০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে নাবিকেরাও ততই নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে। মেলভিল উপসাগরে জাহাজ পৌঁছার পর সবাই দেখল ওখানকার নীল জল। মাঝে মাঝে সবুজ দেখাচ্ছে। ডক্টর জানালেন নীল জলে কীটাণু অথবা জেলীফিশ থাকে না বলেই এমন হয়। হানার সিম্পসনও সমুদ্র সম্পর্কে বেশ জ্ঞান রাখে। সে বলল, সমুদ্রে যে তেলতেলে জিনিস ভেসে বেড়াচ্ছে তার মানে হল কোন তিমি খানিকক্ষণ আগে এ পথ ধরে গেছে। হানারের কথাই সত্যি হল। একটু পরেই জাহাজের সামনের দিক থেকে কেউ চিৎকার করে বলল, দূরে তিমি দেখা যাচ্ছে।
সেদিন তিমি শিকার করতে গিয়ে ওদের কজন মস্ত বিপদ থেকে রক্ষা পেল। নৌকা করে ওরা তিমি শিকার করতে গিয়ে একটাকে হাৰ্পন দিয়ে গেঁথে ফেলতেই প্রায় ১৩০ ফুট লম্বা তিমিটা হার্পনের দড়ি সমেত নৌকাটাকে টানতে টানতে সামনে এগিয়ে চলল। ঠিক এমনি সময়ে দুদিক থেকে দুটো বরফ-পাহাড় ভাসতে ভাসতে এসে ভীষণ আওয়াজে এক হয়ে গেল। হার্পনের দড়ি কেটে দেয়ায় নৌকা ও যাত্রীরা অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও প্রকান্ড তিমিটা, বরফ-পাহাড়ের ধাক্কায় একদম থেঁতলে গেল।
এরপর জুলাই মাসের তিন তারিখে বীচি দ্বীপে এসে পৌঁছলেন ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস। ভবিষ্যতে অভিযাত্রীরা যেন অনাহারে না মরে তাই ১৮৫৩ সালে প্রচুর খাবার-দাবার এনে রাখা হয়েছিল এই দ্বীপে। বছরের পর বছর বরফে খাবার থাকলেও তা নষ্ট হয় না। ক্যাপ্টেন কিন্তু এখানকার খাবার সামগ্রী সংগ্রহে একটুও আগ্রহী নন। তার জাহাজে যে পরিমাণ খাদ্য আছে তাতে বেশ কবছর চলে যাবে। ক্যাপ্টেন চিন্তিত কয়লার জন্যে।
এই সেই বীচি দ্বীপ যেখানে মেরু অভিযানের কিংবদন্তীর নায়ক ফ্রাঙ্কলিন অজানা আবিষ্কারের নেশায় সঙ্গীসহ নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। তারই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি কালো মার্বেলের স্মৃতিসৌধ বানিয়েছে পরের অভিযাত্রীরা।
ফ্রাঙ্কলিনের স্মৃতিসৌধের সামনে কিছুটা সময় কাটিয়ে সবাই কয়লা খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও কয়লা বা সঞ্চিত খাবারের কোন চিহ্নই খুঁজে পাওয়া গেল না। এক জায়গায় তিনটা মাটির ঢিবিতে ফ্রাঙ্কলিনের তিন সঙ্গীদের কবর আর দূরে একটা ছেড়া তাঁবু, ভাঙা লোহা আর কাঠের কয়েকটা টুকরো দেখতে পেলেন ক্যাপ্টেন। বুঝতে আর কিছুই বাকি রইল না তার। মরু অভিযাত্রীদের জন্যে রাখা রসদ ভান্ডারের খোঁজ পেয়ে নিশ্চয়ই এস্কিমোরা সব লুট করে নিয়েছে। মহা সমস্যায় পড়লেন ক্যাপ্টেন। কয়লা যা মজুত আছে তাতে কিছুতেই মাস দুয়েকের বেশি চলবে না। এখনই কয়লার ব্যবস্থা করতে না পারলে কি যে বিপদ হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেখতে দেখতে শীতের প্রকোপ বাড়ছে। চারদিকে আরও বরফ জমতে শুরু করেছে। থার্মোমিটারে পারদ এসেছে শূন্যেরও বাইশ ডিগ্রি নিচে। হ্যাটেরাস দারুণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সমুদ্র যদি পুরোটা জমে যায় তাহলে সারা শীতকাল সবাইকে এখানেই আটকে থাকতে হবে। শীতে জমে মরতে হবে। কিছু একটা করা দরকার। ক্যাপ্টেন জানেন এখন তার পক্ষে আছে মাত্র তিনজন। ডক্টর, জনসন এবং বেল। বাকি চোদ্দজন এমনকি শ্যানডনও এখন তার ঘোর বিরোধী। ওরা কেউই আর সামনে এগিয়ে যেতে চায় না। ওদেরকে অনুরোধ বা আদেশ করেও আর কিছুতেই দাঁড় টানানো যাবে না। উপায় এখন একটাই। জাহাজের বয়লার চালু করার হুকুম দিলেন ক্যাপ্টেন। এখন থেকে স্টীমে চলবে জাহাজ।
ক্যাপ্টেনের আদেশ শুনে সবাই বোকা বনে গেল। কয়লা যা আছে তা দিয়ে জাহাজ চালালে কদিনই বা চলবে? তাহলে প্রচন্ড শীতে আগুন পোহানো যাবে কি করে? জাহাজশুদ্ধ সবাইকে জমে মরতে হবে যে! ক্যাপ্টেনের আদেশ শুনেও তাই কেউই নড়ল না, ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
ক্যাপ্টেন খেপে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, তোমরা কি কানে শোন না? ব্রানটন! যাও, বয়লার চালু কর!
না, ব্রানটন, যেয়ো না। কে যেন বলে উঠল।
কি? আমার হুকুমের উপর হুকুম। কার এতবড় বুকের পাটা? ক্যাপ্টেনের কথা শেষ না হতেই পিছন থেকে ঠেলে এগিয়ে এল পেন।
আমার! আপনার পাগলামি যথেষ্ট সহ্য করেছি আমরা। অনেক হয়েছে। আর নয়। এবার সোজা বলে দিচ্ছি, আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোন অধিকার আপনার নেই। আমরা বয়লারও চালু করব না, আর সামনেও এগোব না।
যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব দেখিয়ে ঠান্ডা গলায় শ্যানডনকে লক্ষ্য করে ক্যাপ্টেন বললেন, পেনকে খাচায় বন্দী করে রাখুন।
কিন্তু, ক্যাপ্টেন…
শ্যানডন, পেনের পক্ষ নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু ক্যাপ্টেন তাকে এক হুঙ্কারে থামিয়ে দিলেন।
পেনের পক্ষ নিয়ে ওকালতি করলে আপনাকেও খাঁচায় যেতে হবে। কি হল, বন্দী করুন পেনকে!
শ্যানডন হুকুম দিতেই জনসন, বেল আর সিম্পসন পেনকে পাকড়াও করতে এগিয়ে গেল। ওরা এগুতেই পেন একটা লোহার রড মাথার উপর বন বন করে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, খবরদার! যে আমার দিকে এগোবে তাকেই ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেব!
এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন নিজেই। হাতে পিস্তল। গলার স্বরকে খাদে নামিয়ে রক্ত হিম করা কণ্ঠে বললেন, রডটা ফেলে দাও পেন, নইলে পিস্তলের গুলি তোমার কপাল ফুটো করে দেবে।
জাহাজসুদ্ধ পিনপতন স্তব্ধতা। সবাই ভয় পেয়ে গেছে হ্যাটেরাসের ঠান্ডা কণ্ঠস্বরে। এমন কি পেনও রড় ফেলে খাঁচায় আবদ্ধ সিংহের মত ফুসতে লাগল। সবাই জানে হ্যাটেরাসের অভিধানে অসাধ্য বলে কিছুই নেই। পেনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল।
কয়লা দিয়ে বয়লার চালু হল। ধীর গতিতে আবার এগিয়ে চলল ফরওয়ার্ড।
আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
পরের পর্ব :
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা