দ্যা লস্ট সিম্বল: ১২. ঘন্টাঘরের তীব্রতায়

দ্যা লস্ট সিম্বল: ১২. ঘন্টাঘরের তীব্রতায়

১১১ অধ্যায়:

ঘন্টাঘরের তীব্রতায় পুরো তিন মিনিট ঘন্টাটা বেজে চলে, ল্যাংডনের মাথার উপরে স্ফটিকে ঝাড়বাতি কিন্নর শব্দে আলোড়িত হয়। ফিলিপস এক্সিটার একাডেমীর এই সর্বজন প্রিয় এ্যাসেম্বলী হলে সে বহু দশক আগে এখানে লেকচার শুনতে আসত। অবশ্য আজ এসেছে তার এক বন্ধুর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বক্তৃতা শুনতে। আলো কমে আসতে পেছনের দেয়ালের পাশে সে একটা চেয়ারে উপবিষ্ট হয়, তার মাথার উপরে হেডমাস্টারদের প্রতিকৃতির একটা সমাবেশ দেয়ালে সাজান আছে।

দর্শকদের ভিতরে একটা নিরবতা নেমে আসে।

পরিপূর্ণ অন্ধকারের ভিতরে একটা লম্বা, আবছায়া অবয়ব স্টেজের উপর দিয়ে পোডিয়ামের দিকে এগিয়ে আসে। সুপ্রভাত, মাইক্রোফোনে অবয়বহীন

একটা কণ্ঠ ফিসফিস করে উঠে।

উপস্থিত সবাই চোখ কুঁচকে দেখতে চেষ্টা করে সে কথা বলছে।

একটা স্লাইড প্রোজেক্টর জীবন্ত হয়ে উঠে, একটা সেপিয়া ফটোগ্রাফের আবছা প্রতিকৃতি দেখা যায়-লাল বেলেপাথরের একটা দূর্গের নাটকীয় চেহারার সম্মুখভাগ, উঁচু চারকোণা টাওয়ার এবং গোথিক রীতিতে যা অলঙ্কৃত।

ছায়াটা আবার কথা বলে। আমাকে কে বলতে পারবে এটা কোথায় অবস্থিত?।

ইংল্যানয! একটা মেয়ে অন্ধকারে বলে উঠে। এটা গোথিক আর রোমানেস্কের শেষের দিকের রীতির একটা সংমিশ্রণ যা একে গুরুত্বপূর্ণ নরম্যান দূর্গের মহিমা দান করেছে এবং ইংল্যাণ্ডের বারো শতকের কীর্তি।

বাবা, চেহারাহীন কণ্ঠস্বর বলে। কেউ দেখছি স্থাপত্যবিদ্যায় পণ্ডিত আমাদের মাঝে উপস্থিত আছে।

নিরব হতাশা চারপাশে বিরাজ করে।

দুর্ভাগ্যবশত, কণ্ঠস্বরটা এবার বলে, তুমি মেয়ে, তিন হাজার মাইল দূরে আর পাঁচশ বছর এগিয়ে গিয়েছে।

সারা ঘর চমকে যায়।

প্রজেক্টর এবার একই ছবির অন্য আঙ্গিক থেকে কালার আধুনিক ছবি উপস্থাপন করে। দূর্গটার সেনেকা ক্রীক বেলেপাথর সামনের দৃশ্যপট জুড়ে অবস্থান করছে কিন্তু পেছনে খুব কাছেই রাজকীয়, সাদা, কলামযুক্ত ইউ.এস ক্যাপিটলের গম্বুজ দেখা যাচ্ছে।

দাঁড়াও! মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠে। ডি.সিতে নরম্যান দূর্গ আছে??

সেই ১৮৮৫ সাল থেকে, কণ্ঠস্বরটা উত্তর দেয়। পরের ছবিটা সে সময়ে। তোলা।

আরেকটা নতুন স্লাইড ভেসে উঠে-সাদা কালো ভেতরের দৃশ্য, একটা খিলানাকৃতি বলরুম, প্রাণীদেহের কঙ্কাল, বৈজ্ঞানিক নমুনার ডিসপ্লে, বায়োলজিক্যাল স্যাম্পেলের কাঁচের জার, নৃতাত্ত্বিক প্রত্নবস্তু, এবং প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের প্লাস্টার কেসে রুমটা সজ্জিত।

এই বিস্ময়কর দূর্গ, কণ্ঠস্বরটা বলে, আমেরিকার প্রথম সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক জাদুঘর। এটা আমেরিকাকে উপহার দিয়েছিলেন এক ধনবান বৃটিশ বিজ্ঞানী যিনি আমাদের পূর্বপুরুষদের মত বিশ্বাস করতেন আমাদের এই ক্রমবর্ধমান দেশ একদিন আলোকিত ভূখণে ড পরিণত হবে। তিনি আমাদের পূর্বপুরুষদের বিশাল সম্পদ দান করেন এবং অনুরোধ করেন দেশের কেন্দ্রস্থলে জ্ঞানের প্রসার আর প্রচারের জন্য একটা ভবন নির্মাত করা হয় যেন এই সম্পদ দিয়ে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এই বিজ্ঞানীর নাম কে বলতে পারবে?

সামনের সারি থেকে একজন ভীরু কণ্ঠে বলে, জেমস স্মিথসন?

চিনতে পারার পরিচিত গুঞ্জনে এবার ক্লাসরুম ভাসতে থাকে।

অবশ্যই স্মিথসন, স্টেজের লোকটা বলে। পিটার সলোমন এবার আলোতে এসে দাঁড়ায় তার ধুসর চোখে আনন্দ খেলা করছে। সুপ্রভাত, আমার নাম পিটার সলোমন আর আমি স্মিথসোনিয়ান অনুষদের সেক্রেটারী।

ছাত্ররা হাততালিতে ঘর ভরিয়ে তোলে।

ল্যাংডন পেছনে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখে পিটার ছাত্রদের অনুষদের শুরু দিকের ইতিহাস ছবির সাহায্যে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলে। বর্ণনাটা শুরু হয় স্মিথসোনিয়ান দূর্গ, বেসমেন্টের বিজ্ঞান গবেষণাগার, এক্সিবিট ভর্তি করিডোর, বিজ্ঞানীদের ছবি যারা নিজেদের কিউরেটরস অব ক্রাস্টেসিয়ানস বলতেন এবং বর্তমানে মৃত অনুষদের দুই সবচেয়ে জনপ্রিয় বাসিন্দা- ডিফিউশন আর ইনক্রিজ নামের দুটো প্যাচা। আধঘন্টার স্লাইড শো শেষ হয় ন্যাশনাল মলে অতিকায় স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরের স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে।

আমি শুরুতে যা বলেছিলাম, সলোমন সমাপ্তি ভাষণে বলেন, জেমস স্মিথসন আর আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের এই দেশ আলোকিত ভূখণ্ডে পরিণত হবে। আমি বিশ্বাস করি আজ বেঁচে থাকলে তারা গর্ব বোধ করতেন। আমেরিকা একেবারে কেন্দ্রস্থলে বিজ্ঞান আর জ্ঞানের প্রতীক হয়ে তাদের মহান স্মিথসোনিয়ান অনুষদ আজ দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের। পূর্বপুরুষদের স্বপ্নের আমেরিকার এটা একটা জলজ্যান্ত প্রতিরূপ- যে দেশটা বিজ্ঞান, জ্ঞান, আর জ্ঞানের নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

একটা ছেলে হাত তুলে, মি. সলোমন, তার কণ্ঠস্বরে বিভ্রান্তি পরিষ্কার। আপনি বলেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা ইউরোপের ধর্মীয় নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে এখানে পালিয়ে এসেছিলেন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির নীতির উপরে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় নিয়ে। .

ঠিক আছে।

কিন্তু…আমার এখন মনে হচ্ছে তারা খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

সলোমন হাসেন। বন্ধুরা আমার কথা ভুল ব্যাখ্যা কোরো না। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন গভীর ধর্মপ্রাণ কিন্তু সেইসাথে ডেইষ্ট- যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন বটে কিন্তু সেটা ছিল বিশ্বজনীন আর উদারমনের। তাদের একমাত্র ধর্মীয় মতবাদ ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা। তারা আধ্যাত্মিকতায় উদ্দীপিত একটা ইউটোপিয়ান সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা বস্তাপচা ধর্মীয় কুসংস্কারের জায়গায় জনশিক্ষা আর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আর চিন্তার স্বাধীনতার ভিত্তিতে গঠিত।

একটা মেয়ে হাত তুলে।

হ্যাঁ?

আমি, হাতের সেলফোন সে দেখায়, উইকেপিডিয়া সার্চ করছিলাম যেখানে বলছে আপনি একজন অগ্রগণ্য ফ্রিম্যাসন।

পিটার হাতের আংটি দেখিয়ে বলে, তোমার ডাটা চার্জ আমি বাচিয়ে দিতে পারতাম।

আপনি বললেন, সে একটা ঢোক গিলে, বস্তা পচা ধর্মীয় কুসংস্কার কিন্তু…ম্যাসনরাই আমি জানি বস্তাপচা কুসংস্কারের সবচেয়ে বড় প্রস্তাবক।

সেটা কিভাবে?

আমি পড়েছি যে আপনারা অদ্ভুত প্রাচীন কৃত্যানুষ্ঠান আর বিশ্বাসের ধারক। আপনারা একধরণের প্রাচীন যাদুকরী জ্ঞানয় বিশ্বাস করেন…যার কিনা মানুষকে দেবতাদের কাতারে উন্নীত করতে সক্ষম?

আসলে, সলোমন বলে, তোমার কথা পুরোপুরি ঠিক।

সলোমন হাসি চেপে মেয়েটাকে বলে, আর কি লেখা আছে তোমার উইকি-জ্ঞানয়?

মেয়েটা অস্বস্তি নিয়ে পড়তে শুরু করে।

এই শক্তিশালী জ্ঞান অদীক্ষিতের দল যাতে ব্যবহৃত না করতে পারে সেকারণে গোড়ার দিকের দীক্ষিতেরা সংকেতে তাদের জ্ঞানের কথা লিপিবদ্ধ করেন…এর শক্তিশালী সত্য রূপক, পূরাণ আর প্রতাঁকের আবরণে আড়াল করে ফেলেন। আজও এই সাঙ্কেতিক জ্ঞান আমরা আমাদের চারপাশে দেখতে পাই…যুগ যুগ ধরে আমাদের পূরাণ, চিত্রকলা আর অকাল্ট পাণ্ডুলিপিতে এটা প্রচলিত হয়ে এসেছে। আধুনিক মানুষ দুর্ভাগ্যবশত এই জটিল জ্ঞান পাঠোদ্ধারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে…আর তাই মহান সত্য লুপ্ত হয়েছে।

সলোমন খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে থাকেন। এই শেষ?

না আরেকটু লেখা আছে?

আমাদের বলেন।

যে মুনি ঋষির দল প্রাচীন রহস্যময়কে সাঙ্কেতিক ভাষায় পরিণত করেছিল তারা অনেক আগেই তা পাঠোদ্ধারের জন্য একধরণের সূত্র রেখে গিয়েছেন…যাকে বলা হয় ভারবাম সিগনিফিকেটিয়াম- বলা হয়ে থাকে অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে প্রাচীন রহস্যময়তাকে সব মানুষের বোধগম্য করার ক্ষমতা এর আছে।

আর এই বিস্ময়কর শব্দ এখন কোথায় আছে?

এখানে বলা হয়েছে, ভারবাম সিগনিফিকেটিয়াম মাটির গভীরে প্রোথিত আছে যেখানে এটা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের জন্য ধৈৰ্য্য নিয়ে অপেক্ষা করছে…যখন মানবজাতি সর্বযুগের সত্য, জ্ঞান আর জ্ঞান ব্যাতীত টিকে থাকতে পারবে না। এই অন্ধকার চরম মুহূর্তে তারা শব্দকে খুঁজে বের করবে এবং একটা নতুন আলোকিত যুগের সূচনা করবে।

মি. সলোমন, আপিনি এসব বিশ্বাস করেন?

সলোমন হাসে। করলে ক্ষতি কি? আমাদের পূরানে যাদুকরী মন্ত্রের লম্বা ইতিহাস আছে যা মানুষকে অন্তদৃষ্টি আর দেবতার শক্তি প্রদান করে। আমাদের ছেলেরা আজও বলে অ্যাব্রাকাস্ত্রো যার মানে আমি যা বলি তাই সৃষ্টি হয়, এটা প্রাচীন আর‍্যামায়িক মরমীবাদ–আভরা কাড়াভরা- থেকে এসেছে।

কিন্তু স্যার কেবল একটা শব্দ …এই ভারবাম সিগনিফিকেটাম…এর প্রাচীন জ্ঞান উন্মোচনের ক্ষমতা আছে এটা নিশ্চয়ই আপনি বিশ্বাস করেন না।

সলোমন চুপ করে থাকে। আমার বিশ্বাস নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। তোমার ভাবনার বিষয় হল এই অনাগত আলোকময়তার কথা সব বিশ্বাস আর দার্শনিক প্রথায় ভবিষ্যত বাণী করা হয়েছে। হিন্দুরা একে বলে কৃত্য যুগ, জ্যোতির্বিদরা বলে একুয়ারিসের যুগ, ইহুদিরা একে বলে মেসিয়ার আগমন, থিওসোফিস্টরা বলে নতুন যুগ, কসমোলজিস্টরা বলে হারমোনিক কনভারজেন্স আর এর নির্দিষ্ট তারিখ তারা উল্লেক করেন।

ডিসেম্বর ২১, ২০১২। হ্যাঁ, খুবই সন্নিকটে…অবশ্য মায়ান গণিতে যদি তুমি বিশ্বাস কর।

ল্যঙ্গডন হাসে, সলোমন দশ বছর আগেই টেলিভিশনের এই বর্তমান প্রচারণা যে ২০১২ পৃথিবীর ধ্বংস সূচীত করবে বলে বাড়াবাড়ি শুরু হবে, ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।

সময়কালটা আপাতত ভুলে যাও, সলোমন বলে, কিন্তু মানবজাতির সব মতের দার্শনিকরা এই মহান আলোকময়তা আসবার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন। সব যুগে, সব সংস্কৃতিতে মানুষ এই একটা ধারণা অধিশ্রয়ন করেছে মানুষের রূপান্তরের আগমন কাল…মানুষের মনের সত্যিকারের সম্ভাবনার স্থগিত রূপান্তর। সে হাসে। বিশ্বাসের এই ঐক্যতানের কি ব্যাখ্যা হতে পারে?

সত্য।

সলোমন ঘুরে তাকায়, কথাটা কে বললো?

একটা তিব্বতী বা নেপালী ছেলে হাত তুলে, হয়ত একটা বিশ্বজনীন সত্য সব মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত আছে। আমাদের ডিএনএতে হয়ত সাধারণ একটা ধ্রুবক আছে। এই সমষ্টিগত সত্য হয়ত আমাদের সবার গল্পগুলোকে একই মাত্রা দিয়েছে।

সলোমন হাত জোড়া করে ছেলেটার দিকে আলোকিত চিত্তে মাথা নোয়ায়। ধন্যবাদ।

সত্য, সলোমন তার শ্রোতাদের বলে, সত্যের একটা শক্তি আছে। আমরা যদি সবাই একই ধারণার প্রতি ধাবিত হই, আমরা ধাবিত হই সম্ভবত এই ধারণাগুলো সত্যি বলে…আমাদের গভীরে প্রোথিত আছে। আর আমরা যখন এই সত্য কথন শুনি, আমরা যদি সেটা বুঝতে নাও পারি, আমরা অনুভব করি সত্যটা আমাদের ভিতরে অনুরণিত হচ্ছে…আমাদের ভেতর একটা অচেতন জ্ঞানকে আন্দোলিত করেছে। সম্ভবত এই সত্য আমাদের জানতে হবে, বরং একে জাগিয়ে তুলতে হবে…পুনরায় স্মরণ করতে হবে…পুনরায় জানতে হবে., যা ইতিমধ্যেই আমাদের ভিতরে অবস্থান করছে।

সারা ক্লাস স্তব্ধ হয়ে থাকে।

সলোমন আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সবাইকে ব্যাপারটায় ধাতস্থ হতে দেয়। তারপরে শান্ত কণ্ঠে বলে, শেষে তোমাদের সাবধান করে বলি, এই সত্যের দেখা পাওয়া মোটেই সহজ না। সবকালেই আলোকতার সাথে সাথে এসেছে অন্ধকারাচ্ছন্নতা যা ঠিক বিপরীত দিকে আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছে। প্রকৃতি আর ভারসাম্যের সূত্র এটাই। আজ বিশ্বে অন্ধকারের বাড়বাড়ন্ত দেখে ভীত হবার কিছু নেই এর মানে আলোও সমান তেজে বাড়ছে। আমরা আলোকময়তার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি। আমরা সবাই খুবই ভাগ্যবান যে ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আমরা জীবিত রয়েছি। আমাদের আগে যারা জীবিত ছিলেন সবাই ইতিহাসের বিভিন্ন কালে জীবিত ছিলেন….আমরাই পরম রেনেসাসের প্রত্যক্ষদর্শী হবার সৌভাগ্য নিয়ে বেঁচে আছি, সময়ের এই সংকীর্ণ গণ্ডিতে আমরা এর সাক্ষী হয়ে থাকব। সহস্র বর্ষের অন্ধকারাচ্ছন্নতার পরে আমরা আমাদের বিজ্ঞান, মন আর ধর্মকে একসাথে সত্যকে উন্মোচিত করছে প্রত্যক্ষ করবো।

সবাই হাততালিতে ফেটে পড়বে তার আগেই সে সবাইকে থামিয়ে সেলফোন হাতের সেই মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ম্যাম তোমার ধারণার সাথে আমি হয়ত একমত না কিন্তু তোমার প্যাশন একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক এই অনাগত পরিবর্তনের জন্য। অন্ধকারাচ্ছন্নতা সমবেদনার উপরে ভর করে বৃদ্ধি পায়…আর বিশ্বাস হচ্ছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক। বাইবেল পাঠ অব্যাহত রাখবে। সে হাসে। বিশেষ করে শেষের পাতাগুলো।

মহাপ্রলয়? মেয়েটা জানতে চায়।

ঠিক। বুক অব রিভিলেশন আমাদের এই একই সত্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বাইবেলের এই শেষ বইটা অন্য অসংখ্য প্রথার একই বিশ্বাসের গল্প বলেছে। তারা সবাই অনাগত জ্ঞানর আগমনের আসন্নতার কথা বলেছেন।

কিন্তু মহাপ্রলয় পৃথিবীর অন্তিম সময়ের কথা বলছে নাকি? মানে অ্যান্টিক্রাইস্ট, আর্মাগেডন, শুভ আর অশুভের লড়াই এসব কথা।

সলোমন হাসে। এখানে গ্রীক জানা আছে কার কার?

কয়েকজন হাত তুলে।

এ্যাপোক্যালিপস শব্দে আক্ষরিক মানে কি?

এর মানে, সে শুরু করে নিজেই চমকে উঠে। এ্যাপোক্যালিপস মানে উন্মোচিত…অবারিত।

সলোমন ছেলেটার দিকে তাকিয়ে প্রশংসাসূচক মাথা নাড়ে। ঠিক তাই। এ্যাপোক্যালিপস মানে প্রকাশ পাওয়া। দি বুক অব রিভিল-এশন অনুমান করে মহান আর অচিন্তনীয় জ্ঞানণ উন্মোচনে। এ্যাপোক্যালিপস মানে পৃথিবী শেষ না, আমরা যেভাবে পৃথিবীকে চিনি তার সমাপ্তি। এ্যাপোক্যালিপসের ভবিষ্যদণী আরো অনেক কিছুর মতই বিকৃত হয়েছে।

সে স্টেজের সামনে এগিয়ে যায়। বিশ্বাস কর…পরিবর্তন আসছে, আর সেটা আমরা যেমন ভেবেছি মোটেই সেরকম নয়।

তার মাথার অনেক উপরে ঘন্টা বাজতে শুরু করে। সারা ক্লাসের ছাত্ররা হাততালি আর হতবাক বিস্ময়ে মুখরিত হয়ে উঠে।

.

Done page 411 ১১২ অধ্যায়

ক্যাথরিন সলোমন জ্ঞান হারাবার দ্বার প্রান্তে টলমল করছে এমন সময়ে বিস্ফোরণের শব্দে সে কেঁপে উঠে।

কিছুক্ষণ পরে সে ধোয়ার গন্ধ পায়।

তার কান ভো ভো করছে।

চাপা কণ্ঠস্বর দূর থেকে ভেসে আসে। চিৎকার শোনা যায়। পায়ের শব্দ। সহসা সে পরিষ্কার করে শ্বাস নিতে থাকে। তার মুখ থেকে কাপড়টা টেনে বের করে নিয়েছে।

তুমি এখন নিরাপদ, একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে তাকে বলে। একটু ধৈৰ্য্য ধর।

সে আশা করে লোকটা তার হাত থেকে নিডলটা বের করবে কিন্তু তার বদলে সে আদেশ দিতে থাকে। মেডিকেল কিট নিয়ে আস…নিডলের সাথে আইভি দাও…ল্যাকটেটেড রিঙগারস সলোউশনস মিশাও…আমাকে ব্লাড প্রেশার পরিমাপক দাও। লোকটা তার ভাইটাল সাইন পরীক্ষা শুরু করে সে জিজ্ঞেস করে, মিসসলোমন যে লোকটা তোমার সাথে এসব করেছে…সে

কোথায় গেছে?

ক্যাথরিন কথা বলতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।

মিস.সলোমন? কণ্ঠস্বরটা আবার প্রশ্নটা করে। সে কোথায় গিয়েছে?

সে চোখ খুলে রাখতে চেষ্টা করে কিন্তু টের পায় সে জ্ঞান হারাতে যাচ্ছে।

আমাদের জন্য জানাটা জরুরী সে কোথায় গিয়েছে, লোকটা কণ্ঠে মিনতির সুর।

ক্যাথরিন কেবল তিনটা শব্দ ফিসফিস করে বলতে পারে, যদিও সে জানে সেগুলোর কোন অর্থ হয় না। পবিত্র…পাহাড়ের…পাদদেশে।

.

সাটো দুমড়ে যাওয়া দরজা অতিক্রম করে কাঠের র‍্যাম্প দিয়ে নিচে নেমে আসে। একজন এজেন্ট তাকে দেখে এগিয়ে যায়।

ডিরেকটর আমার মনে হয় এটা আপনার দেখা উচিত।

সংকীর্ণ হলওয়ে দিয়ে সে তাকে অনুসরণ করে একটা ঘরে প্রবেশ করে। ঘরটা উজ্জ্বলভাবে আলোকিত এবং খালি কেবল মেঝেতে কাপড়ের একটা স্তূপ পড়ে আছে। সাটো ল্যাংডনের লোফার আর টুইডের কোট চিনতে পারে।

লোকটা এবার দূরের দেয়ালে রাখা একটা শবাধারের মত কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে।

এটা আবার কিসের আলামত?

সাটো এবার সেদিকে এগিয়ে যেতে দেখে দেয়াল থেকে একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের পাইপ এসে বাক্সটায় প্রবেশ করেছে। উদ্বিগ্নচিত্তে সে বাক্সটার দিকে এগিয়ে আসে। সে এবার বাক্সের উপরে একটা ছোট স্লাইড দেখতে পায়। সে ঝুঁকে সেটা একপাশে সরিয়ে দিলে একটা ছোট জানালার মত জায়গা উন্মুক্ত হয়।

সাটো আতঙ্কে গুটিয়ে যায়।

প্লেক্সিগ্নাসের নীচে…প্রফেসর ল্যাংডনের ডুবন্ত, ভাবলেশহীন মুখ ভেসে আছে।

.

আলো!

যে অনন্ত শূন্যতায় ল্যাংডন মহানন্দে ভেসে বেড়াচ্ছিল সেখানে হঠাৎ এক চোখ ধাঁধান সূর্যের আবির্ভাব হয়। সাদা আলোর ঝলকানি অন্ধকার স্থান দখল করে তার মনকে জ্বালাতে শুরু করে।

আলোটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

সহসা উজ্জ্বল মেঘের আড়াল থেকে একটা সুন্দর মুখের আভাস দেখা যায়। একটা মুখ…ঝাঁপসা আর অস্পষ্ট…শূন্যতার অন্যপ্রান্ত থেকে দুটো চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলোর ধারা মুখটাকে ঘিরে রয়েছে, ল্যাংডন ভাবে এটাই কি তবে ঈশ্বরের মুখ।

.

সাটো ট্যাঙ্কের ভিতরে তাকায়, ভাবে প্রফেসরের কি বিন্দুমাত্র ধারণা আছে কি ঘটেছে। তার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিশেষ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এই পুরো প্রক্রিয়াটার মূল উদ্দেশ্য।

পঞ্চাশের দশক থেকেই অনুভূতি বিবর্জিত ট্যাঙ্ক প্রচলিত আছে এবং আজও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের নতুন যুগের গবেষণার জনপ্রিয় অনুষঙ্গ। ভাসমান বলে একে চিহ্নিত করা হয়, যা সর্বগ্রাসী মাতৃজঠরের অনুভূতি প্রদান করে…একধরণের। ধ্যান যা মস্তিষ্কের সবধরণের অনুভূতির উপযোগ-আলো, শব্দ, স্পর্শ, এমন কি মাধ্যাকর্ষণের টান নাকচ করে তাকে শান্ত করে। প্রচলিত ট্যাঙ্কে মানুষ প্রচণ্ড ভাসমান ক্ষমতার লবণাক্ত দ্রবণে পিঠ দিয়ে ভেসে থাকে যাতে সে শ্বাস নিতে পারে।

সম্প্রতি এসব ট্যাঙ্কের প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।

নতুন এই প্রযুক্তির নাম- টোটাল লিকুইড ভেন্টিলেশন-যা এতটাই বিস্ময়কর যে অনেক বিশ্বাস করে না এর অস্তিত্ব আছে।

শ্বাসযোগ্য তরল।

১৯৬৬ সাল থেকে শ্বাসযোগ্য তরল একটা বাস্তবতা, যখন লিল্যাণ্ড সি.ক্লার্ক সাফল্যের সাথে অক্সিজেনেটেড পারফ্লুরোকার্বনের দ্রবণে একটা ইঁদুর কয়েক ঘন্টা বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হন। ১৯৮৯ সালে দি এ্যাবিস ছবিতে টিএলভি প্রযুক্তি নাটকীয় উপস্থিতি দেখা যায় যদিও খুব কম দর্শকই বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি পর্দায় দেখেছেন।

টিএলভি প্রিম্যাচিউর বাচ্চাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবদান যেখানে তাদের তরল পূর্ণ মাতৃজঠরের একটা পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়া হয়। গর্ভাশয়ে নয়মাস কাটাবার পরে মানুষের ফুসফুস তরল পূর্ণ। অবস্থার সাথে মোটেই অপরিচিত না। পারফ্লুরোকার্বন একটা সময়ে শ্বাস নেবার জন্য যথেষ্ট আঠাল বলে বিবেচিত হত কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি তাকে প্রায় পানির মত শ্বাসযোগ্য তরলে রূপান্তরিত করেছে।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর নেভীর ডুবুরিরা হেলিঅক্স বা ট্রাইমিক্স ব্যবহার না করে এটা ব্যবহার করে যা তাদের চাপজনিত অসুস্থতার ঝুঁকি ছাড়াই অনেকক্ষণ নীচে কাজ করার সুবিধা দিয়েছে। নাসা বা বিমান বাহিনীও দেখেছে টিএলভি উচ্চতর জি ফোর্সে অক্সিজেনের চেয়ে অনেক সহজে বিভিন্ন অগানে ছড়িয়ে যেতে পারে। সাটো শুনেছিল অনেক অনেক চরম অভিজ্ঞতার ল্যাবর কথা। শুনেছিল যেখানে মানুষ এই টিএলভি ট্যাঙ্কের অভিজ্ঞতা নিতে পারে- তারা অবশ্য একে বলে মেডিটেশন মেশিন। এই মেশিনটাও সম্ভবত মালিকের ব্যক্তিগত ব্যবহারে স্থাপন করা হয়েছিল কিন্তু বাইরে ছিটকিনির বাহুল্য দেখে সে বুঝতে পারে আরও অনেক ভীতিকর লক্ষ্যেও এটা ব্যবহৃত হয়ে থাকবে…সিআইএ যেমন জেরার জন্য এটা ব্যবহার করে থাকে।

কুখ্যাত জল চিকিৎসা জেরার ক্ষেত্রে কাজে দেয় কারণ ভুক্তভোগী মনে করে সে আসলেই ডুবতে বসেছে। ভুক্তভোগী কখনও বুঝতে পারে না সে যা শ্বাস নিচ্ছে সেটা পানির চেয়ে আঠাল একটা দ্রবণ ফলে ফুসফুঁসে এটা প্রবেশ করলে সে প্রায়ই ভয়ে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেলে চরম একাকিত্বে নিজেকে আবিষ্কার করে।

রিনক্ষীয় অবশকারী দ্রব্য, প্যারালাইসিস ড্রাগস আর হ্যালুসিনজেনস উষ্ণ অক্সিজেনের সাথে ব্যবহার করে বন্দিকে ধারণা দেয়া হয় তার আত্মা দেহ থেকে মুক্তি পেয়েছে। তার মস্তিষ্ক অঙ্গপ্রতঙ্গ সঞ্চালনের আদেশ দিলে কিছুই ঘটে না। মৃত্যু অবস্থার এই পর্যায় ভয়ঙ্কর তার চেয়েও ভয়ঙ্কর পুনজন্মের প্রক্রিয়া যা তীব্র আলো, শব্দ আর ঠাণ্ডা বাতাসের সাহায্যে দেয়া হয় যা প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক আর বিপর্যস্তকারী বলে প্রতিয়মান হতে পারে। কয়েকবার মৃত্যু আর পুনজন্মের প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যাবার পরে জেরার সম্মুখীন হওয়া ব্যক্তির মনে থাকে না সে বেঁচে আছে না মারা গেছে ফলে সে জেরাকারীর সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। সাটো ভাবে মেডিক্যাল টিমের জন্য সে অপেক্ষা করবে কিনা কিন্তু সে জানে তার হাতে সময় কম। আমার জানতে হবে সে কি জানে।

আলো জ্বালো আর আমাকে কয়েকটা কম্বল এনে দাও।

.

সূর্য উবে গেছে।

মুখটাও দেখা যায় না।

অন্ধকার ফিরে এসেছে আর ল্যাংডন আলোকবর্ষ দূরের শূন্যতার প্রান্ত থেকে আগত ফিসফিস গুঞ্জন শুনতে পায়। চাপা কণ্ঠস্বর…দুর্বোধ্য শব্দ। এখন আবার ঝাঁকি শুরু হয়েছে…যেন পৃথিবী ভেঙে খান খান হয়ে যাবে।

তারপরে সেটা ঘটে।

কোন জানান না দিয়ে বিশ্ব দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। একটা অতিকায় ফাটল শূন্যস্থানে দেখা দেয়…যেন শূন্যস্থান জোড়া দেয়ার স্থান থেকে ছিঁড়ে এসেছে। একটা ধূসর ধোয়া ফাঁকা জায়গা দিয়ে প্রবেশ করে এবং ল্যাংডন একটা ভীতিকর দৃশ্য দেখতে পায়। দেহহীন একজোড়া হাত কোথা থেকে উদিত হয়। তাকে ধরে এবং তার পৃথিবী থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।

না! সে তাদের বাধা দিতে চায় কিন্তু দেখে তার নিজের কোন হাত নেই…পাঞ্জা নেই। নাকি তার আছে? সহসা সে তার শরীরকে নিজের চারপাশে যেন ভূমিষ্ট হতে দেখে। তার মাংস পেশী ফিরে আসে এবং সেটাকে একজোড়া শক্তিশালী হাত আঁকড়ে ধরে উপরের দিকে টানে। না! দয়া কর।

কিন্তু দেরী হয়ে গেছে।

যন্ত্রণায় তার বুক বিদীর্ণ হয় হাত জোড়া তাকে ফাঁকা স্থান দিয়ে উপরে টেনে আনতে। তার ফুসফুঁসে বুঝি কেউ বালি ভরে দিয়েছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না! সে সহসা চিন্তার অতীত শক্ত শীতল একটা কিছুর উপরে নিজেকে আবিষ্কার করে। কেউ তার বুকে বারবার চাপ দিতে থাকে, জোরে এবং যন্ত্রণাদায়ক ভঙ্গিতে। সে উষ্ণতা বমি করে।

আমি ফিরে যেতে চাই।

তার মনে হয় সে সদ্য মাতৃজঠর থেকে জন্ম নেয়া শিশু।

সে কাশতে থাকে কাশির দমকে তরল উগড়ে দেয়। সে বুকে আর ঘাড়ে অসম্ভব ব্যথা অনুভব করে। তার গলায় যেন আগুন জ্বলছে। মানুষ তার চারপাশে কথা বলে ফিসফিস করে কিন্তু সবই কর্ণবিদারী। তার দৃষ্টি ঝাঁপসা আর সে কেবল শব্দহীন অবয়ব দেখতে পায়। তার ত্বক অবশ অনেকটা মৃত চামড়ার মত।

তার বুক আগের চেয়ে ভারী মনে হয়…চাপ। আমি শ্বাস নিতে পারছি!

সে আরও তরল উগরে দেয়। একটা অচিন্তনীয় কণ্ঠরোধী প্রতিক্রিয়া তাকে আক্রমণ করে এবং সে ভেতরের দিকে খাবি খায়। শীতল বাতাস অবশেষে ফুসফুঁসে প্রবেশ করে এবং সে সদ্যজাত নবজাতকের মত পৃথিবীর বাতাসে প্রথম নিঃশ্বাস নেয়। এই পৃথিবীটা বড্ড যন্ত্রণাদায়ক।

ল্যাংডন আবার সেই মাতৃজঠরে ফিরে যেতে চায়।

.

রবার্ট ল্যাংডনের কোন ধারণা নেই কতক্ষণ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। সে কেবল বুঝতে পারে কম্বল আর ভোয়ালে মোড়া অবস্থায় সে শক্ত মেঝের উপরে শুয়ে আছে। একটা পরিচিত মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে…আলোর সেই উজ্জ্বল ধারা উধাও হয়েছে। দূরাগত শ্লোকের ধ্বনি তার মাথায় এখনও গুঞ্জরিত হয়।

ভারবাম সিগনিফিকেটাম…ভারবাম ওমনিফিকাম….

প্রফেসর ল্যাংডন, কেউ ফিসফিস করে বলে। তুমি বুঝতে পারছে কোথায় আছো?

ল্যাংডন কাশতে কাশতে দূর্বলভাবে মাথা নাড়ে।

তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এইমাত্র তার মনে পড়েছে আজ রাতে কি ঘটছে।

.

১১৩ অধ্যায়

কম্বলে মোড়ান অবস্থায় দাঁড়িয়ে মুরগীর বাচ্চার মত টলমল পায়ে সে তরল পূর্ণ ট্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আবার তার শরীর ফিরে পেয়েছে অবশ্য ফিরে na পেলেই বোধহয় সে খুশী হত। তার গলা আর বুক জ্বলে যায়। এই পৃথিবী তার কাছে নিষ্ঠুর আর নির্মম মনে হয়।

সাটো তাকে অনুভূতি বিবর্জিত ট্যাঙ্কের বর্ণনা দিয়েছে, এবং বলেছে সে তাকে টেনে বের না করলে সে অন্নের অভাবে মারা যেত বা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটত। ল্যাংডনের সন্দেহ নেই পিটারও এই অত্যাচার সহ্য করেছে। পিটার এখন দুইয়ের মাঝে অবস্থান করছে উল্কি আঁকা লোকটা তাকে আজ রাত শুরুর সময়ে বলেছিল। পিটার যদি এমন জন্ম অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে একাধিকবার অতিক্রম করে তবে অবাক হবার কিছু নেই যদি সে তাকে বন্দিকর্তা যা জানতে চেয়েছে সব বলে দেয়।

সাটো ইশারায় ল্যাংডনকে অনুসরণ করতে বলে এবং সে ধীরে হেচড়ে হেচড়ে একটা সরু হল দিয়ে এই আজব স্থানের গভীরে এগিয়ে যায় যা সে প্রথমবারের মত দেখছে। তারা পাথরের টেবিল রয়েছে এমন একটা ঘরে প্রবেশ করে যেখানে আতঙ্কজনক রহস্যময় আলো জ্বলছে। ক্যাথরিনকে সেখানে দেখে ল্যাংডন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যদিও দৃশ্যটা রীতিমত উদ্বেগজনক।

ক্যাথরিন পাথরের টেবিলের উপরে শুয়ে আছে রক্তে ভেজা তোয়ালে মেঝেতে পরে আছে। এক সিআইএ এজেন্ট তার বাহুর সাথে আটকানো টিউবে যুক্ত আইভি ব্যাগ ধরে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

সে নিরবে কাঁদছে।

ক্যাথরিন? ল্যাংডন ফ্যাসফেসে কণ্ঠে বলে, কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে।

সে তার দিকে তাকায় তার দৃষ্টিতে বিভ্রান্তি আর অচেনার অভিব্যক্তি। রবার্ট?

তার চোখ অবিশ্বাস পরে আনন্দে বড় হয়ে উঠে। কিন্তু আমি তোমাকে…পানিতে ডুবতে দেখেছি!

সে পাথরের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসে।

ক্যাথরিন আইভি টিউব বা মেডিক্যাল অফিসারের নিষেধের তোয়াক্কা না। করে উঠে বসে। ল্যাংডন টেবিলের কাছে আসতে সে তার কম্বলে মোড়ান দেহটা আঁকড়ে ধরে কাছে টেনে আনে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সে ফিসফিস করে বলে তার গালে চুমো দেয়। তারপরে কি মনে হতে আবার চুমো দেয় এবার আবেগ নিয়ে ঠোঁটে এবং তাকে সজোরে আঁকড়ে ধরে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না সে আসলেও সত্যি কেউ। আমি বুঝতে পারছি না…কিভাবে…

সাটো অনুভূতি বিবর্জিত ট্যাঙ্ক আর অক্সিজেনেটেড পারফ্লুরোকার্বণের ব্যাখ্যা করে কিন্তু ক্যাথরিনের কানে সেসব পৌঁছে না। সে কেবল ল্যাংডনকে আঁকড়ে ধরে থাকে।

রবার্ট, সে বলে, পিটার বেঁচে আছে। পিটারের সাথে ভয়ঙ্কর সাক্ষাতের কথা মনে পড়তে সে এখনও কেঁপে উঠে। সে পিটারের শারিরীক অবস্থা বর্ণনা করে- হুইলচেয়ার, আজব চাকু, বলিদানের পরোক্ষ উল্লেখ এবং কিভাবে তাকে মানবিক বালিঘড়িতে পরিণত করেছে পিটারকে সহযোগিতা করতে দ্রুত রাজি করাতে।

ল্যাংডন কথা খুঁজে পায় না। তোমার কোন ধারণা…আছে…তারা কোথায় গিয়েছে?!

সে পিটারকে কোন পবিত্র পাহাড়ে নিয়ে যাবে বলে গেছে।

ল্যাংডন তার আলিঙ্গন থেকে সরে এসে তার মুখের দিকে তাকায়।

ক্যাথরিনের চোখ অশ্রুসজল। সে বলেছে পিরামিডের গ্রিড সে সমাধান করেছে আর সেটা তাকে পবিত্র পাহাড়ে যেতে বলেছে।

প্রফেসর, সাটো তাড়া দেয়, আপনি কি এর মানে কিছু বুঝতে পারছেন?

ল্যাংডন অপারগতায় মাথা নাড়ে। একেবারেই না। কিন্তু তারপরেও সে আশার আলো দেখে। সে যদি পিরামিডের তলদেশে তথ্য পেয়ে থাকে তবে আমরাও পার। আমিই তাকে বলেছি কিভাবে সেটা সমাধান করতে হবে।

সাটো মাথা নাড়ে। পিরামিডটা নেই। আমরা খুঁজে দেখেছি। সে সাথে করে নিয়ে গেছে।

ল্যাংডন এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, চোখ বন্ধ করে পিরামিডের পাদদেশে কি দেখেছিল মনে করতে চেষ্টা করে। ডুবে যাবার আগে প্রতাঁকের গ্রিডটা তার। শেষ দেখা স্মৃতি আর ট্রমা স্মৃতিকে মনের গভীরে স্থায়ীত্ব দিয়ে থাকে। সে গ্রিডটা মনে করতে পারে পুরোটা হলেও অনেকটাই, যা হয়ত তাদের সহায়তা করবে।

সে সাটোর দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে বলে কিন্তু ইন্টারনেটে আমাকে একটা জিনিস খুঁজে দেখতে হবে।

সাটো বিনা বাক্য ব্যয়ে ব্ল্যাকবেরী বের করে।

আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার লিখে সার্চ দাও।

সাটো বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে টাইপ শুরু করে।

ল্যাংডনের দৃষ্টি এখনও ঝাঁপসা এবং এবার সে তার চারপাশে বিচিত্র পরিবেশের দিকে তাকায়। সে দেখে যে টেবিলে তার ঝুঁকে আছে তাতে অনেক পুরানো রক্তের দাগ লেগে আছে তাদের ডান পাশের দেয়ালে অনেক টেক্সট, ছবি আর ড্রয়িং, ম্যাপ দিয়ে ভর্তি সেগুলো আবার পরস্পর সূততা দিয়ে সংযুক্ত।

হায় ঈশ্বর।

ল্যাংডন অদ্ভুত কোলাজটার দিকে এগিয়ে আসে এখন সে কম্বল গায়ে দিয়ে আছে। দেয়ালে উদ্ভট তথ্যের একটা সংগ্রহ- প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে ছেঁড়া কাগজ যেখানে কালো জাদু থেকে বাইবেলের পাতা আছে, প্রতীক আর সিজিলসের ড্রয়িং পাতার পর পাতা ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের ওয়েব সাইট, এবং ওয়াশিংটন ডি.সির স্যাটেলাইট ছবি নোট আর প্রশ্নবোধক চিহ্নে ভরা। একটা। পাতায় বিভিন্ন ভাষার অনেক শব্দের একটা তালিকা। সে কিছু গোপন ম্যাসনিক শব্দ বলে চিনতে পারে বাকিগুলো প্রাচীন ডাকিনী বিদ্যর কিছু শব্দ যজ্ঞে ব্যবহৃত হয়।

সে কি এটার সন্ধান করছে?

একটা শব্দ?

এটা কি আসলেও এত সহজ?

ল্যাংডন ম্যাসনিক পিরামিড সম্পর্কে এতদিনে সংশয় একটা বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যা হল- এর সম্পর্কে কথিত কিংবদন্তি যে এটা প্রাচীন রহস্যময়তার অবস্থান নির্দেশ করে। যার আবিষ্কারের সাথে ভল্ট জাতীয় কিছুর যোগাযোগ থাকতে হবে যেখানে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রন্থাগারে রক্ষিত পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে যা এতদিন সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। যা এক কথায় অসম্ভব। এতবড় ভল্ট ডি.সির নীচে?

এখন এইসব ম্যাজিক শব্দের সাথে ফিলিপ এক্সটারে পিটারের প্রদত্ত বক্তৃতা আরো একটা চমকপ্রদ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করেছে।

ল্যাংডন নিজে ডাকিনী শব্দের শক্তিতে বিশ্বাস করে না…কিন্তু বোঝাই যায় উল্কি আঁকা লোকটা তা করে। সে আবার দেয়ালে লেখা নোটগুলো খুটিয়ে দেখতে তার নাড়ীর গতি বৃদ্ধি পায়।

একটা ধারণাই সেখানে বারবার ঘুরে এসেছে।

খোদা, সে ভারবাম সিগনিফিকেটিয়াম খুঁজছে…হারিয়ে যাওয়া শব্দ। ল্যাংডন ভাবনাটা গুছিয়ে নেয়, পিটারের বক্তৃতা স্মরণ করে। সে তাহলে সত্যিই হারিয়ে যাওয়া শব্দটা খুঁজছে! যা সে বিশ্বাস করে এখানে এই ওয়াশিংটন ডি.সিতে প্রোথিত আছে।

সাটো তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তুমি কি এটা দেখতে চেয়েছো? ব্ল্যাকবেরী তার হাতে দিয়ে সে বলে।

ল্যাংডন আট-বাই-আটের সংখ্যার গ্রিডটা দেখে। ঠিক তাই, সে একটা কাগজ মেঝে থেকে তুলে নেয়। একটা কলম।

সাটো পকেট থেকে কলম বের করে বলে, দ্রুত কর।

.

ডিরেক্টরের অফিসের বেসমেন্টে বসে নোলারিক পারিসের আনা সম্পাদিত ডকুমেন্টটা দেখে। সিআইএ ডিরেকটর প্রাচীন পিরামিড আর গোপন ভূগর্ভস্থ অবস্থানের ফাইল নিয়ে কি করতে চাইছে?

সে ফোন খুলে একটা নম্বর ডায়াল করে।

সাটো সাথে সাথে উত্তর দেয়, তার গলার স্বরে উৎকণ্ঠা। নোলা, আমিই তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।

আমার কাছে নতুন তথ্য আছে, নোলা বলে। আমি জানি না ব্যাপারটা প্রাসঙ্গিক কিনা কিন্তু একটা সম্পাদিত ফাইল-

জাহান্নামে যাক ফাইল, সাটো তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে। আমাদের হাতে সময় একেবারেই নেই। আমরা এখন টার্গেটকে গ্রেফতার করতে পারিনি এবং আমার বিশ্বাস সে যে হুমকি দিয়েছে সেটা সে ঠিকই পালন করবে।

নোলার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

সুসংবাদ হল আমরা এখন জানি সে কোথায় যাচ্ছে। সাটো একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়। দুঃসংবাদ হল তার সাথে একটা ল্যাপটপ রয়েছে।

.

১১৪ অধ্যায়

দশ মাইলেরও কম দূরত্বে, মাল’আখ একটা বিশাল ভবনের ছায়ায় কম্বল দিয়ে জড়িয়ে পিটার সলোমনকে হুইলচেয়ারে করে চাঁদের আলোয় আলোকিত পার্কিং লট দিয়ে নিয়ে যায়। ভবনটার বাইরে ঠিক তেত্রিশটা কলাম রয়েছে…প্রতিটা তেত্রিশ ফিট উঁচু। পর্বতপ্রমাণ ভবনটা রাতের এই মুহূর্তে জনশূন্য আর এখানে কারো দেখার প্রশ্নই উঠে না। দেখলেও কোন ব্যাপার না। দূর থেকে দয়ালু চেহারার লম্বা কালো কোট পরিহিত একজন লোককে ন্যাড়া মাথার পঙ্গু এক। লোককে হুইলচেয়ারে সান্ধ্যভ্রমণে বেরোতে দেখে দ্বিতীয়বার কেউ ফিরে তাকাবে না।

তারা পেছনের প্রবেশ পথের কাছে পৌঁছালে মাল’আখ পিটারকে সিকিউরিটি কিপ্যাডের কাছে নিয়ে আসে। পিটার উদ্ধত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে বোঝা যায় কোড এন্টারের কোন অভিপ্রায় তার নেই।

মাল’আখ হাসে। তোমার ধারণা তোমার দয়ায় আমাকে এখানে প্রবেশ করতে হবে? তুমি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে আমি তোমার একজন গুরুভাই? তেত্রিশ ডিগ্রীতে তার দীক্ষার পরে তাকে দেয়া অ্যাকসেস কোড সে টাইপ করে।

ভারী দরজাটা মৃদু শব্দে খুলে যায়।

পিটার গুঙিয়ে উঠে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করে।

পিটার, পিটার, মাল’আখ তাকে প্রবোধ দেয়। ক্যাথরিনের কথা কল্পনা কর। সহযোগিতা কর তাহলে সে প্রাণে বাঁচবে। তুমি তাকে বাঁচাতে পারো। আমি তোমাকে কথা দিলাম।

মাল’আখ তাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা আটকে দেয়, তার হৃৎপিণ্ড এবার উত্তেজনায় দ্রুত স্পন্দিত হয়। সে পিটারকে নিয়ে হলওয়ে অতিক্রম করে এলিভেটরে উঠার বোম চাপ দেয়। তারপরে সে কি করছে সেটা যেন পিটার। দেখতে পায় সে জন্য সে একপাশে সরে এসে তাকে দেখিয়ে লিফটের সর্বোচ্চ বোতামে চাপ দেয়।

পিটারের নির্যাতিত মুখে গাঢ় ভয়ের একটা ছায়া খেলা করে।

শশশ…এলিভেটরের দরজা বন্ধ হতে সে পিটারের কামানো মাথায়। আলতো চাপড় দিয়ে বলে। তুমি ভাল করেই জানো…রহস্যটা হল কিভাবে মারা যেতে হয়।

.

আমার সবগুলো প্রতীক মনে নেই!

ল্যাংডন চোখ বন্ধ করে পিরামিডের তলদেশের প্রতীকগুলোর সঠিক অবস্থা মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু তার শ্রুতিধর স্মৃতিও স্মরণ করতে ব্যর্থ হয়। সে যে কয়টা প্রতীক মনে পড়ে সে কয়টা ফ্রাঙ্কলিনের ম্যাজিক বর্গ অনুসারে সাজায়।

এখন পর্যন্ত সে অর্থবোধক কিছু দেখতে পায়নি।

প্রথম সারিতে কেবল গ্রীক অক্ষর
দেখো! ক্যাথরিন ব্যগ্র কণ্ঠে বলে। তোমার স্মৃতি ঠিকই সাহায্য করছে। প্রথম সারিতে কেবল গ্রীক অক্ষর-একই ধরণের প্রতীক একসাথে বিন্যস্ত রয়েছে!

ব্যাপারটা ল্যাংডনও খেয়াল করেছে কিন্তু এই বিন্যাস আর অক্ষরের সাথে খাপ খায় এমন গ্রীক শব্দ তার মনে পড়ছে না। আমার প্রথম অক্ষরটা প্রয়োজন। সে ম্যাজিক বর্গটার দিকে তাকিয়ে বামদিকের নীচের কোনের শব্দটা মনে করতে চেষ্টা করে। ভাববা! সে চোখ বন্ধ করে পিরামিডের তলদেশটা দেখতে চেষ্টা করে। নীচের সারি…বাম দিকের প্রথম অক্ষর…কি অক্ষর সেটা?

মুহূর্তের জন্য ল্যাংডন ট্যাঙ্কে ফিরে যায়, আতঙ্কিত হয়ে প্লেক্সিগ্নাসের ভিতর দিয়ে পিরামিডের তলদেশের দিকে তাকিয়ে আছে।

সহসা সে দেখতে পায়। সে চোখ খুলে ভারী শব্দে শ্বাস নেয়। প্রথম অক্ষরটা এইচ!

ল্যাংডন গ্রিডের দিকে ফিরে প্রথম অক্ষরটা লিখে। শব্দটা এখনও অসম্পূর্ণ কিন্তু সে অনেকটাই দেখেছে। সে এবার বুঝতে পারে শব্দটা কি হতে পারে।

Ηερδομ

ধকধক করতে থাকা নাড়ীর স্পন্দন নিয়ে ল্যাংডন আরেকটা শব্দ ব্ল্যাকবেরীতে লিখে সার্চ দেয়। সে এই পরিচিত গ্রীক শব্দে ইংলিশ প্রতিশব্দ ব্যবহার করে। প্রথমটা একটা বিশ্বকোষ জাতীয় এন্ট্রি সে পুরোটা পড়ে বুঝতে পারে ঠিক আছে।

HEREDOM n. a significant word in high degree Freemasonry, from French Rose Croix rituals, where it refers to a mythical mountain in Scotland, the legendary site of the first such Chapter. From the Greek Ηερδομ originating from Hieros-domos, Greek for Holy House.

পেয়েছি, অবিশ্বাসের কণ্ঠে ল্যাংডন বলে। তারা এখানেই গেছে।

সাটো তার কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে ছিল সে বেকুবের মত তাকায়। স্কটল্যাণ্ডের কোন পৌরাণিক পাহাড়ে?!

ল্যাংডন মাথা নাড়ে। না, একটা ওয়াশিংটনে অবস্থিত একটা ভবন যার সাঙ্কেতিক নাম Heredom.

.

১১৫ অধ্যায়

দি হাউজ অব দি টেম্পল- গুরুভাইরা একে হেরেডোম বলে- আমেরিকার ম্যাসনিক স্কটিশ রাইটের মধ্যমণি হিসাবে বিরাজ করেছে।

পিরামিডের মত খাড়া, ঢালু ছাদের এই ভবনটার নামকরণ স্কটল্যাণ্ডের একটা কাল্পনিক পাহাড়ের নামে করা হয়েছে। মাল’আখ অবশ্য জানে এখানে লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন মোটেই কাল্পনিক না।

এটাই সেই স্থান, সে জানে। মাসনিক পিরামিড পথ দেখিয়েছে।

বুড়ো এলিভেটর তৃতীয় তলায় উঠে আসতে মাল’আখ একটা কাগজ বের করে যাতে সে ফ্রাঙ্কলিনের ম্যাজিক বর্গ ব্যবহার করে প্রতীকগুলো নতুন করে সাজিয়েছে। সব গ্রীক অক্ষর এখন প্রথম সারিতে স্থানান্তরিত হয়েছে, সাথে একটা সাথে একটা মামুলি প্রতীক।

The-Lost-Symbol-115
বাণীটা এর চেয়ে প্রাঞ্জল হওয়া সম্ভব না।

হাউজ অব টেম্পলের নীচে।

হেরেডোম

হারিয়ে যাওয়া শব্দ এখানেই …কোথাও আছে।

মাল’আখ যদিও সেটা নির্ণয়ের কোন উপায় জানে না, সে নিশ্চিত গ্রিডের বাকী প্রতাঁকের ভেতর সেটা জানা যাবে। সুবিধা হল, ম্যাসনিক পিরামিড আর এই ভবনের রহস্য সমাধানে পিটার সলোমনের চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই। প্রধান পুরোহিত নিজে।

পিটার হুইল চেয়ারে বসে মোচড়াতে আর অব্যক্ত আওয়াজ করা অব্যহত রাখে।

আমি জানি তুমি ক্যাথরিনের জন্য দুশ্চিন্তা করছো, মাল’আখ বলে। আমাদের কাজও এখানে প্রায় শেষ।

মাল’আখের কাছে মনে হয় সমাপ্তিটা সহসা এসে হাজির হয়েছে। বহু বছরের পরিকল্পনা আর যন্ত্রণা, অপেক্ষা আর অনুসন্ধান শেষে…এখন সময় এসেছে।

এলিভেটর থামতে শুরু করলে সহসা উত্তেজনার একটা রাশ এসে তাকে ঘিরে ফেলে।

খাঁচাটা একটা ঝাঁকি খেয়ে থেমে যায়।

ব্রোঞ্জের দরজা পিছলে দুপাশে খুলে যায় এবং মাল’আখ তাদের সামনের দ্যুতিময় চমকপ্রদ চেম্বারের দিকে অপলক তাকিয়ে রয়। বিশাল বর্গাকার কামরাটা প্রতীক দিয়ে সজ্জিত এবং চাঁদের আলোয় ভাসছে যা উঁচুতে অবস্থিত ছাদের শীর্ষে স্থাপিত গবাক্ষের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করেছে।

আমি পুরো বৃত্ত সম্পূর্ণ করেছি, মাল’আখ ভাবে।

টেম্পল রুমেই পিটার সলোমন আর তার গুরুভাইয়েরা আহাম্মকের মত তাকে তাদের একজন হিসাবে অভিষিক্ত করেছিল। এখন ম্যাসনদের সবচেয়ে নাজুক রহস্য- অনেক গুরুভাই যার অস্তিত্ব আছে বলেই বিশ্বাস করে না। তার অবগুণ্ঠন খুলে প্রকাশিত হতে চলেছে।

.

সে কিছু খুঁজে পাবে না। সাটোর পেছন পেছন কাঠের র‍্যাম্প দিয়ে উঠে আসবার সময়ে ল্যাংডন বলে। আসলে তেমন কোন শব্দ নেই। পুরোটাই একটা রূপকল্প-প্রাচীন রহস্যময়তার একটা প্রতীক।

লিভিং রুমে প্রবেশ করার অবসরে ল্যাংডন সাটোকে ব্যাখ্যা করে বোঝয় হারিয়ে যাওয়া শব্দ ফ্রিম্যাসনারীর সবচেয়ে পুরানো প্রতীক- একটা শব্দ প্রাচীন দুর্বোধ্য ভাষায় লিখিত যা আজ মানুষ চর্চার অভাবে ভুলে গেছে। শব্দটা হারিয়ে যাওয়া রহস্যময়তার মত যারা আলোকপ্রাপ্ত এর পাঠোদ্ধারে সক্ষম তাদের অমিত শক্তির অধিকারী হবার প্রতিশ্রুতি দেয়। বলা হয়ে থাকে, ল্যাংডন সিদ্ধান্ত টেনে বলে, তুমি যদি হারিয়ে যাওয়া শব্দ অধিকার আর এর মানে বুঝতে সক্ষম হও…তাহলে প্রাচীন রহস্যময়তা তোমার কাছে পরিষ্কার হবে।

সাটো তার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার বিশ্বাস সে একটা হারিয়ে যাওয়া শব্দ খুঁজছে?

ল্যাংডন স্বীকার করে ব্যাপারটা সামনাসামনি ভাবতে হাস্যকর মনে হচ্ছে কিন্তু তারপরেও অনেক প্রশ্নের উত্তর এতে রয়েছে। দেখো আমি বলিদান বা পূজা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ নই, সে বলে, কিন্তু তার বেসমেন্টের দেয়ালের নথি দেখে…আর ক্যাথরিনের বর্ণনা অনুযায়ী তার খুলির উল্কিহীন অংশের কথা বিবেচনা করে …আমি বলতে পারি সে হারিয়ে যাওয়া শব্দ খুঁজে বের করে সেটা মাথার ফাঁকা স্থানে উল্কি করবে।

ল্যাংডন জোরে জোরে কথা বলতে থাকে। লোকটা যদি সত্যিই বিশ্বাস করে সে প্রাচীন রহস্যময়তার শক্তি মুক্ত করতে পারবে তবে হারিয়ে যাওয়া শব্দের চেয়ে শক্তিশালী প্রতীক তার কাছে আর কিছু নেই। সে যদি শব্দটা খুঁজে পেয়ে সেটা তার মাথার চাদিতে- যা নিজেই একটা পবিত্র স্থান- আঁকতে পারে তবে সে নিজেকে পুরোপুরি জারিত আর পূজা অর্চনার দ্বারা প্রস্তুত বলে বিবেচনা করবে…সে থেমে তাকিয়ে দেখে ক্যাথরিন পিটারের ভবিষ্যত নিরাপত্তা আশঙ্কা করে শঙ্কিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

কিন্তু রবার্ট, হেলিকপ্টারের শব্দে তার কণ্ঠস্বর খুবই অস্পষ্ট শোনা যায়। এটা একটা সুসংবাদ, তাই না? সে যদি পিটারকে বলি দেবার আগে মাথায় হারিয়ে যাওয়া শব্দ আঁকতে চায় তাহলে আমাদের হাতে সময় আছে। হারিয়ে যাওয়া শব্দ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সে পিটারকে হত্যা করবে না। আর যদি কোন শব্দ না থাকে…।

ল্যাংডন তার মুখের অভিব্যক্তি আশাবাদী রাখতে চেষ্টা করে। ক্যাথরিনকে এজেন্টদের একজন বসতে চেয়ার এগিয়ে দেয়। দুর্ভাগ্যজনক হল পিটার এখনও ভাবছে তুমি রক্তপাতের ফলে মারা যেতে বসেছে। সে ভাববে তোমাকে। বাচাবার একমাত্র পথ পাগলটাকে সহযোগিতা করা…তাকে হারিয়ে যাওয়া। শব্দ খুঁজতে সহায়তা করা।

তাকে কি? ক্যাথরিন ব্যগ্র কণ্ঠে বলে। শব্দ যদি না থাকে

ক্যাথরিন, ল্যাংডন তার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে। আমি যদি বিশ্বাস করি তুমি মারা যেতে বসেছো, আর কেউ আমাকে প্রতিশ্রুতি দেয় হারিয়ে যাওয়া শব্দ খুঁজে দিলে সে তোমাকে বাঁচাবে আমি তাকে শব্দটা খুঁজে দিতাম- যেকোন একটা শব্দ আর তারপরে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম সে যেন তার প্রতিশ্রুতি রাখে।

ডিরেকটর সাটো, পাশের ঘর থেকে এক এজেন্ট চেঁচিয়ে বলে। আপনি একবার এসে দেখলে ভাল হয়।

সাটো খাবার ঘরে এসে দেখে এক এজেন্ট দোতলার শোবার ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। তার হাতে একটা সোনালী পরচুল। আবার কিসের আলামত?

লোকটা পরচুলা, সে তার হাতে সেটা দিয়ে বলে। ড্রেসিং রুমে পেয়েছি। একটু ভাল করে দেখেন।

সোনালী পরচুলাটা সাটো যেমন মনে করেছিল তার চেয়ে ভারী। ত্বকটা একধরণের জেলে তৈরী বলে মনে হয়। অবাক কাণ্ড নীচের দিকে একটা তার বের হয়ে আছে।

জেল-প্যাক ব্যাটারী যা খুলির আঁকৃতিতে তৈরী, এজেন্ট বলে। যা চুলের ভিতরে লুকান ফাঁইবার অপটিকের পিনপয়েন্ট ক্যামেরায় শক্তি সরবরাহ করে।

কি? সাটো চারপাশে হাতড়ে দেখে শেষে চুলের ভিতরে একটা লেন্স দেখতে পায় সোনালী চুলের ভাজে লুকিয়ে আছে। এর ভেতরে একটা লুকান ক্যামেরা রয়েছে?

ভিডিও ক্যামেরা, এজেন্ট শুধরে দেয়। এই সলিড-স্টেট কার্ডে ফুটেজ ধারণ করে। সে খুলিতে প্রোথিত একটা চারকোণা স্ট্যাম্পের আঁকৃতির ক্ষুদ্র সিলিকনের টুকরোর দিকে ইঙ্গিত করে। সম্ভবত গতি-সংবেদনশীল। জেসাস, সাটো ভাবে। এভাবে তাহলে হারামজাদা কাজটা করেছে।

এই পরিপাটি দর্শন কলারে-প্রস্ফুটিত-ফুল সিক্রেট ক্যামেরা ওএস ডিরেকটর আজ রাতে যে বিপর্যয় মোকাবেলা করছে তাতে মূখ্য ভূমিকা পালন। করেছে। সে এক মুহূর্ত তীব্র দৃষ্টিতে পরচুলাটার দিকে তাকিয়ে থেকে সেটা এজেন্টকে দিয়ে দেয়।

বাসাটা তল্লাশি অব্যহত রাখো, সে বলে। আমি এই লোকটার ব্যাপারে সম্ভাব্য সবকিছু জানতে চাই। আমরা জানি তার ল্যাপটপ পাওয়া যায়নি আর আমি জানতে চাই সে চলমান অবস্থায় কিভাবে সেটা বাইরের জগতের সাথে সংযুক্ত করতে পারে। তার স্টাডি খুঁজে দেখো কোন ম্যানুয়াল কোন কেবল পাওয়া যায় কিনা যা দিয়ে তার হার্ডওয়্যার সম্পর্কে জানা যাবে।

সময় হয়েছে যেতে হবে, সাটো ভাবে, কানে হেলিকপ্টারের ব্লেডের পুরো আস্থার শব্দ ভেসে আসে। সে আবার ডাইনিং রুমে ফিরে আসে যেখানে সিমকিনস বেল্লামিকে হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে নিয়ে আসছে আর তার কাছে জানতে চেষ্টা করছে তাদের টার্গেট যে ভবনে গিয়েছে বলে তারা মনে করছে সেখানে প্রবেশের সম্ভাব্য উপায় সম্বন্ধে।

দি হাউজ অব দি টেম্পল।

সামনের দরজা ভেতর থেকে সীল করা, বেল্লামি বলে, ফ্রাঙ্কলিন পার্কে বেহুদা কাটান সময়ের প্রভাবে এখনও কম্বল গায়ে দিয়ে সে কাঁপছে। ভবনের পেছনের দিক দিয়ে কেবল ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব। আমার কাছে একটা কিপ্যাড আছে সাথে একসেস পিন যা কেবল গুরুভাইয়েরাই জানে।

পিনটা কত, নোট নেবার অবসরে সিমকিনস জানতে চায়।

বেল্লামি দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বসে পড়ে। কাঁপতে থাকা দাঁতের ফাঁক দিয়ে সে এ্যাকসেস কোডটা বলে তারপরে যোগ করে, ঠিকানা হল ১৭৩৩ সিক্সটিন্থ কিন্তু তোমাদের উচিত হবে চালাকি করে পেছন থেকে পার্কিং এলাকায় প্রবেশ করা। খুঁজে বের করা কঠিন কিন্তু

আমি জানি সেটা কোথায় আছে, ল্যাংডন বলে। সেখানে পৌঁছে আমি দেখিয়ে দেব।

সিমকিনস মাথা নেড়ে বলে, প্রফেসর আপনি যাচ্ছেন না এটা সামরিক-

তোমার মাথা আর মুণ্ড, ল্যাংডন ক্ষেপে উঠে। পিটার সেখানে আছে! আর ভবনটা একটা গোলকধাঁধা। কেউ পথ দেখাবার না থাকলে উপরের টেম্পল রুমে পৌঁছাতে তোমাদের দশ মিনিট সময় লাগবে।

সে ঠিকই বলেছে, বেল্লামি সায় দেয়। জায়গাটা একটা ভুলভুলাইয়া। একটা এলিভেটর আছে যেটা পুরানো আর শব্দ করে কিন্তু টেম্পল রুমের পুরো দৃশ্য দেখা যায় এমনভাবে সেটার দরজা খুলে। তোমরা নিরবে পৌঁছাতে চাইলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হবে।

তোমরা পথ খুঁজে পাবে না, ল্যাংডন হুশিয়ারী উচ্চারন করে বলে। পেছনের প্রবেশ পথ থেকে তোমাদের হল অব রিগেলিয়া, হল অব অনার, মাঝের ল্যাণ্ডিং, এ্যাট্রিয়াম, গ্রাণ্ড স্টেয়ার

অনেক হয়েছে, সাটো বলে। প্রফেসর আমাদের সাথে যাবে।

.

১১৬ অধ্যায়

শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মাল’আখ অনুভব করে তার শিরায় একটা নতুন টান জেগেছে, শরীরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে যখন সে পিটারকে হুইল চেয়ারে করে বেদীর দিকে এগিয়ে আসে। আমি প্রবেশের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে এই ভবন ত্যাগ করবো। এখন কেবল শেষ উপকরণটা খুঁজে বের করা বাকি।

ভারবাম সিগনিফিকেটিয়াম, সে নিজেই ফিসফিস করে বলে। ভারবাম ওমনিফিকাম।

মাল’আখ বেদীর সামনে পিটারের হুইলচেয়ারটা থামায় তারপরে ঘুরে এসে পিটারের কোলে উপরে রাখা ল্যাংডনের ব্যাগের চেন খুলে। সে হাত বাড়িয়ে পাথরের পিরামিডটা চাঁদের আলোয় বের করে আনে এবং পিটারকে নীচে খোদাই করা প্রতীকগুলো দেখায়। এতগুলো বছর, সে বিদ্রূপ করে, এবং তুমি জানই না পিরামিড কিভাবে নিজের রহস্য গোপন রেখেছে। মাল’আখ ডিরামিডটা বেদীর এককোণে সাবধানে রেখে আবার ব্যাগের কাছে আসে। আর এই টালিসমান, সোনার শিরোশোভা বের করার ফাঁকে সে বলে, আসলেই প্রতিশ্রুতি অনুসারে বিশৃঙ্খলার মাঝে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছে। সে শিরোশোভাটা পিরামিডের মাথায় স্থাপন করে সরে আসে পিটার যাতে ভাল করে দেখতে পারে। সাবধান, তোমার সিম্বল সম্পূর্ণ হয়েছে।

পিটারের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয় সে কথা বলার বৃথা চেষ্টা করে।

ঈশ্বর দেখেছো তুমি দেখছি আমাকে কিছু বলতে চাইছো, মাল’আখ তার মুখে গোঁজা কাপড়টা বের করে আনে।

পিটার সলোমন কাশে হাঁসফাস করে কথা বলার শক্তি ফিরে পাবার আগে। ক্যাথরিন…

ক্যাথরিনের হাতে সময় অল্প। তাকে বাঁচাতে চাইলে আমার কথা মত কাজ কর। মাল’আখ ভাবে সে হয় এতক্ষণে মারা গেছে বা মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিছু যায় আসে না তাতে। সে ভাগ্যবান ভাইকে বিদায় জানাতে পারা পর্যন্ত জীবিত থেকেছে বলে।

দয়া কর, পিটার অনুনয়ের সুরে বলে, তার কণ্ঠস্বর কর্কশ শোনায়। একটা এ্যাম্বুলেন্স পাঠাও…

আমি তাই করবো। তার আগে আমাকে বল কিভাবে গোপন সিঁড়িটা খুঁজে পাব।

পিটারের অভিব্যক্তিতে অবিশ্বাস ফুটে উঠে। কি?

সিঁড়ি গো। তোমাদের ম্যাসনিক কিংবদন্তিতে বলা সেই সিঁড়ি যা গোপন অবস্থানের কয়েকশ ফিট নীচে নেমে গেছে যেখানে হারিয়ে যাওয়া শব্দ সমাধিস্থ রয়েছে।

পিটারকে এখন আতঙ্কিত দেখায়।

তুমি কিংবদন্তিটা জানো, মাল’আখ সুতা ছাড়ে। একটা গোপন সিঁড়ি যা একটা পাথরের আড়ালে চাপা রয়েছে। সে কেন্দ্রীয় বেদীটা দেখায় যেখানে হিব্রু ভাষায় সোনালী অক্ষরে লেখা আছে: GOD SAID, LET THERE BE LIGHT AND THERE WAS LIGHT. অবশ্যই এটাই সঠিক স্থান। সিঁড়িতে প্রবেশের পথ আমাদের নীচের তলার কোথায় লুকান রয়েছে।

এই ভবনে কোন লুকান সিঁড়ি নেই, আহাম্মক, পিটার মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে নির্ভীক হয়ে উঠে।

মাল’আখ ধৈর্যের সাথে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে এবং উপরের দিকে দেখায়। এই ভবনটা পিরামিড আঁকৃতির। সে চারদিক থেকে বেকে উঠে আসা ছাদের দিকে ইঙ্গিত করে যা শীর্ষের কেন্দ্রে একটা চারকোণা গবাক্ষের সৃষ্টি করেছে।

হ্যাঁ, হাউজ অব টেম্পল একটা পিরামিড কিন্তু তার সাথে।

পিটার আমার হাতে পুরো রাত রয়েছে, মাল’আখ তার নিখুঁত শরীরের উপরে সাদা সিল্কের আলখাল্লার ভাজ ঠিক করতে করতে বলে। ক্যাথরিনের হাতে তা নেই। তুমি যদি তাকে বাঁচাতে চাও তবে আমাকে বল গোপন সিঁড়িটা কোথায় আছে।

আমি ইতিমধ্যে তোমাকে বলেছি, সে ঘোষণা করে, এই ভবনে কোন লুকান সিঁড়ি নেই।

না? সে শান্ত ভঙ্গিতে একটা কাগজ বের করে যার উপরে সে পিরামিডের তলদেশের প্রতীক পুনরায় সাজিয়েছে। এটা ম্যাসনিক পিরামিডের শেষ ধাপ। তোমার বন্ধু রবার্ট ল্যাংডন এটার পাঠোদ্ধারে আমাকে সাহায্য করেছে।

মাল’আখ কাগজটা পিটারের সামনে এনে ধরে। প্রধান পুরোহিত সভয়ে নিঃশ্বাস নেন সামনের কাগজটা দেখে। শুধু যে চৌষট্টিটা প্রতীক পরিষ্কার অর্থবোধক দলে সজ্জিত হয়েছে তাই না, বিশৃঙ্খলার ভিতরে একটা সত্যিকারের ইমেজ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।

সিঁড়ির একটা অবয়ব…পিরামিডের ঠিক নীচে।

.

পিটার সলোমন তার সামনে অবস্থিত প্রতাঁকের গ্রিডটার দিকে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। বহু পুরুষ ধরে ম্যাসনিক পিরামিড এর গোপনীয়তা রক্ষা করে এসেছে। এখন সহসা এর অর্থ প্রকাশিত হতে সে তার পেটে আশঙ্কার একটা শীতল অনুভূতি অনুভব করেন।

পিরামিডের শেষ সঙ্কেত।

এক নজর দেখে পিটারের কাছে এই প্রতীকগুলো সবসময়ে রহস্যময় মনে হয়েছে এবং তারপরেও সে বুঝতে পারে উল্কি আঁকা লোকটা কেন যা বিশ্বাস করেছে সেটাকে সত্যি মনে করে।

সে ভেবেছে হেরেডোম নামে অভিহিত পিরামিডের নীচে একটা গোপন সিঁড়ি আছে।

সে এই প্রতীকগুলোর ভুল অর্থ করেছে।

The-Lost-Symbol-116
কোথায় সেটা? উল্কি আঁকা লোকটা জানতে চায়। আমাকে বলল, কিভাবে সিঁড়িটা খুঁজে পেতে হবে আমি তাহলে ক্যাথরিনকে বাঁচাব।

আমি যদি পারতাম তাহলে করতাম, পিটার ভাবে। কিন্তু সিঁড়িটা বাস্তব না। সিঁড়ির কিংবদন্তি পুরোপুরি প্রতীকি…ম্যাসনারী রূপকের একটা অংশ। প্যাচান সিঁড়ি, যেভাবে এটা পরিচিত, দ্বিতীয় ডিগ্রীর ট্রেসিং বোর্ডে আবির্ভূত হয়। এটা মানুষের দিব্য সত্যের অনুধাবনে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উত্থান বোঝায়। অনেকটা জ্যাকবস ল্যেডারের মত প্যাচান সিঁড়ি স্বর্গের সোপানের প্রতীক…মানুষের ঈশ্বরের অনুসন্ধানে যাত্রা…পার্থিব আর আধ্যাত্মিক জগতের সংযোগ সেতু। এর ধাপগুলো মানুষের মনের একেকটা সদগুণ।

এসব তার জানার কথা, পিটার ভাবে। সে পুরো দীক্ষা নিয়েছে।

সব ম্যাসনিক শিষ্য প্রতীকি সিঁড়ির অর্থ হিসাবে জানে যে সে নিজের উত্থান ঘটাতে পারে, মানব শরীরের রহস্যের অংশ নিতে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে। ফ্রিম্যসনারী নিওটিক বিজ্ঞানের আর প্রাচীন রহস্যময়তার মত মানুষের মনের সুপ্ত সম্ভাবনাকে সম্মান করে এবং আর অনেক ম্যসনারী প্রতিক মানুষের দেহের অঙ্গসৌষ্ঠবের সাথে জড়িত।

মন ভৌত শরীরের শীর্ষে সোনার শিরোশোভার মত পায়। পরশ পাথর। মেরুদণ্ডের সিঁড়ির ভেতর দিয়ে শক্তি উঠা নামা করে, পার্থিব দেহের সাথে দিব্য মনের সংযোগ সঞ্চালন ঘটায়।

পিটার জানে মেরুদণ্ডের তেত্রিশটা কশেরুকা কোন কাকতালীয় ব্যাপার না। তেত্রিশটা হল ম্যাসনারী ডিগ্রী বা ধাপ। মেরুদণ্ডের পাদদেশ বা সেক্রাম এর আক্ষরিক মানে পবিত্র হাড়। আমাদের শরীর বাস্তবিকই মন্দির। ম্যাসনরা যে মানবিক বিজ্ঞানকে শ্রদ্ধা করে সেটাই সবচেয়ে প্রাচীন জ্ঞান কিভাবে এই মন্দিরকে সবচেয়ে কার্যকরী আর হিতকারী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়।

দুর্ভাগ্যবশত, এই বেআক্কেলকে এসব ব্যাখ্যা করলে ক্যাথরিনের কোন লাভ হবে না। পিটার প্রতাঁকের ছকটার দিকে তাকায় এবং হাল ছেড়ে দেয়ার ভাব করে। তুমিই ঠিক, সে মিথ্যা বলে। এই ভবনের নীচে আসলেও একটা গোপন সিঁড়ি আছে। তুমি যত দ্রুত ক্যাথরিনের জন্য সাহায্য পাঠাবে তত তাড়াতাড়ি আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব।

উল্কি আঁকা লোকটা তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে।

সলোমনও অবজ্ঞার চোখে তার দিকে চেয়ে রয়। তুমি আমার বোনকে বাঁচিয়ে সত্যটা জান …বা আমাদের দুজনকেই হত্যা করে আজীবন অজ্ঞতার বোঝা বয়ে বেড়াও।

লোকটা কাগজের টুকরোটা নামিয়ে আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। পিটার আমি তোমার উপরে ভীষণ রাগ করেছি। তুমি তোমার পরীক্ষায় ফেল করেছে। তুমি এখনও আমাকে বোকা মনে করছো। তুমি কি সত্যিই মনে কর আমি বুঝি

আমি কি খুঁজছি? আমার সত্যিকারের সম্ভাবনা আমি এখনও বুঝিনি বলে তুমি মনে করেছো?

কথাটা শেষ করে লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে গা থেকে আলখাল্লাটা পিছলে নেমে যেতে দেয়, পিটার প্রথমবারের মত লোকটার মেরুদণ্ড দিয়ে উঠে যাওয়া লম্বা উল্কিটা দেখে।

হায় ঈশ্বর,…

লোকটার সাদা নেংটির উপর থেকে একটা সাবলীল প্যাচান সিঁড়ি তার পিঠের মধ্যভাগ দিয়ে উপরে উঠে এসেছে। সিঁড়িটার প্রতিটা ধাপ একেকটা কশেরুকায় অবস্থিত। নির্বাক তাকিয়ে থেকে পিটারের চোখ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে লোকটার করোটির কাছে এসে পৌঁছে।

পিটার কেবল তাকিয়ে দেখে।

উল্কি আঁকা লোকটা এবার তার মাথা নীচু করলে তার ঠিক চাঁদিতে একটা বৃত্তাকার এলাকার ত্বক খালি রয়েছে দেখা যায়। কুমারী ত্বকটা কেবল একটা সাপ দিয়ে সীমানা চিহ্নিত, যে নিজেই নিজেকে ভক্ষণ করছে।

এট-ওয়ান-মেন্ট।

লোকটা এবার ধীরে ধীরে পিটারের দিকে ঘুরে তার মাথা নীচু করে। তার বুকের অতিকায় দুই মাথা বিশিষ্ট ফিনিক্স মৃত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

আমি হারিয়ে যাওয়া শব্দটা খুঁজছি, লোকটা বলে। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে…না তুমি আর তোমার বোন দুজনেই মারা যাবে?

.

তুমি জানো কিভাবে খুঁজে পেতে হবে, মাল’আখ ভাবে। তুমি কিছু একটা জানো যা আমাকে তুমি বলছো এখনও বলছে না।

পিটার সলোমন জেরা করার সময়ে কি বলেছে সেসব সম্ভবত এখন তার মনেও নেই। অনুভূতিবর্জিত ট্যাঙ্কে পরপর ভেতর বাহির করার কারণে সে নমনীয় আর বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। আজব ব্যাপার হল সে যখন নিজের গোপন কথা প্রকাশ করে, যা কিছু মাল’আখকে বলেছে সবই হারিয়ে যাওয়া শব্দের কিংবদন্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

হারিয়ে যাওয়া শব্দ কোন রূপক না…এটা বাস্তব। একটা প্রাচীন ভাষায় শব্দটা লেখা রয়েছে…এবং বহুদিন ধরে গোপন আছে। শব্দটার আসল মানে যে বুঝতে পারবে শব্দটা তাকে অমিত শক্তির অধিকারী করার ক্ষমতা রাখে। আজ পর্যন্ত শব্দটা গোপন রাখা হয়েছে…আর ম্যাসনিক পিরামিডের ক্ষমতা আছে সেটাকে অবগুণ্ঠিত করার।

পিটার, মাল’আখ এখন, তার বন্দির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি যখন প্রতিকের এই ছকটার দিকে তাকিয়েছিলে…তখন তুমি কিছু একটা লক্ষ্য করেছো। তুমি কিছু অনুধাবন করেছে। এই ছকটার কোন মানে আছে তোমার কাছে। আমাকে সেটা বলো।

ক্যাথরিনকে সাহায্য না পাঠান পর্যন্ত আমি তোমাকে কিছুই বলবো না!

মাল’আখ তার দিকে তাকিয়ে হাসে। বিশ্বাস কর, তোমার বোনকে নিয়ে এখন তোমার দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। আর একটা কথাও না বলে সে ল্যাংডনের ডেব্যাগের ভিতরে বেসমেন্টে থাকার সময়ে যে পোটলাটা রেখেছিল সেটা বের করে। তার পরে সে নিখুঁতভাবে উৎসর্গ বেদীর উপরে সেসব সাজিয়ে রাখতে থাকে।

একটা ভাঁজ করা সিল্কের কাপড়। ধবধবে সাদা।

একটা রূপার পিরীচ। মিশরীয় গন্ধরস।

পিটারের রক্ত ভর্তি শিশি। তাতে ছাই মিশ্রিত।

একটা কাকের কালো পালক। তার পবিত্র শলাকা।

ভীতিকর চাকুটা। কানানের মরুভূমিতে প্রাপ্ত উল্কাপিণ্ডের লোহা দিয়ে তৈরী এর ফলাটা।

তুমি ভেবেছো আমি মরতে ভয় পাই? পিটার চিৎকার করে জানতে চায়, মানসিক যন্ত্রণায় তার কণ্ঠস্বর চিরে যায়। ক্যাথরিন মারা গেলে আমার আর কিছুই বাকি রইল না! তুমি আমার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছে। আমার সবকিছু আমার কাছ থেকে তুমি ছিনিয়ে নিয়েছো!

সবকিছু না, মাল’আখ উত্তর দেয়। এখন না। সে ডেব্যাগের ভেতর। থেকে তার ল্যাপটপটা বের করে। সেটা চালু করে সে তার বন্দির দিকে তাকায়। তুমি কি ধরণের ঝামেলায় পড়েছে সেটা প্রকৃতি তুমি এখনও বুঝতে পারনি।

.

১১৭ অধ্যায়

ল্যাংডন সিআইএর হেলিকাপ্টারে উঠতে সেটা লন থেকে লাফিয়ে উঠে শূন্যে ভাসে, তীক্ষ্ণ বাঁক নেয় এবং এমন বেগে গতি বৃদ্ধি করে যেটা কোন হেলিকপ্টারের পক্ষে সম্ভব সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি, তার পেটে প্রজাপতির ডানা ঝাঁপটানি সে অনুভব করে। ক্যাথরিন বেল্লামির সাথে থেকে গেছে ধাক্কা কাটিয়ে উঠার জন্য আর তাদের সাথে একজন এজেন্ট আছে যে ম্যানসনটা তল্লাশি করবে আর ব্যাকআপ টিম আসবার জন্য অপেক্ষা করবে।

ল্যাংডন হেলিকপ্টারে উঠবার আগে সে তাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে এবং ফিসফিস করে বলেছে, রবার্ট, নিরাপদে আমার কাছে ফিরে এসো।

ল্যাংডন এখন কোনমতে প্রাণ নিয়ে বসে আছে সামরিক হেলিকপ্টারটা অবশেষে সোজা হয়ে হাউজ অব টেম্পলের দিকে উড়ে চলে।

সাটো তার পাশে বসে পাইলটকে চেঁচিয়ে বলে, ডুপন্ট সার্কেলের দিকে উড়ে চলো! সে রোটরের শব্দ ছাপিয়ে বলে, আমরা সেখানেই নামব!

চমকে উঠে ল্যাংডন তার দিকে তাকায়। ডুপন্ট?! সেটা হাউজ অব। টেম্পল থেকে কয়েক ব্লক দূরে? আমরা টেম্পলের পার্কিং লটেই নামতে পারি!

সাটো অসম্মতির মাথা নাড়ে। আমরা ভবনটায় নিরবে প্রবেশ করতে চাই। আমাদের টার্গেট যদি আমাদের আসবার শব্দ শুনে-

আমাদের হাতে সময় অল্প! ল্যাংডন প্রতিবাদ করে। এই উন্মাদটা পিটারকে বলি দেবে! হেলিকপ্টারের শব্দ হয়ত তাকে ভীত করে তুলবে এবং সে নিরস্ত হবে!

সাটো তার দিকে বরফ শীতল চোখে তাকায়। আমি তোমাকে আগেও বলেছি পিটার সলোমনের জীবন বাচান আমার মূল লক্ষ্য না। আমি আশা করি আমার কথা তুমি বুঝেছো।

দেশ ও জাতির নিরাপত্তা সংক্রান্ত আরেকটা বক্তৃতা শোনার মুডে ল্যাংডন নেই। দেখো, আমি একমাত্র লোক এই চপারে যে ভবনটার ভিতরে পথ চিনে যেতে পারবে–

প্রফেসর, সাবধান, ডিরেকটর কড়া কণ্ঠে এবার বলে। তুমি এখানে এসেছে আমার দলের একজন হয়ে এবং আমার সাথে তুমি পূর্ণ সহযোগিতা করবে। সে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কি যেন ভাবে আর তারপরে যোগ করে, আমার মনে হয় সময় হয়েছে তোমাকে জানান আজ রাতে আমরা কি মাত্রার বিপর্যয় মোকাবেলা করছি।

সে তার সীটের নীচে হাত দিয়ে একটা পাতলা টাইটেনিয়ামের বিফ্রকেস বের করে এবং সেটা খুলতে ভেতরে অস্বাভাবিক জটিল একটা কম্পিউটার রয়েছে দেখা যায়। সেটা চালু করলে সিআইএ লোগো সাথে লগ-ইন প্রম্পট ভেসে উঠে।

সাটো লগ-ইন করার ফাঁকে জিজ্ঞেস করে, প্রফেসর তোমার মনে আছে এই লোকটার বাসায় আমরা পরচুলা পেয়েছিলাম?

হ্যাঁ।

বেশ সেই পরচুলার ভেতরে একটা ক্ষুদে ফাঁইবার অপটিক ক্যামেরা বসান ছিল…চুলের আড়ালে ঢাকা।

একটা গোপন ক্যামেরা। আমি বুঝতে পারলাম না।

সাটোকে গম্ভীর দেখায়। শীঘ্রই বুঝতে পারবে। সে একটা ফাইল লঞ্চ করে ল্যাপটপে।

একটা ভিডিও উইনডো পপ-আপ করে, পুরো স্ক্রিন নিয়ে। সাটো এবার ব্রিফকেসটা তুলে নিয়ে ল্যাংডনের উরুর উপরে বসিয়ে দিয়ে তাকে সিনেমা হলের সামনের সারির দর্শকে পরিণত করে।

একটা অপরিচিত দৃশ্য স্ক্রিনে ভেসে উঠে।

ল্যাংডন বিস্ময়ে গুটিয়ে যায়। এটা কি কিভাবে?!

ঘন আঁধারের ভিতরে চোখবাঁধা অবস্থায় একজন লোককে দেখা যায়। ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে হেঁটে যাওয়া মধ্যযুগীয় খারেজী মতাবলম্বীর মত লেবাস তার পরণে- গলায় ফাঁসির দড়ি, প্যান্টের বাম পা হাঁটু পর্যন্ত গোটান, শার্টের ডান হাত কনুইয়ের কাছে তোলা, আর শার্টের সামনের খোলা অংশ দিয়ে তার নিলোম বুক দেখা যায়।

চোখে অবিশ্বাস নিয়ে ল্যাংডন তাকিয়ে থাকে। ম্যাসনিক কৃত্যানুষ্ঠান সম্পর্কে সে এত বেশি পড়েছে যে সে দেখা মাত্র বুঝতে পারে কি দেখছে।

ম্যাসনিক দীক্ষা…প্রথম ধাপে অভিষেকের প্রস্তুতি।

লোকটার দেহ পেশীবহুল আর ভীষণ লম্বা, মাথায় সোনালী চুলের ছাট পরিচিত আর গাঢ় তামাটে ত্বক। ল্যাংডন দেহাবয়ব দেখে সাথে সাথে চিনতে পারে। লোকটার গায়ের উল্কি এখন নিঃসন্দেহে তামাটে মেকআপের নিজে ঢাকা পড়ে আছে। সে একটা প্রমাণ আঁকৃতির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি পরচুলায় লুকিয়ে রাখা ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করছে।

কিন্তু…কেন?

স্ক্রীন ঝাঁপসা হয়ে যায়।

নতুন ফুটেজ এবার দেখা যায়। একটা ছোট মৃদুভাবে আলোকিত আয়তাকার চেম্বার। মেঝেতে দাবার ছকের মত সাদা কালো টাইল। একটা নীচু কাঠের বেদী, তিনপাশে কাঠের বেদী দিয়ে ঘেরা, যার প্রতিটার উপরে মোমবাতি জ্বলছে।

ল্যাংডন সহসা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে।

সর্বনাশ।

হোম ভিডিওর অপেশাদার ভঙ্গিতে ভোলা, ক্যামেরা এবার ঘরের সীমানার ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা একদল লোককে দেখায় যারা দীক্ষা গ্রহণের অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করছে। লোকগুলোর পরণে পুরোদস্তুর ম্যাসনিক রিগ্যেলিয়া। আঁধারের কারণে ল্যাংডন তাদের মুখ দেখতে পায় না কিন্তু দীক্ষাটা কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ঠিকই বুঝতে পারে।

লজ রুমের এই সনাতন আঁকার দুনিয়ার যেকোন প্রান্তে অবস্থিত হতে পারে, কিন্তু প্রধান পুরোহিতের চেয়ারের উপরে পাউডার-রু ত্রিকোণাকৃতি গঠন দেখে বোঝা যায় এটা ডি.সির সবচেয়ে পুরাতন ম্যাসনিক লজ-পোটোম্যাক লজ নং৫-জর্জ ওয়াশিংটনের বাসা এবং ম্যাসনিক পূর্বপুরুষ যিনি হোয়াইট হাউজ আর ক্যাপিটল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।

লজটা আজও সক্রিয়।

পিটার সলোমন হাউজ অব টেম্পলের তত্ত্বাবধায়ন করা ছাড়াও এই লোকাল লজের তিনি পুরোহিত। এবং এ ধরণের লজের মত জায়গাতেই ম্যাসনিক দীক্ষার যাত্রা শুরু হয়, যেখানে একজন দিক্ষিত ফ্রিম্যাসনারীর প্রথম তিন ধাপ অনুশীলন করে।

ব্ৰেদরেন, পিটারের পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান স্থপতির নামে আমি এই লজ ম্যাসনারীর প্রথম ধাপ অনুশীলনের জন্য অবারিত ঘোষণা করছি!

একটা হাতুড়ির জোরাল আঘাতে শব্দ শোনা যায়।

ল্যাংডন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সে দেখে ভিডিওটা দ্রুত প্রেক্ষাপট বদলে পিটারকে আরও কঠিন কৃত্যানুষ্ঠান পালনের মুহূর্তগুলো উপস্থাপন করে।

দীক্ষিতের খোলা বুকে একটা চকচকে চাকু রাখা…দীক্ষিত অযোগ্য ব্যক্তির কাছে ম্যাসনারীর রহস্য প্রকাশ করলে বর্শাবিদ্ধ হবে…সাদা-কালো মেঝেকে জীবিত আর মৃত বলে বর্ণনা করা…শাস্তির মাত্রা বর্ণনা যার ভেতরে আছে কানের একপাশ থেকে আরেকপাশ পর্যন্ত গলা কাটা, জিহ্বা মূল থেকে উপরে নেয়া আর সমুদ্রের বালিতে লাশ কবর দেয়া…

ল্যাংডন তাকিয়ে থাকে। আমি কি সত্যিই এসব দেখছি। ম্যাসনদের দীক্ষার কৃত্যানুষ্ঠান বহু শতাব্দি গোপনীয়তার অবগুণ্ঠনে ঢাকা ছিল। কেবল স্বপক্ষত্যাগী গুরু ভাইদের বর্ণনা থেকে মানুষ যতটুকু জেনেছে। ল্যাংডন সেসব অবশ্যই পড়েছে কিন্তু নিজের চোখে দীক্ষা অনুষ্ঠান দেখা…অনেক গুরুতর একটা বিষয়।

বিশেষ করে এভাবে সম্পাদিত। ল্যাংডন এখনই বলতে পারে ভিডিওটা একটা অনৈতিক প্রোপাগাণ্ডা দীক্ষার মহৎ দিকগুলো বাদ দিয়ে কেবল বিব্রতকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই ভিডিওটা রিলিজ হলে সাথে সাথে ইন্টারনেট সেনসেশনে পরিণত হবে। অ্যান্টি ম্যাসনিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থকরা হাঙরের মত এটা লুফে নেবে। ম্যাসনিক প্রতিষ্ঠান আর বিশেষ করে পিটার সলোমন নিজেদের একটা বিতর্কের ঝড়ের ভিতরে আর ক্ষতি রোধের বেপরোয়া চেষ্টারত অবস্থায় আবিষ্কার করবেন…যদিও কৃত্যানুষ্ঠানের পুরোটাই প্রতীকি আর নির্বীষ।

আতঙ্কিত করে তুলে ভিডিওটা বাইবেলে মানুষের আত্মোৎসর্গের একটা বাণী উদ্ধৃত করে শেষ হয়…মহান সত্ত্বার কাছে আব্রাহামের সমর্পন তার সদ্যোজাত প্রথম শিশু ইসহাককে উৎসর্গ করে। ল্যাংডন পিটারের কথা ভাবে। আর মনে মনে বলে হেলিকপ্টারটা আরেকটু দ্রুত যেতে পারে না।

ভিডিও ফুটেজ এবার বদলে যায়।

একই কামরা, আরেক রাতের কাহিনী। ম্যাসনদের একটা বিশাল দল তাকিয়ে রয়েছে। পুরোহিতের চেয়ারে বসে পিটার সলোমন দেখছেন। দ্বিতীয়। ধাপে উত্তরণের যজ্ঞ। মাত্রা আরও তীব্র হয়েছে। বেদির কাছে হাঁটু মুড়ে অবস্থান…ফ্রিম্যাসনারীর রহস্য চিরকাল গোপন থাকবে শপথ গ্রহণ…বুক চিরে তাজা হৃৎপিণ্ড মাংসভুক প্রাণীকে উৎসর্গ করা হবে এই শাস্তির প্রতি সম্মতি প্রদান…

ল্যাংডনের নিজের হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয়ে উঠে ভিডিও আরেকবার প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে দেখে। আরো বিশাল দর্শক সমাগম। মেঝেতে কফিনের মত একটা ট্রেসিং বোর্ড।

তৃতীয় ধাপ।

এটা মৃত্যুযজ্ঞ- সব ধাপের ভিতরে এটাই শ্রমসাধ্য- যেখানে দীক্ষিতকে আত্মবিনাশের চরম পরীক্ষার মুখোমুখি জোর করে দাঁড় করান হয়। এই

অবিশ্রান্ত জেরা থেকেই আমরা আজ যে বাগধারা ব্যবহার করি কাউকে থার্ড শ্রিী শাস্তি দেয়া, সেটার উদ্ভব হয়েছে। ল্যাংডন বইয়ে এটা সম্বন্ধে পড়েছে কিন্তু যা দেখে সেটা দেখার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না।

হত্যাকাণ্ড।

দ্রুত কাট করে ভিডিও এবার রক্তহিম করা দীক্ষিতের নির্মম মৃত্যুর ব্যাপারে ভিকটিমের পয়েন্ট-অব-ভিউ বর্ণনা দেখান হয়। মাথায় আঘাতের ভান করা হয়, কেই ম্যাসনদের ব্যবহৃত পাথরের গদা দিয়ে তাকে আঘাত করে। পুরোটা সময় উপপুরোহিত বিষণ্ণ কণ্ঠে বিধবার ছেলের গল্প বলে- হিরাম আবিফ-সলোমনের মন্দিরের প্রধান স্থপতি যে গোপন জ্ঞান প্রকাশ করার চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিল।

আক্রমণটা অবশ্যই কেবল অভিব্যক্তির অভিনয়, কিন্তু ক্যামেরাতে দেখার সময়ে রক্ত হিম হয়ে আসে। মৃত্যুঘাতের পরে দীক্ষিত– এখন যার পূর্বের সত্ত্বা মৃত-তার প্রতীকি কফিনে তাকে শোয়ান হয়, যেখানে তার চোখ বন্ধ, হাত বুকের উপর আড়াআড়ি করে রাখা যেমন কফিনে লাশ রাখা হয়। ম্যাসনিক গুরুভাইয়েরা উঠে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে তার মৃত দেহ ঘিরে দাঁড়ায় যখন পাইপ অর্গানে মার্চ অব দি ডেডের সুর বাজান হয়।

ইঙ্গিতপূর্ণ দৃশ্যটা খুবই বিব্রতকর।

আর খারাপের এখনও অনেক বাকি আছে।

মৃত ভাইয়ের চারপাশে দাঁড়ান লোকদের মুখ লুকান ক্যামেরায় স্পষ্ট দেখা যায়। ল্যাংডন বুঝতে পারে ঘরে কেবল সলোমনই একমাত্র বিখ্যাত ব্যক্তি উপস্থিত না। দীক্ষিতের দিকে তাকিয়ে থাকা একজনকে আজকাল প্রায় টিভির। পর্দায় দেখা যায়।

এক প্রভাবশালী ইউ.এস সিনেটর।

হায় হায়…

দৃশ্যপট আবার বদলে যায়। এবার বাইরে…রাতের বেলা…একই রকমের জাম্পি ফুটেজ…লোকটা শহরের একটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে…ক্যামেরার সামনে সোনালী চুলের গোছা উড়তে দেখা যায়…বাক ঘুরে…ক্যামেরা এবার লোকটার হাতে রাখা কিছু একটার উপরে স্থির হয়…একটা ডলার বিল…গ্রেট সীলের ক্লোজআপ…সর্বদর্শী চোখ…অসমাপ্ত পিরামিড. ..তারপরে সেখান থেকে দূরের এক অনুরূপ আঁকৃতি ক্যামেরায় ভেসে উঠে…একটা বিশাল পিরামিড আঁকৃতির ভবন…শীর্ষের ঢালু ছাদ উপরের কাটা মাথায় মিলিত হয়েছে।

দি হাউজ অব টেম্পল।

তার সর্বাঙ্গ আপ্লুত করে এক বিভীষিকা।

ভিডিও এখনও শেষ হয়নি…লোকটা এবার ভবনটার দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়…কয়েকস্তর বিশিষ্ট একটা সিঁড়ি…একটা বিশাল ব্রোঞ্জের দরজার দিকে

এগিয়ে যায়…দুপাশে দুটো সতের টনের স্ফিংসের মূর্তি অভিভাবক।

এক জ্ঞানান্বেষী দীক্ষার পিরামিডে প্রবেশ করছে।

আবার অন্ধকার।

দূরে একটা শক্তিশালী পাইপ অর্গানের শব্দ…এবার নতুন দৃশ্য ফুটে উঠে।

দি টেম্পল রুম।

ল্যাংডন জোরে ঢোক গিলে।

বিশাল কামরাটা স্ক্রিনে আলোকিত দেখা যায়। গবাক্ষের নীচে কালো। মার্বেলের বেদী চাঁদের আলোয় চমকায়। তার চারপাশে হাতে তৈরী শুকরের চামড়া দিয়ে মোড়া চেয়ারে তেত্রিশ ডিগ্রী ম্যাসনদের একটা গম্ভীর প্রতিনিধি দল সাক্ষী থাকার জন্য উপস্থিত। ভিডিও ক্যামেরা এবার তাদের মুখের উপরে ধীর

আর ইচ্ছাকৃত মন্থরতায় আবর্তিত হয়।

আতঙ্কিত চোখে ল্যাংডন তাকিয়ে থাকে।

সে যদিও এটা আগে বুঝতে পারেনি কিন্তু সে যা দেখে সেটা ঠিক ঠিক মিলে যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শহরে ম্যাসনদের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত আর সম্মানিত সদস্যদের সমাবেশে যুক্তিযুক্ত কারণেই অনেক পরিচিত আর প্রভাবশালী ব্যক্তি উপস্থিত থাকতেই পারে। কোন সন্দেহ নেই অল্টারের চারপাশে লম্বা সিল্কের দাস্তানা, ম্যাসনিক উর্দি আর চোখ ধাঁধান অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী লোকদের কয়েকজন বসে আছে।

সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারপতি…

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী…

সিনেটের স্পিকার…

ক্যামেরা উপস্থিত সবার মুখের উপর দিয়ে ঘুরতে থাকলে ল্যাংডন অসুস্থবোধ করে।

দুজন প্রভাবশালী সিনেটর…যার ভিতরে একজন সরকারী দলের নেতা…

.

হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সেক্রেটারী…

এবং…

সিআইএর ডিরেকটর…

ল্যাংডন চোখ ফিরিয়ে নিতে চায় কিন্তু পারে না। দৃশ্যটার ভিতরে যেন সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে, এবং তার কাছেও আতঙ্কজনক বলে প্রতিয়মান হয়। এইবার সে বুঝতে পারে সাটোর উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের উৎস কি।

স্ক্রিনে এবার একটা মাথা নষ্ট করে দেবার মত ইমেজ ফুটে উঠে।

মানুষের করোটি…লাল রক্তের মত তরলে পূর্ণ। বিখ্যাত ক্যাপুট মরটাম পিটার সলোমনের সুগঠিত হাত দীক্ষিতের দিকে এগিয়ে দেয় তার হাতের ম্যাসনিক আংটি আলোয় ঝলসে যায়। লাল তরলটা ওয়াইন…কিন্তু রক্তর মত চকচকে। ভার্চুয়াল ইফেক্ট কাকে বলে।

দি ফিফথ লিবেশন, ল্যাংডন বুঝতে পারে জন কুইন্সী এ্যডামসের লেটারস অন ম্যাসনিক ইন্সটিটিউশন-এ সে এই দীক্ষার উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা। পড়েছে। তারপরেও এটা চোখের সামনে ঘটতে দেখা…আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী লোকটা শান্তভঙ্গিতে বসে প্রত্যক্ষ করছে দেখাটা…ল্যাংডনের দেখা সবচেয়ে শকিং ইমেজ।

দীক্ষিত করোটিটা হাতে নেয়…ওয়াইনের নিথর উপরিভাগে তার চেহারা ভাসে। আমার পান করা এই ওয়াইন আমার ভেতরে এক মারাত্মক বিষে পরিণত হোক, সে ঘোষণা করে, আমার শপথ যদি আমি কখনও জেনে বা। ইচ্ছাকৃতভাবে ভঙ্গ করি।

এটা স্পষ্ট এই নব্য দীক্ষিত সবার কল্পনাকে হার মানিয়ে সেটা ভাঙতে ইচ্ছুক।

ল্যাংডন কল্পনা করতে পারে না এই ভিডিও প্রকাশ হলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে। কেউ বোঝ কোন চেষ্টাই করবে না। সরকার একটা বিশৃঙ্খলার ভিতরে পতিত হবে। বাতাসের তরঙ্গ মাধ্যমে বিরোধীরা যাদের ভিতরে এ্যান্টি ম্যাসনিক দল, মৌলবাদী, ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক রয়েছে সবাই ঘৃণা আর ভয় উগড়ে দিতে শুরু করবে, পিউরিটান ডাইনী নিধন আরো একবার নতুন করে শুরু হবে।

সত্যকে বিকৃত করা হবে, ল্যাংডন জানে। ম্যাসনদের সাথে যা বরাবর হয়ে এসেছে।

সত্য হল ভ্রাতৃসংঘের মৃত্যুর এই অধিশ্রয়ন আসলে জীবনের বলিষ্ঠ উদযাপন। ম্যাসনিক কৃত্যানুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা লোকটাকে জাগ্রত করা, অজ্ঞতার অন্ধকার শবাধার থেকে তাকে তুলে আনা, তাকে আলোতে অধিষ্ঠিত করা আর দেখার চোখ খুলে দেয়া। মৃত্যুর অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে কেবল একজন জীবনের অভিজ্ঞতা বুঝতে পারে। পৃথিবীর বুকে তার বসবাসের দিন নির্দিষ্ট এটা অনুধাবন করতে পারলেই কেবল একজন সেই দিনগুলো সম্মান, সততা এবং চারপাশের মানুষের সেবায় কাটাবার গুরুত্ব বুঝতে পারবে।

ম্যাসনিক কৃত্যানুষ্ঠানগুলো চমক সৃষ্টিকারী কারণ সেগুলোর উদ্দেশ্য রূপান্তর ঘটান। ম্যাসনিক শপথ ক্ষমাহীন কারণ তাদের উদ্দেশ্য হুশিয়ার করে দেয়া যে একজন মানুষ এই পৃথিবী থেকে নিজের সম্মান আর তার দেয়া কথা কেবল সঙ্গে নিয়ে যাবে। ম্যাসনিক শিক্ষা দুর্বোধ্য কারণ তার উদ্দেশ্য বিশ্বজনীন…ধর্ম, সংস্কৃতি আর বর্ণ অতিক্রম করে প্রতীক আর রূপকের সাধারণ ভাষায় শিক্ষা দেয়া…ভ্রাতৃপ্রেমের একটা বিশ্বব্যাপী সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করা।

ল্যাংডন হঠাৎ আশার আলো দেখতে পায়। সে নিজেকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করে যে এই ভিডিও যদি প্রকাশ পায় তবে জনগণ উদারমনস্ক আর সহনশীল হবে, বুঝতে পারবে আধ্যাত্মিক কৃত্যানুষ্ঠানের সবসময়েই এমন কিছু দিক থাকে। যা তার উদ্দেশ্য থেকে আলাদা করে দেখলে ভীতিকর মনে হবে- ক্রুশবিদ্ধকরণ। পুনপ্রবর্তিতকরণ, ইহুদিদের লিঙ্গাগ্রের তুকচ্ছেদ কৃত্য, ক্যাথলিকদের ভূত তাড়ান, ইসলামিক নিকাব, শামানিক মোহাচ্ছন্ন উপশম, এমনকি যীশুর দেহ আর রক্তের আলঙ্কারিক ভক্ষণ।

আমি স্বপ্ন দেখছি, ল্যাংডন জানে। এই ভিডিও একটা বিশৃঙ্খলার জন্ম দেবে। সে ভাবতে পারে না রাশিয়া বা মুসলিম বিশ্বের কেউ যদি, উন্মুক্ত বুকে চাকু ঠেকাতে, ভয়ঙ্কর শপথ নিতে, মিথ্যা মৃত্যুর অভিনয় করতে, প্রতীকি কফিনে শুতে করোটি থেকে ওয়াইন পান করতে দেখে তাহলে তার পরিণতি কি হতে পারে। বিশ্বব্যাপী মাত্রাতিরিক্ত আর তাৎক্ষণিক হট্টগোল শুরু হবে।

ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন…। স্ক্রিনে এবার দীক্ষিতকে করোটি তার ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসতে দেখা যায়। সে সেটা পেছনের দিকে হেলায়…রক্ত লাল ওয়াইন পান করে…তার শপথ পূর্ণ করে। সে তারপরে করোটি নামিয়ে রেখে তার চারপাশে বসে থাকা লোকদের দিকে তাকায়। আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাবান বিশ্বস্ত ব্যক্তিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

স্বাগতম, গুরু ভাই,পিটার সলোমন বলে।

স্ক্রিন ঝাঁপসা হয়ে আসতে ল্যাংডন বুঝতে পারে সে শ্বাস বন্ধ করেছিল।

কোন কথা না বলে সাটো ফ্রিকেসটা বন্ধ করে তার কোলের উপর থেকে। তুলে নেয়। ল্যাংডন তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চায় কিন্তু কোন কথা খুঁজে। পায় না। তাতে কিছু যায় আসে না। তার মুখেই সব কিছু পরিষ্কার ফুটে আছে। সাটোর কথাই ঠিক। আজ জাতীয়-নিরাপত্তা বিপর্যয়ের সম্মুখীন…অকল্পনীয় মাত্রায়।

.

১১৮ অধ্যায়

নেংটি পরিহিত অবস্থায় মাল’আখ পিটার সলোমনের হুইলচেয়ারের সামনে হনহন করে পায়চারি করে। পিটার, সে ফিসফিস করে বলে, বন্দির আতঙ্ক সে বেশ উপভোগ করছে, তুমি ভুলে গিয়েছে তোমার দ্বিতীয় একটা পরিবার আছে…তোমার ম্যাসনিক ভাইরা। আর আমি তাদেরও ধ্বংস করে দেব…তুমি যদি আমাকে সাহায্য না কর।

উরুর উপরে রাখা ল্যাপটপের আভায় সলোমনকে প্রায় নিথর দেখায়। এটা কোরো না, সে অবশেষে মুখ তুলে তাকিয়ে থেমে থেমে বলে। এই ভিডিও যদি বাইরে প্রকাশ পায়…

যদি? মাল’আখ হাসে। যদি এটা প্রকাশ পায়? সে ল্যাপটপের পাশে সন্নিবিষ্ট ছোট সেলুলার মডেমটা দেখায়। আমি বিশ্বের সাথে সংযুক্ত।

তুমি এমন করতে পার না…

আমি পারি, সলোমনের আতঙ্ক উপভোগ করে সে ভাবে। তোমার ক্ষমতা আছে আমাকে থামাবার, সে বলে। আর তোমার বোনকে বাঁচাবার। কিন্তু তোমাকে বলতে হবে আমি যা জানতে চাই। হারান শব্দ কোথাও লুকান রয়েছে, পিটার আমি জানি এই ছক বলছে ঠিক কোথায় খুঁজতে হবে।

পিটার প্রতাঁকের ছকের দিকে তাকায় তার চোখে কোন ভাব প্রকাশ পায় না।

এটা হয়ত তোমাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। মাল’আখ ল্যাপটপের কয়েকটা কি হিট করে। একটা ই-মেইল প্রোগ্রাম লঞ্চ হতে দেখে পিটার আড়ষ্ট হয়ে যায়। মাল’আখ আগে কিউ করে রেখেছিল এমন একটা ই-মেইল স্ক্রিনে ডিসপ্লে হয়- একটা ভিডিও ফাইল প্রধান প্রধান মিডিয়া নেটওয়ার্কের একটা লম্বা তালিকার ঠিকানায়।

মাল’আখ হাসে। আমার মনে হয় এখনই আমাদের শেয়ার করা উচিত, তাই না?

কোরো না!

মাল’আখ নীচু হয়ে সেণ্ড বাটনে চাপ দেয়। পিটার বাধন সত্ত্বেও চেয়ার ঝাঁকাতে চায়, যাতে ল্যাপটপটা পড়ে যায়।

শান্ত হও, মাল’আখ ফিসফিস করে বলে। অনেক বড় ফাইল। কয়েক মিনিট সময় লাগবে যেতে। সে প্রোগ্রাম বারের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়।

SENDING MESSAGE: 2% COMPLETE

আমি যা জানতে চাই যদি তুমি আমাকে বলো, আমি ই-মেইল বন্ধ করে দেববা আর কেউ এটা কখনও দেখবে না।

টাস্ক বার একটু বড় হয়ে পিটারের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়।

SENDING MESSAGE: 4% COMPLETE

মাল’আখ ল্যাপটপটা পিটারের কোল থেকে নিয়ে সামনের শুকরের চামড়া মোড়ান একটা চেয়ারে রেখে সেটা পিটারের দিকে ঘুরিয়ে দেয় যাতে সে অগ্রগতি দেখতে পায়। তারপরে সে পিটারের কাছে ফিরে এসে প্রতীক আঁকা কাগজটা তার কোলে রাখে। কিংবদন্তিতে বলা আছে ম্যাসনিক পিরামিড হারিয়ে। যাওয়া শব্দ অবারিত করবে। এটা পিরামিডের শেষ সঙ্কেত। আমার বিশ্বাস তুমি জানো এটা কিভাবে পাঠোদ্ধার করতে হবে।

মাল’আখ ল্যাপটপের দিকে তাকায়।

SENDING MESSAGE: 8% COMPLETE

মাল’আখ আবার পিটারের দিকে তাকায়। সলোমন এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে তার ধুসর চোখে থিকথিকে ঘৃণা।

আমাকে ঘৃণা কর, মাল’আখ ভাবে। আবেগ যত বেশি হবে, কৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হবার পরে নির্গত ক্ষমতা তত শক্তিশালী হবে।

.

ল্যাঙ্গলীতে, নোলা ফোন কানে দিয়ে আছে হেলিকপ্টারের কারণে সাটোর কথা ভাল করে শুনতে পায় না।

তারা বলছে ফাইল ট্রান্সফার বন্ধ করা অসম্ভব! নোলা চিৎকার করে বলে। স্থানীয় আইএসপি বন্ধ করতে হলেও এক ঘন্টার আগে সম্ভব না এবং তার যদি ওয়্যারলেস প্রোভাইডার হয়, তাহলে গ্রাউণ্ড-বেসড প্রোভাইডার বন্ধ করে মেইল পাঠান বন্ধ করা যাবে না।

আজকাল, ডিজিটাল ইনফরমেশন প্রবাহ রোধ করা এক কথায় প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। ইন্টারনেটে এখন অসংখ্য অগণিত এ্যাকসেস রুট। হার্ড লাইন, উই-ফি হট স্পট, সেলুলার মোডেম, স্যাট ফোন, সুপারফোন, ই-মেইল দক্ষ পিডিএর ভিতরে সম্ভাব্য তথ্য পাচার বন্ধ করার একমাত্র উপায় সোর্স মেশিন ধ্বংস করে দেয়া।

তোমার হেলিকপ্টারের স্পেক শিট আমার কাছে আছে, নোলা বলে, এতে দেখছি চপারে ইএমপি আছে।

ইএমপি বা ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক পালস গান আজকাল গাড়ির রেসের বিরুদ্ধে বেশ দক্ষতার সাথে নিরাপদ দূরত্ব থেকে ব্যবহৃত হয়। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক বিকিরণের উচ্চমাত্রার পালস নিক্ষেপ করে এটা নিশানা করা যে কোন ইলেকট্রনিকস ডিভাইস ভাজি করে দিতে পারে- গাড়ি, সেল ফোন, কম্পিউটার। নোলার স্পেক শিট অনুযায়ী ইউএইচ-৬০ চেসিস-মাউন্টেড, লেজার সাইটেড, ছয় গিগা হার্টজের ম্যাগট্রেন সাথে পঞ্চাশ ডিবি গেইন হর্ণ যা দশ গিগা ওয়াট পালস ছুঁড়তে সক্ষম। ল্যাপটপের উপরে সরাসরি বিকিরিত হলে মাদারবোর্ড সাথে সাথে ভাজি হবে আর হার্ডডিস্কের মেমরি উবে যাবে।

ইএমপি কাজে আসবে না, সাটো বলে, টার্গেট পাথরের ভবনের ভিতরে আছে। কোন দৃষ্টিপথ নেই আর মোটা ইএম ঢাল। তোমার কাছে কোন সূত্র। আছে যে ভিডিওটা লিক হয়েছে কিনা?

নোলা দ্বিতীয় মনিটরের দিকে তাকায় যেখানে চলমান সার্চ দেয়া আছে। ম্যাসন সম্পর্কে ব্রেকিং নিউজের জন্য। এখনও পর্যন্ত কোন খবর নেই। ফাস হলে আমরা কয়েক সেকেণ্ডের ভিতরে জানতে পারব।

আমাকে অবগত রাখতে থাকো, সাটো লাইন কেটে দেয়।

.

আকাশ থেকে এক ঝাঁকিতে ডুপন্ট সার্কেলের দিকে নেমে আসলে ল্যাংডনের পেটে সুড়সুড়ি লাগে। যে কয়েক জন পথচারী ছিল তারা সরে যায় আর চপারটা গাছপালার ভিতরে একটা ফাঁকা স্থানে নেমে আসে লনের দুই স্তর বিশিষ্ট ঝর্ণার ঠিক দক্ষিণে লিংকন মেমোরিয়াল যারা যে দুজন তৈরী করেছে এই। ঝর্ণাও তাদের সৃষ্টি।

ত্রিস সেকেণ্ড পরে, লেক্সাস এসইউভিতে করে নিউ হ্যাম্পশায়ার এ্যাভিনিউ দিয়ে দি হাউজ অব টেম্পলের দিকে ছুটে চলে।

পিটার সলোমনের মনে ভাবনার ঝড় বয়ে যায় কি করা উচিত সে বিষয়ে। কিন্তু সে কেবল ক্যাথিরিনের ছবি দেখতে পায় অন্ধকার বেসমেন্টে রক্তপাতের কারণে আস্তে আস্তে নির্জীব হয়ে আসছে…আর এইমাত্র প্রত্যক্ষ করা ভিডিওটা। সে আস্তে আস্তে কয়েকগজ দূরে শুকরের চামড়ায় মোড়া চেয়ারের উপরে রাখা ল্যাপটপটার দিকে তাকায়। প্রগেস বার প্রায় এক তৃতীয়াংশ পথ অতিক্রম করেছে।

SENDING MESSAGE: 29% COMPLETE

উল্কি আঁকা লোকটা এবার চারকোনা বেদীর চারপাশে ধীরে ধীরে হাটছে, জ্বলন্ত ধূপদানি আন্দোলিত করতে করতে আপন মনে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। সাদা ধোয়ার একটা মেঘ আঁকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। লোকটা চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে আর সে কোন অশুভ আবেশে মুগ্ধ। পিটার বেদীর উপরে সিল্কের কাপড়ে রাখা চাকুটার দিকে তাকায়।

পিটার সলোমনের মনে কোন সন্দেহ নেই আজ রাতে এই টেম্পলে সে মারা যাচ্ছে। প্রশ্নটা হল কিভাবে মারা যাবে। সে কি তার বোনকে বাচাবার জন্য কোন পথ খুঁজে বের করবে সাথে তার গুরুভাইদের, নাকি বৃথাই মারা যাবে?

সে প্রতীক আঁকা ছকটার দিকে তাকায়। সে প্রথমবার ছকটা দেখার সময়ে সেই মুহূর্তের শক তাকে অন্ধ করে ফেলেছিল…তার বিশৃঙ্খলার অবগুণ্ঠন ভেদ করে দেখার শক্তি ব্যবহত করেছিল…ফেলে সে সত্যের ঝলক দেখতে ব্যর্থ হয়। এখন এই প্রতীকগুলোর আসল অর্থ তার কাছে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ হয়ে উঠে। ছকটা সে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোনো থেকে অবলোকন করে।

একটা বড় শ্বাস নিয়ে সে উপরের গবাক্ষের ভিতর দিয়ে চাঁদের দিকে তাকায়। তারপরে কথা বলতে শুরু করে।

.

সব মহান সত্যই আটপৌরে।

মাল’আখ অনেক আগেই সেটা শুনেছে।

পিটার সলোমন এখন যে সমাধানের কথা বলছে তা এতটাই শুদ্ধ আর সাবলীল যে মাল’আখ নিশ্চিত সেটা সত্যি না হয়ে পারে না। অবাক করার মত ব্যাপার হল পিরামিডের শেষ সঙ্কেত সে যা ভেবেছিল তার চেয়েও সরল।

হারিয়ে যাওয়া শব্দ ঠিক আমার চোখের সামনেই ছিল।

মুহূর্তের ভিতরে তীব্র আলোর রশ্মি হারিয়ে যাওয়া শব্দ ঘিরে থাকা শতাব্দি ব্যাপী তমসা আর ইতিহাসের কিংবদন্তি ভেদ করে। প্রতিশ্রুতির মত হারিয়ে যাওয়া শব্দ প্রাচীন ভাষায় লেখা এবং মানুষের জানা বিজ্ঞান, দর্শন আর ধর্মের। ক্ষেত্রে মরমী শক্তিবহন করে। অ্যালকেমী, জ্যোবিবিদ্যা, কাবালআহ, খ্রিস্টান ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, নিওটিকস….

হেরেডমের শীর্ষে বিশাল পিরামিডের উপরে দীক্ষাদানের চেম্বারে দাঁড়িয়ে মাল’আখ এত বছর সে যে গুপ্তধন খুঁজেছে সেদিকে তাকায় এবং সে জানে নিজেকে এরচেয়ে নিখুঁতভাবে সে আর কখনও প্রস্তুত করতে পারবে না।

শীঘ্রই আমি সম্পূর্ণ হব।

হারিয়ে যাওয়া শব্দ পাওয়া গেছে।

.

ক্যালোরমা হাইটসে, সে সিআইএ এজেন্ট থেকে গিয়েছিল একরাশ আর্বজনার সামনে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যা সে ময়লা ফেলার বিন থেকে টেলেছে।

মিস. নোলা? সে সাটোর এ্যানালিস্টের সাথে ফোনে কথা বলে। কপাল ভাল তার ময়লা দেখার কথা আমার মনে হয়েছিল। আমার মনে হয় আমি কিছু একটা খুঁজে পেয়েছি।

.

বাসার ভিতরে ক্যাথরিন সলোমন প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আরও প্রাণবন্ত অনুভব করতে থাকে। রিঙগারস সলিউশনের ল্যাকটেটেড ইনফিউশন তার রক্তচাপ বৃদ্ধি করেছে এবং মাথাব্যথা কমিয়ে দিয়েছে। এখন সে খাবারঘরের চেয়ারে সে আছে আর তাকে একদমই নড়াচড়া করতে নিষেধ করা হয়েছে। তার স্নায়ু বিবশ হয়ে আছে এবং সে ক্রমশ তার ভাইয়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে। উঠছে।

সবাই কোন চুলায় গিয়েছে? সিআইএর ফরেনসিক টিম এখনও এসে পৌঁছেনি। এখানে যে এজেন্ট রয়েছে সে এখনও তল্লাশি অব্যাহত রেখেছে। বেল্লামি তার সাথে বসার ঘরে রয়েছে, এখন কম্বলে জড়িয়ে আছে আর সেও পিটারকে সিআইএ রক্ষা করেছে এমন কোন সংবাদের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।

চুপ করে বসে থাকতে থাকেতে বিরক্ত হয়ে ক্যাথরিন টলতে টলতে লিভিংরুমের দিকে এগিয়ে যায়। সে দেখে বেল্লামিও তার দেখাদেখি উঠে। স্টাডির দিকে যাচ্ছে, সে অনুসরণ করে। স্থপতি একটা খোলা ড্রয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে পিঠ করে আছে এবং এতটাই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। যে তার প্রবেশ সে টের পায়নি।

সে তার পেছনে এসে বলে, ওয়ারেন?

বুড়ো লোকটা চমকে ঘুরে তাকায়, দ্রুত কোমর দিয়ে ঠেলে ড্রয়ার বন্ধ করে দেয়। তার চেহারা বিপর্যয়, বিষাদ ফুটে আছে, চোখের কোণে অশ্রু।

কি হয়েছে?! সে ড্রয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে। কি ওটা?

বেল্লামি কথা বলতে পারে না। তাকে সেই লোকের মত দেখায় যে দেখতে চায়নি এমন কিছু একটা দেখে ফেলেছে।

ড্রয়ারে কি? সে আবার জানতে চায়।

বেল্লামির অপূর্ণ চোখ তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অবশেষে সে কথা বলে। তুমি আর আমি ভাবছিলাম কেন…কেন এই লোকটা তোমার পরিবারকে এত ঘৃণা করে।

ক্যাথরিনের ভ্রু কুচকে উঠে। হ্যাঁ।

বেশ…, বেল্লামির কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। উত্তরটা আমি জানতে পেরেছি।

.

১১৯ অধ্যায়

হাউজ অব দি টেম্পলের উপরের চেম্বারে যে লোকটা নিজেকে মাল’আখ বলে দাবী করে সে বিশাল বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে এবং আস্তে আস্তে মাথার চাঁদির উল্কিহীন বৃকটা ঘষছে। ভারবাম সিগনিফিটেটিয়াম, সে প্রস্তুতির মন্ত্রোচ্চারন করে। ভারবাম ওমনিফিকাম। শেষ উপাচার অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেছে।

মূল্যবাণ সম্পদ প্রায়শই নিতান্তই সাধারণ হয়ে থাকে।

বেদীর উপরে ধূপের ধোঁয়া এঁকেবেঁকে উপরে উঠে যায়। ধূপের সুগন্ধি ধোয়া চাঁদের আলোর ভিতর দিয়ে উপরে উঠে আঁকাশের দিকে একটা পথ পরিষ্কার করতে করতে যেখান দিয়ে মুক্ত আত্মা নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে।

সময় সমাগত।

সে পিটারের রক্তপূর্ণ শিশিটা বের করে মুখটা খুলে। সে তার বন্দির সামনেই কাকের পালকের শীর্ষদেশ রক্তিম মিশ্রণে ডোবায় এবং চাদির পবিত্র বৃত্তের কাছে নিয়ে আসে। সে এক মুহূর্ত বিরত থাকে…ভাবে আজকের এই রাতটার জন্য সে কতদিন অপেক্ষা করছে। হারিয়ে যাওয়া শব্দ যখন কোন লোকের মনে লেখা হবে সে তখন অকল্পনীয় ক্ষমতার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। রূপান্তরের এটাই প্রাচীন প্রতিশ্রুতি। মাল’আখ সেটাকে সেভাবেই রাখতে চেষ্টা করেছে।

স্থির নিষ্কম্প হাতে মাল’আখ শলাকার নিবটা চামড়ায় ঠেকায়। তার কোন সাহায্য বা আয়নার প্রয়োজন নেই কেবল স্পর্শের অনুভূতির আর মনের চোখের সাহায্য হলেই চলবে। সে ধীরে নিখুঁতভাবে বৃত্তাকার ওরোবোরাসে হারিয়ে যাওয়া শব্দ খুলির ত্বকে লিখতে শুরু করে।

আতঙ্কিত চোখে পিটার সলোমন তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

লেখা শেষ হতে মাল’আখ চোখ বন্ধ করে এবং বুক থেকে সব বাতাস বের করে দেয়। জীবনে প্রথমবারের মত সে একটু আবেগ অনুভব করে যা আগে কখনও বোধ করেনি।

আমি সম্পূর্ণ।

আমি এককে একা।

মাল’আখ বহুবছর তার দেহকে শিল্পবস্তুর মমতায় তৈরী করেছে এবং আর এখন সে চূড়ান্ত রূপান্তরের মূহূর্ত নিকটে নিয়ে এসেছে। তার চামড়ায় অঙ্কিত প্রতিটা লাইন সে অনুভব করতে পারে। আমি সত্যিকারের মাস্টারপিস। সম্পূর্ণ আর নিখুঁত।

তুমি যা চেয়েছো আমি তোমাকে দিয়েছি, পিটারের কণ্ঠ বাগড়া দেয়। ক্যাথরিনকে সাহায্য পাঠাও আর এই ফাইলটা পাঠান বন্ধ কর।

মাল’আখ চোখ খুলে হাসে। আমার আর তোমার কাজ এখনও শেষ হয়নি। সে বেদির দিকে ঘুরে বলি দেবার জন্য সংরক্ষিত চাকুটা তুলে নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ফলার ধার পরীক্ষা করে। এই প্রাচীন চাকুটা ঈশ্বর কর্তৃক আদিষ্ট, সে বলে, মানুষ বলি দেবার জন্য। তুমি আগেই এটা চিনতে পেরেছিলে, তাই না।

সলোমনের ধুসর চোখ যেন পাথরের তৈরী। এটা অনন্য আর আমি কিংবদন্তিটা শুনেছি

কিংবদন্তি? বাইবেলে পর্যন্ত এর উল্লেখ আছে। আর তুমি বিশ্বাস কর না এটা সত্যি বলে?

পিটার কথা না বলে কেবল তাকিয়ে থাকে।

মাল’আখ সাত রাজারধন বিকিয়ে এটা সনাক্ত আর কুক্ষিগত করেছে। আকেহ চাকু বলে পরিচিত এই চাকুটা তিন হাজার বছরের পুরানো যা লোহার উল্কাপিণ্ড থেকে প্রস্তুত করা হয়েছে। স্বর্গ থেকে পতিত লোহা, প্রাচীন মরমী সাধকরা একে এই নামেই অভিহিত করতেন। বিশ্বাস করা হয়, আব্রাহাম আকেডাহয় ঠিক এই চাকুটাই ব্যবহার করেছিলেন- মরিয়াহঁ পাহাড়ে তার ছেলে ইসহাকের নিকট বলিদানের ক্ষেত্রে জেনেসিসে যেমন বলা হয়েছে। চাকুটার বর্ণাঢ্য ইতিহাসে এটা পোপ, থেকে শুরু করে জার্মান নাজি মরমীসাধক, ইউরোপীয় অ্যালকেমিস্ট আর ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের কাছে এটা গচ্ছিত ছিল।

তারা এটা সংরক্ষণ করেছে আর শ্রদ্ধা জানিয়েছে, মাল’আখ ভাবে, কিন্তু কারও সাহস হয়নি এটাকে সত্যিকারে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে এর সুপ্ত ক্ষমতা জাগ্রত করার। আজ রাতে আকেডাহ্ চাকু তার নিয়তির যাত্রা সমাপ্ত করবে।

ম্যাসনিক কৃত্যানুষ্ঠানে আকেডাহকে সবসময়ে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়েছে। প্রথম ধাপের দীক্ষার সময়ে, ম্যাসনরা উদযাপন করে, ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা সবচেয়ে সুমহান বলিদান, ইসহাক আব্রাহামের প্রথম সন্তানকে সবোচ্চ সত্ত্বার সংকল্পের কাছে সমর্পনের জন্য উৎসর্গ করা…মাল’আখের হাতে ধরা চাকুর ভার তাকে উল্লসিত করে সে যখন নীচু হয়ে হুইলচেয়ারের সাথে পিটারের বাধন ছিন্ন করে। মেঝেকে বাধনের অবশিষ্টাংশ খসে পড়ে।

পিটার সলোমন তার আড়ষ্ট অঙ্গপ্রতঙ্গ সঞ্চালিত করার চেষ্টা করে ব্যথা মুখ কুচকে ফেলেন। আমার সাথে তুমি এমন কেন করছো? এটা করে তুমি কি অর্জন করবে বলে ভেবেছো?

তোমার সেটা আগে বোঝার কথা, মাল’আখ উত্তর দেয়। তুমি প্রাচীন ধারা পাঠ করেছো। তুমি জান মরমী মাথনার শক্তি উৎসর্গের মাঝে নিহিত…মানুষের আত্মাকে দেহের খাঁচা থেকে মুক্তি দেয়া। শুরু থেকেই এই ধারা চলে আসছে।

তুমি উৎসর্গের ঘন্টা জানো, তার কণ্ঠস্বর ভর্ৎসনা আর যন্ত্রনায় উদ্বেল।

চমৎকার, মাল’আখ ভাবে। তোমার ঘৃণাকে জাগ্রত কর। এটা আরও সহজ করে তুলবে বিষয়টা।

বন্দির সামনে পায়চারি করার সময়ে তার খালি পেট আবারও মোচড় দিয়ে উঠে। মানুষের রক্ত ঝরানর ভিতরে অসীম ক্ষমতা নিহিত আছে। আজটেক থেকে শুরু করে চিনারা, প্রাচীন মিশরীয়রা থেকে সেলটিক ড্রইডসরা সবাই এটার সম্পর্কে অবগত। মানুষ বলি দেয়ার ভিতরে একটা জাদু আছে কিন্তু আধুনিক মানুষ দুর্বল হয়ে পড়েছে, ভীরু হয়ে উঠেছে সত্যিকারের এই বলিদানের ক্ষেত্রে, আধ্যাত্মিক রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় জীবন উৎসর্গ করার জন্য সে যথেষ্ট কঠোর না। অবশ্য প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে এটা পরিষ্কার বলা হয়েছে। সবচেয়ে পবিত্র যা সেটা উৎসর্গ করে মানুষ অমিত ক্ষমতা লাভ করতে পারবে।

তোমার ধারণা আমি একটা পবিত্র বলির পাঠা?

মাল’আখ এবার উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে। তুমি সত্যিই বুঝতে পারনি তাই না?

পিটার অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।

তুমি জান আমি বাসায় কেন অনুভূতি বিবর্জিত ট্যাঙ্কটা রেখেছি? মাল’আখ কোমরে হাত রেখে তার অলঙ্কৃত দেহের পেশী প্রসারিত করে, এখনও। কেবল সেংটিটা তার পরণে। আমি অনুশীলন করছিলাম…প্রস্তুত হচ্ছিলাম…যখন আমি কেবল আমার আত্মায় রূপান্তরিত হব তখন কেমন অনুভূতি হবে সেটা বোঝার জন্য…যখন আমি নশ্বর দেহ থেকে মুক্তি পাব…যখন আমি আমার এই নিখুঁত দেহ ঈশ্বরকে উৎসর্গ করবো। আমি সেই মূল্যবান একজন! আমিই সেই শ্বেতশুভ্র সাদা ভেড়ার বাচ্চা!

পিটারের চোয়াল ঝুলে যায় কিন্তু সে কোন কথা বলে না।

হ্যাঁ, পিটার মানুষ ঈশ্বরকে সেটাই উৎসর্গ করে যা তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তার শ্বেতশুভ্র সাদা কপোত…তার মূল্যবান আর উপযুক্ত সমর্পন। তুমি আমার কাছে মূল্যবান নও। তুমি উৎসর্গের উপযুক্ত না। মাল’আখ তার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকায়। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না? পিটার তোমাকে বলি দেয়া। হবে না…আমি সেই উপলক্ষ্য। আমার দেহ উৎসর্গের জন্য প্রণীত। আমিই সেই উপহার। আমার দিকে তাকাও। আমি প্রস্তুত হয়েছি, নিজেকে শেষ যাত্রার। জন্য গড়ে তুলেছি। আমি সেই উপহার!

পিটার বাক্যহারা হয়ে তাকিয়ে থাকে।

রহস্যটা হল কিভাবে মৃত্যুকে বরণ করতে হবে, মাল’আখ এখন বলে। ম্যাসনরা সেটা বোঝে। সে বেদীর দিকে দেখায়। তুমি প্রাচীন সত্যিকে শ্রদ্ধা কর আর তুমি মোটেই কাপুরুষ নও। উৎসর্গের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে। এবং তারপরেও তোমরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে কেবল মারা যাবার অভিনয় কর রক্তপাতহীন মৃত্যুর কৃত্যানুষ্ঠান পালন কর। আজরাতে, তোমাদের প্রতীকি বেদী সত্যিকারের ক্ষমতার সাক্ষী হবে…আর এর সত্যিকারের উদ্দেশ্যেরও বটে।

মাল’আখ নীচু হয়ে পিটারের বাম হাত আঁকড়ে ধরে তার হাতে আকেডাহ্। চাকুর বাট গুঁজে দেয়। বাম হাত অন্ধকারের প্রতিভূ। এটাও পরিকল্পিত। এ বিষয়ে পিটারের পছন্দের কোন সুযোগ নেই। এই চাকু দিয়ে এই লোকটা এই বেদীতে আজ যে বলি দেবে মাল’আখ এর চেয়ে শক্তিশালী প্রতীকি কোন বলিদানের কথা ভাবতে পারে না, যার মরমী প্রতাঁকে আবৃত দেহ একটা উপহারের মত তার নশ্বর দেহের হৃৎপিণ্ডে চাকুটা আমূল গেঁথে দিয়ে।

নিজেকে উৎসর্গ করে মাল’আখ শয়তানের কাতারে নিজেকে সামিল করবে। অন্ধকার আর রক্তের মাঝেই আসল ক্ষমতা নিহিত। প্রাচীনরা সেটা জানতো, দীক্ষিতেরা তাদের প্রবৃত্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দিক বেছে নিত। মাল’আখ অনেক বিবেচনা করে বেছে নিয়েছে। বিশ্বের প্রাকৃতিক নিয়মই হল বিশৃঙ্খলা। বিতৃষ্ণা বিদ্রোহের সামিল। মানুষের করুণা সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র যেখানে অশুভ আত্মা তার বীজ বপন করে।

আমি তাদের পূজা করেছি তারা আমাকে দেবতা হিসাবে বরণ করে নেবে।

পিটার স্থাণুর মত বসে রয়। সে তার হাতের প্রাচীন চাকুটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।

আমি তোমাকে বলছি, মাল’আখ বলে। আমি স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গ করছি। তোমার চুড়ান্ত ভূমিকা স্থির হয়ে আছে। তুমি আমাকে আমার দেহ থেকে মুক্তি দেবে। তুমি এটা করবে নয়তো তুমি তোমার বোন তোমার গুরুভাই সবাইকে হারাবে। তুমি তখন সত্যিই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। সে হেসে তার। বন্দির দিকে তাকায়। এটাকে তোমার শেষ শাস্তি হিসাবে বিবেচনা কর।

পিটার চোখে তুলে মাল’আখের দিকে তাকায়। তোমাকে হত্যা করবো? একটা শাস্তি? তোমার কি মনে হয় আমি ইতস্তত করবো? তুমি আমার ছেলেকে খুন করেছে। আমারে মাকে হত্যা করেছে। আমার পুরো পরিবার।

না! মাল’আখ এমনভাবে ক্ষেপে উঠে যা তাকেও বিস্মিত করে। তোমার ধারণা ভুল! আমি তোমার পরিবারের হত্যাকারী নই। সেটা তুমি নিজে। তুমিই জ্যাকারিয়াকে কারাগারে পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। আর সেখান থেকেই নিয়তির চাকা ঘুরতে শুরু করে। পিটার তুমি তোমার পরিবারের হত্যাকারী আমি নই।

পিটারের আঙ্গুলের গাট সাদা হয়ে যায় সে চাকুটা প্রচণ্ড শক্তি আঁকড়ে ধরলে। তুমি কিছুই জানো না আমি কেন জ্যাকারিয়াকে জেলখানায় রেখে এসেছিলাম।

আমি সব জানি! মাল’আখ পাল্টা চিৎকার করে। আমি সেখানে ছিলাম। তুমি বলেছিলে তুমি তাকে সাহায্য করতে চাও। তুমি কি তাকে সাহায্য করেছিলে যখন তুমি তাকে জ্ঞান না সম্পদ বেছে নিতে বলেছিলে। তাকে ম্যাসন সঙ্গে যোগ দেবার সময়সীমা বেধে দেয়ার সময়ে কি তুমি তাকে সাহায্য করেছিলে। কোন বাবা তার ছেলেকে জ্ঞান আর সম্পদের ভিতরে বেছে নিতে বলতে পারে। কোন বাবা তাকে বাসায় নিরাপদে ফিরিয়ে নেবার বদলে জেলখানায় রেখে যায়। মাল’আখ এবার পিটারের সামনে এসে নীচু হয় তার উল্কি আঁকা মুখটা তার মুখ থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে অবস্থান করে। কিন্তু সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ…কোন বাবা তার নিজের ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে…হোক এত বছর পরে…এবং তাকে চিনতে ব্যর্থ হয়!

মাল’আখের শব্দ পাথরের চেম্বারে কয়েক সেকেণ্ড প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

তারপরে নিরবতা নেমে আসে।

সেই সহসা নিরবতায়, পিটার যেন তার আবিষ্টতা থেকে ভুলুণ্ঠিত হন। তার মুখে পরিপূর্ণ অবিশ্বাসের ছায়া খেলা করতে থাকে।

হ্যাঁ বাবা। আমিই। মাল’আখ এই মুহূর্তটার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছে…যে লোকটা তাকে পরিত্যাগ করেছিল তার উপরে প্রতিশোধ নেবার জন্য…তার ধুসর চোখের দিকে তাকিয়ে এতগুলো বছর চেপে রাখা সত্যি কথাটা তাকে বলবে বলে এখন সময় হয়েছে এবং সে ধীরে ধীরে কথা বলে যাতে তার শব্দের ভারে পিটার সলোমনের আত্মা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়। বাবা তোমার খুশী হওয়া উচিত। তোমার অমিতব্যায়ী ছেলে ফিরে এসেছে।

পিটারের মুখ মৃতের মত বিবর্ণ দেখায়।

প্রতিটা মুহূর্ত মাল’আখ উপভোগ করে। আমার বাবা আমাকে জেলখানায় ফেলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়…আর সেই মুহূর্তে আমি শপথ নেই সে আমাকে শেষবারের মত পরিত্যাগ করেছে। আমি আর তার সন্তান নই। জ্যাকারিয়া সলোমনের সেখানেই মৃত্যু ঘটে।

তার বাবার সহসা কষ্টের দুটো অশ্রুবিন্দুর সৃষ্টি হয় এবং মাল’আখ ভাবে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য সে আর তার জীবনে দেখেনি।

পিটার অশ্রু দমন করে মাল’আখের দিকে তাকায় যেন সে এই প্রথম তাকে দেখছে।

ওয়ার্ডেন কেবল টাকা চেয়েছিল, মাল’আখ বলে, কিন্তু তুমি দিতে অস্বীকার কর। কিন্তু তোমার কাছে মনে হয়নি আমার টাকাও সবুজ রঙের। ওয়ার্ডেন টাকা কে দিল সেটার পরোয়া করে না সে কেবল টাকা চেনে। আমি যখন তাকে টাকা দেব বলি সে আমার আঁকৃতির এক কয়েদি খুঁজে বের করে। তাকে বেধড়ক পিটিয়ে চেনার অযোগ্য করে হত্যা করে। যে ছবি তুমি দেখেছিলে…যে বন্ধ শবাধার সমাধিস্থ করেছিলে…সেটা আমার ছিল না। এক অচেনা আগন্তুকের ছিল।

পিটারের কান্না গড়িয়ে পড়া মুখ অবিশ্বাস আর যন্ত্রণায় বিকৃত দেখায়। হা খোদা…জাকারিয়া।

এখন আর নই। জ্যাকারিয়া জেল থেকে রূপান্তরিত হয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

তার অপরিপক্ক শরীর আর শিশুসুলভ মুখমণ্ডল নাটকীয়ভাবে বদলে যায় পরীক্ষামূলক গ্রোথ হরমোন আর স্টেরয়েডের প্রয়োগে। এমনকি তার কণ্ঠস্বর এর সংক্রমণ থেকে রেহাই পায় না, তারা কচি কণ্ঠস্বর নাকি ফিসফিস পরিণত করে।

জাকারিয়া পরিণত হয় এনড্রোসে।
এ্যানড্রোস পরিণত হয় মাল আখে।
আর আজরাতে…মাল’আখ তার সবচেয়ে মহান অবতারে অধিষ্ঠিত হবে।

.

সেই মুহূর্তে ক্যালোরমা হাইটসে ক্যাথরিন সলোমন খোলা ড্রয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখে পুরাতন সংবাদ পত্র আর আর্টিকেলের একটা সংগ্রহ যাকে কেবল কোন বদ্ধ সংস্কারকের সংগ্রহ বলে তার মনে হয়।

আমি বুঝতে পারি নি, সে বেল্লামির দিকে তাকিয়ে বলে। এই পাগলটা নিঃসন্দেহে আমার পরিবারের বিষয়ে আগ্রহী কিন্তু

বলতে থাকো…বেল্লামি একটা চেয়ারে বসে বলে এখনও তাকে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে।

ক্যাথরিন খবরের কাগজের আর্টিকেলগুলো ঘাটতে থাকে প্রতিটাই তাদের পরিবারের সাথে সম্পর্কিত- পিটারের সাফল্য গাথার সংবাদ, ক্যাথরিনের গবেষণা, তাদের মায়ের নির্মম মৃত্যু, জ্যাকারিয়া সলোমনের বহুল আলোচিত মাদক ব্যবহার, টার্কিশ প্রিজনে তার কারাবাস আর মৃত্যু।

সলোমন পরিবারের প্রতি এই লোকের আগ্রহ উগ্রতাকেও হার মানায় কিন্তু ক্যাথরিন এখনও বুঝতে পারে না কেন।

ছবিগুলো ঠিক তখনই তার চোখে পড়ে। জ্যাকারিয়া গ্রীসের নীল পানির সমুদ্র সৈকতে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীস? ইউরোপে মচ্ছব করার সময়ে তোলা ছবি হবে এটা সে ভাবে। কিন্তু পাপারাজ্জিদের তোলা ছবির চেয়ে তাকে এখানে অনেক স্বাস্থ্যবান দেখাচ্ছে। তাকে অনেক পরিণত, শক্তিশালী আর ফিট দেখায়। ক্যাথরিন তাকে এতটা স্বাস্থ্যবান কখনও দেখেনি।

বিভ্রান্ত হয়ে সে ছবিব ডেটটা দেখে।

কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব…অসম্ভব।

জেলখানায় মারা যাবার প্রায় একবছর পরে তোলা ছবি এটা।

ক্যাথরিন সহসা বেপরোয়াভাবে ছবির তোড়াটা উল্টাতে শুরু করে। সবগুলোই জ্যাকারিয়া সলোমনের…ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠছে। ছবিগুলো অনেকটা চিত্রিত জীবন গাথা, ক্রমিক রূপান্তরের একটা স্মারক। ক্যাথরিন আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকে ছবিতে যখন জ্যাকারিয়ার শরীরে ভাঙাগড়ার খেলা শুরু হয়, তার পেশী ফুলতে শুরু করে, স্টেরয়েডের প্রভাবে মুখের গড়ন বদলে যেতে থাকে। তার দেহকাঠামো যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠে আর চোখে জন্ম নেয় একটা ভীতিকর হিংস্রতা।

এই লোককে আমি চিনি না!

ক্যাথরিনের কিশোর ভাস্তের সাথে এই লোকের কোনই মিল নেই।

সে যখন তার কামানো মাথার একটা ছবি দেখতে পায়, সে টের পায় তার হাঁটু ভেঙে আসতে চাইছে। সে তার নগ্ন দেহের একটা ছবি দেখে…প্রথম। আঁকা উল্কির ছোঁয়ায় মগ্ন।

তার হৃৎপিণ্ড যেন ভার বইতে পারে না। ওহ্ ঈশ্বর…

.

১২০ অধ্যায়

ডান দিকে! লেক্সাসের পেছনের সীট থেকে ল্যাংডন বলে।

সিমকিনস ছেচড়ে এস স্ট্রীটে প্রবেশ করে এবং গাছপালা ঘেরা আবাসিক এলাকার ভিতর দিয়ে ছুটে চলে। সিক্সটিন্থ স্ট্রীটের বাঁকে আসলে ডান দিকে হাউজ অব দি টেম্পল একটা পাহাড়ের মত দৃশ্যমান হয়।

সিমকিনস বিশাল কাঠামোেটার দিকে তাকায়। তার মনে হয় রোমের প্যান্থেয়নের উপরে কেউ একটা পিরামিড বসিয়ে দিয়েছে। সে মোলতে বাক নিয়ে ভবনের সামনে পৌঁছাবার জন্য প্রস্তুত হয়।

বাঁক নিয়ো না! ল্যাংডন চেঁচিয়ে উঠে। সোজা যেতে থাকো! এসেই থাকো!

সিমকিনস কথা মত কাজ করে, ভবনের পূর্বপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।

পনেরতে মোড় ঘুরবে, ল্যাংডন বলে। ডান দিকে! সিমকিনস তার পথ নির্দেশকের কথা চালায় এবং মুহূর্ত পরে ল্যাংডন হাউজ অব টেম্পলের পেছনের বাগানে প্রায় অদৃশ্য একটা ফুটপাথ বিহীন রাস্তা দেখায়। সিমকিনস রাস্তায় উঠে আসে এবং ভবনের পেছনে এসে পৌঁছে।

দেখো! ল্যাংডন পেছনের প্রবেশ পথের কাছে পার্ক করা একমাত্র গাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে। একটা বিশাল ভ্যান। তারা এখানেই আছে।

.

সিমকিনস গাড়ি পার্ক করে ইঞ্জিন বন্ধ করে। নিরবে সবাই গাড়ি থেকে নেমে আসে এবং অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নেয়। সিমকিনস একশিলা কাঠামোর দিকে তাকায়। তুমি বললে টেম্পল রুম সবচেয়ে উপরের তলায় অবস্থিত?।

ল্যাংডন মাথা নেড়ে ভবনের শীর্ষের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায়। পিরামিডের কাটা মাথাটা আসলে একটা আলো প্রবেশের গবাক্ষ।

সিমকিনস চমকে উঠে ল্যাংডনের দিকে তাকায়। টেম্পল রুমে গবাক্ষ আছে?

ল্যাংডন গাড়লের দিকে তাকিয়ে আছে এমন ভঙ্গিতে তাকায়। অবশ্যই আছে। একটা গোলাকার গবাক্ষ স্বর্গের দিকে উৎসরিত…ঠিক একেবারে বেদীর উপরে অবস্থিত।

.

ইউএইচ-৬০ অলস ভঙ্গিতে ডুপন্ট সার্কেলে বসে আছে।

ডিরেকটর সাটো প্যাসেঞ্জার সিটে বসে নখ কামড়ায়, তার দলের কাছ। থেকে সংবাদের প্রতিক্ষা করছে।

অবেশেষে রেডিওতে সিমকিনসের গলা পাওয়া যায়। ডিরেকটর?

সাটো বলছি, সে ধমকে উঠে।

আমরা ভবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, কিন্তু আমি আপনাকে একটা নতুন রিকন দিতে চাই।

বকতে থাকো।

মি. ল্যাংডন এইমাত্র জানিয়েছেন টেম্পল রুমে যেখানে আমাদের টার্গেটের অবস্থানের প্রচুর সম্ভাবনা সেখানে একটা বড় গবাক্ষ রয়েছে।

সাটো তথ্যটা কিছুক্ষণ বিবেচনা করে। বুঝেছি, ধন্যবাদ তোমাকে।

সিমকিনস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

সাটো মুখ থেকে নখের টুকরো ফেলে পাইলটের দিকে তাকায়। বেটিকে আঁকাশে তোল।

আগের পর্ব :

০১. বিশ্বজুড়ে সমাদৃত আইফেল টাওয়ার
০২. পিটার ফোন ধরছে না কেন
০৩. দি এ্যাপোথেসিস অব ওয়াশিংটন
০৪. ত্রিস ডান কিউবের উজ্জ্বল আলো
০৫. পাথরের পিরামিড
০৬. ক্যাথরিন সলোমন
০৭. আজকের রাতটাই প্রথম না
০৮. স্টিম শাওয়ারের তরঙ্গায়িত উষ্ণতার মাঝে
০৯. ভূ-গর্ভস্থ স্থান
১০. ক্যাথিড্রাল কলেজের ভিতরে
১১. রবার্টকে ওখান থেকে
পরের পর্ব :

১৩. এক সন্তান হারানো পিতামাতা
১৪. ওয়াশিংটন মনুমেন্টর মধ্যে দিয়ে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত