স্ত্রী যখন বান্ধবী
ডেল কার্নেগি
০১. সাফল্যের প্রথম সিঁড়ি
দু’জন মানুষের কাহিনী দিয়েই শুরু করা যাক। ১৯১০ সালের কথা। নিউইয়র্ক শহর। সেখানকার এক এলাকায় কম ভাড়ায় একখানা ঘর ভাড়া নিতে দেখা গেল দুই বন্ধুকে। দুই বন্ধুর একজন হলেন মিসৌরী থেকে আসা ডেল কার্নেগী আর অন্যজন তার বন্ধু ম্যাসাচুসেটস থেকে আসা এক গ্রামের ছেলে জে. এফ. লুইটনি। কার্নেগী আমেরিকার একাডেমি অফ ড্রামাটিক আর্টসের ছাত্র ছিলেন।
আমি ডেল কার্নেগীর কাছে তাঁর বন্ধুর জীবন কাহিনী শুনেছি।
লুইটনি এক কৃষি খামারে কাজ করে তার জীবন শুরু করেছিলেন। সামান্য ওই কাজ করেও লুইটনি তার জীবনে আশা-আকাঙ্ক্ষাকে হারিয়ে ফেলেন নি। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল অপরিসীম। তিনি মনে কল্পনা করতেন যে একদিন তিনি মস্ত এক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবেন।
একদিন সত্যই লুইটনির কপালে একটা কাজ জুটে গেল। সেটা হল বিরাট খাদ্য সামগ্রীর দোকানে কর্মচারীর চাকরি। লুইটনি কাজে উন্নতির চেষ্টায় পাইকারী জিনিস বিক্রি দপ্তরের কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাইতেন। সেইজন্য মধ্যাহ্ন ভোজের সময়টা তিনি কাজে লাগাতেন। এর পুরস্কারস্বরূপ তিনি হলেন প্রধান সেলসম্যান। তারপর ডিপার্টমেন্টের প্রধান আর সেখান থেকে জেলার বিক্রয় অধিকর্তা। এভাবে নিজের পরিশ্রম আর কৃতিত্বের ফলশ্রুতিতে ধাপে ধাপে লুইটনি একবারে শিখরে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন।
লুইটনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দেখান। বীচনাট প্যাকিং কর্পোরেশন’ তাঁকে তাঁর যোগ্যতার দাম দিল। সেখানকার প্রেসিডেন্টের পদও তিনি অলঙ্কৃত করতে সক্ষম হন। এরপর লুইটনি নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্লু মুন চীজ কোম্পানী। জীবনের স্থির লক্ষ্য তার সামনে ধ্রুবতারার মতো বর্ণনাজ্জ্বল করতে চাইতেন। এই আশা তাকে যুগিয়েছিল বড় হওয়ার শক্তি।
এখন প্রশ্ন হল সকলেরই জীবনে তো সফলতা আসে না। লুইটনির এই অসামান্য খ্যাতি আর সাফল্যের মূল কথাটা কী? এই রহস্যের মূল হল তিনি যে কাজ করতেন হৃদয় দিয়েই তাকে গ্রহণ করতেন। কোনো কাজকেই তিনি তুচ্ছ বলে, ছোট বলে ভাবতেন না। নিত্যনতুন কাজে তার উৎসাহ ছিল অপরিসীম।
উদ্দেশ্যহীন কাজ কখনই সফল হতে পারে না। উদ্দেশ্যহীন মানুষেরা লক্ষ্য সামনে না রেখেই লক্ষ্যহীনভাবে এগিয়ে যেতে চায়। পরিণামে তারা শুধু ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে বেড়ায়। এদের একমাত্র অভাব হল, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সাফল্যের সুনির্দিষ্ট কোনো পথ।
নিউইয়র্ক শহরে কর্মজীবীদের বিভিন্ন পরামর্শ দেবার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর নাম কেরিয়ার বেজিং ক্লিনিক। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন মিস অ্যানী হেউড। যে সব চাকরিজীবী নিজেদের কর্মজীবনে খুশি নন তাদের নানা পথের সন্ধান দেওয়া হয় এখানে। মিস হেউডের সঙ্গে চাকরির নানা সমস্যা নিয়ে আমি আলোচনা করেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, তাঁর কাজের একমাত্র অসুবিধা হল তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের বেশির ভাগই জানে না-তারা কী চায়, তাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যই বা কী? যে কোনো তরুণী যখন বিয়ে করে স্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তার প্রথমেই জানা দরকার তার স্বামী জীবনে কী চান? এ সম্পর্কে স্ত্রীর মনে একটা স্পষ্ট ছবি থাকা চাই-ই। এর পরের কাজটি হবে স্ত্রীকে স্বামীর সব কাজকে সমান করে তোলার জন্য সহযোগিতা করে যাওয়া এর জন্য প্রয়োজন নিজেকে যোগ্য করে তোলা।
স্যামুয়েল ও ক্রাথার কিং ম্যারেজ গাইড’ নামে একখানা বই রচনা করেন। তাঁর বইটিতে বলেছেন যে, কোনো স্বামী-স্ত্রীর সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা চাই। এই লক্ষ্য বাসগৃহ তৈরি থেকে দেশভ্রমণ বা অন্য যে কোনো বিষয় হতে পারে। উদ্দেশ্য যাই হোক দুজনের মনে একই পরিষ্কার প্রতিচ্ছবি থাকা দরকার। স্যামুয়েল ও ক্রাথার কিং-এর বক্তব্য হল-আসল কাজ নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করা আর সেই লক্ষ্যকে সম্পূর্ণভাবে রূপদান করা। স্বামী-স্ত্রী উভয়কে উদ্দেশ্যে সফল করার জন্য একই চিন্তায় বিভোর থাকতে হবে। কোনো কারণে যদি ব্যর্থতা এসে হাজির হয়, তবে সেই ব্যর্থতার গ্লানিও দু’জনকেই ভাগ করে নিতে হবে। এর ফলেই আমার সমব্যথিতার সমচিন্তার সুযোগ।
একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি : আমেরিকায় কানসাস শহরে মি, ও মিসেস উইলিয়াম বিল গ্রাহামের সাফল্যের মূলে এই ধরনের ব্যবস্থা অপূর্ব কাজ করে। কানসাসে মি. গ্রাহামের একটি বড় প্রতিষ্ঠান আছে। নাম গ্রাহাম অয়েল কোম্পানী, ব্যবসাতে মি. গ্রাহাম মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে অগাধ সম্পত্তি অর্জন করেন। বিল গ্রাহাম ও তার স্ত্রী মার্জোরি গ্রাহাম ছিলেন সুখী পরিবার। তাঁদের ছ’টি সন্তান।
একদিন আমি বিল গ্রাহামকে তার সাফল্যের গোপন রহস্যটি কী জানাতে চাইলে তিনি বললেন, ভবিষ্যতের জন্য আগেভাগে পরিকল্পনা করে রাখা আর কাজ করে যাওয়া। এগুলোকে মূলধন করেই তারা কাজে নামেন। এই কাজের জন্য তাদের অফিসঘর বলতে ছিল একজন ব্যবসায়ীর অব্যবহৃত একটি কামরা।
একে একে গ্রাহাম দম্পতি নিজেরাই বাড়ি কিনে বিক্রি শুরু করেন। তার সাথে সাথে তেলের ব্যবসাতেও লেগে থাকেন। ধাপে ধাপে উন্নতি হতে লাগলো।
এখানেই থেমে থাকার মানুষ নন গ্রাহ্যম দম্পতি। তাঁদের ব্রত হল আরও এগিয়ে চলা। তাই গ্রাহাম দম্পতি ভাবতে লাগলেন বৈদেশিক ব্যবসার দিকে হাত বাড়াবেন কি না।
এই দম্পতির সাফল্যের মূল কথা হল-কোনো কাজ বা পরিকল্পনা হাতে নিলে তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাতে সাফল্যে কোনো বাধা না ঘটে। তারা তাদের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা আর পরিশ্রমকে উজাড় করে দিতেন এই কাজে। গ্রাহাম দম্পতির জীবন থেকেই বোঝা যায়, ইচ্ছা আর পরিশ্রম যে কোনো মানুষকে তার উদ্দেশ্য সাধনে সহায়তা করে থাকে। এছাড়াও আছে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সফলতার কাছাকাছি পৌঁছান সম্ভব, তাতে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না।
কলম্বিয়া কলেজের ডীন হার্বাট ই হক বলেন যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতা দুশ্চিন্তার এক প্রধান কারণ। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হলে সাফল্যের পথে বাধার সৃষ্টি হয়। এই কারণেই বলতে বাধা নেই যে, প্রত্যেক স্ত্রীর জানা প্রয়োজন তাদের স্বামীর সাফল্য লাভ করার পথে তাদেরই প্রেরণা যোগান দিতে হবে, যাতে তাঁর স্বামী জীবনে স্থির লক্ষ্যে অগ্রসর হতে পারেন।
সাফল্যের অর্থ এক-একজনের কাছে এক-একরকম। তাই সফলতার অর্থ কি শুধু বিপুল সম্মান, না অর্থ, না নির্বিঘ্ন জীবন তা আপনার এবং আপনার স্বামী উভয়কেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী এই দু’জনের মিলিত আকাক্ষাই আপনার স্বামীর পথনির্দেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর উচিত স্বামীকে প্রেরণা যোগানো, আর স্বামীর কর্তব্য কোনো সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
জেনে রাখা উচিত, স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা শুধুমাত্র প্রেমের প্রসন্ন দৃষ্টির মধ্যেই থাকে না–আদর্শ দম্পতির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেম আর ভালবাসা হল পরস্পরের হৃদয়কে, মনকে জানতে চাওয়া, বুঝতে চাওয়া।
এই কথাটা বলেছিলেন–একজন মানব-প্রেমিক মানুষ। অতএব মনে রাখা প্রয়োজন, কৃতকার্য হওয়ার প্রথম পদক্ষেপটি হবে স্বামীকে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করা।