ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ

১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ

প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ পার হলেন ক্যাপ্টেন। সন্ধ্যা নামতেই বরফ দিয়ে ইগলু বানিয়ে রাত যাপনের ব্যবস্থা করা হল। সারাদিনের পথ চলায় সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাতের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন ও তার সঙ্গীরা।

শীতের প্রকোপ কমার কোন লক্ষণই যেন নেই। আপাদমস্তক গরম কাপড়ে আবৃত থাকা সত্ত্বেও অভিযাত্রীরা সবাই যেন জমে যাচ্ছে! শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। কথা বললেই ঠোঁটে বরফ জমে যায়। এই অবস্থাতে ১৫ জানুয়ারি একশো মাইল পথ পাড়ি দিল ক্যাপ্টেনরা। আর সেদিনই দুপুরে একদল হিংস্র জন্তুর হামলায় স্লেজের প্রায় সবকিছুই খুইয়ে বসল ওরা।

দুপুরের খাবার খেয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিল সবাই। ডক্টরের কড়া নির্দেশ–শীতে জমে যাবার হাত থেকে রক্ষা পেতে চাইলে প্রতিদিন কিছুটা সময় হাঁটাহাঁটি করে শরীরকে চাঙা রাখতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে ছোট একটা বরফ পাহাড়ের কাছে পৌঁছল ওরা। চারদিকটা ভাল করে দেখে নেয়ার জন্যে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ে উঠতে লাগলেন ক্লবোনি। বেশ খানিকটা উঠে পেছনে ফিরে চাইতেই দুচোখ কপালে উঠল তার। ডক্টরের দেখাদেখি সবাই ঘুরে তাকাল পেছনে। ওরা দেখল গোটা পঁচিশেক শিয়াল আর পাঁচ-ছটা ভালুক স্লেজের সমস্ত খাবার দাবার লুট-পাট করে নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করে জন্তগুলো তাড়ালেন ক্লবোনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচে নেমে দৌড়ে গেল ওরা স্লেজের কাছে। কিন্তু যে সময়টুকু পেয়েছিল সেটাই যথেষ্ট। মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট, তাতেই ২০০পাউন্ড মাংস, ১৫০ পাউন্ড বিস্কুট, এক পিপে মদ আর অনেক চা পাতা নষ্ট করে ফেলেছে হিংস্র জানোয়ারের দল। উপোসী জন্তুদের কাছ থেকে এরকম আচরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। ক্ষতির কথা ভেবে আর সময় নষ্ট করতে চান না ক্যাপ্টেন। এখন থেকে খাবার-দাবার বুঝে সমঝে খেতে হবে। সবাইকেই বরাদ্দের অর্ধেক খেতে হবে। তা না হলে যে খাবার রয়েছে তাতে অভিযান শেষ করে জাহাজে ফেরা সম্ভব নয়। আবার এগিয়ে চললেন ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস। কোন কিছুতেই দমবার পাত্র তিনি নন। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী তবুও তিনি এগিয়ে যাবেনই।

এদিকে সিম্পসনের শরীর প্রতি মুহুর্তেই আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। শরীর মন দুই-ই ভেঙে পড়েছে তার। শরীরের এ অবস্থা নিয়েও ফিরে যেতে চেয়েছিল সে। কিন্তু কাউকে সাথী না পাওয়ায় অগত্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগিয়ে চলল হ্যাটেরাসের সঙ্গে।

১৮ জানুয়ারি। বরফ প্রান্তর রূপ বদলাতে শুরু করেছে। পিচ্ছিল সমতল প্রান্তর হয়ে উঠল এবড়োখেবড়ো খাজকাটা। সারাদিন পথ চলে ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন ও তার সঙ্গীরা। কিন্তু পথ পার হল মাত্র পাঁচ মাইল। ক্লান্তি আর অবসাদে ওরা এতই কাবু হয়ে পড়েছে যে ইগলু বানানোর শক্তি পর্যন্ত কারও নেই। এদিকে তাপমাত্রা আবারও শূন্য তাপাঙ্কের উনচল্লিশ ডিগ্রি নিচে নেমে এসেছে। কোনমতে মোষের চামড়ার তাঁবু খাটিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা।

২০ জানুয়ারি। আবহাওয়া মোটেই ভাল যাচ্ছে না। হঠাৎ ধাক্কা লেগে স্লেজ গাড়ির সামনেটা ভেঙে গেল। গাড়ি ঠিক করতে লেগে গেল অনেকটা সময়। এদিকে সিম্পসনের অবস্থা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন ডক্টর। স্কার্ভিতে ভুগছে সে। শুধু হাত-পা নয় মাড়িও ফুলে উঠেছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। ডক্টর তাই হ্যাটেরাসকে বললেন, ক্যাপ্টেন, সিম্পসনের যা অবস্থা তাতে ওকে আর হাঁটিয়ে নেয়া যাবে না। গাড়িতে শুইয়ে নিতে হবে। আমার মনে হয় দিন দুয়েক বিশ্রাম নিলে ওর জন্যে ভাল হয়।

বিশ্রাম! অবাক হলেন ক্যাপ্টেন। কয়লার উপর নির্ভর করছে জাহাজের সবার জীবন। একজনের জন্যে বিশ্রাম নেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়!

ক্যাপ্টেনের কথার অবাধ্য হবার সাহস আর কারও নেই। সারারাত সিম্পসনের সেবা করলেন ডক্টর। পরদিন রওনা হবার আগে সিম্পসন বার বার অনুরোধ করল তাকে রেখে যেতে। আমাকে এখানেই রেখে যান। অন্তত শান্তিতে মরতে দিন। ধরা গলায় বলল সে।

ডক্টর সিম্পসনের ছেলেমানুষি কথায় কান দিলেন না। স্লেজ গাড়িতে তোলা হল তাকে। ঠিক তখনি আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। এমন সময় ডাক হঠাৎ চেঁচাতে চেঁচাতে কোথায় যেন গিয়ে আবার ফিরে এল। ডাক বারবারই ওই একটা দিকেই ছুটে যেতে লাগল। অর্থাৎ, অভিযাত্রীরা যেন ওকে অনুসরণ করে। ডক্টর আর বেল ওর পিছু নিল। পেছনে পেছনে গিয়ে ওরা হাজির হল একটা চুনাপাথরের তৈরি বরফ ঢাকা স্তুপের সামনে।

ক্লবোনি আর বেল উত্তেজনার বশে এক মুহূর্ত দেরি না করে গাঁইতি দিয়ে ভেঙে ফেলল সেই স্তুপ। গর্তের ভেতরে পাওয়া গেল একটা ভেজা স্যাতসেঁতে কাগজ। তাতে লেখা রয়েছে মাত্র দুলাইন, অনেকটা সাঙ্কেতিক ভাষার মত করে লেখা; আলটাম… পরপয়েজ… ১৩ ডিসেম্বর… ১৮৬০… ১২ ডিগ্রি… লঙ্গি… ৮…৩৫ মিনিট ল্যাটি…। কাগজটা হাতে করে ফিরে গেল ওরা ক্যাপ্টেনের কাছে। কাগজটায় একবার চোখ বুলাতেই ভুরু কুঁচকে উঠল ক্যাপ্টেনের। পরপয়েজ নামের কোন জাহাজের কথা ক্যাপ্টেন জানেন না।

ক্লবোনি বললেন, ক্যাপ্টেন পরপয়েজের নাম আপনার কাছে অজানা থাকলেও এ জাহাজের নাবিকরা যে কিছুদিনের মধ্যে এই পথ দিয়েই গেছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
পরের পর্ব :
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত