১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল। এবারের পথ প্রায় চারশো মাইল। সময় লাগবে দুসপ্তাহের কিছু বেশি। লক্ষ্যস্থল পরপয়েজ জাহাজ। আলটামন্টের কাছ থেকে জানা গেছে, জাহাজে খাবারের কোন অভাব নেই। নেই কয়লার অভাব। রসদপত্র যা প্রয়োজন সবই আছে। একবার কোনমতে পরপয়েজে পৌঁছতে পারলেই হল। শীতটা আরামে কাটিয়ে বরফ গলা শুরু হলে দেশে ফিরে যাওয়া যাবে। পরপয়েজ তিন মাস্তুলের জাহাজ ! পাহাড়ের গায়ে কাত হয়ে পড়লেও জাহাজের তেমন ক্ষতি হয়নি। সামান্য মেরামত করেই সমুদ্রে নামানো যাবে।
ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে আলটামন্ট আরও জানালেন বরফ প্রান্তরে বন্দী অবস্থায় ভেসে গিয়ে পাহাড়ে ঠেকেছে পর পয়েজ। দুমাস আগে পরপয়েজে করে স্মিথ প্রণালীর দিকে রওনা হয়েছিলেন আলটামন্ট। পথে সঙ্গীসাথীরা সবাই মারা গেলেও তিনি বেঁচে গেলেন ফরওয়ার্ডের অভিযাত্রীদের সহায়তায়।
হ্যাটেরাস আবার জানতে চাইলেন, তিরিশ ডিগ্রিতে খোলা সমুদ্র দেখতে পেয়েছিলেন কি?
আলটামন্ট জানালেন, না।
বরফ সমুদ্রের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছে ওরা। জনসন একটা কথা ভেবে ভয় পাঁচ্ছিল, শেষমেষ কথাটা বলেই ফেলল সে, খোলা সমুদ্রের উপর বরফ তো জমে আছে ঠিকই। কিন্তু কখন যে পায়ের তলার বরফ সরে গিয়ে সোজা সমুদ্রের পানিতে পড়তে হয়, সেটাই ভয়!
জনসনের কথা শুনে ডক্টর হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, তোমার অত ঘাবড়াবার কিছুই নেই। এসমস্ত অঞ্চলে বরফ প্রায় তিরিশচল্লিশ ফুট পুরু হয়। তাছাড়া এটা বোধহয় জান না যে দু-ইঞ্চি পুরু বরফ অনায়াসে একজন মানুষের ভার সইতে পারে। ঘোড়াসহ ঘোড়সওয়ারের ভার বইতে সাড়ে তিন ইঞ্চি বরফই যথেষ্ট। একটা সেনা-ডিভিশন নির্বিঘ্নে দশ ইঞ্চি পুরু বরফের ওপর দিয়ে মার্চ করে যেতে পারে।
জনসন এবার আশ্বস্ত হল। হঠাৎ বরফস্তর ভেঙে গিয়ে পা পিছলে সমুদ্রে তলিয়ে যাবার কোন ভয় নেই!
পথ আর শেষ হয় না। ইতিমধ্যে কেটে গেছে আরও ষোলোটি দিন। আজ ১৪ মার্চ। কিন্তু এখনও পরপয়েজে যেতে প্রায় একশো মাইল পথ বাকি। খাবার-দাবার যা কিছু ছিল সবই প্রায় শেষ হয়ে গেছে। অভিযাত্রীদের চলার শক্তি নেই বললেই চলে। জীবজন্তু শিকার করার মত গুলিগোলাও নেই। মাত্র ছয়টা কার্তুজ আছে। গোটাকয়েক শিয়াল আর খরগোস এদিক-সেদিক দেখা গেলেও সেগুলো মারা সম্ভব হল না। ডক্টর ছোট একটা সীল মাছ পেয়ে সেটাকেই গুলি করে মারলেন। কিন্তু একটা সীলের মাংসে কি আর পাঁচজনের পেট ভরে! শেষ পর্যন্ত পেটে ক্ষুধা নিয়েই আবারও ওরা পথ চলতে লাগল।
ক্ষুধার্ত শরীরে সারাদিন পথ চলতে গিয়ে ক্লান্তিতে ওদের শরীর ভেঙে পড়তে চায়। সন্ধ্যা নেমে আসতেই ইগলু বানিয়ে স্টোভ জ্বালিয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। রাতে আর খাবার খেল না কেউ। কেননা এখনও যেটুকু খাবার অবশিষ্ট আছে তা আধপেটা খেলেও ওদের দুদিনের বেশি চলবে না।
পরদিন ওদের পথ চলার গতি আরও কমে এল। শরীরে নেই শক্তি। পেটে ক্ষুধা! হেঁটে চলার শক্তি পাবে কোত্থেকে? ডক্টর কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন শিয়াল মারার। অনর্থক আরও কয়েকটি কার্তুজ নষ্ট হল। গুলির আওয়াজে অন্যেরা ভেবেছিল, ডক্টর বোধহয় কোন কিছু মেরে আনলেন। কিন্তু তাকে খালি হাতে ফিরে আসতে দেখে হতাশায় ওদের চোখ-মুখ আরও কালো হয়ে গেল।
রোববার রাতে অবশিষ্ট খাবারটুকুও শেষ হল। সবাই ভাবছে, এখন কি করা যায়! এমন সময় জনসন দেখল, দূরে স্লেজ গাড়ির কাছে একটা ভালুক খাবার আছে কিনা কে দেখছে। আর যায় কোথায়! শিকার হাতের কাছে। জনসন ছুটে গিয়ে ডক্টরের কাছ থেকে বন্দুক নিয়ে দৌঁড়াল ভালুকটাকে মারতে। কাছাকাছি এসে গুলি করতে গিয়ে দেখল, নিশানা করতে পারছে না। হাত কাঁপছে। হাতের দস্তানার জন্যেও অসুবিধা হচ্ছে। পরিণাম কি হতে পারে না ভেবেই চট করে হাত থেকে দস্তানা খুলে ফেলে ভালুকটাকে গুলি করতে গেল সে। দস্তানা খুলতেই হাড় কাঁপানো শীতে চিৎকার করে উঠল জনসন! বন্দুকটি বরফের ওপর ছিটকে পড়ে শেষ গুলিটিও খামোকা নষ্ট হল। শীতের এতই প্রকোপ যে মুহূর্তের মধ্যে আঙুল জমে ট্রিগারে আটকে গিয়েছিল। জনসনের চিৎকারে ছুটে এলেন ডক্টর। ওকে ইগলুর ভেতরে নিয়ে অল্প গরম জলে ওর আঙুল চোবালেন। তারপর মালিশ করে, ঘষে, সুস্থ করে তুললেন জনসনকে।
সুস্থ হয়ে উঠতেই অনুশোচনায় ভেঙে পড়ল জনসন। বারবার শুধু একই কথা বলতে লাগল সে-তার নির্বুদ্ধিতার জন্যেই শেষ বুলেটটিও খরচ হয়ে গেল। এখন চলবে কি করে?
ওদের ভরসা ডক্টর ক্লবোনি। যাই হোক না কেন একটা কিছু উপায় তিনি বের করবেনই। পরদিন ওদের চলার গতি শম্বুক গতিকেও হার মানাল। সারাদিনে ওরা পথ পেরোল মাত্র তিন মাইল! পেটে একফোটা খাবার পড়েনি। কুকুরগুলোরও একই অবস্থা! খিদের জ্বালায় নিজেদের মধ্যে কামড়া-কামড়ি করছে। এই সমস্ত অঞ্চলের লোকেরা শরীর সুস্থ রাখার জন্যে সারাদিন ভরপেট খায় আর ওরা আজ প্রায় দেড়দিন কিছুই খেতে পায়নি। এর আগেও আধপেটা খেয়ে কাটিয়েছে। তাই চলার শক্তি বলতে আর কিছুই ওদের অবশিষ্ট নেই। কিন্তু ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস এখনও নিরাশ হয়ে পড়েননি। এরকম শারীরিক ও মানসিক অবস্থাতেও তিনি রাত ফুরোতেই আবার যাত্রা শুরু করলেন। এবার আর হ্যাটেরাস নির্দয় হতে পারলেন না। দুই ঘণ্টা চলার পর তিনি দেখলেন কেউই আর পা ফেলে এগোতে পারছে না। অগত্য তিনি জনসনকে নিয়ে ইগলু বানালেন। খাবার না হয় না-ই পাওয়া গেল। অন্তত শান্তিতে একটু বিশ্রাম অবশ্যই প্রয়োজন। সারাদিন ওরা মড়ার মত শুয়ে থাকল। কে ঘুমাচ্ছে আর কে জেগে আছে তা কিছুই বোঝা গেল না।
রাতের বেলা হঠাৎ জনসন ভয়ে চিৎকার করে উঠল। দুঃস্বপ্ন দেখে ওর ঘুম ভেঙে গেছে। একটা ভালুক ওকে তাড়া করেছিল; আর একটু হলেই ধরে ফেলত আর কি! জনসন বলল গত দুদিন ধরেই ও লক্ষ্য করছে একটা ভালুক ওদের পিছু নিয়েছে। সারাক্ষণ ভালুকের কথা ওর মাথায় থাকলেও এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেনি সে। জনসনের কাছে ভালুকের কথা শুনে ডক্টর তো আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠলেন।
তিনি ভাবলেন-যাক, সাময়িকভাবে কিছু খাবারের জোগাড় হয়ত হল।
ডক্টরের মনোভাবের কথা জানতে পেরে অন্যেরা তো অবাক! বুলেট নেই ভালুক মারবেন কি করে!
ডক্টর ওদের আশ্বস্ত করলেন, বুলেট নেই তো কি হয়েছে? বানিয়ে নেব। থার্মোমিটারের পারা দিয়ে গুলি বানাব।
ডক্টর ওদেরকে আর কোন প্রশ্ন করতে না দিয়ে ইগলুর বাইরে এসে থার্মোমিটারটা বরফের ওপর রাখলেন। অভিজ্ঞ ক্লবোনি বুঝতে পারলেন, বাইরের তাপমাত্রা শূন্য তাপাঙ্কের প্রায় পঞ্চাশ ডিগ্রি নিচে। সুতরাং থার্মোমিটার বাইরে রাখতে না রাখতেই সেটার পারা শূন্য তাপাঙ্কের উনচল্লিশ ডিগ্রিতে এসে জমে শক্ত হয়ে গেল। ডক্টর খুব সাবধানে থার্মোমিটারের কাঁচ ভেঙে জমাট পারদটুকু বের করে নিলেন। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল সকালে এটা দিয়েই মারব ওই ভালুকটা।
ডক্টরের কথায় সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকাল তাঁর দিকে। কি সব অবিশ্বাস্য কথা বলছেন ডক্টর! মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল না তো?
এদিকে ডক্টর বলেই চলেছেন, এই পারদটুকুই আমাদের জীবন বাঁচিয়ে দেবে। তোমরা জান, জেমস রস জমাট পারার বুলেট দিয়ে কাঠ ফুটো করেছিলেন। এমনকি বাদাম তেলের জমাট বুলেট দিয়েও রস কাঠ ফুটো করেছিলেন…।
ডক্টর আরও কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু ক্যাপ্টেন ইগলু থেকে বের হয়ে জানতে চাইলেন, ডক্টরের মতলবটা কি! সব শুনে ক্যাপ্টেন বললেন, আমি ভালুক মারব। আমাকেই পারদটা দিন।
ক্যাপ্টেন আবারও বললেন, এই ভালুক মারার উপরই নির্ভর করছে আমাদের সবার জীবন। তাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও খুব কাছে গিয়ে গুলি করতে হবে যাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়।
ক্যাপ্টেনকে এই বিপদের মাঝে যেতে দিতে আপত্তি জানালেন ডক্টর। হ্যাটেরাস তখন সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, ভয়ের কোন কারণ নেই। আমার কিছুই হবে না। সীল মাছের চামড়া পরে একদম কাছে গিয়ে দ্রুম ! ব্যস, ভালুক বাবাজী অক্কা পেয়ে যাবে। সীল মাছ দেখলে ভালুক মোটেও ভয় পায় না। বরং ভাল শিকার মনে করে গোঁফে তা দেয়।
পরদিন সকাল। ক্যাপ্টেন ইগলুর ভেতরেই সীলের চামড়াটা গায়ে জড়িয়ে নিলেন। ডক্টর বন্দুকে গুলি ভরে দিলেন। নলের ভিতরে পারদটুকু ঠেসে ভরা হল। ক্যাপ্টেন তৈরি হয়ে নিলেন। চামড়ার নিচে বন্দুক লুকিয়ে বের হয়ে পড়লেন তিনি।
ক্যাপ্টেনের কান্ড দেখে সবাই অবাক! এমনভাবে তিনি হেলেদুলে হামাগুড়ি দিয়ে বরফের উপর এঁকে বেঁকে চলতে লাগলেন যে কিছুতেই তাঁকে সীল মাছ ছাড়া অন্যকিছু বলে মনে হয় না। ক্যাপ্টেন চালাকি করে এদিক সেদিক ঘুরে আস্তে আস্তে ভালুকটার দিকে এগোচ্ছেন। যেন পথহারা সীল বরফের ফুটো খুঁজছে! সীল দেখেই ভালুকের চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল। অসহায় সীল মেরে বেশ খাওয়া যাবে। কতদিন ভালুকটা শিকার পায়নি কে জানে!
যখন সীল মাছটা একদম কাছাকাছি চলে এল অমনি মহানন্দে ভালুকটা ছুটে গেল সীলের ঘাড় মটকাতে! কিন্তু বেচারা জানে না জীবনের সবচাইতে বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে ওর জন্যে!
সীল মাছের হাততিনেক সামনে আসতে না আসতেই প্রচন্ড ভয়ে পেছনের দুপায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে পড়ল ভালুক! ক্যাপ্টেন তার সীলের ছদ্মবেশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রণমূর্তি ধারণ করেছেন। মুহুর্তেই গুলি করলেন ? অব্যর্থ নিশানা। গুলি সোজা ফুটো করে দিয়েছে ভালুকের হৃৎপিন্ড। ভালুকের আর শিকার করা হল না। নিজেই পরিণত হল অন্যের শিকারে! মেরু অভিযাত্রীদের মাঝে আবার প্রাণের সঞ্চার হল।
আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
পরের পর্ব :
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা