্তু আলামন্টের জন্যে কিছুতেই সুযোগ পাঁচ্ছিলেন না। আজ এ সুযোগ হাতছাড়া করলেন না তিনি। বললেন, আলটামন্ট এখন নেই। এই ফাকে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক করে নিতে হবে। শীতের প্রকোপ মাসখানেকের মধ্যেই কেটে যাবে। শীত কমলে আমি কি করতে চাই তা নিশ্চয়ই আপনারা ভাল করেই জানেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আপনাদের মতামত কি তা আগে জানা দরকার।
ডক্টর এবং জনসন ক্যাপ্টেনের মনের কথা বুঝতে পেরে তাদের সম্মতি জানালেন। বেল কিছুটা আমতা আমতা করতে লাগল। ক্যাপ্টেন তাই সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন বেলকে, তুমি কি ঠিক করলে, বেল?
ক্যাপ্টেন, আমরা তো অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। এবার দেশে ফিরলে কেমন হয়? মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল বেল।
ক্যাপ্টেন বুঝতে পারলেন ইংল্যান্ডের জন্যে মন টানছে বেলের। শুধু ওর কেন, সবারই। তাই স্নেহমাখা কণ্ঠে তিনি বললেন, দেখ বেল, আমরা অনেক দুঃখ কষ্ট সয়ে এতদূর এসেছি। সবচেয়ে ঠান্ডা অঞ্চলও পার হয়ে এসেছি। এখান থেকে আর মাত্র ৩৬০ মাইল গেলেই আমরা উত্তর মেরুতে পৌঁছতে পারব। তাছাড়া উত্তরে আর শীতের কষ্ট নেই। এতই যখন সয়েছ তো আর এই সামান্য কষ্টটুকু কি সইতে পারবে না?
অবশ্যই পারব, ক্যাপ্টেন। এতটা পথই যখন পেরিয়ে এসেছি তখন এসামান্য পথটুকুও পার হতে পারব। বেল দৃঢ়কণ্ঠে তার সম্মতি জানাল।
ক্যাপ্টেনের যত ভয় ওই আমেরিকান আলটামন্টকে নিয়ে ! আলটামন্ট ও একজন ক্যাপ্টেন। এখন কে শুনবে কার কথা ! কে করবে অধিনায়কত্ব? তার মনের ভয়টা আগাম আভাস দিয়ে রাখলেন তার সঙ্গীদের।
ডক্টর জিজ্ঞেস করলেন, কোন পথে এবার যাত্রা শুরু হবে, ক্যাপ্টেন?
কেন, উপকূল ধরে চলব আমরা।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু যেতে যেতে যদি সামনে সমুদ্র পড়ে তাহলে কি করব আমরা? এজন্যে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া দরকার। আমার তো মনে হয় পরপয়েজ জাহাজের ভাঙা কাঠ দিয়ে একটা নৌকা তৈরি করে নিলেই হয়।
এতক্ষণ ক্যাপ্টেনের মেজাজ ভালই ছিল। কিন্তু পরপয়েজের কাঠ দিয়ে নৌকা বানানোর কথা শুনেই খেপে উঠলেন তিনি। বললেন, আমেরিকান জাহাজের কাঠ দিয়ে তৈরি নৌকায় মেরু কেন্দ্রে যাব আমি! তা কক্ষনো হতে পারে না।
ডক্টর আর কোন কথা বলার সুযোগ পেলেন না। কেননা, আলটামন্ট ডিউটি শেষ করে ফিরে এসেছেন। সবাই চট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। আলটামন্ট ভালুকের ছায়াও দেখতে পাননি ! সবাই নিশ্চিত হলেন, ভালুকগুলো নিশ্চয়ই অন্য কোথাও চলে গেছে। ওদের আর ভয় নেই। অভিযাত্রীরা আর পাহারা দেবার প্রয়োজনবোধ করল না। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। কিন্তু পরদিন সকালবেলা ওদের জন্যে কি সাংঘাতিক বিপদ অপেক্ষা করছে তা যদি ওরা ঘুণাক্ষরেও টের পেত তাহলে পাহারা তুলে নেয়ার কথা কেউ মুখেও আনত না।
ভালুকের ছফরে এসেছেন লার সুযোগ পেলে কক্ষনো হতে
পরদিন সকাল। জনসনকে ডক্টর হাউসের পাহারায় রেখে ক্যাপ্টেন, আলটামন্ট ও বেল শিকারে গেলেন আর ডক্টর গেলেন জনসন আইল্যান্ডে, ওখানকার প্রাকতিক পরিবেশ খুঁটিয়ে দেখতে। অল্প কিছুক্ষণ পরেই বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেয়ে কিছুটা অবাকই হল জনসন! আজ এত কাছাকাছি শিকার পাওয়া গেল? মনে মনে ভাবল সে। আবার শোনা গেল গুলির আওয়াজ। এবার বেশ খুশি হয়ে উঠল সে। আজ নিশ্চয়ই খানাটা বেশ মজাদার হবে। অনেক শিকার পাঁচ্ছে ওরা। কিন্তু ওর এই আনন্দের ভাবটা বেশিক্ষণ রইল না বন্দুকের একটানা গুডুম গুডুম আওয়াজ ওকে বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলল, চোখমুখ কালো হয়ে গেল অশুভ আশঙ্কায়!
ছুটে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে উঠল জনসন। যা দেখল তাতে ভয়ে ওর হৃদস্পন্দন। বন্ধ হবার উপক্রম হল। পাঁচটা হিংস্র ভালুক ক্যাপ্টেন, আলটামন্ট, বেল ও ডাককে তাড়া করছে, নাগালের মধ্যে পেলেই এক থাবায় টুটি ছিড়ে ফেলবে। প্রাণের মায়ায় জানপ্রাণ দিয়ে ছুটছে ওরা। বার বার গুলি করেও ভালুকগুলোকে কাবু করতে পারছে না। তাই প্রাণভয়ে ছুটছে আর একেকটা জিনিস ছুঁড়ে দিচ্ছে ভালুকগুলোর দিকে। ভালুকদের একটা বৈশিষ্ট্য হল, ওদের সামনে কোন কিছু ছুঁড়ে দিলে ওরা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হলেও থমকে দাঁড়িয়ে সেটা শুকবে। অভিযাত্রীরা ভালুকদের থমকে দাঁড়ানোর সুযোগে নিজেদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার ভালুকদের তাড়া খাচ্ছে ওরা। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে ওরা ডক্টর হাউসের দিকে। শেষ পর্যন্ত কোনমতে ঢুকে পড়লেন আলটামন্ট, বেল ও ডাক। ক্যাপ্টেন দৌড়ে একটু পিছিয়ে ছিলেন, তাই ডক্টর হাউসে ঢুকতে গিয়ে অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন ভালুকের থাবার হাত থেকে। সময় মত বরফ কাটার চাকুটা ভালুকগুলোর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বলেই। এ যাত্রা বেঁচে গেলেন তিনি। হাঁপাতে হাপাতে ঘরে ঢুকে বন্ধ করে দিলেন দরজা।
ঘরে ঢুকেই জনসনের কথায় ডক্টরের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন। ডক্টর একা রয়ে গেছেন দ্বীপে। এখন কি হবে? ডক্টর যদি বন্দুকের আওয়াজ পেয়ে সাবধান হয়ে যান তাহলে চিন্তার কোন কারণ নেই। কিন্তু যদি না শুনে থাকেন। তাহলে কিছুই না জেনে বেঘোরে ভালুকের হাতে প্রাণ দিতে হবে তাকে।
কিছু একটা করা দরকার। এখন উপায় একটাই। তা হল ভালুকগুলোকে তাড়ানো-বা খতম করা। দুটোই বলা যত সহজ করা তত সহজ নয়। ঘর থেকে বেরুলেই ভালুকের থাবায় প্রাণটা খোয়াতে হবে। আলটামন্ট একটা বুদ্ধি বের করলেন। দেয়ালে একটা ফুটো করলেন তিনি তারপর ফুটো দিয়ে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দিলেন। নল দেখে ভালুক যেই সামনে এসে দাঁড়াবে অমনি গুলি ছুঁড়ে খতম করতে হবে। কিন্তু, আলটামন্ট ভাবতেও পারেননি ভালুকদের বুদ্ধির কাছে তাঁকে হার মানতে হবে।
আলটামন্ট বন্দুকের নলটা ফুটো দিয়ে বাইরে বের করতেই এক হ্যাঁচকা টানে বন্দুকটা কেড়ে নিল ভালুকের দল। ট্রিগার টেপার কোন সুযোগ পেলেন না তিনি। ভালুকদের আসুরিক শক্তির পরিচয় পেয়ে অবাক হলেন আলটামন্ট।
বাইরে ভালুকেরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। ভেতরে নিরুপায় অভিযাত্রীরা উত্তেজনায় অস্থির। বন্দুক কেড়ে নেয়ার পর দুটি ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। খিদেও পেয়েছে বেশ। জনসন খাবারের ব্যবস্থা করল।
খেয়েদেয়ে ক্যাপ্টেন এক নতুন ফন্দি আঁটলেন। জনসনকে তিনি আগুন খোঁচাবার শিকটা তাতিয়ে লাল করতে বললেন। বুদ্ধিটা এরকম, তাতানো শিক বরফের ফুটো দিয়ে বের করলে ভালুকরা যেইমাত্র ধরবে অমনি ছ্যাকা খেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়বে আর সে সুযোগে বন্দুকের গুলি ছুড়বেন ক্যাপ্টেন।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। জনসন তাতানো শিকটা ফুটো দিয়ে বাইরে বের করে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই ভালুকেরা শিক চেপে ধরেই বিকট চিৎকার করে উঠল। সেই সুযোগে দ্রুম দ্রুম গর্জে উঠল বন্দুক। আবার তাতিয়ে আনা হল শিক। বাইরে ভালুকগুলো গজরাচ্ছে। এবার ফুটো দিয়ে শিক ঢুকাতে গিয়ে দেখা গেল, কিসে যেন সেটা আটকে যাচ্ছে। আলটামন্ট বুঝে ফেললেন ব্যাপারটা। মুখ কালো হয়ে গেল তার। ভালুকেরা বরফের চাই দিয়ে ফুটো বন্ধ করেছে, এর অর্থ একটাই ভালুকেরা দম বন্ধ করে ওদের মারতে চায়। এদিকে পালাবার রাস্তাও বন্ধ। ভালুকদের এই চতুর পরিকল্পনায় সত্যিই অবাক হতে হয়। কি আশ্চর্যভাবে ওদের জব্দ হতে হচ্ছে পাঁচটা ভালুকের কাছে।
চিন্তায় পড়ে গেলেও বিপদে ভেঙে পড়ার লোক ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস নন। তিনি অভয় দিয়ে বললেন, অত ঘাবরাবার কিছু নেই। রাত নামুক। ছাদে ফুটো করে নেব। তাহলেই অক্সিজেনের অভাব হবে না আর। ফুটো দিয়ে প্রয়োজনে গুলিওছোড়া যাবে। এত সহজে পরাজয় মেনে নেয়া চলে না।
রাত নেমে আসতেই বেল দক্ষ হাতে খুব সাবধানে ছাদ ফুটো করা শুরু করল। এমন সময় হঠাৎ জনসন চিৎকার করে শোবার ঘরের পাহারা ছেড়ে ছুটে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, শোবার ঘরের দেয়ালে কেমন যেন খচখচ শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাইরে থেকে কারা যেন বরফের দেয়াল কাটছে। নিশ্চয়ই ভালুকগুলো ধারাল নখের আঁচড়ে বরফের দেয়াল কেটে আক্রমণ করতে আসছে।
ভালুকগুলোকে প্রতিরোধ করার কোন উপায় ওদের জানা নেই। তার চেয়ে সরাসরি লড়ে মরাই ভাল। এক হাতে কুঠার আর অন্য হাতে ছুরি নিয়ে দেয়ালের দুপাশে ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে গেলেন আলটামন্ট, ক্যাপ্টেন ও জনসন। আর বেল প্রস্তুত রইল বন্দুক নিয়ে।
খচমচ শব্দ দেয়ালের একদম কাছে চলে এল। উত্তেজনায় ঘরের সবাই ঘামছে। এবার দেয়ালটা একটু নড়ে উঠল। তারপরেই বরফের আস্তর ভেঙে কি যেন একটা ঘরের মেঝেতে এসে পড়ল। আলটামন্টও প্রস্তুত ছিলেন কুঠার নিয়ে। কুঠারটাকে পিঠের পিছন দিকে বাঁকিয়ে নিয়ে সজোরে নামিয়ে আনছিলেন কিন্তু মানুষের গলা শুনে থমকে গেল তাঁর হাত! পুরো ঘটনাটাই মাত্র দুতিন সেকেন্ডের ব্যাপার!
একি! আমাকে মারবেন নাকি? গলাটা অতি পরিচিত এবং আকাঙ্ক্ষিত। হাতের কুঠার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে গিয়ে ডক্টরকে জড়িয়ে ধরলেন আলটামন্ট। ডক্টরকে নিজেদের মাঝে ফিরে পেয়ে অভিযাত্রীরা সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল।
জনসনের আনন্দ আর ধরে না! সে উল্লাস করে উঠল, ডক্টর যখন এসে পড়েছেন তখন আর কোন ভাবনা নেই ! এবার ভালুকগুলোকে উচিত শিক্ষা দেয়া যাবে।
ডক্টরও জনসনকে উৎসাহিত করে বললেন, অবশ্যই মজা দেখিয়ে ছাড়ব ওই পাঁচটাকে।
বরফ কেটে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলেন ডক্টর। জনসন তাকে খেতে দিল। ডক্টর বললেন, তিনিও গুলির শব্দ শুনে টিলার উপর উঠে সবই দেখেছেন। দেখেছেন ভালুকদের তাড়া খেয়ে ক্যাপ্টেন, আলটাম ও বেলের প্রাণপণ ছুট। তারপর বললেন, কিভাবে সুযোগ বুঝে চুপি চুপি বারুদ ঘর হয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা ছুরি দিয়ে বরফ কেটে তারপর পৌঁছলেন এই ঘরে।
এবার ভালুক জব্দ করার পরিকল্পনাটা সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন ডক্টর। সকালে একটা শিয়াল মেরেছিলেন তিনি, সেটাকে টোপ বানালেন সারারাত ধরে সবাই মিলে সুড়ঙ্গ কেটে পথ বানালেন বাইরের ঢাল পর্যন্ত। ডক্টর এক খাসা ফন্দি বের করেছেন। সুড়ঙ্গ কাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে সেই শিয়ালটিকে প্রায় একশো পাউন্ড বারুদের ওপর ভালভাবে বেঁধে সুড়ঙ্গের বাইরের দিকটার ছাদে তক্তা মুড়ে দিয়ে চেলাকাঠের সাহায্যে তা ঠেকনা দিয়ে রাখা হল ! আর সেই ঠেকনার ওপর রইল শিয়ালটা। বারুদের সঙ্গে ইলেকট্রিক তার লাগিয়ে টেনে আনা হল ডক্টর হাউস পর্যন্ত। বারুদ জ্বালানর জন্যে এ এক নতুন বুদ্ধি। বারুদের ভেতর দুটো তারই মুখোমুখি জুড়ে দেয়া হল। সংযোগ রইল ডক্টর হাউসের ইলেক্ট্রিক ব্যাটারির সঙ্গে। যাতে স্পার্ক করালেই বিস্ফোরিত হয় বারুদ। একটা দড়ি বাধা খুটির গোড়ায়। দড়িটা বারুদ ঘর পর্যন্ত লম্বা, ওখানে জনসন অন্যপ্রান্ত ধরে বসে থাকবে। দড়ি ধরে টান দিলেই বরফের ছাদ ভেঙে পড়বে নিচে আর ভালুকদের জন্যে রাখা টোপ বের হয়ে আসবে খোলা আকাশের নিচে ! ভালুকরা যেইমাত্র শিয়ালটার কাছে আসবে তক্ষুণি ব্যাটারির স্পার্ক দিয়ে বারুদে আগুন লাগাতে হবে। ব্যস, বিস্ফোরণে উড়ে যাবে ভালুক-বাবাজীরা।
প্ল্যান মাফিক বারুদ ঘরে বসে দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান দিল জনসন। বরফের আস্তর ভেঙে নিচে পড়ে গেল। ভালুকগুলোর সামনে আছড়ে পড়ল শিয়ালটা। প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পর মুহূর্তেই ওরা আঁফিয়ে পড়ল শিয়ালের উপর। ডক্টরও মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে ব্যাটারির সুইচ টিপে দিলেন। ব্যস, আর যায় কোথায়! প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল দৈব-দুর্গ। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল সুড়ঙ্গ। বন্দুক হাতে বাইরে ছুটে এল অভিযাত্রীরা। চারটা ভালুকের ঝলসানো দেহ খন্ডবিখন্ডিত হয়ে পড়ে আছে চারদিকে। আর অন্য ভালুকটা সারা দেহে আগুনের ছ্যাকা নিয়ে তীরবেগে পালিয়ে যাচ্ছে।
ভালুকের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অভিযাত্রীরা। বড় বিপদের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলল ওদের।
আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
পরের পর্ব :
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা