১২. নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলুন
এক ধরনের মহিলাদের দেখা যায়, যারা স্বামীদের নিজের কাজের জায়গাতেই আবদ্ধ রাখতে চান-তারা কোনো অবস্থাতেই স্বামীদের অন্য জায়গায় যেতে দিতে রাজি হন না। অনেক সময় এই ধরনের মহিলারাই হয়ে ওঠেন পুরুষের উন্নতি লাভের প্রধান অন্তরায়।
এটা ঠিক কথা যে, নিজের পরিচিত গণ্ডি নিজের বাসস্থানটি ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে বেশ একটু সাহসের প্রয়োজন হয়। মেয়েরা এ ব্যাপারে প্রকৃতিগত দিক থেকে দক্ষ হতে পারে। অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সুখের সংসার গড়ে তুলতে পারে একমাত্র মেয়েরা। এর জন্য প্রয়োজন সহনশীলতা। একজন সহনশীলা স্ত্রীই চলার পথে সব বাধা কাটিয়ে উঠতে পারেন। এই রকমই একজন মহিলা ছিলেন মিসেস লিওনার্ড কাসনার। মিসেস কাসনার উওম্যান’স ডে ম্যাগাজিন নামের এক পত্রিকায় নিজের কাহিনী লিখেছিলেন। তিনি যা লেখেন তা হল এই রকম :
দু’বছর আগে আমার স্বামীর ডাক পড়েছিল এক নৌযুদ্ধে যোগদান করার জন্য। আমাকেও যেতে হল সঙ্গে। কিন্তু আমাদের নতুন সুন্দর বাড়ি ছেড়ে মাত্র দু’বছরের ছোট ছেলেকে নিয়ে যেতে হবে জেনে, বিশেষ করে বিদেশে, আমার মন খুবই খারাপ হয়ে যায়। উপায়হীন হয়ে আমাকে যেতে হল, স্বামীর সঙ্গে প্রথম সেনা ছাউনীতে হাজির হলাম।
আমি কেবলই ভাবছিলাম যে, আমদের চরম দুঃখের দিনই বোধ হয় এসে গেছে। কিন্তু আবহাওয়া আর নতুন নতুন জায়গায় ঘোরার পর ভেবে দেখতে লাগলাম ব্যাপারটা সত্যিই তো তেমন খারাপ হল না। আমার স্বামী তাড়াতাড়ি কাজ থেকে অবসর নিতে চলেছেন। আমরা আবার ফিরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করবার চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করেছি। ভবিষ্যৎ জীবনের হাতছানিতে রোমাঞ্চিত হয়েও কিন্তু বর্তমান জীবন থেকে সরে যাওয়াটাও খারাপ লাগতে শুরু করেছে।
এই নতুন জীবনের দু’টো বছর যেভাবে কাটালাম তাতে আমি কৃতজ্ঞ না হয়ে পারছি না। দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো সমস্ত অসুবিধা এখন আমি কাটিয়ে উঠতে শিখেছি।
আজ আমি বুঝতে শিখেছি যে, সুখের ঘর সংসার বলতে কেবল কিছু সুযোগ সুবিধা আর বস্তুকেই বোঝায় না-বরং যে সব মানুষের সংশ্রবে আমরা বাস করি তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা আর সহমর্মিতাকেই বোঝায়। পারস্পরিক প্রীতি ও ভালবাসা, মূল্যবোধ আর পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়ে জীবন উপভোগই আসল জীবনের মাধুর্য।
.
কোনো কারণে যদি পরিচিত পরিবেশ থেকে দূরে কোথাও যেতে হয় এবং সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়, তাহলে নিচের চারটি পরিকল্পনার কথা মনে রাখা প্রয়োজন।
(১) এ কথা কখনও মনে করতে নেই বা এ ধরনের আশা পোষণ করতে নেই যে, নতুন জায়গায় পরিচিত পরিবেশ পাওয়া যাবে। স্বামীর আগের চাকরি বা কর্মস্থল যদি কোনো ভাবে বর্তমানের চেয়ে কম মর্যাদার হয় তাহলে নিরুৎসাহ হবার কিছু নেই। মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান অতীতের থেকে বেশি মর্যাদা আনতে পারে।
২) অভ্যস্ত আর পরিচিত সুযোগ-সুবিধা থেকে হঠাৎ বঞ্চিত হতে হলেও ভেঙে পড়ার কিছু নেই। যা পাওয়া যাচ্ছে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থেকে নিজের কর্মশক্তিকে পরীক্ষা করতে হবে। আত্মবিশ্বাসই হল মূল শক্তি, এই বিশ্বাস হারানো উচিত নয়।
আমার নিজের জীবন থেকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি : এক গ্রীষ্মকালে আমার স্বামী উইওমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাকোর্সে শিক্ষা দান করছিলেন। থাকার জায়গার অভাবে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম প্রবীণ সৈনিক ও তাদের পরিবারদের জন্য তৈরি অস্থায়ী বাড়ির একটিতে। আমি ভাবতেই পারি নি যে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি আমার ভুল ভেঙে গেল। ওখানে বাস করতে গিয়ে আমি আমার জীবনের এক মূল্যবান আর শ্রেষ্ঠ পুরস্কারই লাভ করেছিলাম।
এক সুন্দর অভিজ্ঞতা আমার লাভ হল। আমি দেখলাম আমার কাছাকাছি যারা ছিল তারা কেমন নিশ্চিন্ত আরামেই জীবনধারণ করছে। সব কিছু স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দেখে নিজের মনোভাবের জন্য লজ্জিত হলাম। বহু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার অভিজ্ঞতাও অনেক বেড়ে গেল। বুঝতে পারলাম যে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে কৃতকার্যতা ও আনন্দের কোনো সম্পর্ক নেই, সবটাই মানসিক।
(৩) যে অবস্থার মধ্যে পড়ুন না কেন কখনোই অবস্থার ভালো-মন্দ না দেখে বিচার করা ঠিক নয়।
আমার পরিচিত একজন মহিলার কথা বলছি। মহিলাটির স্বামীর পদোন্নতির ফলে অন্য জায়গায় বদলী হন। স্বামীর সঙ্গে মহিলাটিও নতুন বড় কোনো শিল্প শহরে গেলেন। কিন্তু পরিবেশে মানাতে না পেরে চব্বিশ ঘন্টা পরেই নিজের শহরে চলে এলেন। স্বামীকে এরপর দু’জায়গায় খরচ চালাতে হল আর সমস্ত আয়ই নিঃশেষ হতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক আগে মাইনের, আগের পদ ও জায়গায় ফেরার আবেদন জানালেন যেহেতু ভদ্রলোকের স্ত্রী পদোন্নতির জায়গা পছন্দ করেন নি।
(৪) নতুন সুযোগ-সুবিধার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করুন-পিছনে ফেলে আসা কিছুর জন্য চিন্তা করবেন।
নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে যেতে হলে প্রথমেই সেখানে নিজে এগিয়ে গিয়ে মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হয়। যে সব কাজকর্ম আপনার রুচি-বিরুদ্ধ তার সম্বন্ধে অনুযোগ না জানিয়ে সেগুলোর উন্নতি সাধনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই নিষ্কলঙ্ক নয়-প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যেকটির মধ্যে দোষ, গুণ, সমানভাবে থাকে।
আর এক মহিলার কথা আপনাদের শোনাব। তিনি হলেন মিসেস রবার্ট ওয়াটসন। তিনি বর্তমানে থাকেন ওকলাহোমায়। তিনি তার স্বামীর সঙ্গে প্রায় সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন। তার স্বামী মি. ওয়াটসন কার্টার অয়েল কোম্পানীর ভূতাত্ত্বিক।
ওয়াটসন দম্পতি তাদের চারটি সন্তানকে নিয়ে পৃথিবীর সুদূর আদিম পরিবেশের মধ্যে কাটিয়েছেন। ওইভাবে অচেনা অজানা পরিবেশে বাস করে আশ্চর্য অভিজ্ঞতা লাভ করে তারা প্রচুর আনন্দও পেয়েছেন। ওয়াটসন পরিবারের মতো সত্যিকার আদর্শ পরিবার পাওয়া সত্যিই কঠিন ব্যাপার।
মিসেস ওয়াটসন অত্যন্ত দক্ষ মহিলা। তিনি বলেন, যে কোনো মুহূর্তে আমি আমার পরিচিত পরিবেশ আর বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে দ্বিধা বোধ করি না। আমার অনুভূতি আর প্রবণতাকে এই অতি সহজ কাজ করার জন্য তৈরি রাখি। আমাদের পরিবার আজ বুঝতে পেরেছে যে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় তাদের সকলকেই সমান আনন্দ, শিক্ষা আর উপভোগের সমস্ত রকম উপকরণই সরবরাহ করতে পারে। এরজন্য যে আগ্রহের প্রয়োজন হয় তার সবটুকুই আমাদের সকলের আছে। সুদূর বাহামা দ্বীপপুঞ্জে থাকার সময় হঠাৎ জানা যায় যে, একজন বিখ্যাত ডুবুরী, সমুদ্রে ডুবুরীর কাজ সম্বন্ধে চিত্তাকর্ষক শিক্ষা দান করছে। আমাদের মেয়ে সুমির ডুবুরীর কাজে আগহ থাকায় ওই মানুষটির কাছে তাকে পাঠালাম আর অল্প কিছুদিনের মধে সে চমৎকার দক্ষতা অর্জন করলো। আমরা যদি অন্য কোথাও থাকতাম তাহলে এমন আনন্দময় অভিজ্ঞতা কখনোই অর্জন করতাম না।
মিসেস ওয়াটসন আরও বলেন যে, আমি একসময়ে কোনো এক প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিচালককে মন্তব্য করতে শুনেছি তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে সেই কর্মীদেরই নিয়োগ করেন যাদের স্ত্রীরা যে কোনো জায়গায় সানন্দে যেতে প্রস্তুত।
.
এই সব ঘটনা থেকে বুঝতে পারা যায় যে, বিদেশে বা অপরিচিত কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকলে নিজেদের উন্নতির পথই পরিষ্কার হয়। তাই কোনো অনুযোগ না জানিয়ে বিদেশে চাকরির সমস্ত সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা উচিত। প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত স্বামীর কাজ যদি এই ধরনের হয় তবে সব সময় তাকে উৎসাহিত করা।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘সঞ্চরণশীল প্রস্তরখণ্ডে শেওলা ধরে না।’ কথাটি খুবই সত্য, প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত স্বামীকে ওই প্রবাদের মতো সঞ্চরণশীল পাথর হতে উৎসাহিত করা।
কতকগুলি নিয়ম আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন :
১। এই ধরনের আশা কখনোই করা ঠিক নয় যে, নতুন পাওয়া পরিবেশ আপনার আগের পরিবেশের মতোই হবে।
২। আপনার অভ্যস্ত পরিচিত সুযোগ-সুবিধার স্মৃতি মনে না রাখাই ভালো, অতীতের চিন্তা মন থেকে মুছে না ফেললে বিরক্তির শিকার হতে হবে। তাই অতীতের স্মৃতিতে অবগাহন করা ঠিক নয়।
৩। নতুন কোনো কাজে নতুন জায়গায় আসতে হলে কখনোই সেই কাজ আর পরিবেশকে ভালোভাবে পরীক্ষা না করে এমন সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না যে, ‘এই কাজ বা জায়গা আপনার পক্ষে উপযোগী হবে না।’
৪। নতুন পাওয়া সুযোগকে সুফলদায়ী করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আগের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা ভাবনা করে কাতর না হওয়াই ভালো।