১৩১ অধ্যায়:
ওয়াশিংটন মনুমেন্টর মধ্যে দিয়ে যে প্যাচান সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে তাতে ৮৯৬ টি পাথরের ধাপ রয়েছে। এটি একটা উন্মুক্ত এলিভেটর শ্যাফটের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে নেমেছে। ল্যাংডন আর সলোমন নীচে নামেন। কয়েক মুহূর্ত আগে পিটার তাকে যে চমকপ্রদ তথ্য জানিয়েছে সেটার সাথে সে ধাতস্থ হতে চেষ্টা করে: রবার্ট এই মনুমেন্টের ফাঁপা ভিত্তিপাথরের ভিতরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা দি ওয়ার্ড-বাইবেলের একটা সংস্করণ রেখেছিলেন, যা অন্ধকারে এই সিঁড়ির শেষে অপেক্ষা করছে।
নীচে নামবার সময়ে রবার্ট হঠাৎ একটা জায়গায় থমকে দাঁড়াল। ফ্যাশলাইটের আলোর মুখ ঘুরালে দেয়ালে প্রোথিত একটা বিশাল পাথরের মেডালিয়ন বা মূর্তি ধাচের কিছু একটা জিনিস আলোকিত হয়ে উঠে।
এটা আবার কি? ল্যাংডন খোদাই করাটা দেখে চমকে উঠে।
মেডালিয়নে আলখাল্লা পরিহিত একটা ভীতিকর প্রতিকৃতি হাতে কাস্তে ধরে একটা বালিঘড়ির পাশে হাটু ভেঙে বসে আছে। প্রতিকৃতিটার হাত উপরের দিকে। তোলা আর তর্জনী সোজা উপরের দিকে একটা বিশাল খোলা বাইবেল ইঙ্গিত করছে যেন বলতে চায়: উত্তর এখানে আছে! জেনে নাও।
খোদাই করা প্রতিকৃতিটা দেখে পিটারের দিকে তাকয় ল্যাংডন।
তার গুরুর চোখে এখন রহস্য উঁকি দেয়। আমি তোমাকে একটা বিষয় বিবেচনা করে দেখতে বলবো রবার্ট। তার কণ্ঠস্বর খালি সিঁড়ির মাঝে প্রতিধ্বনি তোলে। তোমার কি মনে হয় হাজার বছরের ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে সংগ্রাম করে বাইবেল আজও টিকে আছে? এখনও কেন সে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে? তার কারণ কি এর গল্পগুলো আমরা পড়তে বাধ্য বলে? অবশ্যই না…কিন্তু অন্য একটা কারণ আছে। একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে যে কারণে খৃস্টান পাদ্রীরা। আজীবন বাইবেলের পাঠোদ্ধারে সময় কাটিয়ে দেয়। কারণ নিশ্চয়ই আছে যে জন্য কাবালিস্ট আর ইহুদি মরমীবাদীরা ওল্ড টেস্টামেন্টে মুখ খুঁজে পড়ে থাকে। আর সেই কারণটা হল রবাট এই প্রাচীন বইয়ের পাতায় শক্তিশালী রহস্য লুকান রয়েছে…অর্জিত জ্ঞানের একটা বিশাল সমাবেশ যা প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করছে।
বাইবেলের একটা আলাদা লুকানো অর্থ আছে। ল্যাংডন এই ধারণার সাথে পরিচিত। সেগুলো রূপক, প্রতীক আর নীতিগর্ভ কাহিনীর আড়ালে চাপা পড়ে থাকা বার্তা।
নবীরা আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন, পিটার বলে চললেন, যে ভাষায় তারা গোপন রহস্যের কথা বলেছেন সেটা সাঙ্কেতিক। মার্কের গসপেলে বলা হয়েছে, রহস্য জানবার অধিকার তোমারও আছে, কিন্তু সেটা বলা হবে রূপকের আশ্রয়ে। আমরা শ্লোকে পাই জ্ঞানী মানুষের কথা হল ধাঁধা যেখানে করিন্থিয়ানরা লুকান জ্ঞান নিয়ে কথা বলে। জনের গসপেলে সাবধান করে দেয়া হয়েছে: আমি তোমার সাথে রূপকের আঙ্গিতে কথা বলবো…এবং আমার অন্ধকারের বাণী ব্যবহার করবো।
অন্ধকারের বাণী বা ডার্ক সেয়িং। ল্যাংডন মজা পায়, সে জানে এই বিচিত্র বাগধারাটা পুস্তকে বেখাপ্পাভাবে উপস্থিত আছে সেই সাথে আরো আছে ৭৮নং স্তুতিগানে। আমি আমার মুখ খুলে রূপক ছড়িয়ে দেব আর প্রাচীনদের অন্ধকারের বাণী উচ্চারিত হবে। ল্যাংডন জেনেছে, অন্ধকারের বাণীর ধারণার ভিতরে অশুভ কিছু নেই বরং এটা দিয়ে বোঝান হয় অবগুণ্ঠিত বা আলো থেকে দূরের কোন কিছু।
আর তোমার মনে যদি কোন সন্দেহ থাকে, পিটার বলে, কোরিন্থিয়ানসরা আমাদের স্পষ্টতই বলে গেছে যে রূপকের দুটো মানে আছে : বাচ্চাদের জন্য দুধ আর পুরুষদের জন্য মাংস- এখানে দুধের অর্থ অজ্ঞ লোকের জন্য পানির মত পড়ে যাওয়া আর মাংসটা হল আসল বার্তা। পরিণত মস্তিষ্কই কেবল সেটা অনুধাবন করতে পারবে।
পিটার আবার আলোটা উঁচু করে আলখাল্লা পরা প্রতিকৃতি দেখে নেন। রবার্ট আমি জানি তুমি সংশয়বাদী, কিন্তু একটা বিষয় ভেবে দেখো। বাইবেলে যদি কোন গোপনবাণী না থাকবে তাহলে ইতিহাসের এত পণ্ডিত ব্যক্তিরা কেন যার ভিতরে রয়্যাল সোসাইটির চৌকষ বিজ্ঞানীও আছেন- এটা এত মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছে। বাইবেলের আসল মানে উদ্ধার করতে গিয়ে আইজাক নিউটন দশ লক্ষের বেশি শব্দ লিখেছেন। যার ভিতরে ১৭০৪ পাণ্ডুলিপি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে এখানে তিনি বাইবেলের গোপন বৈজ্ঞানিক তথ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন।!
ল্যাংডন জানে এটা সত্যি।
আবার ফ্রান্সিস বেকন, পিটার বলতে থাকে, আক্ষরিক অর্থে কিং জেমস বাইবেল সৃষ্টি করার জন্য কিং জেমস এই প্রতিভাবানকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, বাইবেলের লুকান অর্থের অবস্থান সম্পর্কে তার মনে এতটাই প্রত্যয় জন্মায় যে তিনি সেটা নিজের মত করে সংকেতে প্রকাশ করে গেছেন, যা আজও পাঠ করা হয়। তুমি জান যে বেকন ছিলেন রোজিসিয়ান আর দি উইজডম অব দি এ্যানশিয়েন্টস এর লেখক। পিটার হাসে। এমনকি মূর্তিপূজারী কবি উইলিয়াম ব্লেক আভাস দিয়েছেন যে আমাদের উচিত অন্তনিহিত মানে সম্পর্কে সচেতন থাকা।
ল্যাংডন কবিতাটার সাথে পরিচিত।
BOTH READ THE BIBLE DAY AND NIGHT,
BUT THOU READ BLACK WHERE I READ WHITE.
আর ইউরোপের প্রতিভাবানরাই কেবল না, পিটার দ্রুত নামতে নামতে বলে। রবার্ট, এখানে এই তরুণ আমেরিকান জাতির একেবারে মর্মমূলে এখানেও ছিল, আমাদের উজ্জ্বলতম প্রতিভাবান পূর্বপুরুষেরা– জন অ্যাডামস, বেন ফ্রাঙ্কলিন, টমাস পেইন সবাই আক্ষরিক অর্থে বাইবেল পাঠের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে গিয়েছেন। বস্তুত পক্ষে টমাস জেফারসন বাইবেলের আসল বাণী গোপন রয়েছে এটা সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি আক্ষরিক অর্থে পাতা কেটে বইটা সম্পাদনা করেছিলেন, কৃত্রিম জঞ্জাল সরিয়ে আসল মতবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তিনি একাজটা করেছিলেন।
ল্যাংডন এই আজব ব্যাপারটা সম্পর্কেও অবগত রয়েছেন। জেফারসনের বাইবেল আজও ছাপা হয় এবং সেখানে নানা বিতর্কিত সংশোধন রয়েছে যার ভিতরে কুমারী জন্ম আর পূর্নজন্মটা বাদ দেয়া হয়েছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল জেফারসনের বাইবেল উনিশ শতকের প্রথম অর্ধেও নতুন সিনেটরদের উপহার দেয়া হত।
পিটার আমি জানি বিষয়টা আকর্ষণীয় এবং এটাও বুঝতে পারি যে প্রতিভাবানদের এটা প্ররোচিত করে বাইবেলের গোপন অর্থ রয়েছে বিবেচনা করতে, কিন্তু আমি এর ভিতরে কোন যুক্তি খুঁজে পাই না। যেকোন দক্ষ প্রফেসর তোমাকে একটা কথা বলবে শিক্ষা কখনও সাঙ্কেতিক উপায়ে দান করা যায় না?
আমি দুঃখিত?
শিক্ষকেরা শিক্ষা দেন, পিটার। আমরা ভোলা খুলি কথা বলি। নবীরা কেন দুবোধ্য ভাষা ব্যবহার করবেন। সবাই যাতে বুঝতে পারে এমনভাবে বললে ক্ষতি কি?
পিটার নীচে নামতে নামতে কাঁধের উপর দিয়ে ঘুরে তাকায়। প্রশ্নটা তাকে বিস্মিত করেছে। রবার্ট, প্রাচীন রহস্য সদ্য যে কারণে গোপন রাখা হয়েছিল ঠিক সেই কারণেই বাইবেলে খোলাখুলি সব বলা হয়নি…যে কারণে নিওফাইটসদের দীক্ষা নিতে হত পুরুষানুক্রমিক গোপন শিক্ষা গ্রহণের আগে…যে কারণে ইনভিজিবল কলেজের বিজ্ঞানীরা তাদের জ্ঞান অন্যদের মাঝে বিতরণ করতে গররাজি ছিলেন। রবার্ট এই জ্ঞান খুবই শক্তিশালী। ছাদের উপর থেকে চেঁচিয়ে প্রাচীন রহস্যময়তা সম্বন্ধে বলা যায় না। রহস্য একটা জলন্ত মশাল, যা ওস্তাদের হাতে আলো হয়ে পথ দেখাবে। ওটা পাগলের হাতে পড়লে সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।
লাঙ্গডন দাঁড়িয়ে পড়ে। সে কি বলছে পিটার আমি বাইবেলের কথা বলছি। তুমি কেন প্রাচীন রহস্যময়তা সম্পর্কে কথা বলছো?
পিটার ঘুরে দাঁড়ায়। রবার্ট এখনও বুঝতে পারোনি? প্রাচীন রহস্যময়তা আর বাইবেল একই জিনিস।
ল্যাংডন হতবাক হয়ে যায়।
পিটার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, ধারণাটা আত্মস্থ হবার সময় দেয়। বাইবেলের সাহায্যে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রহস্যময়তার ধারা বয়ে এসেছে। এর পাতাগুলো আমাদের বেপরোয়াভাবে রহস্যের কথা বলতে চায়। তুমি কি বোঝ না? বাইবেলের অন্ধকারের বাণী হল প্রাচীন মুনিদের গুঞ্জন, নিরবে তাদের জ্ঞান আমাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাইছে।
ল্যাংডন কোন কথা বলে না। প্রাচীন রহস্যময়তা সে যতদূর বোঝে কিছু লিখিত নির্দেশ যা মানুষের মনের সুপ্ত ক্ষমতাকে জাগ্রত করতে সহায়তা করবে…বাক্তিগত রূপান্তরের একটা ফর্দ। সে কখনও সুফীবাদের ক্ষমতা বুঝতে পারেনি, এবং বাইবেলে এইসব রহস্যের সমাধানের চাবি রয়েছে এই ধারণাটা মেনে নেয়া অসম্ভব।
পিটার বাইবেল আর প্রাচীন রহস্যময়তা একেবারে পুরোপুরি বিপরীত। রহস্যময়তার বিষয় হল আমাদের ভেতরের দেবরূপ…মানুষের দেবতায়ন। বাইবেলে বিষয় আমার উপরে ঈশ্বর…মানুষ ক্ষমতাহীন পাপী।
হ্যাঁ! তাইতো! তুমি একেবারে আসল সমস্যাটায় হাত দিয়েছো! যে মুহূর্তে মানুষ নিজেকে ঈশ্বরের থেকে পৃথক করে ফেলো সেই মুহূর্তে শব্দের আসল অর্থ হারিয়ে গেল। প্রাচীন গুরুদের বাণী তলিয়ে গেল আত্মস্বীকৃত অনুশীলনকারীদের হট্টগোলের ভিতরে যারা দাবী করে কেবল তারাই শব্দের অর্থ বোঝে…যে শব্দ তাদের ভাষায় লেখা হয়েছে অন্য কারো ভাষায় না।
পিটার এখনও নীচে নামছে।
রবার্ট তুমি আমি আমরা দুজনেই জানি প্রাচীন মুনি ঋষিরা আঁতকে উঠতেন যদি দেখতেন কিভাবে তাদের শিক্ষাকে কলঙ্কিত করা হয়েছে…ধর্ম কিভাবে স্বর্গে যাবার টিকিট কাউন্টারে পরিণত হয়েছে…কিভাবে যোদ্ধারা স্রষ্টা তাদের সাথে আছে মনে করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমরা শব্দ হারিয়ে ফেলেছি কিন্তু এর সত্যিকারের মানে এখনও আমাদের নাগালের ভেতরে রয়েছে, ঠিক আমাদের চোখের সামনে। বাইবেল থেকে ভগবত গীতা থেকে কোরান শরীফ সব টিকে থাকা পুস্তকে এটা বিদ্যমান। ফ্রিম্যাসনারীর প্রার্থনার বেদীতে এসবগুলো পুস্তককে শ্রদ্ধার সাথে রাখা হয় কারণ ম্যাসনরা বোঝে যা পৃথিবীর মানুষ ভুলে গেছে…যে এইসব পুস্তক নিজের মত করে নিরবে একটা বাণীই আউড়ে গেছে। পিটারের কণ্ঠে আবেগ উথলে উঠে। নিজেকে জান তবেই স্রষ্টাকে জানতে পারবে?।
এই বিখ্যাত প্রাচীন বাণীটা কিভাবে বারবার আজ রাতে আলোচিত হচ্ছে ল্যাংডন ভাবে। গ্যালোওয়ের সাথে কথা বলার সময়ে সে এটার উদ্ধৃতি দিয়েছে এবং ক্যাপিটল ভবনে অ্যাপোস্থেসিস ব্যাখ্যা করার সময়ে।
পিটার তার কণ্ঠস্বর নীচু করে প্রায় ফিসফিসের পর্যায়ে নিয়ে আসে। বুদ্ধ বলেছেন, তুমি নিজেই ভগবান। যীশু বলে ঈশ্বরের রাজত্ব তোমার ভিতরেই নিহিত এবং প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন আমি যা করি তুমিও সেটা করতে সক্ষম…আরো বেশি মাত্রায়। এমনকি প্রথম এ্যান্টিপোপ-হিপ্পোলিটাস অব রোম- এই একই বাণী উদ্ধৃত করেছেন, মোনোইমাস নামে গস্টিক গুরু যা প্রথম উচ্চারণ করেছিল: ঈশ্বরের সন্ধান করা বন্ধ কর…তার বদলে নিজের ভেতর থেকে আরম্ভ কর।
ল্যাংডনের হাউজ অব টেস্পলের কথা মনে পড়ে, সেখানে ম্যাসনিক টাইলারের চেয়ারের পেছনে দুটো পথ প্রদর্শক শব্দ খোদাই করা আছে নিজেকে জানো।
এক জ্ঞানী লোক একবার আমাকে বলেছিল, পিটার বলে তার গলার স্বর মৃদু শোনা যায়, তোমার আর ঈশ্বরের ভিতরে একটাই পার্থক্য তুমি ভুলে গেছো যে তুমি অনিন্দ্য।
পিটার তোমার কথা আমি শুনেছি- আমি মানি। আমি এটাও সানন্দে মানতে রাজি যে আমরা ঈশ্বর, কিন্তু পৃথিবীতে আমি কোন ঈশ্বরকে হাঁটতে দেখছি না। আমি কোন অতিমানব কোথাও দেখছি না। তুমি বাইবেলের তথাকথিত অলৌকিক কাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করতে পার বা অন্য কোন ধর্মীয় গ্রন্থের কথা বলতে পার কিন্তু সেসব গল্প মানুষের উদ্ভাবন আর সময়ের সাথে সাথে যা অতিশয়োক্তিতে পরিণত হয়েছে।
হয়তো, পিটার বলে। বা সম্ভবত আমাদের বিজ্ঞান প্রাচীন জ্ঞানর সমকক্ষ হয়ে উঠা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারি। সে থামে। মজার ব্যাপার হল…আমার বিশ্বাস ক্যাথরিনের গবেষণা বোধহয় ঠিক সেই কাজটাই করতে চলেছে।
ল্যাংডনের এখন মনে পড়ে হাউজ অব টেম্পলার থেকে ক্যাথরিন দৌড়ে বের হয়ে গিয়েছিল। আচ্ছা, সে কোথায় গেল, বলতো?
সে শীঘ্রই এখানে আসবে, পিটার মুচকি হেসে বলে। সে একটা সৌভাগ্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে আসতে গিয়েছে।
.
বাইরে, মনুমেন্টের পাদদেশে, পিটার সলোমন রাতের শীতল বাতাসে বের হয়ে আসলে তার নিজেকে বেশ প্রাণবন্ত মনে হয়। সে আমোদিত হয়ে দেখে রবার্ট ল্যাংডন গভীর মনোযোগ দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে মাথা চুলকাতে চুলকাতে এবং ওবেলিস্কের পাদদেশে চারপাশে ঘুরে দেখছে।
প্রফেসর, পিটার ঠাট্টা করে বলে, যে ভিত্তিপ্রস্তরের ভিতরে বাইবেলটা আছে সেটা মাটির নীচে রয়েছে। তুমি আসলে বইটা দেখতে পাবে না কিন্তু আমি নিশ্চিত করতে পারি তোমাকে আছে।
আমি বিশ্বাস করি তোমার কথা, ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে ল্যাংডন বলে। আমি কেবল…আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি।
ল্যাংডন পিছিয়ে এসে ওয়াশিংটন মনুমেন্ট যে বিশাল চত্ত্বরে অবস্থিত সেটা পর্যবেক্ষণ করে। বৃত্তাকার চাতালের পুরোটা সাদা মার্বেলের…কেবল কালো পাথরের দুটো সৌন্দর্যবর্ধক গতিপথ যা মনুমেন্টের চারপাশে দুটো এককেন্দ্রিক বৃত্তের জন্ম দিয়েছে।
বৃত্তের ভিতরে বৃত্ত, ল্যাংডন বলে। আমি কখনও উপলব্ধি করিনি ওয়াশিংটন মনুমেন্ট বৃত্তের ভেতরে বৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পিটার হেসে উঠে। ব্যাটার চোখে কিছুই এড়িয়ে যায় না। যা, মহান সারকামপাঙ্কট…স্রষ্টার বিশ্বজনীন প্রতিক,, আমেরিকার ক্রসরোডের উপরে অবস্থিত। সে একটা সবজান্তার মত কাঁধ ঝাঁকানি দেয়। এটা বোধহয়। কাকতালীয় হবে।
ল্যাংডনকে অন্যজগতের বাসিন্দা মনে হয়, শীতের কালো রাতে ধবধবে সাদা আলোকিত চূড়ার দিকে তার চোখ ধীরে ধীরে উঠে যায়।
পিটার বুঝতে পারে এই মনুমেন্টটা আসলে কেন বানান হয়েছিল সেটা বোধ হয় ল্যাংডন উপলব্ধি করতে পেরেছে…প্রাচীন জ্ঞানর নিরব সতর্কবাণী…একটা মহান জাতির হৃদয়ে আলোকপ্রাপ্ত মানুষের প্রতীক। পিটার যদিও এ্যালুমিনিয়ামের শীর্ষদেশ এখান থেকে দেখতে পায় না কিন্তু জানে সেটা সেখানে আছে মানুষের আলোকিত মনের স্বর্গের উদ্দেশ্যে আঁকুতি।
লাস ডিও।
পিটার? ল্যাংডন এগিয়ে এসে বলে, তাকে দেখে মনে হবে এইমাত্র সে কোন মরমী দীক্ষা লাভ করেছে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, পকেটে হাত দিয়ে সে পিটারের সোনার ম্যাসনিক আংটি বের করে দেয়। আজ সারারাত এটা তোমাকে ফেরত দেবো বলে নিয়ে ঘুরছি।
ধন্যবাদ রবার্ট, পিটার বাম হাত বাড়িয়ে আংটিটা নিয়ে, প্রশংসার চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তুমি জান, এই আংটিটা ঘিরে যত গোপনীয়তা রহস্য ছিল এবং ম্যাসনিক পিরামিড়…আমার জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি যখন তরুণ পিরামিডটা আমাকে দেয়া হয়েছিল একটা প্রতিশ্রুতির সাথে যে এর ভেতরে একটা মরমী রহস্য লুকান রয়েছে। এর উপস্থিতিই আমায় স্মরণ করিয়ে দিত পৃথিবীতে অনেক রহস্যময়তা রয়েছে। এটা আমার কৌতূহলকে খোঁচা দিয়েছে, আমার বিস্ময়ের অনুভূতি বাড়িয়ে। তুলেছে এবং প্রাচীন রহস্যময়তার প্রতি নিজের মনকে অবারিত করতে অনুপ্রাণিত করেছে। সে হেসে নিরবে আংটিটা পকেটে রেখে দেয়। আমি এখন বুঝতে পারছি ম্যাসনিক পিরামিডের আসল তাৎপর্য উত্তর দেয়া না বরং প্রশ্নের প্রতি আগ্রহ জাগ্রত করা।
মনুমেন্টের পাদদেশে দুজন অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
ল্যাংডন আগে কথা বলে এবং তার কণ্ঠস্বরে একটা গুরুতর ভাব। পিটার আমি তোমার কাছে একটা সুবিধা চাইছি…বন্ধু হিসাবে।
অবশ্যই, যেকোন কিছু।
ল্যাংডন তার অনুরোধ…জোরালভাবে পেশ করে।
সলোমন মাথা নাড়ে, জানে তার কথাই ঠিক। আমি করব।
এখনই, দাঁড়িয়ে থাকা এসকালেড দেখিয়ে ল্যাংডন বলে।
ঠিক আছে, কিন্তু একটা শর্ত।
ল্যাংডন চোখ মটকে হাসে। কিভাবে যেন তুমি সবসময়ে শেষ কথাটা বল।
হ্যাঁ, আর আমি চাই তুমি আর ক্যাথরিন শেষ একটা জিনিস দেখো।
এই সময়ে? ল্যাংডন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে।
সলোমন তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে উষ্ণ হাসি দেয়। এটা ওয়াশিংটনের সবচেয়ে দর্শনীয় সম্পদ…এবং এমন একটা জিনিস যা খুব খুব খুবই কম লোক প্রত্যক্ষ করেছে।
.
১৩২ অধ্যায়
ওয়াশিংটন মনুমেন্টের দিকে দৌড়ে আসবার সময়ে ক্যাথরিন নিজেকে হাল্কা অনুভব করেন। আজ রাতে সে অনেক বিপর্যয় আর ধাক্কা সামলেছে এবং তার ভাবনা এখন আবার সে রিফোকাস করতে পারছে, হোক সেটা কেবল সাময়িকভাবে। পিটার একটু আগে যে চমকপ্রদ সংবাদ তাকে জনিয়েছে …খবরের সত্যতা এইমাত্র নিজেরে চোখে দেখে নিশ্চিত হয়েছে ক্যাথরিন।
আমার গবেষণা নিরাপদ আছে। পুরোটাই।
আজ রাতে তার গবেষণাগারের হলোগ্রাফিক ডাটা ডিভাইস সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একটু আগে দি হাউস অব টেম্পলে পিটার তাকে জানিয়েছে যে সে গোপনে তার নিওটিক গবেষণার আরেকটা ব্যাকআপ এসএমএসসির এক্সিকিউটিভ অফিসে সংরক্ষণ করেছে। তুমি জানো তোমার গবেষণা নিয়ে আমি দারুণভাবে অভিভূত, সে তাকে ব্যাখ্যা করে বলে, আমি তোমাকে বিব্রত করে তোমার অগ্রগতি দেখতে চেয়েছিলাম।
ক্যাথরিন? একটা ভারী কণ্ঠ তার নাম ধরে ডাকে।
সে মুখ তুলে তাকায়।
আলোকিত মনুমেন্টের পাদদেশে একটা আবছা অবয়বকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
রবার্ট! সে দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে আলিঙ্গন করে।
সুসংবাদটা আমি শুনেছি, ল্যাংডন ফিসফিস করে বলে। তুমি নিশ্চয়ই হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।
তার কণ্ঠস্বর আবেগে কেঁপে যায়। অবিশ্বাস্যভাবে। পিটার যে গবেষণা রক্ষা করেছে সেটা একটা বৈজ্ঞানিক টুর ডি ফোর্স- মানুষের ভাবনা যে একটা সত্যিকারের আর পরিমাপযোগ্য শক্তি সেটা প্রমাণিত করতে যথেষ্ট গবেষণা পত্র। ক্যাথরিনের গবেষণায় দেখান হয়েছে মানুষের ভাবনার প্রভাব পানি বরফের স্ফটিকে পরিণত হওয়া থেকে র্যানডম ইভেন্ট জেনারেটর এমনকি অতিআণবিক বস্তুকণার চলাচলে পড়ে। ফলাফল সিদ্ধান্তমূলক আর নাকচ করা কোন উপায় নেই, আর সংশয়বাদীদের বিশ্বাসীতে পরিণত করতে সক্ষম আর বিশ্বব্যাপী সচেতনতাবোধকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। রবার্ট সবকিছু বদলে যাবে। সবকিছু।
পিটারেরও তাই ধারণা।
ক্যাথরিন তার ভাইকে খুঁজতে চারপাশে তাকায়।
হাসপাতালে, ল্যাংডন বলে। আমি তাকে বলেছি আমার খাতিরে যেন সে যায়।
ক্যাথরিন স্বস্তির শ্বাস ফেলে। ধন্যবাদ।
সে আমাকে বলেছে এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করতে।
ক্যাথরিন মাথা নাড়ে সে বিশাল সাদা ওবেলিস্কটার দিকে তাকায়। সে আমাকে বলেছে যে সে তোমাকে এখানে আনছে। লাউস ডিওর ব্যাপারে কিছু একটা। সে খুলে বলেনি।
ল্যাংডন একটা ক্লান্ত হাসি হাসে। আমি নিশ্চিত না সে ঠিক কি বলেছে। সে মনুমেন্টের উপরের দিকে দেখে। তোমার ভাই আজ রাতে এমন নতুন কিছু আমাকে বলেছে যা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না।
আমাকে অনুমান করতে দাও, ক্যাথরিন বলে। প্রাচীন রহস্যময়তা, বিজ্ঞান আর হোলি স্ক্রিপটার।
বিনগো।
আমার ভূবনে স্বাগতম। সে চোখ মটকে বলে। পিটার আমাকে এই জগতের সাথে অনেক আগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আমার গবেষণায় অনেক সাহায্য করেছে।
সহজ জ্ঞানে, সে যা বলেছে তারইকিছু একটা অর্থ করা সম্ভব। ল্যাংডন মাথা নাড়ে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে…
ক্যাথরিন হেসে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে। রবার্ট তুমি জানো আমি হয়ত তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
.
ক্যাপিটল ভবনের অনেক ভেতরে স্থপতি ওয়ারেন বেল্লামি একটা জনশূন্য হলওয়ে দিয়ে হেঁটে যায়।
আজ রাতে আর একটা কাজ বাকি আছে, সে ভাবে।
নিজের অফিসে পৌঁছে সে তার ড্রয়ার থেকে একটা লোহার খুব পুরাতন চাবি বের করে। লোহাটা কালো হয়ে গেছে, লম্বা আর চিকন উপরে হাল্কা কিছু খোদাই করা রয়েছে। চাবিটা পকেটে ভরে সে তার অতিথিদের স্বাগত জানাবার জন্য প্রস্তুত হয়।
রবার্ট ল্যাংডন এবং ক্যাথরিন সলোমন ক্যাপিটলে আসছে। পিটারের অনুরোধে বেল্লামি তাদের খুব বিরল একটা সুযোগ দিতে যাচ্ছে- এই ভবনের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক রহস্য নিজের চোখে দেখার সুযোগ…যা কেবল স্থপতির পক্ষে উন্মোচন করা সম্ভব। অন্য কারো পক্ষে এ রহস্য ভেদ করা অসম্ভব।
.
১৩৩ অধ্যায়
ক্যাপিটল রোটানডার মেঝে থেকে অনেক উপরে, অবস্থিত রবার্ট ল্যাংডন অনেক ভয়ে ভয়ে বৃত্তাকার ক্যাটওয়াকে যা গম্বুজের ছাদের ঠিক নীচে ঝুলে রয়েছে সেটার উপরে ধীর পায়ে হাঁটে। সে রেলিংএর উপরে বিক্ষিপ্তভাবে ঘোরাঘুরি করতে করতে একবার উঁকি দিয়ে দেখে, উচ্চতার কারণে তার মাথা ঝিমঝিম করে, তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় নীচের মেঝেতে পিটারের কাটা কব্জি দেখার পরে দশ ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়নি।
সেই একই মেঝের উপরে ভবনের স্থপতিকে একটা ক্ষুদে বিন্দুর মত দেখায়, একশ আশি ফিট নীচে রোটানডার উপর দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে হারিয়ে যান। বেল্লামি, ক্যাথরিন আর ল্যাংডনকে এখানে পৌঁছে দিয়ে ঠিকমত পালনীয় নির্দেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন।
পিটারের নির্দেশ।
ল্যাংডন তার হাতে ধরা লোহার চাবির দিকে তাকায় যা বেল্লামি তাকে দিয়েছে। তারপরে সে এই স্তর থেকে উপরে উঠে যাওয়া আটসাট সিঁড়িটার দিকে তাকায়…আরো উপরে উঠে কোথায় হারিয়ে গেছে। খোদা বাঁচাও। স্থপরিতর ভাষ্য অনুযায়ী এই সরু সিঁড়িগুলো একটা লোহার দরজা পর্যন্ত উঠে গেছে যা ল্যাংডনের হাতের চাবিটা দিয়ে খোলা যায়।
দরজার পেছনে এমন কিছু আছে যা ল্যাংডন আর ক্যাথরিনকে দেখতে সানুনয় অনুরোধ করেছে পিটার। পিটার বাকিটা খুলে বলেনি কিন্তু কঠোর নির্দেশ দিয়েছে দরজাটা ঠিক কখন খুলতে হবে সে বিষয়ে। দরজাটা খুলতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে? কেন?
ল্যাংডন আবার হাতের ঘড়ির দিকে তাকায় এবং আঁতকে উঠে।
চাবিটা পকেটে ফেলে সে ব্যালকনির শেষ প্রান্তের বিশাল শূন্যস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্যাথরিন নির্ভয়ে সামনে এগিয়ে গেছে, উচ্চতা সম্পর্কে একেবারে বেখেয়াল হয়ে। সে ইতিমধ্যে বৃত্তাকার পথের অর্ধেকটা অতিক্রম করেছে, তাদের মাথার উপরে আবছাভাবে দৃশ্যমান ক্ৰমিডির দি এ্যাপোস্থেসিস অব ওয়াশিংটনের প্রতি ইঞ্চি সে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। এই বিরল দৃশ্যবিন্দু থেকে প্রায় পনের ফিট লম্বা প্রতিকৃতি যা ক্যাপিটল ভবনের গম্বুজের প্রায় পাঁচ হাজার ফিটের পুরোটা জুড়ে রয়েছে অবাক করা খুটিনাটিসহ দৃশ্যমান।
ল্যাংডন ক্যাথরিনের দিকে পিঠ করে বাইরের দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ায় এবং মৃদু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, ক্যাথরিন এটা তোমার বিবেকের কণ্ঠস্বর। তুমি কেন রবার্টকে পরিত্যাগ করলে?
ক্যাথরিন আপাতভাবে গম্বুজের শ্রুতির বৈজ্ঞানিক পর্যেষণা সম্পর্কে অবগত…কারণ দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়। কারণ রবার্ট একটা চিকেন হার্ট। তার উচিত ছিল আমার সাথে এখানে আসা। কারণ দরজা খোলার আগে এখনও অনেক
সময় আমাদের একসাথে কাটাতে হবে।
ল্যাংডন জানে তার কথাই ঠিক, কি আর করা দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে ব্যালকনি দিয়ে এগিয়ে আসে।
এই ছাদটা দারুণ বিস্ময়কর, ক্যাথরিন অভিভূত কণ্ঠে বলে, মাথার উপরের এ্যাপোস্থেসিসের চমৎকারিত্ব পুরোপুরি উপভোগ করতে সে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারক আর তাদের আবিষ্কারের সাথে পৌরাণিক দেবতারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে? আর ভেবে দেখো আমাদের ক্যাপিটলের ঠিক কেন্দ্রে এই ইমেজটা রয়েছে।
ল্যাংডন ফ্র্যাঙ্কলিন, ফুলটন, আর মোর্স তাদের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে, উপরের দিকে চোখ তুলে দেখে। একটা ঝকঝকে রঙধনু এইসব প্রতিকৃতি বেঁকে বেরিয়ে এসেছে, সেখান থেকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করে সে দেখে জর্জ ওয়াশিংটন মেঘে করে স্বর্গের দিকে উঠে যাচ্ছে। মানুষের দেবতায় পরিণত হবার দারুণ প্রতিশ্রুতি।
ক্যাথরিন বলে, দেখে মনে হয় না প্রাচীন রহস্যময়তার পুরো নির্যাস এখানে রোটানার উপরে ভাসছে।
ল্যাংডন মনে মনে স্বীকার করে পৃথিবীতে খুব বেশি একটা ফ্রেসকো আঁকা হয়নি যেখানে মানুষের রূপান্তর এবং পৌরাণিক দেবতাদের সাথে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ছাদের প্রতিকৃতিগুলোর দর্শনীয় সংগ্রহ আসলেই প্রাচীন রহস্যময়তার একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে এবং এখানে এটা আঁকার একটা কারণ আছে। আমেরিকার ভিত্তিস্থাপনকারী পূর্বপুরুষেরা দেশটাকে একটা খালি ক্যানভাস হিসাবে বিবেচনা করেছিল, একটা উর্বর ভূমি যেখানে রহস্যময়তার বীজের অঙ্কুরোদগম সম্ভব। আজ, অনেক উঁচুতে ভেসে থাকা এই আইকন- জাতির পিতার স্বর্গে আরোহন-নিরবে আমাদের নেতা, প্রেসিডেন্ট আর সাংসদদের মাথার উপরে নিরবে বিরাজ করছে…একটা জোরাল সতর্কবাণী, ভবিষ্যতের মানচিত্র, একটা সময়ের প্রতিশ্রুতি যখন মানুষ তাদের আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা অর্জন সমাপ্ত করবে।
রবার্ট, মিনার্ভার সান্নিধ্যে আমেরিকার মহান আবিষ্কারকদের অতিকায় প্রতিকৃতির দিকে তখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে ফিসফিস করে বলে। এটা আসলেও ভাবীকালসূচক। আজ, মানুষের সবচেয়ে অগ্রসর উদ্ভাবকের দল মানুষের সবচেয়ে প্রাচীণ ধারণা নিয়ে গবেষণা করছে। নিওটিক বিজ্ঞানের ধারা হয়ত আমাদের কাছে নতুন কিন্তু এটা আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম বিজ্ঞান- মানুষের ভাবনার বিশ্লেষণ। সে চোখে বিস্ময় নিয়ে ল্যাংডনের দিকে তাকায়। আর আমরা ক্রমশ জানতে পারছি প্রাচীন মানুষেরা, আজ আমরা ভাবনা যত ভাল করে বুঝতে পারি তারা আসলে এরচেয়েও ভাল বুঝতেন।
কথায় যুক্তি আছে, ল্যাংডন উত্তর দেয়। মানুষের মন আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের একমাত্র লভ্য প্রযুক্তি ছিল। প্রাচীন দার্শনিকেরা এর নিরন্তর সাধনা করে গেছেন।
হ্যাঁ! প্রাচীন পাণ্ডুলিপি মানুষের মনের ক্ষমতার বিষয়ে একেবারে আবিষ্ট হয়ে রয়েছে। মানসিক শক্তির প্রবাহ বেদে বর্ণনা করা হয়েছে। পিসটিস সোফিয়াতে বিশ্বর্বোধের বর্ণনা রয়েছে। মানবিক আত্মার প্রকৃতি অনুসন্ধান করেছে জোহর। শামানিক পাণ্ডুলিপিতে আইনস্টাইনের দূরবর্তী প্রভাবএর ধারণা দূর থেকে নিরাময়ের আঙ্গিকে কল্পনা করা হয়েছে। সবকিছুই সেখানে রয়েছে। আর বাইবেলের কথা না হয় বাদই দিলাম।
তুমিও শুরু করলে, ল্যাংডন মুচকি হেসে বলে। বাইবেলের ভিতরে বৈজ্ঞানিক তথ্য সাঙ্কেতিক আঁকারে রয়েছে এটা মেনে নিতে তোমার ভাই পাগল করে ছেড়েছে।
আসলেই তাই আছে, ক্যাথরিন বলে। পিটারের কথা তোমার বিশ্বাস না হলে, তাহলে নিউটনের বাইবেল সম্বন্ধে লেখা দুর্বোধ্য পাণ্ডুলিপিগুলো পড়ে দেখতে পার। বাইবেলের সাঙ্কেতিক রূপক একবার বুঝতে পারলে, রবার্ট তুমি বুঝতে পারবে এটা আসলে মানব মনের একটা বিশ্লেষণ।
ল্যাংডন কাঁধ ঝাঁকায়। আমার মনে হয় ফিরে গিয়ে আরেকবার ভাল করে পড়ে দেখতে হবে।
আচ্ছা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও, বোঝাই যায় ল্যাংডনের সংশয়বাদী মনোভাব তার পছন্দ হয়নি। বাইবেলে আমাদের যখন বলা হয় যাও আমাদের মন্দির তৈরী কর…একটা মন্দির যা আমরা অবশ্যই কোন অনুষঙ্গ ছাড়া এবং কোন ধরণের শব্দ না করে তৈরী করব, তোমার কি মনে হয় কোন মন্দিরের কথা এখানে বোঝাতে চাইছে?
বেশ, ভাষ্যে বলা হয়েছে তোমার দেহ একটা মন্দির।
হ্যাঁ, কোরিন্থিয়ানস ৩:১৬। তুমি ঈশ্বরের মন্দির। সে তার দিকে তাকিয়ে হাসে। আর গসপেল অব জনেও ঠিক একই কথা বলা হয়েছে। রবার্ট, স্ক্রিপচার খুব ভাল করেই আমাদের মাঝে নিহিত শক্তির বিষয়ে অবগত ছিল এবং সেই শক্তির সাধনা.করতে তারা আমাদের বলেছে…আমাদের মনের মন্দির তৈরী করতে অনুরোধ করেছে।
দুর্ভাগ্যবশত, আমি মনে করি একটা আসল মন্দির পূর্ণনির্মাণের জন্য ধর্মীয় পৃথিবী অপেক্ষা করছে। এটা মেসিয়ানিক ভবিষ্যবাণীর অংশ।
হ্যাঁ, কিন্তু এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় আবির্ভাব আসলে মানুষের আবির্ভাব- যে মুহূর্তে মানবজাতি তার মনের মন্দির তৈরী করতে সমর্থ হবে।
আমি জানি না, ল্যাংডন চিবুক ঘষতে ঘষতে বলে। আমি বাইবেল পণ্ডিত নই, কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি বাইবেলে একটা বাস্তব মন্দির যা নির্মাণ করা প্রয়োজন সেটার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। কাঠামোটাকে দুটো অংশে বর্ণনা করা হয়েছে- একটা বাইরের মন্দির যাকে বলা হয়েছে হোলি প্লেস আর একটা ভিতরের নিরাপদ শরণ যাকে বলা হয়েছে হোলি অব হোলিস। দুটো অংশের ভেতরে কেবল একটা পাতলা পর্দা দিয়ে পৃথক করা রয়েছে।
ক্যাথরিন মুচকি হাসে। বাইবেল সংশয়ীর পক্ষে ভালই বর্ণনা বলতে হবে। যাই হোক, তুমি কখনও মানুষের মস্তিষ্ক সামনা সামনি দেখেছো? এটা দুটো অংশে বিভক্ত- বাইরের অংশকে বলা হয় ডুরা ম্যাটার আর ভিতরের অংশকে বলা হয় পিয়া ম্যাটার। এই দুটো অংশকে পৃথক করে রেখেছে এ্যারাকনয়িড জালের মত টিস্যুর একটা পর্দা।
ল্যাংডন চমকে তাকায়।
ক্যাথরিন আলতো করে ল্যাংডনের কপালের পাশে স্পর্শ করে। রবার্ট, একটা কারণ আছে তাইতো এটাকে তোমার টেম্পল বলা হয়।
ক্যাথরিনের কথা হৃদয়ঙ্গম করতে করতে হঠাৎ গ্লস্টিক গসপেল অব মেরী অপ্রত্যাশিতভাবে তার মনে পড়ে: যেখানে মন রয়েছে সেখানেই আছে সম্পদ।
তুমি হয়ত শুনে থাকবে, ক্যাথরিন সমঝোতার সুরে বলে, ধ্যানস্থ ঋষিদের ব্রেন স্ক্যানের কথা? মানুষের মস্তিষ্ক, অধিশ্রয়নের উচ্চকোটিতে, পিনিয়াল গ্ল্যাণ্ড থেকে মোমের মত পদার্থ বাস্তবিক তৈরী হয়। মানুষের দেহে মস্তিষ্কের এই ক্ষরণের মত কিছু নিঃসৃত হয় না। এই মোমের মত পদার্থের একটা আজব নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে, আক্ষরিক অর্থে কোষ সৃষ্টি করতে পারে আর হয়ত এজন্যই ঋষিরা দীর্ঘজীবি হয়। এটাই সত্যিকারের বিজ্ঞান, রবার্ট। এই উপাদানের গুণাগুণ অচিন্তনীয় এবং কেবল গভীর অধিশ্রয়ণের উচ্চতর মার্গে কেবল মনেই এর সৃষ্টি হয়।
কয়েক বছর আগে এ সম্বন্ধে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম।
হ্যাঁ, আর এই বিষয়ে তুমি বাইবেলের ভাষ্য মন্না ফ্রম হেভেনর সাথে পরিচিত?
ল্যাংডন দুটোর ভিতরে কোন যোগসূত্র খুঁজে পায় না। তুমি বলতে চাইছে স্বর্গ থেকে চ্যুত জাদুকরী পদার্থ যা ক্ষুধা নিবৃত্ত করে।
ঠিক তাই। এই উপাদান বলা হয়ে থাকে অসুস্থকে নিরাময় করে অনন্ত জীবন দান করে এবং আজব ব্যাপার হল যে এটা হজম হবার পরে কোন বর্জ্য তৈরী হয় না। ক্যাথরিন চুপ করে যেন তাকে সময় দেয় ব্যাপারটা আত্মস্থ করতে। রবার্ট? সে উৎসাহী কণ্ঠে বলে। স্বর্গ থেকে চ্যুত একধরণের পুষ্টিবর্ধক সে নিজের কপালের পাশে টোকা দেয়। রহস্যময়ভাবে দেহকে উপশম দেয়? কোন বর্জ্য তৈরী করে না। এখনও বুঝতে পারছো না? এগুলো সব সাঙ্কেতিক শব্দ, রবার্ট! টেম্পল হল দেহ। স্বর্গ হল মন। জ্যাকবস ল্যাডার হল মেরুদণ্ড। আর মান্না হল মস্তিষ্কের এই বিরল নিঃসরণ। বাইবেলে এসব সাঙ্কেতিক শব্দ দেখলে মনোযোগ দিও। তারা প্রায়ই আপাতভাবে যা মনে হয় তারচেয়েও গভীর কোন কিছু বোঝায়।
ক্যাথরিন এখন দ্রুত কথা বলতে শুরু করেছে, সে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছে কিভাবে এই একই রহস্যময় উপাদান প্রাচীন রহস্যময়তায় ফিরে ফিরে এসেছে: নেকটার অব গড, এলিক্সির অব লাইফ, ফাউন্টেন অব ইয়ুথ, পরশ পাথর, এ্যামব্রোসিয়া, ডিউ, ওজাস, সোম। তারপরে সে মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্ল্যাণ্ড ব্যাখ্যা করে, যা ঈশ্বরের সর্বদর্শী চোখের উপস্থাপক। মথি ৬:২২ অনুসারে, সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, তোমার চোখ যখন একা, তোমার দেহ আলোয় ভরে উঠে। এই একই ধারণা আজনা চক্র উপস্থাপন করে এবং হিন্দুদের কপালের তিলক, যা-
ক্যাথরিন হঠাৎ থেমে যায় তাকে অপ্রস্তুত দেখায়। দুঃখিত…আমি জানি আমি আবোলতাবোল বকছিলাম। আমি আসলে খুবই উত্তেজিত। বহু বছর আমি মানুষের মনের অমিত শক্তি সম্বন্ধে প্রাচীন মুনিঋষিদের দাবী অধ্যয়ন করেছি আর এখন বিজ্ঞান আমাদের বলছে যে সেই শক্তি অর্জন আসলে একটা শারিরীক প্রক্রিয়া। আমাদের মস্তিষ্ক যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তবে আক্ষরিক অর্থেই অতিমানবিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে। অনেক প্রাচীন পাণ্ডুলিপির মত বাইবেল, এ পর্যন্ত প্রস্তুত সবচেয়ে জটিল যন্ত্রের বিস্তারিত ব্যাখ্যা,
মানবদেহ। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হল বিজ্ঞান এখনও মানব মনের পুরো প্রতিশ্রুতির কেবল বহিরাঙ্গ নিয়েই সামান্য নাড়াচাড়া করেছে।
মনে হচ্ছে তোমার নিওটিক গবেষণা সামনের দিকে একটা বিশাল অগ্রগতির সূচনা করবে।
অথবা পেছনের দিকে, সে বলে। আমরা এখন আবিষ্কার করছি এমন অনেক বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা প্রাচীন মুনি ঋষিরা জানতেন। কয়েক বছরের ভিতরে আধুনিক মানুষ এখন পর্যন্ত অচিন্তনীয়কে মেনে নিতে বাধ্য হবে: আমাদের মন ভৌত পদার্থ রূপান্তরে সক্ষম শক্তি বিকিরিত করতে পারে। সে একটু চুপ করে। আমাদের ভাবনার প্রতি বস্তুকণা সাড়া দেয়, যার মানে আমাদের ভাবনার ক্ষমতা রয়েছে পৃথিবী বদলে দেবার।
ল্যাংডন কোমলভাবে হাসে।
আমার গবেষণা আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে, ক্যাথরিন বলে। ঈশ্বর খুবই বাস্তব- একটা মানসিক শক্তি যা সবকিছুতে বিদ্যমান। আর আমরা মানুষেরা সেই আদলে তৈরী হয়েছি।
বুঝতে পারলাম না? ল্যাংডন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে। সেই আদলে তৈরী…মানসিক শক্তি?
ঠিক তাই। আমাদের পার্থিব দেহ সময়ের সাথে বদলায় কিন্তু আমাদের মন ঈশ্বরের আদলে সৃষ্ট। আমরা বাইবেল বড় বেশি হাল্কাভাবে পাঠ করি। আমরা শিখেছি ঈশ্বর আমাদের তার আদলে তৈরী করেছেন কিন্তু ঈশ্বরের সাথে আমাদের শরীরের না আমাদের মনের, আত্মার মিল আছে।
ল্যাংডন চুপ করে থাকে ভাবনার রাজ্যে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।
এটাই আসলে সবচেয়ে বড় উপহার, রবার্ট আর ঈশ্বর অপেক্ষা করছেন সেটা কবে আমরা বুঝতে পারব। সারা পৃথিবীব্যাপী, আমরা আঁকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের প্রতীক্ষা করি…কখনও উপলব্ধি করি না যে ঈশ্বর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ক্যাথরিন একটু থেমে তার শব্দগুলোকে জারিত হতে দেয়। আমরা স্রষ্টা অথচ কি অবুঝের মত আমরা সৃষ্টির ভূমিকা পালন করছি। আমরা নিজেদের অসহায় ভেড়া মনে করি, ঈশ্বর যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার দ্বারা নিয়তির বিড়ম্বনার শিকার। ভীতচকিত শিশুর মত আমরা হাটু ভেঁঙে বসে সাহায্য ভিক্ষা চাই, অনুকম্পা আর সৌভাগ্য কামনা করি। কিন্তু আমরা যদি একবার বুঝতে পারি আমরা আসলে স্রষ্টার আদলে সৃষ্ট হয়েছি, তখন আমরা বুঝতে পারব যে আমরাও অবশ্যই স্রষ্টা। যখন এটা আমরা অনুধাবন করব তখনই মানুষের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে।
দার্শনিক ম্যানলী পি.হলের একটা লেখা একটা অনুচ্ছেদ ল্যাংডনের মনে পড়ে যা সবসময়ে তাকে ব্ৰিত করেছে: এটা যদি অনন্তের অভিপ্রায় হত যে মানুষ বিজ্ঞ হবে না তাহলে সে কখনও জানার ক্ষমতায় তাকে বলীয়ান করত না। ল্যাংডন আবার উপরে এ্যাপোস্থেসিস অব ওয়াশিংটনের দিকে তাকায় মানুষের দেবত্ব অর্জনের প্রতীকি প্রকাশ। সৃষ্টির…স্রষ্টায় পরিণত হওয়া।
সবচেয়ে চমকপ্রদ অংশ, ক্যাথরিন বলে, মানুষ যত তাড়াতাড়ি তার আসল ক্ষমতার চর্চা শুরু করবে, আমাদের পৃথিবীর উপরে আমাদের অমিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা বাস্তবতার প্রতি প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পরিবর্তে বাস্তবতার বিন্যাস করতে সক্ষম হব।
ল্যাংডন দৃষ্টি নামিয়ে আনে। বিপজ্জনক…শোনাচ্ছে।
ক্যাথরিন চমকে উঠে তাকায়…দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। হ্যাঁ, ঠিক তাই! যদি চিন্তা আমাদের পৃথিবীকে প্রভাবিত করে তবে আমাদের অবশ্যই কিভাবে চিন্তা করছি সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ধ্বংসাত্মক ভাবনারও প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে আর আমরা ভাল করেই জানি সৃষ্টির চেয়ে ধ্বংস করাটা সহজ।
প্রাচীন জ্ঞানকে ইতরজনের হাত থেকে রক্ষা করে এবং কেবল আলোকপ্রাপ্তের সাথে এটা ভাগ করে নেবার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করে যত গল্পগাথার সৃষ্টি হয়েছে সেসবের কথা ল্যাংডন চিন্তা করে। অদৃশ্য কলেজের কথা সে ভাবে এবং মহান বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন রবার্ট বয়েলকে অনুরোধ করেছিলেন তাদের গোপন গবেষণা সম্পর্কে চরম নিরবতা বজায় রাখতে। এটা বোঝান সম্ভব না, ১৬৭৬ সালে নিউটন লিখেছিলেন, পৃথিবীর মারাত্মক ক্ষতি সাধন না করে।
এখানে একটা চিত্তাকর্ষক প্যাঁচ আছে, ক্যাথরিন বলে। সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা হল পৃথিবীর সব ধর্ম শতাব্দি পর শতাব্দি ধরে তাদের অনুসারীদের আস্থা আর বিশ্বাস এর ধারণা গ্রহণ করতে বলেছে। এখন বিজ্ঞান, বহু শতাব্দি ধরে যা ধর্মকে কুসংস্কার বলে হেয় করে এসেছে, এখন তাকে স্বীকার করতেই হবে যে আক্ষরিক অর্থেই বিজ্ঞানের পরবর্তী চর্চার ক্ষেত্র আস্থা আর বিশ্বাস …উদ্দেশ্য আর প্রত্যয়ের অধিশ্রয়ন ক্ষমতা। অলৌকিকের প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে যে বিজ্ঞান এক সময়ে বিনাশ করেছিল এখন নিজের সৃষ্ট গভীর ফাটলের উপরে সেতু নির্মাণ করছে ফিরে যাবার অভিপ্রায়ে।
ল্যাংডন তার কথাগুলো অনেকক্ষণ ভাবে। তারপরে সে আবার এ্যাপোস্থেসিসের দিকে তাকায়। আমার একটা প্রশ্ন আছে, ক্যাথরিনের দিকে তাকিয়ে সে বলে, আমি যদি গ্রহণও করি, এক মুহূর্তের জন্য হলেও, যে আমার মনের দ্বারা ভৌত পদার্থ বদলে দেবার ক্ষমতা আমার আছে এবং আক্ষরিকভাবে আমি যা আশা করি সেটাই প্রতিভাত হয়…আমি দুঃখিত আমি আমার জীবনে এমন কিছু দেখছি না যা আমাকে বিশ্বাস করাতে পারে যে আমার সে শক্তি রয়েছে।
ক্যাথরিন কাঁধ ঝাঁকায়। তাহলে বলবো তুমি ভাল করে দেখছো না।
না আসলেই, আমি একটা সত্যি উত্তর চাই। তোমার উত্তরটা ছিল প্রিস্টের মত। আমি একজন বৈজ্ঞানিকের উত্তর শুনতে আগ্রহী।
তুমি সত্যি উত্তর চাও? তাহলে শোন। যদি আমি তোমার হাতে একটা বেহালা দিয়ে বলি তুমি এটার সাহায্যে অসাধারণ সুর সৃষ্টি করতে সক্ষম তাহলে আমি তখন মিথ্যা বলছি না। তোমার অবশ্যই সেই ক্ষমতা আছে কিন্তু সেজন্য তোমাকে প্রচুর অনুশীলন করতে হবে। রবার্ট, তোমার মনকে ব্যবহার করা শিখতে হলেও সেরকম প্রচুর অনুশীলনের দরকার। সুনির্দিষ্ট ভাবনা একটা অর্জিত দক্ষতা। একটা প্রত্যয়ের প্রকাশ ঘটাতে প্রয়োজন লেজারের মত অধিশ্রয়ন, পূর্ণ ঐন্দ্রিয়ক প্রত্যক্ষীকরণ আর প্রগাঢ় বিশ্বাস। গবেষণাগারে এটা আমরা প্রমাণ করেছি। আর ঠিক বেহালা বাজাবার মত অনেক মানুষ অন্যদের চেয়ে বেশি প্রকৃতি প্রদত্ত ক্ষমতা প্রদর্শন করে। ইতিহাসের দিকে দেখো। সেইসব আলোকিত মনের মানুষদের গল্পগুলো আরো একবার বিবেচনা কর যারা অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারতেন।
ক্যাথরিন দোহাই লাগে এখন আবার বলো না যে তুমি অলৌকিক বিশ্বাস কর। আমি বলছি, সিরিয়াসলি…পানিকে মদে পরিণত করা, হাতের স্পর্শে অসুস্থকে নিরাময় করা?
ক্যাথরিন একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আমি মানুষকে ক্যানসার আক্রান্ত কোষকে কেবল তাদের সম্পর্কে চিন্তা করে সুস্থ কোষে রূপান্তরিত করতে দেখেছি। মানুষের মন পার্থিব জগতকে। বিপুলভাবে প্রভাবিত করছে আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। আর রবার্ট তুমি একবার সেটা ঘটতে দেখলে তখন সেটা তোমার বাস্তবতার একটা অংশে পরিণত হবে এবং বাকিটা তখন কেবল মাত্রার পার্থক্য।
ল্যাংডনকে বিষণ্ণ দেখায়। ক্যাথরিন পৃথিবীকে দেখার এটা একটা আশাব্যঞ্জক উপায় কিন্তু আমার জন্য এটা কেবল বিশ্বাসের একটা অসম্ভব অগ্রগতি। আর তুমি জানই বিশ্বাস কখনও আমার কাছে সহজে ধরা দেয়নি।
বেশ এটাকে তাহলে বিশ্বাস হিসাবে বিবেচনা কোরো না। এটাকে কেবল তোমার ধারণার পরিবর্তন হিসাবে বিবেচনা কর, মেনে নাও যে তুমি যেমন কল্পনা করেছিলে পৃথিবী ঠিক অবিকল সেরকম নয়। ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার শুরু হয়েছে একটা সাধারণ ধারণা থেকে যা আমাদের বিশ্বাসকে বদলে দেবার হুমকি দিয়েছে। পৃথিবী বৃত্তাকার এই সাধারণ বক্তব্যটাকে একেবারে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল কারণ কিছু লোক বিশ্বাস করতো এর ফলে সমুদ্রের পানি পৃথিবী থেকে গড়িয়ে যাবে। পৃথিবী। সূর্যের চারপাশে ঘোরে এই মতবাদ খারেজী করে দেয়া হয়েছিল। অজ্ঞ মানব মন সে যা বোঝে না তাকে হিংস্রভাবে আক্রমণ করে। কিছু লোক আছে যারা সৃষ্টি করে…কিছু লোক আছে যারা ধ্বংস করে। এই দ্বন্দ্ব চলে আসছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্রষ্টারা বিশ্বাসীদের খুঁজে পায়, এবং বিশ্বাসীদের সংখ্যা একটা নিরূপণকারী মাত্রায় পৌঁছে এবং সহসা পৃথিবী গোলকে পরিণত হয় এবং সৌরজগত সূর্যকেন্দ্রিক হয়ে উঠে। ধারণা রূপান্তরিত হয়, আর একটা নতুন বাস্ত বতা জন্ম নেয়।
ল্যাংডন মাথা নাড়ে, তার চিন্তার রাজ্যে ঝড় উঠেছে।
তোমার চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন? ক্যাথরিন জিজ্ঞেস করে।
ওহ, জানি না। কেন জানি না কিভাবে গভীর রাতে লেকের মধ্যেখানে নৌকা নিয়ে গিয়ে শুয়ে শুয়ে তারা দেখার ফাঁকে এসব আবোলতাবোল কথা ভাবতাম সে কথা আমার মনে হচ্ছিল।
সবজান্তার ভঙ্গিতে ক্যাথরিন মাথা নাড়ে। আমার মনে হয় আমাদের সবারই একই স্মৃতি রয়েছে। মাঠে অন্ধকারে চিত হয়ে শুয়ে আঁকাশের দিকে তাকিয়ে…মনে দ্বার খুলে দেয়া। সে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার জ্যাকেটটা আমাকে দাও।
কি? জ্যাকেটটা খুলে সেটা সে তার দিকে এগিয়ে দেয়।
সেটা দুভাঁজ করে একটা বালিশ বানিয়ে মাটিতে বিছিয়ে দেয়। শুয়ে পড়।
ল্যাংডন তার কথামত পিঠ দিয়ে শোয়, এবং ক্যাথরিন তার মাথার নীচে জ্যাকেটটা অর্ধেক দেয় এবং তারপরে সে বাকি অর্ধেকে মাথা রেখে নিজেও তার পাশে শুয়ে পড়ে- দুটো শিশু, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে সংকীর্ণ ক্যাটওয়াকে শুয়ে উপরে ব্রুমিডির আঁকা ফ্রেসকো দেখতে বিভোর।
ঠিক আছে, সে ফিসফিস করে বলে। তোমার মনকে সেই একই ভাবনায় আবিষ্ট কর…একটা ছেলে নৌকায় শুয়ে…তারা দেখছে…তার মন অবারিত আর বিস্ময়ে ভরা।
ল্যাংডন চেষ্টা করে কিন্তু সেই মুহূর্তে, একটু আরাম পেতে, ক্লান্তির ঢেউ তাকে আপুত করে। তার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসছে, সে তার মাথার উপরে। একটা নির্বাক আঁকৃতি উপলব্ধি করে যা সাথে সাথে তাকে সজাগ করে তোলে। এটা কি সম্ভব? তা বিশ্বাস হতে চায় না সে আগে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি, কিন্তু দি এ্যাপোস্থেসিস অব জর্জ ওয়াশিংটন এর চরিত্রগুলো পরিষ্কারভাবে দুটো এককেন্দ্রিক রিঙে বিন্যস্ত- বৃত্তের ভিতরে বৃত্ত। দি এ্যাপোস্থেসিস আবার সারকামপাঙ্কট। সে ভাবে আজ রাতে আর কি তার চোখ এড়িয়ে গেছে।
রবার্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি তোমাকে বলতে চাই। আমার গবেষণার আরো একটা অংশ আছে…এই অংশটা আমার বিশ্বাস আমার সমগ্র গবেষণার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক।
আরো বাকি আছে?
ক্যাথরিন কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে উঠে বসে। এবং আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি…মানুষ হিসাবে যদি আমরা এই একটা সহজ সত্য সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারি…পুরো পৃথিবী একরাতের ভিতরে বদলে যেতে পারে।
ল্যাংডনের পুরো মনোযোগ এখন ক্যাথরিনের কজায়।
আমার অবশ্য আগে বলে নেয়া উচিত, সে বলে, তোমাকে ম্যাসনিক মন্ত্র মনে করিয়ে দেয়া যা ছড়িয়ে আছে তাকে সংগ্রহ করতে…বিশৃঙ্খলার ভিতরে শৃঙ্খলা আনতে…এ্যাট-ওয়ান-মেন্ট খুঁজে পেতে।
বলে যাও, ল্যাংডন কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।
ক্যাথরিন মাথা নীচু করে তার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি মানুষের ভাবনার ক্ষমতা বীজগণিতের সূচকের হারে বাড়তে থাকে সেই ভাবনা ভাগ করে নেয়া মনের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে।
ল্যাংডন চুপ করে থেকে ভাবে এখান থেকে মেয়েটা কোথায় যেতে পারে।
আমি যা বলতে চাইছি সেটা হল…একটা মাথার চেয়ে দুটো মাথা ভাল…আর দুটো মাথা দ্বিগুণ ভালো না তারা অনেক অনেক বেশী বার ভালো। একাধিক মন একসাথে কাজ করে ভাবনার প্রভাবকে বাড়িয়ে দিতে পারে…গাণিতিক হারে। এটাই প্রার্থনা সঙ্, উপশম চক্র, দলগত সঙ্গীত আর একত্রে উপাসনার অন্তর্গত ক্ষমতা। বিশ্বজনীন সচেতনতা কোন বায়বীয় নিউ এজ ধারণা নয়। এটা একটা নিরেট বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা…আর এর চর্চা বিশ্বকে বদলে দেবার ক্ষমতা রাখে। নিওটিক বিজ্ঞানের এটাই মূল কথা। তারচেয়েও বড় বিষয়, এই মুহূর্তে সেটা সংঘটিত হচ্ছে। তুমি তোমার চারপাশে সেটা অনুভব করতে পারবে। প্রযুক্তি আমাদের এমনভাবে সম্পর্কিত করছে যেটা আমরা আগে কখনও কল্পনা করতে পারিনিঃ টুইটার, গুগল, উইকিপেডিয়া আরো অনেক কিছু– সব কিছু মিলে এক আন্তসম্পর্কিত মনের জাল তৈরী করেছে। সে হাসে। আর আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমার লেখা প্রকাশিত হবার সাথে সাথে টুইটেরাটি টুইট পাঠাতে শুরু করবে যা বলবে নিওটিক সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ এবং বিজ্ঞানের এই ধারার প্রতি আগ্রহ গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে।
ল্যাংডনের চোখের পাতা অসম্ভব ভারী হয়ে আসে। তুমি জানো, আমি এখনও জানি না কিভাবে একটা টুইটার পাঠাতে হয়।
টুইট,সে শুধরে দিয়ে হাসে।
দুঃখিত?
ব্যাপার না। চোখ বন্ধ কর, সময় হলে আমি তোমাকে উঠিয়ে দেব।
ল্যাংডনের মনে পড়ে স্থপতির দেয়া চাবিটার কথা এতক্ষণ তার মনে পড়েনি…এবং কেন তারা এখানে এসেছে। ক্লান্তির নতুন ঢেউ আছড়ে পড়তে সে চোখ বন্ধ করে। নিজের মনে অন্ধকারে সে দেখে বিশ্বজনীন সচেতনতাবোধ সম্পর্কে সে ভাবছে…প্লেটোর লেখা দি মাইণ্ড অব দি ওয়ার্ল্ড এবং গ্যাদারিং গড. ..জুজের সমষ্টিগত অসচেতনতা। ধারণাটা একাধারে সরল এবং চমকপ্রদ।
অনেকের সমষ্টির ভিতরে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যায়…একের ভিতরে পাবার চেয়ে।
এলোহিম, ল্যাংডন সহসা বলে উঠে, একটা অপ্রত্যাশিত যোগসূত্র দেখতে পেয়ে তার চোখ আবার বড় বড় হয়ে উঠেছে।
কি হল? ক্যাথরিন এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে।
এলোহিম, সে আবার বলে। ওল্ড টেস্টামেন্টে ঈশ্বরের হিব্রু শব্দ। আমার সবসময়ে এটা নিয়ে কৌতূহল ছিল।
ক্যাথরিন আবার একটা সবজান্তার হাসি দেয়। হ্যাঁ। শব্দটা বহুবচন।
ঠিক তাই! ল্যাংডন কখনও বুঝতে পারেনি বাইবেলের প্রথম অনুচ্ছেদেই কেন ঈশ্বরকে বহুবচনে অভিহিত করা হয়েছে। এলোহিম। জেনেসিসে মহান ঈশ্বরকে একক হিসাবে বর্ণনা করা হয়নি…অনেক হিসাবে বোঝান হয়েছে।
ঈশ্বর বহুবচন, ক্যাথরিন বলে, কারণ মানুষের মন অনেক।
ল্যাংডনের ভাবনা এখন জট পাকিয়ে যেতে শুরু করে…স্বপ্ন, স্মৃতি, আশা, ভয়, প্রকাশ…সব তার মাথার উপরে রোটানডার গম্বুজের নীচে ঘুরপাক খায়। তার চোখ আবার খুঁজে আসতে থাকলে সে এ্যাপোস্থেসিসে আঁকা তিনটা ল্যাটিস শব্দের দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারে।
E PLURIBUS UNUM:
অনেকের ভিতরে, এক, ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে, সে ভাবে।
.
পরিশিষ্ট
আস্তে আস্তে জেগে উঠে রবার্ট ল্যাংডন।
তার দিকে অনেকগুলি মুখ তাকিয়ে ছিল। আমি কোথায়?
পরক্ষণেই তার মনে পড়ে সে কোথায়। এ্যাপোথেসিসের নীচে সে ধীরে ধীরে উঠে বসে। ক্যাটওয়াকে দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকার জন্য পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে।
ক্যাথরিন কোথায়?
ল্যাংডন তার হাতের মিকি মাউস ঘড়ির দিকে তাকায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে রেলিং এর উপর দিয়ে নীচের বিশাল ফাঁকা স্থানটার দিকে উঁকি দেয়।
ক্যাথরিন? সে চিৎকার করে ডাকে। জনমানবহীন রোটানডার নিরবতায় শব্দগুলো প্রতিধ্বনি তুলে হারিয়ে যায়।
মেঝে থেকে তার টুইডের জ্যাকেটটা তুলে নিয়ে ধূলো ঝেড়ে সেটা সে আবার গায়ে দেয়। জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে দেখে প্রকৌশলীর দেয়া। লোহার চাবিটা উধাও হয়ে গেছে।
ওয়াকওয়ের পেছন দিয়ে ঘুরে এসে, ল্যাংডন স্থপতির দেখিয়ে দেয়া খোলা স্থানটার দিকে রওয়ানা দেয়…লোহার খাড়া সিঁড়ি উপরে জমাট অন্ধকারের দিকে উঠে গেছে। সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করে। সে উপরে উঠতে থাকে আর উঠতেই থাকে। সিঁড়ি ক্রমশ সরু আর ঢালু হয়ে আসে। ল্যাংডন এখনও উপরে উঠছে তো উঠছেই।
আর একটু বাকি আছে।
সিঁড়ির ধাপগুলো এখন মইয়ের মত হয়ে উঠেছে এবং ল্যাংডন অবশেষে সিঁড়ি শেষ হয় এবং ল্যাংডন একটা ছোট ল্যাণ্ডিংএ এসে পৌছে। তার সামনে একটা বিশাল আকৃতির লোহার দরজা। চাবিটা দরজার তালায় প্রবেশ করিয়ে সে দেখতে পায় আর দরজাটা খুলে গেছে। সে এগিয়ে এসে ধাক্কা দিতেই সেটা ভেতরের দিকে খুলে যায়। দরজার পেছনের বাতাস বেশ শীতল। ল্যাংডন চৌকাঠ অতিক্রম করে গাঢ় অন্ধকারে এসে দাঁড়ালে সে বুঝতে পারে সে এখন ভবনের বাইরে।
আমিই তোমার কাছে এখনই আসছিলাম, ক্যাথরিন তার কাছে এসে হেসে বলে। সময় প্রায় হয়ে এসেছে।
ল্যাংডন যখন তার চারপাশের পরিবেশটা চিনতে পারে, সে চমকে উঠে। সে ইউ.এস ক্যাপিটলের চূড়ার চারপাশে বৃত্তাকার একটা সংকীর্ণ স্কাইওয়াকে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তার মাথার উপরে ব্রোঞ্জের স্বাধীনতার মূর্তি ঘুমন্ত রাজধানী শহরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মূর্তিটা পূর্ব দিকে তাকিয়ে আছে, যেখানে ভোরের প্রথম লালচে আভা দিগন্তকে রাঙিয়ে দিতে শুরু করেছে।
ক্যাথরিন ল্যাংডনকে পথ দেখিয়ে পেছনে নিয়ে আসে যতক্ষণ না তারা পশ্চিমে মুখ করে, ন্যাশনাল মলের সাথে নিখুঁত রেখায় এসে দাঁড়ায়। দূরে ওয়াশিংটন মনুমেন্টকে ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের সুউচ্চ ওবেলিস্কটাকে আগের চেয়েও চিত্তাকর্ষক দেখায়।
ওটা যখন নির্মিত হয়েছিল, ক্যাথরিন ফিসফিস করে বলে, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু নির্মাণ কাঠামো ছিল সেটা।
ল্যাংডন পুরাতন সেপিয়া ফটোগ্রাফে ভাড়ার উপরে স্টোনম্যাসনদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, মাটি থেকে পাঁচশ ফিট উপরে, প্রতিটা বল্ক হাতে গেথে তুলছে, একটার পরে একটা।
আমরা নির্মাতা, সে ভাবে। আমরা স্রষ্টা।
সময়ের শুরু থেকে, মানুষ অনুভব করেছে তার ভিতরে বিশেষ কিছু একটা রয়েছে…বেশি কিছু একটা। সে তার যে ক্ষমতা নেই তা অর্জন করতে ব্যাগ হয়ে উঠেছে। সে আঁকাশে উড়বার স্বপ্ন দেখেছে, নিরাময়ের আর পৃথিবীকে সম্ভাব্য সব উপায়ে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেছে।
এবং সে ঠিক সেটাই করেছে।
আজ, মানুষের সাফল্যের সৌধ ন্যাশনাল মলে ছড়িয়ে রয়েছে। স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরে উপচে পড়ছে আমাদের মহান চিন্তাবিদদের ধারণা, আমাদের বিজ্ঞান, চিত্রকলা আর আমাদের আবিষ্কারের উপাচারে। স্রষ্টা হিসাবে মানুষের সাফল্যের গল্প তারা শোনায়-নেটিভ আমেরিকান হিস্ট্রি মিউজিয়ামে পাথরের অনুষঙ্গ থেকে ন্যাশনাল এয়ার আর স্পেস মিউজিয়ামে রক্ষিত রকেট আর জেট ইঞ্জিন।
আমাদের পূর্বপুরুষরা আজ আমাদের দেখলে আসলেই দেবতা মনে করতো।
সামনে ছড়িয়ে থাকা অতিকায় সৌধ আর জাদুঘরের দিকে ভোরের আগের কুয়াশার ভিতরে তাকিয়ে থেকে তার চোখ আবার ওয়াশিংটন মনুমেন্টের উপরে ফিরে আসে। ভিত্তিপ্রস্তরের নীচে চাপা থাকা বাইবেলটা তার চোখে ভাসে এবং ভাবে কিভাবে স্রষ্টার কথা কিভাবে আসলে মানুষের কথাতেই পরিণত হয়েছে।
আমেরিকার ক্রসরোডে স্থাপিত মনুমেন্টের নীচে বৃত্তাকার রাজার ভিতরে লুকিয়ে রাখা গ্রেট সারকামপাঙ্কটের কথা সে ভাবে। সহসা পিটারের দেয়া পাথরের বাক্সটার কথা তার মনে পড়ে। ঘনকটা, সে এখন বুঝতে পারে কজা থেকে খুলে গিয়ে একই জ্যামিতিক আঁকৃতি তৈরী করে একটা ক্রস যার কেন্দ্রে রয়েছে একটা সারকামপাঙ্কট। ল্যাংডন হেসে ফেলে। ক্ষুদে বাক্সটাও এই ক্রসরোডের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রবার্ট, দেখো, ক্যাথরিন মনুমেন্টের শীর্ষের দিকে ইঙ্গিত করে।
ল্যাংডন চোখ তুলে তাকায় কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না।
তারপরে, ভাল করে তাকালে তার নজরে পড়ে।
মলের অন্যপ্রান্তে সুউচ্চ টাওয়ারের সর্বোচ্চ বিন্দুতে সোনালী সূর্যরশ্মির একটা ক্ষুদ্র কণা চকচক করছে। চমকাতে থাকা সূচীবিন্দুটা দ্রুত উজ্জ্বল, আরো দীপ্তিমান হয়ে উঠে ক্যাস্টোনের এ্যালুমিনিয়ামের চূড়ায় চমকাতে থাকে। ল্যাংডন অবাক হয়ে দেখে সূর্যের রশি একটা আলোক সঙ্কেতে পরিণত হয়ে ছায়াময় শহরের উপরে ভাসছে। এ্যালুমিনিয়ামের শীর্ষদেশের পূর্বপাশে ক্ষুদ্র খোদাইটার কথা ভাবে এবং অবাক হয়ে উপলব্ধি করে যে সূর্যের প্রথম রশ্মি জাতির রাজধানীতে প্রতিদিন সকালে দুটো শব্দ আলোকিত করে:
Laus Dco
রবার্ট, ক্যাথরিন ফিসফিস করে বলে। সূর্যোদয়ের সময়ে কেউ এখানে আসতে পারে না। পিটার চেয়েছিল এটাই আমরা প্রত্যক্ষ করি।
ল্যাংডন অনুভব করে তার নাড়ীর স্পন্দন মনুমেন্টের উপরের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
সে বলেছিল, এই কারণেই আমাদের পূর্বপুরুষরা মনুমেন্টটাকে এত উঁচু করে নির্মাণ করেছিল। আমি জানি না এটা সত্যি কিনা, কিন্তু আমি এটা জানি একটা খুব পুরানো আইন আছে যেখানে জারী করা হয়েছে আমাদের রাজধানী শহরে এই মনুমেন্টের চেয়ে উঁচু কোন নির্মাণ নিষিদ্ধ।
সূর্য তাদের পেছনে দিগন্তের উপরে গুঁড়ি দিয়ে উঠে আসলে ক্যাপস্টোন থেকে আলো আরেকটু নীচে নেমে আসে। ল্যাংডন তাকিয়ে থেকে সে প্রায় অনুভব করতে পারে তার চারপাশে শূন্য স্থানের ভিতর দিয়ে স্বর্গীয় গোলকসমূহ তাদের চিরন্তন কক্ষপথ স্পর্শ করছে। সে বিশ্বস্রষ্টার কথা ভাবে এবং পিটার কিভাবে জোর দিয়ে বলেছিল সে যে গুপ্তধন রবার্টকে দেখাতে চায় সেটা কেবল স্রষ্টাই তার সামনে অবারিত করতে সক্ষম। ল্যাংডন মূর্খ ভেবেছিল সেই স্রষ্টা ওয়ারেন বেল্লামি। ভুল স্রষ্টা।
সূর্যের রশ্মি জোরাল হতে সোনালী আভা তেত্রিশ-শো-পাউণ্ডের ক্যাপস্টোন পুরোপুরি আপুত করে ফেলে। মানুষের মন…আলোক শুদ্ধি গ্রহণ করছে। আলো মনুমেন্টের পৃষ্ঠদেশ বেয়ে নামতে শুরু করে, প্রতিদিন সকালে সে একই ভাবে নীচে নেমে আসে। স্বর্গ ধরণীর বুকে নেমে আসছে…ঈশ্বর সংযুক্ত হচ্ছেন মানুষের সাথে। ল্যাংডন বুঝতে পারে আসছে সন্ধ্যার এই একই প্রক্রিয়া উল্টোভাবে ঘটবে। সূর্য পশ্চিমে ডুব দেবে আলো পৃথিবী থেকে স্বর্গে ফিরে যাবে…নতুন দিনের প্রস্তুতির প্রত্যাশায়।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাথরিন শীতে কেঁপে উঠে তার দিকে এগিয়ে আসে। ল্যাংডন তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে। তারা দুজন নিরবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে, ল্যাংডন গত রাতে সে যা কিছু শিখেছে সেগুলোর কথা ভাবে। ক্যাথরিনের বিশ্বাস যে সবকিছু শীঘই বদলে যাবে সেটা ভাবে, আরো ভাবে পিটারের বিশ্বাস যে আলোকময়তা আন্ন। এবং সে মহান প্রফেটের কথা ভাবে যিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলে গিয়েছেন: গোপন কোন কিছুই গোপন থাকবে না; রহস্যময় সবকিছুই আলোয় প্রকাশিত হবে।
সূর্য ওয়াশিংটনের আঁকাশে উঠে আসতে ল্যাংডন আঁকাশের দিকে তাকায় যেখানে রাতের শেষ তারাগুলো দ্রুত ম্লান হয়ে আসছে। মানুষ, বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের কথা সে ভাবে। সে ভাবে কিভাবে প্রতিটা সংস্কৃতি, প্রতিটা দেশে, প্রতিটা সময়ে কিভাবে একটা সাধারণ জিনিস ভাগ করে নিয়েছে। আমাদের সবারই স্রষ্টা রয়েছে। আমরা ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করি, ভিন্ন রূপ, ভিন্ন প্রার্থনা ব্যবহার করলেও মানুষের কাছে ঈশ্বর বিশ্বব্যাপী একটা ধ্রুব সত্ত্বা। ঈশ্বরের প্রতীক আমরা সবাই ভাগ করে নিয়েছি…জীবনের সেইসব রহস্যের প্রতীক যা আমরা বুঝতে অপারগ। প্রাচীনরা ঈশ্বরের প্রশংসা করেছে মানুষের সীমাহীন সম্ভাবনার প্রতীক হিসাবে কিন্তু প্রাচীন প্রতীক সময়ের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল। এতদিন পর্যন্ত।
বহু কাঙ্খিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, ক্যাপিটলের শীর্ষে দাঁড়িয়ে ঝর্ণার মত নেমে আসা সূর্যরশ্মির উষ্ণতায়, রবার্ট ল্যাংডন নিজের মাঝে একটা শক্তিশালী আবেগের স্ফুরণ অনুভব করে। তার সারা জীবনে এমন কোন অনুভূতি এত গভীরভাবে তাকে তাড়িত করেনি।
আশা।
আগের পর্ব :
০১. বিশ্বজুড়ে সমাদৃত আইফেল টাওয়ার
০২. পিটার ফোন ধরছে না কেন
০৩. দি এ্যাপোথেসিস অব ওয়াশিংটন
০৪. ত্রিস ডান কিউবের উজ্জ্বল আলো
০৫. পাথরের পিরামিড
০৬. ক্যাথরিন সলোমন
০৭. আজকের রাতটাই প্রথম না
০৮. স্টিম শাওয়ারের তরঙ্গায়িত উষ্ণতার মাঝে
০৯. ভূ-গর্ভস্থ স্থান
১০. ক্যাথিড্রাল কলেজের ভিতরে
১১. রবার্টকে ওখান থেকে
১২. ঘন্টাঘরের তীব্রতায়
১৩. এক সন্তান হারানো পিতামাতা