৩২. বত্রিশ স্বামীর স্বাস্থ্য ও সম্পদ রক্ষা করুন আয় বুঝে ব্যয় করুন
সংসার জীবনটায় দারিদ্র্য আর আর্থিক অক্ষমতার মতো মারাত্মক আর কিছুই নেই। যে লোক নিজের আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করে সে কখনোই কৃতকার্য হতে পারে না। অমিতব্যয়ী স্ত্রী স্বামীর কাছে বিরাট বোঝার মতো। এটা প্রমাণিত সত্য যে, অতিরিক্ত আয় অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একটি পারিবারিক বিষয়ক সম্পর্কে মনস্তত্ত্বের বই আমার হাতে এসে পড়ে। লেখক মনস্তাত্ত্বিক ব্যক্তিটির এক বিশেষ দুর্বলতা ছিল-তিনি কোনো পারিবারিক বাজেট বরদাস্ত করতে পারতেন না। তার মতে, পরিবারের আয়-ব্যয় কোনো ঝামেলার ব্যাপার নয়। হাতে যখন প্রচুর টাকা থাকে তখন আমরা ইচ্ছামতো খরচ করি। আর যখন থাকে না তখন সংযম অভ্যাস করি।
আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে একমত যে তার পদ্ধতি বেশ সহজ। টাকা থাকলে খরচ করব, না থাকলে করব না। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই এই পদ্ধতিকে কোনো ভাবেই সত্যিকার বুদ্ধিদীপ্ত অর্থনীতি বলে না। পরিকল্পনাহীন ব্যয়ের অর্থই হল আপনার আয় প্রায় সকলেই ভোগে লেগেছে।
পরিকল্পনা আর ব্যয়ের মাধ্যমে আপনি ও আপনার পরিবারের মানুষ শুধু উপার্জিত অর্থের একাংশ ভোগ করতে পারছেন। বাজেটের অর্থ কিন্তু উদ্দেশ্য বিহীন ব্যয় বা চুলচেরা হিসাবের তালিকামাত্র নয়। এটা হল, আপনার কাছে যে টাকা আছে বা আসছে তার সাহায্যে বেশি পরিমাণে জিনিষপত্র কেনার পরিকল্পিত এক কর্মসূচি। বাজেট অনুযায়ী ব্যয় করলে আপনি কেনাকাটার ব্যাপারে কোথায় হ্রাস-বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, কোটা বাদ দেওয়া উচিত, কোটার সংযোজন চাই, এসব সহজেই বুঝতে পারবেন। আপনি যদি বরাবর বাজেট সম্পর্কে সচেতন না হন, তাহলে বাজেটানুগ হওয়ার পদ্ধতিটি লিখে ফেলুন। কীভাবে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করতে হয় তাও অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত করার চেষ্টা করতে শুরু করুন।
আপনার স্বামীকে জীবনযুদ্ধে জয়ী করে তোলার ক্ষেত্রে আপনি যে মস্ত এক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন তা হল, যতদূর সম্ভব তার আয়-ব্যয়ের সাহায্যে চাহিদার সঙ্কুলান করা আর তাকে আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখা। আপনার কাছাকাছি ব্যাঙ্কে নিশ্চয়ই নিজস্ব বাজেট থাকে বা এ বিষয়ে তাদের উপদেস্টাও থাকা সম্ভব। তাহলে পারিবারিক বাজেট কীভাবে তৈরি করা যায় সে সম্পর্কে তাদেরই সাহায্য নিন। তারা নিশ্চয়ই আনন্দের সঙ্গে আপনাকে পরামর্শ দেবেন। বিনা খরচেই ব্যাঙ্ক আপনার সেবায় তৈরি থাকবে। এ ছাড়াও নানা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে পারিবারিক বাজেটের উপর নানা ধরনের বুলেটিন প্রকাশ করা হয়। এই সব পাঠ করলে আপনি নিশ্চয়ই উপকৃত হবেন। তবে আপনার নিজস্ব বাজেট আপনাকেই তৈরি করতে হবে-আর সেটা করতে হবে আপনার নিজের সামর্থ্য ও প্রয়োজনের দিকে নজর রেখেই।
এবার বাজেট সম্পর্কে আপনাকে কিছু ধারণা দিতে চাই। যেমন, তালিকা রাখুন :
১। প্রথমেই খরচের একটা তালিকা রাখতে শুরু করুন : কোথায় কীভাবে ব্যয় কমাতে হবে সেটা ধরতে না পারলেও খরচ কমানো যাবে না। অতএব কিছুদিনের জন্য নমুনা হিসাবে একটা খরচের তালিকা তৈরি করে নিন। ফলে বছরে মোট ব্যয়ের পরিমাণ কত হল, কোন্ খাতেই বা কত তার সবই বুঝতে পারা যায়। এর ফলে যদি দেখা যায় যে, খরচ বেড়ে যাচ্ছে তাহলে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয়। এটা করার সত্যিই দরকার আছে।
২। আপনার পরিবারের প্রয়োজনের দিকে নজর রাখার বাজেট তৈরি করুন : বছরের যে সব ব্যয় নির্দিষ্ট, যেমন-বাড়ি ভাড়া, ধার শোধ, জিনিসপত্র কেনাকাটা, বীমার প্রিমিয়াম ইত্যাদির হিসাব রাখা চাই। পারিবারিক বাজেটের ক্ষেত্রে এটা হল জটিলতার দিক। বাজেটের এই দিকের সিদ্ধান্তে পারিবারিক সহযোগিতা আর আত্মত্যগের প্রশ্ন জড়িত। সব কিছুই আমাদের পক্ষে পাওয়া সহজ নয় মনে রাখবেন, চটজলদি কোনো বাজেটে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করা থাকে না।
৩। বার্ষিক আয়ের দশভাগ যেন পরিবার পায় : একটা কৌশল সকলের পক্ষে বেশ কার্যকর। সেটা হল, নিজেকে আর পরিবারকে পাওনাদার বলে ভাবতে থাকা। এই জন্যই কমপক্ষে আপনার আয়ের দশভাগ সঞ্চয় করান বা বিনিয়োগ করুন। আপনি যদি স্বামীর আয়ের দশভাগ সঞ্চয় করতে সক্ষম হন, তাহলে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও খুব বেশি সময় লাগবে না।
এক ভদ্রলোকের কথা আমার জানা আছে, যার নীতি ছিল যেমন করেই হোক আয়ের দশভাগ তিনি বাঁচাবেন, এজন্যই তার যতরকম অসুবিধাই হোক তিনি তা সহ্য করতেন।
৪। দুর্দিনের জন্য তহবিল : বেশির ভাগ বাজেট বিশেষজ্ঞ এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন যে, তিন মাসের সমপরিমাণ অর্থ দুর্দিনের জন্য সঞ্চিত রাখা একান্ত প্রয়োজন। এমার্জেন্সী ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টেই এই টাকা রাখা যায়। তাঁদের মতে, এ কাজ প্রত্যেকেরই করা উচিত। তারা এ কথা বলেন যে, অযৌক্তিকভাবে সঞ্চয় করতে থাকলে অনেক জরুরি কাজে ঘাটতি দেখা দেয়, কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হওয়ার অবস্থায় এসে পড়ে। একসাথে অনেক টাকা সঞ্চয় না করে বরং অল্প অথচ নিয়মিতভাবে সঞ্চয় করতে শুরু করলে সঞ্চয়ের আনন্দ উপভোগ করা যায়-আর পরিবারের আর্থিক অনটনও থাকে না।
৫। বাজেটকে পারিবারিক উদ্যোগ করে তুলুন : উপদেষ্টারা মনে করেন যে, পারিবারিক বাজেট তৈরি করার কাজে পরিবারের প্রায় সকলেই সহযোগিতা আর উৎসাহ থাকা একান্ত প্রয়োজন। মাঝে মাঝে পরিবারের সদস্যরা বাজেট বৈঠকে উপস্থিত থেকে নানা আবেগময় অভিযোগের সমাধান ঘটাতে পারেন। এতে অনেক সুরাহা হবে।
৬। জীবন বীমা গ্রহণ করে সুখী হয়ে উঠুন : ইনস্টিটিউট অফ লাইফ ইন্সুরেন্সের মহিলা বিভাগের পরিচালক মেরিয়ান স্টিভেন্স বীমা সংক্রান্ত তথ্যাবলীর উপর অতুলনীয় দক্ষতায় আলোচনা করতে পারতেন।
আসলে বীমা সম্বন্ধে ভদ্রমহিলার বিপুল অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি গৃহিণীদের এ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। প্রশ্নগুলো এই রকম : যেমন-আপনি কি জানেন জীবনবীমার পলিসি গ্রহণ করলে আপনার পরিবারের মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে কোনগুলো পূরণকরতে হবে? আপনি কি জানেন স্থায়ী ও অস্থায়ী পলিসির মধ্যে পার্থক্য কোথায় আর দুটোই বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক? আপনি কি জানেন যে আধুনিক জীবন বীমার লক্ষ্য হল দু’রকম। যেমন-যদি বীমাকারী অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যান তা হলে সম্পাদিত বীমাচুক্তি তার পরিবারকে রক্ষা করবে। আর যদি তার অকালে মৃত্যু না হয় তবে বার্ধক্যের সময় ওই টাকা তার জীবনে মূলধনের রূপ নিয়ে আসবে? এই ধরনের নানা প্রশ্নই আপনার পরিবারের সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয়। এই সব প্রশ্নের উত্তর কেবল আপনার স্বামীর জানা থাকলেই চলবে না, পরিবারের অন্যতম পরিচালিকা হিসেবে আপনারও এসব জানা থাকা দরকার।
এটি সত্যি যে, টাকাই সবকিছু নয়। কিন্তু কীভাবে আমরা নিজের নিজের উপার্জন দূরদৃষ্টির সঙ্গে ব্যয় করব তা জানার উপরেই আমাদের মনের সুখ-শন্তি স্বামী আর পরিবারের মঙ্গল ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
আমাদের স্ত্রীদের উচিত, স্বামী যা উপার্জন করছেন ব্যয়ের ব্যাপারে অনেক সতর্ক আর সুবিবেচক হয়ে ওঠা। এক্ষেত্রে কয়েকটি নিয়ম আমাদের মেনে চলা প্রয়োজন। যেমন :
১। একটি বাৎসরিক বাজেট তৈরি করে ফেলুন।
২। আপনার আয়ের দশ ভাগ সঞ্চয় করুন।
৩। দুর্দিনের জন্য একটি তহবিল তৈরি করুন।
৪। বাজেটকে পারিবারিক বিষয় করে তুলুন।
৫। জমানো সম্পর্কে সজাগ থাকার চেষ্টা করুন।