ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর

১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর

বিশাল বরফ প্রান্তর। হাড় কাঁপানো শীত। জ্বলন্ত ফরওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন, ডক্টর ক্লবোনি, বেল আর জনসন। সতেরোজনের একজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। বারোজন বিশ্বাসঘাতকতা করে নৌকা নিয়ে পালিয়েছে। আর অসহায় ওরা চারজন রয়ে গেছে বরফ রাজ্যে। সহায়-সম্বলহীন। না আছে রসদ, না জ্বালানি কিংবা আশ্রয়! ফিরে যাবার জন্যে জাহাজ তো দূরের কথা, একটা নৌকাও নেই। দেশে ফিরতে চাইলে এখনও পাড়ি দিতে হবে কম করে হলেও আড়াই হাজার মাইল।

বিস্ফোরণে জাহাজের সবকিছু চারদিকে বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। কামানটা পড়েছে কিছুদূরে একটা হিমশিলার ওপর। চারদিকে শুধু লোহালক্কড়, দুমড়ানো মুচড়ানো যন্ত্রপাতি, কাঠের টুকরো এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এখানে-সেখানে এখনও আগুন জ্বলছে। বরফ গলে গিয়ে আবার জমতে শুরু করেছে।

জনসন আপ্রাণ চেষ্টা করেছে ফরওয়ার্ডকে বাঁচাতে। কিন্ত শ্যানডন ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে একা পেরে ওঠেনি। তাই গুম হয়ে আছে সে। একথা সেকথার পর জনসন হঠাৎ লক্ষ্য করল সিম্পসন ওদের সঙ্গে নেই। সিম্পসনের অসহায় মৃত্যুর কথা শুনে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল জনসনের মন। তারপর যখন শুনতে পেল কয়লা আনা হয়নি তখন রীতিমত হতাশ হয়ে পড়ল সে। চুপচাপ অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর জনসন বলল, যা হবার তা তো হবেই। শুধু শুধু দুশ্চিন্তা না করে দেখা যাক ধ্বংসস্তুপ থেকে কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা। ডক্টর ও জনসন দুজন দুদিকে বের হল কি পাওয়া যায় খুঁজে দেখতে। ক্যাপ্টেন ভগ্নহৃদয়ে নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন কয়লা হয়ে যাওয়া ফরওয়ার্ডের সামনে।

ডক্টরকে ডেকে স্লেজ গাড়িটা নিয়ে আসতে বলল জনসন স্লেজে মৃতের মত শুয়ে আছেন আলটামন্ট। এদিকে বেল নিদারুণ হতাশায় বরফের উপরই শুয়ে পড়েছিল। জনসন বকে-ঝকে সান্ত্বনা দিয়ে তাকে বোঝাল, হতাশ হয়ে পড়লে চলবে না। মনোবল শক্ত রেখে কাজ করে যেতে হবে।

বেলকে নিয়ে জনসন একটা ইগলু বানিয়ে ফেলল। ডক্টর একটা স্টোভ মোটামুটি অক্ষত অবস্থায় পেয়েছিলেন, সেটায় আগুন জ্বালানো হল। আবার কিছুটা উদ্যম ফিরে এল ওদের মাঝে।

খাবারের পালা চুকিয়ে ডক্টর আর জনসন বের হল ধ্বংসস্তুপে আর কি পাওয়া যায় খুঁজে বের করতে। চাঁদের আলো থাকাতে সবকিছু খুঁজে ফিরতে ওদের বেশ সুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। কিছু শুকনো মাংস, চারটা বোতলে কিছু ব্র্যান্ডি, কয়েক ব্যাগ বিস্কুট, চকোলেট, কফি এসব ছাড়া আর তেমন কিছুই উদ্ধার করা গেল না।

আলটামন্টের শারীরিক অবস্থায় এখনও তেমন কোন উন্নতি হয়নি। স্কার্ভিতে ভুগে বেচারার অবস্থা রীতিমত কাহিল। এখনও মড়ার মত পড়ে আছেন তিনি। অন্যেরাও মানসিক দিক দিয়ে আলামন্টের মতই নিস্তেজ।

জনসন জানাল, শ্যানডনরা কিভাবে মদে চুর হয়ে নৌকা নিয়ে পালিয়েছে। আর পেন ক্যাপ্টেনের উপর প্রতিশোধ নিয়েছে জাহাজে আগুন লাগিয়ে। বারবার এত আপদ-বিপদ সয়ে সহ্যশক্তি বেড়ে গিয়েছিল সবার, তাই জনসনের কথা শুনে ওদের আর তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হল না।

এত ঝড়-ঝাপটার পর আর উত্তরে যাবার সখ কারও থাকার কথা নয়। ডক্টর তাই পশ্চিমে ফিরে যাবার প্রস্তাব দিলেন। যে যাই বলুক না কেন ক্যাপ্টেন কিন্তু উত্তর মেরু যাবার জন্যে এখনও একপায়ে খাড়া। তাই তিনি কৌশলে ডক্টরের মত পরিবর্তনের জন্যে বললেন, পশ্চিমের পথ তো তাদের সবার কাছেই অজানা!

ডক্টর বুঝে গেছেন ক্যাপ্টেন কি বলতে চান। তাই কিছুটা রাগতঃস্বরে তিনি বলে উঠলেন, পথ জানা বা অজানা যাই হোক না কেন আমরা পশ্চিমেই যাব। ইংল্যান্ড উত্তরে নয় পশ্চিমে!

বেল আর জনসনকে তার দলে আনতে চেষ্টা করলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু ওরা ডক্টরের পক্ষে রইল।

ডক্টর ওদের উৎসাহ দিয়ে বললেন, যদিও পশ্চিমে যেতে প্রায় দুশো মাইল পথ পার হতে হবে। তবুও স্লেজে করে গেলে বেশি দিন লাগবে না। মার্চ মাসের শেষ নাগাদ সমুদ্রের ধারে পৌঁছে যাওয়া যাবে। প্রতিদিন গড়ে কুড়ি মাইল করে হাঁটলেই চলবে। তেমন কষ্টও হবে না।

ডক্টরকে যখন তার সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যাবেই না তখন ক্যাপ্টেন তাকে শুধু আর একটা দিন অপেক্ষা করে যেতে বললেন। ডক্টর, বেল অথবা জনসন কেউই ক্যাপ্টেনের প্রস্তাবে রাজি হল না। তখন ক্যাপ্টেন মিনতি জানিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমি জানি, উত্তরে বাঁচার পথ আছে বললে কেউ সে কথা শুনবে না। কিন্তু তোমরা বিশ্বাস কর, উত্তরেই আছে স্মিথ প্রণালী, খোলা সমুদ্র। একবার যেতে পারলেই হয়। শীত তো প্রায় কমে আসছে। আর কিছুটা কমলেই আমাদের আর কোন অসুবিধা হবে না।

ক্যাপ্টেনের মিনতি ওদের মোটেও বিচলিত করল না। জনসন আবেগে কাজ করে না। ঠান্ডা গলায় সে বেলকে বলল, চল স্লেজের সবকিছু ঠিকঠাক করে নেই।

তুমিও! জনসন, তুমিও আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছ? ক্যাপ্টেন একদম ভেঙে পড়লেন।

এবার বিপাকে পড়ে গেল জনসন। কি করা যায়? এতদিনই যখন ক্যাপ্টেনের নির্দেশ ওরা সবাই মেনেছে। আজ ক্যাপ্টেনের অনুরোধে একটা দিন থেকে গেলে কি এমন এসে যায়? জনসন তাকাল বেল আর ডক্টরের দিকে। দেখল, ওদের চোখেমুখেও সম্মতির ভাব উঠেছে।

এদিকে একই সময়ে আলটামন্ট শোয়া থেকে উঠে এসে হাঁটু গেড়ে বসেছেন, এখনও তার শরীর খুবই দুর্বল। জনসনের হাত ধরে নাড়া দিলেন তিনি। তুষারের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ঠোঁটে কিছু বললেন জনসনকে। বিকৃত স্বর শোনা গেল, এক বর্ণও বোঝা গেল না।

অনেক কষ্টে শুধু একটা কথা বোঝা গেল-পরপয়েজ।

পরপয়েজ!-অবাক ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস।

কোথায় আছে? এখানে? আবারও প্রশ্ন করলেন ক্যাপ্টেন।

আলটামন্ট ঘাড় কাত করে জানালেন এখানেই আছে পরপয়েজ।

এবার ক্যাপ্টেন একের পর এক প্রশ্ন করলেন আর আলটামন্ট ঘাড় কাত করে হ্যাঁ-না বলে দিলেন। এভাবেই বেশ সময় নিয়ে ক্যাপ্টেন পরপয়েজের অবস্থান বের করে ফেললেন। পরপয়েজ জাহাজ পড়ে আছে একশো বিশ ডিগ্রি পনেরো মিনিট লঙ্গিচিউড এবং তিরাশি ডিগ্রি পঁয়ত্রিশ মিনিট ল্যাটিচিউডে।

অন্যেরা সবাই পরপয়েজের সন্ধান জেনে আনন্দিত হলেও ক্যাপ্টেন অত্যন্ত নাখোশ হলেন। কেননা পরপয়েজ যে তার চাইতেও তিন ডিগ্রি বেশি উত্তরে এগিয়ে গেছে! এ যে তারই ব্যর্থতা।

আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
পরের পর্ব :
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত