দ্যা লস্ট সিম্বল: ১১. রবার্টকে ওখান থেকে

দ্যা লস্ট সিম্বল: ১১. রবার্টকে ওখান থেকে

১০১ অধ্যায়:

রবার্টকে ওখান থেকে তোমাকে বের করতেই হবে! ক্যাথরিন মিনতি করে, কান্নায় ভেঙে পড়ে। তুমি যা চাও আমরা তাই করবো! পানি ভেতরে অব্যাহত গতিতে প্রবেশ করতে থাকলে সে এখন ল্যাংডনকে আরও উন্মত্তের মত বাক্সের ভেতরে ধড়ফড় করতে শোনে।

উল্কি আঁকা শয়তানটা কেবল মুচকি হাসে। তোমার ভাইয়ের চেয়ে তুমি অনেক নরম। পিটারকে তার রহস্যের কথা আমাকে বলার জন্য কত কিছু যে। করতে হয়েছিল…

সে কোথায়?! ক্যাথরিন জানতে চায়। কোথায় পিটার? বল আমাকে! আমরা তুমি যা বলেছো ঠিক তাই করেছি। আমরা পিরামিডের পাঠোদ্ধার করেছি এবং-

না তোমরা পিরামিডের পাঠোদ্ধার করোনি, তোমরা চালাকি করেছে। তোমরা তথ্য গোপন রেখে এক সরকারী এজেন্টকে আমার বাসায় নিয়ে এসেছে। এমন কাজ যা আমাকে কেবল ক্ষিপ্তই করেছে।

আমাদের কোন উপায় ছিল না, সে বলে, কান্নার আবেগ এখন অনেক সামলে নিয়েছে। সিআইএ তোমাকে খুঁজছে। তারা এজেন্টকে আমাদের সাথে জোর করে গুছিয়ে দিয়েছে। আমি তোমাকে সব বলবো। রবার্টকে কেবল বের কর! সে রবার্টকে বাক্সের ভেতর কাটা মুরগীর মত ছটফট আর গোঙাতে শোনে এবং পাইপ দিয়ে পানি অনরবতভাবে প্রবেশ করছে দেখে। সে বুঝতে পারে। সময় আর বেশি নেই।

চিবুক ঘষতে ঘষতে উল্কি আঁকা লোকটা শান্ত কণ্ঠে কথা বলে। আমার ধারণা ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যারে আরও এজেন্ট আমার জন্য ওঁত পেতে আছে?

ক্যাথরিন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলে বিশাল দানবটা তার গামলার মত হাতের তালু দিয়ে ক্যাথরিনের কাঁধ চেপে ধরে তাকে সামনের দিকে ধীরে ধীরে টানতে থাকে। তার হাত চেয়ারের পেছনে বাঁধা থাকায় তার কাঁধ টান খায়, ব্যথায় জ্বলতে থাকে মনে হয় যেন ছিঁড়ে আসবে।

হ্যাঁ! ক্যাথরিন বলে। ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যারে এজেন্ট আছে!

সে আরও জোরে টানে। শিরোশোভার উপরের ঠিকানাটা কি?

ক্যাথরিনের কাঁধ আর কব্জির ব্যথা অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে কিন্তু তারপরেও সে চুপ করে থাকে।

ক্যাথরিন তুমি আমাকে এখনও বলতে পার নয়তো তোমার কাঁধ গুঁড়িয়ে দিয়ে আমি আবার জানতে চাইবো।

আট, ব্যথায় হাঁসফাঁস করে সে কোনমতে বলে। কালো কালির নীচের সংখ্যাটা আট! শিরোশোভায় লেখা বলা আছে: দি সিক্রেট হাইডস উইথইন দি অর্ডার–আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার। আমি শপথ করে বলছি আমি এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না। এটা আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার!

লোকটা এখনও তার কাঁধ ছাড়েনি।

আমি এটুকুই কেবল জানি! ক্যাথরিন বলে। এটাই ঠিকানায় আমার কাঁধ ছাড়ো! রবার্টকে ট্যাঙ্ক থেকে বের কর।

আমি করবো…লোকটা বলে, কিন্তু একটা সমস্যা আমি আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যারে গেলে ধরা পড়বো। আমাকে বল সেখানে কি আছে?

আমি জানি না!

আর পিরামিডের তলদেশের প্রতীকগুলো? তুমি তার মানে জানো?

তলদেশের আবার কিসের প্রতীক? ক্যাথরিন তার কথা বুঝতে পারে না। জায়গাটা মসৃণ আর খালি পাথর।

সাহায্যের জন্য শবাধরের মত বাক্সের ভিতর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতিনা দেখিয়ে উল্কি আঁকা লোকটা ল্যাংডনের ডেব্যাগের কাছে গিয়ে পিরামিডটা বের করে। তারপরে ক্যাথরিনের কাছে এসে সেটা তার চোখের সামনে ধরে দেখার জন্য।

ক্যাথরিন খোদাই করা প্রতীকগুলো দেখলে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু…এটা কিভাবে সম্ভব?

খোদাই করা প্রতীকগুলো
পিরামিডের পাদদেশে জটিল প্রতাঁকের খোদাই করা আঁকৃতি ভরে আছে। আগে এখানে কিছু ছিল না। আমি নিশ্চিত জানি! তার এসব প্রতাঁকের মানে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। প্রতীকগুলো দেখে মনে হচ্ছে সব মরমী ধারা জুড়ে তারা বিস্তৃত যার অনেকগুলো সম্বন্ধে তার কোন ধারণা নেই।

সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা।

আমি. ..আমি জানি না এদের মানে কি, সে বলে।

আমিও জানি না, বন্দিকর্তা বলে। সোভাগ্যবশত আমাদের কাছে একজন বিশেষজ্ঞ আছেন। তাকেই জিজ্ঞেস করা যাক কি বল? সে পিরামিডটা শবাধারের কাছে নিয়ে আসে।

সামান্য সময়ের জন্য ক্যাথরিন আশাবাদী হয়ে উঠে যে সে হয়ত ঢাকনা খুলবে। তার বদলে সে শান্ত ভঙ্গিতে বাক্সের উপরে উঠে বসে একটা ছোট প্যানেল এক পাশে সরায় ঢাকনায় একটা প্লেক্সিগ্নাসের ছোট জানালার সৃষ্টি হয়।

.

আলো!

ল্যাংডন চোখ কুঁচকে উপর থেকে বন্যার মত ভেসে আসা আলোর দিকে। তাকায়। তার দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক হলে আশার বদলে বিভ্রান্তি তাকে পেয়ে বসে। সে বাক্সের উপরে একটা জানালার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারে। জানালা দিয়ে একটা সাদা ছাদ আর ফ্লুরোসেন্ট আলো দেখা যায়।

কোন আগাম জানান না দিয়ে উল্কি আঁকা লোকটা জানালা দিয়ে উঁকি দেয়।

ক্যাথরিন কোথায়?! ল্যাংডন চেঁচিয়ে উঠে। আমাকে এখন বের কর।

লোকটা হাসে। তোমার বন্ধু ক্যাথরিন আমার কাছে আছে, লোকটা বলে। তার প্রাণ বাচাবার ক্ষমতা আমার আছে। তোমার জীবনও। কিন্তু তোমার হাতে সময় কম, তাই আমি বলবো মন দিয়ে আমার কথা শোন।

ল্যাংডন কাঁচের বাইরে থেকে তার কথা ভাল মত শুনতে পায় না, আর পানি এখন তার বুকের উপরে উঠে এসেছে।

তুমি কি জানো, লোকটা জিজ্ঞেস করে, পিরামিডের তলদেশে খোদাই করা রয়েছে?

হ্রঅ! ল্যাংডন চেঁচিয়ে বলে, উপরের তলায় পিরামিডটা উল্টে পড়ে থাকার সময়ে সে দেখেছে। কিন্তু তাদের মানে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই! উত্তর আছে সেখানে! শিরোশোভার সেটাই-

প্রফেসর তুমি আর আমি আমরা উভয়েই জানি সিআইএ সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি একটা ফাঁদের ভিতরে হেঁটে যেতে চাই না। আর তাছাড়া আমার সড়ক নাম্বার দরকার নেই। স্কোয়্যারে কেবল একটা ভবনই আছে যা সম্ভবত এর সাথে সম্পর্কিত- দি আলমাস শ্রাইন টেম্পল। সে থেকে লাঙ্গডনের দিকে তাকিয়ে থাকে। দি এ্যানশিয়েন্ট এ্যারাবিক অর্ডার অফ নোবলস অফ দি মিস্টিক শ্রাইন।

ল্যাংডন বিভ্রান্ত বোধ করে। সে আলমাস টেম্পলের সাথে পরিচিত কিন্তু ওটা সে ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যারে সেটা ভুলে গিয়েছিল। দি ইনারসরাই…দি অর্ডার? তাদের টেম্পলই গোপন সিঁড়ির উপরে স্থাপিত? কোন ঐতিহাসিক অর্থ সে বুঝতে পারে না কিন্তু ল্যাংডন এই মুহূর্তে ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের মত কোন অবস্থায় নেই। হ্যাঁ, সে চেঁচিয়ে উঠে। এটাই সেটা! দি সিক্রেট হাইডস উইথইন দি অর্ডার!

তুমি ভবনটার সাথে পরিচিত?।

অবশ্যই!ল্যাংডন তার দপদপ করতে থাকা মাথা পানির উপরে তোলে যাতে দ্রুত বাড়তে থাকা পানি কানে প্রবেশ না করে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব! আমাকে এখান থেকে বের করো!

তার মানে তোমার ধারণা তুমি বিশ্বাস কর এই প্রতাঁকের সাথে টেম্পলের যোগসূত্র তুমি বলতে পারবে?

হ্যাঁ, আমাকে কেবল প্রতীকগুলো দেখতে দাও।

বেশ, দেখা যাক তুমি কি বলতে পার।

দ্রুত! উষ্ণ পানি দ্রুত বাড়তে থাকায় সে ঢাকনাটা ঠেলতে থাকে আশা করে লোকটা সেটা খুলবে। দয়া করে তাড়াতাড়ি কর! কিন্তু ঢাকনাটা খুলে না। তার বদলে প্লেক্সিগ্নাসের জানালায় পিরামিডের তলদেশটা ভেসে উঠে।

ল্যাংডন আতঙ্কিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

আমার বিশ্বাস এভাবে তুমি ভালই দেখতে পাচ্ছ? লোকটা তার উল্কি আঁকা হাতে পিরামিডটা ধরে থাকে। দ্রুত চিন্তা কর প্রফেসর। আমার মনে হয় ষাট সেকেণ্ডেরও কম সময় আছে তোমার হাতে।

.

১০২ অধ্যায়

রবার্ট ল্যাংডন প্রায়ই এটা বলতে শুনেছে কোন প্রাণীকে কোণঠাসা করে ফেললে সে অলৌকিক শক্তির নমুনা প্রদর্শিত করে থাকে। সেও একইভাবে, তার পুরো শক্তি বাক্সের ভেতরে প্রয়োগ করে, কিছুই হয় না। তার চারপাশে তরল ধীরে ধীরে উপরে উঠতেই থাকে। ছয় ইঞ্চির কম শ্বাস নেবার জায়গা বাকি থাকতে, ল্যাংডন তার মাথা বাতাসের বাকি অংশটুকুতে তুলে নিয়ে আসে। প্লেক্সিগ্নাসের জানালার দিকে সে পিরামিডের নীচের অংশে তাকিয়ে থাকে, তার হতবুদ্ধি করা প্রতীক তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে।

এর মানে সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই নেই।

পাথরের গুড়ো আর মোমের শক্ত আবরণের নীচে কয়েক শতাব্দি ঢাকা থাকার পরে ম্যাসনিক পিরামিডের শেষ খোদাই অবশেষে উন্মুক্ত হয়েছে। সম্ভাব্য সব ধারার প্রতীক একটা বর্গাকার গ্রীডে খোদাই করা রয়েছে– অ্যালকেমীক্যাল, জ্যোতির্বিদ্যা, হেরালডিক, এ্যাঞ্জেলিকম ম্যাজিক্যাল,সংখ্যাতত্ত্বীয়, সিজিলিক, গ্রীক, ল্যাটিন। প্রতাঁকের সম্পূর্ণতায়, পুরোপুরি বিশৃঙ্খলা- একটা পাত্র ভর্তি অক্ষর যা পৃথিবীর সব ভাষা, সময় আর সংস্কৃতির।

সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা।

খোদাই করা প্রতীকগুলো
সিম্বলিক রবার্ট ল্যাংডন তার শিক্ষাগত পেশার পুরোটা ব্যয় করেও বুঝতে পারে না এই গ্রিড থেকে কিভাবে কোন অর্থ আদৌ বের করা সম্ভব। বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা? অসম্ভব।

তরল এখন গলার,কণ্ঠার হাড় ছুঁই ছুঁই করছে আর ল্যাংডন টের পায় তার আতঙ্কও পানির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। সে বাক্সের ভিতরে আঘাত অব্যাহত রাখে। বিদ্রূপ করে যেন পিরামিডটা তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

উন্মত্তের মত সে তার পুরো মানসিক শক্তি দিয়ে প্রতীকগুলোর দিকে তাকায়। এদের মানে আসলেই কি হতে পারে? দুর্ভাগ্যবশত সমাবেশটা এতটাই বৈষম্যপূর্ণ যে সে বুঝতেই পারে না কোথা থেকে শুরু করবে। তারা ইতিহাসের একই সময়কালেরও না।

বাইরে থেকে চাপা কিন্তু শ্রবণযোগ্য স্বর ভেসে আসে, বোঝা যায় ক্যাথরিন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে ল্যাংডনের মুক্তি ভিক্ষা চাইছে। সামাধান খুঁজে পেতে তার। ব্যর্থতা মৃত্যুর সম্ভাবনায় গোপন শব্দ, দেহের প্রতিটি কোষকে উদ্দীপিত করে তুলে একটা সমাধান বের করার অভিপ্রায়ে। সে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করে যা সে আগে কখনও অনুভব করেনি। ভাবো! সে গ্রিডটা ভাল করে দেখে, একটা সূত্র খুঁজে পেতে সে মরীয়া- একটা বিন্যাস, একটা গোপন শব্দ, কোন বিশেষ প্রতীক, যেকোন কিছু- সে কেবল অসম্পর্কিত প্রতাঁকের একটা বিন্যাস দেখে।

প্রতিটা সেকেণ্ড পার হবার সাথে সাথে, একটা আতঙ্কিত করে তোলা অবশভাব ল্যাংডন তার দেহে অনুভব করে। যেন তার দেহের প্রতিটা কোষ তার মনকে মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে আড়াল করতে চাইছে। পানি এবার তার কানের ভিতরে প্রবেশের উপক্রম করছে এবং সে মাথা যতটা উপরে তোলা সম্ভব তুলে বাক্সের নীচের দিকে চেপে ধরে। তার চোখের সামনে ভীতিকর সব ছবি ভেসে উঠতে শুরু করে। নিউ ইংল্যাণ্ডে একটা ছেলে একটা ইদারার পানিতে সাঁতার কাটছে। রোমে একটা প্রাপ্তবয়স্ক লোক উল্টে যাওয়া কফিনের কঙ্কালের নীচে আটকে পড়েছে।

ক্যাথরিনের চিৎকার ক্রমেই ক্ষ্যাপাটে শোনায়। ল্যাংডন বুঝতে পারে সে পাগল লোকটাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে। বোঝাতে চাইছে আলমাস টেম্পলে না গিয়ে ল্যাংডনের পক্ষে পিরামিডের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না। সেখানেই এই ধাঁধার বাকী অংশ রয়েছে! রবার্ট সব সূত্র ছাড়া কিভাবে পাঠোদ্ধার করবে?!

ল্যাংডন তার চেষ্টার প্রশংসা করে কিন্তু বুঝতে পারে আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার মোটেই এ্যাডমস টেম্পল নির্দেশ করছে না। সময়ের নিরিখে গোলমাল আছে। কিংবদন্তি অনুসারে ম্যাসনিক পিরামিড ১৮০০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ তৈরী করা হয়েছে শ্রাইন তৈরী হবার কয়েকদশক আগে। ল্যাগড়ন বুঝতে পারে কোয়্যারের নাম ফ্রাঙ্কলিন হবার আগের ঘটনা এটা। শিরোশোভাটা কোন মতেই একটা নামহীন প্রান্তরে তৈরী না হওয়া ভবন নির্দেশ করতে পারে না। আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার এমন কোন একটা স্থান বোঝাচ্ছে যার ১৮৫০ সালে অস্তিত্ব ছিল।

দুর্ভাগ্যবশত ল্যাংডন চেতনা হারিয়ে ফেলতে থাকে।

সময়ের সাথে খাপ খায় এমন কিছু একটা সে বেপরোয়া গতিতে ভাবতে শুরু করে। আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার? ১৮৫০ সালে যার অস্তিত্ব ছিল। ল্যাংডনের কিছুই মনে পড়ে না। তরল এবার তার কানে প্রবেশ করছে। আতঙ্কের সাথে লড়াই করতে করতে সে কাঁচের প্রতাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি সম্পর্কটাই ধরতে পারছি না! মৃত্যুভয়ে তার মন সম্ভব অসম্ভব সব ধরণের সাদৃশ্য কল্পনা করতে থাকে।

আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার, স্কোয়্যার…এই গ্রিডের প্রতীকগুলো স্কোয়্যারবন্দি…স্কোয়্যার আর কম্পাস ম্যাসনিক প্রতীক… ম্যাসনিক বেদী বর্গাকার…স্কোয়্যারে আছে নব্বই ডিগ্রী। পানি উঠতেই থাকে কিন্তু ল্যাংডন পাত্তা দেয় না। আট ফ্রাঙ্কলিন…আট…এই গ্রিডটা আট-বাই-আট…আট ফ্রাঙ্কলিন…আট…এই গ্রিডটা আট-বাই-আট…ফ্রাঙ্কলিনে আটটা অক্ষর…দি অর্ডার আট অক্ষর…আট হল অসীমের উল্টোদিকে ঘুরান প্রতীক …সংখ্যাতত্ত্বে আট ধ্বংসের প্রতীক…

ল্যাংডন থই পায় না।

ট্যাঙ্কের বাইরে, ক্যাথরিন তখনও অনুনয় করতে থাকে। কিন্তু ল্যাংডনের শ্রবণ ক্ষমতা পানির ঢেউয়ে ছলকে যেতে থাকে।

…জানা না থাকলে অসম্ভব…শিরোশোভার বাণী পরিষ্কারভাবে…দি সিক্রেট হাইডস উইথইন-

তার পরে তার কথা আর শোনা যায় না।

পানি ল্যাংডনের কানে প্রবেশ করেছে, ক্যাথরিনের শেষ স্বরটুকু শুষে নিয়ে। সহসা একটা মাতৃজঠরের স্তব্ধতা তাকে ঘিরে ফেলে ল্যাংডন বুঝতে পারে এবার

সে সত্যি সত্যিই মারা যাচ্ছে।

দি সিক্রেট হাইডস উইথইন—
ক্যাথরিনের শেষ বাক্যটা তার সমাধির স্তব্ধতার ভিতরে অনুরণিত হয়
দি সিক্রেট হাইডস উইথইন–

আজব ব্যাপার ল্যাংডনের মনে পড়ে এই শব্দগুলো সে আগে অনেকবার শুনেছে।

দি সিক্রেট হাইডস…উইথইন

এখন পর্যন্ত তার মনে হচ্ছিল প্রাচীন রহস্যময়তা তাকে বিদ্রূপ করছে। দি সিক্রেট হাইডস উইথইন রহস্যময়তার মর্মমূলের বস্তু যা মানুষকে শিখিয়েছে ঈশ্বরকে উপরে স্বর্গে না খুঁজে…নিজের ভিতরে খুঁজে দেখতে। দি সিক্রেট হাইডস উইথইন। এটাই সব সূফী সাধকদের বাণী।

যীশু বলেছেন, ঈশ্বরের রাজত্ব তোমার ভেতরেই লুকিয়ে আছে।

পিথাগোরাস বলেছেন, নিজেকে জানো।

হার্মেস ট্রিসমেজিসটাস বলেছেন, জেনো যে তুমিই ঈশ্বরের প্রতিভূ।

আরো অনেক আছে…

সব সূফী মতবাদ এটাই বলতে চেয়েছে। দি সিক্রেট হাইডস উইথইন। মানুষ তবুও ঈশ্বরের মুখের সন্ধানে আঁকাশের দিকে তাকিয়েছে বারবার।

এই উপলব্ধি ল্যাংডনের জন্য একটা সত্যিকারের বিড়ম্বনা বয়ে আনে। তার আগে মৃত অন্যসব অন্ধ লোকদের মত তার চোখ স্বর্গের দিকে তাকিয়ে আছে। রবার্ট ল্যাংডন সহসা আলো দেখতে পায়।

বজ্রপাতের মত বিষয়টা তাকে আঘাত করে।

দি

অর্ডার হাইডস

উইথইন দি অর্ডার

আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার

নিমেষের ভিতরে সে বুঝতে পারে।

শিরোশোভার বাণী ফটিক স্বচ্ছ হয়ে যায়। অর্থটা সারারাত তার দিকে তাকিয়ে ছিল। শিরোশোভার বাণী, ম্যাসনিক পিরামিডের মত একটা সিম্বলন–টুকরো করা সঙ্কেত- কয়েক খণ্ডে লিখিত বাণী। শিরোশোভার বাণী এমন মামুলিভাবে আড়াল করা হয়েছিল যে ল্যাংডন আর ক্যাথরিন সেটা বুঝতে পারেনি সেটা তার বিশ্বাসই হতে চায় না।

তারচেয়েও অবাক করা ব্যাপার শিরোশোভার বাণী আদতেই পিরামিডের প্রতাঁকের পাঠোদ্ধারের সূত্র দেখিয়েছে। খুবই সাধারণ ব্যাপার। পিটার সলোমনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, শিরোশোভা একটা শক্তিশালী টালিসমান বিশৃঙ্খলার ভিতরে শৃঙ্খলা আনয়নে।

ল্যাংডন আবার বাক্স ধাক্কাতে শুরু করে। আমি জানি! আমি জানি!

তার মুখের উপর থেকে পাথরের পিরামিড ভেসে উঠে সরে যায়। তার জায়গায় হাজির হয় উল্কি আঁকা মুখ, রক্ত হিম করা একটা দৃশ্য জানালা দিয়ে দেখা যায়।

আমি সমাধান করেছি! ল্যাংডন চিৎকার করে বলে। আমাকে এখান। থেকে বের করো।

উল্কি আঁকা লোকটা কি বলে পানির জন্য সে শুনতে পায় না। তার চোখ অবশ্য, বুঝতে পারে সে কি বলছে, আমাকে বলো।

আমি বলবো! ল্যাংডন আর্তনাদ করে উঠে পানি তার চোখে প্রবেশ করছে। আমাকে বের করো! আমি সব ব্যাখ্যা করবো! খুবই সহজ।

লোকটা ঠোঁট আবার নড়ে। আমাকে বলো…নইলে মরো।

পানি শেষ ইঞ্চি খালি জায়গা ভরতে শুরু করলে ল্যাংডন তার মাথা বাক্সে। ঠেকায় মুখ পানির উপরে রাখার জন্য। সেটা করতে গিয়ে, গরম পানি তার চোখে প্রবেশ করে, দৃষ্টি ঝাঁপসা করে দেয়। পিঠ বাঁকা করে সে তার মুখ প্লেক্সিগ্নাসের নীচে ঠেকিয়ে রাখে।

তখন কয়েক সেকেণ্ড বাতাস অবশিষ্ট থাকতে সে ম্যাসনিক পিরামিড কিভাবে পাঠোদ্ধার করতে হবে সেটা বলতে শুরু করে।

সে কথা শেষ করতে পানি তার ঠোঁটের উপরে উঠে আসে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে ল্যাংডন বড় শ্বাস নিয়ে মুখ বন্ধ করে। এক মুহূর্ত, তরল তাকে। পুরো গ্রাস করে, তার পুরো শবাধারটা ছাপিয়ে উঠে প্লেক্সিপ্লাসে ছড়িয়ে যায়।

.

সে পেরেছে, মাল’আখ উপলব্ধি করে। ল্যাংডন পিরামিডের পাঠোদ্ধার করেছে।

উত্তরটা খুবই সাধারণ। খুবই স্বাভাবিক।

জানালার নীচে রবার্ট ল্যাংডনের বেপরোয়া আর সাহায্যপ্রার্থী চোখ তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

মাল’আখ তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে আর ধীরে মুখ নেড়ে বলে: ধন্যবাদ প্রফেসর। পরের জীবন উপভোগ কর।

.

১০৩ অধ্যায়

কঠোর সাঁতারু হবার কারণে ল্যাংডন প্রায়ই একটা কথা ভাবতে পানিতে ডুবে ডাবার অনুভূতি কেমন। সে এবার হাতেনাতে সেটা প্রথমবারের মত বুঝতে যাছে। সে যদিও অন্য যেকোন লোকের চেয়ে বেশি দম রাখতে পারে, সে বুঝতে বাতাসের অভাবে তার দেহ বিদ্রোহ করতে চাইছে। রক্তে কার্বনডাই অক্সাইড মিশে গিয়ে প্রবৃত্তিকে প্ররোচিত করছে শ্বাস নিতে। শ্বাস নেয়া চলবে না। প্রতিমুহূর্তে শ্বাস নেবার সহজাত প্রবৃত্তি বেড়ে চলেছে। ল্যাংডন জানে শীঘ্রই সে শ্বাসরোধী পর্যায়ে পৌঁছাবে–চুড়ান্ত মুহূর্ত যে সময়ে একটা লোক তার। শাস আর আটকে রাখতে পারে না।

ঢাকনা খোলো! ল্যাংডনের প্রবৃত্তি ছটফট মোচড়াতে চায় কিন্তু সে জানে সেটা কেবল মূল্যবান অক্সিজেন নষ্ট করবে। সে কেবল তার সামনের স্বচ্ছ স্থানটুকু পানির নীচে ঝাঁপসাভাবে তাকিয়ে থাকে আর আশায় বুক বাঁধে। বাইরের পৃথিবী এখন কেবল একটা ঝাঁপসা আলোর নামান্তর প্লেক্সিপ্লাসের বাইরে। তার ভেতরের মাংসপেশীতে জ্বালা শুরু হয় বুঝতে পারে হাইপেক্সিয়া শুরু হচ্ছে।

সহসা একটা সুন্দর মুখ উপরে ভেসে উঠে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার নরম অভিব্যক্তি তরলের পর্দার আড়ালে কেমন মায়াবী দেখায়। তাদের। চোখাচোখি হয় প্লেক্সিগ্নাসের আবরণের দুপাশে এবং এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয় সে বেঁচে যাচ্ছে। ক্যাথরিন! তার পরে সে তার আতঙ্কে চাপা কান্নার সুর শুনে বুঝতে পারে সেখানে তাকে তাদের বন্দিকর্তা ধরে রেখেছে। উল্কি আঁকা দানবটা তাকে তার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য করছে।

ক্যাথরিন আমি দুঃখিত…

পানির নীচে আটকে পড়ে এই অদ্ভুত অন্ধকার স্থানে ল্যাংডনের বিশ্বাস হতে চায় না এখানে তাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত কাটাতে হবে। শীঘ্রই তার অস্তিত্ব বিলীন হবে…সে যা কিছু . বা তার সম্ভাবনা,, সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। তার মস্তিষ্কের মৃত্যু হলে, তার সমস্ত স্মৃতি যা কিছু সে শিখেছিল সব রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভণ্ডুল হয়ে যাবে।

এই মুহূর্তে, ল্যাংডন উপলব্ধি করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কাছে নিজের তুচ্ছতা। একটা নিঃসঙ্গ বিনয়ী মুহূর্ত যা সে আগে কখনও অনুভব করেনি। প্রায় কৃতজ্ঞতার সাথে সে টের পায় শ্বাসরোধী মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে।

তার সময় হয়েছ।

ল্যাংডনের ফুসফুস তার ভেতরের বাতাস বের করে দেয় শ্বাস নেবার অদম্য। আঁকাভক্ষায় চুপসে আসে। সে তারপরেও কিছুক্ষণ দম আটকে থাকে। তার অন্তি ম মুহূর্ত। তারপরে একটা লোক যখন আর গরম পা ধরে রাখতে না পেরে ছেড়ে দেয় সেভাবে সে নিয়তির হাতে নিজেকে সপে দেয়।

প্রবৃত্তি যুক্তিকে ছাপিয়ে যায়। তার ঠোঁট ভাগ হয়। তার ফুসফুস প্রসারিত হয়। এবং তরল ভিতরে প্রবেশ করতে থাকে।

ল্যাংডনের বুকে যে ব্যথ্যা ছড়িয়ে পড়ে তেমন কিছু সে আগে অনুভব করেনি। তার ফুসফুঁসে প্রবেশ করে তারা জ্বালা ধরিয়ে দেয়। নিমেষে ব্যথা মাথায় উঠে আসে এবং সে টের পায় তার মাথা শিরস্ত্রাণের ভিতরে যেন দুমড়ে যায়। তার কানে মুহুহু বজ্রপাত হয় তার ভিতরে সে ক্যাথরিনের চিৎকার শুনতে পায়।

চোখ ধাঁধান আলোর একটা ঝলসানি।

এবং তারপরে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়।

রবার্ট ল্যাংডন আর নেই।

.

১০৪ অধ্যায়

সব শেষ।

ক্যাথরিন সলোমন চিৎকার বন্ধ করেছে। এইমাত্র সে ডুবে যাবার যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে তা তাকে বিমূঢ়, হতাশা আর বেদনায় দৃশ্যত পঙ্গু করে ফেলে।

প্লেক্সিগ্নাসের জানালার নীচে, ল্যাংডনের ভোলা চোখের দৃষ্টি তাকে ছাড়িয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। তার নিথর মুখে যন্ত্রণা আর আক্ষেপের অভিব্যক্তি। শেষ একটা বাতাসের বুদবুদ তার খোলা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আর নিজের আত্মাকে ছেড়ে দেবার অভিপ্রায়ে রবার্ট ধীরে পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে…ছায়ার ভিতরে সে হারিয়ে যায়।

সে মারা গেছে। ক্যাথরিন বিবশ হয়ে আসে।

উল্কি আঁকা লোকটা নীচু হয়ে নির্দয় নির্মমতায় ছোট জানালাটা বন্ধ করে দেয়, ল্যাংডনের লাশ অদৃশ্য হয়ে যায়।

তারপরে তার দিকে তাকিয়ে সে হাসে। আমরা এবার যেতে পারি?

ক্যাথরিন কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশের আগে, সে তার বিষাদ ভারাক্রান্ত দেহ ঝটকা দিয়ে সরিয়ে নিয়ে তাকে কাঁধে তুলে নেয়, আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কয়েক পা সদর্পে এগিয়ে সে হলের শেষ প্রান্তে চলে আসে একটা বেশ খোলা জায়গা যেটা লালচে-বেগুনী আলোয় আলোকিত। ঘরটায় ধূপের গন্ধ। সে তাকে ঘরের ভিতরে একটা চারকোণা পাথরের টেবিলের উপরে জোরে নামিয়ে রাখলে তার বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে যায়। পিঠের নীচে সে শীতল আর শক্ত একটা কিছু অনুভব করে। এটা কি পাথরের?

ক্যাথরিন সুস্থির হয়ে উঠতে উঠতে লোকটা তার হাত আর পায়ের বাঁধন খুলে ফেলে। সে সহজাত প্রবৃত্তির বশে তাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু হাত পায়ে কোন সাড়া পায় না। সে এবার তাকে চামড়ার ফালি দিয়ে টেবিলে বেঁধে ফেলতে শুরু করে, দুহাত পা দুদিকে ছাড়ান অবস্থায় সে তাকে বাঁধে। শেষে সে তার উদরের উপরে একটা শেষ চামড়ার ফালি দিয়ে পেচায়।

কয়েক সেকেণ্ড লাগে পুরো ব্যাপারটা ঘটতে আর ক্যাথরিন আবারও নড়াচড়া করতে পারে না। তার হাত পা দবদব করে আবার রক্ত চলাচল শুরু হতে।

মুখ খোলো, লোকটা ফিসফিস করে বলে, নিজের উল্কি আঁকা ঠোঁট চাটতে চাটতে।

ক্যাথরিন দাঁতে দাঁত চেপে থাকে বিতৃষ্ণায়।

লোকটা আবার তার তর্জনী ঠোঁটের চারপাশে বুলায়, তার চামড়া কুঁচকে আসে। সে আরো জোরে দাঁত চাপে। উল্কি আঁকা লোকটা হাসে এবং অন্য হাতে গলার একটা প্রেশার পয়েন্ট খুঁজে নিয়ে সেখানে চাপ দেয়। ক্যাথরিনের মুখ সাথে সাথে খুলে যায়। সে টের পায় তার আঙ্গুল মুখের ভিতরে ঢুকে জিহ্বা উপরে নড়ছে। সে শ্বাসরুদ্ধ হতে কামড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু আঙ্গুলটা ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। হাসতে হাসতে সে তার ভেজা আঙ্গুল তার চোখের সামনে এনে ধরে। এবং এরপরে চোখ বন্ধ করে সে আরো একবার মাথার উল্কিহীন অংশে সেটা ঘষতে থাকে।

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুলে আর তারপরে আতঙ্কিত করে তোলার মত শান্ত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

সহসা আপতিত হওয়া নিরবতায়, ক্যাথরিন নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পায়। তার মাথার উপরে উদ্ভট একটা আলোর বিন্যাস বেগুনী থেকে লালচে বর্ণ। ধারণ করছে ঘরের নীচু ছাদ আলোকিত হয়ে উঠে। সে ছাদটা দেখার পরে কেবল সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। পুরো এলাকাটা ছবি দিয়ে ভরা। তার। মাথার উপরে দিব্য আঁকাশের মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত একটা কোলাজ। গ্রহ তারা নক্ষত্র জ্যোতির্বিদ্যার প্রতাঁকের সাথে মিশেছে। সেখানে আছে অনুমিত তীর, বৃত্তাকার গোলক, উত্থানের জ্যামিতিক চিহ্ন, আর রাশিতত্ত্বের প্রাণীরা উপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক কোন উন্মাদ সিসিটিন চ্যাপেলে ঢুকলে যা হতে পারে।

ক্যাথরিন মাথা ঘুরায়, এবং বামে তাকিয়ে দেখে সেদিকেও একই অবস্থা। মধ্যযুগীয় মোমদানিতে জ্বলতে থাকা মোমের আলোয় দেখা যায় ছবি, ড্রয়িং আর টেক্সটে দেয়ালটা পুরো ঢাকা। কিছু কিছু দেখে মনে হয় প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে ছিঁড়ে নেয়া প্যাপিরাস বা ভেলামের পাতা, অন্যগুলো নিশ্চিতভাবেই নতুন বই ম্যাপ, ড্রয়িং, ছবি সব ছকবদ্ধ দেয়ালে নিষ্ঠার সাথে আঠা দিয়ে লাগান হয়েছে। তার উপরে সূতার একটা জাল বিভিন্ন বিন্যাস তৈরী করে অসংখ্য সম্ভাবনার জন্ম। দিয়েছে।

ক্যাথরিন অন্যদিকে মাথা ঘুরায়। দুর্ভাগ্যবশত সেদিকে সবচেয়ে ভীতিকর দৃশ্যটা সে দেখতে পায়।

পাথরের যে চাইটার উপরে সে বাঁধা অবস্থায় আছে তার ঠিক পাশেই একটা ছোট যন্ত্রপাতি রাখার সাইড কাউন্টার টেবিল অনেকটা হাসপাতালের অপারেশন টেবিলের মত। কাউন্টারে অনেক কিছু সাজিয়ে রাখা আছে- সিরিঞ্জ, কালো তরলে ভর্তি কাঁচের ভায়াল…এবং একটা বিশাল চাকু যার বাটটা হাড়ের তৈরী আর ফলাটা লোহার অস্বাভাবিক তার ধার।

হায় ঈশ্বর…সে আমার সাথে কি করবে বলে ঠিক করেছে?

.

১০৫ অধ্যায়

সিআইএ সিস্টেম এনালিস্ট রিক পারিস যখন নোলার অফিসে শেষ পর্যন্ত আসে তার হাতে একটা কাগজের শিট দেখা যায়।

এত দেরী হল কেন? নোলা জানতে চায়। আমি সাথে সাথে তাকে আসতে বলেছিলাম।

দুঃখিত, পুরু কাঁচের চশমা নাকে উপরে ঠেলে দিয়ে সে বলে। আমি তোমার জন্য আরো তথ্য সংগ্রহ করতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু-

কি আছে সেটা কেবল আমাকে দেখাও।

পারিস তার হাতে প্রিন্টটা দেয়। সম্পাদিত কিন্তু মূলটা ঠিকই তুমি বুঝবে।

নোলা বিস্ময়ে পাতাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমি এখনও বুঝতে পারছি না হ্যাকার কিভাবে ঢুকল, পারিস বলে, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে একটা ডেলিগেটর স্পাইডার আমাদের গবেষণা হাতিয়ে নিয়ে

সেটা ভুলে যাও! নোলা পাতাটা থেকে চোখ তুলে নিয়ে বলে। সিআইএর সাথে পিরামিড, সিংহদ্বার আর খোদাই করা সিম্বলনের কি সম্পর্ক?

আমার সেজনই দেরী হয়েছে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম কোন কোন ডকুমেন্ট টার্গেট করা হয়েছে তাই আমি ফাইল পাথ ট্রেস করি, পারিস থেমে। গলা পরিষ্কার করে। এই ডকুমেন্টটা দেখা যায় সিআইএ ডিরেক্টরের ব্যক্তিগত পার্টিশানে অবস্থিত।

নোলা ঘুরে তাকায়, চোখে অবিশ্বাস। সাটোর বসের কাছে ম্যাসনিক। পিরামিড সম্পর্কিত ফাইল আছে? সে জানে যদিও সিআইএর বর্তমান ডিরেকটর এবং আরও অনেক উচ্চপদস্থ সিআইএ প্রশাসকরা উচ্চ পদস্থ ম্যাসন কিন্তু তাদের কেউ সিআইএর কম্পিউটারে ম্যাসনিক গুপ্ত তথ্য লুকিয়ে রাখবে সেটা কল্পনা করা অসম্ভব।

তারপরে আবার, গত চব্বিশ ঘন্টায় সে যা খেল দেখেছে সেটা ভেবে নিয়ে মনে মনে বলে হতেও পারে।

.

এজেন্ট সিমকিন্স পেটের উপরে ভর দিয়ে ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যারের ঝোঁপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। তার চোখ আলমাস টেম্পলের স্তম্ভযুক্ত প্রবেশপথ খুটিয়ে দেখে। কিছু নেই। ভেতর থেকে কোন আলো দেখা যায় না আর কেউ দরজার দিকে যায়নি। সে মাথা ঘুরিয়ে বেল্লামির দিকে তাকায়। পার্কের মাঝে লোকটা বেকুবের মত পায়চারি করছে, মুখের অভিব্যক্তি শান্ত। সত্যিই শান্ত। সিমকিনস তাকে কাঁপতে আর হাঁপাতে দেখে।

তার ফোন কেঁপে উঠে। সাটোর ফোন।

আমাদের টার্গেট আসার সময় কতক্ষণ আগে পার হয়েছে? সে জানতে চায়।

সিমকিনস তার ক্রোনোগ্রাফের দিকে তাকায়। টার্গেট বলেছিল বিশ মিনিট। এখন প্রায় চল্লিশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। কিছু গড়বড় হয়েছে।

বুঝেছি কি হয়েছে, সাটো বলে। সে আসছে না।

সিমকিনস বুঝতে পারে সে ঠিক কথাই বলছে। হার্টম্যান যোগাযোগ করেছে?

সে ক্যালোরমা হাইটস থেকে একবারও যোগাযোগ করেনি। আমিও ফোনে তাকে পাইনি।

সিমকিনস আড়ষ্ট হয়ে যায়। ব্যাপারটা সত্যি হলে আসলেই গণ্ডগোল বেঁধেছে আর ভীষণ মাত্রার।

আমি ফিল্ড সাপোর্টের জন্য বলে পাঠাই, সাটো বলে, আর তারাও সেখানে কিছু পায়নি।

হলি শিট! তারা এসকালেডের জিপিএস লোকেশন পায়নি?

হ্যাঁ। একটা আবাসিক এলাকা, সাটো বলে। লোকদের ফিরে আসতে বল। আমরা এখান থেকে ফিরে যাচ্ছি।

সাটো ফোনের লাইন কেটে রাজধানীর রাজকীয় দিগন্ত রেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। শীতল বাতাস তার হাল্কা জ্যাকেটের প্রান্ত উড়িয়ে নেয় এবং সে দুহাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণ রাখতে। ডিরেকটর ইনউ সাটো সেইসব মেয়েদের কাতারে পড়ে না যাদের প্রায়ই ঠাণ্ডা লাগে…বা ভয়। এই মুহূর্তে সে অবশ্য দুটোই অনুভব করছে।

.

১০৬ অধ্যায়

মাল’আখ কেবল তার নেংটি পরে র‍্যাম্প দিয়ে উঠে আসে, ইস্পাতের দরজা খুলে বের হয় এবং ছবির আড়াল থেকে বসার ঘরে বেরিয়ে আসে। আমাকে দ্রুত প্রস্তুত হতে হবে। ফয়্যারে পরে থাকা মৃত সিআইএ এজেন্টের দিকে সে তাকায়। এই বাসা আর মোটেই নিরাপদ না।

পিরামিডটা হাতে নিয়ে সে সোজা নীচ তলায় তার স্টাডিতে প্রবেশ করে এবং ল্যাপটপ কম্পিউটারে সামনে বসে। নীচে ল্যাংডনের বাক্সবন্দি লাশের কথা ভাবে চিন্তা করে নীচের পানিতে ডুবে থাকা সাশটা কতদিন কত সপ্তাহ পরে কেউ খুঁজে পাবে। তাতে কিছু আসে যায় না। মাল’আখ ততদিনে সবার নাগালের বাইরে চলে যাবে।

ল্যাংডন তার ভূমিকা দারুণ পালন করেছে…প্রশংসনীয়।

ল্যাংডন ম্যাসনিক পিরামিডই কেবল সম্পূর্ণ করেনি সে প্রতাঁকের গ্রিড কিভাবে সমাধান করতে হবে সেটাও খুঁজে পেয়েছে। প্রথম দর্শনে প্রতীকগুলোকে পাঠোদ্ধারের অযোগ্য মনে হবে…এবং তারপরেও উত্তরটা খুবই সহজ…তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মাল আখের কম্পিউটার জীবন্ত হয়ে উঠে তার স্ক্রিনে আগের ই-মেইল এখন দেখা যায়- শিরোশোভার দীপ্তিমান একটা ছবি, বেল্লামির আঙ্গুলে অর্ধেক ঢাকা।

The
secret hides
within The Order.
–Franklin Square.

আট…ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার, ক্যাথরিন মাল’আখকে বলেছে। সে আরও বলেছে সিআইএ এজেন্ট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যারে ওত পেতে আছে তাকে ধরার জন্য এবং শিরোশোভা কিসের ইঙ্গিত করেছে সেটা বুঝতে। ম্যাসন? শ্রাইনারস? রোজিসিয়ানস?

এগুলোর একটাও না, মাল’আখ এখন জানে। ল্যাংডনই কেবল সত্যিটা দেখেছে।

দশ মিনিট আগে পানি তার মুখের উপরে উঠে আসবার সময়ে হার্ভাডের প্রফেসর পিরামিডের পাঠোদ্ধারের পথ খুঁজে পান। দি-অর্ডার-আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার! সে আতঙ্কিত চোখে চেঁচিয়ে বলেছিল। দি সিক্রেট হাইডস উইথইন। দি অর্ডার আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার!

মাল’আখ প্রথমে মানেটা বুঝতে পারেনি।

এটা কোন ঠিকানা না! প্লেক্সিগ্নাসের কাঁচে ঠোঁট ঠেকিয়ে সে বলেছে। দি অর্ডার আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার! একটা ম্যাজিক স্কোয়্যার! সে তারপরে ডুরারের সম্বন্ধে কিছু বলে…এবং পিরামিডের প্রথম সঙ্কেত কিভাবে শেষ সঙ্কেত পাঠোদ্ধারে সহায়তা করবে।

মাল’আখ ম্যাজিক স্কোয়্যারের সাথে পরিচিত কামিয়াস, গোড়ার দিকে মরমীবাদীরা এই নামেই একে অভিহিত করতো। প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ডি অকাল্টা ফিলোসোফিয়ায় ম্যাজিক স্কোয়্যারের ক্ষমতা বর্ণনা করা হয়েছে এবং কিভাবে শক্তিশালী সিজিল তৈরী করতে হয় সংখ্যার ম্যাজিক্যাল গ্রিড ব্যবহার করে। আর ল্যাংডন তাকে বলেছে যে একটা ম্যাজিক স্কোয়্যার পিরামিডের নীচের সংকেত পাঠোদ্ধারে সহায়তা করবে।

আট-বাই-আটের একটা ম্যাজিক স্কোয়্যার তোমার দরকার? প্রফেসর রীতিমত চেঁচিয়ে বলে তার দেহের কেবল ঠোঁটই তখন পানির উপরে ভেসে আছে। ম্যাজিক স্কোয়্যার শ্ৰেণীবদ্ধ করা হয়েছে অর্ডার অনুসারে। তিন-বাই তিন অর্ডার তিন! চার-বাই-চার স্কোয়্যার অর্ডার চার! তোমার দরকার আট বাই-আটের অর্ডার।

পানি ল্যাংডনকে পুরোপুরি আপুত করে এবং প্রফেসর শেষ একটা মরীয়া শ্বাস নিয়ে একজন বিখ্যাত ম্যাসন…আমেনিকার প্রতিষ্ঠাতা পূর্বপুরুষ…একাধারে বিজ্ঞানী, মরমী সাধক, গণিতবিদ, আবিষ্কারক…এবং সেই সাথে মরমী কামিয়ার স্ৰষ্ট যা আজও তার নাম ধারণ করে আছে।

ফ্রাঙ্কলিন।

এক নিমেষে মাল’আখ বুঝতে পারে ল্যাংডন ঠিক কথাই বলছে।

এখন শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনায় মাল’আখ তার কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। সে দ্রুত একটা ওয়েব সার্চ করে, অনেক হিট পায় এবং একটা বেছে নিয়ে পড়তে শুরু করে।

দি অর্ডার আট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার

ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত ম্যাজিক স্কোয়্যার দি অর্ডার আট স্কোয়্যার প্রকাশিত হয় ১৭৬৯ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানী বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন কর্তৃক এবং এটা আগে কখনও দেখা যায়নি এমন বেন্ট ডায়াগনাল সামেশন অন্তর্ভূক্ত করার কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে। তার সময়ের বিখ্যাত অ্যালকেমিস্ট আর মরমী সাধকদের সাথে তার সখ্যতা আর জ্যোতির্বিদ্যায় নিজের আগ্রহ থেকে ফ্রাঙ্কলিনের এই আবিষ্টতা জন্মায় মরমী আর্ট ফর্মের প্রতি। আর এটাই তার ভবিষ্যদ্বাণী পুওর রিকার্ডস এ্যালম্যানাকের মূল সুর।

১ থেকে ৬৪ সংখ্যার অনন্য সমাবেশ
মাল’আখ ফ্রাঙ্কলিনের বিখ্যাত সৃষ্টি খুটিয়ে দেখে-১ থেকে ৬৪ সংখ্যার অনন্য সমাবেশ-যেখানে প্রতিটা রো, কলাম আর ডায়াগোনাল একই ম্যাজিকাল ধ্রুবক উৎপাদন করে। দি সিক্রেট হাইডস উইথইন দি অর্ডার এইট ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়্যার।

মাল’আখ হাসে। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে সে পাথরের পিরামিডটা ধরে উল্টে নীচের দিকটা পরীক্ষা করে।

খোদাই করা প্রতীকগুলো
এই চৌষট্টিটা প্রতীক পুনরায় বিন্যস্ত করে ভিন্ন ধারায় সাজাতে হবে যেভাবে ফ্রাঙ্কলিন ম্যাজিক স্কোয়্যারে বলে দেয়া আছে। মাল’আখ যদিও বুঝতে পারে না কিভাবে এই গ্রিড সহসা ভিন্নভাবে সাজাতে অর্থবোধক হয়ে উঠবে, কিন্তু প্রাচীন প্রতিশ্রুতির প্রতি তার বিশ্বাস আছে।

অর্ডো আর কাও।

সে একটা খালি পাতায় আট বাই আটের একটা গ্রিড আঁকে এবং তারপরে তাদের নতুন ক্রম অনুসানে তাদের সাজাতে শুরু করে। প্রায় সাথে সাথে তাকে বিস্মিত করে গ্রিডটা অর্থবোধক হয়ে উঠতে থাকে।

বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা।

সে পুরো পদ্ধতিটা সমাপ্ত করে এবং বিস্মিত হয়ে তার সামনের সমাধানের দিকে তাকিয়ে রয়। একটা সম্পূর্ণ ইমেজ জন্ম নিয়েছে। বিশৃঙ্খল গ্রিডটা রূপান্তি রিত হয়েছে…পূনর্বিন্যস্ত হয়েছে…মাল’আখ যদিও পুরো ইমেজটার মানে বুঝতে পারে না, সে এতটুকু বুঝতে পারে …যা তার জন্য যথেষ্ট সে শেষ পর্যন্ত কোথায় যাচ্ছে।

পিরামিডটা পথ প্রদর্শন করছে।

গ্রিডটা পৃথিবীর সবচেয়ে আধ্যাত্মিক স্থানের দিকে নির্দেশ করছে। অবিশ্বাস্যভাবে, এটা ঠিক একই অবস্থান মাল’আখ প্রায় চিন্তা করে যেখানে তার যাত্রা শেষ হবে।

নিয়তি।

.

১০৭ অধ্যায়

পাথরের টেবিলটা ক্যাথরিনের পিঠের নীচে শীতল অনুভূত হয়।

তার মানসচক্ষে কেবল রবার্টের বীভৎস মৃত্যু ভাসে, সাথে তার ভাইয়ের জন্য দুশ্চিন্তা। পিটারও কি মারা গিয়েছে? পাশে রাখা অদ্ভুতদর্শন চাকুটা তার তার ভাগ্যে কি থাকতে পারে সে বিষয়ে নানা স্বপ্নের জন্ম দেয়।

এটাই তাহলে ইতি?

তাকে অবাক করে দিয়ে নিজের গবেষণার ভাবনা তার মাথায় ভর করে…নিওটিক সাইন্স, এবং তার সাম্প্রতিক অগ্রগতি। এর পুরোটাই হারিয়ে গিয়েছিল…ধোঁয়ায় পরিণত হয়েছিল। সে পৃথিবীকে জানাতে পারবে না সে যা জেনেছে। তার সবচেয়ে বিহ্বল করা আবিষ্কার কেবল কয়েক মাস আগের ঘটনা আর এটা মৃত্যু সম্বন্ধে মানুষের ভাবনা আমূল বদলে দিতে পারে। অদ্ভুতভাবে, সেই গবেষণার কথা এখন ভাবাটা…তার মনে একটা অপ্রত্যাশিত সান্ত্বনা বয়ে আনে।

ছেলেবেলায় ক্যাথরিন প্রায়ই কল্পনা করতো মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে। স্বর্গ বলে কিছু কি সত্যিই আছে? আমরা মারা যাবার পরে কি হয়? বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় হতে তার মন থেকে স্বর্গ, নরক, পরকাল সম্বন্ধে কাল্পনিক ধারণা দূর হয়। মৃত্যুর পরে জীবনর ধারণা সে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় মানুষের বিনির্মাণ বলে…একটা রূপকথা যা আমাদের মরণশীলতা মেনে নিতে সাহায্য করে।

বা আমি তাই বিশ্বাস করতাম…।

এক বছর আগে, সে আর তার ভাই দর্শনের সবচেয়ে পুরাতন প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করছিলো- আত্মার অস্তিত্ব বিশেষ করে মানুষের এমন কোন সচেতনতাবোধ আছে কিনা যা দেহের বাইরে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে।

তাদের দুজনেরই ধারণা এমন একটা কিছুর অস্তিত্ব থাকতেও পারে। বেশিরভাগ প্রাচীন দর্শন এ বিষয়ে একমত হয়েছে। বৌদ্ধ আর ব্রাহ্মণ্য মতবাদে জন্মান্তরের ধারণা বলা হয়েছে- মৃত্যুর পরে নতুন দেহে আত্মার অধিষ্ঠান; প্যাটোনিস্টরা দেহকে একটা পিঞ্জর বলেছে যেখান থেকে আত্মা পালিয়ে যায়; স্টোয়িকসরা আত্মাকে বলেছেন এ্যাপোসপিসমা তোউ থিউ–ঈশ্বরের ক্ষুদ্র অংশ- বিশ্বাস করত মৃত্যুর পরে ঈশ্বর সেটা নিজের কাছে নিয়ে আসতেন।

মানুষের আত্মার অস্তিত্ব, ক্যাথরিন হতাশার সাথে লক্ষ্য করেছে যা কখনও। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়নি। মৃত্যুর পরে একটা সচেতনতাবোধ। মানুষের দেহের বাইরে বেঁচে থাকে ব্যাপারটা অনেকটা হুক্কায় টান দিয়ে বহু বছর পরে তার ধোয়া খোঁজার সামিল।

তাদের আলোচনার পরে ক্যাথরিনের ভিতরে একটা আজব ধারণা জন্ম নেয়। তার ভাই তাকে বুক অব জেনেসিসের কথা আর এতে লিপিবদ্ধ আত্মার ধারণা কথা বলেছিল নেশহেমাহ- এক ধরণের আধ্যাত্মিক বোধশক্তি যা দেহ থেকে আলাদা। ক্যাথরিনের কাছে মনে হয়েছে বোধশক্তি শব্দটা ভাবনার অস্তি ত্বের কথা বোঝায়। নিওটিক সাইন্স পরিষ্কারভাবে দাবী করে ভাবনার একটা ভর আছে আর তাহলে সঙ্গত কারণেই মানুষের আত্মারও ভর থাকতে পারে।

মানুষের আত্মা কি ওজন করা সম্ভব?

ভাবনাটাই অবশ্য অসম্ভব, এ নিয়ে চিন্তা করাটাও সময় নষ্ট করার সামিল।

এর পরের ঘটনা রাতের বেলা ক্যাথরিনের ঘুম ভেঙে যায় এবং সে বিছানায় সোজা হয়ে উঠে বসে। সে লাফিয়ে উঠে তৈরী হয়ে নেয় এবং সোজা ল্যাবে। আসে এবং একটা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে যা নিতান্তই সাদামাটা …

এবং ভীতিকর রকমের সাহসী।

সে বুঝতে পারে না তার ধারণা অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব কিনা তাই সে পরীক্ষাটা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত পিটারকে কিছু না জানানর সিদ্ধান্ত নেয়। তার চারমাস সময় লাগে এবং ক্যাথরিন একদিন তার ভাইকে ল্যাবে নিয়ে আসে। সে একটা বিশাল চাকাঅলা সামগ্রী ঠেলে নিয়ে আসে যা সে পেছনের স্টোরেজ রুমে লুকিয়ে রেখেছিল।

আমি নিজে এটার নক্সা করেছি, পিটারকে নিজের উদ্ভাবন দেখিয়ে সে বলে। কিছু বুঝতে পারছো?

তার ভাই বিচিত্র যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইনকিউবেটর?

ক্যাথরিন হেসে উঠে মাথা নাড়ে যদিও যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত অনুমান। হাসপাতালে যেমন দেখা যায় অনেকটা সেধরণের স্বচ্ছ ইনকিউবেটরের মতই দেখতে যন্ত্রটা। মেশিনটা অবশ্য বড়দের সাইজের অনেকটা ভবিষ্যত প্রজন্মের লম্বা, বায়ুনিরোধক, পরিষ্কার প্লাস্টিক ক্যাপসূল আঁকৃতির স্লিপিং পড। সেটা আবার আরেকটা বিশাল বৈদ্যুতিক অনুষঙ্গের উপরে স্থাপিত।

দেখে তো, এবার কিছু বুঝতে পার নাকি, বিচিত্র কলটায় বৈদ্যুতিক সংযোগ দিয়ে সে বলে। একটা ডিজিটাল ডিসপ্লে আলোকিত হয়ে উঠে এবং সে কয়েকটা ডায়াল নাড়াচাড়া করতে সেখানে সংখ্যার নাচানাচি শুরু হয়।

সে কাজ শেষ করলে ডায়ালে দেখা যায় লেখা আছে:
০.০০০০০০০০০০ কেজি

.

পরিমাপক যন্ত্র, পিটার বিস্মিত কণ্ঠে বলে।

এটা কোন সাধারণ পরিমাপক না, সে কাছের কাউন্টারের উপর থেকে এক টুকরো কাগজ তুলে নিয়ে সেটা আলতো করে ক্যাপসুলের উপরে রাখে। ডিসপ্লের সংখ্যাগুলো আবার উঠানামা শুরু করে এবং এবার একটা নতুন পাঠ দেখায়।

০.০০০৮১৯৪৩২৫ কেজি।

হাই-প্রিসিশস মাইক্রোব্যালেন্স, সে বলে।

কয়েক মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পরিমাপ করতে সক্ষম।

পিটার এখনও কিছু বুঝতে পারে না। তুমি একজন লোককে…মাপার জন্য এই প্রিসিশন-স্কেল বানিয়েছো?

ঠিক তাই। সে যন্ত্রটার স্বচ্ছ ঢাকনা তুলে। আমি যদি একটা লোককে এর ভেতরে রেখে ঢাকনা বন্ধ করে দেই সে তাহলে একটা পুরোপুরি নিরোধক ব্যবস্থার ভিতরে অবস্থান করবে। কিছুই ঢুকতে বা বের হতে পারবে না। কোন বায়বীয় পদার্থ, কোন প্রকার তরল, কোন ধরণের ধূলিকণা কিছুই না। কিছুই বিচ্যুত হতে পারবে না- লোকটার শ্বাসপ্রশ্বাস, ঘাম, বা নিঃসৃত কোন তরল কিছুই এখান থেকে নিঃসৃত হবে না।

পিটার ক্যাথরিনের মতই মাথা ভর্তি রূপালি চুলে হাত বুলায় নাভাস বোধ করলে দুজনই একই মুদ্রাদোষ প্রদর্শন করে। হুমমম…নিশ্চিতভাবেই একজন এখানে দ্রুত মারা যাবে।

সে মাথা নাড়ে। খুব বেশি হলে ছয় মিনিট, নির্ভর করছে নিঃশ্বাসের বেগের উপরে।

পিটার তার দিকে তাকায়। আমি বুঝতে পারলাম না।

সে হাসে। শীঘ্রই বুঝতে পারবে।

মেশিনটা সেখানেই রেখে ক্যাথরিন পিটারকে কিউবটার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে আসে এবং একটা প্লাজমা দেয়ালের সামনে এনে বসিয়ে দেয়। হলোগ্রাফিক ড্রাইভে রক্ষিত একাধিক ভিডিও ফাইল সে এ্যাকসেস করতে শুরু করে। প্লাজমা দেয়াল জীবন্ত হয়ে উঠলে তাদের সামনের ইমেজ দেখে মনে হবে কোন ধরণের হোম ভিডিওর ফুটেজ।

ক্যামেরা প্রথমে একটা মধ্যবিত্ত শোবার ঘরে দৃশ্য দেখায় যেখানে একটা অগোছাল বিছানা দেখা যায় সাথে ঔষধের বোতল, রেসপিরেটর আর হার্ট মনিটর আছে। পিটার ধাঁধায় পড়ে যায় ক্যামেরা গতি অব্যাহত থাকলে, অবশেষে ঘরের ভিতরে শোবার ঘরের কেন্দ্রে ক্যাথরিনের বৈদ্যুতিক কল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

পিটারের চোখ বড় বড় হয়ে উঠে। কি সর্বনাশ…?

ক্যাপসুলের ঢাকনাটা ভোলা আর ভিতরে একজন বৃদ্ধকে অক্সিজেন মাস্ক পরিহিত অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়। পডের পাশে তার বৃদ্ধ স্ত্রী আর হাসপাতালের কর্মচারী দাঁড়িয়ে আছে। বৃদ্ধ লোকটার শ্বাস নিতে কষ্ট হচেছ দেখা যায় আর তার চোখ বন্ধ।

ক্যাপসুলে শুয়ে থাকা লোকটা ইয়েলে আমার বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিল, ক্যাথরিন বলে। তার সাথে আমার বহু বছরের পরিচয়। সে এখন ভীষণ অসুস্থ। সে সবসময়ে নিজের দেহ বিজ্ঞানের কাজে দান করতে চেয়েছে আর তাই আমি যখন তাকে আমার গবেষণার কথা খুলে বলি সে এক কথায় রাজি হয় এতে অংশ নেবার জন্য।

তার সামনে দৃশ্যপটের বিস্তার দেখে পিটার স্পষ্টতই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

হাসপাতালের কর্মচারী লোকটার স্ত্রীর দিকে তাকায়। সময় হয়েছে। সে প্রস্তুত।

বৃদ্ধা নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ আলতো করে স্পর্শ করে এবং দৃঢ়তার সাথে মাথা নাড়ে। ঠিক আছে।

খুব আলতো করে হাসপাতালের কর্মচারী পডের দিকে হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধ লোকটার অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেয়। লোকটা মৃদু নড়ে উঠে কিন্তু তার চোখ বন্ধই থাকে। কর্মচারীটা এবার রেসপিরেটর ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরিয়ে নেয়, বৃদ্ধ লোকটা ঘরের মধ্যে ক্যাপসুলের ভিতরে একেবারে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় শুয়ে থাকে।

মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের স্ত্রী এবার এগিয়ে এসে তার কপালে আলতো করে চুমু দেয়। বৃদ্ধ তার চোখ খুলে না কিন্তু তার ঠোঁটে হাল্কা একটা প্রেমপূর্ণ হাসির। আভাস খেলে যায়।

অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া বৃদ্ধের শ্বাস প্রশ্বাস অচিরেই কষ্টকর হয়ে উঠে। মহাপ্রস্থান নিকটেই। শ্রদ্ধা করার মত শক্তি এবং ধৈর্যের প্রদর্শন করে বৃদ্ধের স্ত্রী এবার পডের ঢাকনি বন্ধ করে দেয় ঠিক যেভাবে ক্যাথরিন তাকে দেখিয়েছে।

পিটার আশঙ্কায় গুটিয়ে যায়। ক্যাথরিন, এসব কি হচ্ছে?

সব ঠিক আছে, ক্যাথরিন ফিসফিস করে বলে। ক্যাপসুলে প্রচুর বাতাস আছে। সে এই ভিডিওটা বেশ কয়েকবার দেখেছে কিন্তু তারপরেও তার নাড়ীর স্পন্দন বেড়ে যায় প্রতিবার নতুন করে দেখার সময়ে। সে মৃত্যুপথযাত্রী লোকটার পডের নীচের স্কেল পিটারকে দেখায়। ডিজিটাল নাম্বার ওজন দেখায়:

৫১.৪৫৩৪৬৪৪ কেজি।

এটা তার শরীরের ওজন, ক্যাথরিন বলে।

বৃদ্ধ লোকটার শ্বাসপ্রশ্বাস আরও অস্পষ্ট হয়ে উঠে এবং পিটার বিবশের মত সামনে এগিয়ে বসে।

এটাই সে চেয়েছিল, ক্যাথরিন ফিসফিস করে বলে। দেখো কি হয়।

বৃদ্ধের স্ত্রী এবার বিছানায় বসে হাসপাতালের কর্মচারীর সাথে পডের দিকে নিরবে তাকিয়ে থাকে।

পরের ষাট সেকেণ্ডে লোকটা অস্পষ্ট শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হয়, তারপরে একটা সময়ে, যেন লোকটা নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে তার শেষ নিঃশ্বাস গ্রহণ করে। সবকিছু নিথর হয়ে যায়।

সব চুকে যায়।

বৃদ্ধা আর হাসপাতালের কর্মচারী নিরবে একে অন্যকে সান্ত্বনা দেয়।

আর কিছুই ঘটে না।

কয়েক সেকেণ্ড পরে এবার পিটার ক্যাথরিনের দিকে তাকায় বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে।

অপেক্ষা কর ব্যাপারটার জন্য, সে ভাবে, সে পিটারের দৃষ্টি ডিজিটাল ডিসপ্লের দিকে ফিরাতে ইঙ্গিত করে সেটা এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে মৃত লোকের ওজন দেখাচ্ছে।

তারপরে ব্যাপারটা ঘটে।

পিটার সেটা লক্ষ্য করে চমকে পিছিয়ে যায়, আরেকটু হলে সে চেয়ার থেকে পড়ে যেত। কিন্তু…এটা…সে হতবিহ্বল হয়ে মুখে হাত চাপা দেয়। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না…

পিটার সলোমন তার জীবনে বাক্য হারা হয়েছেন এমন ঘটনার সংখ্যা খুবই কম। ক্যাথরিনের অভিব্যক্তিও একই ছিল প্রথমবার যখন সে ব্যাপারটা ঘটতে দেখে।

লোকটা মারা যাবার কয়েক মুহূর্তের ভিতরে ডিজিটাল স্কেলের ওজন সূচকে সহসা একটা হ্রাস লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যুর পরপরই লোকটা আগের তুলনায় একটু হাল্কা হয়ে গেছে। ওজনের হ্রাসটা খুবই সূক্ষ কিন্তু সেটা পরিমাপযোগ্য…

আর এর ফলাফল একেবারেই মনকে চমকে দেবার মত।

ক্যাথরিনের মনে পড়ে সে তার ল্যাব নোটে কাঁপাকাঁপা হাতে লিখেছিল: মৃত্যুর মুহূর্তে মানুষের দেহ থেকে একটা অদৃশ্য বস্তু বের হয়ে যায় বলে মনে হয়। যা পরিমাপযোগ্য এবং কোন ধরণের ভৌত বেষ্টনী দিয়ে তাকে আটকানো সম্ভব না। আমার ধারণা এটা এমন এক মাত্রায় চলাচল করে যা এখনও আমার বোধগম্যতার বাইরে।

ভাইয়ের চেহারায় ফুটে ওঠা অভিঘাত দেখে ক্যাথরিন বুঝতে পারে সে এর ব্যঞ্জনা বুঝতে পেরেছে। ক্যাথরিন…সে কথা খুঁজে পায় না, চোখ পিটপিট করে যেন স্বপ্ন দেখছে কিনা নিশ্চিত হতে চাইছে। আমার মনে হয় এইমাত্র তুমি মানুষের আত্মা পরিমাপ করলে।

তারা দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে।

ক্যাথরিন বুঝতে পারে তার ভাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সব বিস্ময়কর আর চমকে দেবার মত প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করছে। সময় লাগবে পুরোটা আত্মস্থ করতে। তারা এইমাত্র যা প্রত্যক্ষ করল তা যদি আসলেই যা মনে হয়েছে সেটা হয়ে থাকে– যে প্রমাণ করা সম্ভব আত্মা, সচেতনতাবোধ বা প্রাণশক্তি দেহের খাঁচার বাইরে স্থানান্তরিত হতে পারে তাহলে অসংখ্য মরমী প্রশ্নের উপরে নতুন চমকপ্রদ নতুন একটা মাত্রা যোগ হল: আত্মার স্থানান্তর, মহাজাগতিক সচেতনতা, নিকট-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা, দূরদর্শন, লুসিড ভিউয়িং, নাক্ষত্রিক প্রক্ষেপণ এবং আরো অনেক অনেক প্রশ্ন। মেডিকেল জার্নালে এমন অনেক নজির আছে যেখানে অপারেশন টেবিলে রোগী মারা গেছে উপর থেকে নিজের শরীর অবলোকন করেছে এবং তারপরে আবার বেঁচে উঠেছে।

পিটার মৌন হয়ে যায় এবং ক্যাথরিন তার চোখে অশ্রু দেখতে পায়। সে কান্না চেপে রাখতে পারে না। পিটার আর ক্যাথরিন দুজনই তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে এবং যাদের এই অভিজ্ঞতা আছে তারাই বুঝতে পারবে মৃত্যুর পরে আত্মার বেঁচে থাকার সামান্যতম ধারণাও একটা আশার আলো দেখায়।

সে জ্যাকারিয়ার কথা ভাবছে, ভাইয়ের চোখে গভীর বিষণ্ণতা ফুঠে উঠেছে দেখে, ক্যাথরিন ভাবে। বহু বছর সন্তানের মৃত্যুর দায় পিটার নিজে কাঁধে বহন করে আসছে। সে ক্যাথরিনকে অনেকবার বলেছে জ্যাকারিয়াকে জেলখানায় রেখে আসাটা ছিল তার জীবনের চরমতম ভুল এবং এজন্য সে জীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।

দরজা বন্ধ হবার শব্দে ক্যাথরিনের চমক কাটে সে আবার বেসমেন্টের শীতল পাথরের টেবিলে ফিরে আসে। র‍্যাম্পের উপরের ধাতব দরজা শব্দ করে বন্ধ হয় এবং উল্কি আঁকা লোকটা আবার নীচে নামছে। সে নীচের অন্য একটা ঘরে প্রবেশ করে তাকে কিছু একটা করতে শোনে। সে তার ঘরের ভিতরে ঢুকলে ক্যাথরিন দেখে সে কিছু একটা নিজের সামনে ঠেলে নিয়ে আসছে। ভারী কিছু একটা…চাকা রয়েছে। সে আলোর নীচে আসলে, ক্যাথরিনের চোখে অবিশ্বাস ফুটে উঠে। উল্কি আঁকা লোকটা হুইলচেয়ারে করে একজনকে নিয়ে এসেছে।

বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে ক্যাথরিন হুইলচেয়ারে বসা লোকটাকে চিনতে পারে। কিন্তু তার আবেগ কিছুতেই সে যা দেখছে মেনে নিতে চায় না।

পিটার?

সে বুঝতে পারে না ভাইকে জীবিত দেখে তার খুশী হওয়া উচিত কিনা…নাকি আতঙ্কিত হওয়া উচিত। পিটারের পুরো শরীরের নোম ভালমত নাশ করা হয়েছে। তার মাথাভর্তি রূপালি চুল, চোখের ভ্রু কিছুই অবশিষ্ট নেই তার দেহের তুক এমনভাবে দ্যুতি ছড়ায় যেন তেল মাখান। তার পরণে একটা কালো রেশমের আলখাল্লা। তার ডান হাত যেখানে থাকার কথা সেখানে কেবল একটা ডালের মত অংশ দেখা যায় পরিষ্কার ব্যাণ্ডেজ দিয়ে মোড়ান। তার ভাইয়ের ব্যথায় কাতর চোখ ক্যাথরিনকে দেখলে সেখানে কেবল আক্ষেপ আর বিষাদ ফুটে উঠে।

পিটার! ক্যাথরিনের গলার স্বর ভেঙে যায়।

তার ভাই কিছু বলতে চেষ্টা করে কিন্তু গলা থেকে কেবল অব্যক্ত শদ বেরিয়ে আসে। ক্যাথরিন বুঝতে পারে তাকে হুইলচেয়ারের সাথে বেধে রাখা। হয়েছে এবং মুখে কাপড় গোজা আছে।

উল্কি আঁকা লোকটা নীচু হয়ে পিটারের কামান মাথায় আলতো করে চাপড় দেয়। আমি তোমার ভাইকে বিশাল সম্মানের জন্য প্রস্তুত করেছি। আজ রাতে তার একটা পালনীয় ভূমিকা আছে।

ক্যাথরিনের পুরো শরীর আড়ষ্ট হয়ে যায়। না…

পিটার আর আমি কিছুক্ষণের ভিতরে বিদায় নেব তার আগে ভাবলাম তুমি হয়ত তাকে শেষ বিদায় জানাতে চাইবে।

তুমি পিটারকে কোথায় নিয়ে যাবে? সে নিস্তেজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

সে হাসে। পিটার আর আমাকে অবশ্যই পবিত্র পাহাড়ে যেতে হবে। সেখানেই গুপ্তধনটা লুকান আছে। ম্যাসনিক পিরামিড তার অবস্থান প্রকাশ করেছে। তোমার বন্ধু রবার্ট ল্যাংডন খুবই সাহায্য করেছে।

ক্যাথরিন তার ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায়। সে রবার্টকে….খুন। করেছে।

তার ভাইয়ের চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ ফুটে এবং জোরে মাথা নাড়তে থাকে যেন সে এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছে না।

দেখো, দেখো, পিটার, লোকটা পিটারের চাঁদিতে আলতো চাপড় দিয়ে বলে। এই ক্ষণটার মাহাত্ম এভাবে বানচাল কোরো না। আদরের বোনকে শেষ বিদায় জানাও। এটাই তোমাদের শেষ পারিবারিক সাক্ষাৎ।

ক্যাথরিন টের পায় তার মন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তুমি কেন এটা করছো?! সে চিৎকার করে জানতে চায়। আমরা তোমার কি ক্ষতি করেছিলাম?! আমার পরিবারকে তুমি এত ঘৃণা কেন কর?!

উল্কি আঁকা লোকটা তার দিকে এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ক্যাথরিন আমার সঙ্গত কারণ আছে। তারপরে সে টেবিলের কাছে গিয়ে অদ্ভুতদর্শন চাকুটা হাতে নেয়। সে সেটা ক্যাথরিনের কাছে নিয়ে এসে এর চকচকে ধারাল ফলা তার গালে ছোঁয়ায়। এটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত চাকু বলা হয়ে থাকে।

ক্যাথরিন এমন কোন চাকুর কথা শোনেনি কিন্তু জিনিসটা দেখতে প্রাচীন আর ভীতিকর। ফলাটা টের পায় ক্ষুরের মত ধারাল।

ভয় পেয়ো না, সে বলে। এর ক্ষমতা তোমার উপরে নষ্ট করার আমার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই। আমি এটাকে অনেক পবিত্র একটা স্থানে…তোমার চেয়ে মূল্যবান বলিদানের জন্য সংরক্ষিত রেখেছি। সে এবার তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। পিটার চাকুটা তোমার পরিচিত, তাই না?

তার ভাইয়ের চোখে অবিশ্বাস আর ভয় একসাথে ফুটে আছে।

হ্যাঁ, পিটার এই প্রাচীন প্রত্নবস্তুটা এখনও টিকে আছে। আমি অনেক মূল্য দিয়ে এটাকে কুক্ষিগত করেছি…আর তোমার জন্য তুলে রেখেছি। অবশেষে তুমি আর আমি একসাথে আমাদের এই যন্ত্রণাদায়ক যাত্রা সমাপ্ত করবো।

কথাটা বলে সে চাকুটা তার অন্যসব উপকরণের সাথে- ধূপ, তরল ভর্তি কাঁচের ছোটশিশি, শাদা স্যাটিন, এবং অন্যান্য পূজার উপাচার- সে একটা কাপড় দিয়ে যত্ন করে জড়িয়ে নেয়। রবার্ট ল্যাংডনের চামড়ার ব্যাগ যার ভিতরে পাথরের পিরামিড আর শিরোশোভা আছে সেটার পাশে বলির উপকরণ নামিয়ে। রাখে। ক্যাথরিন অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখে লোকটা ব্যাগের চেন বন্ধ করে পিটারের দিকে তাকিয়েছে।

পিটার ব্যাগটা ধরবে, ভারী ব্যাগটা সে পিটারের কোলের উপরে রাখে।

এরপরে, সে ড্রয়ারের কাছে যায় এবং কি যেন খুঁজে। সে ছোট ছোট ধাতব বস্তুর বাড়ি খাবার শব্দ শোনে। ফিরে এসে লোকটা ক্যাথরিনের ডান হাত নিয়ে ভাল করে ধরে। ক্যাথরিন দেখতে পায় না সে কি করছে কিন্তু পিটার স্পষ্ট দেখতে পায় এবং পাগলের মত মাথা নাড়তে শুরু করে।

ক্যাথরিন সহসা ডান হাতের কনুইয়ের কাছে তীক্ষ্ণ খোঁচা অনুভব করে এবং একটা আতঙ্কজনক উষ্ণ কিছু চারপাশে গড়িয়ে পড়ে। পিটার যন্ত্রণাদগ্ধ চাপা শব্দ করে এবং চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। ক্যাথরিন একটা শীতল অসাড়তা কনুইয়ের নীচে থেকে আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে টের পায়।

লোকটা সরে গেলে ক্যাথরিন দেখতে পায় তার ভাই কেন এত আতঙ্কিত হয়েছিল। উল্কি আঁকা লোকটা একটা মেডিকেল নিডল তার শিরায় প্রবেশ করিয়েছিল যেন সে রক্ত দেবে। নিডলটা অবশ্য কোন টিউবের সাথে সংযুক্ত ছিল না। রক্ত নিডল এর ভিতর দিয়ে অবাধে প্রবাহিত হয়েছে, তার কনুই দিয়ে গড়িয়ে আঙ্গুলে এসে পাথরের টেবিলে পড়েছে।

একটা মানবিক বালিঘড়ি, লোকটা পিটারের দিকে ঘুরে বলে। কিছুক্ষণ পরে আমি যখন তোমাকে তোমার ভূমিকা পালন করতে আদেশ দেব তখন আমি চাই তুমি কল্পনা করবে ক্যাথরিন এখানে অন্ধকারের একা একা মারা যাচ্ছে।

পিটারের অভিব্যক্তি চরম নির্যাতনের ছাপ ফুটে উঠে।

সে এক ঘন্টা বা কিছু বেশি সময়, লোকটা বলে, বেঁচে থাকবে। তুমি যদি আমার সাথে সহযোগিতা কর তবে আমি তাকে বাচাবার প্রচুর সময় পাব। অবশ্য তুমি বেয়াদবি করলে…তোমার বোন এখানে অন্ধকারে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যাবে।

মুখ বন্ধ থাকায় পিটার অব্যক্ত স্বরে গুঙিয়ে উঠে।

আমি জানি, আমি জানি, লোকটা পিটারের কাঁধে একটা হাত রেখে বলে, তোমার জন্য এটা মানা কঠিন। কিন্তু সেটা হওয়া উচিত না। কারণ এই প্রথম তুমি তোমার পরিবারকে পরিত্যাগ করছে না। সে ঝুঁকে পিটারের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে কিছু বলে। আমি অবশ্যই তোমার ছেলে জ্যাকারিয়ার কথা বলছি যাকে তুমি সোগানলিক কারাগারে পরিত্যাগ করেছিলে।

পিটার তার বাঁধন ছিঁড়তে ব্যর্থ চেষ্টা করে এবং তার গলা দিয়ে আরেক দফা অব্যক্ত চিৎকার বেরিয়ে আসে।

বন্ধ কর? ক্যাথরিন থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠে।

সে রাতের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, লোকটা বিদ্রুপের কণ্ঠে বলে সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে। আমি পুরোটা শুনেছিলাম। ওয়ার্ডেন তোমাকে প্রস্তাব দিয়েছিল ছেলে নিয়ে যাবার জন্য কিন্তু তুমি জ্যাকারিয়াকে শিক্ষা দেবে বলে মনস্থির করেছিলে…তাকে ত্যাগ করেছিলে। তোমার ছেলের শিক্ষা হয়েছে, বটে, তাই না? লোকটা হাসে। তার ক্ষতি…আমার পৌষমাস।

লোকটা এবার লিনেনের একটা কাপড়ের টুকরো ক্যাথরিনের মুখে ভাল করে গুঁজে দেয়। মৃত্যু, সে তাকে ফিসফিস করে বলে, একটা স্বস্তিদায়ক জিনিস।

পিটার পাগলের মত চেয়ার ঝাঁকাতে থাকে। আর একটা কথাও না বলে, উল্কি আঁকা লোকটা পিটারকে শেষবারের মত তার বোনের দিকে দীর্ঘ একটা চাহনি দেবার সুযোগ দিয়ে ধীরে ধীরে পিটারের হুইলচেয়ার বের করে নিয়ে আসে।

ক্যাথরিন আর পিটার শেষবারের মত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তারপরেই সে দরজার বাইরে চলে যায়।

ক্যাথরিন তাকে র‍্যাম্প দিয়ে উঠে ধাতব দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে শুনে। তারা বেরিয়ে যেতে, ক্যাথরিন শুনতে পায় উল্কি আঁকা লোকটা ধাতব দরজায় তালা দিয়ে থ্রি গ্রেসেসের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়। কয়েক মিনিট পরে সে একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পায়।

তারপরে পুরো ম্যানসনে নিরবতা নেমে আসে।

ক্যাথরিন অন্ধকারে রক্তপাতের একান্ততায় মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে।

.

১০৮ অধ্যায়

রবার্ট ল্যাংডনের মন একটা অসীম গহ্বরে ভেসে বেড়ায়।

কোন আলো নেই। শব্দ নেই। নেই কোন অনুভূতি।

কেবল একটা অনন্ত আর নিরব শূন্যতা।

কোমলতা।

ওজনহীনতা।

তার দেহ তাকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। সে এখন বন্ধনহীন।

পার্থিব জগতের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। সময়ের ধারাপাত বলে আর কিছু নেই।

সে এখন কেবলই একটা সজ্ঞানতা…একটা দেহহীন চেতনা বিশ্ব চরাচরের শূন্যতায় আলম্বিত রয়েছে।

.

১০৯ অধ্যায়

রূপান্তরিত ইউএইচ-৬০ ক্যালোরমা হাইটসের ছড়ান ছাদের খুব কাছ দিয়ে উড়ে যায়, সাপোর্ট টিম তাদের সে অবস্থান দিয়ে সেদিকে তার সগর্জনে উড়ে চলা। এজেন্ট সিমকিসই প্রথম একটা ম্যানসনের সামনে কালো এসকালেড এলোপাথাড়ি পার্ক করা অবস্থায় সামনের সনে দেখতে পায়। ড্রাইভওয়ের গেট বন্ধ এবং ম্যানসনের সব আলো নেভান আর চারিদিকে নিস্তব্ধতা।

সাটো টাচডাউনের সঙ্কেত দেয়।

সামনের লনে আরো অনেকগুলো গাড়ির…যার একটা সিকিউরিটি সিডান ছাদে বাবল লাইট ভিতরে সাবলীল ভঙ্গিতে হেলিকপ্টারটা অবতরণ করে।

সিমকিনস আর তার দল মাটিতে নেমে অস্ত্র উঁচিয়ে পোর্চের দিকে এগিয়ে যায়। সামনের দরজা বন্ধ দেখে সিমকিনস দুহাত চোখের দুপাশে রেখে জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। ফয়্যার অন্ধকার কিন্তু সিমকিনস ঠিকই মেঝেতে একটা দেহ পড়ে থাকতে দেখে।

নিকুচি করেছি, সে ফিসফিস করে বলে। হার্টম্যান ওটা।

তার এক এজেন্ট পোর্চ থেকে একটা চেয়ার তুলে নিয়ে জানালার দিকে ছুঁড়ে দেয়। পেছনে গর্জন করতে থাকা হেলিকপ্টারের কারণে কাঁচ ভাঙার শব্দ খুব একটা পাওয়া টের পাওয়া যায় না। মুহূর্ত পরে তারা সবাই ভেতরে প্রবেশ করে। সিমকিনস ফয়্যারের উপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে হার্টম্যানের নাড়ী পরীক্ষা করে। সব নিথর। চারিদিকে রক্তের ছড়াছড়ি। তখনই সে হার্টম্যানের গলায় স্কুড্রাইভারটা এফোড়ওফোড় অবস্থায় দেখে।

খোদা। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার লোকদের পুরো এলাকাটা ভাল করে তল্লাশি করতে ইশারা করে।

তার এজেন্টরা নীচের তলায় ছড়িয়ে যায় তাদের লেজার ফুটকি বিলাসবহুল বাসা অন্ধকারে নাচতে থাকে। তারা লিভিংরুম বা স্টাডিতে কিছু খুঁজে পায়না কিন্তু খাবার ঘরে একটা মহিলা সিকিউরিটি অফিসারকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় মৃত দেখতে পায়। রবার্ট ল্যাংডন বা ক্যাথরিন সলোমনকে জীবিত খুঁজে পাবার আশা সিমকিনসের ক্রমেই কমে আসতে থাকে। এই নির্মম খুনী একটা ফাঁদ পেতে ছিল আর সে যদি সিআইএর এজেন্ট আর সিকিউরিটি কর্মীকে খুন করতে পারে তবে প্রফেসার আর বিজ্ঞানী তার কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু।

নিচের তলায় তল্লাশি শেষ হতে সে তার দুজন এজেন্ট উপরে পাঠায় তল্লাশি করতে। ইতিমধ্যে সে রান্নাঘরে একটা সিঁড়ি বেসমেন্টের দিকে নেমে যেতে দেখে। সিঁড়ির নীচে সে আলো ফেলে দেখে বেসমেন্ট বেশ প্রশস্ত এবং দেখে মনে হয় ব্যবহৃত হয় না। বয়লার, সিমেন্টের আস্তরহীন দেয়াল আর কয়েকটা বাক্স পড়ে আছে। এখানে কিছু নেই। সে ঘুরে দাঁড়াতে উপর তলা থেকে তার লোকেরা নেমে আসে, মাথা নেড়ে জানায় কিছু পায়নি।

বাড়িটা পরিত্যাক্ত।

কেউ নেই, আর কোন লাশও কোথাও নেই।

সিমকিনস সাটোকে রেডিওতে খবরটা জানায়।

সে ফয়্যারে আসতে আসতে সাটো পোর্চ দিয়ে উঠে আসে। ওয়ারেন বেল্লামিকে তার পেছনে দেখা যায় সাটোর ব্রিফকেস পায়ের কাছে নিয়ে হতবুদ্ধি আর একাকী হেলিকপ্টারে বসে আছে। ওএস ডিরেক্টরের নিরাপদ ল্যাপটপ তাকে সাঙ্কেতিক স্যাটেলাইট আপলিঙ্কের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সিআইএ কম্পিউটার সিস্টেমে এ্যাকসেস করার সুযোগ দেয়। আজ রাতে সামান্য সময় আগে সে বেল্লামি এই ল্যাপটপে কিছু একটা দেখিয়েছে যা দেখে লোকটা পুরো সহযোগিতা করেছে। সিমকিনসের কোন ধারণা নেই লোকটা কি দেখেছে কিন্তু তারপর থেকেই তাকে আপাদমস্তক নাড়া খাওয়া একটা লোকের মত দেখাচ্ছে।

সাটো ফয়্যারে প্রবেশ করে হার্টম্যানের লাশের দিকে তাকিয়ে মাথা নোয়ায়। তারপরে চোখ তুলে সিমকিনসের দিকে তাকায়। ল্যাংডন, ক্যাথরিন বা পিটার সলোমনের কোন খবর নেই?

সিমকিনস মাথা নাড়ে। তারা যদি এখনও বেঁচে থাকে তবে সে তাদের সাথে করে নিয়ে গিয়েছে।

বাসায় কোন কম্পিউটার দেখেছো?

অফিসে আছে?

আমাকে দেখাও। সিমকিনস সাটোকে ফয়্যার থেকে লিভিংরুমে নিয়ে আসে। পুরু কার্পেটে বে উইনডোর ভাঙা কাঁচ পড়ে আছে। তারা কয়েকটা বইয়ের শেলফ, ফায়ারপ্লেস আর একটা বিশাল চিত্রকর্ম অতিক্রম করে অফিসের দরজার কাছে আসে। অফিসের ভেতরটা কাঠের প্যানেল করা, একটা এ্যান্টিক ডেস্কের সামনে। বিশাল মনিটর দেখা যায়। সাটো টেবিল ঘুরে মনিটরের সামনে দাঁড়িয়েই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।

নিকুচি করেছি, সে নিঃশ্বাস ফেলে বলে।

সিমকিনস ঘুরে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে দেখে স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে আছে। কি হয়েছে?

সাটো একটা খালি ডকিং স্টেশন দেখায় ডেস্কের উপরে। সে ল্যাপটপ ব্যবহার করছে আর সেটা সাথে নিয়ে গেছে।

সিমকিনস তবুও বুঝতে পারে না। তার কাছে কি এমন তথ্য আছে যেটা তুমি দেখতে চাও?

না, সাটো হিংস্র কণ্ঠে বলে। আমি চাই তার কাছে যে তথ্য আছে সেটা যেন কেউ না দেখে।

.

নীচের তলায় ক্যাথরিন হেলিকপ্টার নামার আর কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পায় তারপরেই ভারী বুটের শব্দে নীচের তলা প্রকম্পিত হতে থাকে। সে চিৎকার করতে চায় কিন্তু মুখে কাপড় থাকায় করতে পারে না। সে যত জোরে চেষ্টা করে তত দ্রুত তার শিরা থেকে রক্তপাত হয়।

তার ক্লান্ত লাগে মাথাটাও হাল্কা ঝিমঝিম করে।

ক্যাথরিন জানে তাকে শান্ত থাকতে হবে। ক্যাথরিন মনকে জাগ্রত কর। নিজের পুরো ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগ করে সে নিজেকে ধ্যানস্থ অবস্থায় নিয়ে যায়।

.

শূন্যের নিঃসঙ্গতা দিয়ে রবার্ট ল্যাংডনের মন ভেসে চলে। সে অসীম শূন্যতায় উঁকি দিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু খুঁজতে চায়। সে কিছুই খুঁজে পায় না।

সম্পূর্ণ অন্ধকার। সম্পূর্ণ নিরবতা। সম্পূর্ণ প্রশান্তি।

মাধ্যাকর্ষণের কোন টান অনুভব না করায় সে বুঝতে পারে না কোন দিকটা উপরের দিক।

তার দেহ বিলীন হয়েছে।

এটাই তাহলে মৃত্যু।

সময়কে বর্ধিত হতে, সংকুচিত হতে, দূরবর্তী হতে মনে হয় তার, যেন এই স্থানের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। কতটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সে বিষয়ে তার কোনই ধারণা নেই।

দশ সেকেণ্ড? দশ মিনিট? দশ দিন?

সহসা, অবশ্য, দূরের ব্রহ্মাণ্ডে বিস্ফোরণের মত বিশাল শূন্যতার উপর দিয়ে তরঙ্গ অভিঘাতের মত স্মৃতি ল্যাংডনের দিকে ঢেউয়ের মত ছুটে রূপ লাভ করে।

মুহূর্তের ভিতরে ল্যাংডন সব মনে করতে পারে। রূপকল্পগুলো তাকে ছিঁড়ে ফেলতে থাকে…বিশাল আর বিব্রতকর। সে একটা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। যা উল্কিময়। একটা শক্তিশালী হাত তার মাথাটা মেঝেতে ঠুকে দেয়।

ব্যাথ্যা ঝলসে উঠে…তারপরে অন্ধকার।

ধূসর আলো।

দপদপ অনুভূতি।

স্মৃতির ছিটেফোঁটা। ল্যাংডনকে অর্ধ চেতন অবস্থায় নিচের দিকে আরো নিচের দিকে কেউ টানছে। তার বন্দিকর্তা শ্লোকের মত কিছু আবৃত্তি করে।

ভারবাম সিগনিফিকেটিয়াম…ভারবাম ওমনিফিকাম…ভারবাম পেডরো…

.

১১০ অধ্যায়

ডিরেকটর সাটো স্টাডি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন সিআইএ স্যাটেলাইট ইমেজ ডিভিশন তার অনুরোধ পালন করার অবসরে। ডি.সি এলাকায় কাজ করার অন্যতম সুবিধা এর স্যাটেলাইট কাভারেজ। কপাল ভাল থাকলে একটা সরাসরি এই বাসার উপরে অবস্থান করছিলো আজ রাতে…

দুঃখিত ম্যাম, অপারেটর বলে, আজ রাতে এই কো-অর্ডিনেটসে কোন কাভারেজ নেই। কোন রি-পজিশন অনুরোধ আছে?

না, ধন্যবাদ।

সাটো ভেবে পায় না টার্গেটের গন্তব্য কিভাবে সনাক্ত করবে সে। সে ফয়্যারে হেঁটে যায় সেখানে তার লোকেরা হার্টম্যানের লাশ ব্যাগে ঢুকিয়েছে চপারে নিয়ে যাবে বলে। সাটো এজেন্ট সিমকিনসকে বলে তার লোকদের ল্যাঙ্গলি ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে, কিন্তু সিমকিনস হাঁটুর উপরে ভর করে লিভিংরুমের মেঝের উপরে বসে আছে যেন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

তুমি ঠিক আছে?

সে মুখ তুলে তাকায় তার চেহারায় একটা বিস্মিত অভিব্যক্তি। তুমি কি এটা লক্ষ্য করেছো? সে লিভিংরুমের মেঝেতে ইঙ্গিত করে।

সাটো এগিয়ে এসে রুমের পুরু কার্পেটের দিকে তাকায় কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না।

নীচু হয়ে দেখো, সিমকিনস বলে। কার্পেটের আশের দিকে দেখো।

সে নীচু হয় এবং বুঝতে পারে কি, কার্পেটের ধার দেবে আছে, দুচাকার। ভারী কিছু একটা ঘরের ভিতর দিয়ে টেনে নিয়ে যাবার চিহ্ন।

অবাক করার বিষয় হয় চিহ্নটা যেদিকে গেছে, সেই দিকটা, সে ইঙ্গিত করে।

সাটো সেদিকে তাকিয়ে দেখে দাগটা একটা বিশাল ছবির পেছনে হারিয়ে গেছে। এসব আবার কিসের আলামত?

সিমকিনস ছবিটার দিকে এগিয়ে গিয়ে সেটা দেয়াল থেকে নামাতে চেষ্টা করে। কিন্তু নড়াতে পারে না। ছবিটা আটকান রয়েছে, সে বলে তার হাত ছবির ধার দিয়ে কিছু আছে কিনা খুঁজতে ব্যস্ত। দাঁড়াও, এখানে নীচে কিছু একটা আছে…তার হাত নীচের দিকে একটা লিভার খুঁজে পায় এবং চাপ দিতে কোথাও ক্লিক করে একটা শব্দ হতে শোনা যায়।

সাটো সামনে এগিয়ে আসে এবং সিমকিনস ফ্রেমটা ধাক্কা দিলে পুরো ফ্রেমটা কেন্দ্রের উপর ভর দিয়ে ঘূর্ণায়মান দরজার মত ঘুরে যায়।

সে ফ্ল্যাশলাইট দিয়ে পেছনের অন্ধকারে আলো ফেলে।

সাটোর চোখ সরু হয়ে উঠে। এইতো আশার অন্ধকার।

ছোট সংকীর্ণ করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা ভারী ইস্পাতের দরজা দেখা যায়।

ল্যাংডনের অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে স্মৃতির ঝাঁপটা আসে আর ফিরে যায়। তাদের যাওয়া আসার অন্তবর্তী কালে লাল আলোর ফুটকি চারপাশে ঘুরতে থাকে, সাথে দূর থেকে ভেসে আসে রহস্যময় আতঙ্কিত করে তোলার মত চাপা গুঞ্জন।

ভারবার সিগনিফিকেটিয়াম…ভারবাম ওমনিফিকাম…ভারবাম পেডরো।

মধ্যযুগীয় স্তুতিগানের মত একঘেয়ে কণ্ঠস্বরের সমবেত ঐক্যতান চলতে থাকে।

ভারবার সিগনিফিকেটিয়াম…ভারবাম ওমনিফিকাম। শূন্য স্থানের ভিতরে শব্দগুলো বড্ড বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আর তার সাথে নতুন কণ্ঠস্বরের হাঙ্গামা তার চারপাশে শুরু হয়। মহাপ্রলয়…ফ্রাঙ্কলিন…মহাপ্রলয়…ভারবাম…মহাপ্রলয়…কোন পূর্ব সংকেত না দিয়ে একটা বিষণ্ণ ঘন্টা ধ্বনি দূরে কোথাও ধ্বনিত হতে থাকে। ঘন্টাটা অবিরত বাজতে থাকে, তার শব্দ তীব্র হচ্ছে। ঘন্টাটা জরুরী একটা সুরে যেন বাজছে, আশা করছে ল্যাংডন এখন বুঝতে পারবে, যেন তার মনকে কিছু একটা অনুসরণ করতে বলছে।

আগের পর্ব :

০১. বিশ্বজুড়ে সমাদৃত আইফেল টাওয়ার
০২. পিটার ফোন ধরছে না কেন
০৩. দি এ্যাপোথেসিস অব ওয়াশিংটন
০৪. ত্রিস ডান কিউবের উজ্জ্বল আলো
০৫. পাথরের পিরামিড
০৬. ক্যাথরিন সলোমন
০৭. আজকের রাতটাই প্রথম না
০৮. স্টিম শাওয়ারের তরঙ্গায়িত উষ্ণতার মাঝে
০৯. ভূ-গর্ভস্থ স্থান
১০. ক্যাথিড্রাল কলেজের ভিতরে
পরের পর্ব :

১২. ঘন্টাঘরের তীব্রতায়
১৩. এক সন্তান হারানো পিতামাতা
১৪. ওয়াশিংটন মনুমেন্টর মধ্যে দিয়ে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত