ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল

১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল

ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল চাপে। এবার তিনি ভাবলেন একটা লাইট হাউস তৈরি করা প্রয়োজন। আলোক-স্তম্ভ থাকলে ঘন কুয়াশা বা তুষার ঝটিকার মধ্যেও আলো দেখে বাড়ি ফেরা যাবে। পথ হারিয়ে বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না। লাইট হাউস বসার জায়গাও বেছে নিয়েছেন ডক্টর। বরফ প্রাসাদের পেছনে যে পাহাড়টা, সেটার চূড়া যথেষ্ট উচু এবং লাইট হাউসের জন্যে বেশ উপযোগী।

ডক্টর তার নতুন প্রস্তাব পেশ করতেই আলটামন্ট জানতে চাইলেন, আলো কি দিয়ে জ্বালবেন, ডক্টর? সীলের তেল দিয়ে কি?

না, তেলের আলোর প্রখরতা অনেক কম। তেল দিয়ে চলবে না।

তাহলে কয়লার গ্যাস ছাড়া আর কি আছে!

আলামন্টের কথায় ডক্টর বেশ অবাক হয়েই বললেন, কি যে বলেন! নিজেকে বাঁচানোর জন্যে কয়লা পাওয়া যায় না, আর সেই কয়লা দিয়ে কিনা আলোক স্তম্ভ জ্বালাব।

জনসন বুঝে ফেলেছে ডক্টরের মাথায় অন্য কিছু খেলছে। তাই সে বলল, ডক্টর নিশ্চয়ই আবার নতুন কিছু ভেবে বের করেছেন।

এবার ডক্টর তাঁর পরিকল্পনার কথা বললেন, পরপয়েজের বুনসেন ব্যাটারি দেখেছি, সেটা নষ্ট হয়নি। এটা দিয়েই আলোক স্তম্ভের বাতি জ্বালাব।

বরফের চাঁই দিয়ে পাহাড়ের চূড়ার উপর দশ ফুট উঁচু একটা স্তম্ভ তৈরি করলেন ডক্টর। স্তম্ভের উপর বসালেন জাহাজের একটা বৈদ্যুতিক লণ্ঠন! সেটার সঙ্গে তার জোড়া লাগিয়ে সংযোগ নিয়ে এলেন বরফ প্রাসাদে। সেখানে রাখলেন ব্যাটারিটা। সন্ধ্যায় লণ্ঠনের কার্বন পেন্সিল দুটো মুখোমুখি ধরতেই ব্যাটারি চার্জে জ্বলে উঠল আলো। ডক্টর আর একবার তার কেরামতি দেখিয়ে সবাইকে অবাক করলেন।

আবারও একঘেয়ে হয়ে উঠছে অভিযাত্রীদের জীবন। নতুন কিছুই করার নেই। বিরক্তিকর ঠেকছে সবকিছু। মাঝখানে সপ্তাহ খানেক আবহাওয়া খারাপ থাকায় প্রায় গৃহ বন্দী অবস্থায় দিন কাটাতে হল সবাইকে। ২১ এপ্রিল আকাশ মোটামুটি ভাল থাকায় ডক্টর ক্লবোনি, আলটামন্ট ও বেল বের হল শিকারের খোঁজে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পনেরো মাইল পার হয়েও কোন কিছুই পাওয়া গেল না। এদিক সেদিকে বরফের ফাঁক দিয়ে কিছু গর্ত দেখা গেল। সীল মাছ এসব গর্ত দিয়ে বের হয় শ্বাস নেয়ার জন্যে। ডক্টর ওদের জানালেন, এস্কিমোরা শীতের সঙ্গে লড়বার জন্যে গা গরম রাখতে দৈনিক প্রায় দশ থেকে পনেরো পাউন্ড সীলের মাংস খায়। ডক্টর কথা বলতে বলতেই লক্ষ্য করলেন, দূরে কি যেন একটা নড়ছে।

ডক্টর দূর থেকেই চিনে ফেললেন, ওটা সিন্ধুঘোটক। সবাইকে আওয়াজ করতে একদম বারণ করে দিলেন তিনি। তারপর তিনজন তিন দিক থেকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে বরফের আড়াল থেকে লুকিয়ে গুলি ছুঁড়ল। কিন্তু গুলি ঠিক কাবু করতে পারল না সিন্ধুঘোটককে। তীরবেগে ছুটে পালাতে গেল। আলটামন্ট সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না। ঝুঁকি নিয়ে সোজা পথ আগলে দাঁড়ালেন, আর ক্ষিপ্র বেগে কুঠারের আঘাতে কেটে ফেললেন সিন্ধুঘোটকের দুই পাখা। তবুও রক্তাক্ত দেহে গড়াগড়ি দিয়ে পালাতে চাইল প্রাণীটা। আবার গুলি ছুঁড়ল অভিযাত্রীরা। এবার বরফের উপর রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়ল সিন্ধুঘোটক। উক্টর মেপে দেখলেন, প্রাণীটা লম্বায় প্রায় পনেরো ফুট। তিনি শুধু সুস্বাদু মাংসের অংশটুকু কেটে নিয়ে বাকিটা ফেলে দিলেন।

ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। তবে তেমন অসুবিধা হয়নি। ডাক ওদেরকে অনেকটা পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছে। আর দৈব-দুর্গের কাছাকাছি আসতেই আলোক স্তম্ভের আলো দেখে পথ চিনে নিতে কারও কোন কষ্ট হল না।

ডক্টরের অনেক গুণের একটি হচ্ছে রান্না। পাকা রাঁধুনিও হার মানবে তার কাছে। সিন্ধুঘোটকের মাংস দিয়ে এমন সুস্বাদু কাটলেট বানালেন যা একবার খেলে সহজে কেউ ভুলতে পারবে না। কাটলেট খাওয়াবার পর কফি বানালেন ডক্টর। কফিতে চুমুক দেয়ার ফাকে ফাকে মানুষের উত্তাপ সইবার ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি এমন এক গল্প বললেন যা শুনে সবাই অবাক। মানুষ নাকি তিনশো ডিগ্রি উত্তাপ পর্যন্ত সইতে পারে! সবার শেষে খাওয়া শেষ করে কফিতে চুমুক দিয়েই আর্তনাদ করে বলে উঠলেন, আলটামন্ট, ডক্টর কি আমাদের জিভ পোড়ানোর বন্দোবস্ত করেছেন নাকি, যে এত গরম কফি খেতে দিয়েছেন?

আলামন্টের কথা শুনে ডক্টর বললেন, অভ্যাস থাকলে সবই পারা যায়।

তারপর নিজের কাপে থার্মোমিটার ডুবিয়ে সবাইকে রিডিং দেখালেন-১৩১ ডিগ্রি! তারপর বেশ মজা করে চুমুক দিয়ে দিয়ে খেতে লাগলেন কফি। ডক্টরের দেখাদেখি বেলও যেই চুমুক দিয়েছে অমনি চিৎকার করে উঠল সে। গরমে জিভ পুড়ে গেছে তার।

ডক্টর বললেন, অভ্যাস না থাকলে এমনই হয়। কিন্তু অভ্যাস থাকলে যে কি বিস্ময়কর উত্তাপ মানুষ সইতে পারে তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। ফ্রান্সের এক রুটি কারখানায় কয়েকটি মেয়ে বাজি ধরে তিনশো ডিগ্রি উত্তাপে দশ মিনিট দাঁড়িয়েছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এত উত্তাপেও ওদের কিছুই হয়নি অথচ পাশে রাখা ডিম আর মাংস সিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বরফ প্রাসাদে বসে ডক্টরের মুখ থেকে মানুষের অবাক করা ক্ষমতার কথা শুনে শীতের দিনেও যেন ঘেমে উঠল সবাই। সত্যি বড় আশ্চর্য মানুষের ক্ষমতা!

আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
পরের পর্ব :
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত