০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে। পেনের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের ব্যবহারে সবাই গুম হয়ে আছে। এমনি অসন্তোষের মাঝেই বীচার পয়েন্টে জাহাজ পৌঁছল।
কিন্তু হায়! কোথায় সেই বরফহীন সমুদ্র? হ্যাটেরাস অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে মাস্তুলের মাথায় উঠলেন। যদি কোনদিকে দেখা যায় সেই আকাক্ষিত সমুদ্র! কিন্তু সবই দূরাশা! চোখে-মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে নেমে এলেন ক্যাপ্টেন।
দিনদিন শীতের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। একদিন সন্ধ্যায় ডেকে দাঁড়িয়ে ডক্টর বললেন, দেখ জনসন, শীতের পাখিরাও ঠান্ডার ভয়ে কেমন দক্ষিণ দিকে উড়ে যাচ্ছে। ওদের মত পাখা থাকলে এ জাহাজের অনেকেই ওদের সঙ্গী হত।
জনসনও সায় দিল ডক্টরের কথায়।
১৮ আগস্ট। কুয়াশার আবরণের ভিতর দিয়ে দুরে ব্রিটানিয়া পাহাড়ের আবছা আকৃতি দেখা যাচ্ছে। পরদিনই অর্থাৎ ১৯ আগস্ট নর্দমবারল্যান্ড উপসাগরে যাবার পথে আবার বরফে আটকে গেল জাহাজ। সাদা বরফের স্তুপ চারদিক থেকে জাহাজটাকে ঘিরে ফেলছে। যেন গিলেই ফেলবে ফরওয়ার্ডকে!
শোনা যায়, এখানে পৌঁছে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিলেন স্যার এডোয়ার্ড বেলচার। এই অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শুধু বরফ আর উত্তর-পশ্চিম দিকে খোল সমুদ্র-টলটলে নীল জল। কিন্তু হ্যাটেরাস দেখলেন উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম যেদিকেই চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ! কোথায় খোলা সমুদ্র? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ক্যাপ্টেন মনে মনে ভেঙে পড়ছেন। তবু তিনি উত্তর দিকেই এগোবার নির্দেশ দিলেন। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ অমান্য করার সাহস আর কারও হল না।
অনেক কসরৎ করে তেরো দিনে পেনী প্রণালীতে পৌঁছল ফরওয়ার্ড। সেখানে নাবিকেরা দেখল, দক্ষিণে যাবার পথ একদম বন্ধ থাকলেও উত্তর দিক কিছুটা খোলা। বিপদের ভয় ওদিকে কিছুটা কম, ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের যে পথ পেরোতে লেগেছে পাঁচ মাস, সেই পথ পূর্ববর্তী যাত্রীরা পার হয়েছেন তিন বছরে। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু সমুদ্রের যা অবস্থা তাতে আদৌ আর সামনে এগোনো যাবে কিনা সন্দেহ। আর বেশি পথ বাকি নেই ভেবে অজানা একটা আনন্দ অনুভব করছেন হ্যাটেরাস।
৮ সেপ্টেম্বর আবার বরফে আটকে গেল জাহাজ। কামান দেগে বরফ উড়িয়ে পথ করে নিলেন ক্যাপ্টেন। কোন বাধাই আর মানতে রাজি নন তিনি।
সেই রাতেই প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে পড়ল ফরওয়ার্ড। বরফের পাহাড়গুলো যেভাবে ঢেউয়ের মাথায় নাচছে তাতে নাবিকদের বুকের রক্ত হিম হয়ে আসার জোগাড় এমন সময় একটা হিমশিলা প্রচন্ড গতিতে এগিয়ে এল জাহাজের দিকে।
গেল, গেল! পালাও, পালাও! চিৎকার করে উঠল নাবিকেরা! কিন্তু পালাবে কোথায়?
কামান দেগে বরফের পাহাড়টা ঠেকানর হুকুম দিলেন ক্যাপ্টেন। আদেশ পেয়ে কয়েকবার কামান দাগল নাবিকেরা; কিন্তু কোন ফায়দা হল না। দড়াম করে জাহাজের সামনের গলুইয়ের ওপর আছড়ে পড়ল বরফের পাহাড়। গুড়িয়ে গেল সামনেটা। পর মুহূর্তেই আর একটা বরফের চাই এসে পড়ল মাস্তুলের উপর। ক্যাপ্টেন চিৎকার করে সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিলেন।
নাবিকেরা সাবধান হবার আগেই দুমদাম শব্দে বরফের প্রকান্ড একেকটা টুকরো ভেঙে পড়তে লাগল জাহাজের উপর। বরফের ভারে জাহাজ ডোবে আর কি! শঙ্কিত হয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন। বরফের সঙ্গে গেঁথে আছে জাহাজ! মাস্তুলও ভাঙে ভাঙে অবস্থা। এবার আর রক্ষে নেই।
ঠিক তখনি একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটল। গলুইয়ের উপর যে বরফ-পাহাড়টা আছড়ে পড়েছিল, সেটার গা থেকে কিছু বরফ খসে পড়তেই ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে পড়ল সেটা সমুদ্রের বুকে। আবার ভেসে উঠল ফরওয়ার্ড। জাহাজের নিচে মড় মড় শব্দে ভাঙল বরফের চাক!
ক্যাপ্টেন দেখলেন, জাহাজের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। একটা হিমবাহ ফরওয়ার্ডকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে গেল সামনের দিকে। কিন্তু ১৫ সেপ্টেম্বর আবার একটা বরফ প্রান্তরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল জাহাজ। থর থর করে কেঁপে উঠে আটকে গেল ফরওয়ার্ড।
ভৌগোলিকেরা পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা বলে মানচিত্রে যে অঞ্চলকে চিহ্নিত করেছেন তা তারা কেউই দেখেননি। হ্যাটেরাস যন্ত্রপাতি দিয়ে মাপ-জোক করে বুঝতে পারলেন এটাই সেই অজানা অঞ্চল। আরও একটা অজ্ঞাত অঞ্চলের সন্ধান পেয়ে হ্যাটেরাসের মন খুশিতে নেচে উঠল।
পৃথিবীর সবচাইতে ঠান্ডা অঞ্চলে এসে শুরু হল শীতের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রস্তুতি। বরফ প্রান্তরে কিভাবে শীতকাল কাটাতে হয় সে-ব্যাপারে জনসন ও ক্যাপ্টেন দুজনেই অভিজ্ঞ। ওদের অভিজ্ঞতাই তখন একমাত্র সম্বল। কারণ বরফ প্রাচীর যেভাবে চারদিক থেকে জাহাজটাকে আটকে ফেলেছে তাতে শীতকালটা এখানে কাটানো ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
মেরু অঞ্চলে শীতকাল কাটানর কথা ভেবে নাবিকেরা অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। সবাই কম বেশি চিন্তিত হলেও একজনের এ ব্যাপারে কোন বিকার নেই। তিনি ডক্টর ক্লবোনি। সবাই যখন মৃত্যুভয়ে অস্থির, ডক্টর তখন আনন্দে আটখানা। তাঁর মতে, এটা নেহায়েতই কপালের জোর! নইলে মেরু অঞ্চলে শীতকাল কাটাবার সুযোগ কজন পায়?
এস্কিমোদের ইগলুর মত করে জাহাজের চারদিকে বরফ দিয়ে আবরণ সৃষ্টি করা হল। তুষার তাপ বহন করে না। জাহাজের ভেতরকার উত্তাপও তাই আর বাইরে বেরুতে পারবে না। বাতাস চলাচলের জন্যে শুধু একটা ফুটো রাখা হল উপরে।
ক্যাপ্টেন সবাইকে নিয়মিত ব্যায়াম করে শরীর গরম রাখতে বললেন। একটা বড় রূমে সারাক্ষণ স্টোভ জ্বালিয়ে রাখা হল। জাহাজশুদ্ধ সবাইকে ওই স্টোভ ঘিরেই বসে কাটাতে হচ্ছে। ক্যাপ্টেনের কড়া নির্দেশ কেউ যেন অলসভাবে গুটিসুটি মেরে বসে না থাকে। তাহলে শীতে ধরে বসবে, অসুখ-বিসুখ করবে। খাওয়া-দাওয়াও সবাইকে বেশি করে করতে বললেন। বিশেষ করে চর্বি জাতীয় খাবার, চা, কোকো ইত্যাদি। ডক্টরও সবাইকে বেশি করে তৈলাক্ত খাবার খেতে বললেন, এভাবেই শীতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়া হল।
সারাদিন জাহাজের খোলে বসে থাকা ছাড়া করার কিছুই নেই। সুযোগ পেলেই নাবিকেরা শিকারে বেরিয়ে পড়ে। প্রচুর মেরু-মোরগ তারা প্রতিদিনই মেরে আনে। যতই দিন যাচ্ছে হ্যাটেরাসের প্রতি নাবিকেদের অসন্তোষ আর রাগ ততই বেড়ে চলেছে।
এরই মাঝে একদিন সবাই ঠিক করল ভালুক মারতে হবে। শীতে গা গরম রাখার জন্যে ভালুকের মাংস আর চর্বি দুটোই অত্যন্ত উপযোগী। গেল সবাই ভালুক মারতে। কিন্তু মেরে আনল একটা শিয়াল। শিকারিদের কোন দোষ নেই। আলোর প্রতিসরণের ভেলকিবাজিতে সাদা শিয়ালকেই মনে হচ্ছিল যেন বিরাট এক সাদা ভালুক। শিকারিরাও ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতে পারেনি। ভালুক মারার আনন্দেই তখন অস্থির সবাই। কিন্তু মড়াটার কাছাকাছি যেতেই ভুল ভাঙল সবার। এতক্ষণ যেটাকে ভালুক ভেবে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল ওরা, সেটা আর কিছুই নয়-একটা সাদা শিয়াল!
শিয়ালটার একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেল। ওর গলায় রয়েছে একটা কলার। তাতে কি যেন লেখা, স্পষ্ট পড়া যায় না। অস্পষ্ট লেখার রহস্য ডক্টর উদঘাটন করলেন। জেমস রস ১৭৪৮ সালে কয়েকটা শিয়ালের গলায় এই কলার পরিয়ে দিয়েছিলেন। এই জাতের শিয়াল খাবারের খোঁজে অনেক দূর পর্যন্ত পাড়ি জমায়। রস ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই কারও না কারও হাতে এসব শিয়াল একদিন ধরা পড়বে। আর কলারের লেখা পড়ে তাদের উদ্ধারের জন্যে নিশ্চয়ই কোন অভিযাত্রী এগিয়ে আসবেন। এদিকে বারো বছর পার হয়ে গেছে। শিয়ালও ঠিকই ধরা পড়েছে। কিন্তু রস? তিনি আর নেই!
আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
পরের পর্ব :
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা