ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে

১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে

প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে। ঘরে চব্বিশ ঘণ্টাই আগুন জ্বলে। আগুনের আঁচ একটু কমে এলেই মেঝে, বল্টু, পেরেক সবকিছুতেই বরফ জমা শুরু হয়ে যায়। এমন কি নিঃশ্বাসও জমে যায়। সবাই তাই সারাক্ষণ আগুনের আশেপাশেই থাকে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের হুকুম, কেউ যেন অলসভাবে বসে না থাকে। প্রতিদিনই সবাইকে কিছুটা সময় ডেকে পায়চারি করে, দৌড়াদৌড়ি করে শরীর গরম রাখতে হবে। সবাই হ্যাটেরাসের কথা শুনে চললেও পেন এবং তার বন্ধুরা ক্যাপ্টেনের কথা একদমই মানছে না। ওরা দিনরাত কেবল কম্বল মুড়ি দিয়ে আয়েশ করে কাটায়। এর ফল ফলতে বেশি দেরি হল না। মাত্র কদিন যেতে না যেতেই ওদের সবার স্কার্ভি রোগ দেখা দিল। হাত-পা ফুলে, নীল আর কালো ছোপে সারা শরীর ছেয়ে গেল। সেই সঙ্গে অসহ্য ব্যথা আর কষ্ট। ওদের ছটফটানি দেখে বড় খারাপ লাগে।

ক্যাপ্টেন,কয়লা বাঁচানর জন্যে নিজের কেবিনে আগুন না জ্বেলে বড় রূমটায় এসে আগুন পোহান। তাঁর উপস্থিতি সাধারণ নাবিকেরা কেউই সহ্য করতে পারে না। সবাই তার দিকে ঘৃণা আর বিদ্বেষের চোখে তাকায়। ক্যাপ্টেন এসব ভ্রুক্ষেপ না করলেও এটা ঠিকই উপলব্ধি করতেন যে নাবিকেরা কেউই তাকে সহ্য করতে পারছে না।

ডক্টর ক্লবোনি বড় অদ্ভুত লোক। জাহাজের সবার মন যখন ভয়ে আচ্ছন্ন, তিনি তখন মহা ফুর্তিতে প্রকৃতির অপরূপ লীলা উপভোগ করছেন। আকাশে উল্কার ছোটাছুটি, মেরু অঞ্চলে আলোর ভেলকিবাজি, চাঁদের বৈচিত্র্যময় অবস্থান-এসব নিয়েই ডক্টর মত্ত। ৮ ডিসেম্বর হঠাৎ থার্মোমিটারের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন তিনি। শূন্য তাপাঙ্কের ঊনচল্লিশ ডিগ্রি নিচে নেমে জমে গেছে পারদ। বাইরের তাপমাত্রা আরও কম। এই তাপমাত্রায় বেঁচে থাকাই খুব কষ্টসাধ্য কাজ। সেদিনই আর একটা দুঃসংবাদের মুখোমুখি হতে হল সবাইকে। কয়লার মজুদ শেষ। যেটুকু কয়লা ছিল তাই দিয়ে শেষবারের মত জ্বালানো হয়েছে আগুন।

২০ ডিসেম্বর, ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের জীবনের সবচেয়ে সঙ্কটময় দিন। কয়লা শেষ। আগুন নিভে গেছে। নাবিকেরা সবাই ক্যাপ্টেনকে ঘিরে ধরল। শ্যানডন নাবিকদের পক্ষ হয়ে এগিয়ে এসে জানাল কয়লা শেষ।

ক্যাপ্টেন কি উত্তর দেবেন? মুখে কোন কথা নেই তার। এতদিন পর পেন ক্যাপ্টেনের উপর একটু চোটপাট করার সুযোগ পেল। সে চিৎকার করে উঠল, কয়লা শেষ তো কি হয়েছে? জাহাজের কাঠ আছে। জাহাজের কাঠ কেটে পোড়াও!

অন্য নাবিকেরাও পেনের কথায় সায় দিয়ে উঠল। ফ্যাকাসে হয়ে গেল হ্যাটেরাসের মুখ। তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। আচমকা একটা কুঠার তুলে নিয়ে পেনের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলেন। ডক্টর সময় মত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ায় এ যাত্রা বেঁচে গেল পেন। কুঠারটা গেঁথে গেল কাঠের পাটাতনে।

নিজেকে সামলে নিলেন ক্যাপ্টেন। ভৎসনা করে পেনের উদ্দেশ্যে বললেন, হাঁদারাম! জাহাজ পোড়ালে আমরা দেশে ফিরব কি করে? জাহাজে মজুদ মদ দিয়েই আপাতত আগুন জ্বালাও। এছাড়া আর কোন উপায় নেই।

ক্যাপ্টেনের কথায় কাজ হল। নাবিকেরা জাহাজের খোল থেকে মদ এনে আগুন ধরাল।

ক্যাপ্টেন এখন কাউকেই আর বিশ্বাস করছেন না। সবসময় কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে ডেকের ওপর পায়চারি করেন। তাকে সঙ্গ দেয় সেই ডেনিস কুকুরটা।

কিছুতেই দিন যেন আর কাটতে চায় না। মদ দিয়ে আগুন জ্বালানো খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হল না। পাঁচদিন যেতে না যেতে বাধ্য হয়েই ডক্টর নিজে এসে হ্যাটেরাসকে বলল, ক্যাপ্টেন, কাঠ দিয়েই আগুন জ্বালাতে হবে! তা নাহলে নির্ঘাত মরতে হবে সবাইকে।

ক্যাপ্টেন অন্তত ডক্টরের কাছ থেকে এধরনের প্রস্তাব আশা করেননি। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, আপনারা যা খুশি করতে পারেন, জাহাজের কাঠ পোড়ানোর অনুমতি আমি কক্ষনো দেব না।

তার অনুমতির অপেক্ষায় থাকল না কেউ, নাবিকেরা কুঠার নিয়ে ছুটল পাটাতন কাটতে। ক্যাপ্টেনের চোখ ছল ছল করে উঠল। কিন্তু বলার কিছু নেই।

নববর্ষের দিন একটা সুসংবাদ নিয়ে ছুটে এলেন ডক্টর ক্লবোনি। হাতে বেলচারের লেখা একটা বই। বেলচার লিখেছেন, এখান থেকে প্রায় একশো মাইল দূরে মাটির নিচে কয়লা লুকানো আছে। সেটা নিজে দেখেছেন বেলচার।

ডক্টরের কথা শুনেই ক্যাপ্টেন যন্ত্রপাতি নিয়ে মাস্তুলের উপরে উঠে গেলেন। ফিরে এলেন অনেকক্ষণ পরে। কয়লার সন্ধান পাবার উৎফুল্লতা আর নেই। ডক্টরকে আড়ালে ডেকে তিনি বললেন, খবরদার, ডক্টর! কাউকে বলবেন না। আমরা আপনাআপনি প্রায় দু-ডিগ্রি আরও ভেসে এসেছি। কয়লা এখান থেকে এখনও তিনশো মাইল দূরে!

মুখে যাই বলুন না কেন, মনে মনে কিন্তু হ্যাটেরাস আনন্দিত। নিজের অজান্তেই তার জাহাজ সুমেরু বৃত্তের আট ডিগ্রির কাছে চলে এসেছে।

কয়লার স্তুপ তিনশো মাইল দূরে হলে কি হবে! জনসন কয়লা উদ্ধারের যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করে দিল। প্রায় তিনশো মাইল পথ বরফের উপর দিয়ে যেতে ছয় সপ্তাহ সময় লেগে যাবে। সেভাবেই ৩৫ফুট লম্বা আর ২৪ ফুট চওড়া স্লেজ গাড়ির প্রয়োজনীয় সবকিছু তুলে নিল জনসন। ছয়টি কুকুর জুড়ে দেয়া হয়েছে গাড়িতে আগে! প্রায় দুশো পাউন্ড মালপত্র তোলা হয়েছে। খাবার-দাবার, বন্দুক, বারুদ, স্টোভ কোন কিছুই বাদ পড়েনি।

রওনা হবার আগ মুহূর্তে হ্যাটেরাস চিন্তায় পড়ে গেলেন। যারা তার সঙ্গে যাচ্ছে তারা তো যাচ্ছেই। কিন্তু যারা থাকছে তারা না জানি কি অঘটন ঘটিয়ে বসে! তাই জনসনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, দেখ জনসন, যারা জাহাজে রয়ে গেল তাদের মধ্যে শুধু তোমাকেই আমি বিশ্বাস করি। তুমি জাহাজের দিকে লক্ষ্য রেখ। তোমাকে অধিকার দিয়ে যাচ্ছি, যদি দরকার পড়ে, জাহাজের কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেবে। যে রকম প্রয়োজন, হুকুম দেবে। আমরা যদি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ফিরে না আসি তাহলে জাহাজ নিয়ে তোমরা দেশে ফিরে যেয়ো।

আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবেই সব হবে, ক্যাপ্টেন। কোন চিন্তা করবেন। বাধ্য নাবিকের মত গদগদ কণ্ঠে ক্যাপ্টেনকে আশ্বস্ত করল জনসন।

ডক্টর ক্লবোনি, বেল, সিম্পসন এবং কুকুর ডাককে নিয়ে ৬ জানুয়ারি ক্যাপ্টেন বেরিয়ে পড়লেন কয়লার সন্ধানে। নাবিকদের কাছে বিদায় নিতে গিয়ে ওদের চোখে-মুখে বিদ্রুপের হাসি দেখলেন তিনি। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সবাইকে নিয়ে উঠে পড়লেন স্লেজ গাড়িতে। ধীরে ধীরে পিছনে মিলিয়ে গেল বরফ ঢাকা ফরওয়ার্ড। স্লেজ এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে।

আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
পরের পর্ব :
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত