০২. সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ
সমুদ্রে যাত্রার সব আয়োজনই প্রায় শেষ। ৬ এপ্রিল রওনা হবার দিন ঠিক করা হয়েছে। কারা যাচ্ছে তার একটা লিস্ট তৈরি করেছে শ্যানডন। অদৃশ্য ক্যাপ্টেন সহ মোট আঠারো জনের নাম রয়েছে লিস্টে। তারা: কে. জেড-ক্যাপ্টেন, রিচার্ড শ্যানডন-ফার্স্ট মেট, জেমস ওয়াল-সেকেন্ড মেট, ডক্টর ক্লবোনি-ডাক্তার, জনসন-ডেক নাবিকদের অফিসার, সিম্পসন-হার্পনার, বেল-ছুতোর, ব্ৰানটন-চীফ এঞ্জিনিয়ার, প্লোভার-সেকেন্ড এঞ্জিনীয়ার, স্ট্রং-বাবুর্চি, ফোকার-বরফ সর্দার, ওয়ালটন-কামার, ওয়ারেন-কয়লা জোগানদার এবং বোল্টন, গ্যারী, ক্লিফটন, গ্রিপার, পেন-নাবিক।
সবাই যার যার কেবিন গুছিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। শ্যানডনও চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হতে। তা নাহলে দেরি দেখে নাবিকেরা হয়ত বেঁকে বসতে পারে। বিশেষ করে কুকুরটির চাল-চলন সবাইকে কেমন যেন ভয় পাইয়ে দিয়েছে।
ক্যাপ্টেনের কেবিনে তালা মেরে চাবি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ইতালির পোস্টমাস্টারের ঠিকানায়। ঠিক ক্যাপ্টেনের কেবিনের সামনেই কুকুরটির ঘর। তবে কুকুরটি ঘরে থাকার চাইতে বাইরে টহল দেয়াই বেশি পছন্দ করে। কারও কথা শোনে না, কাউকে মানে না। আর, রাত-দুপুরে এমন বিকট সুরে কেঁদে ওঠে যে রীতিমত ভয় পেয়ে যেতে হয়।
কুকুরটা এমনভাবে ডেকের উপর টহল দেয়, দেখে মনে হয় যেন স্বয়ং ক্যাপ্টেন, গভীর চিন্তামগ্ন, হেঁটে বেড়াচ্ছেন জাহাজের ডেকে। ডক্টর ক্লবোনি বনের বাঘকে পোষ মানাতে পারলেও কুকুরটির বেলায় একদম নিরাশ হলেন। এমন বেয়াড়া কুকুর এর আগে তিনি দেখেননি। নাবিকেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করে দিল, এই কুকুরটি শয়তানের চেলা না হয়েই যায় না। সময় মত কুকুরের রূপ ছেড়ে আসল চেহারায় আত্মপ্রকাশ করবে; জাহাজের সবাইকে নিদের্শ দেবে।
কুকুরটি সম্পর্কে নাবিকদের এই ধারণা আরও পাকাপোক্ত হল সেদিন, যখন পেন কুকুরটিকে জখম করতে গিয়ে নিজের মাথা ফাটিয়ে বসল। এ থেকে কুকুরভীতি জাহাজের সবার মনে আরও জেঁকে বসল। সবাই ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছে কবে কুকুরটি নিজের খোলস বদলে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে।
জাহাজের কুকুর-ভীতি ডক্টর ক্লবোনিকে মোটেও দুশ্চিন্তায় ফেলেছে বলে মনে হয় না। একমনে তাঁর কেবিন সাজিয়ে চলেছেন তিনি। ওষুধপত্র থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছু এমন ভাবে সাজিয়ে নিয়েছেন, যেন হাত বাড়ালেই ঠিক জিনিসটি পাওয়া যায়।
পাঁচ তারিখ সন্ধ্যায় খেতে বসে কথা হচ্ছিল, কি করা যায় এখন। মহা সমস্যায় পড়েছে শ্যানডন। জাহাজ ছাড়বার কথা আগামীকাল অথচ এখনও ক্যাপ্টেনের নির্দেশের কোন নিশানাই নেই। ক্যাপ্টেনের আদেশ ছাড়া নোঙর তোলা সম্ভব নয়। নাবিকেরা এমনিতেই ভাগে ভাগে অবস্থা। তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই নানা রকম ভয় দেখাচ্ছে। জাহাজ কোথায় যাবে তার কোন ঠিক নেই। জাহাজের ক্যাপ্টেনেরও কোন পাত্তা নেই। শ্যানডন ঠিক করে ফেলেছে, ক্যাপ্টেনের নির্দেশ আসুক আর না আসুক আগামীকাল রওনা হয়ে পড়বে।
পরদিন সকাল থেকেই কৌতূহলীদের ভিড় বাড়ছে তো বাড়ছেই। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। দেখতে দেখতে বারোটা বেজে গেল। বারোটার ডাকেও কোন চিঠি পেল না শ্যানডন। আর অপেক্ষা করা যায় না। বেলা একটা থেকে ভাটা শুরু হবে। জোয়ার থাকতে থাকতেই রওনা হতে না পারলে জাহাজ সমুদ্রে বের হতে পারবে না, আর দেরি না করে জাহাজ ছাড়ার নির্দেশ দিল শ্যানডন। দর্শকদের ডেক থেকে নামিয়ে দিয়ে নাবিকেরা যেই নোঙর তোলার ব্যবস্থা করছে অমনি শোনা গেল কুকুরের ডাক। সবাই অবাক চোখে দেখল দর্শকদের মাঝ দিয়ে পথ করে ছুটে আসছে সেই ডেনিশ কুকুরটি। দাঁতের ফাঁকে একটি চিঠি। শ্যানডন বিস্ময়ে চেঁচিয়ে – উঠল, চিঠি, চিঠি! উনি তাহলে কাছেই কোথাও আছেন!
জনসন মৃদু স্বরে উত্তর দিল, তা তো বটেই, তা না হলে কুকুরটা চিঠি পেল। কোথায়!
ডক্টর ক্লবোনি কুকুরটিকে তার কাছে ডাকলেন। বেয়াড়া কুকুর ডক্টরকে গ্রাহ্যই করল না। সোজা শ্যানডনের পায়ের কাছে চিঠিটা ছেড়ে দিয়ে বিকট আওয়াজ করে ডেকে উঠল তিনবার। যেন শ্যানডনকে চিঠিটা পড়ার নির্দেশ দিচ্ছে।
চিঠিতে কি লেখা আছে দেখুন না! ডক্টর ক্লোনির কথায় হতভম্ব শ্যানডন বাস্তবে ফিরে এল।
চিঠিখানা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখল শ্যানডন, খামের ওপর তার নাম ছাড়া, আর কিছুই লেখা নেই। কোন তারিখ কিংবা ডাকঘরের ছাপ কিছুই নেই। ছোট্ট একটি নির্দেশ: ফেয়ারওয়েল অন্তরীপ অভিমুখে যাত্রা শুরু করুন। এপ্রিলের বিশ তারিখ নাগাদ পৌঁছে যাবেন। সেখানে পৌঁছেও যদি ক্যাপ্টেনের দেখা না পান তাহলে ডেভিস প্রণালী পার হয়ে বাফিন উপসাগর হয়ে যেতে হবে মেলভিল উপসাগরে।
(স্বাক্ষর) কে. জেড
আগের পর্ব:
০১. লিভারপুল হেরাল্ডের ছোট্ট এক খবর
পরের পর্ব :
০৩. জাহাজ সমুদ্রে ভাসতেই সবকিছু স্বাভাবিক
০৪. নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যে দিয়ে
০৫. ডক্টর ক্লবোনি অনিশ্চিত অবস্থায়
০৬. ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখে
০৭. ফরওয়ার্ডের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে সবারই খুশি
০৮. জাহাজ যতই এগিয়ে চলছে
০৯. জাহাজের পরিস্থিতি থমথমে
১০. প্রতিদিন শীতের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে
১১. প্রথমদিনেই বিশ মাইল পথ
১২. অশান্তি, অসন্তোষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে
১৩. বিশাল বরফ প্রান্তর
১৪. আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হল
১৫. ডক্টর আর জনসন ভালুকটার মাংস কেটে
১৬. ডক্টর ক্লবোনির বুদ্ধির জোরে
১৭. ডক্টর ক্লবোনির মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল
১৮. সময় আর কাটতে চায় না
১৯. হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলে গেল
২০. হরিণ ও খরগোসের নির্ভয় ছুটাছুটি দেখে
২১. মেরু অভিযাত্রীদের নৌকা
২২. এই সেই উত্তর মেরু-ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস
২৩. এত বড় বিজয়ের গৌরবে
২৪. ডক্টরের সেবা শুশ্রুষা