ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে

ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস: ০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে

০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে

নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে মেরুবৃত্ত পার হবার পর একটা বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল শ্যানডন এবং জাহাজের অন্য সবার জন্যে। ৩০ এপ্রিল ভোরে শ্যানডন তার ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। টেবিলের ওপর একটা চিঠি! তার নামেই লেখা। বিস্ময়ের ঘোরে শ্যানডন, অনেকক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে থেকে ডক্টর, জেমস, ওয়াল ও জনসনকে ডেকে আনল।

খাম ছিড়ে চিঠিটা পড়ল শ্যানডন: সাম্প্রতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় নার্বিক আর অফিসারদের সাহসিকতায় ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেন খুশি হয়েছেন। শ্যানডন যেন নাবিকদের ক্যাপ্টেনের অভিনন্দন জানিয়ে দেয়।

তারপর আছে, আরও উত্তরে মেলভিল উপসাগরের দিকে রওনা হয়ে সেখান থেকে স্মিথ সাউন্ডের দিকে যাবার নির্দেশ। চিঠিটা ৩০ এপ্রিল অর্থাৎ আজই লেখা।

চিঠিটা পড়া হল। সবার মুখ থমথমে। সবাই বুঝে ফেলেছে, ক্যাপ্টেন এই জাহাজেই আছেন। কিন্তু শ্যানডন কিছুতেই এ কথা মানতে পারছে না। জাহাজের প্রত্যেকেই তার বিশেষ পরিচিত। তবে জাহাজেরই কেউ ক্যাপ্টেন হয় কি করে?

তাহলে চিঠিটা লিখল কে? কুসংস্কারাচ্ছন্ন নাবিকদের মনে আবার সেই সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এ কি তাহলে কুকুরটার কাজ?

এসব নানান জল্পনা-কল্পনার মাঝেই জাহাজ এগিয়ে চলেছে। দিন দিন তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে। ১ মে সে তাপমাত্রা শূন্য তাপাঙ্কের পঁচিশ ডিগ্রি নিচে নেমে গেল।

আবার বরফ ভেসে বেড়াতে শুরু করেছে চারদিকে। বড় একটা হিমশিলার একটা ভালুক আর দুটো বাচ্চাকে দেখে বন্দুক হাতে সেদিকে ছুটলেন ডক্টর, ক্লবোনি। ভালুক-মা বিপদ আঁচ করতে পেরে বাচ্চাসমেত গা-ঢাকা দিল।

রাতে বহু দূরে ডিস্কো পাহাড় ভেসে উঠতেই আবার ডক্টরকে অন্যমনস্ক দেখা গেল। এই ডিস্কো দ্বীপের আর এক নাম তিমি দ্বীপ। এখান থেকেই শেষ চিঠি লিখেছিলেন স্যার জন ফ্রাঙ্কলিন। সেটা ১৮৪৫ সালের ১২ জুলাইয়ের কথা।

ডিস্কো দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছুতেই জাহাজের আশেপাশে তিমি মাছের আনাগোনা শুরু হল। পাখনাওয়ালা তিমিরা স্পাউটের ফুটো দিয়ে ফোয়ারার মত পানি ছিটিয়ে খেলতে লাগল।

যতই দিন যাচ্ছে সূর্য যেন আর ডুবতেই চায় না। দিগন্ত রেখা ঘেঁষে কেবল সরে যাচ্ছে। ৩ মে অনভ্যস্ত নাবিকের মনে একটানা এরকম সূর্য দেখে কি প্রতিক্রিয়া হবে ভেবে শঙ্কিত হলেন ডক্টর। নাবিকেরা প্রথম প্রথম একটানা সূর্যের আলো দেখে অবাক হল, পরে বিরক্ত ও শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ওরা মর্মে মর্মে অনুভব করল যে আঁধার আছে বলেই আলো এত আনন্দময়।

৬ মে সবচাইতে উত্তরে এস্কিমোদের রাজ্যে জাহাজ পৌঁছল। এস্কিমো গভর্নর সপরিবারে অভ্যর্থনা জানাতে এলেন। শ্যানডন, ডক্টর ক্লবোনি ও মাত্র তিনজন নাবিক জাহাজ থেকে নামল। পাঁচজনই গর্ভনরের সঙ্গে এগিয়ে গেল। শুধু গভর্নরের বাড়িটিই কাঠের। আর বাকি সবাই থাকে এস্কিমোদের ঐতিহ্যবাহী বরফের তৈরি ঘর–ইগলুতে। ইগলুর গড়ন বড় আজব ধরনের। সরু সুড়ঙ্গের মত পথ বেয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। কোন জানালা নেই। একটা ফুটো আছে ছাদে, ধোঁয়া বার হবার জন্যে। ঘরে ঢুকলে বোটকা গন্ধে পেটের সবকিছু উগরে বেরিয়ে আসতে চায়। সীল মাছের মাংস, পচা মাছ আর এস্কিমোদের শরীরের বিদঘুটে গন্ধ, সব মিলে, যাচ্ছেতাই এক অবস্থা।

এস্কিমোদের এস্কিমো বলে ডাকলে তারা ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়। এস্কিমো শব্দের অর্থ হচ্ছে কাঁচা মাছ খেকো। ডক্টর ক্লবোনি তাই ওদের একটু তোয়াজ করার জন্যে গ্রীনল্যান্ডবাসী বলে সম্বোধন করলেন। এস্কিমোরা বেজায় খুশি হল। ওদের ইগলু পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনল ডক্টরকে। ইগলুর ভেতরের বোটকা গন্ধে তার অবস্থা কাহিল হলেও ডক্টর আগ্রহের সঙ্গেই সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখলেন। তাদের কথাবার্তা চলল জাহাজের দোভাষীর জানা মাত্র কুড়িটা এস্কিমো শব্দ আর আকারইঙ্গিতের মাধ্যমে।

শ্যানডন জানে এখানে ক্যাপ্টেনের খোঁজ করে কোন লাভই নেই। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিতে খোঁজ নিল এ অঞ্চলে তিমি ধরা বা অন্য কোন জাহাজ এসেছিল কিনা। জানা গেল আসেনি। অগত্যা নিরুপায় হয়ে শ্যানডন জানিয়ে দিল, মেলভিল সাউন্ডেও যদি ক্যাপ্টেনের দেখা না মেলে তাহলে সে নিজেই ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেন হয়ে বসবে।

গত কদিন ধরে লবণ মাখানো মাংস খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে সবার। স্ট্রং তাই আইডার হাঁসের কতগুলো ডিম জোগাড় করে আনল। সবুজ রঙের এই ডিমগুলো আকারে বেশ বড়। ওমলেট খেতে ভালই লাগবে।

পরদিন আবার জাহাজ ছাড়ল। ক্যাপ্টেনের সাক্ষাৎ পাবার আশায় শ্যানডন ঘন্টায় ঘন্টায় কামান দেগে সঙ্কেত দিয়ে চলল কিন্তু কোন উত্তর পেল না ওরা।

ডাঙা থেকে জাহাজে তোলা হয়েছে কুড়িটা কুকুর আর একটা স্লেজ গাড়ি।

কুকুরগুলো হিংস্র জাতের হলেও জাহাজের ভাল ভাল খাবার পেয়ে শান্তই আছে। ডেনিশ কুকুরটিকেও অন্য কুকুরগুলোর ব্যাপারে উত্তেজিত দেখাল না।

এদিকে আবার বরফ জমতে শুরু করেছে। চারদিক থেকে ভেসে আসা বরফ জাহাজকে বারবার ঘিরে ধরছে। সামনে যাবার পথও হিমশিলার জন্যে প্রায় বন্ধ। অবস্থা দেখে নাবিকদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। ভয়, উদ্বেগ, কুসংস্কার, সবকিছু মিলিয়ে ওদের মাঝে অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিছুতেই আর এগুতে চায় না ওরা। কিন্তু একরোখা শ্যানডন কিছুই শুনতে রাজি নয়। তার এক কথা, জাহাজ সামনে এগোবে।

মের আট তারিখ থেকে ১৬ মে পর্যন্ত জাহাজ মাত্র দুমাইল পথ পার হল। ছসাত ফুট বরফ করাত দিয়ে কাটা যায় না। বরফে নোঙর আটকে ক্যাপস্টান ঘুরিয়ে গুণ টেনে চালাতে হচ্ছে। এত কিছুর পরেও জাহাজটা এগোচ্ছে খুবই ধীর গতিতে!

এখন কি করা যায়? ডক্টর ক্লবোনি বরফের ওপর নেমে পড়লেন সবকিছু ভাল করে দেখবার জন্যে। নেমেই ভক্টর পড়লেন আলোক প্রতিসরণের ধাধায়। ডক্টর যেখানে মনে করছেন এক ফুট লাফ দিলেই গর্ত পেরুনো যাবে সেখানে হয়ত পাঁচ-ছয় ফুট লাফানর দরকার। আবার যেখানে মনে হচ্ছে চার-পাঁচ ফুট গর্ত সেটা আসলে এক ফুটেরও কম। যাই হোক ডক্টর খুব সতর্কতার সঙ্গে চারদিক পর্যবেক্ষণ করে ফিরে আসলেন।

ডক্টর বললেন, যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে প্রকৃতি যে কি নিয়মে চলে বৈজ্ঞানিকরা আজও তা ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেনি। ১৮১৭ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল ছিল শুধু বরফ আর বরফ। বরফে সমুদ্র পথ ছিল বন্ধ। হঠাৎ এক প্রলয়ে সব বরফ সরে যায়। তিমি শিকারিদের মরশুমের সূচনা হয় বাফিন উপসাগরে। কিন্তু গত বছর থেকে প্রকৃতি তার রূপ বদলাতে শুরু করেছে। বরফ জমা শুরু হয়েছে। আবার সেই ভয়াবহ বরফের রাজত্ব ফিরে আসছে।

ডক্টরের বক্তব্যে অন্য ইঙ্গিত আছে ভেবে শ্যানডন জিজ্ঞেস করল, তাহলে কি আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত?

ফিরে যাওয়া, পিছু হটা, এসব কাকে বলে আমি জানি না। দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে উত্তর দিয়ে গ্যারীকে তার অভিমত জানাতে বললেন ডক্টর। গ্যারীও পিছু হটবার লোক নয়। সে-ও চায় যত আপদ বিপদই আসুক না কেন অভিযান এগিয়ে চলুক। অজানাকে জানতে হবে তার।

আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
পরের পর্ব :
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত