ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়

০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়

ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায় বসে থাকবার লোক নন। তিনি গ্যারী আর শ্যানডনকে নিয়ে আবার নেমে পড়লেন বরফের ওপর। এগোবার রাস্তা খুঁজে বার করতেই হবে।

ডক্টররা নেমে যেতেই নাবিকেরা এক কান্ড করে বসল। ওদের বদ্ধ ধারণা সব। বিপদের মূলই হচ্ছে কুকুরটা। ওকে মারলে বা ফেলে দিলেই ওদের সব বিপদ কেটে যাবে। শ্যানডনও আর একরোখামি না করে ফিরে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ডেকের উপর থেকে ঘুমন্ত কুকুরটার মুখ আর পা বেঁধে উঠিয়ে নিয়ে আসা হল। দূরে একটা বরফের ফোকর দেখে সেখানে ছুঁড়ে ফেলা হল কুকুরটাকে। তারপর বরফ দিয়ে ফুটোটা বন্ধ করে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফিরে এল সবাই। চুপিসারে কাজ সারল ওরা। এমনকি জনসনও জানতে পারল না।

বেশ অনেকক্ষণ পরে শ্যানডন ফিরল। মাইল দুই সামনে একটা বরফের ফাঁক পাওয়া গেছে। কোনমতে বরফ ভেঙে অথবা কেটে ওই পথটুকু যেতে পারলেই আর কোন বাধাই থাকবে না। উত্তরের দিকে এগোনো যাবে বিনা বাধায়।

নাবিকেরা শ্যানডনের নির্দেশে বরফ কাটা শুরু করল বটে, কিন্তু বেশ বোঝা গেল ভেতরে ভেতরে ওদের একটা চাপা আক্রোশ রয়েছে। কেউ কোন প্রতিবাদ না করলেও শ্যানডন বুঝল, এই নীরবতা বিপদেরই পূর্বাভাস।

এমনি অস্বস্তিকর পরিবেশের মাঝেই আরও দুদিন কাটল। আঠারো তারিখে ফরওয়ার্ডের সবাই অবাক হয়ে দেখল, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ভেসে উঠেছে অদ্ভুত আকৃতির এক পর্বত শৃঙ্গ। বড় অদ্ভুত জায়গা এটা। এখানেই আগেকার অনেক নাবিকই মাসের পর মাস বরফের মাঝে আটকা পড়ে থেকেছে।

বরফ কেটে অতিকষ্টে অল্প অল্প করে এগোচ্ছে ওরা। দিনটা কাটল কোনভাবে। পরদিন শনিবার। সকাল থেকেই জোর বাতাস বইছে। কুয়াশার মধ্যে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে আবার কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে বিকট আকৃতির পর্বতচূড়াটা। হঠাৎ জাহাজের নাবিকদের বাঁচাও বাঁচাও চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। সেই অদ্ভুত আকৃতির পাহাড়ের চূড়াটা হঠাৎ দানবিক আকৃতি নিয়ে নাবিকদের ওপর ভেঙে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। সবার হৈ-চৈ ছাপিয়ে ডক্টরের চিৎকার শোনা গেল, ভয় পেয়ো না। এটা আলোর ভেলকি মাত্র।

ক্লবোনির কথা শেষ হতে না হতেই একটা দমকা হাওয়ায় সেই বিভীষিকা একপলকে শূন্যে মিলিয়ে গেল।

আবার শুরু হল বরফ কেটে, গুণ টেনে, সামনে চলা। কিছুটা সময় যেতেই আবার প্রচন্ড হট্টগোল শোনা গেল। নাবিকেরা প্রাণভয়ে গুণ-টুন সব ফেলে ছুটে আসছে জাহাজের দিকে। ওদের পেছনে ধাওয়া করে ছুটে আসছে অতিকায় এক চারপেয়ে জন্তু। কম করে হলেও বিশ ফুট উঁচু হবে। ওর লেজটাই দশ ফুট লম্বা।

কেউ চিৎকার করছে: ভালুক! ভালুক!

আবার কেউ: ড্রাগন! ড্রাগন!

গুড়ুম গুড়ুম করে গর্জে উঠল ডক্টর আর শ্যানডনের বন্দুক। সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হল সেই ভালুক বা ড্রাগনটা। এমন সময় দেখা গেল দৌড়াতে দৌড়াতে এসে পৌঁছুল ফেলে দেয়া সেই ডেনিশ কুকুরটা। বরফের ফুটোতে জ্যান্ত কবর দিয়েও কুকুরটাকে মারা গেল না। অন্য ফুটো বের করে ঠিকই উঠে এসেছে সে। বরফের ওপর আলোর প্রতিসরণে কুকুরটাকেই মনে হচ্ছিল যেন প্রাগৈতিহাসিক কোন দানব বুঝি ছুটে আসছে!

কুকুরের পুনরাৰ্বিভাব (নাবিকদের মতে শয়তানের পুনরাৰ্বিভাব) ওদের মনোবল একদম ভেঙে দিল। যারা কুকুরটাকে বেঁধে ফেলে দিয়ে এসেছিল তাদের আরও বেশি ভয়। এবার আর কারও ফিরে যাওয়া হবে না। সবাইকে প্রাণ হারাতে হবে।

বরফে কিছুটা ফাঁক পেয়ে ফরওয়ার্ড এঞ্জিনে চালাচ্ছে শ্যানডন। আর জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে আসছে সেই ডেনিশ কুকুর। মঝে মাঝে পিছিয়ে পড়লেই জাহাজ থেকে কে যেন শিস দিয়ে কুকুরটাকে ডাকে আর সঙ্গে সঙ্গেই সে দ্বিগুণ উৎসাহে ছোটা শুরু করে।

জাহাজের ভেতর থেকে শিস শুনে নাবিকেরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করল। ফিসফাস শুরু হল ওদের মধ্যে। অনেক হয়েছে। অজানা, অনিশ্চিত পথে আর এক পাও তারা যেতে রাজি নয়। এ নির্ঘাত শয়তানের কাজ। ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ফরওয়ার্ডকে। কিছুতেই আর যাওয়া চলে না। নাবিকেরা বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিল।

এই সময়েই শ্যানডন দূরবীনে দেখতে পেল প্রায় ১৮০০ ফুট ব্যাসের একটা বিরাট হিমশিলা আর কিছুক্ষণ পরেই ফরওয়ার্ডের পথ আটকে দেবে। শ্যানডন ভাবছে কিভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। আর তখনি বোল্টন তার দলবল নিয়ে হাজির হল। কাপা গলায় জানাল, কমান্ডার, আমরা ফিরে যেতে চাই। আমরা আর সামনে এগোব না।

কি বললে? চিৎকার করে উঠল শ্যানডন।

আমরা-আর এক ইঞ্চিও এগোব না, বোল্টন নির্বিকার।

শ্যানডন এগিয়ে যাচ্ছিল বোল্টনকে উচিত শিক্ষা দিতে। কিন্তু এই সময়ে ছুটে এল তার মেট। হাঁপাতে হাপাতে সে বলল, এক মুহূর্ত দেরি করলে জাহাজ আর বের হতে পারবে না। ওই দেখুন কি ভয়ঙ্কর অবস্থা?

শ্যানডন দেখল, একটা বিরাট হিমশিলা ভাসতে ভাসতে বেরুনর পথের দিকে এগিয়ে আসছে। মুখটা বন্ধ হয়ে গেলেই সব শেষ। ভরাট গলায় হুঙ্কার ছেড়ে সবাইকে যার যার জায়গায় যেতে হুকুম করল শ্যানডন। হতচকিত নাবিকেরা ছুটে গেল বিপদ মোকাবিলায়। ফুলস্পীডে ফরওয়ার্ড ছুটে চলল। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হল না। বরফের গতির কাছে হার মানল জাহাজ। বোতলের মুখে ছিপি আটকানর মত বের হবার পথ বন্ধ করে দিল উত্তর দিক থেকে ভেসে আসা বরফ-পাহাড়।

সব আশা-ভরসা শেষ। হতাশ হয়ে পড়ল শ্যানডন।

হঠাৎ নাবিকেরা উন্মত্ত হয়ে উঠল। ওদের হৈ হুল্লোড়ে তুমুল কান্ড বেধে গেল জাহাজে।

পালাও! নৌকা নামাও! মদের ভাড়ার লুট কর! খাবার লুট কর! নাবিকদের বিশৃঙ্খলায় হতবাক শ্যানডন ! হতবাক ডক্টর ক্লবোনিও। ওরা কেউ ভাবতেও পারেনি নাবিকেরা হঠাৎ এভাবে বিদ্রোহ করে বসবে।

অকস্মাৎ হট্টগোল ছাপিয়ে একটা বজ গম্ভীর আদেশ শোনা গেল। সবাই যার যার জায়গায় যাও! জাহাজ ঘোরাও!

যাদুর মত কাজ হল ওই কণ্ঠস্বরে। তৎক্ষণাৎ জাহাজ ঘুরিয়ে দিল জনসন। নাবিকেরাও মন্ত্রমুগ্ধের মত যে যার জায়গায় ছুটে গেল।

কিন্তু কে? কে এই হুকুম দিল? কার এই কণ্ঠস্বর?

পরক্ষণেই ক্যাপ্টেনের কেবিনের দরজা খুলে গেল ! জমকালো পোশাকে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। বাইরে এসেই তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে উঠলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে যেন কুকুরটা দৌড়ে এসে ক্যাপ্টেনের পায়ের কাছে মুখ ঘষে লেজ নাড়তে লাগল। হ্যাঁ, ইনিই তো ক্যাপ্টেন। তাহলে ক্যাপ্টেন রহস্যের সমাধান হল!

আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
পরের পর্ব :
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত