০৪. ছয়টি উদাহরণ
যে ছ’টি নিয়মের কথা এই পরিচ্ছেদে উল্লেখ করবো সেগুলো যদি ঠিক মতো অনুসরণ করা যায়, আমার মনে হয় এর সুফল নিশ্চয় প্রত্যক্ষ করা যাবে। একজন আদর্শ স্ত্রী হিসাবে এই নীতি আপনি আপনার স্বামীকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করুন। অল্প সময়ের মধ্যেই ফল বুঝতে পারবেন। এবার আমরা নিয়মগুলো আলোচনা করবো:
১। আপনার কাজের জায়গায় শিক্ষা নিন। কাজের সব খুঁটিনাটি আর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সার্বিক সম্পর্কে জেনে নিন : যারা চাকরি করতে অভ্যস্ত তাদের শতকরা অন্তত পঁচাত্তর ভাগ মানুষ মনে করেন, তারা কোনো বিশাল যন্ত্রের একটা অংশ মাত্র। এর অর্থ হল, তারা নিজেদের কাজের গুরুত্ব বা নিজেদেরও গুরুত্ব সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। এই সমস্ত লোক শুধু নিজেদের কাজটুকু নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সেই কাজের সঙ্গে অন্য যে সব কাজ অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকে সে সব কাজ সম্পর্কে তার আর কোনো রকম আগ্রহ থাকে না।
এটা আমাদের জানা দরকার যে, কোনো জিনিস সম্পর্কে জানতে গেলে যেটা একান্ত প্রয়োজন সেটা হল অনুসন্ধিৎসা। যদি অনুসন্ধিৎসা না থাকে তাহলে জানার স্পৃহা গড়ে ওঠা একেবারেই সম্ভব নয়। এই সম্বন্ধে প্রখ্যাত সাংবাদিক আইডা এম, টারবেল বলেন-একবার মাত্র পাঁচ’শ শব্দের একটি রচনা লেখার জন্য আমি কয়েক সপ্তাহ পরিশ্রম করে রচনার বিষয়বস্তুর মালমসলা যোগাড় করেছিলাম। কিন্তু লেখার সময় আমার সংগ্রহ করা মালমসলার সামন্যই কাজে লেগে ছিল। তবু তাতে আমি প্রচুর আনন্দ পেয়েছিলাম। যে মালমসলা বাইরে পড়েছিল সেগুলো থেকে আমার জ্ঞান বেড়ে গিয়েছিল অঢেল। আমার লেখায়ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ায় দারুণ কার্যকরী হয়ে ওঠে।
প্রখ্যত বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবনেও এই অনুসন্ধিৎসা ভীষণভাবে কার্যকরী হয়েছিল। ফ্রাঙ্কলিন জীবন শুরু করেছিলেন এক সাবানের কারখানায় মজুর হিসাবে। কীভাবে সাবান তৈরি করা হয় সে সম্পন্ধে তার আগ্রহ ছিল। নিজের করণীয় কাজে তার একটুও অনীহা ছিল না। কাজের ব্যাপারে মালিকও ফ্রাঙ্কলিনের ওপর খুব খুশি ছিলেন।
এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের উৎপন্ন মালপত্র বিক্রির জন্য বিক্রয় প্রতিনিধি রাখা হয়, তাদের প্রতিটি উৎপন্ন জিনিসের তৈরি বিশদ বিবরণ লিখতে হয়। অথচ বিক্রি করার সময় সেটার কোনো প্রয়োজন হয় না। এই বাড়তি জ্ঞান থাকার দরুন প্রতিনিধিদের দায়িত্ব জ্ঞান বাড়ে আর উৎসাহও দেখা যায়। যে বিষয়ে যত বেশি জানা যায়, সে বিষয়ে আমাদের ততই উৎসাহ বেড়ে যায়। এই জন্যই যে কোনো আদর্শ স্ত্রীর জানা প্রয়োজন যে, যদি তার স্বামী কাজে উৎসাহ বোধ না করে তবে তার ত্রুটি কোথায়? এই ত্রুটি খুঁজে বের করে স্বামীকে উদ্বুদ্ধ করাই হবে স্ত্রীর কাজ। হয়তো লক্ষ্য করা যাবে যে স্বামীর নিজের কাজ সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান নেই বা আগ্রহও নেই, এক্ষেত্রে স্ত্রীর কর্তব্য হবে সেই সুপ্ত অজ্ঞানতাকে দূর করার জন্য সাহায্য করা।
২। লক্ষ্য স্থির করে তাতে লেগে থাকুন : আপনি যদি মনে করেন, কোনো কাজে সফল হবেন তাহলে আপনার প্রথম কাজ হবে কাজটির দিকে স্থির দৃষ্টি রাখা। আপনার জানা অবশ্যই প্রয়োজন যে কাজটির প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? এর পরের কাজ হবে তার পিছনে লেগে থাকা। এই ধরনের মন মানসিকতা থাকলে নানা বাধা-বিপত্তি বা সাময়িক ব্যর্থতায় কখনও নিরুৎসাহ হবেন না।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, কেউ যদি নিজের কাজে সিদ্ধিলাভ করতে আগ্রহী হয়, তাহলে নিজের কাজ আর কর্তব্য সম্পর্কে তাকে নিবিষ্ট হতেই হবে। জীবনে কৃতকার্য হতে গেলে এটা প্রয়োজন।
একজন কর্তব্যপরায়ণা স্ত্রী হিসাবে আপনার কাজ হবে আপনার স্বামীর কাজ সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা গড়ে তোলায় সহায়তা করা, ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে অবহিত করে তোলা-বাস্তব পরিস্থিতি মেনেই এটা করা প্রয়োজন।
৩। ছোটখাটো গল্প বলুন : যে কোনো ধরনের গল্প হোক না কেন, এতে মানুষের অনুসন্ধিৎসা বাড়ে। এর উপযোগিতা অনেক। বিশিষ্ট সাংবাদিক এইচ. ভি. কেন্টেনবার্ন বলেন, এক সময় তিনি যখন ফ্রান্সে জীবনবীমা বিক্রির কাজ করতেন তখন তিনি এই ধরনের গল্প কাজে লাগিয়ে সফল হন।
এইরকম ঘটনা ঘটে বিখ্যাত জাদুকর হাওয়ার্ড আমটর্নের জীবনেও। এই গল্প বলার মধ্যে দিয়ে আমটর্ন বেশ সজীবতা লাভ করতেন আর দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারতেন।
আমাদের উচিত নানা ছোট ছোট ঘটনাকে মনে রেখে কাজের মধ্যে সজীবতা আর অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলা। যে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করার প্রথম ও একমাত্র চাবিকাঠি হল সজীব থাকা, প্রাণবন্ত থাকা। এই কারণে ছোট ছোট সরলতায় ভরা গল্প তাই মানুষের মন সজীব করে তোলার কাজে খুবই উপকারী।
৪। অল্প স্বার্থপরতায় দোষ নেই : বিখ্যাত দার্শনিক সম্রাট আলেকজান্ডারের শিক্ষাগুরু অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘দোষমুক্ত স্বার্থপরতা মানব কল্যাণকর।’ যারা জীবনে উন্নতি করতে চায় তাদের জন্য একটি চমৎকার পথ। পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক স্বার্থপর। আর সেই স্বার্থপরতা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিতেই ব্যস্ত থাকে। এইসব লোক হল অলস, ক্লান্ত, জীবনপথে সে ব্যর্থ।
আমাদের জেনে রাখা উচিত যে, অপরের স্বার্থ লক্ষ্য রেখে কাজ করা অনেক বেশি আনন্দ আনে। এতে মনে উদ্যমের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে অনেক কৃতী মানুষ আছেন যারা অপরের জন্য নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেন। এই সব মানুষ সমাজসেবা আর ধর্মের কাজে নিজেদের বিলিয়ে দেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়। তাই তাদের সামান্য স্বার্থপরতা বজায় রেখে চললে দোষ হয় না। সেই
কারণে আপনার স্বামীকে উদ্দীপনায় উৎসাহিত করতে হলে একটু স্বার্থপরতার আশ্রয় নিতে পারেন।
৫। উদ্যোগী মানুষের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করুন : এমন মানুষের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করবেন যার মধ্যে উদ্যোগী পুরুষের সব লক্ষণ চোখে পড়ে, জীবন সংগ্রামে যার প্রচেষ্টা সার্থক। এ কাজ করলে আপনার নিরুৎসাহ ভাবটা তাতে দূর হয়ে যাবে। মার্কিনী দার্শনিক রালফ ওয়ালজে এমারসন বলেছিলেন, ‘যে মানুষ আমাকে কর্তব্য আর কাজে অনুপ্রাণিত করতে পারে তেমন মানুষকে আমার প্রয়োজন।
আপনি স্ত্রী হয়ে স্বামীর বন্ধু হয়ে তার সুপ্ত কর্মকুশলতা জাগিয়ে তুলতে পারেন। এ কাজ ঢের বেশি বাস্তব চিন্তা যোগাতে সাহায্য করে আর জীবনযাত্রায় উদ্বুদ্ধ করে। আপনার স্বামীকে যদি সত্যিই উদ্দীপনায় উত্তেজিত হতে দেখতে চান তাহলে কৃতী আর উদ্যোগী মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে আপনার প্রভাবকে কাজে লাগান। এমন সব মানুষ উৎকর্ষতায় সজীব আর জাগ্রত জেনে রাখা ভালো যে, প্রত্যেক দেশে ও সমাজে এই ধরনের মানুষের অভাব নেই। এই উদ্দীপনা ব্যাপারটা প্রত্যেককেই স্পর্শ করবে এমন কী আপনার স্বামীকেও।
পার্শি এইচ. লুইটিং তার বিখ্যাত বই ‘ফাইভ গ্রেট রাথস ফর সেলিং’-এ বলেছেন, যে সব মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা জেগে থাকে তাদের আগ্রহের অভাব লক্ষ্য করা যায়। যারা অনিচ্ছার সঙ্গে দৈনিক কাজ কোনোরকমে শেষ করতে চায় তাদের সংস্পর্শ বিষবৎ এড়িয়ে চলাই ভালো।
৬। উদ্যোগী হতে মনে জোর আনুন, সফল হবেনই : বিখ্যাত দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম জেম্সই এই দার্শনিক তত্ত্বের উদাতা। জেম্স বলেছিলেন, যদি আপনার মনের মধ্যে আবেগপূর্ণ উদ্দীপনার স্রোত জাগাতে চান তাহলে ভাবতে হবে আর এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন ওই ভাব সত্যিই আপনার মনে সঞ্চার হয়েছে। এটা সত্যিই প্রমাণিত সত্য। এভাবে কাজ করতে করতে দেখা যাবে উদ্দীপনার জন্ম আপনার থেকেই হবে। উদ্যোগী হতে গেলে উদ্যোগপূর্ণ চিত্তে কাজ করতে হবে। স্ত্রী হিসাবে আপনার স্বামীকে এভাবেই সাহায্য করা ভালো।
এই সূত্রগুলো মনে রাখবেন :
১। সাফল্যের প্রথম সিঁড়ি : আপনার স্বামীর জীবিকা আর জীবনদর্শন নির্বাচনে সাহায্য করুন। কোনো আদর্শ লক্ষ্য রেখে তাকে এগিয়ে চলতে আপনার প্রেরণা উজাড় করে দিন।
২। কোনো কাজের সাফল্য এলেই অন্যটিতে নজর দিন : কোনো কাজে সফলতা লাভ করতে পারলে অন্য কাজ হাতে নিন। পাঁচ বছরের পরিকল্পনার ছক তৈরি করুন।
৩। স্বামীকে উদ্দীপিত করুন : স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করুন, উদ্দীপনার মূল্য কতখানি আর জীবনে যারা সফল ব্যক্তিত্ব তাদের জীবনের উদাহরণ দিন।
স্বামীর উদ্যম বৃদ্ধির জন্য নিম্নের পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করুন :
১। স্বামীর প্রতিটি কাজে অনুপ্রেরণা দিন।
২। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির রেখে কাজে এগিয়ে চলুন আর তাতেই লেগে থাকুন।
৩। প্রতিদিন স্বামীর কাজে টুকরো টুকরো গল্প বলুন আর তাকে অনুপ্রাণিত করুন।
৪। সমান্য স্বার্থপরতা অন্যায় নয়, তবে পরের কথা আগে ভাবতে শিখুন।
৫। উদ্যমশীল লোকের সাথে মেলামেশা করুন।
৬। একটা কথা মনে সব সময় রাখুন, উদ্যোমের সঙ্গে কাজ করলে উদ্যমশীল হওয়া যায়।