১৭. এক তরুণী স্ত্রী ও তার স্বামীর কাহিনী
আমেরিকার কেন্টাকির অধিবাসী মি. এবং মিসেস হাইনস চৌদ্দ বছর বিবাহিত জীবন যাপন করেছিলেন। আশ্চর্য ঘটনা যেটা তা হল, মিসেস হাইন্স অহেতুক নানান রকম ভয় পেতেন। সব রকম আত্মবিশ্বাসই তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
মি. হাই ছিলেন একজন স্থানীয় রাজনীতিজ্ঞ যুবক আর আইন ব্যবসায়ী। প্রায় সময়ই তাকে অতিথি অভ্যাগতদের অপ্যায়ন করতে হত। তার স্ত্রী কোরী হাইন্স কিন্তু এই সব কাজে এগিয়ে যেতে ভয় পেতেন। স্বামীর সব রকম সামাজিক কাজকর্মে অংশ নিতে ভয় পেতেন। লজ্জা আর ভয় তাকে ঘিরে থাকতো। মিসেস হাইস মনস্থির করে ফেললেন যে, যেভাবেই হোক স্বামীর কাজে সহায়তা করার জন্য এই ভয় আর আড়ষ্টতা তাকে দূর করতেই হবে।
একদিন এক মাসিক পত্রিকার একটি প্রবন্ধ পড়েই তার চিন্তাধারা একেবারে পাল্টে যায়। তাতে লেখা ছিল: মানুষ বিশেষভাবে নিজের প্রতি আকর্ষণশীল হয়-তাই সব সময় অন্যের উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অপরকে তাই সুকৌশলে তার সমস্যা সমাধানের বিষয়ে তার নিজের সাফল্যের বর্ণনা করতে দিন। তার দিকেই মনোযোগ দিয়ে নিজের কথা ভুলে যান।
কোরী হাইন্স ঠিক করলেন যে, এই পরামর্শ নিজের জীবনে লাগাবেন। তিনি বলেন, অন্যের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ফলে সত্যিই একটু একটু করে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিল, আমার সমস্ত ভয়ও দূর হয়ে গেল। আমি লক্ষ্য করলাম আমার মতো অন্যদেরও সমস্যা আর অসুবিধা আছে। একে একে তাদের আমি ভালবাসতে শুরু করলাম। আমার বাড়িতে তাদের আদর আপ্যায়ন করতে লাগলাম। আমার স্বামীর সঙ্গে আমি নানা জায়গায় যেতে লাগলাম। সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজে আমার স্বামীকে অর্থাৎ বর্তমানে আইনসভার একজন সম্মানিত সদস্য যিনি, তার সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ পতন থেকে রক্ষা করেছি। এ কথা যখন মনে হয় তখন নিজেকে ধন্য বলে ভাবি। . স্বামীর জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রত্যেক স্ত্রীর অবশ্য কর্তব্য। স্বামীর কাজের উন্নতির পথে এগিয়ে চলার জন্য স্ত্রীকে অন্য সকলের সঙ্গে সদ্ভাব আর আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখাই কর্তব্য। এ কাজে নিজেকে যোগ্য করে তোলা চাই।
সফল স্বামীর স্ত্রীর সাফল্যও অবহেলার নয়। এটি একটি প্রয়োজনীয় গুণ। আমেরিকার একজন অত্যন্ত বিখ্যাত গভর্নর আমাকে বলেছেন যে, তার সাফল্যের বেশির ভাগটাই একজন চিন্তাশীল সুন্দরী স্ত্রীর উপরেই নির্ভরশীল ছিল। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর সহায়তা আমার পক্ষে অপরিহার্য।
এই প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, কোরী হাইসের মতো আপনার যদি ভয় থাকে তাহলে সেটা ত্যাগ করার জন্য তৈরি হোন। অন্য মানুসের সঙ্গ আপনার সাহায্যে আসতে পারে। অন্যকে তাই সম্মান করুন, তাদের ভালবেসে একাত্ম হয়ে উঠুন, দেখবেন আপনার ত্রুটি অনেকটাই দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যের সাহচর্যেই এটা সম্ভব।
আমেরিকান সিনেমা অ্যাসোয়িশনের প্রেসিডেন্টের স্ত্রী মিসেস জনস্টন লিখেছেন-’সফল কোনো বিবাহের আসল চাবিকাঠি হল, স্বামীর সদা পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সঙ্গে তালে পা ফেলে চলতে পারার ক্ষমতা। মিসেস জনস্টনের উপদেশ হল, যারা স্বামীর পদক্ষেপের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে চান তারা যেন সুযোগ পেলেই সামাজিক কাজকর্মে বেশি করে অংশ গ্রহণ করে বন্ধু-বান্ধবের পরিচয়ের গণ্ডী যেন বাড়াতে থাকেন।’
আমরা কিন্তু কেউই জানি না কীভাবে কার ভবিষ্যতের দরজা খুলে যাবে। কিন্তু যখন সুযোগ উপস্থিত হবে তখন তার জন্য নিজেকে তৈরি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। যেমন-দেখবেন আপনার স্বামী একটা উপযুক্ত সামাজিক অবস্থায় পৌঁছে গেছেন, সেই সময়ের সদ্ব্যবহারের জন্য তৈরি সামাজিক অবস্থা যাই হোক না কেন আপনার উচিত হবে আপনার স্বামীকে সব সময় সাহায্য করা। কোনো ক্ষেত্রে যদি কখনও স্বামীর আচার-ব্যবহার অভদ্রোচিত হয়, তখন বুদ্ধিমতী স্ত্রীর উচিত হবে স্বামীর ভুল সংশোধন করা।
আবার এটাও মনে রাখা চাই যে, স্ত্রী সব সময় ভালবাসাপূর্ণ মনোভাব ও পরিবেশের সৃষ্টি করেন, সে রকম স্ত্রীকে পিছনে ফেলে কখনও কোনো স্বামী জীবনপথে এগিয়ে যেতে পারেন না। এই ধরনের স্ত্রী যে কোনো স্বামীর কাছেই শুভেচ্ছায় দূত। এমনও মানুষ বহু পথের সন্ধান পেতে পারে যার সাহায্যে যে কোনো সুরুচিসম্পন্ন স্ত্রী স্বামীকে মূল্যবান সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা দান করতে পারে। মনে রাখা দরকার অন্য সব কৌশলের মতো এই কৌশলেও সব সময় অনুশীলন করা প্রয়োজন।
এই বিষয়ে একজনের উদাহরণ দিচ্ছি। তিনি হলেন আমেরিকান সংবাদ পরিবেশন সংস্থার প্রেসিডেন্ট মি. হ্যাঁনস ডি. কান্টেনবর্নের স্ত্রী মিসেস কান্টেনবর্ন। এই ধরনের সহায়তা দানের কাজে অত্যন্ত নিপুণা তিনি। তিনি অতি কৌশলে কথা বলতে পারেন।
একবার টাউন হলে কোনো সভায় বক্তৃতার শেষে মি. ক্যন্টেনবর্ন শ্রোতাদের কাছ থেকে এত বেশি সংখ্যায় প্রশ্নের সম্মুখীন হন যে মিসেস কান্টেনবর্ন দেখেন যে, কোনোভাবে বাধা না দিলে তার স্বামী খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। মিসেস কান্টেনবর্ন চাইলেন, যত শীঘ্র সম্ভব সভা ভেঙে দেওয়া দরকার। মিসেস কান্টেনবর্ন তাই মাথা তুলে বলে উঠেছিলেন, আমার একটা প্রশ্ন আছে, দয়া করে শুনুন। সবাই থামতেই তিনি বললেন, ‘মিসেস কান্টেনবর্ন’ জানতে চায় মি. কান্টেনবর্ন কখন মধ্যহ্নভোজ সারতে বাড়ি ফিরবেন?’ এ কথায় শ্রোতারা বেশ লজ্জিত বোধ করে থেমে যান আর বক্তাও বাড়ির দিকে রওনা হল।
স্বামীকে সফলতার পথে নিয়ে যাওয়ার কাজে আরও এক মূল্যবান সাহায্য স্ত্রী করতে পারেন। এই কাজটি করতে গেলে যথেষ্ট রকম ভালবাসা, অনুভূতি এবং তারই সঙ্গে চাই বেশ কিছু সময়। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এটা নিপুণভাবে সম্পন্ন না করা হয় তাহলে ভীষণভাবে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। স্ত্রীর নজর রাখা প্রয়োজন যে স্বামীর মন থেকে সাফল্যের আর কৃতকার্য হওয়ার আশা বা ধারণা যেন কোনোভাবেই চলে না যায়।
প্রত্যেক স্ত্রীই জানেন বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনো কোনো স্বামী-স্ত্রী কীভাবে কাজটি করতেন চান। এই কাজটি যে স্ত্রী সাফল্যের সঙ্গে করতে পারেন তিনি সত্যিই কৃতজ্ঞতার পাত্রী তাতে সন্দেহ নেই। এই ধরনের স্ত্রী নিঃসন্দেহে যা চায় তাই পেয়ে থাকে। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলি তার স্ত্রীকে কঠোর সমালোচক বলতেন। ডিজরেলি স্ত্রীর কথাকে প্রচুর মূল্য দিতেন বলেই এ কথা বলতেন। তিনি এই প্রশংসা করেছেন সমালোচনার জন্যই। তিনি বলেছিলেন যে, তাঁর স্ত্রী সমালোচনার মধ্যে দিয়েই তাঁকে পদঙ্খলন থেকে রক্ষা করেছেন সেই কারণে তিনি ধন্য।
আমার একজন অতি পরিচিত অত্যন্ত সফল মানুষ আমাকে একবার বলেছিলেন যে, তাঁর স্ত্রী তার সফল জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের এক বিরাট অংশ। ভদ্রলোকের নাম লাইনম্যান বীচার স্টো। তার পিতামহী হ্যারিয়েট বীচার স্টো একদিন বিখ্যাত ‘আঙ্কল টমস কেবিন’ নামের বইটি রচনা করেছিলেন। তিনি একজন বিখ্যাত লেখক আর অধ্যাপক।
মিষ্টার স্টো বলেন, যখন আমি প্রথম মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিয়েছিলাম, তখন সৌভাগ্যক্রমে আমার শ্রোতাদের খুবই সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলাম। কলেজে ওই বক্তৃতার কথা ছাপাও হয়। আমার স্ত্রী হিলডা প্রধানত আত্মবিশ্বাসের উপরেই জোর দিয়েছে। সে আমাকে বলল, লাইনম্যান, তুমি যে ভালো করেছ তাতে আমি সত্যিই খুব আনন্দিত, কিন্তু কখনোই প্রশংসায় তুমি পথভ্রষ্ট হবে না। মনে রেখো, কঠোর পরিশ্রম করে তারই সঙ্গে যদি তোমার কাজের ধারাকে ঠিক না রাখ, তাহলে দেখবে তোমার এই শ্রোতারাই তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে।
একবার এক জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বাড়ি ফিরে হিলডার কাছে বক্তৃতার খুঁটিনাটি শোনালাম। আর অপেক্ষা করতে থাকলাম তার প্রশংসা শোনার জন্য।
হিলডা মন দিয়ে সব শুনে সে মৃদু হেসে বললো, ‘খুবই চমৎকার আর আনন্দের খবর, কিন্তু বক্তৃতার বিষয় থেকে দেখতে পেলাম তুমি ওই বাড়িতে যারা থাকবে তাদের সম্বন্ধে কিছুই বল নি। আমার ধারণা তারাও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর প্রশংসা পাওয়ার সব আশাই মিলিয়ে গেল। কিন্তু হিলডাকে আমি আরও বেশি ভালবাসতে শুরু করলাম কারণ ওর সুরুচি সম্বন্ধে জ্ঞান দেখে। আমি এর পরই আমার কাজে আরও সতর্ক হলাম আর সেই ভাবেই কাজ করতে লাগলাম। এভাবেই আমার ভবিষ্যতকে মজবুত করলাম।
মিসেস হাইস, মিসেস জনস্টন, মিসেস কান্টেনবর্ন ও মিসেস স্টো এই সমস্ত মহিলারাই জানেন, কেমন করে স্বামীর সঙ্গে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে হয়। আর কেমন করে তাদের ভালবাসা লাভ করা যায়।
এই কাজ তারা করেছেন বন্ধু-বান্ধবদের ভালবাসা জয় করে, আদরণীয় হয়ে স্বামীদের বাস্তবভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করে। এর সঙ্গে তারা স্বামীদের সঙ্গে সমান তালেই চলতে পেরেছেন।
যে স্ত্রী এভাবে কাজ করতে পারেন তার ভবিষ্যৎ স্বামীর সঙ্গে মজবুত না হয়ে পারে না।
সংক্ষেপে তের-চৌদ্দ-পনের-ষোল-সতের পাঠের নিয়মগুলি:
১। যখনই প্রয়োজন দেখা দেবে তখনই অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি রাখতে হবে।
২। স্বামীকে বাড়তি কাজ করতে হলে সে ব্যাপারটি মানিয়ে নিতে হবে।
৩। স্বামীর কাজে হাসিমুখে যোগ দেওয়া দরকার।
৪। স্বামীকে যদি ঘরে বসে কাজ করতে হয় তবে পরিবেশকে সহজ করে নেওয়া দরকার।
৫। নিজের কাজ যদি কোনো ভাবে স্বামীর স্বার্থের পরিপন্থী হয় তাহলে তা পরিত্যাগ করা উচিত।
৬। স্বামীর কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলা প্রয়োজন।