ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে

১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে

অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে অভিযাত্রীদের। সিম্পসনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। বাঁচার কোন আশাই নেই। ডক্টরকে চোখের সেই ছোঁয়াচে রোগে পেয়ে বসেছে। চোখের যন্ত্রণায় রীতিমত কাহিল অবস্থা তার বেশি অনিয়ম হলে অন্ধ হয়ে যাবার ভয় আছে। চলার পথ এখন আরও দুর্গম। মাঝে মাঝে স্লেজ ঘাড়ে করে অনেক উঁচু পাহাড়ে উঠতে হচ্ছে। তার ওপর তুষার ঝড় তো আছেই। তবু ক্যাপ্টেন নির্ভিকভাবে এগিয়েই চলেছেন।

২৫ জানুয়ারি মস্ত এক বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেলেন ক্যাপ্টেন ও তার সঙ্গীরা। সেদিন বেশ ঝড় বইছিল। রাতে ইগলুর ভেতর ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ডক্টর উঠে বসতে গেলেন কিন্তু মাথা ঠুকে গেল ইগলুর ছাদে। সময়মত টের পেয়েছিলেন বলে সবাইকে ঝটপট ইগলুর বাইরে বের করে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। ডক্টর জেগে না উঠলে ইগলুর ছাদ ধসে গিয়ে সবারই জীবন্ত সমাধী হয়ে যেত।

পরদিন পথে একটি আমেরিকান বন্দুক কুড়িয়ে পেল বেল। সম্ভবত ওটা পরপয়েজের নাবিকদের কারও ছিল। এ ছাড়াও পাওয়া গেল একটা সেক্সট্যান্ট আর একটা ফ্ল্যাস্ক। এসব দেখে সবাই ভাবল পরপয়েজের নাবিকদের সঙ্গে শিগগিরই হয়তো দেখা হবে ওদের। হ্যাটেরাস কিন্তু মোটেও খুশি নন। পরপয়েজের অসহায় নাবিকদের এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন বেঁচে যান তিনি।

২৭ জানুয়ারি ফরওয়ার্ডের অভিযাত্রীদের জন্যে সবচেয়ে বেদনার দিন। সন্ধ্যার দিকে সিম্পসনের অন্তিম সময় ঘনিয়ে এল। এদিকে তুষারের ঝাপ্টা ও ঝড়ের বেগও বাড়ছে। তিন তিনবার চেষ্টা করেও ওরা তাঁবু খাটাতে পারল না। তুষার-কণা সুচের মত এসে বিধছে ওদের চোখে-মুখে। মৃত্যু পথের যাত্রী সিম্পসন খোলা আকাশের নিচে শুয়ে শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা করছে। দাঁতে দাঁত লেগে ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। দেহে প্রাণের স্পন্দন কমে আসছে, তবুও জুলন্ত চোখে সে চেয়ে আছে হ্যাটেরাসের দিকে। শেষ মুহুর্তে দেহের সর্বশক্তি দিয়ে শেষবারের মত উঠে বসল সিম্পসন। নিঃশব্দে ক্যাপ্টেনের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তার এ পরিণতির জন্যে দায়ী করল ক্যাপ্টেনকে। তারপরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল সে। অসম্ভবকে জয় করার অভিযানে প্রথম মৃত্যু! ফরওয়ার্ডের ১৭ জন অভিযাত্রীর অভিযানের প্রথম আত্মদান।

এই প্রথম ক্যাপ্টেনের আর এক রূপ দেখার সৌভাগ্য হল ওদের। পলকহীন দৃষ্টিতে সিম্পসনের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আছেন ক্যাপ্টেন তার গাল বেয়ে নেমে এল ছোট্ট এক ফোটা অশ্রু। মাঝপথে জমে বরফ হয়ে গেল সেটা। সারারাত একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন। তাঁর এই মূর্তি অবাক করল ডক্টর আর বেলকে।

ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের দাপাদাপি অনেকটা কমে এল। বেশ কদিন পর সকালে সূর্যের মুখ দেখা গেল। আকাশে সূর্য উঠলেও হ্যাটেরাসের মনের আকাশ তখন কালো মেঘে ঢাকা। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে ক্যাপ্টেন বলে উঠলেন, ডক্টর, বেল, যে জায়গায় কয়লা আছে বলে বেলচার উল্লেখ করেছেন তা এখান থেকে আরও প্রায় ষাট মাইল দূরে। আমাদের এখন যা অবস্থা, তাতে সামনের দিকে এগোলে মৃত্যু অবধারিত। তারচেয়ে বোধহয় ফিরে যাওয়াই ভাল।

বেশ। তাহলে ফিরেই যাওয়া যাক। ক্যাপ্টেনের কথায় সানন্দে রাজি হলেন ডক্টর। বেলও একমত।

তাহলে যাত্রা শুরুর আগে দুএকটা দিন বিশ্রাম নিলে মন্দ হয় না, কি বলেন? আবারও নরম গলায় বললেন ক্যাপ্টেন। এতেও কারও অমত নেই।

বিশ্রামের দুদিন স্লেজ মেরামত, পোশাক সেলাই ইত্যাদি কাজ সারল ওরা। ডাককে এবার জুড়ে দেয়া হবে গাড়ির সঙ্গে। দুটো কুকুর পথে মারা গিয়েছিল। ডাক ওদের বদলে টানবে স্লেজ। তাছাড়া এখন মালপত্রের ওজনও অনেক কম। মাত্র দুশো পাউন্ডে এসে ঠেকেছে।

৩০ জানুয়ারি। সকাল থেকেই ডক্টর লক্ষ করলেন উত্তেজিতভাবে ডাক একটা স্তুপের সামনে গিয়ে বারবার ঘেউ ঘেউ করছে, তারপর আবার ফিরে আসছে। ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠেছে সে। হয়ত সিম্পসনের কথা এখনও ভুলতে পারছে না সে। মানুষের প্রতি কুকুরের প্রেম কারও অজানা নয়। হঠাৎ কি জানি কেন, ডক্টরের ইচ্ছে হল-ডাক যে বরফ স্তুপের সামনে বারবার গিয়ে ফিরে আসছিল সিম্পসনের মৃতদেহ তিনি সেখানেই গর্ত করে কবর দেবেন বলে ঠিক করলেন। বেলসহ বরফ স্তুপের কাছে গিয়ে আলগা তুষার সরিয়ে গাঁইতি দিয়ে শক্ত বরফ কাটতে শুরু করলেন তিনি। ডক্টর গাঁইতি দিয়ে জোরে এক ঘা মারতেই ঠং করে একটা বোতল গুড়িয়ে গেল ! চমকে উঠল সবাই। এখানে বোতল এল কিভাবে? বেল ততক্ষণে গাইতির আঘাতে তুলে এনেছে একটা ব্যাগ। ব্যাগের ভিতর কিছু বিস্কুটের গুড়ো ! খুশি হয়ে উঠল ওরা সবাই। তাহলে কি খাবারের কোন গোপন ভান্ডার মিলল? দ্বিগুণ উদ্যমে ডক্টর ও বেল গাইতি চালাতে লাগল। একটি বরফের চাই ভেঙে সরে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল বেল। দুটো পা! মানুষের দুটো পা দেখা যাচ্ছে!

বরফের নিচ থেকে বের করা হল লাশটি। মারে কাঠ হয়ে আছে। বয়স বছর তিরিশেক হবে। খুঁড়তে খুঁড়তে বয়স্ক লোকের আর একটি মৃতদেহ পাওয়া গেল। একই অবস্থা। মেরু অভিযাত্রীর পোশাক দুজনেরই গায়ে। আরও একজনকে টেনে আনল ওরা। কি মনে করে দেহটিকে খুব ভাল করে পরীক্ষা করলেন ডক্টর। তারপর বেলের দিকে ফিরে বললেন, নাড়ির স্পন্দন প্রায় নেই বললেই চলে; তবুও চেষ্টা করতে দোষ কি? জলদি একে স্লেজে নিয়ে চল।

লোকটার বয়স চল্লিশের কোঠায়। পকেটে কি আছে দেখতে গিয়ে একটা আধপোড়া খাম রের হল। খামে অনেকটা সাঙ্কেতিক অক্ষরের মত করে লেখা–টামন্ট…পয়েজ… ইয়র্ক। অবশ্য পুড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে।

জ্ঞানের আধার ডক্টর ক্লবোনির বেশি সময় লাগল না পোড়া খামের বাকি লেখা মিলিয়ে ফেলতে। কি হতে পারে বের করার আনন্দে চিৎকার করে তিনি সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন। ওটা হবে আলটামন্ট-পরপয়েজ-নিউ ইয়র্ক। অর্থাৎ নিউ ইয়র্ক পরপয়েজ জাহাজের আলটামন্ট।

ক্লবোনির উল্লাসে ক্যাপ্টেন কিছুতেই খুশি হতে পারলেন না। তিনি দাঁত চেপে এমনভাবে আমেরিকান! কথাটা উচ্চারণ করলেন যে কারও বুঝতে বাকি রইল না হ্যাটেরাস কি বোঝাতে চান। ক্যাপ্টেন কোন উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চান না। সবচেয়ে বড় কথা, কোন আমেরিকান ওদের সঙ্গী হবে এটা যেন তার সহ্যের বাইরে। তবুও ডক্টর বললেন, আমেরিকান হলেও কোন মৃত্যু পথযাত্রীকে অসহায় ফেলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি আলটামন্টকে বাঁচিয়ে তুলতে চান।

সিম্পসনকে বরফ খুঁড়ে সমাহিত করার পর আলটামন্টকে স্লেজে শুইয়ে দেয়া হল। এবার শুরু হল ফিরতি যাত্রা।

অবর্ণনীয় পথশ্রম পদে পদে নানারকম বিপদের মাঝেই কেটে গেল আরও কটি দিন। অভিযাত্রীরা ফরওয়ার্ডের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ক্যাপ্টেন একটি দৃশ্য দেখে হতচকিত হয়ে পড়লেন। ফরওয়ার্ড যেদিকে, সেদিকের আকাশে কালো ধোঁয়া! ক্যাপ্টেন পাগলের মত চিৎকার করে উঠলেন, নিশ্চয়ই শয়তান, বিশ্বাসঘাতক নাবিকেরা ফরওয়ার্ডকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ঘণ্টাখানেক অতি দ্রুত বেগে দৌড়ে এসে ওরা থামল জ্বলন্ত ফরওয়ার্ডের কাছে। দেখল, জনসন ক্ষোভে পাগলের মত হাত পা ছুড়ছে। পরক্ষণেই প্রচন্ড বিস্ফোরণে জাহাজের বারুদ ঘর উড়ে গেল। চৌচির হল বরফ প্রান্তর। এ দৃশ্য দেখে ক্যাপ্টেন যেন বোবা হয়ে গেলেন। অসহায় দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে রইলেন আগুনের লেলিহান শিখার দিকে। দেখলেন, তার সাধের ফরওয়ার্ড কিভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

একদিন নয়, দুদিন নয়, নয়-নয়টি মাস অবর্ণনীয় কষ্ট, পথশ্রমের পর আজ এ কি হল! এই পরিণাম হবে তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? স্থাণুর মত দাঁড়িয়েই থাকলেন ক্যাপ্টেন। তিনি চেয়েছিলেন বরফ রাজ্যে অনাবিষ্কৃত সমুদ্র আবিষ্কার করে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেবেন। ফরওয়ার্ডের অভিযাত্রীরা বিজয়ের গর্বে বুক চিতিয়ে হাঁটবে দেশের মাটিতে। কিন্তু হায়! সব আশাই বুঝি শেষ হয়ে গেল।

আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
পরের পর্ব :
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত