৭১ অধ্যায়:
স্টিম শাওয়ারের তরঙ্গায়িত উষ্ণতার মাঝে মাল’আখ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইথানলের শেষ গন্ধটুকুও ধুয়ে যাবার পরে, নিজেকে তার আবার পবিত্র মনে হয়। ইউক্যালিপটাস মিশ্রিত বাষ্প তার ত্বকে প্রবেশ করতে সে অনুভব করে তাপে তার লোমকূপগুলো খুলে যাচ্ছে। তারপরে সে তার পালনীয় আঁচার শুরু করে।
প্রথমে, সে তার উল্কি আঁকা দেহ আর মাথায় লোমনাশক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ভাল করে ঘষে, লোমের সামান্যতম উপস্থিতিও নাশ করে। সাত দ্বীপের হেলিডাসের দেবতারা ছিলেন লোমহীন। তারপরে সে আব্রামেলিন তেল তার নরম আর গ্রহণোন্মুখ পেশীতে ভাল করে মালিশ করে। অ্যাব্রামেলিন তেল মহান মেজাইয়ের পবিত্র তেল। এবার সে তার শাওয়ারের লিভারে একেবারে বামে ঘুরিয়ে দেয় এবং বরফ শীতল পানি প্রবাহিত হতে শুরু করে। কনকনে ঠাণ্ডা পানির নীচে সে পুরো এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে লোমকূপের মুখ বন্ধ করতে। যাতে তাপ এবং শক্তি তার ভেতরে আটকে পড়ে। ঠাণ্ডা পানি হিমশীতল সেই নদীর কথা মনে করিয়ে দেয় যেখান থেকে এই রূপান্তর শুরু হয়েছিল।
সে কাঁপতে কাঁপতে শাওয়ারের নীচ থেকে বের হয়ে আসে কিন্তু কয়েক সেকেণ্ডের ভিতরে তার ভেতরের তাপ মাংসপেশীর ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে পড়ে তাকে উষ্ণ করে তোলে। মাল’আখের ভেতরে এখন চুল্লীর উত্তাপ। সে নগ্ন অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে…সম্ভবত এই শেষবার সে নিজেকে নশ্বর মানুষের রূপে দেখছে।
তার পায়ের পাতা হল বাজপাখির বাঁকান নখর। তার পা দুটো-বোয়াজ আর জাচিন-জ্ঞানর প্রাচীন স্তম্ভ। তার কটিদেশ আর উদর মরমী শক্তির তোরণদ্বার। তোরণের নীচে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকা তার অতিকায় যৌন অঙ্গে তার নিয়তির প্রতাঁকের উল্কি আঁকা। আগের জীবনে এই মুগুরের মত মাংসের পেশীটা ছিল দৈহিক সুখের উৎস। কিন্তু এখন আর নয়।
আমি পরিশোধিত হয়েছি।
কাঠারোই এর খোঁজা মরমী আশ্রমিকের মত, মাল’আখ নিজের অণ্ডকোষ ফেলে দিয়েছে। সে নিজের পুরুষত্ব উৎসর্গ করেছে আরো মূল্যবান কিছুর জন্য। ঈশ্বরের কোন লিঙ্গ নেই। পার্থিব যৌন আঁকাক্ষার প্ররোচণা আর মানব লিঙ্গের অসম্পূর্ণতা ঝেড়ে ফেলে, মাল’আখ আঞ্চুরিয়ান কিংবদন্তির খোঁজা জাদুকর, অওরানস, অ্যাটিস, স্পোরাসের মত হয়ে উঠেছে। প্রতিটা আধ্যাত্মিক রূপান্তরের আগে ঘটেছে শারিরীক রূপান্তর। প্রতিটা মহান দেবতাদের ক্ষেত্রে এটা হয়েছে…ওসিরিস থেকে তামুজ, জেসাস থেকে শিব, বুদ্ধের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে।
আমার ভিতরে পোশাক পরা লোকটাকে অপসারিত করতে হবে।
সহসা, মাল’আখ তার দৃষ্টি সরিয়ে উপরে নিয়ে আসে, বুকের দুই মাথা বিশিষ্ট ফিনিক্স থেকে মুখে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্মারকের বিন্যাস ছাড়িয়ে সোজা মাথার তালুতে উঠে আসে। সে তার মাথাটা আয়নার দিকে কাত করে, কোনমতে চাদির উল্কিহীন বৃত্তাকার স্থানটা দেখে। দেহের এই স্থানটা পবিত্র। ফনটানেল বলে পরিচিত, জন্মের সময় মানব দেহের এই স্থানটা উন্মুক্ত থাকে। মস্তিষ্কের চক্ষু। অবশ্য কয়েক মাসের ভিতরে শরীরবৃত্তিক এই দ্বারটা বন্ধ হয়ে যায়, তারপরে বাইরের আর ভিতরের জগতের হারিয়ে যাওয়া যোগসূত্রের চিহ্ন হিসাবে বিরাজ করে।
মাল’আখ উল্কিহীন পবিত্র হুকটা পরীক্ষা করে দেখে যার চারপাশে মুকুটের মত বৃত্তাকারে রয়েছে একটা অনবোবোরস একটা রহস্যময় সাপ নিজের লেজ নিজেই ভক্ষণ করছে। খালি ত্বকটা যেন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে…প্রতিশ্রুতিতে উজ্জ্বল।
রবার্ট ল্যাংডন শীঘ্রই সেই গুপ্তধন খুঁজে বের করবে যা মাল’আখের প্রয়োজন। মাল’আখ একবার সেটা আয়ত্ত্বে পেলে তার মাথার এই খালি জায়গাটা পূর্ণ হবে এবং তারপরেই সে চূড়ান্ত রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত হবে।
মাল’আখ তার শোবার ঘরের ভেতরে হেঁটে যায়, এবং নীচের ড্রয়ার থেকে সাদা সিল্কের একটা লম্বা ফালি বের করে। আগে বহুবার যেমন সে করেছে, নিতম্ব আর কুচকির চারপাশে সেটা পেচিয়ে বাধে। তারপরে সে নীচতলায় আসে।
তার অফিসের কম্পিউটারে একটা ই-মেইল এসেছে। তার কনট্যাক্ট পাঠিয়েছে। তুমি যা চাও সেটা এখন নাগালের মধ্যে। আমি এক ঘন্টার ভিতরে যোগাযোগ করব। ধৈর্য্য ধর। মাল’আখ হাসে। চুড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণের সময় হয়েছে।
.
৭২ অধ্যায়
রিডিং-রুমের ব্যালকনি থেকে সিআইএ ফিল্ড এজেন্ট মেজাজ খারাপ করে নেমে আসে। বেল্লামি আমাদের মিথ্যা বলেছে। উপর তলায় মোজেসের মূর্তির কাছে। সে তাপের কোন চিহ্ন খুঁজে পায়নি এমনকি আশেপাশেও কোথাও কিছু নেই।
ল্যাংডন তাহলে গেল কোথায়?
তারা তাপের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে এমন একমাত্র স্থানের দিকে এজেন্ট এবার এগিয়ে যায়- লাইব্রেরীর ডিস্ট্রিবিউশন হাব। সে আবার অষ্টভূজাকৃতি কনসোলের নীচে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। গমগম করতে থাকা কনভেয়ারের শব্দ পীড়াদায়ক। ভিতরে এগিয়ে এসে সে থারমাল গগলস চোখে পরে এবং রুমটা স্ক্যান করে। কিছু নেই। সে বইয়ের গাদার দিকে তাকায়, যেখানে ভেঙেচুরে পড়ে থাকা দরজা এখনও উত্তপ্ত। সেটা ছাড়া সে আর কোন
হলি শিট!
এজেন্ট লাফিয়ে পেছনে সরে আসে একটা অপ্রত্যাশিত আভা তার দৃশ্যপটে ভেসে আসলে। দেয়ালের ভিতর থেকে বের হয়ে আসা কনভেয়ার বেল্টের উপরে একজোড়া ভূতের মত, দুটো মানবাকৃতি ছাপ হাল্কাভাবে আভা ছড়ায়। তাপের চিহ্ন।
অবাক হয়ে, এজেন্ট দেখে কনভেয়ার লুপে দুটো অপচ্ছায়া বৃত্তাকার পথে ঘরটা অতিক্রম করে মাথা আগে দিয়ে দেয়ালের সংকীর্ণ গর্তের ভিতরে আবার হারিয়ে যায়। ব্যাটারা কনভেয়ারে করে পালিয়েছে? এটা পাগলামি।
দেয়ালের গর্তের ভিতর দিয়ে রবার্ট ল্যাংডন পালিয়েছে এটা বোঝার সাথে সাথে ফিল্ড এজেন্ট বুঝতে পারে যে তার আরেকটা সমস্যা আছে। ল্যাংডন একা না?
সে তার ট্রান্সরিসিভার অন করে টিম লিডারের সাথে যোগাযোগ করতে যাবে কিন্তু তার আগেই টিম লিডার তার সাথে যোগাযোগ করে।
অল পয়েন্টস, লাইব্রেরীর সামনে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটা সাদা ভলভো পাওয়া গেছে। কোন এক ক্যাথরিম সলোমনের নামে রেজিস্ট্রি করা। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে অনেকক্ষণ আগেই সে লাইব্রেরীতে প্রবেশ করেছে। আমাদের ধারণা এই মুহূর্তে সে ল্যাংডনের সাথে আছে। ডিরেকটর সাটো আদেশ দিয়েছেন অনতিবিলম্বে তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
আমি দুজনের দেহ তাপের চিহ্ন পেয়েছি! ডিস্ট্রিবিউশন রুমে অবস্থানরত এজেন্ট চেঁচিয়ে উঠে। সে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে।
যিশুর দিব্যি! টিম লিডারের প্রতিক্রিয়া। কনভেয়ারটা কোথায় যায়? ফিল্ড এজেন্ট ততক্ষণে বুলেটিন বোর্ডে টাঙান কর্মচারীদের ছকবদ্ধ রেফারেন্স দেখতে শুরু করেছে। এডামস ভবন, উত্তর দেয়। এখান থেকে এক ব্লক দূরে।
অল পয়েন্ট। সবাই এডামস ভবনের দিকে রওয়ানা দাও! এখনই।
.
৭৩ অধ্যায়
শরণস্থল, উত্তর।
এডামস ভবনের পাশের দরজা দিয়ে দৌড়ে বাইরের শীতের ঠাণ্ডা রাতে বের হবার সময়ে শব্দ দুটো ল্যাংডনের মাথায় ঘুরতে থাকে। রহস্যময় যোগাযোগকারী নিজের অবস্থান দুর্বোধ্য ভাষায় জানিয়েছেন, কিন্তু ল্যাংডন বুঝতে পেরেছে। তাদের গন্তব্যের ব্যাপারে ক্যাথরিনের প্রতিক্রিয়া বিস্ময়কর রকমের আশাবাদী: একমাত্র সত্যিকারের ঈশ্বর এরচেয়ে আর ভাল কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে?
এখন প্রশ্ন হল সেখানে কিভাবে যাওয়া হবে।
ল্যাংডন জায়গায় দাঁড়িয়ে দম ফিরে পাবার ফাঁকে চারপাশে ঘুরে তাকায়। চারপাশ অন্ধকার হলেও আশার কথা আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেছে। তারা একটা ছোট কোর্টইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে, ক্যাপিটল ভবনের গম্বুজকে চমকপ্রদভাবে দূরবর্তী দেখায় এবং ল্যাংডনের মনে পড়ে আজ রাতে ক্যাপিটলে আসবার পরে গত কয়েক ঘন্টায় এই প্রথম সে বাইরে পা রাখল।
বক্তৃতা দিতে এসে এত নাকাল কোনদিন হইনি।
রবার্ট, দেখো। ক্যাথরিন জেফারসন বিল্ডিংএর আবছা অবয়বের দিকে। আঙ্গুল তুলে দেখায়।
ভবনটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডনের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল বিস্ময়ের যে তারা কনভেয়ার বেল্টে করে মাটির নীচ দিয়ে এতটা দূরে এসেছে। তার দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া অবশ্য আতঙ্কের। জেফারসন বিল্ডিং এ যেন মচ্ছব লেগেছে- ট্রাক আর গাড়ির বহর আসছে যাচ্ছে, লোকজন কথা বলার শব্দ ভেসে আসছে। ঐটা কি সার্চলাইট দেখলাম?
ল্যাংডন ক্যাথরিনের হাত ধরে। চলে এসো।
আঙ্গিনার উপর দিয়ে উত্তরপূর্ব দিকে তারা দৌড়ে গিয়ে, একটা ইউ আঁকৃতির অভিজাতদর্শন ভবনের পেছনে দ্রুত দৃষ্টিপটের আড়ালে চলে যায়, ল্যাংডন বুঝতে পারে সেটা ফোলগার শেক্সপিয়ার লাইব্রেরী। এই নির্দিষ্ট ভবনটাকে আজ রাতে তাদের জন্য উপযুক্ত ক্যামোফ্লেজ বলে প্রতিয়মান হয়, কারণ এখানে ফ্রান্সিস বেকনের নিউ আটলান্টিসের মূল ল্যাটিন পাণ্ডুলিপি রয়েছে, ইউটোপিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়ে থাকে যার আদলে আমেরিকার পূর্বপুরুষেরা প্রাচীন জ্ঞানের উপরে ভিত্তি করে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলেছিল। তবে ল্যাংডন থামে না।
আমাদের একটা ক্যাব দরকার।
ইস্ট ক্যাপিটল আর থার্ড স্ট্রীটের কোনায় তারা পৌঁছে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে, এবং ট্যাক্সির আশায় আশেপাশে তাকিয়ে ল্যাংডন দমে যায়। থার্ড স্ট্রীটের উপর দিয়ে তারা উত্তর দিকে এগিয়ে যায়, লাইব্রেরী অব কংগ্রেস আর নিজেদের ভিতরে ব্যবধান সৃষ্টি করার অভিপ্রায়ে। আরো পুরো একটা ব্লক অতিক্রম করার পরে সামনের বাঁক ঘুরে ল্যাংডন একটা খালি ট্যাক্সিকে এগিয়ে আসতে দেখে। সে হাত দিয়ে ইশারা করতে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে পড়ে।
তার রেডিওতে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গীত বাজতে শোনা যায় এবং তরুণ আরব ট্যাক্সি চালক তাদের দিকে তাকিয়ে বন্ধুসুলভ হাসি দেয়। কোথায় যাবে? তারা দ্রুত ট্যাক্সিতে উঠে বসতে সে জানতে চায়।
আমরা যাব হল-
উত্তরপশ্চিম দিকে! ক্যাথরিন জেফারসন ভবন থেকে দূরে থার্ড স্ট্রিটের উপর দিয়ে নাকবরাবর দেখিয়ে বলে। সোজা ইউনিয়ন স্টেশন যাও সেখান। থেকে বামে বাক নিয়ে ম্যাসাচুসেটস এ্যাভিনিউ। আমরা বলবো কোথায় থামতে হবে।
ট্যাক্সিচালক কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্লেক্সিপ্লাসের ডিভাইডার উঠিয়ে দিয়ে আবার রেডিও চালিয়ে দেয়।
ক্যাথরিন ল্যাংডনের দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকিয়ে যেন বলতে চায়: কোন চিহ্ন রেখে যাওয়া চলবে না। সে নীচু হয়ে এদিকে উড়ে আসা একটা কালো হেলিকপ্টারের দিকে ল্যাংডনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধুত্তোরি। সাটো দেখছি সলোমনের পিরামিড উদ্ধার না করে থামবে না।
তারা হেলিকপ্টারটা জেফারসন আর অ্যাডামস ভবনের মধ্যে অবতরণ করতে দেখলে তার দিকে তাকায় তার দৃষ্টিতে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। আমি তোমার সেল ফোনটা একটু দেখতে পারি?
ল্যাংডন বিনা বাক্য ব্যয়ে ফোনটা দেয়।
পিটার আমাকে বলেছে তোমার শ্রুতিধরের মত স্মৃতিশক্তি? তার দিকের জানালার কাঁচ নামাতে নামাতে সে জানতে চায়। আর তুমি যেকোন নাম্বার একবার ডায়াল করেই সেটা মনে রাখতে পার?
সেটা সত্যি, কিন্তু–
ক্যাথরিন ততক্ষণে ফোনটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছে। ল্যাংডন হায় হায় করে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তার সেলফোনটা বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে ফুটপাতে আছড়ে পড়ে শতধাবিভক্ত হয়ে যায়। এটা কেন করলে!
গ্রিড থেকে বের হলাম, ক্যাথরিন চোখের দৃষ্টি গম্ভীর করে বলে। আমার ভাইকে খুঁজে পাবার একমাত্র আশা হল পিরামিড়টা আর সিআইএ এসে সেটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিক সেটা আমি চাই না।
সামনের সীটে ওমর আমিরানা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সঙ্গীতের তালে তালে গান গায়। আজকের রাতটা বিশ্রী, তার ভাগ্য ভাল শেষ পর্যন্ত যাত্রী পেয়েছে। স্ট্যানটন পার্ক অতিক্রম করার সময়ে তার ট্যাক্সি কোম্পানীর ডেসপ্যাচারের পরিচিত কণ্ঠস্বর রেডিওতে ভেসে আসে।
ডিসপ্যাঁচ থেকে বলছি। ন্যাশনাল মল এলাকায় অবস্থিত সব যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ্যাডামস ভবনের আশেপাশে দুজন ফেরারি সম্বন্ধে এইমাত্র সরকারী সংস্থার কাছ থেকে আমরা একটা বুলেটিন পেয়েছি…
ডেসপ্যাঁচ তার ক্যাবে বসে থাকা দুজনের হুবহু বর্ণনা দিলে ওমর বেকুবের মত শুনতে থাকে। সে আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকায়। ওমর স্বীকার করে, লম্বা লোকটাকে কেমন যেন পরিচিত মনে হয়। আমেরিকাস মোস্ট ওয়ানটেডে কি আমি তাকে দেখেছি?
ইতস্তত করে ওমর তার রেডিওর হ্যাণ্ডসেটের উদ্দেশ্যে হাত বাড়ায়। ডেসপ্যাঁচ? সে শান্ত কণ্ঠে ট্রান্সসিভারে কথা বলতে থাকে। ক্যাব এক-তিন চার থেকে বলছি। তোমার বর্ণনা দেয়া দুজনই- ক্যাবে রয়েছে-এই মুহূর্তে।
ডেসপ্যাঁচ সাথে সাথে ওমরকে কি করতে হবে বলে দেয়। ডেসপ্যাঁচের দেয়া ফোন নাম্বারে ডায়াল করার সময়ে ওমরের হাত রীতিমত কাঁপতে থাকে। ফোনটা একজন দক্ষ আর কঠোর কণ্ঠের লোক ধরে, অনেকটা সৈনিকের মত।
এজেন্ট টার্নার সিমকিনস বলছি। সিআইএ ফিল্ড অপারেশনস। কে কথা বলছে?
আ…আমি সেই ট্যাক্সি চালক? ওমর জানায়। আমাকে দুজনের ব্যাপারে কথা বলতে ফোন করতে
ফেরারি দুজন এই মুহূর্তে তোমার ট্যাক্সিতে আছে। হ্যাঁ অথবা না বল।
হ্যাঁ।
তারা এই কথোপকথন শুনতে পাচ্ছে? হ্যাঁ অথবা না?
না। স্লাইডার তোলা-
তুমি তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
ম্যাসাচুসেটসের উত্তরপশ্চিম দিকে।
নির্দিষ্ট গন্তব্য?
তারা বলেনি।
এজেন্ট ইতস্তত করে। পুরুষ যাত্রীর কাছে কি কোন লেদারের ব্যাগ আছে?
ওমর আবার রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে তাকায় তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠে। হা! ব্যাগে কোন বিস্ফোরক বা ঐ জাতীয় কিছু–
ভাল করে শোন, এজেন্ট তার কথা পাত্তা না দিয়ে বলে। আমার নির্দেশ পালন করলে তোমার বিপদ হবে না। বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা?
হ্যাঁ, স্যার।
তোমার নাম কি?
ওমর, বিনবিন করে ঘামতে ঘামতে সে বলে।
ওমর শোন, লোকটা শান্ত কণ্ঠে বলে। তুমি দারুণ কাজ দেখাচ্ছে। আমি চাই তুমি যতটা সম্ভব আস্তে গাড়ি চালাও যাতে আমি আমার টিম নিয়ে তোমার সামনে চলে আসতে পারি। বুঝতে পেরেছো?
হ্যাঁ, স্যার।
আর শোন, তোমার ক্যাবে পেছনে বসা যাত্রীর সাথে কথা বলার জন্য ইন্টারকম আছে না?
হ্যাঁ, স্যার।
ভাল। মন দিয়ে শোন তোমাকে কি করতে হবে।
.
৭৪ অধ্যায়
ইউ.এস ক্যাপিটল ভবনের ঠিক পাশে অবস্থিত-আমেরিকার জীবন্ত জাদুঘর ইউ.এস ব্যোটানিক গার্ডেনের মূল আকর্ষণ দি জঙ্গল, এই নামেই পরিচিত। মূলত রেইন ফরেস্ট, দি জঙ্গল উঁচু গ্রীনহাউসের ভিতরে অবস্থিত, এখানে সুউচ্চ রবার গাছ, স্ট্রালার ফিগ বা ডুমুর গাছ এবং সাহসী দর্শনার্থীদের জন্য একটা ক্যানোপী ক্যাটওয়াক আছে।
জঙ্গলের মাটি মাটি গন্ধে বেল্লামি সাধারণত নিজেকে পরিপুষ্ট মনে করেন এবং কাঁচের ছাদের নীচে অবস্থিত বাষ্পের নল থেকে বের হওয়া কুয়াশায় স্নাত হয়ে সূর্যরশ্মি নীচে নেমে আসে। আজরাতে কেবল চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে থাকা জঙ্গল তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। সে বিনবিন করে ঘামছে, এখন কষ্টকর ভঙ্গিতে পেছনে আটকে থাকা হাতে সৃষ্ট ক্র্যাম্প থেকে তিনি এখন রীতিমত কাতরাচ্ছেন।
ডিরেকটর সাটো সিগারেটে টান দিতে দিতে-কাজটা অতি যত্নে তাপমাত্রা সংশোধন করে সৃষ্ট পরিবেশে পরিবেশ সন্ত্রাসের সমতুল্য- নির্বিকার ভঙ্গিতে তার সামনে পায়চারি করে। ধোয়া পূর্ণ চাঁদের আলোতে যা মাথার উপরের কাছের ছাদ ভেদ করে নেমে এসেছে তার মুখটা পিশাচের মত দেখায়।
তো, তারপরে, সাটো শুরু করে, তুমি ক্যাপিটলে এসে যখন দেখলে আমি আগে থেকেই ওখানে উপস্থিত আছি…তুমি একটা সিদ্ধান্ত নিলে। নিজের উপস্থিতি আমার কাছে প্রকাশ না করে তুমি গোপনে এসবিবিতে নেমে আসো, সেখানে নিজেকে হুমকির মুখে ফেলে তুমি চীফ এনডারসন আর আমাকে আক্রমণ কর আর ল্যাংডনকে পিরামিড আর শিরোশোভাসহ পালিয়ে যেতে দাও। সে নিজের আহত কাঁধ ডলে। চিত্তাকর্ষক বিবেচনা।
এই বিবেচনা আমি সুযোগ পেলে আবার করবো, বেল্লামি ভাবে। পিটার কোথায়? সে কুদ্ধ কণ্ঠে জানতে চায়।
আমি কিভাবে জানবো? সাটো বলে।
তুমি দেখা যাচ্ছে এটা ছাড়া বাকি সব কিছুই জানো! বেল্লামি এবার তার উদ্দেশ্যে পাল্টা অভিযোগ করে, তার সন্দেহ যে সবকিছুর পেছনে সাটোই রয়েছে সেটা লুকাবার কোন চেষ্টাই সে করে না। তুমি জানতে তোমাকে ক্যাপিটল ভবনে যেতে হবে। তুমি জানতে রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করতে হবে। আর তুমি এটাও জানতে ল্যাংডনের ব্যাগ এক্স-রে করলে শিরোশোভা খুঁজে পাওয়া যাবে। বোঝাই যাচ্ছে কেউ তোমাকে ভিতরের খবর বেশ ভালই সরবরাহ করেছে।
সাটো শীতল কণ্ঠে হেসে উঠে তার দিকে এগিয়ে আসে। মি. বেল্লামি, তুমি কি সেজন্যই আমাকে আক্রমণ করেছিলে? তোমার কি মনে হয় আমি তোমার শত্রু? তোমার ধারণা আমি তোমার সাধের পিরামিড চুরি করতে চাইছি? সাটো ঠোঁটের সিগারেটে একটা লম্বা টান দেয় এবং নাক দিয়ে গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ে। মন দিয়ে শোনো। গোপনীয়তা রক্ষার গুরুত্ব আমার চেয়ে ভাল কেউ বোঝ না। আমার বিশ্বাস, তোমারও একই ধারণা, যে বিশেষ কিছু তথ্য রয়েছে যার জিম্ম জনগণকে দেয়া যায় না। আজ রাতে, অবশ্য এমন সব শক্তি সক্রিয় হয়েছে যা আমার ভয় হয় তুমি তাদের স্বরূপ পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারোনি। যে লোকটা পিটার সলোমনকে অপহরণ করেছে সে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী…এমন ক্ষমতা যা এখনও তোমার মোটা মাথায় ঢুকেনি। বিশ্বাস কর, সে একজন চলমান বোমা…এমন কিছু ধারাবাহিক ঘটনার সে জন্ম দিতে পারে যা তোমার চেনা পৃথিবী ভীষণভাবে বদলে দিতে পারে।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, বেল্লামি হাতকড়া পরিহিত থাকায় বাহু ব্যথা করতে দেহের ভার বদলে বলে।
তোমার বোঝার কোন দরকার নেই। তোমাকে আজ্ঞানুবর্তী হতে হবে। এই মুহূর্তে, একটা বিশাল মাত্রার বিপর্যয় এড়াতে আমার একমাত্র উপায় এই লোকটার সাথে সহযোগিতা করা…আর সে ঠিক যা চায় সেটা তাকে দেয়া। যার মানে দাঁড়ায় তুমি রবার্ট ল্যাংডনকে ফোন করে তাকে বলবে নিজেকে পিরামিড আর শিরোশোভাসহ সমর্পিত করতে। একবার ল্যাংডন আমার তত্ত্বাবধানে আসবার পরে, সে পিরামিডের পাঠোদ্ধার করে লোকটার দাবী করা তথ্য বের করবে এবং সে যা চায় তাকে ঠিক সেটাই পৌঁছে দেবে।
প্যাচান সিঁড়ির অবস্থান যা প্রাচীন রহস্যময়তার কাছে পৌঁছে দেবে? আমি সেটা করতে পারব না। আমি গোপনীয়তা রক্ষার শপথে আবদ্ধ।
সাটো এবার ক্ষেপে যায়। তোমার গোপনীয়তা রক্ষা মুখে আমি মুতে দেই, আমি তোমাকে এত দ্রুত জেলখানায় নিক্ষেপ করবো।
আমাকে তুমি যত খুশী হুমকি দিতে পার, অবজ্ঞার সুরে বেল্লামি বলে। আমি তোমাকে সাহায্য করবো না।
সাটো একটা বড় শ্বাস নিয়ে ভীতিকর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে। মি. বেল্লামি আপনার কোন ধারণাই নেই আজ রাতে ঠিক কি ঘটছে আমাদের চারপাশে, তাই না?
টানটান নিরবতা সাটোর ফোন বেজে উঠা পর্যন্ত তাদের ভিতরে বিরাজ করে। সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠে ফোনটা বের করে। বলো কি বলবে? সে উত্তর দেয়, এবং নিরবে অপরপ্রান্তের কথা শোনে। তাদের ট্যাক্সি এখন কোথায়? কতক্ষণ? বেশ ভাল। তাদের সোজা ইউ.এস বোটানিক গার্ডেনে নিয়ে আসবে। সার্ভিস এক্ট্রেন্স। আর দেখো পিরামিড আর ঘন্টার শিরোশোভাটা আনতে ভুলে যেও না।
সাটো লাইন কেটে দিয়ে বোমির দিকে তাকিয়ে আত্মতৃপ্ত হাসি দেয়। বেশ তাহলে…দেখা যাচ্ছে শীঘ্রই তোমার প্রয়োজনীয়তা শেষ হবে।
.
৭৫ অধ্যায়
রবার্ট ল্যাংডন ফাঁকা চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে, এতটাই ক্লান্ত বোধ করে যে ধীরে চালাতে থাকা ট্যাক্সি চালককে জোরে চালাতে বলার কথা বলতেও তার আলস্য লাগে। তার পাশে ক্যাথরিনও চুপচাপ বসে থাকে পিরামিডটার গুরুত্ব ঠিক ঠিক বুঝতে না পারার কারণে হতাশ। তারা আবার পিরামিড়, শিরোশোভা আর আজ সন্ধ্যার অদ্ভুত সব ঘটনাবলী খুটিয়ে বিশ্লেষণ করে কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না পিরামিডটা এত কিছু থাকতে কেন একটা ম্যাপ বলে গণ্য করতে হবে।
জিহোভা স্যাঙ্কটাস উনাস? দি সিক্রেট হাইডস উইথইন দি অর্ডার?
তাদের রহস্যময় যোগাযোগকারী তাদের উত্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যদি তারা একটা বিশেষ স্থানে পৌঁছে তার সাথে দেখা করতে পারে। টিবারের উত্তরে, রোমে একটা শরণস্থল ছিল। ল্যাংডন জানে তাদের পূর্বপুরুষদের নিউ রোম বদলে ওয়াশিংটন রাখা হয় শহরটা স্থাপনের কিছুদিনের ভেতরে এবং এখনও তাদের স্বপ্নের অবশিষ্টাংশ এখনও অবশিষ্ট রয়েছে: টিবারের পানি আজও পোটোম্যাক হয়ে প্রবাহিত হয়, সিনেটরের দল আজও সেন্ট পিটারস রেপ্লিকার নীচে, সমবেত হন; এবং ভালকান আর মিনার্ভা আজও বহু আগে নিভে যাওয়া অগ্নি শিখা পাহারা দিচ্ছে।
ল্যাংডন আর ক্যাথরিনের আরাধ্য উত্তর কয়েক মাইল সামনে তাদের জন্য আপাতদৃষ্টিতে অপেক্ষা করছে। ম্যাসাচুসেটস এ্যাভিনিউর উত্তরপশ্চিমে। তাদের গন্তব্যস্থল আসলেই একটা সমায়…ওয়াশিংটনের টিবের ক্রীকে উত্তরে। ল্যাংডন ভাবে ড্রাইভার এত আস্তে চালাচ্ছে কেন।
ক্যাথরিন সহসা তার সীটে সোজা হয়ে বসে, যেন আঁচমকা সে কিছু একটা উপলব্ধি করেছে। ওহ মাই গড, রবার্ট! সে রবার্টের দিকে তাকায় তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে এবং তারপরে জোরালো কণ্ঠে কথা বলতে থাকে। আমরা ভুল পথে যাচ্ছি!
না, ঠিক আছে, ল্যাংডন। ম্যাসাচুসেটসের উত্তরপশ্চিম-
না! মানে আমরা ভুল স্থানে যাচ্ছি।
ল্যাংডন এবার বিভ্রান্তবোধ করে। সে ক্যাথরিনকে ইতিমধ্যে বলেছে তাদের রহস্যময় আশ্রয়দাতার বর্ণনা করা অবস্থান সে চেনে। সিনাই পাহাড়ের দশটা পাথর এখানে রয়েছে, একটা স্বর্গ থেকে দ্রুত এবং অন্যটায় লুকের কৃষ্ণ পিতার অবয়ব ছাপা রয়েছে। পৃথিবীর বুকে কেবল একটা ভবনই এই দাবী করতে পারে। আর তাদের ট্যাক্সি ঠিক সেই দিকেই চলেছে।
ক্যাথরিন আমি লোকেশন সম্পর্কে নিশ্চিত।
না! সে চেঁচিয়ে উঠে। সেখানে যাবার আমাদের আর কোন প্রয়োজন নেই। পিরামিড আর শিরোশোভার রহস্য আমি বুঝতে পেরেছি। আমি জানি পুরো ব্যাপারটা কি নিয়ে!
ল্যাংডন বিস্মিত হয়। তুমি বুঝতে পেরেছো?
যা! আমাদের আসলে যেতে হবে স্বাধীনতা প্লাজায়!
ল্যাংডন এবার খেই হারায়। স্বাধীনতা পাজা কাছেই অবস্থিত কিন্তু একেবারে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়।
জিহোভা স্যাঙ্কটাস উনাস! ক্যাথরিন বলে। হিব্রুদের একমাত্র সত্যিকারের ঈশ্বর। হিব্রুদের পবিত্র প্রতীক জিউইশ স্টার- দি সীল অব সলোমন ম্যাসনদের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক! সে পকেট থেকে একটা ডলার বের করে। তোমার কলমটা আমাকে দাও।
হতবিহ্বল, ল্যাংডন তার জ্যাকেটের পকেট থেকে কলম বের করে দেয়।
দেখো, সে তার পায়ের উপরে ডলারের নোটটা বিছিয়ে, পেছনের গ্রেট সীলের দিকে নির্দেশ করে বলে। তুমি যদি সলোমনস সীল আমেরিকার গ্রেট সীলের উপরে সুপারইমপোজ কর… সে পিরামিডের উপরে একটা নিখুঁত ইহুদিদের স্টার চিহ্ন আকে। দেখো আমরা কি পেলাম!
ল্যাংডন ডলারের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ক্যাথরিনের দিকে তাকায় যেন সে পাগল হয়ে গেছে।
রবার্ট আরো ভালো করে খেয়াল কর! তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না আমি কি দেখাতে চাইছি?
সে আবার ড্রয়িংএর দিকে তাকায়।
The-Lost-Symbol-75
সে কি বোঝাতে চাইছে? ল্যাংডন এই ইমেজটা আগে বহুবার দেখেছে। ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের কাছে এটা একটা জনপ্রিয় প্রমাণ যে আমাদের দেশে ম্যাসনদের একটা গোপন প্রভাব রয়েছে। ছয় শীর্ষবিন্দু বিশিষ্ট তারকা চিহ্নকে যখন গ্রেট সীলের উপরে বসান হয় তারকাটার শীর্ষবিন্দু ম্যাসনিক সবদর্শী। চোখের শীর্ষে নিখুঁতভাবে আপতিত হয়…এবং অনেকটা রহস্যময়ভাবে বাকি পাঁচটা বিন্দু পরিষ্কারভাবে পাঁচটা অক্ষর নির্দেশ করে এম-এ-এস-ও-এন।
ক্যাথরিন এটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার এবং আমি এখনও স্বাধীনতা প্লাজার সাথে এর কোন যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছি না। আবার দেখো! এবার তার কণ্ঠস্বর রীতিমত ক্রুদ্ধ শোনায়। আমি যা নির্দেশ করছি তুমি সেটা দেখছো না! এখানে দেখো। এখনও দেখতে পাচ্ছ না?
এক মুহূর্ত পরে, ল্যাংডন দেখতে পায়।
.
সিআইএ ফিল্ড অপারেশনস লিডার টার্নার সিমকিনস অ্যাডামস ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে সেলফোন কানে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ট্যাক্সির পেছনে চলতে থাকা কথোপকথন সে শুনতে চেষ্টা করছে। এইমাত্র কিছু একটা হয়েছে। তার দল একটা পরিবর্তিত সিকোরস্কি ইউএইচ-৬০ নিয়ে উত্তরপশ্চিমে উড়ে গিয়ে রোডব্লক তৈরী করবে বলে প্রস্তুত হতে এখন দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি আঁচমকা বদলে গিয়েছে।
মুহূর্ত আগে, ক্যাথরিন সলোমন বলছিল তারা ভুল পথে যাচ্ছে। তার ব্যাখ্যা- ডলার বিল আর ইহুদিদের তারকা চিহ্ন সম্পর্কিত-রবার্ট ল্যাংডন আর অপারেশনস টিম লিডারের কাছে আপাতদৃষ্টিতে অর্থব্যঞ্জক মনে হয় না।
হা ঈশ্বর, তোমার কথা ঠিক! ল্যাংডনের কথা জড়িয়ে যায়। আমি আগে দেখিনি।
সিমকিনস সহসা শুনতে পায় কেউ ট্যাক্সির কাঁচে আঘাত করছে এবং তারপরে সেটা খুলে যায়। পরিকল্পনা পরিবর্তন, ক্যাথরিন চিৎকার করে ড্রাইভারকে বলে। আমাদের স্বাধীনতা প্লাজায় নিয়ে চলো।
স্বাধীনতা প্লাজা, ড্রাইভার নাভাস কণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করে। ম্যাসাচুসেটসের উত্তরপশ্চিমে না।
ভুলে যাও! ক্যাথরিন চেঁচিয়ে বলে। ফ্রিডম প্লাজা! এখানে বামে মোড় নাও! এখানে! এখানে!
এজেন্ট সিমকিনস তীক্ষ্ণ শব্দে ট্যাক্সি মোড় নেবার শব্দ শোনে। ক্যাথরিন উত্তেজিত কণ্ঠে ল্যাংডনকে প্লাজার মেঝেতে প্রোথিত বিখ্যাত ব্রোঞ্জের গ্রেট সীলের সম্পর্কে কিছু একটা বলে।
ম্যাম নিশ্চিত হবার জন্য, ক্যাব চালক তাদের মাঝে কথা বলে উঠে তার কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা। আমরা স্বাধীনতা প্লাজায় যাচ্ছি- থার্টিনথ আর পেনসিলভেনিয়ার কোণায় অবস্থিত?
হ্যাঁ! ক্যাথরিন বলে। দ্রুত!
খুবই কাছে আছি আমরা। দুমিনিট লাগবে।
সিমকিনস হাসে। ওমর দারুণ দেখিয়েছে। সে তার শান্ত হয়ে বসে থাকা হেলিকপ্টারের দিকে দৌড়ে যাবার সময়ে তার দলকে চেঁচিয়ে নির্দেশ দেয়। আমরা তাদের খুঁজে পেয়েছি! স্বাধীনতা জা! নড়ো!
.
৭৬ অধ্যায়
স্বাধীনতা চত্ত্বর বা ফ্রিডম প্লাজা আসলে একটা মানচিত্র।
থার্টিনথ স্ট্রিট আর পেনসিলভেনিয়া এ্যাভিনিউয়ের কোণায় অবস্থিত এই প্লজার বিশাল চত্ত্বরে প্রোথিত পাথরে পিয়েরে লাফান্ত ওয়াশিংটন শহরের গোড়া পত্তনের সময়ে কিভাবে এই শহরের রাস্তাঘাট বিন্যস্ত করতে চেয়েছিলেন তার একটা প্রতিকৃতি দেখা যাবে। এই প্রাজার অতিকায় মানচিত্রে হেঁটে বেড়াবার। আনন্দের কারণেই পর্যটকদের কাছে এই জায়গাটা জনপ্রিয় না মার্টিন লুথার কিং, জুনিয়র তার আমার একটা স্বপ্ন আছে বক্তৃতার অধিকাংশ এই চত্ত্বরের কাছে অবস্থিত উইলার্ড হোটেলে বসে লিখেছেন।
ডি.সির ক্যাব চালক ওমর আমিরানা প্রায়শই পর্যটকদের এখানে বেড়াতে নিয়ে আসে কিন্তু আজ রাতে আগত দুজন যাত্রীকে কোনভাবেই সাধারণ দর্শনার্থী বলা যাবে না। সিআইএ তাদের ধাওয়া করছে? বাঁকের মুখে ওমর গাড়ি থামিয়েছে কি থামায়নি তার আগেই যাত্রী ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।
এখানেই দাঁড়িয়ে থাক, টুইডের জ্যাকেট পরা লোকটা ওমরকে বলে, আমরা এখনই ফিরে আসব!
ওমর দেখে তার যাত্রী দুজন বিশাল খোলা স্থানে অবস্থিত ম্যাপের উপর। দিয়ে দৌড়ে যায়, নির্দেশ করে কিছু দেখায় আর চিৎকার করার ফাঁকে পরস্পর মিলিত হওয়া সড়কের জ্যামিতিক নক্সা খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। ওমর। ড্যাসবোর্ডের ওপর থেকে তার সেলফোনটা তুলে নেয়। স্যার, আপনি কি এখনও লাইনে আছেন?
যা, ওমর! লাইনে তার প্রান্তে প্রচণ্ড শব্দের কারণে সে চেঁচিয়ে উত্তর দেয়। তারা এখন কোথায়?
ম্যাপের উপরে ঘুরছে। মনে হয় তারা কিছু একটা খুঁজছে?
তারা যেন তোমার চোখের আড়াল না হয়, এজেন্ট চিৎকার করে বলে। আমি প্রায় পৌঁছে গেছি।
ওমর তাকিয়ে দেখে দুই ফেরারি আসামী দ্রুত প্লাজার বিখ্যাত গ্রেট সীল খুঁজে বের করেছে ঢালাই করা ব্রোঞ্জের অন্যতম বৃহৎ মেড্যালিয়ন। তারা সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় তারপরে দক্ষিণপশ্চিম দিকে ইঙ্গিত করতে শুরু করে। তারপরে টুইডের জ্যাকেট পরা লোকটা দৌড়ে ক্যাবের কাছে আসে। ওমর দ্রুত ফোনটা ড্যাসবোর্ডের উপরে নামিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে।
আলেকজান্দ্রিয়া ভার্জিনিয়া কোন দিকে? লোকটা জানতে চায়।
আলেকজান্দ্রিয়া? ওমর দক্ষিণপশ্চিম দিকে ইঙ্গিত করে দেখায়, ঠিক একই দিকে লোকটা আর তার সাথের ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ আগেই নির্দেশ করেছিল।
আমি জানতাম এটাই! লোকটা শ্বাস নিতে নিতে ফিসফিস করে বলে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে সাথী দ্রমহিলাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে। তোমার কথাই ঠিক! আলেকজান্দ্রিয়া!
দ্রমহিলা এবার প্লাজার অন্যপাশে একটা আলোকিত মেট্রো লেখা দেখায়। নীল রেখাটা সোজা সেখানে গিয়েছে। আমাদের দরকার কিং স্ট্রিট স্টেশন!
ওমর সহসা আতঙ্কিত হয়ে উঠে। হায় হায়।
লোকটা এবার ওমরের দিকে ঘুরে ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি ডলার বিল তার হাতে গুঁজে দেয়। ধন্যবাদ। আমাদের কাজ হয়ে গেছে। সে তার চামড়ার ব্যাগটা তুলে নিয়ে দৌড় দেয়।
দাঁড়াও! আমি তোমাদের পৌঁছে দিতে পারব! আমি সবসময়ে ওদিকে যাই!
কিন্তু দেরী হয়ে গেছে। লোকটা আর তার সাথে মহিলা ততক্ষণে প্রাজার উপর দিয়ে দৌড় শুরু করে দিয়েছে। তারা মেট্রো সেন্টার সাব স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে হারিয়ে যায়।
ওমর তার সেলফোনটা আবার হাতে নেয়। স্যার! তারা দৌড়ে সাবওয়েতে নেমে গেছে। আমি তাদের থামাতে পারিনি। তারা নীল লাইন অনুসরণ করে আলেকজান্দ্রিয়া যাবে!
যেখানে আছ সেখানেই অপেক্ষা কর! এজেন্ট চেঁচিয়ে বলে। আমি পনের সেকেণ্ডের ভিতরে পৌঁছাব!
ওমর তার হাতে ধরা ডলার বিলের গোছার দিকে তাকায় লোকটা তাকে দিয়েছে। উপরের বিলটার উপরে আপাতভাবে দেখা যায় তারা কিছু একটা লিখেছে। ইউনাইটেড স্টেটসের গ্রেচ সীলের উপরে ইহুদিদের তারকা আঁকা। নিশ্চিতভাবেই তারার প্রান্তবিন্দুগুলো যে বর্ণে এসে মিলেছে সেটার উচ্চারণ ম্যাসন।
কোন আগাম জানান না দিয়ে ওমর সহসা তার চারপাশে কানে তালা লাগান কম্পন অনুভব করে, যেন একটা ট্রাক্টর ট্রেইলার যে কোন সময়ে তার ক্যাবকে ধাক্কা দেবে। সে মুখ তুলে তাকায় কিন্তু রাস্তা একেবারে ফাঁকা। শব্দটা আরো বাড়ে এবং কোন জানান না দিয়ে রাতের অন্ধকার আকাশের বুক থেকে একটা চকচকে হেলিকপ্টার প্লাজা ম্যাপের মধ্যেখানে এসে অবতরণ করে।
কালো পোশাক পরিহিত একদল লোক হেলিকপ্টার থেকে বের হয়ে আসে। তাদের প্রায় সবাই সাবওয়ে স্টেশনের দিকে দৌড় শুরু করে কেবল একজন দ্রুত তার ক্যাবের দিকে এগিয়ে আসে। সে এসে প্যাসেঞ্জারের দিকের দরজা খুলে। ওমর? তুমিই তো?
ওমর নির্বাক কেবল কোনমতে মাথা নাড়ে।
তারা কি বলেছে তারা কোথায় যাচ্ছে? এজেন্ট জানতে চায়।
আলেকজান্দ্রিয়া কিং স্ট্রীট স্টেশন, ওমর হড়বড় করে কোনমতে বলে। আমি বলেছিলাম পৌঁছে দেই কিন্তু–
তারা কি বলেছে আলেকজান্দ্রিয়ার কোথায় তারা যাবে?
না! তারা প্লাজার গ্রেট সীলের মেড্যালিয়ন দেখে, তারপরে আমাকে আলেকজান্দ্রিয়ার কথা জিজ্ঞেস করে আর তারপরে আমাকে এগুলো দেয়। সে এজেন্টের হাতে উদ্ভট ডায়াগ্রাম আঁকা ডলার বিলটা ধরিয়ে দেয়। এজেন্ট যখন ডলার বিলটা দেখছে ওমরের মনে তখন সহসা সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। দি ম্যাসনস? আলেকজান্দ্রিয়া! আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত মাসনিক ভবন আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত। এবার বুঝেছি! সে নিজের মনে বলে উঠে। দি জর্জ ওয়াশিংটন ম্যাসনিক মেমোরিয়্যাল! কিং স্ট্রিট স্টেশনের ঠিক উল্টো দিকে ভবনটা অবস্থিত!
সেটাই কথা, বাকী সব এজেন্টরা দৌড়ে স্টেশন থেকে বের হয়ে আসলে, দাঁড়িয়ে থাকা এজেন্ট বলে, সেও আপাতভাবে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।
আমরা তাদের হারিয়ে ফেলেছি! এজেন্টদের ভেতরে একজন চেঁচিয়ে বলে। ৰু লাইন মাত্র ছেড়ে গেছে। তারা নীচে নেই!
এজেন্ট সিমকিনস নিজের ঘড়ি দেখে এবং ওমরের দিকে তাকায়। সাবওয়েতে আলেকজান্দ্রিয়া যেতে কত সময় লাগে?
কম করে দশ মিনিট। বেশিও লাগতে পারে।
ওমর তুমি দারুণ কাজ দেখিয়েছো। তোমাকে ধন্যবাদ।
নিশ্চয়ই। আচ্ছা ব্যাপারটা কি?
কিন্তু এজেন্ট সিমকিনস ততক্ষণে হেলিকপ্টারের উদ্দেশ্যে দৌড় শুরু করে চেঁচিয়ে আদেশ দিচ্ছে। কিং স্ট্রিট স্টেশন! আমাদের তাদের আগে সেখানে পৌঁছাতে হবে!
হতবিহ্বল, ওমর তাকিয়ে বিশাল কালো পাখিটাকে আবার আঁকাশে ভাসতে দেখে। পেনসিলভেনিয়া স্ট্রিট বরাবর সোজা দক্ষিণে সেটা উড়ে যায় এবং রাতের আঁধারে গর্জন করতে করতে হারিয়ে যায়।
.
ক্যাব চালকের পায়ের নীচে, ফ্রিডম প্লাজা থেকে যাত্রা শুরু করে একটা সাবওয়ে ট্রেন গতি বৃদ্ধি করতে শুরু করে। ট্রেনে ল্যাংডন আর ক্যাথরিন রুদ্ধশ্বাসে বসে থাকে কেউ একটা কথাও বলে না ট্রেনটা যখন তাদের বুকে নিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে।
.
৭৭ অধ্যায়
সবসময়ে স্মৃতিটা একইভাবে শুরু হয়।
সে নীচে পড়ছে…একটা গভীর খাদের পাদদেশে বরফ আবৃত নদীতে সে চিত হয়ে দিকে ডুবে যাচ্ছে। তার উপরে, পিটার সলোমন নির্মম চোখে এ্যানড্রোসের পিস্তলের ব্যারেলের উপর দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। সে নীচে পড়তে থাকলে তার উপরের পৃথিবী অপসৃত হয়, সবকিছু হারিয়ে যেতে থাকে উপর থেকে আছড়ে পড়া পানির তোড়ের তরঙ্গায়িত কুয়াশার মেঘ তাকে জড়িয়ে নিলে।
এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু সাদা, স্বর্গের মত মনে হয়।
তারপরে, সে বরফে আছড়ে পড়ে।
ঠাণ্ডা। অন্ধকার। যন্ত্রণা।
সে হাবুডুবু খায়…একটা অসম্ভব শীতল শূন্যতায় একটা শক্তিশালী বল তাকে টেনে নিয়ে বিরামহীনভাবে পাথরের বুকে আছড়ে ফেলতে থাকে। তার বুক বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করে, কিন্তু শীতে তার বুকের পেশী এমন ভীষণভাবে সংকুচিত হয় যে সে শ্বাসই নিতে পারে না।
আমি বরফের নীচে।
তরঙ্গায়িত পানির কারণে জলপ্রপাতের কাছে বরফের আবরণ পাতলা এবং এ্যানড্রোস সেটা ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায়। এখন সে স্বচ্ছ ছাদের নীচ আটকে পড়ে ভাটিতে ভেসে চলে। সে বরফের নীচে আঙ্গুল দিয়ে আঁচড়ায়, বরফ ভাঙতে চেষ্টা করে, কিন্তু সে কোন সুবিধা করতে পারে না। তার কাঁধের বুলেটের ক্ষতের তীব্র বেদনা আর পাখি মারার ছররার আঁচড় সব উবে যেতে থাকে; সব কিছু শুষে নেয় অবশ হয়ে আসা তার শরীর পঙ্গু করে দেয়া দবদব।
স্রোতের বেগ বৃদ্ধি পেয়ে নদীর একটা বাঁকের কাছে তাকে গুলতির মত ছুঁড়ে ফেলে। অক্সিজেনের জন্য তার সারা শরীর আর্তনাদ করতে থাকে। সহসা পানিতে পড়ে থাকা একটা গাছের ডালপালায় সে আটকে যায়। ভাবো। সে। পাগলের মত একটা ডাল আঁকড়ে ধরে ধীরে ধীরে উপরিতলে উঠে আসে এবং ডালটা কোথায় বরফ ফুড়ে পানির উপরে উঠেছে সেটা খুঁজে বের করে। ডালটার চারপাশে তার আঙ্গুলের ডগা খানিকটা জায়গায় খোলা পানি খুঁজে পায় সে বরফের প্রান্ত ধরে টেনে গর্তটা বড় করতে চেষ্টা করে; একবার, দুবার, খোলা। স্থানটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।
ডালটা ধরে নিজেকে ভাসিয়ে তুলে, সে মাথাটা পেছনে কাত করে মুখটা সেই ভোলা জায়গায় এনে চাপ দেয়। তার ফুসফুঁসে প্রবেশ করা শীতের বাতাস গরম মনে হয়। অক্সিজেনের হঠাৎ ঝলক তার মাঝে আশা জাগিয়ে তুলে। সে গাছটার গুঁড়িতে পা ঠেকিয়ে পিঠ আর কাঁধ দিয়ে জোরে উপরের দিকে ধাক্কা দেয়। ভেঙে পড়া গাছের চারপাশে জমে থাকা বরফ, ডালপালা আর ময়লার কারণে ফাটা বলে আগেই দুর্বল হয়ে ছিল এবং সে তার শক্তিশালী পা দিয়ে গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা দিলে তার মাথা আর কাঁধ বরফ ভেঙে শীতের রাতে বরফের উপরে ভেসে উঠে। বাতাস তার ফুসফুঁসে প্রবেশ করে। আধা ডুবা অবস্থায় সে আঁকুলি বিকুলি করে উপরে উঠতে চায়, পা দিয়ে ধাক্কা দেয়, হাত দিয়ে টেনে তুলতে চেষ্টা করতে থাকে যতক্ষণ না সে পানির উপরে উঠে এসে খালি বরফের উপরে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকে।
এ্যানড্রোস তার ভেজা স্কি-মাস্ক খুলে পকেটে রাখে, উজানের দিকে তাকিয়ে পিটার সলোমনকে দেখা যায় কিনা দেখে। নদীর বাঁক তার দৃষ্টিপথে বাধা সৃষ্টি করে। তার বুক আবার জ্বলতে শুরু করে। নিরবে সে একটা ডাল নিয়ে এসে বরফের মাঝের গর্তটা ঢেকে দেয়। গর্তটা সকাল নাগাদ আবার জমে যাবে।
এনড্রোস টলমল করে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেত তুষারপাত শুরু হয়। সে বলতে পারবে না কতটা হাঁটার পরে সে জঙ্গল থেকে হোঁচট খেতে খেতে। বেরিয়ে একটা ছোট রাস্তার পাশের ঢালে উঠে আসে। সে হাইপোথারমিক আর প্রলাপ বকতে শুরু করে। তুষারপাত বেড়েছে এবং দূর থেকে সে গাড়ির একজোড়া হেডলাইট এগিয়ে আসতে দেখে। এ্যানড্রোস পাগলের মত হাত। নাড়লে পিকআপ ট্রাকটা সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ে। গাড়িটায় ভারমন্টের নাম্বারপ্লেট। লাল প্লেট দেয়া শার্ট পরিহিত একটা বুড়ো লোক গাড়ি থেকে বের হয়।
এ্যানড্রোস টলতে টলতে রক্তাক্ত মুখ হাত দিয়ে ঢেকে তার দিকে এগিয়ে যায়। এক শিকারী…গুলি করেছে! আমায়…হাসপাতালে নিয়ে চল!
কোন রকমের ইতস্তত না করে লোকটা এ্যনিড্রোসকে প্যাসেঞ্জার সীটে উঠিয়ে নেয় এবং হিটার চালু করে। কাছের হাসপাতালটা কোথায়?
এ্যানড্রোসের কোন ধারণা নেই, কিন্তু সে দক্ষিণে দেখায়। পরেরও বাঁকে। আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি না।
ভারমন্ট থেকে আগত বুড়ো লোকটাকে পরের দিন নিখোঁজ ঘোষণা করা হয় কিন্তু কারও কোন ধারণা নেই ভারমন্ট থেকে আসার সময়ে তোলপাড় করা তুষারঝড়ের কবলে পড়ে সে কোথায় নিখোঁজ হয়েছে। পরের দিন শিরোনাম হওয়া আরেকটা খবরের সাথে এই নিখোঁজের সাথে কেউ কোন যোগসূত্র খুঁজে পায় না- ইসাবেল সলোমনের হতবিহ্বল করা হত্যাকাণ্ড।
এ্যানড্রোস যখন জেগে উঠে, সে একটা সস্তা জনমানবহীন হোটেলের ঘরে নিজেকে দেখতে পায় পুরো সীজনের জন্য রুমটা তক্তা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার মনে পড়ে সে ঘরের তক্তা ভেঙে ভিতরে ঢুকেছে এবং বিছানার চাঁদর দিয়ে নিজের ক্ষতস্থান বেধে পলকা একটা খাটে ছাতাপড়া কম্বলের একটা। স্তূপের নীচে এসে ঢুকেছে। প্রচণ্ড ক্ষুধায় তার মৃতপ্রায় অবস্থা।
সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাথরুম গেলে সিঙ্কে একগাড়া ছররা পড়ে থাকতে দেখে। তার আবছাভাবে মনে পড়ে বুক থেকে সেগুলো সে টেনে বের করেছে। ময়লা কাঁচের দিকে তাকিয়ে সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্ষতস্থানের পট্টি খুলে ভেতরের। কি অবস্থা দেখার জন্য। বুক আর উদরের শক্ত পেশী ছররা বেশি ভেতরে ঢুকতে দেয়নি কিন্তু তার একদা নিখুঁত শরীরের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ক্ষতগুলো। পিটার সলোমনের ছোঁড়া একটা নিঃসঙ্গ গুলি কাঁধের ভিতরে প্রবেশ করে অন্যপাশ ফুড়ে বেরিয়ে গেছে রক্তাক্ত একটা গহ্বর তৈরী করে।
সবচেয়ে খারাপ খবর এ্যানড্রোস যার জন্য এতদূর এসেছিল সেটাই সে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। পিরামিডটা। তার পাকস্থলী ক্ষুধায় মোচড় দেয় এবং সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাইরে রাখা ট্রাকটার কাছে আসে, আশা বুড়ো লোকটা হয়ত ট্রাকে কোন খাবার রেখেছিল। পুরো পিকআপটা বরফে ঢাকা এ্যানড্রোস ভাবে সে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমার ঘুম ভেঙেছে। এ্যানড্রোস সামনের সীটে কোন খাবার খুঁজে পায় না কিন্তু গ্লোবকমার্টমেন্টে সে আর্থরাইটিসের কিছু পেইনকিলার ট্যাবলেট খুঁজে পায়। সে ট্যাবলেটগুলো নিয়ে কয়েকমুঠো বরফ দিয়ে সেগুলো পেটে চালান করে।
আমার খাবার দরকার।
কয়েক ঘন্টা পরে পুরানো মোটেলের পেছন থেকে পিকআপটা যখন বের হয়ে আসে দুদিন আগে আসা পিকআপের সাথে তার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্যাবের ক্যাপ নেই, সাথে হাবক্যাপও উধাও করে দেয়া হয়েছে আর সেই সাথে পুরো ট্রিমও বিদায় নিয়েছে। ভারমন্টের প্লেটের স্থানে এখন মোটেলের পেছনে ডাম্পস্টারের পাশে খুঁজে পাওয়া মেইটেনেন্স ট্রাকের নাম্বার প্লেট শোভা পাচ্ছে সে ডাম্পস্টারের ভেতরে বিছানার চাঁদর, ছররা আর বাকি সবকিছু ফেলে দিয়ে যাতে বোঝা না যায় সে কখনও এখানে এসেছিল।
এ্যানড্রোস পিরামিডের আশা এখনও ত্যাগ করেনি কিন্তু এই মুহূর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। তাকে লুকিয়ে ক্ষতস্থান নিরাময়ের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই এবং তারচেয়ে আগে কিছু খেতে হবে। সে রাস্তার পাশের এক ডাইনারে গিয়ে ঠেসে ডিম, বেকন, হ্যাস ব্রাউন আর তিন গ্লাস অরেঞ্জ জুস খায়। খাবার শেষ করে সে আরও খাবার অর্ডার দেয় নিয়ে যাবে বলে। রাস্তায় উঠে এ্যানড্রোস গাড়িও পুরানো রেডিও মন দিয়ে শোনে। তার এই বিপর্যয়ের পরে টিভি বা খবরের কাগজ সে দেখেনি, সে অবশেষে একটা স্থানীয় নিউজ স্টেশনের খবর শুনতে পায় রেডিওতে, যার রিপোর্ট শুনে সে রীতিমত চমকে যায়।
এফবিআই তদন্তকারীরা, সংবাদ পাঠক ঘোষণা করে, এখনও দুদিন আগে পোটোম্যাকে নিজের বাসায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ইসাবেল সলোমনের হত্যাকারীর কোন সন্ধান পায়নি। মনে করা হচ্ছে হত্যাকারী বরফের ভিতরে পড়ে গেলে তার লাশ সমুদ্রে ভেসে গিয়েছে।
এ্যানড্রোস ভয়ে জমে যায়। ইসাবেল সলোমনের হত্যাকাণ্ড? সে হতবিহ্বল হয়ে চুপ করে বাকি সংবাদ শোনে।
এই এলাকা ছেড়ে দূরে বহুদূরে পালিয়ে যাবার সময় হয়েছে।
.
সেন্ট্রাল পার্কের নয়ানাভিরাম দৃশ্য আপার ওয়েস্ট সাইডের এই এ্যাপার্টমেন্ট থেকে দেখা যায়। এ্যানড্রোস এই এ্যাপার্টমেন্টটা বেছে নিয়েছে। কারণ এ্যাড্রিয়াটিকের হারিয়ে যাওয়া দৃশ্যের কথা জানালার বাইরের এই সবুজ সমুদ্র তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সে জানে বেঁচে যাবার কারণেই তার খুশী হওয়া। উচিত কিন্তু সেটা সে হতে পারে না। নিঃসঙ্গতা তাকে কখনও ছেড়ে যায় না। এবং সে পিটার সলোমনের পিরামিড চুরি করার ব্যর্থতা সবসময়ে ভাবছে বুঝতে পারে।
ম্যাসনিক পিরামিডের কিংবদন্তি নিয়ে এ্যানড্রোস ঘন্টার পর ঘন্টা অনুসন্ধান চালিয়ে যায়, এবং পিরামিডের বাস্তবতা নিয়ে যদিও সবার ভিতরে একটা মতপার্থক্য রয়েছে কিন্তু তার বিখ্যাত জ্ঞান আর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে দেখা যায়। সবাই একমত। ম্যাসনিক পিরামিড একটা বাস্তবতা, এ্যানড্রোস নিজেকে বলে। আমার ব্যক্তিগত তথ্য নাকচ করা সম্ভব না।
নিয়তি পিরামিডটাতে এ্যানড্রোসের নাগালের ভিতরে নিয়ে এসেছে আর এটাকে অবজ্ঞা করার অর্থ লটারির প্রথম পুরষ্কার জেতা টিকিট হাতে নিয়ে সেটাকে না ভাঙাবার সামিল। আমি একমাত্র নন-ম্যাসন যে জানে পিরামিডটা বাস্তব…আর সে সেটা রক্ষা করছে।
মাস কেটে যায় এবং তার দেহ আরোগ্য লাভ করে, এ্যানড্রোসের গ্রীসে অবস্থানকালীন সেই অতিনিশ্চিত আত্মগর্বিত চরিত্র আর নেই। সে ব্যায়াম করা বন্ধ করে দিয়েছে এবং আয়নার নিজের নগ্ন দেহের দিকে এখন আর সে তাকিয়ে দেখে না। তার মনে হয় নিজের দেহে সে আজকাল জরার লক্ষণ দেখতে পায়। তার একদা নিখুঁত ত্বকে কেবল ক্ষতচিহ্নের কালিমা এবং সেটা তাকে আরও নিষন্ন করে তোলে। আহত থাকাকালীন অবস্থায় গ্রহণ করা বেদনানাশক বড়ির উপরে সে আজও নির্ভর করে এবং সে টের পায় সোগানলিক কারাগারে যে জীবনযাপনের কারনে সে অধঃপতিত হয়েছিল সেই পুরাতন চর্চায় সে আবার ফিরে যাচ্ছে। সে পরোয়া করে না। শরীর যা চায় শরীর সেটা আদায় করে ছাড়ে।
একরাতে, সে গ্রীনউইচ ভিলেজে এক লোকের কাছ থেকে ড্রাগস কিনে যার বাহুতে একটা বজ্রপাতের উল্কি আঁকা ছিল। এ্যানড্রোস তার কাছে জানতে চায় আর লোকটা তাকে বলে গাড়ি দুর্ঘটনার ক্ষত ঢাকতে সে এটা করিয়েছে। প্রতিদিন ক্ষতটার দিকে চোখ গেলে আমার সেই দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ত, ডিলার লোকটা বলে, আমি তার তার উপরে ব্যক্তিগত ক্ষমতার একটা প্রতীক
উল্কি করে নিয়েছি। আমি আবার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছি।
সেই রাতে, নতুন মাদকের ঘোরে আচ্ছন্ন এ্যানড্রোস স্থানীয় একটা উল্কিা। আঁকার পার্লারে প্রবেশ করে গায়ের শার্ট খুলে ফেলে। আমি এই ক্ষতচিহ্নগুলো ঢাকতে চাই, সে ঘোষণা দেয়। আমি আবার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে চাই।
ঢাকতে চান? উল্কি আঁকার কারিগর প্রশ্ন করে। কি দিয়ে?
উল্কি দিয়ে।
হ্যাঁ…মানে আমি বলতে চেয়েছি কিসের উল্কি দিয়ে?
এ্যানড্রোস কাঁধ ঝাঁকায়, সে কেবল তার অতীতের এই অশ্লীল স্মৃতিচিহ্ন ঢেকে দিতে চায়। আমি জানি না, তুমি এইটা পছন্দ কর।
উল্কি শিল্পী মাথা নাড়ে এবং তার হাতে প্রাচীন আর উল্কি আঁকবার সনাতন প্রথার উপরে একটা পুস্তিকা ধরিয়ে দেয়। প্রস্তুত হয়ে ফিরে এসো।
এ্যানড্রোস আবিষ্কার করে নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরীতে উল্কির উপরে। তিপ্পান্নটা বই রয়েছে, এবং কয়েক সপ্তাহের ভিতরে সে সবগুলো পড়ে শেষ করে। পড়ার প্রতি নিজের পুরানো আগ্রহ ফিরে পেতে সে তার এপার্টমেন্ট আর লাইব্রেরীতে কেবল ব্যাগ ভর্তি বই আনানেয়া করতে থাকে, যেখানে বসে। সেন্ট্রাল পার্কের দিকে তাকিয়ে সে তারিয়ে তারিয়ে সেগুলো পাঠ করে।
এই বইগুলো এনড্রোসের সামনে এমন একটা জগতের দ্বার অবারিত করে। যার অস্তিত্ব সম্পর্কেই সে জানত না-প্রতীক, মরমীবাদ, পূরাণ আর ম্যাজিক্যার আর্টের একটা দুনিয়া। সে যত পড়ে ততই বুঝতে পারে সে কি মূর্খই না ছিল। সে একটা নোটবইতে তার ধারণা, তার স্কেচ আর বিচিত্র স্বপ্ন লিখে রাখতে শুরু করে। লাইব্রেরীতে যখন সে আর তার চাহিদা মাফিক বই খুঁজে পায় না, সে বিরল বইয়ের ডিলারদের কাছ থেতে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বোধ্য বই কিনতে শুরু করে।
ডি প্রেসটিজিস ডেমোনাম…ল্যামেজিটন…আরস আরমাডেল…গ্রিমোরিয়াম ভারনুম…আরস নটোরিয়া…এবং আরো অনেক বই। সে সব পড়ে শেষ করে এবং নিশ্চিত হয় পৃথিবী তার জন্য এখনও অনেক সম্পদ আগলে রেখেছে। এমন অনেক রহস্য রয়েছে যা মানুষের বোধগম্যতা ছাপিয়ে যায়।
তারপরে সে অ্যালিস্টার ক্রাওলির লেখা আবিষ্কার করে- উনিশ শতকের গোড়ার দিকের এক স্বপ্নদর্শী মরমী লেখক- চার্চ যাকে এ পর্যন্ত জন্ম নেয়া সবচেয়ে দুষ্ট পাপী লোক আখ্যা দিয়েছিল। মহান আত্মা সবসময়ে ইতর আত্মার ভয়ে ভীত থাকে। এ্যানড্রোস পূজা আর অবতারের শক্তি সম্বন্ধে অবগত হয়। সে পবিত্র মন্ত্র আয়ত্ব করে যা ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারলে অপার্থিব জগতের দ্বার অবারিত হয়। আমাদের জগতের উর্ধ্বে যদি কোন ছায়াময় বিশ্ব থেকে থাকে….একটা জগত যেখান থেকে আমি শক্তি সঞ্চয় করতে পারি। এ্যানড্রোস যদিও সেই শক্তির অধিকারী হতে মরীয়া কিন্তু সে বুঝতে পারে তার। আগে অনেক নিয়ম আর কাজ সম্পাদন করতে হবে।
পবিত্র হতে চাইলে, ক্রাওলি লিখেছেন। নিজেকে আগে পবিত্র কর।
পবিত্র নির্মাণের প্রাচীন রীতি একসময়ে প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ইহুদিরা মন্দিরে নৈবেদ্য পুড়িয়ে উৎসর্গ করতো, মায়ারা চিচেন আটজার পিরামিডের উপরে মানুষ বলি দিতো, যীশু খ্রিস্ট নিজেকে ক্রুসে উৎসর্গ করেছেন, প্রাচীন মানুষেরা উৎসর্গের জন্য ঈশ্বর কি আশা করেন ভাল করেই বুঝত। উৎসর্গ হল মূল কৃত্যানুষ্ঠান যা দিয়ে মানুষ দেবতার কৃপা লাভ করতো এবং নিজেদের পবিত্র করতো।
স্যাকরা- পবিত্র
ফেস- করা
বহু শতাব্দি আগেই যদি উৎসর্গের এই অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে কিন্তু এর ক্ষমতা বজায় আছে। আধুনিক মরমীবাদীদের ভিতরে হাতে গোনা কয়েকজন যাদের ভিতরে ক্রাওলি অন্যতম এই কলা চর্চা করতেন এবং অনুশীলন করে নিজেদের ধীরে ধীরে অন্যকিছু একটায় পরিণত করেছিলেন। তাদের মত এ্যানড্রোস নিজেকে বদলে ফেলতে চায় কিন্তু জানে সেজন্য তাকে বিপজ্জনক সেতু অতিক্রম করতে হবে।
রক্তই আলো আর অন্ধকার পৃথক করে রাখে।
একরাতে একটা কাক এ্যানড্রোসের বাথরুমের খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এবং তার এপার্টমেন্টের ভেতরে আটকে যায়। এ্যানড্রোস পাখিটাকে তার বাসার ভিতরে কিছুক্ষণ উড়াউড়ি করে স্থির হয়ে বসতে দেখে যেন সে মেনে নিয়েছে এখান থেকে পালান যাবে না। এনড্রোস এতদিনে আলামত চিনতে শিখেছে। আমাকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ জানান হয়েছে।
পাখিটা এক হাতে আঁকড়ে ধরে সে তার রান্নাঘরে তৈরী করা অস্থায়ী বেদীতে দাঁড়ায় এবং একটা চাকু উঁচু করে ধরে মুখস্ত করা মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করে।
কামিয়াখ, এওমিয়াচে, এ্যামিয়াল, ম্যাকবাল, এ্যামোইই, জ্যাজিয়ান…বুক অব অ্যাসামাইয়ানের সবচেয়ে পবিত্র দেবদূতদের নামে, আমি তোমাদের নামের দোহাই দিয়ে বলছি যে একমাত্র সত্যিকারের ঈশ্বরের ক্ষমতার দ্বারা আমাকে এই অভীষ্ট কাজে সহায়তা কর।
এ্যানড্রোস চাকুটা নামিয়ে এনে আতঙ্কিত পাখিটার ডান পক্ষে অবস্থিত বড় শিরাটা ছিন্ন করে। কাকটার ছোট দেহ থেকে রক্তপাত শুরু হয়। সে ধারক হিসাবে রাখা ধাতব পেয়ালায় কাকের দেহ থেকে নিঃসৃত রক্ত জমা হতে দেখে, বাতাসে সে একটা অপ্রত্যাশিত শীতলতা অনুভব করে। যাই হোক সে কাজ চালিয়ে যায়।
সর্বশক্তিমান এ্যাডোনাই, অ্যারান, আশাই, এ্যালোহিম, এ্যালোহি, এ্যালিয়ন, অ্যাশের এ্যাইয়েহু, শাই…আমার সহায় হও, যাতে এই রক্ত আমার সকল আশা আর আমার সকল কামনার দক্ষতা আর শক্তি অর্জন করতে পারে।
সেই রাতে সে পাখির স্বপ্ন দেখে…একটা বিশাল ফিনিক্স আগুনের হলকা থেকে উঠে আসছে। পরের দিন সকালে সে একটা নতুন শক্তি নিয়ে জেগে উঠে যা জন্মাবধি সে অনুভব করেনি। সে পার্কে দৌড়াতে গিয়ে দেখে যতটা ভেবেছিল তার চেয়ে দ্রুত আর দূরত্ব সে অতিক্রম করতে পারছে। যখন আর দৌড়াতে পারে না তখন সে পুশ-আপ দেবার জন্য থামে। অগণিতবার সে প্রক্রিয়াটা চালিয়ে যায়। তারপরেও আরও করার শক্তি সে নিজের ভেতরে অনুভব করে।
সেই রাতে আবার সে সেই একই ফিনিক্সটা স্বপ্নে দেখে।
.
সেন্ট্রাল পার্কে আবার শরৎ কাল ফিরে এসেছে এবং বন্য জন্তুরা শীতের খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। এ্যানড্রোস শীত পছন্দ করে না এবং তারপরেও সতর্কতার সাথে পাতা ফাঁদে অসংখ্য কাঠবিড়ালী আর জ্যান্ত ইঁদুর ধরা পড়তে থাকে। সে ব্যাগে ভরে তাদের বাসায় নিয়ে এসে আরও জটিল সব পূজা পালন শুরু করে।
ইম্যানুয়েল, মাসিয়াখ, ইয়ড, হে, ভাউড. ..আমাকে যোগ্যতা দাও।
রক্ত পূজা তার প্রাণশক্তি বাড়িয়ে তুলে। এ্যানড্রোস দিন দিন নিজের বয়স কমছে বলে টের পায়। সে দিনরাত তার পড়া চালিয়ে যায়। প্রাচীন মরমী পাণ্ডুলিপি, মধ্যযুগের মহাকাব্য, প্রাচীন দার্শনিকদের লেখা- আর সে যতই বস্তু সত্যিকারের প্রকৃতি সম্বন্ধে জানতে পারে ততই বুঝতে পারে মানবজাতির সব আশা হারিয়ে গেছে। তারা অন্ধ…একটা পৃথিবীতে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে মরছে যা তারা কখনও বুঝতে পারবে না।
এ্যানড্রোস এখনও পুরুষ কিন্তু সে অনুভব করে অন্য কিছু একটায় তার রূপান্তর শুরু হয়েছে। বড় কিছু একটা। পবিত্র কিছু একটা। সুপ্তবস্থা থেকে তার অতিকায় দেহসৌষ্ঠব জাগ্রত হয় এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। অবশেষে সে এর সত্যিকারের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। আমার দেহ আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ধারক…আমার মস্তিষ্ক।
এ্যানড্রোস জানে তার আসল সম্ভাবনা এখন পূর্ণ হয়নি এবং সে আরও গভীরে প্রবেশ করে। আমার নিয়তি কি? সব প্রাচীন বইয়ে ভাল আর মন্দের কথা লেখা রয়েছে…এবং বলা হয়েছে তাদের ভিতর থেকে একটা বেছে নিতে। আমি অনেক আগেই আমার পছন্দ বেছে নিয়েছি, সে জানে আর সেজন্য সে অনুতপ্ত নয়। কেবলই একটা প্রাকৃতিক আইনব্যতীত, মন্দ কি? আলোর পরেই আসে অন্ধকার। শৃঙ্খলার পরে আসে বিশৃঙ্খলা। এনট্রোপি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সবকিছুরই ক্ষয় আছে। নিখুঁত স্ফটিকও শেষ পর্যন্ত ধূলিকণায় পরিণত হয়।
কেউ কেবল নির্মাণ করে…কেউ কেবলই ধ্বংস।
মিলটনের প্যারাডাইজ লস্ট পাঠ করার আগে এ্যানড্রোস নিজের নিয়তি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে না। সে তার নিয়তিকে তার সামনে দেখতে পায়। সে অধঃপতিত দেবদূতের কথা পড়ে…অশুভ যোদ্ধা যে আলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে…বীর যোদ্ধা…দেবদূত যার নাম মলোখ।
পৃথিবীর বুকে মলোখ দেবতার গর্বে হেঁটে বেড়ায়। দেবদূতের নাম এ্যানড্রোস পরে জানতে পারে প্রাচীন ভাষায় অনুদিত হয়ে মাল’আখে পরিণত হয়েছে।
আমিও তাই হব।
সব মহান রূপান্তরের মত, এটাই একটা উৎসর্গের মাধ্যমে শুরু হয়…কিন্তু এবার আর ইঁদুর বা বিড়াল উৎসর্গ করা হয় না। এই রূপান্তর একটা সত্যিকারের উৎসর্গ দাবী করে।
কেবল একটা বিষয়ই আছে যা উৎসর্গিত হবার যোগ্যতা রাখে।
জীবনে আগে কখনও অনুভব করেনি এমন একটা নিশ্চয়তাবোধ সে অনুভব করে। তার সমগ্র নিয়তি মাত্রা পায়। তিনরাত সে নাগাড়ে একটা বিশাল কাগজের উপরে নক্সা এঁকে চলে। শেষ হবার পরে সে নিজের ভবিষ্যৎ চেহারা সেখানে দেখতে পায় সে যা হবার স্বপ্ন দেখেছে।
সে প্রমাণ আঁকৃতির স্কেচটা দেয়ালে ঝুলিয়ে আয়নার মত সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি একটা শিল্পবস্তু মাস্টারপীস। পরের দিন সে উল্কি আঁকবার পার্লারে স্কেচটা নিয়ে হাজির হয়। সে প্রস্তুত।
.
৭৮ অধ্যায়
ভার্জিনিয়ার আলেকজান্দ্রিয়ার সুটার হিলের উপরে দি জর্জওয়াশিংটন ম্যাসোনিক মেমোরিয়াল অবস্থিত। ডোরিক, আয়নিক আর কোরিস্থিয়ান- তিনটা আলাদা আলাদা স্থাপত্য শৈলীতে ক্রমশ জটিল হয়ে উঠা তিনধাপে নির্মিত এই কাঠামো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থানের একটা নিরেট নিদর্শন। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় নির্মিত ফারাওয়ের বাতিঘর দ্বারা অনুপ্রাণিত এই সুউচ্চ টাওয়ারের শীর্ষদেশে অগ্নিশিখার ন্যায় একটা মিশরীয় পিরামিডের ফিনিয়াল রয়েছে।
ম্যাসনিক রিগেলিয়া সজ্জিত জর্জ ওয়াশিংটনের একটা ব্রোঞ্জের মূর্তি ভেতরের চমকপ্রদ মার্বেলের ফোয়ারে বসে আছে, পাশেই রাখা আছে ক্যাপিটল ভবনের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনে ব্যবহৃত আসল কর্ণিক। ফোয়্যারের উপরে নয়টা ভিন্ন। ভিন্ন লেভেলের নামের ভেতরে কয়েকটা নাম হল, দি গ্রোটো, দি ক্রিপট রুম, দি নাইটস টেম্পলার চ্যাপেল। এইসব স্থানে রক্ষিত সম্পদের ভিতরে রয়েছে। ম্যাসনিক লেখা সমৃদ্ধ বিশ হাজার খণ্ড পুস্তক,আঁর্ক অব দি কভেনেন্টের চমকপ্রদ প্রতিরূপ এমনকি কিং সলোমনের টেম্পলের সিংহাসন কক্ষের আনুপাতিক মডেল।
পোটোম্যাকের উপর অনেক নীচ দিয়ে উড়ে যাবার সময়ে রূপান্তরিত ইউএইচ-৬০ চপারে বসে সিআইএ এজেন্ট সিমকিনস নিজের ঘড়িতে সময় দেখে। ছয় মিনিট বাকী আছে তাদের ট্রেন আসতে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে দূরে দিগন্তে জ্বলজ্বল করতে থাকা ম্যাসনিক স্মরণিকার দিকে তাকায়। সে মনে মনে স্বীকার করে ন্যাশনাল মলের যেকোন স্থাপত্যের মতই চমকপ্রদ ভীষণভাবে আলোকিত টাওয়ারটা। সিমকিনস কখনও মেমোরিয়ালের ভিতরে প্রবেশ করেনি এবং আজ রাতেও প্রবেশের কোন সম্ভাবনা নেই। সবকিছু পরিকল্পনা মত ঘটলে ক্যাথরিন আর রবার্ট সাবওয়ে স্টেশন থেকেই বের হয়ে হয়ে আসতে পারবে না।
ঐ যে ওখানে? সিমকিনস পাইলটকে চিৎকার করে মেমোরিয়ালের উল্টো দিকে কিংওয়ে সাবওয়ে স্টেশন দেখায়। পাইলট সুটার হিল বরাবর হেলিকপ্টারটা রেখে তার পাদদেশের সবুজ ঘাসে ছাওয়া একটা জায়গায় সেটা নিরাপদে নামিয়ে আনে।
পথচারীরা সিমর্কিনস আর তার দলের দিকে বিস্মিত হয়ে তাকায় যখন তারা রাস্তার উপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে কিং স্ট্রীট স্টেশনের দিকে নেমে যায়। সিঁড়িতে উপরে উঠে আসা যাত্রীরা লাফ দিয়ে তাদের পথ থেকে সরে গিয়ে দেয়ালের সাথে সেটে যায়, কালো পোশাক পরিহিত অস্ত্রধারী কাফেলা এগিয়ে আসতে দেখে।
সিমকিনস যা ধারণা করেছিল দেখা যায় কিং স্ট্রিট স্টেশন তার চেয়ে অনেক বড়- নীল, হলুদ, অ্যামট্রাক ভিন্ন ভিন্ন বেশ কয়েকটা লাইনে বিভক্ত। সে দেয়ালে আটকানো মেট্রো ম্যাপের দিকে দিকে ছুটে যায়, ফ্রিডম প্লাজা আর এই স্থানের ভেতরে সরাসরি লাইনটা খুঁজে বের করে।
নীল লাইন, দক্ষিণের প্লাটফর্ম, সিমকিনস চিৎকার করে বলে। সেখানে পৌঁছে সবাই লুকিয়ে পড়? তার দল সেদিকে দৌড়ে যায়।
সিমকিনস টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়, নিজের আইডি দেখিয়ে ভিতরের মহিলার সাথে চেঁচিয়ে কথা বলে। মেট্রো স্টেশন থেকে পরের ট্রেন-সেটা কখন এখানে পৌঁছাবে?
ভেতরের মহিলাকে আতঙ্কি দেখায়। আমি ঠিক বলতে পারব না। নীল লাইন এগার মিনিট পর পর আসে। কোন নির্দিষ্ট সময়সূচী নেই।
শেষ ট্রেন কতক্ষণ আগে এসেছে?
পাঁচ…ছয় মিনিট, সম্ভবত? তার বেশি হয়নি।
টার্নার অংক কষে। নিখুঁত। পরেই ট্রেনই ল্যাংডনদের ট্রেন।
.
দ্রুতগামী সাবওয়ে ট্রেনের কামরায় ক্যাথরিন অস্বস্তির সাথে শক্ত প্লাস্টিকের সীটে নড়েচড়ে বসে। মাথার উপরে জ্বলতে থাকা উজ্জ্বল ফুরোসেন্ট আলোয় চোখ ব্যথা করে, এবং এক সেকেণ্ডের জন্য হলেও চোখ বন্ধ করার ইচ্ছা সে বহুকষ্টে দমিয়ে রাখে। ল্যাংডন তার পাশের খালি সিটে বসে, নিজের পায়ের কাছে রাখা লেদারের ব্যাগের দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখের পাতা ভারী মনে হয় যেন চলন্ত ট্রেনের দুলুনি তাকে আবিষ্ট করতে চাইছে।
ক্যাথরিন ল্যাংডনের ব্যাগের ভেতরে আজব জিনিস দুটোর কথা ভাবে। সিআইএ এই পিরামিড কেন চায়? বেল্লামির ধারণা সাটো হয়ত পিরামিডের গোমর জানে তাই সে এর পিছু নিয়েছে। কিন্তু এই পিরামিড যদি সত্যিই প্রাচীন রহস্যের লুকিয়ে রাখার স্থান উন্মোচিত করে ক্যাথরিনের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এর আদি মরমী জ্ঞানর প্রতি সিআইএর আগ্রহ রয়েছে।
তারপরে তার মনে পড়ে প্যারাসাইকোলজিক্যাল বা পিএসআই প্রোগ্রাম যা প্রাচীন যাদুবিদ্যা আর মরমীবাদের সাথে সম্পর্কিত পরিচালনা করতে গিয়ে সিআইএ বেশ কয়েকবার ধরা পড়ে নাকাল হয়েছে। ১৯৯৫ সালে, স্টারগেট স্ক্যানেট কেলেঙ্কারীর সিআইএর ক্লাসিফায়েড প্রযুক্তি যা দূরবর্তী দর্শন নামে পরিচিত-এক ধরণের টেলিপ্যাথিক মানসিক ভ্রমণ যা এর দর্শককে দূরবর্তী কোন স্থানে মানস চক্ষু স্থানান্তরিত করে সেখানে গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনায় সাহায্য করে, কোন ধরনের শারিরীক উপস্থিতি ব্যাতীত। অবশ্য প্রযুক্তিটা নতুন কিছু না। মরমীবাদী বা সুফীসাধকরা একে নাক্ষত্রিক প্রক্ষেপণ বলে আর যোগীরা একে বলে অশরীরি অভিজ্ঞতা। দুর্ভাগ্যক্রমে আমেরিকার করদাতারা একে অবাস্ত ব বলে অভিহিত করে এবং কার্যক্রমটার ভরাডুবি ঘটে। নিদেনপক্ষে জনগণ তাই জানে।
বিড়ম্বনার কথা হল ক্যাথরিন সিআইএর ব্যর্থ কার্যক্রম আর নিজের নিওটিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক সাফল্যের ভিতরে দারুণ সাদৃশ্য খুঁজে পায়।
ক্যাথরিন পুলিশে ফোন করে ক্যালোরমা হাইটসে তারা কিছু খুঁজে পেয়েছে কিনা জানার জন্য অস্থির হয়ে আছে কিন্তু এই মুহূর্তে তার বা ল্যাংডন কারো কাছে ফোন নেই আর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করাটা এই মুহূর্তে একটা সম্ভবত ঠিক হবে না; সাটোর হাত কতদূর প্রসারিত কে জানে।
ক্যাথরিন ধৈৰ্য্য ধর। কয়েক মিনিটের ভিতরে তারা একটা নিরাপদ গোপন আশ্রয়ে পৌঁছে যাবে এমন এক লোকের অতিথি হিসাবে যে আশ্বাস দিয়েছে সে তাদের উত্তর দিতে পারবে। ক্যাথরিন আশা করে তার উত্তর যাই হোক না কেন। তার ভাইয়ের প্রাণ বাঁচাতে সহায়তা করবে।
রবার্ট? সে ফিসফিস করে বলে, সাবওয়ের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে সে বলে। আমরা পরের স্টপে নামব।
ল্যাংডন ধীরে ধীরে তার দিবাস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে। ঠিক আছে, ধন্যবাদ। স্টেশনের দিকে ট্রেনটা তাদের নিয়ে গড়িয়ে যেতে থাকলে সে তার ডেব্যাগটা তুলে নিয়ে অনিশ্চিত দৃষ্টিতে ক্যাথরিনের দিকে তাকায়। শুধু প্রার্থনা কর আমাদের আগমন যেন ঘটনাবহুল না হয়।
.
টার্নার সিমকিনস দৌড়ে তার লোকেদের সাথে যোগ দেবার আগেই পুরো প্লাটফর্ম জনশূন্য করে ফেলা হয়েছে, তার লোকেরা ছড়িয়ে পড়ে প্লাটফর্মের দৈর্ঘ্য বরাবর পিলারের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। প্লাটফর্মের দূরবর্তী প্রান্তের টানেলের ভিতর থেকে একটা দূরাগম গমগম শব্দ শোনা যায় এবং শব্দ জোরাল হলে সিমকিনস টের পায় একটা একটা উষ্ণ শুষ্ক বাতাস তার চারপাশে ঢেউয়ের মত প্রবাহিত হচ্ছে।
ল্যাংডন এবার আর পালাতে পারবে না।
সে প্লাটফর্মে তার সাথে যে দুজন এজেন্টকে আসতে বলেছে তাদের দিকে তাকায়। আইডি আর অস্ত্র বের কর। এই ট্রেনগুলো অটোমেটেড হলেও সবগুলোতে কনডাকটর রয়েছে যে দরজা খুলে। তাকে খুঁজে বের কর।
ট্রেনের আলো এবার টানেলে দেখা যায় আর ব্রেকের তীক্ষ্ণ শব্দ বাতাস চিরে যায়। ট্রেনটা স্টেশনে প্রবেশ করে গতি হ্রাস করতে শুরু করলে, সিমকিনস আর দুই এজেন্ট লাইনের উপরে ঝুঁকে সিআইএর আইডি নাড়িয়ে কনডাকটর দরজা খোলার আগেই তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়।
ট্রেন দ্রুত এগিয়ে আসে। তৃতীয় বগিতে সিমকিনস শেষ পর্যন্ত কনডাকটরকে দেখতে পায় যে আপাত দৃষ্টিতে তিনজন কালো পোশাক পরিহিত লোক কেন তার দিকে সিআইএর আইডি আন্দোলিত করছে বোঝার চেষ্টায় ব্যস্ত। সিমকিনস প্রায় থেমে পড়া ট্রেনের দিকে দৌড়ে যায়।
সিআইএ, সে চেঁচিয়ে হাতের আইডি প্রদর্শন করে বলে। দরজা খুলো। না? ট্রেনটা ধীরে তার পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে সে কনডাকটরের বগির দিকে তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যায়। দরজা খুলবে না? বুঝতে পেরেছো?! দরজা বন্ধ থাকবে!
ট্রেন এবার দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখ বড়বড় করে কনডাকটর মাথা নাড়ে। কি হয়েছে, লোকটা তার পাশের জানালা দিয়ে মুখ বের করে জানতে চায়।
ট্রেনটা নড়তে দেবে না, সিমকিনস বলে। দরজাও বন্ধ থাকবে।
ঠিক আছে।
তুমি আমাদের প্রথম বগিতে ঢুকবার ব্যবস্থা করতে পারবে?
কনডাকটর মাথা নাড়ে। ভয়চকিত চেহারায় সে ট্রেন থেকে নেমে, তার বগির দরজা বন্ধ করে দেয়। সে সিমকিনস আর তার লোকদের প্রথম বগির কাছে নিয়ে এসে ম্যানুয়ালি দরজা খুলে দেয়।
আমরা ঢুকলে এটা বন্ধ করে দেবে, সিমকিনস অস্ত্র বের করতে করতে বলে। সিমকিনস আর তার লোকেরা প্রথম বগির উজ্জ্বল আলোয় দ্রুত প্রবেশ করে। কনডাকটর তাদের কথামত দরজা বন্ধ করে দেয়।
প্রথম বগিতে কেবল চারজন যাত্রী রয়েছে তিন কিশোর আর এক বৃদ্ধ মহিলা: তাদের সবার চোখে অস্ত্র হাতে তিনজন লোককে প্রবেশ করতে দেখে পরিচিত বিস্ময় ফুটে উঠে। সিমকিনস তার আইডি দেখায়। সব ঠিক আছে। চুপ করে বসে থাক।
সিমকিনস আর তার লোকেরা এবার একটা একটা করে বগি সার্চ করতে করতে পেছনের দিকে এগিয়ে যায়- ফার্মে প্রশিক্ষণের সময় এই ড্রিলটার নাম ছিল টিউব থেকে টুথপেস্ট বের করা। ট্রেনে খুবই কম যাত্রী এবং অর্ধেক অতিক্রম করার পরেও ক্যাথরিন আর ল্যাংডনের সাথে চেহারা মিলে এমন একজনকেও তারা খুঁজে পায় না। অবশ্য সিমকিনস আশাবাদী। সাবওয়ে ট্রেনে লুকিয়ে থাকার কোন জায়গা নেই। বাথরুম, স্টোরেজ বা বিকল্প পথ কিছুই নেই এখানে। টার্গেট যদি তাদের ট্রেনে উঠতে দেখে পিছনে পালিয়ে গিয়ে থাকে, তারা বাইরে বের হতে পারবে না। দরজা জোর করে খোলা অসম্ভব আর সিমকিনসের লোকেরা প্লাটফর্মের দুদিক থেকেই ট্রেনের উপরে নজর রেখেছে।
ধৈৰ্য্য ধর।
শেষ বগির আগের বগিতে পৌঁছালে সিমকিনসের ভেতরে আঁকুপাকু শুরু হয়। শেষের আগের এই বগিতে কেবল একজন যাত্রী- এক চীনা ভদ্রলোক। সিমকিনস আর তার লোকেরা সীটের নীচে উঁকি দেয় কেউ লুকিয়ে আছে কিনা দেখতে। কেউ নেই।
শেষ বগি, সিমকিনস আর তার লোকেরা বীরে মত অস্ত্র উচিতে শেষ বগির প্রবেশ মুখে পৌঁছাতে, সিমকিনস বলে। শেষ বগিতে প্রবেশ করেই তিনজন পাথরের মত দাঁড়িয়ে পড়ে।
নিকুচি করি…?! সিমকিনস সব হারান লোকের মত অধীর হয়ে খালি বগির শেষপ্রান্তে দৌড়ে আসে, সীটের নীচে উঁকি দেয়। তার লোকদের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়, পায়ের রক্ত মাথায় উঠে আসছে। ব্যাটারা গেল কোথায়?
.
৭৯ অধ্যায়
আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আটমাইল উত্তরে, ক্যাথরিন আর ল্যাংডন শান্তভাবে একটা তুষারাবৃত একটা লনের উপর দিয়ে হেঁটে চলে।
তোমার অভিনেত্রী হওয়া উচিত ছিল, ক্যাথরিনের উপস্থিত বুদ্ধি আর উদ্ভাবনী দক্ষতায় তখনও মুগ্ধ, ল্যাংডন বলে।
তুমিও কম যাও না, ক্যাথরিন তার দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে হানে।
ট্যাক্সিক্যাবে ল্যাংডন প্রথমে ক্যাথরিনের আঁকস্মিক আঁচরণের কোন মানে বুঝতে পারেনি। কোন জানান না দিয়ে সে সহসা ফ্রিডম প্লাজার যাবে বলে জেদ। শুরু করে, ইউরাইটের স্টেটের গ্রেট সীল আর ইহুদিদের তারকা সম্পর্কে কিছু একটা তার মনে পড়েছে। সে ডলারের উপরে একটা সুপরিচিত আর জনপ্রিয়। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতীক আকে এবং ল্যাংডনকে বলে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে, সে যেখানে নির্দেশ করছে।
ল্যাংডন অনেক পরে বুঝে সে আসলে ডলার বিল না ড্রাইভারের সীটের পেছনে অবস্থিত একটা আলোর দিকে নির্দেশ করছে। আলোটা ময়লায় ঢাকা। বলে সে প্রথমে দেখতে পায়নি। সে সামনে ঝুঁকে পড়ে দেখে আলোটা জ্বলছে আর একটা মৃদু লাল আলো দপদপ করছে। আলোর নীচে সে আবছা ভাবে দেখে দুটো শব্দ লেখা আছে।
–ইন্টারকম অন–
চমকে উঠে সে ক্যাথরিনের দিকে তাকায় যার চোখের মরিয়া দৃষ্টি সামনের সীটে কিছু একটা তাকে দেখাতে চায়। সে তার কথামত, আড়চোখে ড্রাইভারের দিকে তাকায়। ক্যাব চালকের সেল ফোন ড্যাসবোর্ডের উপরে রাখা, পুরো খোলা, আলোকিত আর ইন্টারকমের স্পিকারের সামনে রাখা। সাথে সাথে ল্যাংডন ক্যাথরিনের আঁচরণের মানে বুঝতে পারে।
তারা টের পেয়েছে আমরা ক্যাবে…আমাদের কথা তারা শুনছে।
ল্যাংডন বুঝতে পারে না তাদের ট্যাক্সি থামাবার আগে আর কতটুকু সময় তাদের হাতে আছে, কিন্তু জানে দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। সাথে সাথে, ল্যাংডন নিজের মনে খেলাটা শুরু করে, সে কেবল জানে ফ্রিডম প্লাজার সাথে পিরামিডের কোন সম্পর্ক নেই ক্যাথরিন সেখানে যেতে চাইছে সেখানে অবস্থিত সাবওয়ে স্টেশন- মেট্রো সেন্টার থাকার কারণে যেখান থেকে তারা লাল, নীল বা কমলা যে কোন একটা লাইন অনুসরণ করে ছয়টা ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।
ফ্রিডম প্লাজায় পৌঁছে তারা ক্যাব থেকে দ্রুত নামে এবং ল্যাংডন এখানে। তার শেষ প্রলেপটা দেয়, আলেকজান্দ্রিয়ার ম্যাসোনিক মেমোরিয়ালের একটা সুতো ছেড়ে দিয়ে, সে আর ক্যাথরিন দ্রুত সাবওয়ে স্টেশনে নেমে আসে আর নীল লাইন অতিক্রম করে এবং লাল লাইনের কাছে এসে বিপরীত মুখী একটা ট্রেনে উঠে পড়ে।
উত্তর দিকে ছয়টা স্টেশন অতিক্রম করে টেনলীটাউনে এসে তারা এক নির্জন উচ্চবিত্ত এলাকায় নেমে পড়ে। তাদের গন্তব্য, কয়েক মাইলের ভিতরে সবচেয়ে উঁচু কাঠামো সাথে সাথে দিগন্তে ভেসে উঠে, ম্যাসাচুসেটস এ্যাভিনিউয়ের ঠিক পরেই যত্ন নেয়া বিশাল লনের মাঝে।
এখন ক্যাথরিন যাকে বেপথে হাঁটা বলে থাকে, তারা দুজনে ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে ঠিক সেভাবে এগিয়ে যায়। তাদের বামে মধ্যযুগীয় রীতির বাগান, প্রাচীন গোলাপে ঝাড় আর শ্যাডো হাউজ গেজাবোর কারণে বিখ্যাত। তারা বাগান অতিক্রম করে রাজকীয় ভবনটার দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তাদের ডাকা হয়েছে। মাউন্ট সিনাইয়ের দশটা পাথর রয়েছে যে আশ্রয়স্থানে, একটা স্বর্গ থেকে চ্যুত, এবং একটা লুকের কৃষ্ণ বাবার অবয়ব দেখা যায়।
রাতের বেলা আমি কখনও এখানে আসিনি, ক্যাথরিন, আলোকিত টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে। দারুণ লাগছে দেখতে।
ল্যাংডন ভুলেই গিয়েছিল এই জায়গাটা কতটা অসাধারণ দেখতে। এ্যামবাসী রোর উত্তর প্রান্তে এই নিও-গথির মাস্টারপীসটা অবস্থিত। বহু বছর আগে বাচ্চাদের জন্য একটা আর্টিকেল লিখেছিল এই আশা নিয়ে যে এই অসাধারণ ল্যাণ্ডমার্ক দেখতে আসা কচি মনের ছেলেমেয়েদের ভিতরে কিছুটা উত্তেজনার খোরাক সরবরাহ করা, তারপরে সে আর এখানে আসেনি। তার। আর্টিকেল- মোজেস, মুন, রকস আর স্টারওয়রস- পর্যটকদের অবশ্যপাঠ্য হিসাবে বহুবছর জনপ্রিয় ছিল।
ওয়াশিংটন ন্যাশনাল ক্যাথিড্রাল, ল্যাংডন ভাবে, এত বছর পরে আবার অপ্রত্যাশিত মনোযোগের কেন্দ্রে নিজেকে আবিষ্কার করেছে। একমাত্র সত্যিকারের ঈশ্বর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করার এর চেয়ে ভাল জায়গা আর কি হতে পারে?
এই ক্যাথিড্রালে কি আসলেও মাউন্ট সিনাইয়ের দশটা পাথর আছে? ক্যাথরিন টুইন-বেল টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়।
ল্যাংডন মাথা নাড়ে। প্রধান অন্টারের কাছে। তারা সিনাই পাহাড়ে মোজেসকে দেয়া টেন কমাণ্ডমেন্টস এর প্রতীকি প্রকাশ।
আর এখানে চাঁদের পাথরও আছে?
স্বর্গ থেকে নিয়ে আসা পাথর। হ্যাঁ। স্পেস উইনডো বলে পরিচিত একটা রঙিন কাঁচের জানালায় চাঁদের পাথরের টুকরো প্রোথিত আছে।
কিন্তু শেষের বিষয়টা নিয়ে তুমি নিশ্চয়ই সিরিয়াস না, ক্যাথরিন আড় চোখে তাকিয়ে বলে, তার সুন্দর চোখের তারায় সংশয় ঝলসায়। ডার্থ ভাডরের…মূর্তি?
ল্যাংডন হাসে। লুক স্কাইওয়াকারের কৃষ্ণ বাবা? অবশ্যই। ভাডর ন্যাশনাল ক্যাথিড্রালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধাতবচোও। সে পশ্চিম দিকের টাওয়ার দেখিয়ে বলে। রাতের বেলা তাকে দেখা কঠিন কিন্তু ওখানে সে আছে।
ডার্থ ভাডর এত জায়গা থাকতে ওয়াশিংটন ন্যাশনাল ক্যাথিড্রালে কি করছে?
বাচ্চাদের জন্য একটা চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিল বিষয় ছিল শয়তানের মুখের মত দেখতে ছাদ থেকে পানি নিষ্কাশনের চোঙ আঁকা। ডার্থ জয়ী হয়েছিল।
প্রধান ফটকের বিশাল সিঁড়ির কাছে তারা পৌঁছে যা একটা চোখ ধাধিয়ে দেয়া রোজ উইনডোর নীচে আশি ফুট তোরণের ভিতরে স্থাপিত। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ল্যাংডন তাদের রহস্যময় আগন্তুকের কথা ভাবে যিনি তাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। দয়া করে কোন নাম বলবেন না…আমাকে কেবল বলেন আপনার কাছে গচ্ছিত রাখা ম্যাপ আপনি সাফল্যের সাথে রক্ষা করেছেন? ভারী পাথরের পিরামিডটা বহন করতে করতে ল্যাংডনের কাঁধ ব্যথা হয়ে গেছে এবং সে ব্যাগটা নামিয়ে রাখতে চায়। আশ্রয় আর উত্তর।
সিঁড়ির উপরে উঠে এসে তারা অতিকায় এক জোড়া কাঠের বন্ধ দরজার মুখোমুখি হয়। আমরা কি নক করবো? ক্যাথরিন জানতে চায়।
ল্যাংডন একই কথা ভাবছিলো, কেবল এখন দরজাটা খুলে যায়।
কে ওখানে? একটা দুর্বল কণ্ঠ জিজ্ঞেস করে। দরজায় একটা বৃদ্ধের কোচকানো মুখ দেখা যায়। তার চোখ অসচ্ছ, সাদা আর ছানির কারণে ঘোলাটে।
আমার নাম রবার্ট ল্যাংডন, সে বলে। ক্যাথরিন সলোমন আর আমি শরণ চাইছি।
অন্ধলোকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
.
৮০ অধ্যায়
ওয়ারেন বেল্লামি সহসা আশার একটা আলো দেখতে পান।
জঙ্গলের ভিতরে, ডিরেকটর সাটো সহসা ফিল্ড এজেন্টের কাজ একটা ফোন কল পায় আর তার পরেই তার ক্রোধোদীপ্ত আস্ফালন শুরু হয়। বেশ তুমি তাদের খুঁজে বের করবে।! সে টেলিফোনে চেঁচিয়ে বলে। আমাদের হাতে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সে লাইন কেটে দেয় এবং বেল্লামির সামনে পায়চারি করতে থাকে যেন ঠিক করতে পারছে না এবার তার কি করা উচিত।
অবশেষে সে ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং ঘুরে। মি. বেল্লামি আমি আপনাকে একবার ঠিক একবার জিজ্ঞেস করবো। তার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে। হ্যাঁ অথবা না- আপনার কি কোন ধারণা আছে রবার্ট ল্যাংডন কোথায় যেতে পারে?
ধারণার চেয়ে ভাল কিছু সে তাকে বলতে পারে, কিন্তু সে মাথা নাড়ে।
সাটোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে। দুর্ভাগ্যবশত, আমার চাকরির একটা দায়িত্ব হল মানুষ কখন মিথ্যা বলছে সেটা বুঝতে পারা।
বেল্লামি চোখ সরিয়ে নেয়। দুঃখিত, তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না।
স্থপতি বেল্লামি, সাটো বলে, আজ রাত ঠিক সাতটার সময়ে তুমি শহরের বাইরে একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার করছিলে যখন একটা লোক তোমাকে ফোন করে জানায় সে পিটার সলোমনকে অপহরণ করেছে।
বেল্লামির হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে আসে এবং সে আবার সাটোর চোখের দিকে তাকায়। তুমি সেটা কিভাবে জানলে?!
সেই লোকটা, সাটো বলে চলে, তোমাকে বলে যে রবার্ট ল্যাংডনকে সে ক্যাপিটল ভবনে পাঠিয়েছে এবং তাকে একটা কাজ দিয়েছে শেষ করার জন্য…একটা কাজ যাতে তোমার সাহায্য সাহায্য তার প্রয়োজন হবে। সে তোমাকে সতর্ক করে দেয় যে রবার্ট ল্যাংডন যদি কাজটা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তোমার বন্ধু পিটার সলোমন মারা যাবে। আতঙ্কিত হয়ে তুমি পিটারের সব নাম্বারে ফোন করে তার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা কর। বোঝাই যায়, এরপরেই তুমি ক্যাপিটল ভবনের দিকে পাগলের মত ছুটে আস।
বেল্লামি এখনও বুঝতে পারে না সাটো ফোন কলের কথা কিভাবে জানল।
তুমি যখন ক্যাপিটলের দিকে ছুটে আসছো, সিগারেটের জলন্ত ডগার পেছন থেকে সাটো বলে চলে, তুমি সলোমনের অপহরণকারীকে একটা টেক্সট ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, তাতে তুমি তাকে আশ্বস্ত করে লিখেছো যে তুমি আর ল্যাংডন ম্যাসনিক পিরামিড সাফল্যের সাথে খুঁজে পেয়েছে।
এসব তথ্য সে পেলো কোথা থেকে বেল্লামি চিন্তায় পড়ে যায়। ল্যাংডনও জানে না আমি টেক্সট ম্যাসেজ পাঠিয়েছি। লাইব্রেরী অব কংগ্রেসে যাবার টানেলে প্রবেশের ঠিক পরে পরেই বেল্লামি ইলেকট্রিক রুমে গিয়েছিল নিমার্ণ কাজের জন্য স্থাপিত আলো জ্বালাতে। সেই মুহূর্তের একান্ততায়, সে সলোমনের অপহরণকারীকে দ্রুত একটা টেক্সট ম্যাসেজ পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে সাটোর নাক গলাবার বিষয়টা জানায়, কিন্তু আশ্বস্ত করে যে সে- বেল্লামি আর ল্যাংডন পিরামিডটা নিয়ে পালিয়েছে আর তারা তার চাহিদার সাথে সহযোগিতা করবে। এটা, অবশ্যই, মিথ্যা কথা কিন্তু বেল্লামি ভেবেছিল এত কিছুটা সময় পাওয়া যাবে, পিটার সলোমন আর পিরামিডটা লুকিয়ে রাখার জন্য।
কে তোমাকে বলেছে যে আমি ম্যাসেজ পাঠিয়েছি? বেল্লামি জানতে চায়।
সাটো বেল্লামির সেলফোনটা তার দিকে ছুঁড়ে দেয়। যেকোন বাচ্চা ছেলেও এটা জানতে পারবে।
বেল্লামির এবার মনে পড়ে তাকে যে এজেন্টরা গ্রেফতার করেছিল তারা তার চাবি আর সেলফোন নিয়ে নিয়েছিল।
ভেতরের বাকি তথ্য, সাটো বলে, প্যাট্রিয়ট এ্যাক্ট দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হতে পারে এমন যে কোন লোকের ফোনে আমাকে ওয়্যারট্যাপ স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। আমার মনে হয়েছিল পিটার সলোমন সেরকম একটা হুমকি এবং গতরাতে আমি ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
সাটোর কথা বেল্লামির বিশ্বাস হতে চায় না। তুমি পিটার সলোমনের ফোন তুমি ট্যাপ করেছিলে?
হ্যাঁ। আর সেকারণেই আমি জানি অপহরণকারী তোমাকে রেস্তোরাঁয় ফোন করেছিল। তুমি পিটারের ফোনে ফোন করেছিলে এবং কি ঘটেছে সেটা ব্যাখ্যা করে একটা উদ্বিগ্ন ম্যাসেজ রেখে এসেছিলে।
বেল্লামি বুঝতে পারে সে ঠিক কথাই বলছে।
আমরা রবার্ট ল্যাংডনের একটা কলও ইন্টারসেপ্ট করি, যে ক্যাপিটল ভবনে ছিল, তাকে চালাকি করে এখানে ডেকে আনা হয়েছে বুঝতে পেরে ভীষণ বিভ্রান্ত। আমি সাথে সাথে ক্যাপিটলে আসি এবং তোমার আগে এখানে এসে। পৌঁছাই কারণ আমি কাছেই ছিলাম। ল্যাংডনের ব্যাগের এক্স-রে কেন দেখতে চেয়েছিলাম সে প্রসঙ্গে বলছি…আমার সব কিছু দেখে মনে হয়েছিল এসবের সাথে ল্যাংডনের সম্পর্ক রয়েছে, আমি আমার সহকর্মীদের সকাল বেলা ল্যাংডন আর পিটার সলোমনের ভিতরে হওয়া নিতান্ত অপহরণকারীর ফোন কল আবার খতিয়ে দেখতে বলি, যেখানে অপহরণকারী পিটার সলোমনের সহযোগী সেজে, ল্যাংডনকে বক্তৃতার জন্য আসতে রাজি করায় এবং পিটার তাকে যে ছোট প্যাকেটটা রাখতে দিয়েছিল সেটাও নিয়ে আসতে বলে। ল্যাংডন যখন তার কাছে থাকা প্যাকেটটার কথা আমার কাছে স্বীকার করছিলো না, আমি তার ব্যাগের এক্স-রে দেখতে চাই।
বেল্লামির চিন্তাভাবনা সব গুলিয়ে যায়। মানতে হবে সাটো যা বলছে তার সবই ঘটা সম্ভব কিন্তু তারপরেও কিছু একটা ঠিক মিলছে না। কিন্তু…জাতীয় নিরাপত্তার জন্য পিটার সলোমনকে কেন তোমার হুমকি বলে মনে হয়েছে?
বিশ্বাস কর, পিটার সলোমন দেশের নিরাপত্তার জন্য ভীষণ হুমকিস্বরূপ, সে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে। আর সত্যি কথা বলতে গেলে তুমিও।
বেল্লামি ঝট করে সোজা হয়ে বসলে হাতকড়া তার কব্জিতে কেটে বসে।
আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না??
সে জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তোলে। তোমরা ম্যাসনরা বড় বিপজ্জনক একটা খেলা খেলছো। তোমরা খুবই বিপজ্জনক একটা সিক্রেট লুকিয়ে রেখেছে।
সে কি প্রাচীন রহস্যময়তার কথা বলছে?
আশার কথা, তোমরা তোমাদের সিক্রেট সবসময়ে বেশ সাফল্যের সাথেই লুকিয়ে এসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সম্প্রতি তোমরা একটু অসাবধানী হয়ে পড়েছিলে এবং আজ রাতে তোমাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক সিক্রেট পৃথিবীর সামনে ফাঁস হয়ে যাবার হুমকির মুখে পড়েছে। এবং আমরা যদি সেটা থামাতে ব্যর্থ হই, আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি ফলাফল খুব বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।
বেল্লামি হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে।
তুমি যদি আমাকে আক্রমণ না করতে, সাটো আবার বলে, তুমি হয়ত বুঝতে পারতে আমি আর তুমি একই দলে।
একই দলে। শব্দটা বেল্লামির ভিতরে এমন একটা ধারণার জন্ম দেয় যার গভীরতা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। সাটো কি ইস্টার্ণ স্টারের সদস্য? দি অর্ডার অব। দি ইস্টার্ণ স্টার- প্রায়ই যাকে ম্যাসনদের সহযোগী সজ্ঞা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যারা হিতসাধনের একই মরমী দর্শন, গোপণ জ্ঞান, এবং আধ্যাত্মিক উদারতায় বিশ্বাসী। একই দল? আমি হাতকড়া পরিহিত অবস্থায়। সে পিটারের ফোন ট্যাপ করছে!
এই লোকটাকে থামাতে তুমি আমায় সাহায্য করবে, সাটো বলে। সে এমন একটা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে যার রেশ থেকে এই দেশ কখনও বের হতে পারবে না। তার মুখটা যেন পাথরে খোদাই করা।
তুমি তাহলে তাকে অনুসরণ করছো না কেন?
সাটোকে হতবাক দেখায়। তোমার কি ধারণা আমি চেষ্টা করছি না? পিটারের সেলফোনে আমার ট্রেস সেটার অবস্থান নির্ণয়ের আগেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তার অন্য নাম্বারগুলো ডিসপোজেবল ফোনের যার অবস্থান নির্ণয় করা এক অর্থে অসম্ভব। প্রাইভেট জেট কোম্পানী বলেছে পিটারের সহযোগী ফ্লাইট বুক করেছিল, সলোমনের ফোন ব্যবহার করে, তারই জেট মারকুইস কার্ড দিয়ে। কোন উপায় নেই অনুসরণ করার। থাকলেও খুব একটা হেলদোল হত না। আমরা যদি জানতেও পারি সে কোথায় আছে আমি সম্ভবত তাকে ধরার। চেষ্টাও করতে পারব না।
কেন?
সেটা আমি তোমাকে বলতে চাই না কারণ তথ্যটা ক্লাসিফায়েড, সাটো বলে, তার ধৈৰ্য্য স্পষ্টতই কমে আসছে। আমি কেবল তোমাকে এটা বিশ্বাস করতে বলছি।
বেশ, আমি করলাম না।
সাটোর চোখে বরফের মত শীতল দৃষ্টি। সে সহসা ঘুরে দাঁড়ায় এবং জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে। এজেন্ট হার্টম্যানন! বিকেসটা নিয়ে আসো।
বেল্লামি হিস শব্দে একটা ইলেকট্রনিক দরজা খুলে যাবার শব্দ শুনে এবং একজন এজেন্ট ভেতরে প্রবেশ করে। তার হাতে একটা পাতলা টাইটেনিয়ামের বিকেস, সেটা সে ওএস ডিরেক্টরের পাশের মাটিতে নামিয়ে রাখে।
তুমি এখন যেতে পার, সাটো বলে।
এজেন্ট বের হতে দরজায় আবার হিস শব্দ শোনা যায় এবং তারপরে আবার নিরবতা।
সাটো বিকেসটা তুলে নিয়ে নিজের কোলে রাখে এবং লক খুলে। তারপরে সে ধীরে বেল্লামির দিকে তাকায়। আমি এটা করতে চাইনি কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে আর তুমি আমার সামনে কোন পথ খোলা রাখনি।
বেল্লামি আজব ব্রিফকেসটার দিকে তাকায় এবং ভয়ের একটা স্রোত তার দেহে বয়ে যায়। সে কি এবার আমাকে নির্যাতন করবে? সে আবার তার হাতকড়া ধরে মোচড় দেয়। কেসের ভিতরে কি আছে?!
সাটো বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসে। এমন একটা কিছু যা সব কিছু আমার দৃষ্টিতে দেখতে তোমায় সাহায্য করবে। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি।
আগের পর্ব :
০১. বিশ্বজুড়ে সমাদৃত আইফেল টাওয়ার
০২. পিটার ফোন ধরছে না কেন
০৩. দি এ্যাপোথেসিস অব ওয়াশিংটন
০৪. ত্রিস ডান কিউবের উজ্জ্বল আলো
০৫. পাথরের পিরামিড
০৬. ক্যাথরিন সলোমন
০৭. আজকের রাতটাই প্রথম না
পরের পর্ব :
০৯. ভূ-গর্ভস্থ স্থান
১০. ক্যাথিড্রাল কলেজের ভিতরে
১১. রবার্টকে ওখান থেকে
১২. ঘন্টাঘরের তীব্রতায়
১৩. এক সন্তান হারানো পিতামাতা
১৪. ওয়াশিংটন মনুমেন্টর মধ্যে দিয়ে