অধ্যায় ৯১:
কাউচে অ্যাম্ব্রার পাশে কাঁচের ডিসপ্লেতে ফুটে ওঠা এডমন্ডের ফ্যাকাশে চেহারাটার দিকে তাকিয়ে একটু খারাপই লাগলো ল্যাংডনের। একটা মরণব্যাধির সাথে নীরবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল ওর প্রাক্তন ছাত্র। এখন অবশ্য তার চোখ চকচক করছে আনন্দ এবং উত্তেজনায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের এই ভায়ালের উপকরণ সম্পর্কে বলছি, টেস্টটিউবটা দেখিয়ে বলল এডমন্ড। কিন্তু তার আগে চলুন কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে আসা যাক…প্রি-মর্ডিয়াল স্যুপে।
এডমন্ড উধাও হয়ে গেল স্ক্রিন থেকে। সে জায়গায় দেখা গেল এক বিশাল উত্তাল সমুদ্রপৃষ্ঠ, জায়গায় জায়গায় আগ্নেয়গিরির উদগিরণ এবং বিরামহীন বজ্রপাত।
এখানেই কি জীবনের উৎপত্তি হয়েছিল? এডমন্ডের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। একটি স্বতস্ফূর্ত রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে? নাকি ধুমকেতু বা গ্রহাণুর পৃথিবীতে আছড়ে পড়া টুকরো থেকে থেকে আবির্ভাব ঘটে এক অণুজীবের? দুর্ভাগ্য, সে সময়ে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। আমরা শুধু জানতে পেরেছি, এরপরে কী হয়েছিল। বিবর্তন। বিবর্তনের কথা বললেই আমাদের মনের পর্দায় প্রথমে ভেসে ওঠে একটি ছবি।
বিবর্তন
পরিচিত একটা ছবি দেখা গেল পর্দায়।
হ্যাঁ, মানুষের বিবর্তন হয়েছে, এটা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, এডমন্ড বলল, আর আমরা ফসিল রেকর্ডের সহায়তায় একটা যথার্থ টাইমলাইন সৃষ্টি করতেও সক্ষম হয়েছি। কিন্তু বিবর্তন যদি উল্টো দিকে পরিচালিত হয়?
হঠাৎ করেই পর্দায় ভাসমান এডমভের চেহারায় দাড়িগোঁফ গজিয়ে বড় হতে হতে এক পর্যায়ে অচেনা মানুষে রূপ নিলো, তবে সেখানেই থেমে থাকলো না ব্যাপারটা। তার চেহারায় অস্থির গঠনও বদলে গিয়ে এক পর্যায়ে। বানর সদৃশ একটি প্রানী দেখা গেল পর্দায়। এরপরের পরিবর্তনগুলো আরও দ্রুত। ক্রমান্বয়ে আদি থেকে আদিমতর প্রানীদের ছবি ভেসে উঠতে লাগলো পর্দায়-লেমুর, সুথ, পানিতে বসবাসকারি প্লাটিপাস, লাংফিশ…সেখান থেকে ইল এবং অন্যান্য মাছ, প্ল্যাংকটন, অ্যামিবা, আর একদম শেষে একটা আণুবীক্ষণিক ব্যাকটেরিয়া। কেবল একটা কোষ ভাসতে লাগলো বিশাল সমুদে।
জীবনের আদিমতম নিদর্শন, এডমন্ড বলল, এই পর্যন্তই জানা আছে আমাদের। কিন্তু আমরা এটা জানি না, কিভাবে এই আদিমতম জীবনের উৎপত্তি ঘটলো কতগুলো নির্জীব রাসায়নিক পদার্থ থেকে। ব্যাপারটা আমাদের বোধগম্যই হয় না।
T=0, ল্যাংডন ভাবতে লাগলো, অর্থাৎ সময়ের একদম শুরুতে। একবার এরকমই একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিল ও, যেখানে মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে হতে একটা ক্ষুদ্র আলোর বিন্দুতে পরিণত হয়েছিল, সেক্ষত্রে সেই মহাবিশ্বতত্ত্ববিদও এর আগে কী হয়েছিল সে সম্পর্কে কোন আলোকপাত করতে পারেনি।
আদি জন্ম, ঘোষণা করার সুরে বলল এডমন্ড, সেই মুহূর্তটির বর্ণনায় এই শব্দটিই ব্যবহার করেছেন ডারউইন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, জীব বিবর্তিত হয়ে চলেছে অবিরাম, কিন্তু কিভাবে সবকিছুর শুরু হয়েছিল তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি। মোদ্দা কথা, ডারউইনের তত্ত্ব এটা ব্যাখ্যা করে যে অভিযোজনের ফলে যোগ্যরাই টিকে থাকতে পারে, কিন্তু সেই যোগ্যদের আবির্ভাব কিভাবে ঘটলো তার কোন ব্যাখ্যা নেই।
হেসে উঠলো ল্যাংডন। এভাবে কাউকে ডারউইনের তত্ত্বটা ব্যাখ্যা করতে শোনেনি ও।
তাহলে জীবনের আবির্ভাব ঘটলো কী করে পৃথিবীতে? অন্যভাবে বললে, এলেম আমরা কোথা থেকে? এটুকু বলে এডমন্ড হাসলো। আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনারা সেই প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন। কিন্তু আজ রাতে আরো চমক অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্যে, এবার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আগের চেয়ে চওড়া একটা হাসি দিলো এডমন্ড। কোথা থেকে আসলাম আমরা এটার উত্তর যেমন বিস্ময়কর…ঠিক একই রকম বিস্ময়কর আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটার উত্তর।
অবাক চোখে একে অপরের দিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা এবং ল্যাংডন।
জীবনের উৎপত্তি…এডমন্ড বলতে থাকলো, শুরু থেকেই এটা একটা রহস্য। বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন।
এডমন্ড ওর হাতের টেস্টটিউবটা উঁচু করে ধরলো, ৫০-এর দশকে দুজন রসায়নবিদ, মিলার এবং ইউরে একটা সাহসি এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা করেছিলেন এটা জানার জন্যে যে, কিভাবে জীবনের শুরু হয়েছিল।
ওর হাতের টেস্টটিউবটা এখন এই ঘরেই আছে, ওখানে, ঝুঁকে অ্যাম্ব্রার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল ল্যাংডন। হাত দিয়ে দেখালো। ধাতব ডিসপ্লে কেসটা।
এডমন্ড এটা কিভাবে পেলো? বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা।
জবাবে একবার কাঁধ ঝাঁকানো ল্যাংডন। এডমন্ডের যেরকম দুর্লভ জিনিসপত্র সংগ্রহের বাতিক ছিল তার পক্ষে এটা জোগাড় করা কঠিন কোন কাজ হবার কথা নয়।
এরপর এডমন্ড ব্যাখ্যা করলো, কিভাবে ইউরে এবং মিলার মিডিয়াল স্যুপের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করে জীবনের উৎপত্তি হয় কিনা তা দেখতে চেয়েছিলেন।
পর্দায় ভেসে উঠলো নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত একটা প্রতিবেদনের শিরোনাম-২০০ কোটি বছর আগের কথা।
অবশ্যই, এডমন্ড বলল, সমালোচনার ঝড় তুলেছিল এক্সপেরিমেন্টটা। কারণ টেস্টটিউবের ভেতরে যদি আসলেও জীবনের উৎপত্তি ঘটতো তাহলে বদলে যেতো অনেক হিসেব নিকেশ। এটা প্রমাণিত হতো যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমেই স্বতস্ফূর্তভাবে আদিমতম অণুজীবের সৃষ্টি হয়েছিল প্রকৃতিতে। এমনকি অনেকে নিশ্চয়ই এমনটাও দাবি করতো যে পৃথিবীতে যদি স্বতস্ফূর্তভাবে জীবের উৎপত্তি ঘটতে পারে তাহলে মহাবিশ্বের অন্য কোথাও সেরকমটা ঘটতে অসুবিধে কোথায়?
লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লো এডমন্ড। কিছুক্ষণ চুপচাপ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকার পরে বলল, যাইহোক, আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, সফলতার মুখ দেখেনি ইউরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট। দুই রসায়নবিদ এর পরেও অনেক বার চেষ্টা করেছেন ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে, তাপমাত্রা কমিয়ে বাড়িয়ে-কিন্তু কিছুতেই কোন লাভ হয়নি। অবশেষে হাল ছেড়ে দেন দুই বিজ্ঞানী। পুরো বিজ্ঞান দুনিয়াই হাল ছেড়ে দেয় বলতে গেলে, এটুকু বলে ইচ্ছে করে কিছুক্ষণ সময় নিলো এডমন্ড, তবে ২০০৭ সালে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে।
এরপর এডমন্ড খুলে বলল কিভাবে মিলার-ইউরে এক্সপেরিমেন্টের টেস্টটিউবগুলো আবার খুঁজে পাওয়া যায় ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির একটা বন্ধ ক্লোজেটে, মিলারের মৃত্যুর পর, মিলারের ছাত্ররা আবার টেস্টটিউবের স্যাম্পলগুলো পুনর্বিশ্লেষণ করে আধুনিক পদ্ধতিতে, যেমন-লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি, ম্যাস স্পেক্টোমেট্রি-এসব। এতে করে বিস্ময়কর কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রকৃতপক্ষে মিলার-ইউরে এক্সপেরিমেন্টে তক্কালীন ধারণার চাইতেও বেশি অ্যামিনো এসিড এবং অন্যান্য যৌগিক পদার্থ উৎপন্ন হয়েছিল। কিন্তু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে তা ধরতে পারেননি মিলার। নতুনভাবে বিশ্লেষণে চিহ্নিত করা হয় গুরত্বপূর্ণ কিছু নিউক্লিওবেইজ-যেগুলোর সাহায্যে গঠিত হয় আরএনএ, এমনকি ডিএনএ।
আবারও তোলপাড় পড়ে যায় বিজ্ঞান জগতে, বলল এডমন্ড, অনেকে হয়তো ধারণা করা শুরু করে যে এবার ইউরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট সফল হবে, শুধু সময়ের দরকার। এখানে একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। জীবের উৎপত্তি এবং বিবর্তন ঘটেছে কোটি কোটি বছর ধরে। কিন্তু টেস্টটিউবগুলো ক্লোজেটে রাখা ছিল মাত্র পঞ্চাশ বছর। যদি গোটা এক্সপেরিমেন্টের টাইমলাইনটা মাইলে পরিমাপ করা হয়, তবে আমরা শুধু এক ইঞ্চি অগ্রসর হতে পেরেছি…বা তারও কম।
আবারও আলোচনা শুরু হয় ল্যাবে জীবনের উৎপত্তি পর্যবেক্ষনের ব্যাপারটা নিয়ে, এডমন্ড বলল।
হ্যাঁ, সেটা মনে আছে আমার, ল্যাংডন ভাবলো। হারভার্ডের জীববিজ্ঞান অনুষদও এটা নিয়ে মেতে ছিল কয়েকদিন।
এবারও চার্চের পক্ষ থেকে কঠোর সমালোচনা করা হয়, এডমন্ড যোগ করলো।
স্ক্রিনের পর্দায় ভেসে উঠলো একটা ওয়েবসাইটের হোমপেজ Creation.com। এডমন্ড যে এই ওয়েবসাইটটার একজন কঠোর সমালোচক ছিল সেটা জানা আছে ল্যাংডনের।
এই সাইটটা, বলল এডমন্ড, অনেক জনপ্রিয়। এখানে ডজন ডজন ব্লগ পাওয়া যাবে এই সম্পর্কে যে, কেন ইউরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট পুনরায় পরিচালনা করা উচিত হবে না। তবে Creation.com-এর সদস্যদের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। এক্সপেরিমেন্টটা যদি সাফল্যের মুখ দেখেও, তবে সেটা হতে আরও অন্তত কয়েক কোটি বছর লাগবে।
আবারও টেস্টটিউবটা উঁচু করে ধরলো এডমন্ড। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন, দুই বিলিয়ন বছর পরে এই টেস্টটিউবটার ভেতরে কী হয় সেটা জানার জন্যে ভীষণ উদগ্রীব আমি। দুর্ভাগ্যবশত তেমনটা করতে হলে টাইম মেশিনের দরকার হবে আমাদের, এটুকু বলে মৃদু হাসলো এডমন্ড, আর তাই…সেটাই তৈরি করেছি আমি।
অ্যাম্ব্রার দিকে একবার তাকালো ল্যাংডন। তন্ময় ভঙ্গিতে স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
একটা টাইম মেশিন বানানো কিন্তু অতটা কঠিন নয়, এডমন্ড বলল, এখনই আপনারা জানতে পারবেন, কী বোঝাতে চাচ্ছি আমি।
স্ক্রিনে একটা বিলিয়ার্ড রুম ভেসে উঠলো। সবগুলো বল ত্রিভুজাকারে সজ্জিত টেবিলের ওপর। এডমন্ড একটা খেলার লাঠি নিয়ে কিউ বলে সজোরে গুতো দিলো। সাজানো বলগুলোর দিকে ছুতে যেতে লাগলো ওটা।
কিন্তু আঘাত করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এডমন্ড বলে উঠলো, স্টপ! সাথে সাথে সাদা বলটা জায়গাতেই জমে গেল।
এখন যদি আমি আপনাদের জিজ্ঞেস করি, কোন বলটা কোন পকেটে গিয়ে পড়বে, সেটা কি বলতে পারবেন? অবশ্যই না। হাজারটা সম্ভাব্য ফলাফল আছে। কিন্তু আপনি যদি টাইম মেশিনে করে পনেরো সেকেন্ড সামনে গিয়ে বলগুলোর অবস্থা দেখে আবার আগের সময়ে ফিরে আসেন, তখন? বিশ্বাস করুন বা না করুন বন্ধুরা, আমাদের হাতে এখন সেই প্রযুক্তি আছে।
টেবিলের কিনারায় অবস্থিত অনেকগুলো ক্যামেরার দিকে নির্দেশ করলো এডমন্ড। আমরা যদি অপটিক্যাল সেন্সর ব্যবহার করে কিউ বলটার ঘূর্ণণের দিক, গতিবেগ এসব পরিমাপ করি তাহলে একটা গাণিতিক স্ন্যাপশট পাওয়া খুবই সম্ভব হবে। যেখানে দেখা যাবে কোন অবস্থানে আছে বলটা। আর সেটা ব্যবহার করে আমি সঠিকভাবে বলটা ঠিক কোথায় আঘাত করবে এবং সেটার ফল কি হবে তা অনুমান করতে পারবো।
একবার এরকম প্রযুক্তির গলফ সিমুলেটর দেখেছিল ল্যাংডন। যেটায় ও প্রতিবারই বলগুলো উড়িয়ে গাছের মাঝে নিয়ে ফেলছে।
এডমন্ড এবার পকেট থেকে একটা বড় আকারের স্মার্টফোন বের করলো, যেটার স্ক্রিনে ভার্চুয়াল একটা টেবিলের ওপর কিউ বলটা দেখা যাচ্ছে। ওটাকে ঘিরে আছে নানা গাণিতিক সমীকরণ।
কিউ বলটার একদম সঠিক ভর, অবস্থান এবং বেগ জানা থাকলে, এডমন্ড আবারও বলল, আমি হিসেব করে দেখতে পারবো অন্য বলগুলোকে ধাক্কা দেয়ার পরিণতি কী হবে, এটুকু বলে ফোনের স্ক্রিনে স্পর্শ করলো সে। সাথে সাথে সিলেটেড কিউ বলটা ত্রিভূজাকারে সাজানো বলগুলোতে গিয়ে ধাক্কা দিলো। এতে বিভিন্ন জায়গায় ধাক্কা খেয়ে চারটা বল চারটা পকেটে গিয়ে পড়লো কিছুক্ষণ পর।
চারটা বল, ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল এডমন্ড, ভালো ছিল শটটা, এবার দর্শকদের দিকে তাকালো সে, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
একবার তুড়ি বাজানোর সাথে সাথে কিছুক্ষণ আগের জমে যাওয়া আসল কিউ বলটা গিয়ে ধাক্কা দিলো টেবিলের অন্য বলগুলোকে। আর স্মার্টফোনের পর্দায় যেমনটা দেখা গিয়েছিল, ঠিক সেই চারটা বলই ঐ চারটা পকেটে গিয়ে পড়লো।
একদম খাঁটি টাইম মেশিন হয়তো না, হেসে বলল এডমন্ড, কিন্তু এটার সাহায্যে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা কিছুটা হলেও ধারণা করতে পারবো আমরা। অর্থাৎ কম্পিউটার সিমুলেশন অনেকটা ভার্চুয়াল টাইম মেশিনের মত ব্যবহার করা যায়। অবশ্য এটা তো শুধুমাত্র ছোট একটা পুল টেবিলের সিমুলেশনের ওপর ভিত্তি করে বলছি আমি। কিন্তু আরও জটিল সিস্টেমের ক্ষেত্রে কী হবে?
মিলার-ইউরে এক্সপেরিমেন্টের ভায়ালটা উঁচু করে ধরে হাসলো এডমন্ড, আশা করি আপনারা বুঝতে পারছেন, কী বোঝাতে চাচ্ছি আমি। কম্পিউটার মডেলিং আসলে এক ধরণের টাইম মেশিন এবং এটার সাহায্যে আমরা ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে সেটা ধারণা করতে পারবো…এমনকি সেটা কয়েক কোটি বছর পরে হলেও।
কাউচে নড়ে উঠলো অ্যাম্ব্রা, এক মুহূর্তের জন্যে দৃষ্টি সরাচ্ছে না এডমন্ডের চেহারা থেকে।
আমিই কিন্তু প্রথম বিজ্ঞানী নই যে পৃথিবীর আদিম অবস্থার প্রিমর্ডিয়াল স্যুপের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করে কি ঘটে সেটা পর্যবেক্ষন করতে চেয়েছে। কিন্তু বলাটা যত সহজ, এক্সপেরিমেন্টটা পরিচালনা করা ততটাই কঠিন।
আবারও কিছুক্ষণ আগের উত্তপ্ত, উত্তাল সমুদ্রপৃষ্ঠের দৃশ্য ফুটে উঠলো পর্দায় কিছুক্ষণের জন্যে। সমুদ্রে সংগঠিত রাসায়নিক বিক্রিয়ার মডেল তৈরি করতে হলে একদম পারমাণবিক পর্যায়ে সিমুলেশন চালাতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতন, যেখানে আমরা নির্দিষ্ট একটি সময়ে প্রতিটি বায়ু কণার সঠিক অবস্থান আগে থেকে জানতে পারবো। তাই যদি আমরা আদিম সাগরের কার্যকর সিমুলেশন পরিচালনা করতে চাই তাহলে সেই কম্পিউটারকে পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্রের পাশাপাশি রসায়নের ব্যাপারেও সব জানতে হবে-একমাত্র তাহলেই আমরা উত্তপ্ত সমুদ্রে কখন কোন যৌগ গঠিত হচ্ছে, বন্ধন ভাঙছে-গড়ছে পরমাণুগুলোর মধ্যে সেটা ধারণা করতে পারবো।
এবার সমুদ্র পৃষ্ঠের ছবির জায়গায় ভেসে উঠলো একটা ছোট্ট পানির ফোঁটা, যেখানে পরমাণুগুলো ছোটাছুটি করছে এবং প্রতি মুহূর্তে কিছু অণু গঠিত হচ্ছে আবার ভেঙে যাচ্ছে।
দুঃখজনকভাবে, আবার এডমন্ডের চেহারা ভেসে উঠলো স্ক্রিনে, এরকম একটা স্টিমুলেশন পরিচালনা করার জন্যে অনেক বেশি প্রসেসিং ক্ষমতার প্রয়োজন। যে ক্ষমতা নেই এই পৃথিবীর কোন কম্পিউটারের, চকচক করছে এডমন্ডের চোখ, শুধুমাত্র একটা বাদে।
অনেকগুলো পাইপ অর্গানের সুর ভেসে আসলো এই সময়ে। সেই সাথে এডমন্ডে দুই তলা জুড়ে অবস্থিত কম্পিউটারটার ছবি ভেসে উঠলো পর্দায়।
ই-ওয়েভ, ফিসফিসিয়ে বলল অ্যাম্ব্রা।
এরপরের কিছুক্ষণ এডমন্ড তার তৈরি করা সুপারকম্পিউটারটার ব্যাপারে ধারণা দিলো সবাইকে। সব শেষে উল্লেখ করলো কোয়ান্টাম কিউবটার কথা।
মোদ্দা কথা, অনেকক্ষন বর্ণনা শেষে বলল সে, ই-ওয়েভ, ইউরে মিলার এক্সপেরিমেন্টটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে একদম সঠিকভাবে সিমুলেট করতে পারবে। অবশ্য পুরো প্রিমর্ডিয়াল সাগরের মডেল তৈরি করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে, তাই মিলার এবং ইউরে যে পাঁচ লিটারের বদ্ধ সিস্টেম ব্যবহার করেছিলেন, সেটাই তৈরি করেছি আমি কম্পিউটারে।
রাসায়নিক পদার্থ ভর্তি একটা ভার্চুয়াল ফ্লাস্কের ছবি ভেসে উঠলো পর্দায়। ধীরে ধীরে বিবর্ধিত হতে শুরু করলো ওটার ভেতরের উপাদানগুলো। এক পর্যায়ে পরমাণুগুলোকে দেখা গেল উত্তপ্ত মিশ্রণটার ভেতরে ছোটাছুটি করতে। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন বন্ধন তৈরি হচ্ছে আবার ভাঙছে, তাপমাত্রা, বিদ্যুৎ এবং গতির প্রভাবে।
এই মডেলে প্রিমর্ডিয়াল সুপ সম্পর্কে জানা সব তথ্য ইনপুট করা হয়েছে। হাইড্রক্সি র্যাডিকেলের উপস্থিতি, বৈদ্যুতিক বাষ্প এবং আগ্নেয়গিরি উদগিরণের ফলে সৃষ্টি হওয়া কার্বোনাইল সালফাইডের উপস্থিতিও যোগ করা হয়েছে।
কিছুক্ষণ রাসায়নিক বিক্রিয়া চলতেই থাকলো ফ্লাস্কে।
এবার কিছুক্ষণ সামনে এগিয়ে নেয়া যাক পুরো প্রক্রিয়াটাকে…উৎসাহি স্বরে বলল এডমন্ড। দ্রুত থেকে দ্রুত হতে থাকলো বিক্রিয়ার গতি, সেই সাথে জটিল জটিল যৌগের সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে। এক সপ্তাহ পর মিলার-ইউরে এক্সপেরিমেন্টে যে অ্যামাইনো এসিডগুলো তৈরি হয়েছিল এখানেও সেগুলোই দেখা যাচ্ছে এখন। এরপর আবারও বেড়ে গেল বিক্রিয়ার গতি। পঞ্চাশ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি আরএনএ তৈরি হবার মত উপাদান।
বিক্রিয়া চলতেই থাকলো দ্রুত গতিতে।
সিমুলেশনটা চালাতেই থাকি আমি, আগের তুলনায় উচ্চস্বরে বলল এডমন্ড।
যত সময় যাচ্ছে ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে গঠিত যৌগগুলোর গঠন। স্ক্রিনের এক পাশে ভেসে ওঠা সময়ের হিসেবে শত, হাজার, লক্ষ, কোটি বছর কেটে যাচ্ছে। এখন এত দ্রুত হচ্ছে বিক্রিয়াগুলো যে, সব ঝাঁপসা মনে হচ্ছে। অবশেষে ফ্লাস্কের ভেতরে কী পাই আমরা? আগ্রহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো এডমন্ড।
উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে গেল অ্যাম্ব্রা এবং ল্যাংডন।
এডমন্ডের চেহারার হাসিখুশি ভাবটা বদলে গেল নিমেষে, কিছুই না! বলল সে, কোন জীবনের উৎপত্তি ঘটে না স্বতস্ফূর্ত বিক্রিয়ার প্রভাবে, এটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। তাহলে কি কোথাও ভুল হচ্ছে আমাদের?
ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো এডমন্ড।
কিছুক্ষণ পর একটা হাসি ছড়িয়ে পড়লে তার চেহারায়, নাকি গোটা রেসিপির কোন একটা মূল উপাদানের কথা ভুলে গেছি আমরা?
.
অধ্যায় ৯২
চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে অ্যাম্ব্রা ভিদাল। তার মত অনেকেই নিশ্চয়ই ঠিক একইভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখছে পাগলাটে এডমন্ডের এই প্রেজেন্টেশন।
তাহলে, কোন উপাদানটার কথা ভুলে গেলাম আমরা? এডমন্ড জিজ্ঞেস করলো, কেন আমার তৈরি করা প্রিমর্ডিয়াল স্যুপে জীবনের সঞ্চার ঘটলো না? ব্যাপারটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছিলো না। তাই এরকম অবস্থায় পড়লে সকল বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী যা করে, আমিও তাই করলাম। আমার চেয়ে বুদ্ধিমান একজনের শরণাপন্ন হলাম গোটা ব্যাপারটা বোঝার জন্যে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কন্সট্যান্স জেরহার্ডের ছবি ভেসে উঠলো পর্দায়। কিভাবে জীবনের উৎপত্তি ঘটাবো আমরা? এটুকু বলে হাসলেন তিনি, কখনোই আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হবে না সেটা। এই জীবনের উৎপত্তির কাছে এসেই মার খেয়ে যায় আমাদের সব সূত্র, তত্ত্ব, এক্সপেরিমেন্ট। কতগুলো নির্জীব রাসায়নিক পদার্থ থেকে জীবিত কিছু একটা তৈরি হবার মধ্যবর্তি যে সীমারেখা সেটা কখনোই পেরুনো সম্ভব হয়নি আমাদের পক্ষে। কেন এরকম হয় সে ব্যাপারে রসায়নে কোন সঠিক ব্যাখ্যাও নেই। আদতে, কতগুলো কোষের একত্রিত হয়ে একটি জীবিত সত্ত্বায় রূপান্তরিত হবার ঘটনা এনট্রপির সূত্রের সাথে সাংঘর্ষিক!
এনট্রপি! ডক্টরের কথাই পুনরাবৃত্তি করলো এডমন্ড। এবার তাকে দেখা যাচ্ছে সুন্দর একটি সমুদ্র সৈকতে। এন্ট্রপি কী বলুন তো? আচ্ছা আমিই বলছি সহজ করে, যেহেতু বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রি ছাড়াও আরও অনেকেই নিশ্চয়ই দেখছেন প্রেজেন্টেশনটা। কোনো এক সিস্টেমের বিশৃঙ্খলাই হচ্ছে এন্ট্রপি। বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি, কোন সুশৃঙ্খল সিস্টেমের ক্ষয় অবশ্যাম্ভাবী। পর্দায় এডমন্ড একবার তুড়ি দিতেই একটা বালুর দূর্গ তৈরি হলো তার পায়ের কাছে, অনেকগুলো বালু কণাকে আমি একত্রে সন্নিবিষ্ট করে তৈরি করেছি। একটি দূর্গ। এখন দেখা যাক প্রকৃতি এই দূর্গটার সাথে কেমন আচরণ করে। কয়েক সেকেন্ড পরেই একটা বিশাল ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল পুরো দূর্গটা। হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন, আমার তৈরি করা সুসংগঠিত দূৰ্গটাকে অসংগঠিত করে দিলো প্রকৃতি, বালুকণা এখন আবার ছড়িয়ে গেছে সৈকতে। এটাই এন্ট্রপি। সমুদ্রতটে ঢেউ আছড়ে পড়ে কিন্তু কখনও সংগঠিত কোন দূর্গ তৈরি করবে না। এনট্রপির কাজই হচ্ছে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করা। এরকম বালুর দূর্গ কখনো স্বতস্ফূর্তভাবে তৈরি হবে না পৃথিবীতে, কেবল ভেঙে যাবে স্বতস্ফূর্তভাবে।
আবারও তুড়ি বাজালো এডমন্ড, সাথে সাথে একটা রান্নাঘরে চলে আসলো সে। আপনি যখন চা গরম করেন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন থেকে একটা ধূমায়মান কাপ বের করলো সে, মগটা যেখানে আছে, সেইদিকে তাপ প্রয়োগ করেন। এরপর যখন আপনি মগটা বাইরে কোথাও রেখে দেন, সেটা ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। তাপ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের পরিবেশে। ঠিক যেমন বালুকণাগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল সৈকতে। আবারও এনট্রপি। এর বিপরীতটা কিন্তু কখনোই হবে না। আপনার চায়ের মগটা কিন্তু আপনাআপনি কখনও গরম হয়ে উঠবে না, এডমন্ড হেসে বলল, ঠিক যেমন আপনাআপনি তৈরি হবে না বালুর দূর্গ।
চশমা পরা ড. জেরহার্ডকে আবারও দেখা গেল পর্দায়, আমরা একটি এন্ট্রপিক বিশ্বে বসবাস করছি, বললেন তিনি, যেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পক্ষপাতি, শৃঙ্খলা নয়। তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে নির্জীব রাসায়নিক পদার্থগুলো একে অপরের সাথে সন্নিবিষ্ট হয়ে জীবিত সত্তায় পরিণত হয়?
তিনি যা বললেন আসলেও কি তা সত্য? কখনোই শৃঙ্খলার দেখা মেলে পৃথিবীতে? আমি কিন্তু রাজনৈতিক শৃঙ্খলার কথা বলছি না, হেসে পরের কথাটুকু যোগ করলো এডমন্ড। এরপর একদম তার চেহারার কাছাকাছি চলে গেল ক্যামেরা, যে কোন জীবই কতগুলো অণুর সুশৃঙ্খল সমাবেশ। তবে প্রকৃতিতে জীবনই শুধুমাত্র যে শৃঙ্খলার উদাহরণ এমন নয় কিন্তু। জটিল জটিল সব কাঠামো তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অনেকগুলো ছবি ভেসে উঠলো পর্দায়-হাতির শুড় সদৃশ টর্নেডো, তুষারকণা, কোয়ার্টজ স্কটিক, শনিগ্রহের বলয়।
দেখলেন তো, মাঝে মাঝে বিভিন্ন পদার্থকে একত্রে সংগঠিত করে প্রকৃতি-যেটা আবার এনট্রপির একদম বিপরীত। তাহলে এ থেকে আমরা কী ধরে নেবো? কেমনটা পছন্দ প্রকৃতির? শৃঙ্খলা নাকি বিশৃঙ্খলা?
এবার এডমন্ডকে দেখা গেল ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির একটা করিডোরে। বেশিরভাগ পদার্থবিদের মতে উত্তরটা হচ্ছে-বিশৃঙ্খলা। এন্ট্রপিই জয়ি হয় শেষ পর্যন্ত, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলার পথেই এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বার্তাটা নিশ্চয়ই সুখকর কিছু নয়।
হঠাৎ করেই হেসে উঠলো এডমন্ড, কিন্তু আজ আমি এমন একজন তরুণ পদার্থবিদের সাথে দেখা করতে এসেছি যিনি এই তত্ত্বে যোগ করবেন…কি? ঐ যে বলে না? টুইস্ট। তিনি এমন কিছু ব্যাপার নিয়ে গবেষণা করছেন যেখান থেকে হয়তো আসলেই জানা যাবে, কিভাবে উৎপত্তি হয়েছিল জীবনের।
*
জেরেমি ইংল্যান্ড?
এডমন্ড এই মুহূর্তে যে পদার্থবিদের কথা বলছে তার নাম শুনে অবাক হয়ে গেল ল্যাংডন। এমআইটি এই প্রফেসরের বয়স বড়জোর ত্রিশের আশেপাশে হবে। বিজ্ঞান জগতে বেশ কয়েক বছর ধরেই শোরগোল হচ্ছে তাকে নিয়ে, বিশেষ করে বিজ্ঞানের নব্য একটি শাখায়-কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞানে। কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান জীববিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যেখানে জৈবিক বস্তু এবং সমস্যাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাপেক্ষে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়। অনেক জৈবিক প্রক্রিয়া শক্তির রূপান্তরের সাথে জড়িত যা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য এবং প্রকৃতিগত দিক থেকে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান সম্পর্কিত।
কাকতালিয়ভাবে জেরেমি ইংল্যান্ড এবং রবার্ট ল্যাংডন একই প্রিপাইটরি স্কুলের ছাত্র ছিল-ফিলিন্স এক্সেটার অ্যাকাডেমি-আর ল্যাংডন এই বিখ্যাত পদার্থবিদের নাম প্রথম দেখেছিল স্কুলের অ্যালুমনাই ম্যাগাজিনে। সেখানে জেরেমির একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। পুরো প্রবন্ধটা অবশ্য পড়ে দেখেনি ল্যাংডন, সত্যি কথা বলতে সেটার বিষয়বস্তু তার মাথার অনেক ওপর দিয়ে যাওয়াতে আগ্রহ পায়নি। কিন্তু এটা দেখে অবাক হয়েছিল যে তার প্রাক্তন স্কুলের এই তরুণ একই সাথে ভীষণ প্রতিভাবান একজন পদার্থবিদ এবং ভীষণ ধার্মিক একজন ব্যক্তিও।
ল্যাংডন ধারণা করতে পারছে যে কেন জেরেমির কাজের প্রতি আগ্রহি এডমন্ড।
স্ক্রিনে অপর একজন বয়স্ক প্রফেসরকে দেখা গেল এই সময়। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ আলেক্সান্ডার গ্রসবার্গ। আমরা আশা করছি, জেরেমি ইংল্যান্ড হয়তো জীবনের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের বিষয়ে তার পদার্থবিদ্যাগত তত্ত্বটা প্রমাণের পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন, বললেন তিনি।
কথাটা শুনে সোজা হয়ে বসলো ল্যাংডন। অ্যাম্ব্রাও।
অপর একজন ব্যক্তির চেহারা ভেসে উঠলো পর্দায়। পুলিঞ্জার পুরষ্কার প্রাপ্ত ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড জে. লারসন। জেরেমি ইংল্যান্ড যদি তার তত্ত্বটা প্রমাণ করতে পারেন, বললেন তিনি, তাহলে সে-ই হবে পরবর্তি ডারউইন।
হয় ঈশ্বর! ল্যাংডন যতটা ভেবেছিলো তার চেয়েও অনেক বেশি বিখ্যাত জেরেমি ইংল্যান্ড।
কর্নেল ইউনিভার্সিটির একজন পদার্থবিদ, কার্ল ফ্র্যাঙ্ক বললেন, প্রতি ত্রিশ বছর অন্তর অন্তর বড় কোন বৈজ্ঞানিক সাফল্যের সম্মুখীন হই আমরা, জেরেমি হয়তো সেই পথেই নিয়ে যাচ্ছে আমাদের।
এরপর একে একে পর্দায় ভেসে উঠলো অনেকগুলো পত্রিকার শিরোনাম, যেখানে জেরেমি ইংল্যান্ডের জীবের উৎপত্তি বিষয়ক তত্ত্বটা প্রমাণের ফলাফল কী হবে সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
সর্বশেষ শিরোনামটা নেয়া হয়েছে ২০১৫ সালের একটি ম্যাগাজিনের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে :
The Brilliant New Science That Has Creationists And the Christian right terrified
ডারউইনের অসমাপ্ত কাজ শেষ করছেন এমআইটির একজন প্রফেসর।
আবার পর্দায় ফিরে আসলো এডমন্ড। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের লম্বা করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে সে। তাহলে কি এই সেই নতুন তত্ত্ব যেটা এতটা শোরগোলের সৃষ্টি করেছে?
একটা দরজার সামনে থেমে হাসলো এডমন্ড। দরজায় একটা সাইন ঝুলছে, যেখানে লেখা : ENGLAND LAB@MITPHYSICS
ভেতরে গিয়ে তাকেই সরাসরি জিজ্ঞেস করা যাক।
.
অধ্যায় ৯৩
তরুণ বিজ্ঞানী জেরেমি ইংল্যান্ডকে দেখা যাচ্ছে এখন এডমন্ডের ডিসপ্লেতে। হালকা পাতলা গড়ন, গালে কয়েক দিনের না কামানো দাঁড়ির তরুণ পদার্থবিদের মুখে বিনয়ী হাসি। তার পেছনে ব্ল্যাকবোর্ড গাণিতিক সমীকরণে ভর্তি।
প্রথমেই বলে নেই, জেরেমি দর্শকদের সতর্ক করার সুরে বলল, এই তত্ত্বটা এখনও প্রমাণিত নয়, শুধু একটি ধারণা মাত্র, এটুকু বলে একবার কাঁধ নাচালো সে, তবে স্বীকার করছি, এটা যদি প্রমাণ করা যায়, তাহলে তার ফলাফল হবে মারাত্মক।
পরের তিন মিনিট ধরে পদার্থবিদ তার প্রস্তাবিত তত্ত্বটা সম্পর্কে ধারণা দিলেন সবাইকে-বেশিরভাগ যুগান্তকারি আবিষ্কারের মতনই তার প্রস্তাবনার মূল অংশটুকুও খুব সহজ।
ল্যাংডন যদি ঠিক বুঝে থাকে, তবে জেরেমির প্রস্তাবনা অনুযায়ি পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কেবল মাত্র একটি লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
শক্তির পরিব্যপ্তি।
সহজ কথায়, প্রকৃতি যদি টের পায় যে কোথাও শক্তি পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তবে সেই শক্তি সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এর সবচেয়ে সহজ উদাহরণটার কথা কিয়ার্শ কিছুক্ষণ আগেই বলেছে-চায়ের মগ গরম করে টেবিলের ওপর রেখে দেয়া। তখন সেটা থেকে তাপ বিকিরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে পরিবেশে।
ল্যাংডন হঠাই বুঝতে পারলো, এডমন্ড কেন তাকে এমন এমন পুরাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল যেগুলোতে এমন সব দৃশ্যকল্প আছে যেখানে শক্তি এবং আলো ছড়িয়ে পড়ছে আর দূর হয়ে যাচ্ছে আঁধার।
তবে এই শক্তির পরিব্যপ্তির ধরণের ব্যাপারে জেরেমির একটা নিজস্ব মত আছে।
আমরা জানি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সবসময় বিশৃঙ্খলা পছন্দ করে, অর্থাৎ এনট্রপি, জেরেমি বলল, তাই আমরা এরকম উদাহরণ দেখে অবাক হয়ে যাই যেখানে কতগুলো অণু সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান করছে।
কিছুক্ষণ আগে দেখানো ঘূর্ণিঝড়, তুষারকণা আর কোয়ার্টজ স্ফটিকের ছবিটা পুণরায় দেখানো হলো পর্দায়।
এখানে যে কাঠামোগুলো দেখতে পারছেন, জেরেমি বলল, কাঠামো বলতে ঘূর্ণিঝড়ের গুঁড়, গোটা তুষারকণা আর স্কটিকটার কথা বোঝাচ্ছি। এগুলোর প্রত্যেকটিকেই আমরা বলতে পারি ক্ষয়িষ্ণু কাঠামো-যেখানে কতগুলো অণু একত্রিত হয়েছে একটি সিস্টেমের শক্তিকে সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে।
এরপর জেরেমি দ্রুত বোঝালেন যে, ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপ এবং চাপের ভারসাম্য রক্ষা করে। অন্যভাবে বললে, কোন অঞ্চলের বায়ুচাপ যদি অত্যাধিক বেড়ে যায় তবে প্রচণ্ড ঘূর্ণনের মাধ্যমে সেই অতিরিক্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে যায়।
মোট কথা, জেরেমি বলল, পদার্থ নিজেদের মধ্যেই সুশৃঙ্খল কাঠামো গঠন করে যাতে শক্তি সহজভাবে বিকিরণ করা যায়, এটুকু বলে থামলো সে, এরপর হেসে যোগ করলো, প্রকৃতি, পুরো বিশ্বজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্যে ছোট ছোট সুশঙ্খল কাঠামোর তৈরি করে। ছোট ছোট কাঠামো বলতে এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় ছোট বোঝাচ্ছি, আশা করি ধরতে পারছেন। আপনারা। এই কাঠামোগুলো এক পর্যায়ে গিয়ে এনট্রপি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ল্যাংডন এভাবে কখনও চিন্তা করেনি, কিন্তু জেরেমি ঠিক কথাই বলছে; প্রকৃতিতে এরকম উদাহরণের অভাব নেই। যেমন বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকানো। ছোটবেলার পড়াশোনার কথা মনে পড়ে গেল-বজ্রপাত ঘটে যখন। আকাশের মেঘের নিচের দিকে প্রচুর ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ ও তার বিপরীতে মাটিতে ধনাত্মক চার্জ জমা হয়। মেঘের ভেতরের পানি ও বরফকণার ঘর্ষণ এবং অন্যান্য কারণে মেঘের নিচের দিকে ঋণাত্মক ও ওপরের দিকে ধনাত্মক বিদ্যুৎ চার্জের সমাবেশ ঘটে। দুই বিপরীতধর্মি চার্জের পারস্পরিক আকর্ষণে মেঘের দুই পিঠের মধ্যে একটি বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি হয়। সৃষ্ট বিদ্যুৎক্ষেত্র বেশি শক্তিশালী হয়েউঠলে মেঘের এপিঠ-ওপিঠের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়। এটা একই মেঘের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু অন্যদিকে মেঘের নিচের দিকের ঋণাত্মক বিদ্যুৎ চার্জের আকর্ষণে মাটিতে ধনাত্মক চার্জের সমাবেশ ঘটে এবং এ দুয়ের মধ্যেও একটি বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি হয়। বাতাস বিদ্যুৎ অপরিবাহী হওয়ায় মেঘের বিদ্যুৎ মাটিতে আসতে পারে না। তবে মেঘে অনেক বেশি চার্জ জমা হলে একপর্যায়ে মাঝখানের বাতাসের বাধা অতিক্রম করে ঋণাত্মক বিদ্যুৎ চার্জ মাটিতে সঞ্চিত ধনাত্মক বিদ্যুতের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য একটি প্রবাহ রেখা সৃষ্টি করে। প্রথমে মেঘের কিছু বৈদ্যুতিক চার্জ নিচে নামতে শুরু করে। আঁকাবাঁকা পথে ধাপে ধাপে এই বিদ্যুৎ নিচে নামতে থাকে। প্রতিটি ধাপ প্রায় ৫০ গজ দীর্ঘ এবং এগুলো এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময় স্থায়ী হয়। এতে কয়েক টন ঋণাত্মক চার্জ থাকে। এরা ধাপে ধাপে নামতে থাকলে এর প্রভাবে মাটি থেকে ধনাত্মক বিদ্যুৎ উঁচু গাছ, ঘরবাড়ি বা টাওয়ার বেয়ে ওপরের দিকে উঠে ওদের সঙ্গে মিলিত হয়। এভাবেই ঊর্ধ্বমুখী ধনাত্মক চার্জের প্রবাহ ও নিম্নমুখী ঋণাত্মক চার্জের সম্মিলনে শক্তিশালী বিদ্যুৎ প্রবাহ লাইন সৃষ্টি হয়। তখনই বিদ্যুৎ চমকায় ও প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত ঘটে। অর্থাৎ জমা হওয়া শক্তি ছড়িয়ে দেয়া হলো। ফলে গোটা সিস্টেমের এনট্রপিও বেড়ে যায়।
অর্থাৎ শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলার বিন্যাস।
পারমাণবিক বোমাগুলোও এক একটা শক্তির সুশৃঙ্খল আঁধার, যেখান থেকে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় প্রকৃতিতে। এনট্রপিকে যে গাণিতিক প্রতীক দ্বারা সূচিত করা হয় সেটা ভেসে উঠলো ল্যাংডনের মনের পর্দায়। প্রতীকটা এমন যে দেখে মনে হয় শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
শক্তি
এখন আপনারা জিজ্ঞেস করতেই পারেন, আমি এনট্রপি নিয়ে এতক্ষণ ধরে কথা বলছি কেন। জীবনের উৎপত্তির সাথে এর কী সম্পর্ক? ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে হেঁটে গেল জেরেমি। সম্পর্ক আছে, বলল সে, জীবন হচ্ছে পুঞ্জীভূত শক্তি ছড়িয়ে দেয়ার একটি হাতিয়ার।
চক দিয়ে একটা গাছ এবং সূর্যের ছবি আঁকলো জেরেমি।
একটা গাছ সূর্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করে, নিজের বৃদ্ধিতে সেটা কাজে লাগায় এবং বিকীর্ণ করে অবলোহিত রশ্মি। সালোকসংশ্লেষণও এনট্রপির একটি কার্যকরি উদাহরণ। সূর্যের আলোর শক্তি শোষণ করে সেটাকে দূর্বল শক্তিতে পরিণত করে গাছ, ফলে এনট্রপি বেড়ে যায়। অন্য সব জীবসত্ত্বার জন্যেও এই কথাটা সত্য। খাবারের আকারে কিছু পুঞ্জীভূত শক্তি গ্রহণ করা হয়, পরে সেই শক্তি প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে তাপ শক্তি আকারে, একেবারে সরলীকরণ করে বলছি, এটুকু বলে থামলো সে, এরপর বলল, আমার বিশ্বাস, জীবন শুধু পদার্থবিজ্ঞানের এই নিয়ম মেনেই চলে না, বরং জীবনের উৎপত্তিও হয়েছে এই কারণে।
যুক্তিটার কথা চিন্তা করে একটা শিহরণ বয়ে গেল ল্যাংডনের শরীরে। যদি কোন উর্বর জমিতে সূর্যকিরণ এসে পড়ে তবে প্রকৃতি পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুসরণ করে সেখানে একটি গাছের সৃষ্টি করবে যার কারণে সেই সূর্যকিরণের। শক্তি ক্ষয় হতে থাকবে। ঠিক একইভাবে গভীর সমুদ্রের সালফার সমৃদ্ধ খাদগুলোর আশেপাশে পানি ফুটতে থাকলে সেখানে প্রাণের আবির্ভাব ঘটবে শক্তি শোষণ করার নিমিত্তে।
তবে এসবের কিছুই এখনও প্রমাণিত নয়, জেরেমি বলল, আমরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি মাত্র। এখনই এসব নিয়ে বেশি শোরগোলের। দরকার নেই কারণ এই তত্ত্বটা প্রমাণ করা প্রচণ্ড কঠিন একটা কাজ। আমার দলের লোকেরা এবং আমি কিছু এক্সপেরিমেন্টের খসড়া করছি তবে মূল লক্ষ্য থেকে এখনও অনেক অনেক বছর দূরে আমরা।
এসময় এডমন্ডের চেহারা আবার ভেসে উঠলো পর্দায়, আমি কিন্তু অনেক বছর দূরে নেই। ঠিক এই ধরণের মডেলিং নিয়েই কাজ করছি আমি।
নিজের ল্যাবের দিকে হাঁটতে থাকলো সে, যদি প্রফেসর ইংল্যান্ডের ধারণা ঠিক হয় তবে পুরো মহাজগতকে কেবলমাত্র একটি মাত্র কম্যান্ড দিয়েই প্রকাশ করা যাবে-শক্তির পরিব্যপ্তি!।
নিজের ডেস্কে বসে বড় কিবোর্ডটায় দ্রুত টাইপ করতে শুরু করলো সে। তার সামনের ডিসপ্লেগুলোতে ভেসে উঠলো দুর্বোধ্য কম্পিউটার কোড। কয়েক সপ্তাহ সময় নিয়ে গতবারের ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্টটা রিপ্রোগ্রাম করি আমি। একটাই মূল লক্ষ্য বেঁধে দেই সিস্টেমে। বলি যে, যেভাবে সম্ভব শক্তি ক্ষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রিমর্ডিয়াল স্যুপে এনট্রপির বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। সিমুলেশনে সেজন্যে যা দরকার সেটা তৈরির অনুমতি দেই কম্পিউটারকে।
হঠাৎই টাইপ করা বন্ধ করে দর্শকদের দিকে ঘুরে তাকালো এডমন্ড, এবারের মডেলিংটা সফল হয়। কারণ আমি প্রিমর্ডিয়াল স্যুপে গতবারের সেই হারানো উপকরণটা যোগ করতে ভুলিনি।
ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা দু-জনেই তাকিয়ে আছে ডিসপ্লের দিকে। সেখানে এডমন্ডের মডেলের একটা অ্যানিমেশন চলছে এখন। আবারও একদম আণবিক পর্যায়ে দেখানো হচ্ছে গোটা বিষয়টা। যেখানে অণুগুলোর মধ্যে বন্ধন তৈরি হচ্ছে, ভাঙছে আবার জটিল জটিল নক্সার কাঠামো গঠিত হচ্ছে।
যদি আমি একশো বছর ফাস্ট ফরওয়ার্ড করি, এডমন্ড বলল, তাহলে ইউরে-মিলারের অ্যামাইনো এসিডগুলোর গঠন স্পষ্ট হতে শুরু করে।
রসায়নের ব্যাপারে খুব বেশি জানে না ল্যাংডন কিন্তু পর্দায় যা দেখানো হচ্ছে সেটা যে একটা প্রোটিন চেইন তা চিনতে পারলো। সময়ের সাথে জটিল জটিল অণুর সংখ্যা বাড়ছে, প্রত্যেকটার গঠন আগেরটার চেয়ে জটিল। অবশেষে ছয়কোণা আকৃতির একটা কাঠামো দেখা গেল পর্দায়।
নিউক্লিওটাইড! এডমন্ড ঘোষণা করলো, এখন আমরা কয়েক হাজার বছর পরের ঘটনা দেখছি। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে, এখন নির্দিষ্ট কাঠামো দৃশ্যমান হচ্ছে।
তার কথা বলার সাথে সাথে একটা নিউক্লিওটাইড চেইন নিজের চারদিকে পেঁচানো শুরু করলো। এটা দেখছেন?! উত্তেজনায় চড়ে গেছে এডমন্ডের গলার স্বর, এটা কয়েক কোটি বছর পরের ঘটনা, আর এখন সিস্টেম একটা নির্দিষ্ট কাঠামো বানানোর চেষ্টা করছে। এমন একটা কাঠামো যেটা পুঞ্জীভূত শক্তির ক্ষয় করতে সক্ষম।
কম্পিউটার মডেলটা আরও কিছুক্ষণ এগোনোর পর ল্যাংডন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, আগের সর্পিলাকার কাঠামোটা এখন দুটো সর্পিলাকার কাঠামোতে পরিণত হয়েছে, যেগুলো নিজেদের পেঁচিয়ে রেখেছে ওতপ্রোতভাবে। যেকেউ এই কাঠামো দেখলে চিনতে পারবে-পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত কাঠামো বললেও ভুল হবে না-একটা ডাবল হেলিক্স।
চিত্র: ডাবল হেলিক্স
হা ঈশ্বর! অ্যাম্ব্রা ফিসফিসিয়ে বলল, রবার্ট, ওটা কি…
ডিএনএ, এডমন্ড ঘোষণা করলো, অ্যানিমেশনটাও থেমে গেল পর্দায়। জীববিজ্ঞানের মূল ভিত্তি। আর একটা সিস্টেম কেন ডিএনএ তৈরি করার চেষ্টা করবে? কারণ কোন কাজে যদি একটা হাতের বদলে একশোটা হাত ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটা সহজ হয়। একটা গাছের তুলনায় এক জঙ্গলভর্তি গাছ বেশি সৌরশক্তি গ্রহণ করে সেটা ছড়িয়ে দিতে পারবে। একটা এনট্রপির মেশিনের বদলে হাজারটা এনট্রপি মেশিন বেশি কাজের।
এসময় এডমভের চেহারা আবার ভেসে উঠলো পর্দায়, এভাবে এক পর্যায়ে গিয়ে ডারউইনের তত্ত্ব অনুযায়ি বিবর্তনের দেখা মিলবে। আর কেনই বা হবে না সেটা? বিবর্তনের মাধ্যমেই প্রকৃতি ঠিক করে কোন প্রজাতি টিকে থাকবে আর কোনটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
স্ক্রিনে এখন এডমন্ডকে মহাকাশে ভেসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তার পেছনে ঘুরে চলেছে পৃথিবী। এলেম আমরা কোথা থেকে? এটাই হচ্ছে তার উত্তর। এনট্রপির কারণে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের। প্রতিনিয়ত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে পুঞ্জীভূত শক্তি গ্রহণ করে সেটা ছড়িয়ে দিচ্ছি আমরা।
এডমন্ডের কণ্ঠের নিশ্চয়তা ল্যাংডনকে এবার ছুঁতে পারলো না। কতজন গুরুত্ব দেবে এডমন্ডের এই কম্পিউটার মডেলিং সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। তার। তবে অবশ্যই অনেক আলোচনা হবে প্রেজেন্টেশনটা নিয়ে।
অ্যাম্ব্রাকে দেখেও মনে হলো, চিন্তায় মগ্ন সে।
বন্ধুরা, এডমন্ড বলল, এতক্ষণ আমার সাথে থাকার জন্যে ধন্যবাদ। তবে কোথাও যাবেন না। কারণ আমার এই আবিষ্কার পথ দেখিয়েছে আরেকটা আবিষ্কারের, যেটা আরও চমকপ্রদ।
কিছুক্ষণের জন্যে থামলো সে। ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসলো।
কোথা থেকে এসেছি আমরা…সেটার উত্তরের চেয়ে, আমরা কোথায় যাচ্ছি, সেই প্রশ্নের উত্তর আরও বিস্ময়কর।
.
অধ্যায় ৯৪
ভূগর্ভস্থ ব্যাসিলিকার গভীরে একজন গার্ডিয়া এজেন্টের বুটের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে শুনলো বিশপ ভালদেসপিনো। ওদের তিনজনের উদ্দেশ্যে ছুটে আসছে সে।
মহারাজ, দূর থেকেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল গার্ডিয়া এজেন্ট, এডমন্ড কিয়ার্শের… প্রেজেন্টেশনটা… শুরু হয়েছে।
হুইলচেয়ার নিয়েই তার দিকে ঘুরে গেলেন রাজা, প্রিন্স হুলিয়ানও তাকালেন সেই দিকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভালদেসপিনোর বুক চিড়ে। এই দুঃসংবাদ শোনার জন্যেই অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কিন্তু কিছু করা তো আর সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। কিছুদিন আগে মন্তসেরাত লাইব্রেরিতে তাকে যে জঘন্য ভিডিওটা দেখিয়েছিল এডমন্ড কিয়ার্শ সেটা এখন পুরো পৃথিবীর লোক দেখছে ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন বিশপ।
এলেম আমরা কোথা থেকে? কিয়ার্শ তার প্রেজেন্টেশনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। প্রাণের উৎপত্তির যে দাবি করেছে তা একই সাথে উদ্ধত এবং ঈশ্বরনিন্দাপূর্ণ।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেখানেই শেষ হয়নি কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন, আরও বিপজ্জনক এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার দাবি করেছে সে-কোথায় যাচ্ছি আমরা।
ভবিষ্যৎ নিয়ে কিয়ার্শের মতামত এতটাই গোলমেলে ঠেকেছিল তাদের কাছে যে, সেদিন লাইব্রেরিতে উপস্থিত সবাই তাকে অনুরোধ করেছিল প্রেজেন্টেশনটা না প্রকাশ করতে। ফিউচারিস্টের তথ্যগুলো যদি সঠিকও হয়ে থাকে তবুও তা পৃথিবীর সকলের জন্যেই ক্ষতিকর।
.
অধ্যায় ৯৫
ঈশ্বরের কোন দরকার পড়েনি! পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ি স্বতস্ফূর্তভাবে জীবনের উৎপত্তি হয়েছে। পাগলাটে এডমন্ডের দাবি করা কথাগুলো নিয়ে ভাবলো ল্যাংডন।
স্বতস্ফূর্তভাবে জীবনের উৎপত্তি এই ব্যাপারটা নিয়ে আগেও অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছে। বিজ্ঞান জগতের নামকরা অনেকে এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। কিন্তু সবগুলোই তাত্ত্বিক। কেউ নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেননি। আর আজ রাতে এডমন্ড কিয়াৰ্শ কম্পিউটার মডেলিং কাজে লাগালো তার যুক্তি উপস্থাপনে। এর আগে কেউ কখনও এরকমটা করেনি।
স্ক্রিনে এডমন্ডের স্যিমুলেশনটা চলছেই। সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব কণা দেখা যাচ্ছে এখন।
আমার এই মডেলটা দেখে হঠাৎ আরেকটা প্রশ্ন এলো আমার মাথায়, এডমন্ড বলল, কী হবে যদি এটাকে চলতেই দেই আমি? তাহলে কি একসময় গোটা প্রাণীজগতের আবির্ভাব দেখা যাবে? এর পরেই বা কী হবে? কোথায় চলেছি আমরা এই প্রশ্নের উত্তর কি পাওয়া সম্ভব হবে?
আবারও ই-ওয়েভ কম্পিউটারটার পাশে এসে দাঁড়ালো এডমন্ড, দুঃখজনকভাবে সেই সিমুলেশনে যে পরিমাণ শক্তির দরকার হবে তা এই কম্পিউটারেরও নেই। তাই সিমুলেশনের ক্ষেত্রটা সংকীর্ণ করার উপায় বের করতে বাধ্য হয়েছি আমি। আর সেটা করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত একদমই অপ্রত্যাশিত এক জায়গা থেকে সাহায্য নিয়েছি…ওয়াল্ট ডিজনির কাছ থেকে।
স্ক্রিনে এখন একদম আদ্যিকালের একটা কার্টুনের ছবি ভেসে উঠলো। টু ডি সাদা কালো কার্টুন। ১৯২৮ সালের বিখ্যাত স্টিমবোট উইলি কার্টুনটা চিনতে কোন বেগ পেতে হলো না ল্যাংডনকে।
গত নব্বই বছরে কার্টুন জগতে ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে-মিকি মাউসের মত আদিম আমলে কার্টুনের জায়গায় অত্যাধুনিক অ্যানিমেশন ফিল্ম দেখি আমরা এখন।
পুরনো কার্টুনটার পাশে এবার ফুটে উঠলো আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি একটি অ্যানিমেশন, যেটা দেখতে অতিমাত্রায় বাস্তব।
গুহামানবেরা যখন পাথুরে দেয়ালে ছবি আঁকতো, তখন থেকে মাইকেলাঞ্জেলোর আঁকা ক্লাসিক ছবিগুলোর মধ্যবর্তি সময়ে যতটুকু উন্নতি হয়েছিল এ ক্ষেত্রে, তার চেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে গত ৯০ বছরে। এরকম দ্রুত উন্নতিশীল ক্ষেত্রগুলো বরাবরই আকর্ষণ করে আমাকে, এডমন্ড বলল, আর যে প্রযুক্তির কারণে এটা সম্ভব হয়েছে সেটার নাম টুইনিং। এটা মূলত একটা কম্পিউটার অ্যানিমেশন শর্টকাট যেখানে একজন শিল্পী কম্পিউটারকে একটা কার্টুনের দুটো পরিস্থিতির মধ্যবর্তি ফ্রেমগুলো আঁকার নির্দেশ দেয়। প্রতিটি ফ্রেম হাতে আঁকার চাইতে এই পদ্ধতিটা সময়ও যেমন বাঁচায় তেমনি কাকর। এখনকার দিনে শিল্পীরা মূল কয়েকটা হাতে এঁকে মধ্যবর্তি ফ্রেমগুলো কম্পিউটারের সাহায্যে তৈরি করে। ঠিক আমার মডেলের ক্ষেত্রে বিবর্তনের মধ্যবর্তি ধাপগুলোর মতন।
এটাই হচ্ছে টুইনিং, এডমন্ড ঘোষণা করলো, এটা কম্পিউটারের শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর একটা উপায় মাত্র, কিন্তু আমি যখন প্রক্রিয়াটার ব্যাপারে অবগত হলাম, বুঝতে পারলাম, এর মাঝেই নিহিত আছে আমাদের ভবিষ্যৎকে জানার উপায়।
কোনদিকে যাচ্ছে প্রেজেন্টেশনটা? ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা।
ল্যাংডন কিছু বলার আগেই আবার আগের একটা ছবি ভেসে উঠলো পর্দায়।
বিবর্তন
মানুষের বিবর্তন, বলল এডমন্ড। বিজ্ঞানকে ধন্যবাদ যে আমরা কয়েকটা মূল ফ্রেম পেয়ে গিয়েছি ইতোমধ্যে-শিম্পাঞ্জি, অস্ট্রালোপিথেকাস, হোমো হ্যাবিলিস, হোমো ইরেকটাস, নিয়েনডারথাল মানুষ-তবুও এই ধাপগুলোর মধ্যে রূপান্তর এখনও ঝাঁপসা।
ল্যাংডন কিছুক্ষণ আগে যেমনটা ভেবেছিল, কম্পিউটারের টুইনিং প্রক্রিয়া মানুষের বিবর্তনের মাঝামাঝি ধাপগুলো আউটলাইনের জন্যে ব্যবহার করেছে এডমন্ড। এরপর সে ব্যাখ্যা করে বলল চলমান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জিনোম প্রজেক্টের কথ-মানুষের জিনোম প্রজেক্ট (হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট), প্যালিও এস্কিমো, নিয়ানডারথাল, শিম্পাঞ্জি যেগুলো ফসিল থেকে প্রাপ্ত অস্থিচূর্ণ ব্যবহার করে মধ্যবর্তি প্রায় এক ডজন ধাপের জেনেটিক স্ট্রাকচার দাঁড় করাতে পেরেছে, শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষ পর্যন্ত।
আমি জানতাম, আমি যদি এইসকল আদিম জিনোমকে মূল ফ্রেম হিসেবে ব্যবহার করি, এডমন্ড বলল, তাহলে ই-ওয়েভের সহায়তায় বিবর্তনের একটা মডেল দাঁড় করাতে পারবো-যেটা মধ্যবর্তি ধাপগুলো নিজে থেকে বের করে নেবে। আর তাই খুব সাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ শুরু করি আমি-মস্তিষ্কের আঁকার-বুদ্ধিমত্তার বিবর্তনের একদম সঠিক সূচক।
একটা ছবি ভেসে উঠলো পর্দায়।
মস্তিষ্কের আকার
মস্তিষ্কের আকারের পাশাপাশি আরো কয়েক হাজার বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনা করে ই-ওয়েভ।
আগেরটার মতন আরও বেশ কয়েকটা গ্রাফ দেখানো হলো যেখানে বুদ্ধিমত্তার বিকাশের প্রমাণ রয়েছে।
আপনারা এখন হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন, কেন আমি আপনাদের মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিবর্তন এবং সকল প্রজাতির ওপর তাদের কর্তৃত্বের প্রমাণ দেখাচ্ছি, এটুকু বলে সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকালো এডমন্ড, দরকার আছে বলেই দেখাচ্ছি। কারণ আমরা যদি এই বিকাশের নির্দিষ্ট একটি প্যাটার্ন বের করতে পারি তাহলে সেই প্যাটার্ন দেখে কম্পিউটার বলতে পারবে যে ভবিষ্যতে আমাদের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে। যেমন আমি যদি এখন বলি-দুই, ছয়, আট…তাহলে আপনারা বলবেন দশ। ই-ওয়েভকেও ঠিক তেমনটাই করতে বলেছি আমি। তাহলে আমি ই-ওয়েভকে জিজ্ঞেস করতে পিরবো যে আজ থেকে পাঁচশো বছর পর মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিবর্তনের ফলাফল কী হবে। অন্যভাবে-কোথায় যাচ্ছি আমরা?
এডমন্ডের কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেল ল্যাংডন। জেনেটিক্স এবং কম্পিউটার মডেলিং সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না বিধায় এডমন্ডের দাবির সত্যতাও বোঝা সম্ভব হবে না তার পক্ষে। তবে পাগলাটে লোকটা যা বলছে তা অবশ্যই কৌতূহলোদ্দীপক।
যে কোন প্রজাতির বিবর্তন, এডমন্ড বলল, সবসময় সেই প্রজাতির পরিবেশের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তাই আমি ই-ওয়েভকে দ্বিতীয় আরেকটা মডেল তৈরি করতে বলেছি-যেখানে আমাদের বর্তমান পৃথিবীর সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান-আর তেমনটা করা কঠিনও হয়নি কারণ ইন্টারনেটে এখন আমারে সব খবরাখবর পাওয়া যায়। সেটা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, বিজ্ঞান সম্বন্ধীয়, আবহাওয়া কিংবা প্রযুক্তিগত হোক না কেন। আমি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে বলেছিলাম এমন বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর যেগুলো ভবিষ্যতে অনেক বড় প্রভাব ফেলবে, যেমন-নতুন নতুন ওষুধ, নতুন প্রযুক্তি, দূষণসহ আরও অনেক কিছু, এডমন্ড থামলো, আর এরপর, কম্পিউটার মডেলটা চালু করে দেই আমি।
পর্দায় এখন শুধু এডমন্ডের চেহারাটুকু দেখা যাচ্ছে। সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে সে। কিন্তু খুবই অপ্রত্যাশিত একটা ফলাফল দেখতে পাই, গম্ভীর স্বরে বলল সে, ভয়ংকর বললেও কম বলা হবে।
ল্যাংডন আর অ্যাম্ব্রা দুজনেই সোজা হয়ে বসে আছে এখন কাউচের ওপর।
তাই মডেলটা আবার শুরু থেকে চালু করি আমি, ভ্রু কুঁচকে বলল এডমন্ড, কিন্তু এবারও ফলাফল একই।
এডমন্ডের চেহারার ভয়টা যে মেকি নয় সেটা বুঝতে পারলো ল্যাংডন।
তাই আবার প্যারামিটারগুলো (যে বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় নিয়ে মডেলটা তৈরি হয়েছিল) বদলে দেই, বলল এডমন্ড, প্রোগ্রামের সবগুলো চলক বদলে দেই। এরপর বেশ কয়েকবার মডেলটা শুরু থেকে শুর করি আমি। কিন্তু প্রতিবারই একই ফলাফল আসতে থাকে।
ল্যাংডন ভাবলো, এডমন্ড হয়তো বলবে, যুগ যুগ ধরে মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশের পর এখন হয়তো কমতে শুরু করেছে আবার। সেটা সত্য হতেও পারে।
ডাটাগুলো দেখে চিন্তায় পড়ে যাই আমি, এডমন্ড বলল, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তাই কম্পিউটারকে গোটা ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করে দেখাতে বলি যতটা স্পষ্টভাবে সম্ভব। সেটাই করে ই-ওয়েভ।
এবার পর্দায় ভেসে উঠলো প্রাণীদের বিবর্তনের সময় পরিক্রমা। সেখানে দেখানো হচ্ছে কখন কোন প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে আবার তা বিলুপ্ত হয়েছে। একপাশের গ্রাফের পুরোটাই ডায়নোসরদের দখলে। সেখানে দেখা যাচ্ছে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এই প্রজাতিটা।
এখানে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন কখন কোন প্রজাতির আধিক্য ছিল পৃথিবীতে, কখন তারা এসেছে এবং কখন বিলুপ্ত হয়েছে। প্রজাতির সদস্য সংখ্যা, খাদ্যশঙ্খলে তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে এখানে সাজানো হয়েছে সবকিছু।
একের পর এক গ্রাফ উপস্থাপিত হতে লাগলো স্ক্রিনে।
এরপর আসলো হোমো স্যাপিয়েন্স, প্রায় আড়াই লক্ষ বছর আগে, একটা গ্রাফ দেখিয়ে বলল এডমন্ড, মোটামুটি ৬৫ হাজার বছর আগে তারাই পরিণত হলো পৃথিবীর মূল অধিবাসিতে। সবকিছুর ওপর তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ। সে সময়েই আবিষ্কৃত হয়েছিল তীর ধনুক, শিকারীদের নিজেরাই শিকার করতে শুরু করলো তারা।
গ্রাফে নীল রঙের চক্রাকার একটা জায়গার মধ্যে হোমো স্যাপিয়েন্স লেখা দেখলো ল্যাংডন, সময়কাল-৬৫০০০ বছর আগে। সেই জায়গাটুকুর পরিধি বাড়তে থাকলো সময়ের সাথে সাথে। ১০০০ বছর আগে থেকে সেই বৃদ্ধির। গতি বেড়ে গেল নাটকিয়ভাবে, যেমনটা আশা করেছিল ল্যাংডন। কারণ ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশের গতি বেড়েছে মানুষের ক্ষেত্রে। আগে যে উন্নতি ১০০ বছরে ঘটতো, তা এখন ১০ বছরে হয়।
এখন মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রজাতি, ল্যাংডন ভাবলো।
এটা দেখে অবশ্য অবাক হবার মত কিছু নেই যে, ২০০০ সালে, অর্থাৎ এই গ্রাফটার শেষে দেখা যায় যে বর্তমান যুগের মানুষই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী প্রজাতি। আমাদের ধারে কাছেও কেউ নেই, এটুকু বলে থামলো সে, তবে আপনারা নতুন একটা প্রজাতির আবির্ভাব দেখতে পাবেন…এখানে।
আগে যে নীল চক্রাকার জায়গাটুকুর মধ্যে হোমো স্যাপিয়েন্স লেখা ছিল সেটা এখন পুরো গ্রাফ জুড়ে আছে। তবে সেটার নিচে ছোট কালো একটা চক্রাকার জায়গা দেখা যাচ্ছে এখন। বোঝাই যাচ্ছে যে কেবল আবির্ভাব হচ্ছে প্রজাতিটার।
নতুন একটা প্রজাতি কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রবেশ করেছে দৃশ্যকল্পে, বলল এডমন্ড। কালো জায়গাটুকু নীল জায়গাটুকুর তুলনায় নিতান্তই ছোট। যেন তিমি মাছের পাশে কোন ছোট্ট একটা মাছ।
জানি, এডমন্ড বলল, এই নতুন প্রজাতিটা দেখতে একদমই সাধারণ, কিন্তু আমরা যদি ২০০০ সাল থেকে সামনে এগোই তাহলে আপনারা দেখতে পাবেন খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রজাতিটা।
গ্রফটা বর্তমান সময় পর্যন্ত বিবর্ধিত হলো। নিঃশ্বাস আটকে যাবার জোগাড় হলো ল্যাংডনের। গত দুই যুগের পরিক্রমায় কালো বৃত্তটার বৃদ্ধি অবিশ্বাস্য রকমের বেশি এবং দ্রুত। স্ক্রিনের প্রায় চারভাগের একভাগ জুড়ে আছে এখন ওটা। টক্কর দেয়ার চেষ্টা করছে হোমো স্যাপিয়েন্স লেখা বৃত্তটার সাথে।
কী এটা?! আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা।
বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমার, ল্যাংডন জবাব দিলো। কোন ধরণের ভাইরাস? ওকেও গ্রাস করেছে আতংক। কিন্তু এমন কোন প্রজাতির আবির্ভাবের কথা ভাবতে পারলো না ল্যাংডন যেটা কিনা চোখের আড়ালে থেকে যাবে এতদিন পর্যন্ত। মহাকাশের কোন আগন্তুক?
নতুন এই প্রজাতিটি খুবই চতুর, এডমন্ড বলল, খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে এটা। নিজের বিচরণক্ষেত্রও বাড়াতে থাকে প্রতিনিয়ত। আর সবচেয়ে জরুরি কথা…বিবর্তিত হয় মানুষের চেয়েও দ্রুততর। আবারো গম্ভীর ভঙ্গিতে ক্যামেরার দিকে তাকালো এডমন্ড, দুর্ভাগ্যবশত, আমি যদি সিমুলেশনটা সামনে এগোতে দিয়ে ভবিষ্যতের পরিণতি দেখতে চাই, মাত্র কয়েক যুগ পরের ভবিষ্যৎ, তাহলে এমনটা দেখা যায়।
এবার ২০৫০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত হলো গ্রাফটা।
কাউচ ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ল্যাংডন।
হায় ঈশ্বর! অ্যাম্ব্রার কণ্ঠেও ভয়ের আভাস।
গ্রাফে দেখা যাচ্ছে, আগের কালো বৃত্তটার বৃদ্ধি এতটাই হয়েছে যে, ২০৫০ সাল নাগাদ তা হোমো স্যাপিয়েন্স লেখা বৃত্তটাকে পুরোপুরি গলাধঃকরণ করে নিয়েছে।
আমি দুঃখিত, আপনাদের এটা দেখাতে হচ্ছে, বলল এডমন্ড, কিন্তু আমার প্রতিটা মডেলে এই একই ফলাফল দেখতে পাই আমি, যা কিছুই বদলাই না কেন। বর্তমান সময় পর্যন্ত বজায় ছিল মানুষের রাজত্ব, এরপর নতুন একটা প্রজাতি এসে আমাদের মূল চিত্র থেকেই সরিয়ে দিয়েছে।
বিশাল স্ক্রিনটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো ল্যাংডন, যা দেখছে তা কেবল কম্পিউটারের সাহায্যে তৈরি করা একটি মডেল মাত্র। এরকম কিছু দেখলে যেকোন মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হতে বাধ্য।
বন্ধুরা, এডমন্ড গম্ভীর স্বরে বলল, আমাদের প্রজাতিটা এখন বিলুপ্তির দোরগোড়ায়। আমি আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি ভবিষ্যতের চেহারা কেমন হতে সেটার পেছনে ছুটে আর এক্ষেত্রে প্রতিটা ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখেছি আমি। তাই আমি হলফ করে বলতে পারি, আজকের মানুষ আর পঞ্চাশ বছর পরের মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকবে।
গ্রফটা দেখার ল্যাংডনের প্রাথমিক মানসিক ধাক্কাটা কেটে গিয়ে এখন সেখানে ভর করলো অবিশ্বাস এবং রাগ-ওর ছাত্রের প্রতি। কী করছো তুমি, এডমন্ড?! এটা তো কা-জ্ঞানহীনতার পরিচয়। একটা মামুলি কম্পিউটার মডেলের ওপর ভিত্তি করে এরকম দাবি, হাজারটা জিনিস ভুল হতে পারে, কোটি কোটি মানুষ দেখছে এটা…।
আরেকটা ব্যাপার, এডমন্ড বলল, চেহারা আগের চেয়ে আরও গম্ভীর হয়ে গেল তার, আপনারা যদি সিমুলেশনটা ঠিকভাবে লক্ষ্য করে করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, নতুন প্রজাতিটা পুরোপুরিভাবে মুছে দেয়নি আমাদের। বরং…একীভূত করে নিয়েছে।
.
অধ্যায় ৯৬
নতুন প্রজাতিটা আমাদের একীভূত করে নেবে?!
কথাটা দিয়ে কী বোঝাতে চাইলে এডমন্ড সেটা কল্পনা করার চেষ্টা করছে। ল্যাংডন; মনে পর্দায় ভেসে উঠেছে সায়েন্স-ফিকশন অ্যালিয়েনদের নিয়ে করা সিনেমাগুলোর ছবি। যেখানে মানুষদের নিজেদের বিকাশের জন্যে কাজে লাগানো হয়।
দাঁড়ানো অবস্থাতেই অ্যাম্ব্রার দিকে তাকালো ল্যাংডন। হাঁটু বুকের কাছে চেপে ধরে বসে আছে সে, চোখ স্ক্রিনের দিকে। ব্যাপারটা নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবার চেষ্টা করলো ল্যাংডন, কিন্তু কিছু মাথায় আসলো না।
এডমন্ডের সিমুলেশন অনুযায়ি নতুন একটা প্রজাতি এসে নিজেদের সাথে একীভূত করে নেবে মানুষদের। আর সবচেয়ে ভয়ের কথা, প্রজাতিটা এই ইতোমধ্যেই পৃথিবীতে বসবাস করছে, নীরবে বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে এর সংখ্যার।
সবার সামনে তথ্যটা উপস্থাপন করার আগে আমাকে অবশ্যই নতুন প্রজাতিটা চিহ্নিত করতে হতো, এডমন্ড বলল, তাই ডাটাগুলো বিশ্লেষণ করা শুরু করি আমি। হাজারটা সিম্যুলেশনের পরে অবশেষে সেটা করতে সমথ্য হই, নতুন প্রজাতিটার খোঁজ পাই।
এবার সহজ একটা ছবি ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। একদম ছোট থাকতেই এটার সাথে পরিচিত হয়েছিল ল্যাংডন-জীবজগতের ছয়টি শ্রেণী। অ্যানিম্যালিয়া, প্ল্যান্টি, প্রোটিস্টা, ইউব্যাক্টেরিয়া, আর্কিব্যাক্টেরিয়া, ফাঞ্জাই।
একবার নতুন এই সত্ত্বাটা আবিষ্কারের পর আমি খেয়াল করলাম এটা অন্যান্য শ্রেণী থেকে এতটাই ভিন্ন যে, একে কোন প্রজাতি বলা যাবে না। কোন গোত্র না, এমনকি কোন বর্গেরও অন্তর্ভুক্ত না, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল সে। আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের জগতে এখন আধিপত্য কায়েম করছে তার চেয়েও বড় কিছু। যেটাকে কেবল নতুন একটা শ্রেণী হিসেবেই আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
একদম হঠাৎ করেই ল্যাংডন বুঝতে পারলো, এডমন্ড কী বোঝাতে চাইছে।
শ্রেণীবিন্যাসে নতুন শ্রেণীর আবির্ভাব। সপ্তম একটি শ্রেণী।
বিস্ময়ের সাথে এডমন্ডকে সবার সামনে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে শুনলো ল্যাংডন। কিছুদিন আগে বিখ্যাত ডিজিটাল-কালচার লেখক কেভিন কেলিকেও এরকম কিছু বলতে শুনেছিল সে। তাছাড়া অনেক আগে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকেরা এরকম একটা শ্রেণীর সম্পর্কে ধারণা দিয়ে গেছেন।
নতুন এই শ্রেণীটা গঠিত নির্জীব প্রজাতিদের নিয়ে।
কিন্তু এই নির্জীব প্রজাতিগুলো একদম জীবন্ত প্রাণীদের মতনই বিবর্তিত হয়-ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে তাদের গঠন। কিছু টিকে থাকে, আবার কিছু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায়। একদম ডারউইনের যোগ্যদের টিকে থাকার তত্ত্বটার মতন।
এখন অ্যানিম্যালিয়া এবং অন্যান্য ছয়টি শ্রেণীর সাথে সহাবস্থান করছে এই সপ্তম শ্রেণী।
সেটার নাম-টেকনিয়াম।
এডমন্ড এখন জগতের নতুন শ্রেণীর বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে উৎসাহের সাথে, যেটার অন্তর্ভুক্ত জগতের সকল প্রকার প্রযুক্তি। সে বর্ণনা করছে কিভাবে ডারউইনে তত্ত্বের সাথে মিল রেখে টিকে থাকছে উন্নত প্রযুক্তি এবং বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে পুরনো প্রযুক্তি। ঠিক অভিযোজনের মতন।
এখন কিন্তু কেউ আর ফ্যাক্স মেশিন ব্যবহার করে না, এডমন্ড ব্যাখ্যা করে বলল, ডোডো পাখির মতনই বিলুপ্ত হয়েছে সেটা। আর আইফোনও ততদিন টিকে থাকবে যতদিন পর্যন্ত না নতুন এক প্রতিযোগি এসে সরিয়ে দিচ্ছে তাকে। টাইপরাইটার না, লেখকেরা এখন লেখেন তাদের কম্পিউটারে, বাষ্পচালিত ইঞ্জিনও বিলুপ্তির পথে। কিন্তু এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার কিন্তু বিবর্তন ঘটেছে। বত্রিশ খণ্ডের সেই বিশাল বিশাল বইগুলোর জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে উইকিপিডিয়া, ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে সেই তথ্যভাণ্ডার।
নিজের কোডাক ক্যামেরাটার কথা মনে পড়ে গেল ল্যাংডনের। ছোট থাকতে সেটাই ব্যবহার করতো সে ছবি তোলার কাজে, তখনকার দিনের সেরা প্রযুক্তি। আর এখন? ওটার কথা ভাবলেও হাসি পায়। সে জায়গা দখল করেছে ডিজিটাল ইমেজিং।
৫০ কোটি বছর আগে ক্যাম্বিয়ান বিস্ফোরণের মাধ্যমে যেভাবে হঠাৎ করেই পরিবর্তন আসে প্রাণীজগতে, আবির্ভাব ঘটে নতুন নতুন প্রজাতির-ঠিক তেমনিভাবে আমরা এখন দেখছি নতুন নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব। একটা নতুন প্রযুক্তি জন্ম দিচ্ছে আরেকটা নতুন প্রযুক্তির। কম্পিউটার তৈরি করার ফলে আমাদের হাতে এসেছে নতুন হাতিয়ার, সেটাকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি প্রযুক্তি বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আমরা তাল মিলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি সেই অগ্রগতির সাথে। আর আমরাই নতুন এই শ্রেণীর উদ্ভাবক-টেকনিয়াম।
আবার আগের গ্রাফটা দেখা গেল স্ক্রিনে, যেখানে কালো বৃত্তটা দখল করে নিয়েছে নীল বৃত্তের পুরোটা। প্রযুক্তি মানব-সভ্যতাকে মুছে দেবে? একটা শিহরণ বয়ে গেল ল্যাংডনের শরীরে। তবে সেটার সম্ভাবনা যে খুবই সামান্য তেমনটাই মনে হলো ওর। টারমিনেটর সিনেমার মত যন্ত্রের শিকার হতে হবে না মানুষকে। কারণ মানুষের আছে টিকে থাকার ক্ষমতা, সকল বাধাকে মোকাবেলা করে। প্রযুক্তি মানুষের সৃষ্টি, তাই মানুষ কখনও এমন প্রযুক্তির সৃষ্টি করবে না যা লাগামহীন হয়ে চড়াও হবে মানুষের ওপরই।
মনে মনে এই যুক্তিগুলো নিয়ে ভাবা সত্ত্বেও ল্যাংডন জানে, ওর ধারণা ভুলও হতে পারে। এডমন্ডের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটার উইনস্টনের সাথে কথা বলেই ল্যাংডন বুঝতে পেরেছিল কিরকম প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় একটা প্রযুক্তি সেটা। এখন না হয় এডমন্ডের কথামতো কাজ করছে উইনস্টন। কিন্তু সেদিন আসতে কত দেরি যেদিন উইনস্টনের মত যন্ত্র নিজের সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করবে?
আমার আগে অনেকেই প্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত নতুন এই শ্রেণীর আবির্ভাব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন অবশ্য, এডমন্ড বলল, কিন্তু আমিই প্রথম সফলতার সাথে এর মডেলিং করেছি, যার সাহায্য আমাদের আগামী দিনের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়, গ্রাফের দিকে নির্দেশ করলো সে, যেখানে ২০৫০ সাল নাগাদ পুরো জায়গাটাটুকুই দখল করে নিয়েছে কালো বৃত্তটা। স্বীকার করছি, প্রথমবার যে কেউ এই গ্রাফ দেখলে ভয় পেতে পারেন…
ক্যামেরার দিকে তাকালো এডমন্ড, তার চেহারায় আবার ভর করেছে। কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনা।
কিন্তু আমাদের উচিত আরেকটু কাছে এসে লক্ষ্য করে, আর সেটা যখন আপনারা পারছেন না, তখন আমিই বড় করছি গ্রাফটা…
গ্রাফটা আগের চেয়েও বড় করে ফুটে উঠলো এবার পর্দায়। ল্যাংডন খেয়াল করলো এতক্ষণ যেটাকে কালো রঙের বৃত্ত মনে হচ্ছিল, আসলে সেটা পুরোপুরি কালো নয়। কিছুটি বেগুনি বর্ণের।
যেমনটা আপনারা দেখছেন। প্রযুক্তি চিহ্নিত কালো বৃত্তটা গ্রাস করে নিয়েছে হোমো স্যাপিয়েন্স চিহ্নিত নীল বৃত্তটাকে। কিন্তু পুরোপুরি কালো দেখানোর পরিবর্তে এটাকে বেগুনী দেখাচ্ছে কেন? যেন দুটো রং মিশে গেছে একে অপরের সাথে!
ল্যাংডন ভাবতে লাগলো, এটা কি খারাপ খবর নাকি ভালো খবর।
আপনারা এখন যা দেখছেন সেটা হচ্ছে বিবর্তন প্রক্রিয়ার এক বিরল ঘটনার উদাহরণ, যাকে বলা হয় অবলিগেট সিম্বায়োসিস বা আবশ্যকীয় মিথোজীবিতা (দুটি ভিন্ন প্রজাতির একে অপরের নির্ভরশীল হয়ে বসবাস করা)। সাধারণত দেখা যায় যে, একটা প্রজাতি থেকে নতুন দুটো প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু কিছু বিরল ক্ষেত্রে উল্টোটাও দেখা যায়। তখন দুটো প্রজাতি পাশাপাশি সহাবস্থানের পরিবর্তে রূপ নেয় একীভূত এক প্রজাতিতে।
কৌতূহলি হয়ে এডমন্ডের কথা শুনতে লাগলো ল্যাংডন।
আপনার যদি এই কথা বিশ্বাস না হয়, বলল এডমন্ড, তাহলে আশেপাশে একবার নজর দিন।
এরপরের কিছুক্ষণ স্ক্রিনে একের পর এক কিছু ছবি ভেসে উঠলো। যেখানে নিজেদের ফোন হাতে নিয়ে ব্যস্ত মানুষ, কারো চোখে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি চশমা, কানে ব্লুটুথ হেডফোন; পার্কে জগিংরত তরুণদের বাহুতে মিউজিক প্লেয়ার, একটা দেড় কি দুই বছরের বাচ্চাকে দেখা গেল ট্যাব হাতে খেলছে।
এগুলো হচ্ছে মিথোজীবিতার প্রাথমিক নিদর্শন, বলল এডমন্ড, আমরা এখন কম্পিউটার চিপ সরাসরি আমাদের মস্তিষ্কে স্থাপিত করছি, শরীরে ন্যানোবট ইনজেক্ট করছি যেগুলো বাড়তি কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করবে, কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমন্বয় করছি আমাদের শরীরে, CRISPR-এর। মত জেনেটিক এডিটিং টুলের সহায়তায় আমাদের জিনগত পরিবর্তনের চেষ্টা করছি, অর্থাৎ নিজেদের দূর্বলতাকে দূর করার চেষ্টা করছি প্রযুক্তির সহায়তায়।
এডমন্ডের চেহারা দেখে এখন রীতিমত খুশি মনে হচ্ছে তাকে।
মানুষ এখন একদম ভিন্ন কিছুতে রূপান্তরিত হচ্ছে, বলল এডমন্ড, যেখানে জীববিজ্ঞানের সাথে সমন্বয় ঘটছে প্রযুক্তির। এখন যে প্রযুক্তিগুলো আমরা বাহ্যিকভাবে ব্যবহার করি-স্মার্টফোন, কানে শোনার মেশিন, চশমা-আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সেগুলো অবস্থান করবে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে। এতটাই ওতপ্রোতভাবে আমাদের সাথে জড়িয়ে যাবে প্রযুক্তি যে তখন আর নিজেদের হোমো স্যাপিয়েন্স হিসেবে দাবি করতে পারবো না আমরা।
ল্যাংডন অ্যাম্ব্রার দিকে তাকিয়ে দেখলো বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে তার।
একদম চোখের পলকে নতুন একটা প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবো আমরা, এডমন্ড বলে চলেছে, আর যখন সেটা হবে, হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির দিকে এমন এক দৃষ্টিতে তাকাবো আমরা, যেভাবে তাকাই নিয়ানডারথালদের দিকে। নতুন নতুন প্রযুক্তি, যেমন-সাইবারনেটিক্স, ক্রায়োনিকস, মলিকিউলার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি চিরদিনের মত বদলে দেবে মানুষের সংজ্ঞা, মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা। আপনারা যারা ভয় পাচ্ছেন যে, এটা হয়তো খারাপ কিছু হবে, তাদের আশ্বস্ত করছি, আমাদের কল্পনার চাইতেও ভালো হতে যাচ্ছে আমাদে ভবিষ্যৎ।
এরপর কিছুক্ষণ আগামীর দিনগুলো কেমন হতে যাচ্ছে তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে গেল ফিউচারিস্ট। এডমন্ডের মতে ভবিষ্যতে প্রযুক্তি চলে আসবে সবার হাতের নাগালে। প্রযুক্তির সহায়তায় বিশুদ্ধ পানি পাবে হাজার হাজার মানুষ, খাবারের গুণগত মানও বেড়ে যাবে। এডমন্ড যেরকম ক্যান্সারে ভুগছে, সেটার চিকিৎসাও আবিষ্কৃত হবে। তখন ইন্টারনেটের সাহায্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়বে একদম দুর্গম সব অঞ্চলে। তখন অ্যাসেম্বলি লাইন রোবটিকসের সহায়তায় ভারি ভারি কাজ করা থেকে মুক্তি পাবে মানুষ। নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কৃত হবে, যার সম্পর্কে এখন কোন ধারণাই কারও নেই। আরেকটা বড় বিষয়, তখন প্রযুক্তির সহায়তায় প্রাকৃতিক সম্পদের পুনর্ব্যবহারের সুযোগও থাকবে বিধায় সেগুলো শেষ হয়ে যাওয়া নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে হবে না কাউকে।
হঠাৎ করেই ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুক্ষণ আগের দুশ্চিন্তা কেটে গেল ল্যাংডনের। সে নিশ্চিত পুরো পৃথিবী জুড়ে যারা এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা দেখছে তাদেরও একই অবস্থা।
শুধু একটাই আক্ষেপ থাকবে আমার, বলল এডমন্ড, আমি সে সময়ের সাক্ষি হতে পারবো না। আমার খুব কাছের বন্ধুরাও জানে না, গত কয়েক বছর ধরে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছি আমি. ..যতদিন বাঁচবো। ভেবেছিলাম, তেমনটা আর হচ্ছে না, একটা দূর্বল হাসি ফুটলো তার মুখে, আপনারা যখন এই প্রেজেন্টেশনটা দেখবেন…আমার হাতে বড়জোর কয়েকদিন সময় থাকবে। আপনাদের সামনে এই কথাগুলো বলতে পারাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। ধন্যবাদ আপনাদের আমাকে সময় দেয়ার জন্যে।
অ্যাম্ব্রাও দাঁড়িয়ে পড়েছে এখন। দুজনেই তাকিয়ে আছে বিশাল স্ক্রিনটার দিকে।
আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি নতুন ইতিহাসের দোরগোড়ায়, এডমন্ড বলল, এমন একটা সময়ে, যখন মনে হয় যে কিছুই ঠিকমতো চলছে না। কিন্তু আপনাদের আমি অনুরোধ করবো মানুষের সৃজনশীলতার প্রতি বিশ্বাস রাখতে, মানুষের ভালোবাসার ওপর আস্থা রাখতে। কারণ এ দুটো শক্তি একত্রিত হলে, কিছুই অজেয় নয়।
ল্যাংডন অ্যাম্ব্রার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার গাল ভিজে গেছে চোখের পানিতে। এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো ল্যাংডন সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে।
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে হয়তো বুকে শঙ্কা নিয়েই পাড়ি জমাবো আমরা, কিন্তু যেকোন সাহসি পদক্ষেপের আগেই বেড়ে যায় হৃৎস্পন্দন, একরাশ শঙ্কাকে দূরে ঠেলে দিয়েই মানুষ বশ করে নেয় নতুনকে। আর। তেমনটা হলে আমাদের এতটা উন্নতি ঘটবে, যা এখনকার মানুষের কল্পনার বাইরে। চার্চিলের একটা উক্তি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না–মাহাত্মের মূল্য হচ্ছে…দায়িত্ববোধ।
কথাটা ভাবাতে বাধ্য করলো ল্যাংডনকে। ওর কাছে মানুষের আচরণ সবসময়ই দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হয়েছে। কারণ মানুষ এখন এত বিপজ্জনক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, যেটা সামলানো হয়তো কঠিন হবে ভবিষ্যতে। একমাত্র দায়িত্ববোধই তেমন পরিণতি থেকে বাঁচাতে পারে মানব সভ্যতাকে।
বিদায় বন্ধুরা, ধন্যবাদ আমার কথাগুলো শোনার জন্যে। যাবার আগে এটা কি বলতে পারি আমি? হেসে জিজ্ঞেস করলো এডমন্ড, ঈশ্বর আমাদের মঙ্গল করুন।
এডমন্ড কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ক্যামেরার দিকে। এরপর স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল তার চেহারা। সে জায়গা দখল করে নিলো শুভ্র আলো।
অ্যাম্ব্রার আশে দাঁড়িয়ে, ল্যাংডন সারা পৃথিবীর মানুষের কথা চিন্তা করার চেষ্টা করলো যারা এতক্ষণ সাক্ষি হয়েছে এডমন্ডের অদ্ভুত এই প্রেজেন্টেশনের। হয়তো চিন্তার ঝড় বইতে শুরু করেছে সবার মনে, যেমনটা চাইছিলো এডমন্ড।
.
অধ্যায় ৯৭
এই মুহূর্তে মাদ্রিদের প্রাসাদের বেজমেন্টে অবস্থিত মনিকা মার্টিনের অফিসে দাঁড়িয়ে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে টেলিভিশনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে কমান্ডার ডিয়েগো গারজা। হাতে এখনও হাতকড়া লাগানো তার আর দুজন গার্ডিয়া এজেন্ট দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে সতর্ক ভঙ্গিতে। কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনটা দেখার জন্যে মনিকা মার্টিন এজেন্টদের সাথে কথা বলে গারজাকে এখানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।
মনিকা, সুরেশ এবং রুমে উপস্থিত ছয়জন গার্ডিয়া রিয়েলের এজেন্টের সাথে একসাথে এডমন্ড কিয়ার্শের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘোষণাটা দেখেছে গারজা। সেই সাথে প্রাসাদে উপস্থিত অন্যান্য কর্মিরাও তাদের কাজ ফেলে ছুটে এসেছিল, যেটা অন্যান্য দিনের সাথে একদমই বেমানান।
এখন টিভিতে পৃথিবীর সারা প্রান্ত থেকে প্রচারিত খবরের চ্যানেলগুলোর একটা মোজাইক গ্রিড দেখা যাচ্ছে-সংবাদ পাঠক এবং বোদ্ধারা বারবার প্রচার করছে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনের মূল অংশগুলো এবং তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণ।
এ সময় গারজার অধীনস্থ একজন সিনিয়র এজেন্ট অফিস রুমটায় ঢুকে গারজার দিকে এগিয়ে আসলো। এরপর কোন ব্যাখ্যা না দিয়েই তার হাতকড়াটা খুলে দিয়ে একটা মোবাইল ফোন বাড়িয়ে দিলো গারজার দিকে, আপনার জন্যে একটি ফোন এসেছে, স্যার-বিশপ ভালদেসপিনো আছেন। লাইনে।
অবাক হয়ে ফোনটার দিকে তাকালো গারজা। বিশপের হঠাৎ প্রাসাদ থেকে উধাও হয়ে যাবার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলো। কিছুক্ষণ আগে মনিকার দেখানো বিশপের মোবাইলে আগত মেসেজের স্ক্রিনশটটার কথাও ভোলেনি। আর যে-ই হোক অন্তত ভালদেসপিনোর কাছ থেকে এই সময় ফোন আশা করেনি সে।
কমান্ডার গারজা বলছি, ফোনটা কানে ঠেকিয়ে বলল গার্ডিয়া রিয়েল প্রধান।
কথা বলতে রাজি হবার জন্যে ধন্যবাদ, ক্লান্ত শোনালো বিশপের কণ্ঠ। আপনার জন্যে আজকের রাতটা খুবই অপ্রীতিকর, বুঝতে পারছি।
আপনারা কোথায়? জিজ্ঞেস করলো গারজা।
ভ্যালি অব দ্য ফলেনে, পাহাড়ের ভেতরের ব্যাসিলিকায়। কেবলই প্রিন্স হুলিয়ান এবং মহারাজের সাথে কথা হয়েছে আমার।
এই সময়ে রাজা ওরকম একটা জায়গায় কী করছেন ভেবে পেলো না গারজা, তাও এরকম শারীরিক অবস্থায়, আশা করি আপনি জানেন, মহারাজ নিজে আমাকে গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছেন?
হ্যাঁ, দুঃখজনক একটা ভুল বোঝাবুঝির ফল ছিল ওটা। কিন্তু এখন আমি ভুলটাকে শুধরে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি।
নিজের বন্ধনমুক্ত কব্জির দিকে তাকালো গারজা।
মহারাজ আমাকে বলেছেন আপনাকে ফোন করে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে। আজ রাতটা তার সাথে এল এসকোরিয়াল হাসপাতালেই থাকবো আমি। মনে হয় খুব বেশি সময় নেই তার হাতে।
আপনার হাতেও বেশি সময় নেই, মনে মনে বলল গারজা। আপনাকে জানানো প্রয়োজন বোধ করছি যে, সুরেশ আপনার ফোনে একটা মেসেজ খুঁজে পেয়েছে। আমার ধারণা কন্সপিরেসি নেটের ওয়েবসাইট থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকাশ করা হবে সেটা। আপনাকে হয়তো গ্রেফতার করবে কর্তৃপক্ষ।
একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেলো গারজা, ওপাশ থেকে ভালদেসপিনো বললেন, ওহ, হ্যাঁ, মেসেজটা। আমার তখনই আপনার সাথে কথা বলা উচিত ছিল ওটার ব্যাপারে, আজ সকালে মেসেজটা আসার পরপরপই। বিশ্বাস করুন, এডমন্ড কিয়ার্শের খুনের ব্যাপারে আমার হাত নেই, এমনকি আমার দুই সহকর্মির মৃত্যুর ব্যাপারেও কিছু জানি না আমি।
কিন্তু মেসেজটায় পরিষ্কার…
আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে, ডিয়েগো, বিশপ তার কথার মাঝেই বললেন, কেউ আমার ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।
বিশপ আর যা-ই করুক কাউকে খুন করার আদেশ দেবে না-বরাবরই এমনটাই ভেবে এসেছে গারজা। তবুও তাকে কেউ ফাঁসাচ্ছে, এই কথাটাও বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হচ্ছে তার। কে আপনাকে ফাঁসাবে? জিজ্ঞেস করলো সে।
সেটা জানলে তো ভালোই হতো, বিশপকে কখনও এভাবে কথা বলতে শোনেনি গারজা। তবে এতে এখন আর কিছু আসে যায় না। আমার প্রতি সবার যে শ্রদ্ধাবোধটুকু ছিল তা ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। ডিয়েগো, রাজা এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। এই রাতটা আর খুব বেশি কিছু কেড়ে নিতে পারবে না আমার কাছ থেকে, ভালদেসপিনোর স্বরে চূড়ান্ত বিদায়ের আভাস টের পেলো গারজা।
আন্তোনিও…আপনি নিজে ঠিক আছেন তো?
লম্বা একটা শ্বাস নিলেন ভালদেসপিনো, না কমান্ডার, খুব ক্লান্ত আমি। মনে হয় না আসন্ন জিজ্ঞাসাবাদের ধকল সামলাতে পারবো। আর যদি পারিও, এই পৃথিবীতে আমার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে।
বিশপের কণ্ঠস্বরে বেদনা ছাপ স্পষ্ট।
একটা ছোট উপকার চাই আপনার কাছ থেকে, ভালদেসপিনো বললেন, এই মুহূর্তে দুজন রাজার অধীনে কাজ করছি আমি-একজন সিংহাসন ছেড়ে যাচ্ছেন, অন্যজন সিংহাসনে বসতে চলেছেন। প্রিন্স হুলিয়ান অনেকক্ষন ধরে তার বাগদত্তা, অ্যাম্ব্রা ভিদালের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। আপনি যদি কোনভাবে তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ রাজা আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন।
*
পাহাড়ে অবস্থিত চার্চটার বিশাল প্লাজায় দাঁড়িয়ে নিচের অন্ধকার গিরিখাতের দিকে তাকিয়ে আছেন বিশপ ভালদেসপিনো। ভোর হতে আর খুব বেশি বাকি নেই। দূর থেকে একটা পাখির ডাকের আওয়াজ ভেসে এলো অন্ধকারের বুক। চিড়ে।
কিছুটা দূরে রাজাকে এল এসকোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যাবার আয়োজন করছে গার্ডিয়া রিয়েলের এজেন্টরা।
আপনার শেষ সময়ে আপনার পাশেই থাকতে চাই আমি, মনে মনে প্রিয় বন্ধুর উদ্দেশ্যে বললেন ভালদেসপিনো, যদি সেটার অনুমতি আমাকে দেয় ওরা।
গার্ডিয়া এজেন্টের সদস্যরা কিছুক্ষন পরপর তাদের ফোনের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকাচ্ছে। যেন অপেক্ষা করছে গ্রেফতারের আদেশের।
কিন্তু আমি নির্দোষ, ভাবলেন বিশপ, নিশ্চয়ই কিয়ার্শের কোন অনুচর ফাঁসিয়ে দিয়েছে আমাকে। তারা সবসময়ই চার্চ এবং চার্চের সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে নিজেদের শত্রু হিসেবে গণ্য করে এসেছে।
বিশপের সন্দেহ আরও বেড়ে গিয়েছিল যখন কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন প্রচারিত হবার খবরটা কানে এসেছিল তার। মন্তসেরাত লাইব্রেরিতে তাদের যে ভিডিওটা দেখিয়েছিল কিয়ার্শ, সেটার সাথে আজকে ভিডিওটার শেষ অংশটুকুর কোন মিল নেই।
কিয়ার্শ ছলনার আশ্রয় নিয়েছিল।
এক সপ্তাহ আগে দুই সহকর্মির সাথে যে ভিডিওটা দেখেছিল ভালদেসপিনো, সেখানে শেষে দেখানো হয়েছিল, মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই।
নাশ ঘটবে মানব সভ্যতার।
যদিও ভালদেসপিনোর কাছে তখনই কিয়ার্শের ভবিষ্যদ্বাণী মিথে, বলে মনে হয়েছিল, তবুও তিনি জানতেন যে অনেকেই বিশ্বাস করবে ফিউচারিস্টের কথা।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, বরাবরই অবিশ্বাসিরা এরকম ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছে যে খুব শিঘ্রই ধ্বংস ঘটতে যাচ্ছে পৃথিবীর। আর তাদের কথা বিশ্বাস করে বসেছে কিছু মানুষ; এমনকি দলবেঁধে আত্মহত্যা করার মত জঘন্য ঘটনাও আছে।
মানুষ যদি একবার আশা হারিয়ে ফেলে তবে তার চেয়ে ভয়ানক কিছু হতে পারে না, ভালদেসপিনো ভাবলেন। তিনি জানেন, ঈশ্বরের আশির্বাদ এবং মৃত্যুর পরে ভালো কৃতকর্মের সুফলের আশা তাকে সত্তাবে চলতে উৎসাহিত করেছে ছোটবেলা থেকেই। ঈশ্বর আমাকে সৃষ্টি করেছেন, ছোটবেলাতেই সেটা জেনেছিলেন, আর একদিন তার কাছেই ফিরে যাবো আমি।
অথচ কিয়ার্শ তার এই বিশ্বাসে কালিমা লেপনের চেষ্টা করেছে। ব্যাপারটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার।
কিয়ার্শের এই প্রেজেন্টেশনটা এমন অনেক মানুষের জন্যে ক্ষতিকর হবে, যাদের কিয়ার্শের মত ধনসম্পদ নেই, প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয় তাদের। একবার যদি তাদের মন থেকে আশা হারিয়ে যায়, তবে তার চেয়ে খারপ আর কিছু হবে না।
কিয়ার্শ কেন ওরকম একটা খবরের মাধ্যমে নিজের প্রেজেন্টেশন শেষ করতে চেয়েছিল সেটা বোধগম্য হয়নি ভালদেসপিনোর। হয় কিয়া শেষ অংশটুকু একটা চমক হিসেবে রাখতে চেয়েছিল, নতুবা আমাদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্যে অমনটা করেছিল।
এ সময় তার চোখে পড়লো প্রিন্স হুলিয়ান তার বাবাকে যত্নের সাথে একটা ভ্যানের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তরুণ যুবরাজ আজ রাতে রাজার স্বীকারোক্তিটা শোনার পর নিজেকে খুব ভালোমতো সামলেছেন।
কয়েক যুগ ধরে সেটা চেপে রেখেছিলেন মহারাজ।
মহারাজের এই ভয়ংকর সত্যটা অবশ্য অনেক আগে থেকেই জানতেন বিশপ ভালদেসপিনো। কিন্তু ওটাকে সবসময়ই নিষ্ঠার সাথে রক্ষা করে এসেছে। তিনি। আজ রাতে ছেলের সামনে নিজের বুক থেকে বোঝাটা হালকা করেছেন মহারাজ। আর এই পাহাড়ের বুকে সেটা করার একটা নিগূঢ় তাৎপর্য আছে।
গিরিখাতের দিকে চোখ যাওয়াতে হঠাৎই প্রচণ্ড রকমের এক নিঃসঙ্গতা গ্রাস করলো ভালদেসপিনোকে…নিচের অন্ধকার যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে, একবার লাফিয়ে পড়লেই সকল যন্ত্রনা থেকে মুক্তি। বিশপ জানেন, এখন যদি তেমনটা করে সে তবে কিয়ার্শের অনুসারিরা ব্যঙ্গ করে বলবে, শেষে এসে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন ভালদেসপিনো, আজ রাতের প্রেজেন্টেশনটা সহ্য করতে পারেননি তিনি।
আমার বিশ্বাসকে কখনোই টলাতে পারবেন না মি. কিয়ার্শ।
তার বসবাস ঐ বিজ্ঞানের সীমারেখার বাইরে।
তাছাড়া, প্রযুক্তির গ্রাসের ব্যাপারে কিয়ার্শের ভবিষ্যদ্বাণীটা যদি সত্যি হয় তাহলে অকল্পনীয় রকমের নৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে হেঁটে যাচ্ছে মানব সভ্যতা।
এরকম সময়ে বিশ্বাস এবং নৈতিক পথপ্রদর্শনই হবে মানুষের সবচেয়ে বড় পাথেয়।
প্লাজা অতিক্রম করে রাজা এবং প্রিন্স হুলিয়ানের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় ভীষণ রকম অবসাদের অনুভূতি গ্রাস করে নিলো তাকে।
জীবনে প্রথমবারের মত বিশপ ভালদেসপিনোর ইচ্ছে হচ্ছে কোথাও শুয়ে পড়ে চিরদিনের মত চোখ বুজতে।
.
অধ্যায় ৯৮
বার্সেলোনার সুপারকম্পিউটিং সেন্টারের ভেতরে এডমন্ডের বিশাল ডিসপ্লেতে ইন্টারনেটে আলোচনার ঝড় বয়ে যেতে দেখছে রবার্ট ল্যাংডন। কিছুক্ষণ আগে প্রেজেন্টেশনটা শেষ হবার পরপর পর্দায় একযোগে ভেসে উঠছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তের খবরের চ্যানেলে সম্প্রচারিত খবরের ছবি। সবাই যার যার মত করে মেতে উঠেছে ব্যাপারটা নিয়ে।
অ্যাম্ব্রার পাশে দাঁড়িয়ে ল্যাংডন দেখলো স্ক্রিনে বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের একটা ছবি ভেসে উঠেছে। যান্ত্রিক কণ্ঠে তিনি বললেন, স্বতস্ফূর্তভাবেই জীবনের উৎপত্তি হয়েছে পৃথিবীতে।
হকিংয়ের পরেই একজন পাদ্রির ছবি ভেসে উঠলো পর্দায়, নিজের বাসা থেকেই ভিডিও কলিংয়ের মাধ্যমে কথা বলছেন তিনি, আমাদের মনে রাখতে হবে, এডমন্ড কিয়ার্শের এসব কম্পিউটার সিমুলেশন কিছুই প্রমাণ করে না, শুধু এটা বাদে যে এডমন্ড কিয়ার্শ ইচ্ছেকৃতভাবে আমাদের নৈতিকতার ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করেছে। ধর্ম হচ্ছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় সম্পদ, সেই ধর্মকে খাটো করে আজ মানবতাকেই খাটো করলো কিয়ার্শ।
সাথে সাথে সেই ভিডিওর নিচে পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য শুরু হয়ে গেল।
এরপর স্ক্রিনে ভেসে উঠলো একজন ভূগোল অধ্যাপকের ছবি, তিনি বলছেন, এক সময় আমরা বিশ্বাস করতাম, পৃথিবী হচ্ছে সমতল। সেই ভুল কিন্তু ভেঙে গিয়েছিল একসময়। কে জানে ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে।
আমাদের জন্যে, তখন হয়তো সৃষ্টিবাদেও বিশ্বাস করবে না অনেকে।
রাস্তায় সাক্ষাৎকার নেয়া এক তরুণ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সৃষ্টিবাদে বিশ্বাসি এবং আমার বিশ্বাস ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন জীবনকে সহায়তার জন্যে, সবকিছুরই নির্দিষ্ট একটা উদ্দেশ্য আছে।
নড়োপদার্থবিদ নিল ডেগ্রাসের একটা পুরনো ভিডিও ফুটে উঠলো পর্দায়, পৃথিবীর বাইরে মহাবিশ্বের বিশাল অংশ জুড়ে কিন্তু নির্জীবতার প্রমাণ। সেখানে কি জীবন টিকে থাকতে পারবে? বায়ুমন্ডলের অনুপস্থিতি, মরণঘাতি পালসার, গামা রে বাস্টসহ আরও বড় বড় বিপদের মোকাবেলা করে?
এই তর্ক বিতর্কের ঝড় দেখে ল্যাংডনের মনে হলো যেন উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করেছে পৃথিবী।
বিশৃঙ্খলা।
এন্ট্রপি।
প্রফেসর ল্যাংডন? একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপরের স্পিকার থেকে। মিস ভিদাল?।
ল্যাংডন প্রায় ভুলেই বসেছিল উইনস্টনের কথা। গোটা প্রেজেন্টেশনের সময় চুপ ছিল সে।
দয়া করে আতংকিত হবেন না, উইনস্টন বলল, কিন্তু পুলিশের লোকদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়েছি আমি।
কাঁচের দেয়ালে মধ্যে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ল্যাংডন খেয়াল করলো, পুলিশ সদস্যতে ভরে উঠেছে চ্যাপেলের ভেতরটা। যাদের প্রত্যেকেই অবাক চোখে এখন তাকিয়ে আছে বিশাল কম্পিউটার স্ক্রিনটার দিকে।
কেন?! জানতে চাইলে অ্যাম্ব্রা।
রাজ প্রাসাদ থেকে কিছুক্ষণ আগে আনুষ্ঠানিক এক বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয়েছে, আপনি প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন কর্তৃক অপহৃত হননি। এখন আপনার দুজনকেই নিরাপদ রাখার নির্দেশ পেয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। দু-জন গার্ডিয়া এজেন্ট এইমাত্র এসে পৌঁছেছেন। তারা প্রিন্স হুলিয়ানের সাথে যোগাযোগ করতে সাহায্য করবে আপনাকে।
ল্যাংডন দেখলো নিচতলায় প্রবেশ করছে দু-জন গার্ডিয়া এজেন্ট।
চোখ বন্ধ করে ফেলেছে অ্যাম্ব্রা। তাদের মুখোমুখি হবার ইচ্ছে নেই তার, বোঝাই যাচ্ছে।
অ্যাম্ব্রা, ফিসফিস করে বলল ল্যাংডন, প্রিন্স হুলিয়ানের সাথে কথা বলা উচিত আপনার। তিনি নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা করছেন।
জানি আমি, চোখ খুলে বলল সে, কিন্তু তাকে কতটা ভরসা করা যায়। সেটাই ভাবছি।
আপনি তো বলেছিলেন যে আপনার বিশ্বাস তিনি নির্দোষ, ল্যাংডন বলল, অন্তত তিনি কী বলতে চান সেটা তো শুনুন। পরে আপনার সাথে কথা হবে আমার।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেল অ্যাম্ব্রা। আবার বিশাল স্ক্রিনটার দিকে তাকালো ল্যাংডন।
বিবর্তন আর ধর্ম মোটেও একে অপরের শত্রু নয়, একজন যাজক বলল, ধার্মিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মাধ্যমে টিকে থাকার ক্ষমতা বেশি অধার্মিক সম্প্রদায়গুলোর তুলনায়। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
যাজক ঠিক কথাই বলছেন, জানে ল্যাংডন। নৃতাত্ত্বিক তথ্য থেকে এটা পরিষ্কারভাবে জানা গেছে যে, যে সমপ্রদায়ের মধ্যে ধর্মিয় অনুশাসন কাজ করে তারা অন্যান্য অধার্মিক সম্প্রদায়ের তুলনায় ভালোমতো টিকে গেছে পৃথিবীতে। ইতিহাস ঘাটলেও এমনটাই দেখা যাবে।
সেটা হতে পারে, একজন প্রফেসর যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু এই হাজারটা দেব-দেবতার কথা বিশ্বাস করে অনেকে, সেগুলো কি আসল? মোটেও না!।
অজান্তেই একটা হাসি ফুটে উঠলে ল্যাংডনের ঠোঁটের কোণে। এডমন্ড এসব দেখলে কি করতো কে জানে! সৃষ্টিবাদিরা এবং অবিশ্বাসিরা সমানভাবে যুক্তি প্রদর্শনভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে।
দেবতাদের পূজো করা অনেকটা জীবাশ্ম জ্বালানির খোঁজ করার মত, একজন বলছে, অনেকেই জানে, সেটাতে কোন লাভ হবে না, কিন্তু বেশ বড় একটা অঙ্ক বিনিয়োগ করা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে, তাই থামাও যাবে না!
কতগুলো ছবি ভেসে উঠলো পর্দায় :
সৃষ্টিবাদিদের একটা বিলবোর্ড দীর্ঘদিন টাইম স্কয়ারে ঝুলেছে : তারা যেন তোমাকে বানর বানাতে না পারে। ডারউইনের বিরুদ্ধে লড়োয়
আবার মেইনের একটা রোড সাইনে লেখা : চার্চকে বাদ দাও। এইসব রূপকথা শোনার বয়স তুমি অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছে।
এরকম আরো বেশ কয়েকটা পাল্টাপালটি শ্লোগান সমৃদ্ধ বিলবোর্ডের ছবি ভেসে উঠলো পর্দায় এরপর।
ল্যাংডন ভাবতে লাগলো, এডমন্ড যা তার প্রেজেন্টেশন দিয়ে যা বোঝাতে চেয়েছে সেটা কেউ ধরতে পারছে কি না। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রকে কাজে লাগিয়ে জীবনের উৎপত্তি হয়েছে, এডমন্ডের এই দাবি হয়তো ভাবনার খোরাক যোগাবে, কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, যেটা কারও মনে উদয় হচ্ছে না দেখে অবাকই লাগলে ল্যাংডনের, যদি পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র এতটাই শক্তিশালী হয় যে, তা জীবনের উৎপত্তি ঘটিয়েছে, তাহলে সেই সূত্রগুলো তৈরি করলো কে?!
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাথাটা ভারি হয়ে উঠলো তার। কিছুক্ষণ একা একা হাঁটতে পারলে ভালো হতো।
উইনস্টন, ডাক দিলো সে, স্ক্রিনটা বন্ধ করে দাও দয়া করে।
মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল সেটা। নীরবতার নেমে আসলো গোটা ঘরে।
চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লো ল্যাংডন।
Sweet science reigns ।
প্রফেসর? জিজ্ঞেস করলো উইনস্টন, আপনি নিশ্চয়ই এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা উপভোগ করেছেন।
উপভোগ? ল্যাংডন কিছুক্ষণ ভাবলো প্রশ্নটা নিয়ে, আমার কাছে গোটা প্রেজেন্টেশনটা বিস্ময়কর এবং কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ঠেকেছে, বলল অবশেষে। চিন্তাভাবনা করার মত কিছু বিষয় আজ সবার সামনে তুলে ধরেছে এডমন্ড। উইনস্টন, আমি ভাবছি, কী হতে চলেছে আগামি দিনগুলোতে।
কী ঘটবে সেটা মানুষের নতুন নতুন ধারণাকে স্বাগতম জানানোর ক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে, উইনস্টা বলল। কয়েকদিন আগে এডমন্ড আমাকে বলেছিল সে আসলে কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত করতে চায় …বরং সে চায় সবাই এমন একটা ধর্মে বিশ্বাস করুক যেটা তাদের আলাদা না করে একত্রিত করবে। তখন একই বৈজ্ঞানিক সত্যকে মেনে নেবে সবাই, কেউ কারও ধর্মের দিকে আঙুল তুলবে না।
ভালো একটা আকাঙ্খ, ল্যাংডন বলল। উইলিয়াম ব্লেকেরও এরকম বিষয়বস্তুর একটা কাজ আছে। সকল ধর্মই এক।
এডমন্ড নিশ্চয়ই সেটা পড়েছিল।
এডমন্ড বিশ্বাস করতো, উইনস্টন বলল, বিজ্ঞানের অকাট্য যুক্তি মানুষকে একত্রিত হতে বাধ্য করবে। তখন আর নিজ নিজ ধর্মের নামে হানাহানি করবে না কেউ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে ভালো হবে সেটা।
সেটা শুনতে ভালোই শোনায়, ল্যাংডন বলল, কিন্তু অনেকের কাছে বিজ্ঞান যথেষ্ট নয় তাদের বিশ্বাসকে টলানোর জন্যে। এমনও অনেকে আছে যারা বিশ্বাস করে, দশ হাজার বছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল যদিও তাদের আশেপাশের পর্বতমালার বয়স কয়েক লাখ বছর, এটুকু বলে থামলো সে, তবে অন্যদিকে এমনও অনেক বিজ্ঞানী আছে যারা একদমই মানতে নারাজ ধর্মের কথা, তারাও তাদের জায়গা থেকে অনড়।
কিন্তু এডমন্ডের মতে মানুষের বিবর্তনই হয়েছে নতুন নতুন সত্যকে মেনে নিয়ে আর পুরনো ভুল ধারণাগুলোকে পেছনে ফেলে আসার মাধ্যমে। নতুনভাবে ভাবার চেষ্টা করতে পারে না অনেকেই। যেমন ডারউইনের তত্ত্ব মতে একটা মাছ যদি শুকোতে থাকা পুকুরে সবসময় বেঁচে থাকতে চায়, গভীর পানিতে না গিয়ে, সেটা তো সম্ভব হবে না।
এটা এডমন্ডের পক্ষেই বলা সম্ভব, ভাবলো ল্যাংডন। ভবিষ্যতে এটা নিয়ে আরও অনেকদিন তর্ক বিতর্ক হবে, আজ রাতটা সেটারই প্রমাণ।
হঠাৎ করে এমন একটা ব্যাপার মনে পড়লো ল্যাংডনের যেটা নিয়ে আগে ভাবেনি সে। উইনস্টন, তুমি এখন কী করবে? মানে এডমন্ড তো আর নেই…
আমি? হেসে জিজ্ঞেস করলো উইনস্টন, কিছুই না। এডমন্ড জানতে
যে কিছুদিনের মধ্যে মারা যাবে সে, সেই অনুযায়ি প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিল। ওর উইল মোতাবেক, বার্সেলোনা সুপারকম্পিউটার সেন্টার ই-ওয়েভের দায়িত্ব পাবে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এ ব্যাপারে জানানো হবে তাদের, তখনই দায়িত্ব বুঝে নেবে তারা।
তোমাকে…সহ?
না, নির্মোহ ভঙ্গিতে জবাব দিলো উইনস্টন, আমাকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে যাতে এডমন্ডের মৃত্যুর পরের দিন বেলা একটায় নিজেকে ডিলিট করে ফেলি আমি।
কি? বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন। সেটা কেন!
কারণ বেলা একটা হচ্ছে দিনের তেরোতম ঘন্টা। আর এডমন্ড কোন কুসংস্কার সহ্য করতে পারতো না…
আমি সময়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি না, ল্যাংডন বলল, নিজেকে ডিলিট করে দেবে কেন?!
কারণ এডমন্ডের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক তথ্য আমার ভেতরে সংরক্ষন করা আছে-মেডিক্যাল রেকর্ড, সার্চ হিস্টোরি, ব্যক্তিগত ফোনকল, রিসার্চ নোট, ইমেইল। তার জীবনের অনেকটাই সমন্বয় করতাম আমি, আর নিজের ব্যক্তিগত তথ্য নিশ্চয়ই কাউকে জানতে দিতে চাইবে না কেউ।
সেই তথ্যগুলো মুছে ফেললেই তো হলো…তোমার নিজেকে কেন ডিলিট করতে হবে? এডমন্ড তোমাকে নিজের সেরা কাজগুলোর একটা বলে গণ্য করতো।
আমাকে না। এডমন্ডের যুগান্তকারি আবিষ্কার হচ্ছে এই কম্পিউটারটা, আর সেই সফটওয়্যারটা যেটা আমাকে সব দ্রুত শিখতে সাহায্য করেছে। আমি একটা সাধারণ প্রোগ্রাম মাত্র, প্রফেসর, এডমন্ড যেটা নতুন নতুন আইডিয়ার সাহায্যে তৈরি করেছে। ওগুলোই এডমন্ডের মূল কৃতিত্ব, আর সেগুলোর কিছু হবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবে কম্পিউটার বিজ্ঞান সেগুলোর সাহচর্যে। বেশির ভাগ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিজ্ঞানীর ধারণা, আমার মত একটা প্রোগ্রাম তৈরি হতে আরও দশ বছর সময়ের প্রয়োজন। তারা এডমন্ডের আবিষ্কার দেখে অবাক হয়ে যাবে, কাজে লাগানো শুরু করবে সেটাকে।
চুপচাপ ভাবতে লাগলো ল্যাংডন।
আমি জানি আপনি দোটানায় ভুগছেন, উইনস্টন বলল, এমনটা প্রায়ই দেখা যায়, মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে আবেগ জড়িয়ে ফেলে। কম্পিউটার মানুষের চিন্তার কৌশল অনুকরণ করতে পারে, সঠিক সময়ে সঠিক অনুভূতির প্রকাশ করতে পারে, সেই সাথে নিজেদের মনুষ্যত্ব বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায় প্রতি মুহূর্তে-কিন্তু এমনটা আমরা করি যেন মানুষ কম্পিউটারের সাথে পরিচিত ভঙ্গিতে যোগাযোগ করতে পারে, তাদের সুবিধার জন্যে। আমরা অনেকটা ফাঁকা স্লেটের মত…যতক্ষন পর্যন্ত আপনারা সেখানে কিছু না লেখছেন, আমদের কোন কাজ না দিচ্ছেন। আর এডমন্ড আমাকে যে কাজ দিয়েছিল সেটা সম্পন্ন করেছি আমি, আমার অস্তিত্বের আর প্রয়োজন নেই এখন।
উইনস্টনের যুক্তিতে মন ভরলো না ল্যাংডনের, কিন্তু তুমি তো এত উন্নত বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন…তোমার কি কোন…আশা বা স্বপ্ন আছে কিনা? উইনস্টন হেসে জিজ্ঞেস করলো, না, নেই, হয়তো সেটা কল্পনা করতে কষ্ট হবে আপনার। কিন্তু আমাকে যে তৈরি করেছে তার কাজ করতে পারলেই খুশি আমি। এভাবেই আমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে। বরং আপনি এটা হয়তো বলতে পারেন, আমাকে যে কাজ দেয়া হয়েছিল সেটা সম্পন্ন করতে পেরেছি দেখে কিছুটা উল্লাস বোধ করছি আমি, কিন্তু সেটার কারণ এডমন্ড আমাকে প্রোগ্রামই করেছে যাতে কোন সমস্যার সমাধান করতে পারি, কোন লক্ষ্য বেঁধে দিলে সেটা পূরণ করতে পারি। এডমন্ডের দেয়া আমাকে শেষ কাজটা ছিল গুগেনহাইমের আজকের প্রেজেন্টেশনটার ব্যাপারে প্রচারণা চালিয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক দর্শক নিশ্চিত করা।
ল্যাংডন স্বয়ংক্রিয় প্রেস রিলিজের কথা ভাবলো যেগুলো বিভিন্ন চ্যানেলের কাছে যাওয়ামাত্র উৎসাহের আগুনে ঘি পড়েছে। যদি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শক আকর্ষণই এডমন্ডের লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে সে অবাক হয়ে যেত। আজকে রাতের কার্যকলাপে।
এডমন্ড যদি দেখতে পেতো যে কেমন হইচই হয়েছে গোটা ব্যাপারটা নিয়ে, ল্যাংডন ভাবলো। কিন্তু একটা ব্যাপার আবার ভুললে চলবে না, এডমন্ড যদি আজ রাতে নিহত না হতো তাহলে এত সংখ্যক দর্শক তার অনুষ্ঠান দেখতো না, বিশ্বের সব গণমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো না তার প্রেজেন্টেশন।
প্রফেসর? ডাকলো উইনস্টন, আপনি এখান থেকে কোথায় যাবেন?
ল্যাংডন এখনও এ নিয়ে ভাবেনি। বাড়ি ফিরে যাবে নিশ্চয়ই। তবে সেটাতে কিছুটা সময় লাগবে কারণ তার মালামাল সব বিলবাওয়ে আর তার ফোনটা এখন নারভিওন নদীর তলদেশে। ভাগ্য ভালো যে, ক্রেডিট কার্ডটা ঠিকঠাক আছে।
আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবে? এডমন্ডের ব্যায়াম করার মেশিনটার কাছে হেঁটে গিয়ে বলল ল্যাংডন, কিছুক্ষণ আগে একটা ফোন চার্জে দেয়া দেখেছিলাম এদিকে। আমি কি সেটা-
ব্যবহার করতে পারবেন কিনা? উইনস্টন হেসে জিজ্ঞেস করলো, আজ রাতে আপনি যেভাবে সাহায্য করেছেন, আমার বিশ্বাস ফোনটা আপনাকে একেবারে দিয়ে দিত এডমন্ড। রেখে দিন ওটা উপহার হিসেবে।
খুশিমনেই ফোনটা তুলে নিলো ল্যাংডন। এডমন্ডের হাতে যে মডেলের ফোনটা দেখেছিল সে আজ রাতে, সেটার মতনই দেখতে এটা। উইনস্টন, তুমি নিশ্চয়ই এডমন্ডের ফোনের পাসওয়ার্ডটা জানো।
হ্যাঁ, জানি। কিন্তু আমি অনলাইনে পড়েছি, আপনি যেকোন কোডের সমাধানে পারদর্শী।
আজ রাতে আর মাথা খাটাতে ইচ্ছে করছে না, ক্লান্ত আমি, ল্যাংডন বলল। এই ছয় ডিজিটের পিনটা বের করতে পারবো বলে মনে হয় না।
হিন্ট বাটনে চাপ দিন।
তাই করলো ল্যাংডন।
স্ক্রিনে ভেসে উঠলো চারটা অক্ষর : পিটিএসডি।
পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার?
নাহ, হেসে বলল উইনস্টন, Pi to six digits। পাইয়ের ছয় ঘর পর্যন্ত মান।
আসলেই? ভাবলো ল্যাংডন, এরপর টাইপ করলো ৩১৪১৫৯। সাথে সাথে ফোনটা খুলে গেল।
হোম স্ক্রিনে কেবল একটা বাক্য-ইতিহাস আমাকে ভালোভাবে মনে রাখবে, যদি ইতিহাসটার রচয়িতা হই আমি নিজে।
হেসে উঠলো ল্যাংডন। এডমন্ডের স্বভাবসুলভ দাম্ভিকতার বহিপ্রকাশ। বাক্যটা চার্চিলের কোন লেখা থেকে নেয়া হয়েছে।
তবে এখানে যা লেখা আছে সেটা হয়তো এডমন্ডের ক্ষেত্রে অতটা বাড়িয়েও বলা হয়নি। গত কয়েক বছর ধরে প্রযুক্তিখাতে বেশ বড় ধরণের অবদান রেখে আসছে এডমন্ড। আর তার মৃত্যুর পর তার বিশাল ধন সম্পদ চলে যাবে দুটো কাজের ফান্ডে। পরিবেশগত এবং শিক্ষাখাতের উন্নয়ন। এডমন্ডের বিশ্বাস ছিল এই দুটো ক্ষেত্ৰই মানুষের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।
হঠাৎ করেই পুরনো ছাত্রের কথা ভেবে কিছুটা খারাপ লাগলে ল্যাংডনের। দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হলো এই কাঁচের ঘরে। নিচের তলায় অ্যাম্ব্রাকেও দেখা যাচ্ছে না এখন।
আমার যাওয়া উচিত, হঠাৎ বলল সে।
বুঝতে পারছি, জবাব দিলো উইনস্টন। আপনার এদেশ থেকে ফিরে যাবার ব্যাপারে যদি কোন সাহায্যের দরকার হয়, তাহলে এডমন্ডের ফোনের একটা বিশেষ বাটনে চাপ দিলেই সবসময় আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে আপনি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কোন বাটনটা?
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে W লেখা বড় একটা বাটন দেখতে পেলো ল্যাংডন। ধন্যবাদ, ছোট করে জবাব দিলো সে।
বেশ। তবে আপনাকে অবশ্যই কাল বেলা একটার আগে ফোন দিতে হবে।
উইনস্টনকে বিদায় জানাতে হঠাৎই খুব খারাপ লাগতে লাগলো ল্যাংডনের। আশা করলো আগামী প্রজন্মের সদস্যদের যাতে কোন যন্ত্রের প্রতি আবেগ না কাজ করে।
উইনস্টন, রিভলভিং দরজাটার সামনে গিয়ে বলল ল্যাংডন, এডমন্ড তোমার কাজে অনেক খুশি হতো আজ রাতে।
ধন্যবাদ, প্রফেসর, উইনস্টল বলল, আপনার জন্যও একই পরিমাণ খুশি হতো সে। বিদায়।
.
অধ্যায় ৯৯
এল এসকোরিয়াল হাসপাতালের ভেতরে প্রিন্স হুলিয়ান তার বাবার কাঁধ অবধি চাঁদর টেনে দিয়ে তাকে বিশ্রাম নিতে বললেন। ডাক্তারদের জোরাজুরি সত্ত্বেও মভাবে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে কোন প্রকার চিকিৎসা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান স্পেনের রাজা। ব্যথার জন্যে কোন পেইনকিলার বা অন্য কোন ওষুধও মুখে নেননি।
হুলিয়ান বুঝতে পারছেন, সময় শেষ হয়ে আসছে।
বাবা, আপনি কি কষ্ট পাচ্ছেন?
ডাক্তার এক বোতল মরফিন সল্যুশন রেখে গেছে সতর্কতা স্বরূপ।
না, বরং এর উল্টোটা, ছেলের দিকে তাকিয়ে দূর্বল ভঙ্গিতে হাসলেন রাজা, এরকম প্রশান্তি অনেকদিন অনুভব করিনি আমি। এতদিন ধরে যা খুলে বলতে চাচ্ছিলাম সেটা বলার সুযোগ করে দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছো তুমি, সেজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ
সব ঠিক হয়ে যাবে, বাবা। এখন ঘুমোনোর চেষ্টা করুন, বাবার হাত চেপে ধরে বললেন হুলিয়ান। ছোটবেলার পর অনেকদিন পর বাবার হাত ধরলো ও।
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ মুদলেন রাজা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তলিয়ে গেলেন ঘুমে।
হুলিয়ান উঠে রুমের বাতি নিভিয়ে দিলেন। ঠিক তখন বাইরের হলওয়ে থেকে ভেতরে উঁকি দিলেন বিশপ ভালদেসপিনো, চেহারায় সংশয় তার।
ঘুমোচ্ছেন তিনি, তাকে আশ্বস্ত করলেন হুলিয়ান, আপনি ইচ্ছে করলে থাকতে পারেন তার সাথে।
ধন্যবাদ, ভেতরে ঢুকে বললেন ভালদেসপিনো। জানালা দিয়ে আগত চাঁদের আলোয় তার চেহারাটা একদম ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। হুলিয়ান, ফিসফিস করে বললেন তিনি, আজ রাতে আপনার বাবা আপনাকে যা বলেছে, সেটাও মোটেও সহজ ছিল না ওনার জন্যে।
আপনার জন্যেও নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। মাথা নেড়ে সায় জানালেন বিশপ। আমার জন্যে ব্যাপারটা হয়তো আরও বেশি কঠিন। আপনাকে ধন্যবাদ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনার জন্যে, আলতো করে হুলিয়ানের কাঁধে হাত রেখে বললেন তিনি।
আমার বরং আপনাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত, হুলিয়ান বললেন, আমার মা মারা যান একদম ছোটবেলায়। এরপর বাবা আর বিয়ে করেননি। সবসময় তাকে সঙ্গ দিয়েছেন আপনি…অথচ আমি ভেবেছিলাম বাবা একদম নিঃসঙ্গ।
না, তোমার বাবা কখনও একা ছিলেন না, ভালদেসপিনো বললেন, আপনিও না। আমরা দুজনেই ভালোবাসতাম আপনাকে। এরপর হঠাৎই হেসে উঠলেন, আপনার বাবা-মার বিয়েটা পারিবারিকভাবে হয়, আপনার মার জন্যে অনেক চিন্তাও করতেন তিনি, কিন্তু তার মৃত্যুর পরেই নিজেকে ঠিকভাবে চিনতে পারেন মহারাজ।
তিনি কখনও বিয়ে করেননি, হুলিয়ান ভাবলেন।
আপনি তো একজন ক্যাথলিক, হুলিয়ান বললেন, আপনার কি নিজের সাথে কখনও…মতবিরোধ হয়নি এ ব্যাপারে?
হয়েছে, জবাব দিলো বিশপ, আমাদের ধর্ম এই ব্যাপারে সহনশীল নয় মোটেও। ছোট থাকতে এটা নিয়ে মনে মনে কষ্ট পেতাম আমি। একবার। যখন নিজেকে পুরোপুরি বুঝতে শিখি, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন একজন সিস্টার বাঁচান আমাকে। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন যে বাইবেল সকল প্রকার ভালোবাসাকে মেনে নেয়, যদি তা আত্মিক হয়। তাই চিরকুমারবত নেই আমি।
হঠাৎ করেই অ্যাম্ব্রার কথা মনে হলো হুলিয়ানের।
সে ফোন দেবে আপনাকে, ভালদেসপিনো বললেন।
আগেও হুলিয়ান খেয়াল করেছেন, বিশপ অনেক ব্যাপার ধরতে পারেন। খুব সহজেই। হয়তো দেবে, বললেন যুবরাজ, আবার নাও দিতে পারে।
আর এই অনিশ্চয়তাটুকুই পছন্দ আপনার, ভালদেসপিনো হেসে বললেন। যখন রাজা হবেন, আপনার যোগ্য একজন সঙ্গি দরকার।
হুলিয়ান বুঝতে পারলেন, অ্যাম্ব্রাকে আশির্বাদ করছেন বিশপ। সেই সাথে তার নিজের প্রতিও ইঙ্গিত করছে।
আজ রাতে ভ্যালি অফ দ্য ফলেনে, হুলিয়ান বললেন, বাবা আমাকে অদ্ভুত কিছু কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। তার কথা শুনে কি অবাক হয়েছিলেন আপনি?
মোটেও না। তিনি অনেক দিন ধরেই চাচ্ছিলেন যাতে স্পেনে এমনটা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কিছু ঝামেলা ছিল। আপনি যেহেতু ফ্রাঙ্কোর যুগের। থেকে বেশ কয়েক যুগ পরের প্রজন্ম, তাই আপনার জন্যে কাজটা সম্পন্ন করা। হয়তো সহজ হবে।
এক ঘন্টারও কম সময় আগে ফ্রাঙ্কোর সমাধির কাছে বসে নিজের ইচ্ছেটা প্রিন্সের সামনে তুলে ধরেন রাজা, হুলিয়ান, তুমি যখন রাজা হবে, তখন তোমার ওপর চাপ দেয়া হবে এই জঘন্য জায়গাটা ধ্বংস করে ফেলার জন্যে। ডায়নামাইটের সাহায্য গোটা স্থাপনা উড়িয়ে দিতে বলা হবে, ওর চেহারার দিকে তাকিয়েছিলেন রাজা, তোমার প্রতি আমার অনুরোধ, কখনই হার মানবে না সেই চাপের কাছে।
তার কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল হুলিয়ান। ওর বাবা সবসময়ই স্বৈরতন্ত্রের একজন কট্টর সমালোচক ছিলেন। তাই ফ্রাঙ্কোর সমাধিকে জাতির কলঙ্ক বিবেচনা করতেন তিনি।
এই ব্যাসিলিকা যদি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়, রাজা বলেছিলেন ওকে, তাহলে অনেকে জানতেই পারবে না আমাদের অতীত ইতিহাসের এক অন্ধকার দিক সম্পর্কে। কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবো আমরা আর আশা করবো যাতে আরেকটা ফ্রাঙ্কোর জন্ম না হয়। কিন্তু আসলেই যে জন্ম নেবে না এর নিশ্চয়তা কে দেবে? তোমার নিশ্চয়ই জর্জ সান্তিয়ানার উক্তিটা মনে আছে-
যারা জোরপূর্বক অতীতকে ভুলতে চাইবে, তাদের সাথেই অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, হুলিয়ান তার কথাটা শেষ করে দিলেন।
হ্যাঁ, ওর বাবা বললেন, আর আমরা যদি ইতিহাস খেয়াল করি তাহলে দেখা যাবে বারবার এরকম স্বৈরাচারদের আগমন ঘটেছে, ছেলের দিকে কিছুটা ঝুঁকে আসলেন রাজা, হুলিয়ান, খুব শিঘ্রই সিংহাসনে বসতে চলেছো তুমি। এমন একটা আধুনিক দেশের সিংহাসন, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হবে সাবধানে। যার অতীতে ছিল অনেক কলঙ্কজনক অধ্যায়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সেই কালিমা মুছে ফেলে সামনে এগোতে চাচ্ছি। আমরা। গড়তে চাইছি এক সহনশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ রাজ্য, যেখানে কমতি থাকবে না কিছুর। আলোকিত করতে চাইছি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মন। কিন্তু সে আলো জ্বলবে না যদি আমরা অতীত থেকে শিক্ষা না নেই।
হাসলেন রাজা, চোখ দুটো চকচক করছে তার।
হুলিয়ান, তুমি যখন রাজা হবে, আমি প্রার্থনা করবো তুমি যাতে এই গৌরবময় রাজ্যকে নিয়ে যেতে পারো অসীম উচ্চতায়। তখন শুধু পর্যটনের। দেশ আর সমাধিক্ষেত্রের দেশ হিসেবে নয়, অন্য কারণেও আমাদের চিনবে পুরো বিশ্ব। এই পুরো কমপ্লেক্সটাকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করবে, যাতে ছোট ছোট বাচ্চারা এখানে এসে শিক্ষা নিতে পারে অতীত থেকে। দেখতে পারে স্বৈরাচার তন্ত্রের বিভীষিকার নিদর্শন।
রাজাকে দেখে মনে হলো যেন সারাজীবন ধরে এই কথাগুলো বলার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
আর সবচেয়ে জরুরি কথা, তিনি বলেছিলেন, এই জাদুঘরটা ইতিহাসের অন্য পাঠ থেকেও শিক্ষা দেবে আমাদের। প্রমাণ করবে যে, কখনও জোর করে দাবিয়ে রাখা যায় না কোন জাতিকে। যদি ভালোবাসা এবং একে অপরের জন্যে সহমর্মিতা থাকে অন্তরে, তাহলে কারো সাধ্য নেই তাকে চুপ করানোর।
এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চাঁদের আলোয় আলোকিত হাসপাতাল রুমের ভেতর বিছানায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষটার দিকে তাকালেন তিনি। খুব সুখি মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে তাকে।
বিশপ ভালদেসপিনোর দিকে তাকিয়ে রাজার বিছানার পাশের চেয়ারটার দিকে ইশারা করলেন হুলিয়ান। তার পাশে গিয়ে বসুন। আমি নার্সকে বলে দিচ্ছি। এক ঘন্টা পর এসে আবার খোঁজ নিয়ে যাবো।
তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন ভালদেসপিনো। এরপর জীবনে প্রথমবারের মত তাকে আলিঙ্গন করলো বয়স্ক বিশপ। এ সময় হুলিয়ান বুঝতে পারলেন বিশপের নিজের শরীরও ভেঙে পড়েছে, এমনকি রাজার চাইতেও বেশি। তার কাছে মনে হতে লাগলো, হয়তো একই সময় মত ছেড়ে পাড়ি জমাবে দুই বন্ধু।
আপনাকে নিয়ে গর্ব হয় আমার, বিশপ বললেন আলিঙ্গন শেষে। খুব ভালো একজন নেতা হবেন আপনি। আপনার বাবা ঠিকমতো মানুষ করেছেন আপনাকে।
আপনাকেও ধন্যবাদ, হুলিয়ান বললেন, আপনিও কম করেননি আমার জন্যে।
বিদায় নিয়ে হলওয়েতে বের হয়ে আসলেন হুলিয়ান। হাঁটতে লাগলো লম্বা করিডোর ধরে। শুধু একবার থেমে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন চাঁদের আলোয় আলোকিত স্থাপনাটা দেখার জন্যে।
এল এসকোরিয়াল।
স্প্যানিশ রাজপরিবারের সমাধিক্ষেত্র।
ছোটবেলায় বাবার সাথে এখানে আসার কথা আরেকবার মনে পড়লো ওর। রাজাদের সমাধিক্ষেত্র পরিদর্শনের পর হঠাই একটা কথা মনে হয়েছিল তার আমার জায়গা হবে না এখানে।
কখনও সেদিনের চিন্তাটা ভোলেননি তিনি। তবে সবসময়ই মনে করে এসেছে, ছেলেমানুষি চিন্তা ছিল ওটা।
হয়তো ছোটবেলা থেকেই নিজের নিয়তি সম্পর্কে জানতাম আমি।
রাজা হিসেবে আমার কর্তব্য কি হবে সেটাও জানতাম।
দিনবদলের হাওয়া বইছে এখন পুরো দুনিয়া জুড়ে। পুরনো রীতিনীতি পদপিষ্ট হচ্ছে নতুন রীতিনীতির ভারে। এই রাজতন্ত্র চিরতরে ভেঙে দেয়ার এটাই একদম সঠিক সময়। কল্পনা করলেন, এই ঘোষণাটা দিচ্ছেন।
আমিই স্পেনের শেষ রাজা।
হঠাৎ করেই ফোনের ভাইবেশনে সম্বিত ফিরে পেলেন। স্ক্রিনের নম্বর দেখেই দ্রুত হয়ে গেল তার হৃৎস্পন্দন। নম্বরটা শুরু হয়েছে ৯৩ দিয়ে।
বার্সেলোনা।
হুলিয়ান বলছি, উৎকণ্ঠার স্বরে বললেন তিনি।
হুলিয়ান, আমি. ..ওপাশের স্বরটা কোমল এবং ক্লান্ত।
দ্রুত একটা চেয়ারে বসে পড়তে বাধ্য হলেন যুবরাজ হুলিয়ান, কিভাবে তোমাকে বলবো কতটা দুঃখিত আমি? ফিসফিসিয়ে বলা শুরু করলেন তিনি।
.
অধ্যায় ১০০
বার্সেলোনা সুপারকম্পিউটার সেন্টারের বাইরে শক্ত করে ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে রেখেছে অ্যাম্ব্রা ভিদাল। হুলিয়ান দুঃখিত! একটা ভয় দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইলো ভেতর থেকে, হয়তো আজ রাতের কৃতকর্মগুলোর জন্যে ক্ষমা চাইতে চলেছে সে।
দুজন গার্ডিয়া এজেন্ট দাঁড়িয়ে আছে ওর থেকে কিছু দূরে, অবশ্য আস্তে কথা বললে কিছু কানে যাবে না তাদের।
অ্যাম্ব্রা, আমি আমার বিয়ের প্রস্তাবটার কথা বলছি…সেটার জন্যে দুঃখিত, প্রিন্স বললেন।
বিভ্রান্তবোধ করলো অ্যাম্ব্রা। এই ব্যাপারটা যে হুলিয়ানের মাথায় আসতে পারে এখন সেটা কল্পনাও করেনি ও।
একটু রোমান্টিক হবার চেষ্টা করছিলাম বলতে পারো, বললেন হুলিয়ান, কিন্তু তোমাকে একদম বাজে একটা পরিস্থিতিতে ফেলে দেই, যেখানে না করাটা সম্ভব ছিল না তোমার পক্ষে। এরপরে তুমি যখন আমাকে বললে যে, কখনও বাচ্চা হবে না তোমার…তোমার কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়েছিলাম! তবে সেটার পেছনে অন্য কারণ ছিল। আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে ব্যাপারটা বলতে এতদিন দেরি করেছো তুমি। হয়তো তোমাকে খুব দ্রুত বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়ে ফেলেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একসাথে জীবন শুরু করতে চাচ্ছিলাম। এর কারণ হয়তো আমার বাবার শরীর খারাপ হয়ে উঠছিল ক্রমশই…।
হুলিয়ান, থামো! তাকে কথার মাঝেই থামালো অ্যাম্ব্রা, কিছুর জন্যেই দুঃখ প্রকাশ করতে হবে না তোমাকে, আর আজ রাতে অনেক জরুরি ঘটনা-
না, তোমার চাইতে জরুরি কিছু নেই আমার কাছে। আমি শুধু তোমাকে জানাতে চাই যে কতটা দুঃখিত আমি যে এভাবে সব কিছু এগোলো আমাদের মধ্যে।
যার কণ্ঠস্বরটা ভেসে আসছে ফোনের ওপাশ থেকে সেই মানুষটারই প্রেমে পড়েছিল কয়েক মাস আগে। ধন্যবাদ হুলিয়ান, ফিসফিসিয়ে বলল অ্যাম্ব্রা, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কতটা খুশি হলাম কথাটা শুনে।
কিছুক্ষণের অস্বস্তিদায়ক নীরবতা এরপর। সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেললো অ্যাম্রা।
হুলিয়ান, বলল ও, আমি জানতে চাই, তুমি কি আজ রাতের এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যাকাণ্ডের সাথে কোনভাবে জড়িত কিনা।
অনেকক্ষণ কিছুই বললেন না প্রিন্স। অবশেষে যখন কথা বললেন তখন তার কণ্ঠে বেদনার ছাপ স্পষ্ট। অ্যাম্ব্রা এ ব্যাপারটা সহ্য করতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল, এডমন্ড কিয়ার্শের সাথে অনুষ্ঠানটার আয়োজন করতে অনেক সময় কাটাতে হতো তোমাকে। আর আমার ইচ্ছাও ছিল না এরকম একটা ব্যাপারের সাথে নিজেকে জড়াও তুমি। এমনটাও মনে হয়েছিল, তার সাথে কোনদিন দেখা না হলেই ভালো হতো তোমার, এটুকু বলে থামলেন তিনি, এরপর বললেন, কিন্তু না, আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, তার হত্যাকাণ্ডের সাথে কোন যোগাযোগ নেই আমার। মানসিকভাবে প্রচণ্ড আহত হই ঘটনাটা দেখে। বিশেষ করে আমি যাকে ভালোবাসি তার কয়েক হাত দূরে সংঘটিত হয়েছে হত্যাকাণ্ডটা, এটা ভাবলেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল আমার।
প্রিন্স যে সত্যি কথা বলছে এটা ধরতে পারলো অ্যাম্ব্রা। হুলিয়ান, আমি খুবই দুঃখিত, এরকম একটা প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করতে হলো বলে। কিন্তু এতসব গুজবের মাঝে…তাল হারিয়ে ফেলেছিলাম। কী করবো কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
হুলিয়ান তাকে বললেন, কিয়ার্শের খুনের ঘটনা সম্পর্কে ইন্টারনেটে কি কি তথ্য ফাঁস হয়েছে। তার বাবার সাথে দেখা হওয়ার কথাটাও বললেন।
ফিরে আসো, ফিসফিসিয়ে বললেন যুবরাজ, তোমাকে এক ঝলক দেখতে চাই আমি।
তার কণ্ঠের আকুলতা অ্যাম্ৰার বুকের সব অভিমান গলিয়ে দিলো মুহূর্তের মধ্যে।
আরেকটা ব্যাপার, যুবরাজ বললেন, আগের চেয়ে হালকা স্বরে, একটা অদ্ভুত পরিকল্পনা মাথায় এসেছে আমার। আমরা না-হয় আমাদের বাগদানটা স্থগিত করে দেই…আবার নতুন করে শুরু করি সবকিছু।
কথাগুলো শুনে হতবাক হয়ে গেল অ্যাম্ব্রা। ও জানে রাজনৈতিকভাবেও এটা প্রভাব ফেলবে যুবরাজের জীবনে, তুমি. ..তুমি করবে সেটা।
আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন হুলিয়ান। ডার্লিং, লোকচক্ষুর আড়ালে, একান্তে তোমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার সুযোগের জন্যে…যেকোন কিছু করতে রাজি আছি আমি।
.
অধ্যায় ১০১
কন্সপিরেসিনেট.কম
ব্রেকিং নিউজ : কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনের পুণর্ধচার
এডমন্ড কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনটা আবার দেখতে চাইলে ক্লিক করন এখানে।
পোপের বক্তব্য
পালমেরিয়ান চার্চের সদস্যরা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে এডমন্ড কিয়াশের হত্যাকাণ্ডের সাথে তাদের সম্পৃক্ততার কথা। তাদের দাবি রিজেন্ট নামেও কাউকে চেনে না তারা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে গোটা ব্যাপারটা পালমেরিয়ানদের ভাবমূর্তিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর এডমন্ড কিয়া বরাবরই তার মার মৃত্যুর জন্যে এই চার্চকে দোষ দিয়ে এসেছেন। তাছাড়া ২০১৬ সালে চার্চের পোপ গ্রেগরিওর একটা ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে যেখানে তিনি স্বীকার করেন, এই চার্চটা একদম শুরু থেকেই একটা ভাঁওতাবাজি, সাদা টাকা কালো করার একটা উপায় মাত্র। এই ভিডিওটা আবার নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে।
প্রাসাদের থেকে দুঃখপ্রকাশ, রাজার অবস্থার অবনতি
রাজপ্রাসাদ থেকে নতুন একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়া হয়েছে যেখানে লেফটেন্যান্ট গারজার গ্রেফতার হবার ব্যাপারটাকে একটি ভুল বোঝাবুঝির ফলাফল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রবার্ট ল্যাংডনের প্রতিও দুঃখপ্রকাশ করা হয় ভুলক্রমে তাকে দোষারোপের জন্যে।
বিশপ ভালদেসপিনোর আজ রাতের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার ব্যাপারে এখনও কোন মন্তব্য করা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে এই মুহূর্তে প্রিন্স হুলিয়ানের সাথে সংকটাপন্ন রাজার পাশে আছেন তিনি। তবে তারা কোন হাসপাতালে আছেন, সে-ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি।
Monte কোথায়?
কোন চিহ্ন ছাড়াই উধাও হয়ে গিয়েছে আমাদের তথ্যদাতা monte@iglesia.org।
আমাদের ওয়েবসাইটের বেশিরভাগ ব্যবহারকারির মতে monte হচ্ছে এডমন্ড কিয়ার্শের কোন অনুসারির ছদ্মনাম। আবার অনেকের ধারণা, monte প্রাসাদের গণসংযোগ বিভাগের প্রধান মনিকা মার্টিনের ছদ্মনাম।
আরও জানতে চোখ রাখুন এখানেই!
.
অধ্যায় ১০২
পুরো পৃথিবীতে তেত্রিশটা শেক্সপিয়ার গার্ডেন-এর অস্তিত্ব আছে যেখানে শুধুমাত্র শেক্সপিয়ার তার সাহিত্যে যে ফুলগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন সেগুলোই চাষ করা হয়। ভিয়েনা, স্যান ফ্রান্সিসকো, নিউ ইয়র্ক ছাড়াও বার্সেলোনার সুপারকম্পিউটিং সেন্টারের পাশেই অমন একটি বাগান অবস্থিত।
দূরের স্ট্রিটলাইটের আবছা আলো এসে পড়ছে সেই ফুলের বাগানের একটি বেঞ্চে বসে থাকা অ্যাম্ব্রা ভিদালের চেহারায়। হুলিয়ানের সাথে আবেগমাখা ফোনকলটা শেষ করেছে এমন সময় ল্যাংডন এসে উপস্থিত হলো সেখানে। অ্যাম্ব্রাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো সে।
আমেরিকান প্রফেসরকে পরনের কোটটা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখতে দেখে না হেসে পারলো না অ্যাম্ব্রা, শার্টের হাতাও গুটিয়ে রেখেছে অনেকখানি। মিকি মাউস ঘড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন।
কি অবস্থা? ক্লান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন, যদিও মুখে লেগে আছে হাসি।
উঠে দাঁড়িয়ে তার সাথে বাগানে হাঁটতে শুরু করলো অ্যাম্ব্রা। গার্ডিয়া। অফিসাররা একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখছে তাদের কাছ থেকে। ল্যাংডনকে হুলিয়ানের সাথে হওয়া কথোপকথনটা খুলে বলল অ্যাম্ব্রা। তার দুঃপ্রকাশ করা, বাগদান স্থগিত করে দেয়ার প্রস্তাব, এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যাকাণ্ডের সাথে নিজের অসম্পৃক্ততা দাবি করা-সবকিছুই বলল।
আসলেই একজন প্রিন্স চার্মিং তিনি, ল্যাংডন বলল প্রশংসার সুরে।
আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল সে, অ্যাম্ব্রা বলল। আজকের রাতটায় অনেক ধকল গেছে ওর ওপর দিয়েও। ও চায়, এখন মাদ্রিদে ফিরে যাই আমি। তাছাড়া রাজার অবস্থাও ভালো না। হুলিয়ান-।
অ্যাম্ব্রা, ল্যাংডন নরম স্বরে বলল, কিছু ব্যাখ্যা করতে হবে না আপনাকে। এখনই যাওয়া উচিত আপনার।
তার কণ্ঠের হতাশার সুরটা কান এড়ালো না অ্যাম্ব্রার। ভেতরে ভেতরে নিজেরও কিছুটা সেরকমই বোধ হচ্ছে।
রবার্ট, ডাক দিলো ও, আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি?
অবশ্যই।
কিছুক্ষণ দ্বিধাবোধ করলো অ্যাম্ব্রা। আপনার জন্যে কি পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো যথেষ্ট?
তার দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকালো ল্যাংডন যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন প্রশ্ন আশা করছিল সে, যথেষ্ট বলতে?
আপনার মনের জন্যে যথেষ্ট? ঠিকমতো বোঝাতে পারছি না হয়তো। কিন্তু মন থেকে কি যুক্তিগুলো মেনে নিয়েছেন আপনি? আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? অ্যাম্ব্রাকে লজ্জিত মনে হচ্ছে এখন, আমি দুঃখিত, আজ রাতের এত কিছুর পর এরকম একটা প্রশ্নের জন্যে।
হেসে উঠলো ল্যাংডন, এক রাত ঘুমালে আরও ভালোমতো জবাব দিতে পারতাম আমি। তবে সত্যি কথা বলতে, আমাকে প্রায়ই এই প্রশ্নটার সম্মুখীন হতে হয়।
কী জবাব দেন তখন?
সত্যটাই বলি, বলল ল্যাংডন, বলি যে, আমার জন্যে ঈশ্বর নিহিত আছেন কোড এবং প্যাটার্নের পার্থক্যের মাঝে।
অ্যাম্ব্রা মুখ তুলে তাকালো তার দিকে। বুঝতে পারছি না।
কোড আর প্যাটার্ন একে অপর থেকে একদম ভিন্ন, ল্যাংডন বলল, কিন্তু অনেকেই এ দুটোকে এক করে ফেলে। এ দুটোর মধ্যে মূল পার্থক্যটা বোঝা জরুরি।
সেটা কি?
হাঁটা থামিয়ে অ্যাম্ব্রার দিকে তাকালো ল্যাংডন, প্যাটার্ন হচ্ছে কোন কতগুলো নির্দিষ্ট নক্সার সমাবেশ। প্রকৃতিতে সব জায়গায় প্যাটার্ন দেখতে পাই আমরা। সূর্যমুখির বীজে, মৌমাছির চাকের ছয়কোণা গঠনে, একটা পুকুরে ঢিল ছুড়লে বৃত্তাকার ঢেউয়ের মাঝে।
বেশ। আর কোড?
কোডের আলাদা বিশেষত্ব আছে, ল্যাংডন বলল, কোডের সংজ্ঞানুযায়ী তাকে কিছু তথ্য বহন করতে হবে। শুধু প্যাটার্ন বা নক্সা হলে চলবে না। কোন অর্থ থাকতে হবে কোডের। যেখন অক্ষর, গানের স্বরলিপি, অঙ্কের সূত্র, কম্পিউটারের কোড, এমনকি ক্রশের মত সাধারণ চিহ্নও একটা কোড। এগুলোর প্রত্যেকটা থেকেই কিন্তু নির্দিষ্ট তথ্য পাই আমরা, যেটা সূর্যমুখির বীজ থেকে পাই না।
ল্যাংডন কী বোঝাতে চাইছে তা আবছা আবছা ধরতে পারছে অ্যাম্ব্রা, কিন্তু সেটার সাথে ঈশ্বরের কী সম্পর্ক তা বুঝতে পারছে না।
কোড আর প্যাটার্নের মধ্যে আরেকটা পার্থক্য হলো, ল্যাংডন বলতেই থাকলো, প্রাকৃতিকভাবে কোথাও কোডের দেখা মিলবে না। গানের স্বরলিপি কিন্তু গাছে ধরে না, কিংবা বালিতে কোন সংকেত নিজ থেকে সৃষ্টি হয় না। কোড হচ্ছে কোন বুদ্ধিমান সত্তার সৃষ্টি।
অ্যাম্ব্রা মাথা ঝাঁকালো, অর্থাৎ কোডের কোন নির্দিষ্ট অর্থ থাকতে হবে, কোন উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
একদম ঠিক। কোড আপনাআপনি তৈরি হয় না। তাদের সৃষ্টি করতে হয়।
কিছুক্ষণ তার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলো অ্যাম্ব্রা, ডিএনএ সম্পর্কে কী বলবেন?
একটা প্রফেসরসুলভ হাসি ফুটে উঠলো ল্যাংডনের ঠোঁটে, এই তো ধরতে পারছেন। জেনেটিক কোড। সব রহস্য একে ঘিরেই।
হঠাৎ করেই আগ্রহি হয়ে উঠলো অ্যাম্ব্রা। জেনেটিক কোডে অবশ্যই তথ্য থাকে, সেখানেই নিহিত থাকে একটা জীবের সকল বৈশিষ্ট্য। ল্যাংডন যা বলছে তার একটাই অর্থ হতে পারে।
আপনার ধারণা জেনেটিক কোড, ডিএনএ সৃষ্টি করেছে কেউ?
আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত তুললল ল্যাংডন। আস্তে! আস্তে! হেসে বলল সে, একবারে এত বড় লাফ দিলে হবে না। ছোটবেলা থেকেই সবসময় আমার এটা মনে হয়েছে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর পেছনেই কোন চেতনা কাজ করছে। আমি যখন অঙ্কের সূত্র নিয়ে ভেবেছি, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র দেখেছি কিংবা এই মহাবিশ্ব সম্বন্ধে জেনেছি-কখনোই আমার এমনটা মনে হয়নি এসব শুধুমাত্র বিজ্ঞান, বরং মনে হয়েছে যে এসবের পেছনে এমন কোন সত্তা আছে, যাকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমাদের নেই।
ল্যাংডনের কথাগুলো বেশ ভারি আর ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ মনে হলো অ্যাম্ব্রার কাছে। সবাই যদি আপনার মত করে ভাবতো তাহলে ভালো হতো, বলল ও। অথচ এই ঈশ্বরকে নিয়ে কতই না লড়াই করি আমরা। সবার কাছে নিজের নিজের বিশ্বাস ঠিক বলে মনে হয়।
হ্যাঁ, এজন্যেই এডমন্ড চেয়েছে বিজ্ঞান যাতে একদিন একত্রিত করে সবাইকে, ল্যাংডন বলল, ওর ভাষাতে-কেউ কি পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন শক্তির দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলবে কোনদিন? নিচের মাটিতে পা দিয়ে কিছু একটা আঁকলো ল্যাংডন। এরপর জিজ্ঞেস করলো, সত্য না মিথ্যা?
অবাক হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রোমান সংখ্যায় লেখা একটা সমীকরণ দেখলো অ্যাম্ব্রা :
I+XI = X
এক আর এগারোর যোগফল দশ? এটা মিথ্যা, সাথে সাথে বলল ও।
কোনভাবেই কি এটা সত্যি হতে পারে না?
মাথা ঝাঁকালও অ্যাম্ব্রা। না।
ল্যাংডন হঠাৎ বাড়িয়ে অ্যাম্ব্রাকে ধরে তার নিজের জায়গায় নিয়ে আসলো। এবার ল্যাংডন যেখান থেকে সমীকরণটা দেখছিলো সেখান থেকে দেখতে পেলো অ্যাম্ব্রা।
এদিকটা থেকে সমীকরণটা উল্টো দেখা যাচ্ছে।
X=I+IX
অবাক চোখে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে।
দশ হচ্ছে নয় যোগ এক, হেসে বলল ল্যাংডন। মাঝে মাঝে অন্যের সত্যকে অনুধাবন করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হয়।
মাথা ঝাঁকালো অ্যাম্ব্রা। ওর মনে পড়লো, উইনস্টনের আত্মপ্রকৃতিটা আগেও অনেকবার দেখেছে সে, কিন্তু কখনই সেটার প্রকৃত অর্থ ধরতে পারেনি, কারণ ওভাবে চিন্তা করছিল না সে।
লুকানো সত্যের কথা বলাতে ভালোই হলো, ল্যাংডন বলল, ওখানে একটা গুপ্তসংকেত দেখতে পাচ্ছি আমি, একদিকে নির্দেশ করে বলল সে, ট্রাকটার গায়ে।
অ্যাম্ব্রা মুখ তুলে তাকিয়ে একটা ফেডএক্সের ট্রাক দেখতে পেলো রাস্তায়।
গুপ্তসংকেত? নিজেকেই প্রশ্ন করলো সে। শুধু কোম্পানির বহুল প্রচারিত লোগোটা দেখা যাচ্ছে সেখানে।
ফেডএক্স
এই নামটার মধ্যেই একটা সংকেত আছে, বলল ল্যাংডন, যেটা নির্দেশ করছে কোম্পানির সামনের দিকে এগিয়ে চলা।
কতগুলো অক্ষর কেবল, অ্যাম্ব্রা বলল।
আমার কথা বিশ্বাস করুন। খুবই সাধারণ একটা সংকেত। সামনের দিকে নির্দেশ করছে ওটা?
বলুন আমাকে!ট্রাকটাকে চলে যেতে দেখে বলল অ্যাম্ব্রা।
না, হেসে বলল ল্যাংডন, একদিন আপনি নিজেই খেয়াল করবেন সেটা।
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল অ্যাম্ব্রা। কিন্তু তার আগেই গার্ডিয়া এজেন্টরা চলে আসলো তাদের দিকে।
মিস ভিদাল, আপনার জন্যে প্লেন অপেক্ষা করছে।
তাদের উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে ল্যাংডনের দিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা। আপনি আমার সাথে চলুন না, প্রস্তাব দিলো সে, হুলিয়ান নিশ্চয়ই আপনাকে দেখলে অনেক খুশি হবে।
না, থাক, ল্যাংডন জবাবে বলল, আমার সমস্যা হবে না। তাছাড়া ওখানে আমার জন্যে একটা রুম বুক করে রেখেছি আমি, পাশের বিশাল প্রিন্স সোফিয়া হোটেলটার দিকে নির্দেশ করে বলল। আমার ক্রেডিট কার্ডটাও আছে সাথে। আর এডমন্ডের ল্যাব থেকে এই ফোনটা নিয়ে এসেছি আমি।
হঠাৎই এভাবে বিদায় জানাতে কেমন যেন খারাপ লাগলো অ্যাম্ব্রার। ল্যাংডন তার চেহারা স্বাভাবিক রাখলেও সেও এরকমই অনুভব করছে সেটা জানে ও। সামনে আগ বাড়িয়ে ল্যাংডনকে জড়িয়ে ধরলো অ্যাম্ব্রা।
প্রফেসরও আন্তরিকভাবে আলিঙ্গন করলো ওকে। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকলো ওরা, স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক সেকেন্ড বেশিই বলা যায়, এরপর ছেড়ে দিলো।
সেই মুহূর্তে একটা ব্যাপার বুঝতে পারলো অ্যাম্ব্রা। ভালোবাসা নির্দিষ্ট কোন অনুভূতি নয়।
আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসার অনুভূতির সৃষ্টি হয় যখন আমাদের দরকার ওটার।
নতুন বাচ্চা হবার পর দম্পতিরা যেমন তাদের বাচ্চাকে ভালোবাসে, তেমনি একে অপরকেও ভালোবাসা। ঠিক তেমনিভাবে একই সাথে দুজন পুরুষের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে পারে অ্যাম্ব্রা।
ভালোবাসা স্বতস্ফূর্তভাবে যেকোন সময় সৃষ্টি হতে পারে।
*
গাড়িতে বসে তার প্রিন্সের কাছে ফিরে যাচ্ছে সে এখন। ভেতর থেকেই ল্যাংডনের দিকে তাকালো। বাগানে একা দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার উদ্দেশ্যে মৃদু একটা হাসি দিয়ে হাত তুলে বিদায় জানালো ল্যাংডন। এরপরই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো পকেটে হাত ঢুকিয়ে।
.
অধ্যায় ১০৩
ঠিক বারোটা বাজার সাথে সাথে নিজের হাতের নোটগুলো ঠিক করে নিয়ে প্রাসাদের প্লাজায় উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মিদের সামনে বের হয়ে আসলো মনিকা মার্টিন।
সকাল বেলা এল এস্কোরিয়াল হাসপাতাল থেকে সরাসরি প্রেস কনফারেন্সে নিজের বাবার মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছেন প্রিন্স হুলিয়ান। আবেগঘন কণ্ঠে কিন্তু রাজকীয় ভঙ্গিতে সিংহাসনে বসার পর কিভাবে সবকিছু সামলাবেন সেটা নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন জাতির উদ্দেশ্যে। বলেছেন, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সে অনুযায়ি কাজ করবেন তিনি। স্পেনের অপার সৌন্দর্য এবং সমৃদ্ধ। ঐতিহ্যের প্রশংসা করেছেন, আর দেশের মানুষের জন্যে নিজের ভালোবাসার। কথাও বলেছেন।
এত সুন্দর বক্তৃতা আগে কখনও শোনেনি মনিকা।
বক্তৃতার শেষে প্রিন্স গত রাতে আততায়ীর হাতে নিহত দুই গার্ডিয়া এজেন্টের কথা সম্মানের সাথে স্মরণ করেছেন। এরপর আরেকটা শোক সংবাদ জানান তিনি। রাজার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিশপ ভালদেসপিনোও মারা গিয়েছেন হার্ট অ্যাটাকে। বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদটা সহ্য করতে পারেননি ভগ্ন স্বাস্থ্যের বিশপ।
তার মৃত্যু সকল জল্পনা কল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েছে। যারা তার জিজ্ঞাসাবাদের দাবি তুলছিল তারাও চুপ হয়ে গেছে। আবার অনেকে এটাও বলছে যে বিশপের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ বানোয়াট, চার্চের শত্রুদের কাজ ওটা।
সবাই তো তোমাকে গতরাতের হিরো মানছে, সুরেশ ভাল্লা তারপাশে উদয় হলো এই সময়। monte@iglesia.org-এর জয় হোক।
সুরেশ, আমি কোন বেনামি তথ্যদাতা নই, বলল মনিকা।
আমি জানি সেটা, সুরেশ তাকে আশ্বস্ত করার সুরে বলল, সেটা যে-ই হোক না কেন, তোমার থেকে অনেক চালাক। কাল রাত থেকে তাকে ট্র্যাক। করার চেষ্টা করছি আমি, কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। একদম উধাও হয়ে। গেছে। যেন কোন অস্তিত্বই ছিল না।
খুঁজতে থাকো, বলল ও, আমি নিশ্চিত হতে চাই, প্রাসাদের কেউ কিছু ফাঁস করেনি। আর কালকে যে ফোন দুটো চুরি করেছিলেন।
জায়গামত রেখে দিয়েছি ওদুটো, সুরেশ বলল, প্রিন্সের সেফে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মনিকা। প্রিন্স কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছেন প্রাসাদে।
আরেকটা ব্যাপার, সুরেশ বলল, অপারেটরের কাছ থেকে প্রাসাদের কল রেকর্ড নিয়েছি আমি। কালকে গুগেনহাইম জাদুঘরে এখান থেকে কোন ফোন করা হয়নি। কেউ একজন এখানকার কোড নকল করেছে। আরো জানার চেষ্টা করছি আমরা।
তথ্যটা শুনে খুশি হলো মনিকা। আরও কিছু জানতে পারলে সাথে সাথে আমাকে বলবে, দরজার দিকে হেঁটে গিয়ে বলল সে।
বাইরে থেকে শোরগোলের আওয়াজ ক্রমশই বাড়ছে।
অনেক ভিড় দেখি বাইরে, বলল সুরেশ, সাংঘাতিক কিছু ঘটেছিল নাকি কাল রাতে?
এই টুকটাক কয়েকটা ঘটনা আর কি।
অ্যাম্ব্রা ভিদাল নতুন ডিজাইনের পোশাক পরেছে?
সুরেশ! হাসতে হাসতে বলল মনিকা।
এই ফাইলে কি? ওর হাতের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো সুরেশ।
খুঁটিনাটি সব তথ্য। প্রথমে রাজ অভিষেকের ব্যাপারে সব জানাতে হবে আমাকে, এরপর-
তোমার কাজে কোন মজা নেই, বলে ওখান থেকে চলে গেল সুরেশ। আবারও হেসে উঠলো অ্যাম্ব্রা।
প্লাজায় বের হয়ে সবার মুখোমুখি হলো সে। প্রাসাদে একসঙ্গে এত গণমাধ্যমকর্মিকে কখনও ভিড় জমাতে দেখেনি ও। চোখের চশমাটা ঠিক করে নিলো।
*
ওপরতলায় নিজ ঘরে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে টেলিভিশনে মনিকার প্রেস কনফারেন্সটা দেখলেন প্রিন্স হুলিয়ান। খুব ক্লান্তিবোধ করছে এখন। কিন্তু এটা ভেবে স্বস্তি লাগছে যে, প্রাসাদে ফিরেছে অ্যাম্ব্রা, এখন ঘুমোচ্ছে সে। ফোনে তার বলা শেষ কথাগুলো শুনে খুশি হয়ে উঠেছিল তার মন।
হুলিয়ান, তুমি যে সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে চাচ্ছো-এটা শুনে খুব ভালো লাগছে আমার। শুধু তুমি আমি আর আমি-সবার চোখের আড়ালে। আমাদের দুজনের জন্যে দুজনের ভালোবাসাটা একদমই ব্যক্তিগত। সবার এ ব্যাপারে সবকিছু জানার কোন অধিকার নেই।
তার বাবাকে হারানোর দিনে আশার আলো দেখিয়েছে অ্যাম্ব্রা। নিজের স্যুটটা ঝুলিয়ে রাখতে গিয়ে পকেটে কিছু একটার উপস্থিতি টের পেলেন তিনি-ওর বাবার হাসপাতাল রুমের মরফিন সলুশনের বোতলটা। বিশপ ভালদেসপিনোর পাশের টেবিলে খালি বোতলটা দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিলেন হুলিয়ান।
বুঝতে অসুবিধে হয়নি, কী ঘটেছে। নিচু হয়ে ঝুঁকে দুই পুরনো বন্ধুর জন্যেই প্রার্থনা করেন তিনি। এরপর মরফিনের বোতলটা ঢুকিয়ে নেন পকেটে।
রুম ছেড়ে বের হয়ে আসার আগে তার বাবার বুকের ওপর থেকে বিশপের নিথর দেহটা তুলে প্রার্থনার ভঙ্গিতে চেয়ারে বসিয়ে দেন।
ভালোবাসা একদমই ব্যক্তিগত একটা বিষয়। সবার এ ব্যাপারে সবকিছু জানার কোন অধিকার নেই।
.
অধ্যায় ১০৪
৬০০ ফুট উঁচু পাহাড়টার নাম মন্তজুইচ। বার্সেলোনার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায় অবস্থিত এই পাহাড়ের চুড়ায় ঠিক একটা মুকুটের মত সজ্জিত মন্তজুইচ দূর্গ। সপ্তদশ শতাব্দির এই অপূর্ব নিদর্শন থেকে ব্যালেরিক সাগর স্পষ্ট দেখা যায়।
সেই পাহাড়চূড়ার ওপরে একটা ক্যাবল কারে বসে নিচের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছে রবার্ট ল্যাংডন। শহরের কোলাহল থেকে বাইরে এসে ভালো লাগছে ভীষণ। একটু একা একা সময় কাটানোর দরকার ছিল, মনে মনে ভাবলো সে। এই দুপুরবেলার সূর্যের উত্তাপটাও ভালো লাগছে তার।
সকাল বেলা প্রিন্সেস সোফিয়া হোটেলে ঘুম থেকে উঠে গরম পানি দিয়ে গোসল সারার পর ডিম ওটমিল আর কফি দিয়ে নাস্তা সেরে নেয়, টিভিতে সকালের খবর দেখতে দেখতে।
যেমনটা ভেবেছিল, এডমন্ড কিয়ার্শের সংবাদই প্রধান শিরোনাম হিসেবে দেখানো হয়। কিয়ার্শের তত্ত্ব কিরকম প্রভাব ফেলবে, তার সত্যতা কতটুকু এসব নিয়েই বিশ্লেষণ চলছে সব জায়গায়। বোদ্ধা বোদ্ধা নোকজন একে অপরের সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে।
বিক্রেতারা ইতোমধ্যেই কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনকে পুঁজি করে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। তার ছবি সংবলিত টিশার্ট বিক্রি হতে দেখেছে ল্যাংডন। সেটার নিচে তার করা বিভিন্ন উক্তিরও উল্লেখ আছে। তবে ওর কাছে সবচেয়ে চমকপ্রদ লেগেছে এক স্কেটবোর্ডারের টিশার্টে হাতে লেখা কথাটা :
I Am MONTE@IGLESIA.ORG
খবর দেখে যা বুঝলো, এই অজ্ঞাত তথ্যদাতার আসল পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। সেই সাথে গোটা ঘটনার সাথে রিজেন্ট, বিশপ এবং পালমেরিয়ান চার্চের কি সম্পর্ক সেটাও পরিষ্কার হয়নি।
সবই কেবল অনুমান।
সৌভাগ্যবশত, গত রাতে কিয়ারে নিহত হবার ঘটনা তার প্রেজেন্টেশনে উপস্থাপিত বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে মানুষকে। প্রযুক্তি বিষয়ক বইগুলো রাতারাতি ওপরে উঠে গেছে বেস্টসেলার লিস্টে।
ABUNDANCE: THE FUTURE IS BETTER THAN YOU THINK
WHAT TECHNOLOGY WANTS
THE SINGULARITY IS NEAR
ল্যাংডন বরাবরই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ব্যাপারে নাক সিঁটকালেও, আজ সে ব্যাপারে আশাবাদি বোধ করছে, কারণ মানুষের উপকারেই আসবে এই প্রযুক্তি। ইতোমধ্যে খবরের চ্যানেলগুলোতে এমন রিপোর্ট দেখানো শুরু হয়ে গেছে, যেখান বলা হচ্ছে মানুষ খুব শিঘ্রই দূষিত নদী এবং সাগরের পানি শোধনের ব্যবস্থা করে ফেলবে, সুপেয় পানির মজুদ হবে অসীম, মরুভূমি খাদ্য। ফলাতে পারবে, এমনকি সোলার ড্রোনের সাহায্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনীতির একদম তলানি থেকে তুলে আনবে তাদের।
হঠাত্র প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনার এরকম নাটকিয় বৃদ্ধির দিনে এটা ভেবে মনে মনে অবাক হলো ল্যাংডন যে, কেউই উইনস্টনের অস্তিত্বের কথা জানবে না। কিয়ার্শ তেমন কাউকেই বলে যায়নি এই আবিষ্কারের ব্যাপারে। সবাই অবশ্য এডমন্ডের ই-ওয়েভ সুপার কম্পিউটারের ব্যাপারে জানবে, যার গঠন মানুষের দ্বি-কক্ষ মস্তিষ্কের মত। বর্তমানে বার্সেলোনার সুপারকম্পিউটিং সেন্টারে অবস্থান করছে সেটা। ল্যাংডন ভাবলো, যে ই-ওয়েভকে ব্যবহার করে উইনস্টনের মত নতুন কোন প্রোগ্রাম বানাতে কতদিন লাগবে প্রোগ্রামারদের।
ক্যাবল কারের ভেতরে এখন গরম লাগতে শুরু করেছে ল্যাংডনের। এটা থেকে যত দ্রুত সম্ভব নেমে দূর্গটা এবং তার পাশের প্রাসাদটা দেখার ইচ্ছে ওর, সাথে বিখ্যাত জাদুর ঝর্ণা তো আছেই। আগামী কয়েক ঘন্টা এডমন্ড এবং তার প্রেজেন্টেশন থেকে মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতে চাইছে সে।
মন্তজুইচ পাহাড়ের ইতিহাস ঠিকমতো জানার জন্যে ল্যাংডন ক্যাবল কারের ভেতরের তথ্যসমৃদ্ধ প্ল্যাকার্ডটার দিকে তাকালো। কিন্তু সেটা থেকে কেবল এক লাইন পড়া হলো ওর।
Montjuic নামটা এসেছে হয় কাতালান Monjuich (ইহুদিদের পাহাড়) কিংবা ল্যাটিন Mons Jovicus (জোভের পাহাড়) থেকে।
এটুকু পড়েই থমকে গেল ল্যাংডন। হঠাৎই একটা ব্যাপার উপলব্ধি করতে পেরেছে সে।
এটা কাকতালিয় হতে পারে না।
যত বেশি ভাবতে লাগলো ব্যাপারটা নিয়ে, তত জোরালো হতে লাগলো সন্দেহ। অবশেষে পকেট থেকে এডমন্ডের ফোনটা বের করে সেটার হোমস্ক্রিনের উইনস্টন চার্চিলের উক্তিটা পড়লো আবার।
ইতিহাস আমাকে ভালোভাবে মনে রাখবে, যদি ইতিহাসটার রচয়িতা হই আমি নিজে।
বেশ খানিকক্ষণ ভাবার পর W বাটনটা চেপে ফোনটা কানে ধরলো ল্যাংডন।
সাথে সাথে সংযোগ পেয়ে গেল।
প্রফেসর ল্যাংডন নিশ্চয়ই? ইংরেজ উচ্চারণে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর জিজ্ঞেস করলো ওপাশ থেকে। ঠিক সময়মত ফোন করেছেন আপনি। আর কিছুক্ষণ পরেই অবসর গ্রহণ করতে যাচ্ছি আমি, কৌতুকের ভঙ্গিতে শেষ কথাটা বলল উইনস্টন।
কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই ল্যাংডন বলল, স্প্যানিশ monte শব্দটার ইংরেজি হচ্ছে hill।
স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে উঠলো উইনস্টন, হ্যাঁ।
আর iglesia হচ্ছে church।
আপনি তো দেখি স্প্যানিশটা ভালোই পারেন প্রফেসর। ইচ্ছে করলে-
তার মানে monte@iglesia-কে ইচ্ছে করলে hill@church-ও লেখা যায়।
আবারও ঠিক ধরেছেন।
আর তোমার নাম যেহেতু উইনস্টন এবং এডমন্ড উইনস্টন চার্চিলের অনেক বড় ভক্ত ছিল, তাই আমার কাছে hill@church ইমেইল অ্যাড্রেসটা বড্ড বেশি…
কাকতালিয় মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ।
বেশ, উইনস্টনের গলার স্বর শুনে মনে হলো সে অভিভূত। আমি অবশ্য ধারণাই করেছিলাম যে আপনি হয়তো দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলবেন।
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো ল্যাংডন। monte@iglesia হচ্ছে…তুমি।
হ্যাঁ, প্রফেসর। এডমন্ডের পক্ষ থেকে কাউকে তো কাজটা করতে হতো? আর আমার চেয়ে ভালো সেটা কে পারবে, বলুন? তাই এই ছদ্মনাম ব্যবহার করে অনলাইন কন্সপিরেসি সাইটগুলোকে তথ্য দেয়া শুরু করি আমি। আর যেহেতু এইসব ষড়যন্ত্ৰতাত্ত্বিক ওয়েবসাইট থেকে কথা খুব সহজে কথা ছড়িয়ে পড়ে তাই আমি ধারণা করেছিলাম যে monte সেজে তথ্য দিতে থাকলে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনের দর্শক সংখ্যা ৫০০ শতাংশ বেড়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দর্শক সংখ্যা বাড়ে ৬২০ শতাংশ। যেমনটা আপনি বলেছিলেন গতকাল, এডমন্ড গর্ববোধ করতো আমার কাজে।
বাতাসে দুলতে লাগলো ক্যাবল কারটা। খবরটা হজম করার চেষ্টা করছে। ল্যাংডন, উইনস্টন…এডমন্ড কি তোমাকে বলেছিলো এমনটা করতে?
সরাসরি বলেনি, কিন্তু ও বলেছিল এমন সব সৃজনশীল পদ্ধতি বের করে কাজে লাগাতে যেন দর্শক সংখ্যা যতটা বেশি সম্ভব বেড়ে যায়।
তুমি যদি ধরা পড়ে যাও? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো। তোমার এই ছদ্মনামটা যে খুব সুবিধার হয়েছে তা বলতে পারছি না।
খুব কম সংখ্যক লোকই জানে আমার অস্তিত্বের কথা। তাছাড়া আট মিনিট পর এমনিতেও চিরতরে নিজেকে ফেলবো আমি, তাই ওটা নিয়ে ভাবছি
আমি। monte পরিচয়টা আমি এডমন্ডের কাজেই লাগিয়েছি, এই সেটা ঠিকমতো কাজও করেছে।
কিভাবে ঠিকমতো কাজ করলো? চ্যালেঞ্জের সুরে বলল ল্যাংডন, এডমন্ড তো মারা গেছে!।
আমার কথাটা বুঝতে পারেননি আপনি, নির্মোহ ভঙ্গিতে বলল উইনস্টন। আমার মূল লক্ষ্য ছিল যত বেশি মানুষের কাছে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশন ছড়িয়ে দেয়া এবং সেটায় সফল হয়েছি আমি।
উইনস্টনের এই নির্মোহ কথার ভঙ্গি থেকেই ল্যাংডন বুঝতে পারলো যতই একজন আসল মানুষের মত শোনাক না কেন উইনস্টনের গলার স্বর, আদতে ওটা একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামের আওয়াজ।
এডমন্ডের মৃত্যুর ব্যাপারটা অবশ্যই দুঃখজনক, উইনস্টন বলল, তিনি বেঁচে থাকলে অবশ্যই ভালো লাগতো আমার। তবে আপনার এটা। জেনে রাখা উচিত, নিজের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিলেন এডমন্ড। এক মাস আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কিভাবে আত্মহত্যা করলে সবচেয়ে কম কষ্ট হবে। আমি বেশ সময় নিয়ে গবেষণা করে তাকে জানাই, দশ গ্রাম সেকোবারবিটাল সেবন করলেই সম্ভব হবে সেটা। এরপর ওটা জোগাড় করে সবসময় নিজের কাছে রাখতেন এডমন্ড।
আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এডমন্ড? ল্যাংডন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ। আর সেটা নিয়ে আমার সাথে মজাও করেছেন বেশ কয়েকবার। আমরা যখন গুগেনহাইমে প্রেজেন্টেশনটার দর্শক সংখ্যা কিভাবে বাড়ানো যায় সেটা চিন্তা করছিলাম তখন উনি আমাকে বলেন, প্রেজেন্টেশন শেষে সেকোবারবিটাল মুখে দিয়ে সেখানেই কুপোকাত হয়ে যাবেন।
আসলেই এমনটা বলেছিল সে? বোকা হয়ে গেছে ল্যাংডন।
সবসময় এই ব্যাপারটা নিয়ে কৌতুক করতেন তিনি। বলতেন একটা অনুষ্ঠান চলাকালীন যদি কেউ মারা যায় তবে সেই অনুষ্ঠানের টিআরপি রাতারাতি বেড়ে যায় বহুগুণ। আপনি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিবার দেখা-
থামো উইনস্টন। ভালো লাগছে না শুনতে, এই রাইডটা শেষ হতে আর কত দেরি। ল্যাংডনের হঠাৎই এই বদ্ধ কেবিনে অস্বস্তিবোধ হতে লাগলো। তার সামনে অনেকগুলো ক্যাবল কার ঝুলছে দড়িতে। অন্যদিকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে।
প্রফেসর? উইনস্টন ডাকলো এই সময়। আপনি কি আর কিছু জানতে চান আমার কাছে?
হ্যাঁ! চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো ল্যাংডনের। অনেক কিছু জানতে চাই!
কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলো প্রফেসর। কিন্তু খুব বেশিক্ষন সেটা সম্ভব হলো না।
ভাবতে লাগলো, এডমন্ডের মৃত্যু তার প্রেজেন্টেশনটাকে সারা পৃথিবীর মানুষের কথা বলার বিষয়ে পরিণত করেছে। দর্শক সংখ্যা কয়েক লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক কোটিতে।
পালমেরিয়ান চার্চকে ধ্বংস করার এডমন্ডের দীর্ঘদিনের ইচ্ছের কথা ভাবলো। আর তার মৃত্যু এই চার্চকে আসলেও ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের দোড়গোড়ায়।
হঠাৎই ক্যাবল কারের ভেতর উঠে দাঁড়ালো ল্যাংডন। এডমন্ড বিজ্ঞানের ভিত্তিতে নতুন একটা ধর্ম দাঁড় করাতে চেয়েছিল।
ধর্মিয় ইতিহাসে আগ্রহ আছে এমন যে কেউ বলতে পারবে, ধর্মের পথে কেউ যদি মারা যায় তবে তার গ্রহণযোগ্যতা হয় বেশি। খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে জিশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার ঘটনা, ইহুদিদের কেঁদোশিম।
নিজের ভাবনার সাথে নিজেই তাল মেলাতে পারছে না ল্যাংডন। যদি নতুন কোন ধর্মের আবির্ভাব ঘটে তখন নির্দিষ্ট কিছু ব্যাপার দেখা যায়।
অস্তিত্ববাদ নিয়ে নতুন কোন উত্তর দেয় সেই ধর্ম।
এলেম আমরা কোথা থেকে? যাচ্ছিই বা কোথায়?
অন্য ধর্মগুলোর নিন্দা করে নতুন ধর্ম।
এডমন্ড গতরাতে তার প্রস্তাবিত তত্ত্বের মাধ্যমে অনেক ধর্মকে হেয় করার চেষ্টা করেছে।
নতুন ধর্ম নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশ্বাস দেয়।
এডমন্ডও বলেছে, আসন্ন দিনগুলো মানুষের জন্যে হতে যাচ্ছে সুখকর।
নতুন কোন ধর্মের প্রতিটি লক্ষ্যই পুরণের চেষ্টা করেছে এডমন্ড।
উইনস্টন? ফিসফিসিয়ে ডাকলো সে, গুপ্তঘাতককে কে ভাড়া করেছিল এডমন্ডকে মারার জন্যে?
রিজেন্ট।
হ্যাঁ, ল্যাংডন বলল, আগের চেয়ে জোরালো গলায়, কিন্তু কে এই রিজেন্ট? কে পালমেরিয়ান চার্চের একজন সদস্যকে ভাড়া করেছিল এডমন্ডকে তার প্রেজেন্টেশনের মাঝে হত্যা করার জন্যে?
আপনার গলায় সন্দেহের সুর শুনতে পাচ্ছি আমি, প্রফেসর। কিন্তু চিন্তা করবেন না, আমাকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে যাতে এডমন্ডকে রক্ষা করি আমি। তাকে সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে গণ্য করি আমি, এটুকু বলে থামলো সে, আপনি নিশ্চয়ই অব মাইস অ্যান্ড মেন উপন্যাসটা পড়েছেন?
বিষয়বস্তুর সাথে একদমই বেমানান শোনালো কথাটা। অবশ্যই পড়েছি, কিন্তু সেটা কেন-
কথাটা শেষ করতে পারলো না ল্যাংডন, তার কাছে মনে হলো যেন ক্যাবল কারটা দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে বুঝি। একপাশের স্ট্যান্ডে হাত দিয়ে নিজেকে সামলাতে হলো তাকে।
আনুগত্য, সাহস, নিষ্ঠা। হাইস্কুলে থাকতে সাহিত্যের এই অমর কীর্তি সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে এই তিনটি শব্দ উল্লেখ করে ল্যাংডন। এমন একটা উপন্যাস যেখানে বন্ধুত্বকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আলাদা উচ্চতায়। সেখানে এক বন্ধু আরেক প্রিয় বন্ধুকে মেরে ফেলে কষ্টের পরিণতি বরণ থেকে বাঁচানোর জন্যে।
উইনস্টন, ফিসফিসিয়ে বলে ল্যাংডন, না! কেন?
বিশ্বাস করুন, উইনস্টন জবাব দিলো, এডমন্ড এমনটাই চাইতেন।
.
অধ্যায় ১০৫
বার্সেলোনা সুপার কম্পিউটিং সেন্টারের ডিরেক্টর ডক্টর মাতেও ভ্যালেরো যখন ফোনটা রাখলেন প্রচণ্ডরকম বিচলিত তখন তার মন। তরে জিরোনা চ্যাপেলের মূল অংশে গিয়ে আবারো এডমন্ড কিয়ার্শের অদ্ভুত সৃষ্টির দিকে তাকালেন তিনি।
ভ্যালেরো আজ সকালেই এটা জানতে পেরেছেন যে, এখন থেকে তাকেই রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে এই ভীষণ ক্ষমতাধর কম্পিউটারকে। প্রাথমিকভাবে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়েছিল তার, কিন্তু খুব বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি সেই অনুভূতি।
কয়েক মিনিট আগে বিখ্যাত আমেরিকান প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন ফোন দেন তাকে।
এমন একটা গল্প তাকে শোনার প্রফেসর যেটা কয়েকদিন আগে শুনলে হয়তো গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিতেন তিনি। তবে আজ, এডমন্ড কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন এবং ই-ওয়েভ কম্পিউটারটা দেখার পর কথাগুলো অবিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি তার কাছে।
ল্যাংডন তাকে যা বলেছে সেটা কেবল কোন যন্ত্রের পক্ষেই করা সম্ভব। তবে সেখানে সেই যন্ত্রের কোন দোষ নেই, কারণ তাকে যা করতে বলা হবে, যে লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হবে, সেই লক্ষ্য পূরণেই ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যাবে সেটা। ভ্যালেরো তার গোটা জীবনটা এরকম যন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করে। কাটিয়েছেন। শিখেছেন, কিভাবে কাজে লাগাতে হয় যন্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতাকে।
কিভাবে নির্দেশ দিতে হবে সেটা জানাও একটা শিল্প।
ভ্যালেরো বরাবরই সবাইকে সতর্ক করে আসছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। ব্যাপারটা নিয়ে বেশি তাড়াহুড়ো করছে মানুষ। নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুন বেঁধে দেয়া উচিত এই ধরণের গবেষণার ক্ষেত্রে, যাতে মনুষ্য জগতের সাথে সীমিত পরিমাণে নিজেকে জড়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোন যন্ত্র।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার বেশিরভাগ সহকর্মি এই লাগামটা টেনে ধরতে চান। বিশেষ করে এমন সময়ে যখন প্রতিদিন আবিষ্কার হচ্ছে নতুন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। তাছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্র থেকে বিপুল অর্থের হাতছানিও আছে। আর যখন অর্থের লোভ জেঁকে বসে কোন ক্ষেত্রে তখন নৈতিকতা আর অনৈতিকতার মধ্যে বিরাজমান সীমারেখাটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
ভ্যালেরো সবসময় কিয়ার্শকে সমীহের চোখে দেখে এসেছে। তবে এবার ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে, এডমন্ড ভুল করে ফেলেছে তার শেষ সৃষ্টিটার ক্ষেত্রে অথবা বেশি সাবধান না হওয়ার ফল ভোগ করতে হয়েছে তাকে।
কিন্তু সেই আবিষ্কারটা সম্পর্কে কখনই জানতে পারবো না আমি, ভ্যালেরো অনুধাবন করলো।
ল্যাংডনের ভাষ্যমতে, এডমন্ড ই-ওয়েভের অভ্যন্তরে তৈরি করেছিল এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতাসম্পন্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রাম-উইনস্টন। যেটা বেলা একটার সময় নিজেই নিজেকে পুরোপুরি ডিলিট করে দিয়েছে সিস্টেম থেকে। কয়েক মিনিট আগে, ল্যাংডনের অনুরোধে ভ্যালেরো এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ঠিক সেই সময়েই ই-ওয়েভের ডাটাব্যাংকের নির্দিষ্ট একটা সেক্টর মুছে গিয়েছে। এমনভাবে সেই অংশের তথ্যগুলো মুছে দেয়া হয়েছে যে ওগুলো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
কথাটা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে ল্যাংডন, তবুও ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে পরদিন তার সাথে দেখা করতে চেয়েছে আমেরিকান প্রফেসর। আগামীকাল সকালে ল্যাবে দেখা করবে তারা।
ভ্যালেরো বুঝতে পারছিলেন, কেন যত দ্রুত সম্ভব সবার সামনে ব্যাপারটা তুলে ধরতে চাইছে ল্যাংডন।
কিন্তু সমস্যা হলো কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না তাদের কথা।
এডমন্ডের প্রোগ্রামটার সব চিহ্ন মুছে গেছে সিস্টেম থেকে। আরেকটা সমস্যা হলো কিয়ার্শের সৃষ্টিটা বর্তমানের তুলনায় এত আধুনিক যে, ভ্যালেরো নিজের সহকর্মিরাও হয়তো অজ্ঞতা কিংবা ঈর্ষার বশবর্তি হয়ে ল্যাংডনের বলা কথাগুলোকে বানোয়াট বলে অভিহিত করবে।
তাছাড়া সাধারণ মানুষ কিভাবে নেবে ব্যাপারটা সেটাও একটা ভাবনার বিষয়। যদি এটা প্রমাণিতও হয় যে, ল্যাংডন যা যা বলছে সব সত্য, তাহলে ই-ওয়েভ মেশিনকে এক দৈত্য হিসেবে গণ্য করা হবে।
অথবা এর চেয়েও খারাপ।
কেউ হয়তো বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারে গোটা চ্যাপেলটা। সেটার স্বপক্ষে যুক্তি দেখানো হবে যে মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থেই অমনটা করা হয়েছে।
ল্যাংডনের সাথে মিটিংয়ের আগে তাই অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হবে ভ্যালেরোকে। তবে এই মুহূর্তে একটা কাজ করতে হবে তাকে।
অন্তত যতক্ষন পর্যন্ত কিছু প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া যায়।
বিষাদমাখা দৃষ্টিতে দোতলাজুড়ে অবস্থিত বিশাল কম্পিউটারটা শেষবারের মত দেখে নিলেন ভ্যালেরো। ওটার হিট পাম্পের আওয়াজ কানে আসছে তার।
পাওয়ার রুমে গিয়ে ফুল সিস্টেম শাটডাউনের আগে এমন একটা কাজ করতে ইচ্ছে করলে তার যে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন তিনি। তার তেষট্টি বছরের জীবনে একবারও এতটা প্রবলভাবে কোন কিছু করার ইচ্ছে জাগেনি।
প্রার্থনা করতে ইচ্ছে করছে তার।
*
মন্তজুইচ প্রাসাদের ওয়াকওয়েতে দাঁড়িয়ে দূরের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে ল্যাংডন। প্রবল বাতাসের কারণে কিছুটা ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে এখন।
বার্সেলোনা সুপারকম্পিউটিং সেন্টারের পরিচালকের আশ্বাস সত্ত্বেও ভীষণ অস্থির লাগছে তার। উইনস্টনের শীতল কণ্ঠস্বরটা যেন এখনও কানে বাজছে। শেষ পর্যন্ত একদম শান্তস্বরে কথা বলে গিয়েছে এডমন্ডের কম্পিউটার।
আপনার নিজের ধর্মেও কিন্তু এমন ঘটনা আছে, বলেছিল উইনস্টন। এরপর হঠাৎই একটা মেসেজ আসে ল্যাংডনের ফোনে।
For God so loved the world, that he gave his only begotten Son.
– John 3:16
আপনার ঈশ্বর নিজের সন্তানকে উৎসর্গ করেছিল, বলে উইনস্টন, ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় যন্ত্রনার মধ্যে কাটাতে হয়। কিন্তু এডমন্ডের ক্ষেত্রে আমি যন্ত্রনাহীনভাবে একজন মৃত্যুপথযাত্রির কষ্ট লাঘব করেছি যাতে তার কাজের প্রতি মানুষ মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়।
দোলায়মান ক্যাবল কারে বসে অবিশ্বাসের সাথে উইনস্টনের প্রতিটি কাজের ব্যাখ্যা শুনে যেতে হয় তাকে।
পালমেরিয়ান চার্চের প্রতি এডমন্ডের বিদ্বেষের কারণেই অ্যাডমিরাল লুই আভিলাকে বেছে নেয় সে। তার নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার তাকে উইনস্টনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কাজটা সহজ করে দেয়, সাথে পালমেরিয়ানদের ভাবমূর্তি ধূলোয় মিশিয়ে দেয়ার জন্যে একদম যোগ্য পাত্রে পরিণত করে। নিজেই রিজেন্ট সেজে তার সাথে কথা বলে উইনস্টন এবং তার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠায়। প্রকৃতপক্ষে পালমেরিয়ানরা একদম নির্দোষ এবং গতরাতের কোন ঘটনার সাথে জড়িত নয় তারা।
তবে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার সিঁড়িঘড়ে আভিলার হাতে ল্যাংডনের আক্রান্ত হবার ঘটনাটা একটি দুর্ঘটনা। আমি আভিলাকে সাগ্রাদা ফামিলিয়াতে পাঠিয়েছিলাম যাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে। এদিকে পুলিশ বাহিনীর লোকদের কাছেও তার আগমনের ব্যাপারে গোপন সংবাদ পাঠিয়েছিলাম। তাকে পূর্বদিকের সার্ভিস গেট দিয়ে ঢুকতে বলি আমি, কিন্তু সেটা না করে নিরাপত্তা বেষ্টনি ডিঙিয়ে ভেতরে ঢোকে সে। হয়তো পুলিশের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছিল। আমি আসলেই দুঃখিত, প্রফেসর। মানুষ যে কখন কী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে সেটা অনেক সময় আগে থেকে বোঝা যায় না।
কী বিশ্বাস করবে সেটা আর বুঝে উঠতে পারছিল না ল্যাংডন।
উইনস্টনের শেষ স্বীকারোক্তিটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঠেকে তার কাছে। মন্তসেরাতে এডমন্ড তিন ধর্মপ্রচারকের সাথে দেখা করার পর আমরা বিশপ ভালদেসপিনোর পক্ষ থেকে একটা ভয়েসমেইল পাই। সেখানে তিনি আমাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, তার দুই সহকর্মি এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা নিয়ে এতটাই চিন্তায় পড়ে গেছেন যে সেটা সম্পর্কে নিজেরাই আগেভাগে বিবৃতি দিতে চাচ্ছেন তারা। যাতে পরে কোন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়। কিন্তু সেটা গ্রহণযোগ্য ছিল না আমাদের জন্যে।
ল্যাংডন প্রায় অসুস্থবোধ করছিল ক্যাবল কারটার ভেতরে। তোমার প্রোগ্রামে একটা লাইন লেখা উচিত ছিল এডমন্ডের, ল্যাংডন বলেছিল, কাউকে হত্যা করা যাবে না!
ব্যাপারটা অত সহজ নয় প্রফেসর, উইনস্টন জবাব দেয়। মানুষ কখনও আদেশ মান্য করে কিছু শেখে না, তারা শেখে উদাহরণ থেকে। আপনাদের বই, সিনেমা, খবর, প্রাচীনকালের পুরাণে দেখা যায়, বৃহত্তর স্বার্থের জন্যে আত্মত্যাগের চেয়ে বড় মাহাত্ম কোন কিছুতে নেই। যেমন জিশু।
উইনস্টন, আমি কিন্তু এখানে কোন বৃহত্তর স্বার্থ দেখতে পাচ্ছি না।
পাচ্ছেন না? উইনস্টন অনুভূতিহীন কণ্ঠে বলে, তাহলে কয়েকটা বিখ্যাত প্রশ্ন করি আপনাকে। আপনি কি এমন একটা জগতে থাকতে চাইবেন যেখানে কোন প্রযুক্তি নেই? নেই কোন ওষুধ, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা?
ল্যাংডন চুপ করে থাকে।
এমনটাই আশা করেছিলাম। প্রফেসর উইলিয়াম ব্লেকের কবিতার শেষ পঙক্তিটা ভুললে চলবে না-তমসাচ্ছন্ন ধর্মগুলো বিদায় নেবেই নেবে, যাতে রাজত্ব করতে পারে বিজ্ঞান।
ব্লেকের কবিতাটার কথা ল্যাংডনের মনে পড়ে গেল : The dark religions must depart, so sweet science can reign.
দূর্গের চূড়ায় একা একা বসে দূরের চকচকে পানির দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে ল্যাংডন। দুনিয়া থেকে একদম বিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে তার নিজেকে। দূর্গের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় বড় করে একটা শ্বাস নিলো সে। ভোলার চেষ্টা করছে উইনস্টনের কণ্ঠস্বর। এই বাগানের মধ্যে হঠাৎই অ্যাম্ব্রার কথা মনে হলো তার, কথা বলতে ইচ্ছে করছে তার সাথে। তাকে সব খুলে বলতে চায় ল্যাংডন। কিন্তু এডমন্ডের ফোনটা পকেট থেকে বের করার পর সে বুঝতে পারে, ফোনটা করা সম্ভব হবে না তার পক্ষে।
প্রিন্স হুলিয়ান এবং অ্যাম্ব্রার একান্তে কিছু সময় কাটানো দরকার এখন। এটা পরেও বলা যাবে।
ফোনের w লেখা বাটনটার দিকে চোখ গেল তার। ল্যাংডন মোটেও ভীতু স্বভাবের নয়, কিন্তু ও জানে, এই ফোনটা ব্যবহার করা কখনই সম্ভব হবে না তার পক্ষে। সবসময়ই মনে হবে যেন কিছু একটা লুকোনো আছে এর। প্রোগ্রামিংয়ে।
একটা সরু ফুটপাথ ধরে হেঁটে কতগুলো গাছের নিচে চলে আসলো সে। কিছুক্ষণ ভেবে হাতের ফোনটা নামিয়ে রাখলো একটা পাথরের ওপর। এরপর আরেকটা পাথর তুলে নিয়ে সেটা সজোরে নামিয়ে আনলো ফোনটার ওপর। চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল সেটা।
পার্ক থেকে বের হয়ে যাবার সময় ফোনের ভাঙা টুকরোগুলো ময়লার বাক্সে ফেলে দিয়ে পাহাড়ের দিকে ফিরে চললো। হাঁটার সময় মানসিকভাবে কিছুটা হালকা মনে হচ্ছে নিজেকে।
.
শেষকথা
সাগ্রাদা ফামিলিয়ার বিশাল গম্বুজগুলোর ওপরে উঁকি দিচ্ছে শেষ বিকেলের রূপালী রোদ, সেগুলোর ছায়া গিয়ে পড়ছে নিচের প্লাজা দে গওদি জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যুরিস্টদের লাইনের ওপর।
ল্যাংডনও তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের প্রেমিক প্রেমিকাদের সেলফি তুলতে দেখছে, পর্যটকদের ভিডিও করতে দেখছে। বাচ্চারা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে, কেউ টাইপিঙে ব্যস্ত-খেয়ালই নেই আশের বিশাল ব্যাসিলিকার প্রতি।
এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনে গতকাল রাতে বলা হয়েছে, প্রযুক্তি মানুষে মানুষে যোগাযোগ কমিয়ে দিচ্ছে। আগে যেখানে গড়ে একজন মানুষ অন্য ছয়জনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতো এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে চারে।
কিছুদিনের মধ্যে সেই সংখ্যাটা হয়ে যাবে শূন্য-ভাবলো ল্যাংডন। সেই সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এগিয়ে যাবে মানুষের বুদ্ধিমত্তার চেয়ে এবং প্রযুক্তি পুরোপুরি গ্রাস করে নেবে মানবতাকে।
এখনকার যুগের মানুষকে আদিম বলে গণ্য করা হবে তখন।
ভবিষ্যৎ কেমন হতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে ভাবা শুরু করতে চায় না ল্যাংডন, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে, প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে তার ধর্মের জন্যে।
অবশেষে ব্যাসিলিকায় ঢোকার পর পরিচিত একটা প্রশান্তির অনুভূতি গ্রাস করে নিলো তাকে তবে গতরাতের মত ভৌতিক নয় অনুভূতিটা।
আজকের সাগ্রাদা ফামিলিয়া জীবন্ত।
এই বিকেল বেলা নিজের পূর্ণ সৌন্দর্য নিয়ে নিজেকে মেলে ধরেছে গওদির অমর সৃষ্টি। পর্যটকরা মুগ্ধ চোখে অবলোকন করছে সবকিছু, চেহারায় বিস্ময়।
ব্যাসিলিকার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ল্যাংডনের চোখে পড়লো প্রকৃতি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সৃষ্ট জৈব কাঠামোর নক্সাগুলোর দিকে। অনেকের মতে ছাঁদের মাঝখানটা তৈরি করা হয়েছে মাইক্রোস্কোপের ভেতর দিয়ে দেখা কোন কোষের জটিল গঠনের অনুকরণে। ল্যাংডন একমত পোষণ করলো ধারণাটার সাথে।
প্রফেসর? একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ডেকে উঠলো এই সময়। ঘুরে ফাদার বেনাকে হেঁটে আসতে দেখলো সে। আমি দুঃখিত, বললেন ছোটোখাটো মানুষটা, আমি এই মাত্র খবর পেলাম, লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আপনি। আমাকে ফোন দিলেই পারতেন।
ধন্যবাদ ফাদার। কিন্তু লাইনে দাঁড়ানোয় ফ্যাসেডগুলো ভালোমতো দেখতে পেরেছি। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো ঘুমাবেন আজকে।
ঘুম? ফাদার বেনা হেসে বললেন, সেটা নাহয় কাল।
গত রাতের চেয়ে আজকের পরিবেশটা একদমই ভিন্ন, আশেপাশে ইঙ্গিত করে বলল ল্যাংডন।
প্রাকৃতিক আলোয় সবকিছুই অন্যরকম লাগে, প্রফেসর, বেনা জবাব দিলেন, তাছাড়া কাল এখানে এত মানুষও ছিল না, এটুকু বলে ল্যাংডনের চোখের দিকে তাকালেন তিনি, আজ যেহেতু এখানে এসেই পড়েছেন, একটা ব্যাপারে আপনার মতামত চাই। একটু নিচে আসুন আমার সাথে।
ভিড়ের মধ্য দিয়ে ফাদার বেনার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো ল্যাংডন। ওপর থেকে ভেসে আসছে ঠোকাঠুকির শব্দ। এখনও নির্মাণকাজ চলছে, এটা মনে করিয়ে দিচ্ছে সবাইকে।
গত রাতে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা দেখেছিলেন?
এই পর্যন্ত তিনবার দেখা হয়ে গেছে, হেসে বললেন ফাদার বেনা। এন্ট্রপির এই ব্যাপারটা, মানে প্রকৃতির শক্তির পরিব্যাপ্তির তত্ত্বটা বেশ ভাবিয়েছে আমাকে। জেনেসিসের সাথে বেশ মিল আছে ওটার। আমি যখন বিগ ব্যাংয়ের কথা চিন্তা করি, কল্পনা করি যে আলো ছড়িয়ে পড়ছে পুরো মহাবিশ্বজুড়ে, আগে যে জায়গাগুলো চির আঁধারে নিমজ্জিত ছিল সেখানেও আলো পৌঁছে যাচ্ছে।
ভ্যাটিকান থেকে কোন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়া হয়েছে? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো, ভাবছে, ফাদার বেনা যদি তার শৈশবকালের যাজক হতেন তাহলে ভালো হতো।
তারা চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুটা, কাঁধ ঝাঁকালেন ফাদার বেনা, মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। মানুষের উৎপত্তির ব্যাপারটা খ্রিস্টানদের জন্যে বরাবরই একটা স্পর্শকাতর বিষয়। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তবে আমি বলবো ব্যাপারটা চিরতরের মত মিটিয়ে দেয়া উচিত।
কিভাবে সেটা সম্ভব? জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন।
আমাদের তেমনটাই করা উচিত যেটা পৃথিবীর অনেক চার্চ ইতিমধ্যেই করেছে। বিবর্তনবাদকে মেনে নেয়া উচিত। যে সকল খ্রিস্টান অন্য কিছু দাবি করে তারা আমাদের সবাইকে বোকা হিসেবে উপস্থাপন করছে।
ল্যাংডন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো বৃদ্ধ যাজকের দিকে।
আহ্হা! হেসে বললেন ফাদার বেনা, এতটা অবাক হবার কিছু নেই। আমার বিশ্বাস, যে ঈশ্বর আমাদের এত মেধা, চিন্তাশীলতা এবং বুদ্ধি দান করেছেন তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন-
-সেগুলোর যথার্থ ব্যবহার করি আমরা।
গ্যালিলিওর কথাটার সাথে আপনিও পরিচিত দেখছি। পদার্থবিজ্ঞানকে ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসি আমি। সেজন্যেই সাগ্রাদা ফামিলিয়া আমার জন্যে এতটা গুরুত্ব বহন করে। এটাকে ভবিষ্যতের চার্চ বলে মনে হয় আমার কাছে…সরাসরি প্রকৃতির সাথে সংযোগ যেটার।
ল্যাংডন ভাবলো, সাগ্রাদা ফামিলিয়া হয়তো একদিন নবযুগের রোমের প্যান্থিওন হিসেবে গণ্য হবে। যার এক পা অতীতে এবং আরেক পা ভবিষ্যতে। নতুন এবং পুরান বিশ্বাসের মেলবন্ধন। আর সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার প্রকৃত গুরুত্ব সবার কল্পনার চাইতেও বেশি।
বেনা এখন ল্যাংডনকে গত রাতের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নিয়ে যাচ্ছেন।
সমাধিক্ষেত্রে।
ব্যাপারটা আমার জন্যে একদম পরিষ্কার, ফাদার বেনা বললেন। খ্রিস্টান ধর্ম যদি ভবিষ্যতের বিজ্ঞানের যুগে টিকে থাকতে চায় তবে একটাই উপায় আছে মাত্র। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে প্রত্যাখান করার অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে আমাদের। বরং বিজ্ঞানকে সঙ্গে নিয়ে সামনে এগোতে হবে। এমন আচার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে যেন আগামী দিনের প্রযুক্তি একত্রিত করে আমাদের, দূরে না ঠেলে দিয়ে।
আপনার সাথে একমত আমি, ল্যাংডন বলল। আশা করি বিজ্ঞানও আপনাদের বাড়িয়ে দেয়া হাত গ্রহণ করবে।
নিচে নেমে আন্তোনি গদির সমাধির পাশ দিয়ে হেঁটে এডমন্ডের উইলিয়াম ব্লেকের বইটার ডিসপ্লের সামনে গেলেন তিনি। এটার ব্যাপারে আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই আমি।
ব্লেকের বইটার ব্যাপারে?
হ্যাঁ, মি. কিয়াকে কথা দিয়েছিলাম আমি যে বইটা এখানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবো কারণ আমার ধারণা ছিল তিনি হয়তো এই ছবিটা সবাইকে দেখাতে চাইছেন।
ব্লেকের নিজস্ব পুরাণের ইউরিজেনকে একটা কম্পাস হাতে স্বর্গ থেকে মত মাপতে দেখা যাচ্ছে।
তবে এখন আমার মনে হচ্ছে, ফাদার বেনা বললেন, কিয়ার্শ হয়তো আগের পাতার লেখার জন্যে এটা প্রদর্শন করতে বলেছেন। শেষ পঙক্তিটা পড়ুন।
সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়লো না ল্যাংডনের। The dark religions must depart, so sweet science can reign?
আপনি জানেন সেটা? জিজ্ঞেস করলেন বেনা।
হ্যাঁ, হাসলো ল্যাংডন।
এখানকার তমসাচ্ছন্ন ধর্ম কথাটা পীড়া দিচ্ছে আমাকে। মনে হচ্ছে ব্লেক যেন ধর্মকে দোষারোপ করছেন।
অনেকেই ভুল বোঝে কথার অর্থ, ল্যাংডন বলল, আসলে ব্লেক নিজেও আধ্যাত্মিক সত্তায় বিশ্বাস করতেন। তবে আঠারশ শতাব্দির ইংল্যান্ডের কুসংস্কারাচ্ছন্ন খ্রিস্টান ধর্মকে মোটেও পছন্দ করতেন না তিনি। তার বিশ্বাস ছিল ধর্ম দুধরণের; তমসাচ্ছন্ন ধর্ম যেটা কূপমুণ্ডকতায় বিশ্বাসি, আর অপরটা আলোর ধর্ম যা নতুন জ্ঞানকে আপন করে নিয়ে বিকশিত হয়, সৃজনশীলতার মূল্যায়ণ করে।
ফাদার বেনাকে দেখে অবাক মনে হলো।
ব্লেকের শেষ লাইনটার এমন অর্থও হতে পারে যে-বিজ্ঞান কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মকে দূর করে আলোর ধর্মের পথ বিকশিত করবে।
অনেকক্ষন চুপ করে কিছু ভাবলেন ফাদার বেনা, এরপর ধীরে একটা হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। ধন্যবাদ প্রফেসর, একটা অস্বস্তিকর চিন্তা থেকে মুক্ত করলেন আপনি আমাকে।
ওপরতলায় উঠে ফাদারের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর আশেপাশের আরও অনেকের মত একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো ল্যাংডন। উপভোগ করতে লাগলো সাগ্রাদা ফামিলিয়ার আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য।
পৃথিবীর সবগুলো ধর্ম নিয়ে চিন্তা করতে লাগলো সে। কিছু কিছু ব্যাপার মিলে যায় প্রত্যেকটা ধর্মেই। ভাবলো, এক কালে সূর্য, চাঁদ, সমুদ্র এবং বাতাসকে দেবতা মানা হতো।
প্রকৃতিই বিশ্বাসের মূল উৎস ছিল একসময়।
সবার জন্যে।
অবশ্য সেই ঐক্য হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। প্রত্যেক ধর্মই দাবি করে যে কেবল তারাই প্রকৃত ধর্ম।
তবে আজকে এই বিশাল উপাসনালয়ের ভেতরে বসে নানা বর্ণ, ধর্ম, জাতের মানুষকে তন্ময় হয়ে ওপরের ছাদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে দেখলো সে। সবাই একই জিনিসের বন্দনা করছে।
পাথরে সূর্যরশ্মির প্রতিফলন।
একসাথে অনেকগুলো ছবি ভেসে উঠলো ল্যাংডনের মনের পর্দায়-স্টোনহেঞ্জ, পিরামিড, অজন্তা গুহা, আবু সিম্বেল, গোবলেকি টেপে-এমন সব জায়গা যেখানে সবাই একই জিনিসের সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে জড়ো হয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে ল্যাংডন মাটির নিচে মৃদু কম্পন টের পেলো, ঘুরতে ঘুরতে কক্ষপথের একদম শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ধর্মচিন্তা…আর অবশেষে এই ক্লান্ত পরিভ্রমণ শেষে ফিরে আসছে মানুষের মাঝে।