স্ত্রী যখন বান্ধবী: ০৩. উদ্দীপনা আর স্ত্রীর দায়িত্ব

স্ত্রী যখন বান্ধবী: ০৩. উদ্দীপনা আর স্ত্রীর দায়িত্ব

০৩. উদ্দীপনা আর স্ত্রীর দায়িত্ব

ফ্রেডারিক উইলিয়ামসন এক সময়ে নিউইয়র্ক মেন্টাল রেলওয়েজে চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেছিলেন। একবার এক বেতার সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়, কোনো ব্যবসাতে কৃতকার্যতার গোপন রহস্যটি কী হতে পারে?

উইলিয়ামসন এর উত্তরে বলেছিলেন, “আমি আমার সারা জীবনেই মনে রাখব যে, কোনো কাজে কৃতকার্য হতে গেলে চাই একমাত্র উদ্দীপনা। সাফল্যের গোপন রহস্য হল উদ্দীপনা।” দুজন বিভিন্ন মানুষের বাস্তব দক্ষতা, শক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তির পার্থক্যের ওপরই যে কোনো কাজে কৃতকার্য হওয়া বা না হওয়া সম্পূর্ণ নির্ভর করে। কোনো সমান যোগ্যতাবিশিষ্ট দুজন মানুষকে ধরা যাক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া হল। প্রতিযোগিতার শেষে নিশ্চয়ই দেখা যাবে, দুজনের মধ্যে যে সত্যিকার উদ্যোগী তার জয় অবশ্যম্ভাবী। একটি কথা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, যিনি খুবই উদ্যোগী পুরুষ তিনি যদি দ্বিতীয় শ্ৰেণীর শক্তিসম্পন্ন মানুষও হন তাহলেও তিনি প্রথম শ্রেণীর ক্ষমতা বিশিষ্ট অথচ উদ্যোগহীন কাউকে সহজেই প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেবেন।

এখন আমাদের জানা প্রয়োজন যে, উদ্যোগ ব্যাপারটি কী? উদ্যোগের অর্থই হল, নিজস্ব কর্মক্ষমতার উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে কোনো কাজে উৎসাহের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। এক্ষেত্রে অন্য কারও কাছে কাজটা সামান্য বা অসামান্য হতে পারে। কোনো লোকের কাছে কাজটি আনুষঙ্গিক বলে মনে হওয়া চাই-সে কাজ যতই কষ্টকর বা সহজ হোক না কেন।

আমেরিকার মনীষী রালফ ওয়ালডো এমরারসন বলেছেন : ‘পৃথিবীর কোনো মহৎ বা শ্রেষ্ঠ কাজ উদ্যোগ ছাড়া সম্পন্ন করা যায় নি। যার কাজে উদ্যোগ থাকবে তার কাজেই আসবে উদ্দীপনা। উদ্যোগ যেমন উদ্দীপনার জন্ম দেয় সেইরকমই এর ফলশ্রুতিতে সাফল্য লক্ষ্য করা যায়।

প্রত্যেক স্ত্রীকে এই কথাই বলতে চাই যে, আপনার পক্ষে যা পাওয়া সম্ভব তা হল আপনার স্বামীকে কৃতকার্যতার দিকে চালনা করার, তার কাজে উদ্দীপনা সৃষ্টি করার প্রেরণা। তাই আপনার ভূমিকা একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে তুলনাহীন। মনে রাখতে হবে, উদ্যোগই একমাত্র গুণ যা সমস্ত সফল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। কাজটি উদ্দীপনা নিয়ে যাতে সুসম্পন্ন হয় সেটিই আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

উদ্দীপনা হল অনেকটা সঞ্জীবনীর মতো। উদ্দীপনার বীজ যে মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, সে যদি কোনো কাজে উদ্দীপনা বোধ করে তাহলে সে দুর্দম হয়ে ওঠে। কাজটি শেষ করার জন্য তার আবেগ আর বাধা মানতে চায় না। এ ব্যাপারে অতি জনপ্রিয় অধ্যাপক উইলিয়াম ফ্লেক্স তাঁর বিখ্যাত ‘দি এক্সাইটমেন্ট অফ টিচিং’ গ্রন্থে লিখেছেন, “শিক্ষকতার কাজ আমার কাজে যে কোনো কলাবিদ্যা বা ব্যবসার চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়। শিক্ষকতার মধ্যে আমি মানসিক উত্তেজনার খোরাক পাই। আমার কাছে শিক্ষাদান ব্যাপরটি শিল্পীর ছবি আঁকা, গায়কের গান গাওয়া, আর কবির কাব্য রচনা করার মতোই প্রিয়। শিক্ষাদান করতে আমি আনন্দ পাই। ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে ওঠার পর আমি এক অপরূপ আনন্দে আমার ছাত্রদের স্মরণ করতে চাই। তাই আমি মনে করি আর বিশ্বাস করি জীবনে কৃতকার্য হওয়ার প্রধান উপায় নিঃসন্দেহে নিজের কাজে দৈনন্দিন আগ্রহ বজায় রাখা। শক্তি অর্জন করা এই কাজের মধ্যেই উদ্দীপনা খুঁজে পাওয়া।“

সুতরাং আপনার কাজ হবে স্বামীর কাজ সম্পর্কে জেনে তাকে সেই কাজে উদ্যোগী হয়ে উঠতে সাহায্য করা। সত্যিকারের কার্যকরী ভূমিকা হবে আপনার স্বামীর মধ্যে উদ্দীপনার রেশ জাগিয়ে তোলা। চার্লস সামিনার উলওয়ার্থ-এর মতে, কোনো লোকই সাফল্য লাভ করতে পারে না, যদি-না তার নিজের কাজে সে উৎসুক হয়ে ওঠে।

বিখ্যাত চার্লস বেন্থয়াও বলেছেন, মানুষ তার প্রতিটি কাজে কৃতকার্য হতে পারে যদি কাজের প্রতি তার আনুগত্য আর উৎসাহ উদ্যম থাকে।

তাই বর্তমানে মানুষ আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় সচেতন আর উদ্দীপনাপূর্ণ আর্থিক বা আধ্যাত্মিক-দুটি বিষয়েই সে অন্যকে ঢের পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবেই। অনেকের ধারণা উদ্দীপনা খুবই উঁচু দরের বৈজানিক অনুসন্ধানেরও পথ হয়ে উঠতে পারে। এ ব্যাপারে স্যার এডওয়ার্ড ভিক্টর বলেছেন, “বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উৎসাহ আর উদ্দীপনাকে যে কোনো সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করে ধীশক্তিরও আগে স্থান দিতে হবে। তাহলে বুঝতে হবে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে যদি এই উদ্দীপনা এতো বেশি রকম গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তাহলে আপনার স্বামীর জীবনেও নিশ্চয়ই তা কার্যকরী হবে।” একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একজন জীবনবীমা ব্যবসায়ী ফ্রাঙ্ক বেটলারের জীবনের একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তিনি নিজেই বলেছেন, “আমি ১৯০৭ সালে বেসবল খোলোয়াড় হিসাবে জীবন শুরু করি। এরপর কিছুদিন পরে আচমকা মারাত্মক ব্যাপার আমার জীবনে চরম আঘাত হয়ে নেমে আসে। আমাকে অযোগ্য বলে বরখাস্ত করা হয়। ম্যানেজার আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেন, যে কাজ এবার থেকে করব তার মধ্যে যেন কিছুটা উদ্দীপনা ঢেলে দেবার চেষ্টা করি। ওখানে আমার মাইনে ছিল ১৭৫ ডলার। বরখাস্ত হওয়ার পর মাত্র মাসিক ২৫ ডলারের আর একটা চকরি নিতে হল আটলান্টিক লীগে। সেটা পেন্সিলভানিয়াতে। সামান্য টাকায় খুশি না হলেও হতাশায় কিন্তু আমি ভেঙে পড়ি নি। যে কাজে যোগ দিয়েছি তাকে সফল করবই বলে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। বিরাট উৎসাহ নিয়ে আমি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দশদিন ওখানে থাকার পরেই আমার ডাক আসে নিউ হ্যাঁভেন সংস্থা থেকে। আমি মনে মনে শপথ নিলাম যে করেই হোক সবচেয়ে উদ্দীপনাময় খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করব। আমার দৃঢ় ধারণা জন্মেছিল, এটাই হবে আমার বেঁচে থাকার মূলকথা। খেলার মাঠে হাজির হওয়ার পরেই অদ্ভুত একটা শিহরণ আর বৈদ্যুতিক শক্তির স্পর্শই যেন শরীর আর মনের মধ্যে দোলা দিয়ে যায় আমার। আমার দলের খেলোড়রাও যেন উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। আমার সঙ্গে তাল দিয়ে তারাও পূর্ণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ায় বিপক্ষ দল দাঁড়াতেই পারল না। আমার উদ্দীপনা যেন মন্ত্রের মতোই কাজ করতে শুরু করেছিল। আমার উৎসাহ আর উদ্দীপনা এমন একটা পর্যায়ে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল যে, আমার নিজের সম্পর্কে কোনো খেয়ালই ছিল না।

পরদিন সকালে খবরের কাগজ খুলে দেখলাম অধিকাংশ খবরই আমার প্রশংসায় ভরা। কাগজে লেখা ছিল নতুন খেলোয়াড় বেটগার অসাধারণ উদ্দীপনাময়। সে দলের সব খেলোয়াড়কেও উদ্দীপিত করেছে। নিউ হ্যাঁভেন শুধু যে খেলায় বিজয়ী তাই নয়, তারা এ মৌসুমের সব সেরা খেলারই নিদর্শন রেখেছে।

আমার মন এই খবর পড়ে আনন্দে ভরে গেল। আমার উদ্দীপনাই আমার ভাগ্যের দরজা খুলে দিল। দিন-দশেকের মধ্যে আমার মাইনে হয়ে গেলো ২৫ ডলার থেকে ১২৫ ডলার। দু’বছর যেতে-না-যেতে নামী ক্লাব কার্ডিনালে সুযোগ পেলাম। সেখানে মাইনে বেড়ে গেল আরও শতকরা ত্রিশ ভাগ। আমি জানি আমার এই সৌভাগ্যের মূল কথা হল-উদ্যম আর উদ্দীপনা।

মি. বেটগার হাতে আঘাত পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বেসবল খেলা ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর তিনি জীবনবীমায় আসেন ব্যবসার চাকরিতে। তিনি ফাঁইডেলিটি মিউঁচুয়াল লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানীতে চাকরি নেন। বছরখানেক কাজ করার পর কোনো উন্নতি না দেখে মি. বেটগার নতুন উদ্যমে উদ্দীপনা নিয়ে কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বেসবল খেলার পুরোনো অভিজ্ঞতা ভুলতে পারেন নি।

বর্তমানে মি. বেটগার জীবনবীমা জগতে একজন সফল ব্যক্তিত্ব বলে চিহ্নিত। তিনি বলেন, আমার ত্রিশ বছরের জীবনবীমা বিক্রির অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করি একজন বিক্রয় প্রতিনিধির জীবনে উদ্দীপনা কতখানি। আবার উদ্দীপনার অভাবে বহু বিক্রয়কারীকে প্রায় দেউলিয়া হতেও দেখেছি।

উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেই প্রয়োজন উদ্দীপনা। কোনো কাজ যতই কষ্টসাধ্য হোক না কেন এই গুণটি থাকলে কাজে সফলতা অবশ্যম্ভাবী।

সুতরাং প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত স্বামীর মধ্যে উদ্দীপনার প্রকাশ ঘটানো, উদ্দীপনাময় কাজে উৎসাহ দেওয়া। আপনার এই উদ্যোগ অনেক সহজ হবে যদি কয়েকটি নিয়ম মেনে চলা যায়। পরের পরিচ্ছেদে আমরা এই নিয়মগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত