অধ্যায় ৬১:
হট্টগোলের মাঝেই ল্যাংডন এবং এজেন্ট ডিয়াজের সহায়তায় হেলিকপ্টারে উঠে পড়লো অ্যাম্ব্রা। বাঁধা যে দেবে সেই শক্তিটুকুও নেই।
রক্ত ঝরছে তার বাম হাত থেকে! হেলিকপ্টারে উঠেই চেঁচিয়ে জানালো প্রফেসর ল্যাংডন।
একবার ঝাঁকি খেয়ে ওপরে উঠে গেল হেলিকপ্টারটা। নিচ থেকে পুলিশ অফিসাররা চেয়ে রইল বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে।
হেলিকপ্টারের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সামনে পাইলটের পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়লো এজেন্ট ফনসেকা। ডিয়াজ এসে বসলো অ্যাম্ব্রার পাশে।
তার হাতের ক্ষতটা দেখতে লাগলো।
কেটে গেছে শুধু, বলল ও।
ফাস্ট এইড কিটটা আনছি, এই বলে কেবিনের পেছনের অংশে চলে গেল এজেন্ট ডিয়াজ।
ল্যাংডন বসে আছে অ্যাম্ব্রার বিপরীত দিকে। একবার চোখাচোখি হতে তার উদ্দেশ্যে একটা হাসি দিলো প্রফেসর, আপনি ঠিক আছেন দেখে ভালো লাগছে।
জবাবে আস্তে করা মাথা নাড়লো অ্যাম্ব্রা। কিছু বলার আগেই তার দিকে ঝুঁকে আসলো ল্যাংডন। ফিসফিসিয়ে বলল, আমাদের রহস্যময় কবির খোঁজ পেয়েছি বোধহয়, চকচক করছে তার চোখ। উইলিয়াম ব্লেক। এডমন্ডের লাইব্রেরিতে উইলিয়াম ব্লেকের সব কাজের একটা ভলিউম আছে। আর ব্লেকের কবিতাগুলো এক একটা ভবিষ্যত্বাণী! এটুকু বলে অ্যাম্ব্রার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো ল্যাংডন, আমাকে এডমন্ডের ফোনটা দিন। উইনস্টনকে ব্লেকের কবিতাগুলোর মাঝে খুঁজে দেখতে বলি, সাত চল্লিশ অক্ষরের পঙক্তিটা খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগার কথা না ওর।
ল্যাংডনের বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে ভীষণ অপরাধবোধে আক্রান্ত হলো অ্যাম্ৰা। সামনে ঝুঁকে ল্যাংডনের হাতে হাত রেখে বলল, রবার্ট, এডমন্ডের ফোনটা হারিয়ে গেছে। ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেছে ওটা, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর বুক চিড়ে।
বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো ল্যাংডন। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। আমি দুঃখিত, রবার্ট, মনে মনে বলল ও। খবরটা হজম করতে যে বেগ পেতে হচ্ছে ল্যাংডনকে, সেটা তার চেহারায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠতে দেখলে অ্যাম্ব্রা।
ককপিটে, এজেন্ট ফনসেকা ফোনে কারও সাথে কথা বলছে। তারা দুজনই এখন আমাদের সাথে হেলিকপ্টারে। মাদ্রিদে যাবার জন্য প্লেনটাকে তৈরি রাখতে বলল। আমি প্রাসাদে যোগাযোগ করে জানিয়ে…
দরকার নেই জানানোর! চিল্লিয়ে এজেন্টের উদ্দেশ্যে বলল অ্যাম্ব্রা। প্রাসাদে যাবো না আমি।
সিট থেকে পেছনে ফিরে সরাসরি ওর দিকে তাকালো লোকটা, অবশ্যই যাবেন! আমার ওপর নির্দেশ ছিল আপনাকে যে কোন মূল্যে নিরাপদ রাখার। ওভাবে জাদুঘর থেকে পালানোটা একদমই উচিত হয়নি আপনার। ভাগ্য। ভালো, আমরা ঠিক সময়মত এসে আপনাকে উদ্ধার করতে পেরেছি।
উদ্ধার?! রাগ ঝরে পড়ছে অ্যাম্ব্রার কণ্ঠে, উদ্ধার করার দরকারটা কী ছিল, শুনি? প্রাসাদ থেকে তো মিথ্যে বলা হয়েছে আমাকে অপহরণের ব্যাপারে। আর আপনি সেটা ভালোমতোই জানতেন। প্রিন্স হুলিয়ান কি এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, একজন নিরীহ মানুষের জীবন নিয়ে খেলছে? আমার নিরাপত্তার কথাটাও তো ভাবেনি সে।
কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার সামনে ফিরলো এজেন্ট ফনসেকা।
ঠিক তখনই পেছন থেকে ফাস্ট এইড কিট নিয়ে ফিরলো ডিয়াজ।
মিস ভিদাল, তার পাশে বসে শান্তস্বরে বলল সে, দয়া করে আমাদের। আজকের রাতের পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করুন। আমাদের বাহিনীর প্রধান, কমান্ডার গারজাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাই সবকিছু ঘোলাটে লাগছে আমার নিজের কাছেও। তবুও, আপনাকে এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি আমি, যুবরাজ হুলিয়ানের এসবের সাথে কোন সম্পৃক্ততা নেই, বিবৃতিটাও। তিনি দিতে বলেননি। এমনকি তার সাথে গত এক ঘন্টা ধরে যোগাযোগ করতে পারছি না আমরা।
কি? তার দিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা। কোথায় ও?
এখন তিনি কোথায় আছেন সেটা ঠিক জানা নেই কারও, ডিয়াজ বলল। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় তিনি আমাদের যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটা একদম পরিষ্কার, আপনাকে যে কোন অবস্থায় নিরাপদ দেখতে চান তিনি।
এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, ল্যাংডন বলল হঠাৎ, এতক্ষণ কিছু একটা ভাবছিলো সে, তাহলে মিস ভিদালকে প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া একটা মারাত্মক ভুল হবে।
এজেন্ট ফনসেকা ফিরে তাকালো তার দিকে, কী বললেন আপনি?!
আমি ঠিক জানি না আপনাদের এখন কে নির্দেশ দিচ্ছে, বলল ল্যাংডন, কিন্তু আপনারা যদি আসলেই প্রিন্স হুলিয়ানের বাগদত্তাকে নিরাপদ। রাখতে চান তাহলে আমার কথা শুনুন মনোযোগ দিয়ে, গম্ভীর হয়ে উঠলো তার চেহারা, এডমন্ড কিয়াকে হত্যা করা হয়েছে যাতে তার আবিষ্কার সে পৃথিবীর সামনে উন্মোচন না করতে পারে। আর, যে বা যারা এই কাজ করেছে। তারা কখনোই তাদের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না।
তাদের লক্ষ্য তো পূরণ হয়েই গেছে, অবজ্ঞার সুরে বলল ফনসেকা, মারা গেছেন এডমন্ড।
কিন্তু তার আবিষ্কার কিন্তু হারিয়ে যায়নি এখনও, ল্যাংডন বলল। সেটাকে এখনও পুরো পৃথিবীর সামনে উন্মোচন করা যাবে।
এজন্যেই তার অ্যাপার্টমেন্টে এসেছিলেন আপনারা, বলল ডিয়াজ, তার প্রেজেন্টেশনটা উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে?
ঠিক বলল ল্যাংডন, আর সেজন্যেই আমরা শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে। পরিণত হয়েছি। আমি অ্যাম্ব্রাকে অপহরণ করেছি এটা কে বলেছে জানি না, তবে এসব সাজানো হয়েছে আমাদের থামানোর জন্যে। আর আপনারা যদি সেই দলের লোক হয়ে থাকেন, যারা এডমন্ডের আবিষ্কারকে আলোর মুখ দেখতে দিতে চান না, তাহলে এই মুহূর্তে আমাকে আর মিস ভিদালকে। হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেয়া উচিত আপনাদের।
অ্যাম্ব্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো ল্যাংডনের দিকে। লোকটা কি পাগল হয়ে গেল?
আর যদি, আবার শুরু করলো ল্যাংডন, রাজপরিবারের সদস্যদের রক্ষা করাই আপনাদের দায়িত্ব হয়ে থাকে তবে মিস ভিদালকে প্রাসাদে নিয়ে যাবেন না আপনারা। সেটাই এখন তার জন্যে সবচেয়ে অনিরাপদ স্থান। ঐ মিথ্যেটার জন্যে কিন্তু মৃত্যুও হতে পারতো ভবিষ্যৎ রাণীর, এটা আপনারাও ভালো করেই জানেন, এটুকু বলে পকেট থেকে একটা দামি কাগজের নকশা। করা নোটকার্ড বের করলো সে। আমাদের এখন এই ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া উচিত আপনাদের।
কার্ডটা ল্যাংডনের হাত থেকে নিয়ে ঠিকানাটা পড়লো ফনসেকা। ভ্রু কুঁচকে বলল, অসম্ভব!
পুরো জায়গাটা ঘিরে একটা প্রতিরক্ষা বেষ্টনি আছে, ল্যাংডন বলল। আপনাদের পাইলট চাইলেই আমাদের চারজনকে সেখানে নিরাপদে নামিয়ে দিয়ে সরে পড়তে পারবে। কেউ জানবেও না, আমরা সেখানে আছি। ওখানকার দায়িত্বে যিনি আছেন তাকে চিনি আমি। সেখানে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পারি আমরা। আপনারাও নাহয় থেকে গেলেন আমাদের সাথে।
এর চেয়ে বরং এয়ারপোর্টের সামরিক হ্যাঙ্গারেই নিরাপদ থাকবেন মিস ভিদাল।
আপনারা কি আসলেই সামরিক দলটাকে বিশ্বাস করতে চান? এমনও হতে পারে যে, যারা আমার আর মিস ভিদাল সম্পর্কে মিথ্যে বলেছে তাদের। কাছ থেকেই নির্দেশ পাচ্ছে দলটা?
ফনসেকার অনুভূতিহীন চেহারার কোন নড়চড় হলো না।
অ্যাম্ব্রা মস্তিষ্কে চিন্তার ঝড় বইছে। কার্ডটায় কি লেখা সেটা ভাবছে ও। ল্যাংডন কোথায় যাওয়ার কথা বলছেন? যেভাবে কথা বলছে সে, শুনে তো মনে হচ্ছে অ্যাম্ব্রার নিরাপত্তা ছাড়াও আরও কোন ব্যাপার মাথায় ঘুরছে তার। অর্থাৎ এখনও এডমন্ডের আবিষ্কারটার ব্যাপারে আশা আছে।
ফনসেকার হাত থেকে লিনেনের কার্ডটা ফেরত নিয়ে সেটা অ্যাম্ব্রার হাতে দিলো ল্যাংডন। এটা এডমন্ডের লাইব্রেরিতে পেয়েছি আমি।
কার্ডটার দিকে এক ঝলক দেখেই অ্যাম্ব্রা বুঝে গেল কী ওটা।
এগুলো টাইটেল কার্ড বলা হয়। সুন্দর নকশার এম্বস করা এই কার্ডগুলো জাদুঘরের পরিচালকরা তাদের ডোনারদের দিয়ে থাকেন, যখন তাদের কাছ থেকে কোন মূল্যবান শিল্পকর্ম ধারে প্রদর্শন করার জন্যে নেন তারা।
প্রথানুযায়ী দুটো একই রকম দেখতে কার্ড ছাপানো হয়। একটা জাদুঘরে ডিসপ্লেতে রাখা থাকে ডোনারকে ধন্যবাদ জানানোর জন্যে, অন্যটা ডোনারকে দেয়া হয় ধার দেয়ার স্বীকৃতি স্বরূপ। যদি দাতার দেয়া শিল্পকর্মের কোন ক্ষতি হয় তবে জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
এডমন্ড তার ব্লেকের কবিতার বইটা ধার দিয়েছে?
তবে কার্ডের লেখা অনুযায়ি খুব দূরে কোথাও বইটা ধারে দেয়নি এডমন্ড। বার্সেলোনাতেই আছে ওটা।
দ্য কমপ্লিট ওয়ার্কস অব উইলিয়াম ব্রেক
এডমন্ড কিয়ার্শের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে লা ব্যাসিলিকা দে লা সাগ্রাদা ফামিলিয়াতে ধার দেয়া হয়েছে
কারের দে মায়োরর্ক, ৪০১
০৮০১৩ বার্সেলোনা, স্পেন
বুঝলাম না, অ্যাম্ব্রা বলল, একজন স্বঘোষিত নাস্তিক কেন কোন চার্চকে একটা বই ধার দেবে?।
যে কোন চার্চ নয়, ল্যাংডন বলল হেসে, গওদির সবচেয়ে সেরা কাজ এটা…এটুকু বলে জানালার বাইরে নির্দেশ করলো সে, খুব শিঘ্রই এটা ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু চার্চের মর্যাদা পেতে চলেছে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো অ্যাম্ব্রা, শহরের উত্তর দিকে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাগ্রাদা ফামিলিয়া। চাৰ্চটার উঁচু গম্বুজগুলোর ছিদের কারণে দূর থেকে দেখলে মনে হয় কয়েকটা সামুদ্রিক স্পঞ্জ যেন আকাশ ছোঁয়ার পায়তারা করছে। তবে সেগুলোকে ঘিরে রয়েছে উঁচু উঁচু ক্রেন এবং কন্সট্রাকশন লাইট।
একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্মাণ কাজ চলছে গওদির ব্যাসিলিকা দে লা সাগ্রাদা ফামিলিয়ার। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানের ওপর নির্ভরশীল হওয়াতে ধীর গতিতে এগোচ্ছে কাজ। শুরু থেকেই গওদিকে ঐতিহ্যবাদিদের ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে এর অদ্ভুত নকশার কারণে। কিন্তু গওদি বরাবরই প্রকৃতি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার নকশাগুলো করতেন। তাই আধুনিকতাবাদিদের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন সবসময়। সাম্ৰাদা ফামিলিয়ার ক্ষেত্রে বায়োমাইমেটিক এবং হাইপারবলয়েড ধাঁচের নকশা ব্যবহার করেছেন প্রকৃতিকে উপস্থাপন করার জন্যে।
চাৰ্চটার নকশা একটু ব্যতিক্রমি, মানছি, বলল অ্যাম্ব্রা, তবুও এটা একটা ক্যাথলিক চার্চ। আর আপনি তো এডমন্ডকে ভালোমতই চিনতেন।
অবশ্যই ভালো করেই চিনতাম, ল্যাংডন ভাবলো, সেজন্যেই এটাও জানি, তার ধারণা ছিল সাগ্রাদা ফামিলিয়ার নকশা খ্রিস্টধর্মের বাইরেও গুপ্ত এক বার্তা উপস্থাপন করছে।
১৮৮২ সালে চার্চটার জন্যে ভূমি খনন শুরু হবার পর থেকেই বিভিন্ন জল্পনা কল্পনা শুরু হয় এর অদ্ভুত নকশার দরজা, প্যাঁচানো থাম, মূর্তি সংবলিত সম্মুখভাগ ঘিরে। এমনকি একটা দেয়ালে ষোলটা বর্গাকৃতির ঘর কেটে সেখানে সংখ্যা খোদাই করা হয়েছে। তাছাড়া পুরো স্থাপনাটা ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, প্রাণীর আদলের সাথে বেশ মিল রয়েছে নক্সাটার।
সাগ্রাদা ফামিলিয়ার নক্সা আসলে কী উপস্থাপন করছে সে ব্যাপারে বেশ কয়েকটা তত্ত্ব সম্পর্কে অবগত ল্যাংডন, কিন্তু ওগুলোর কোনটাকেই কখনো আমলে নেয়নি সে। তবে একবার এডমন্ডের কাছে এটা শুনে অবাক হয়েছিল যে আন্তোনি গদির অনেক ভক্তের মত সেও বিশ্বাস করে, খ্রিস্টিয় ধর্মের বাইরেও গোপনে বিজ্ঞান এবং প্রকৃতির প্রতি সম্মান স্বরূপ সাগ্রাদা ফামিলিয়ার নক্সা করা হয়েছে। তবে তার সাথে একমত প্রকাশ করতে পারেনি ল্যাংডন। বরং এটা মনে করিয়ে দিয়েছিল যে আন্তোনি গওদি একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক ছিলেন। এমনকি চার্চ থেকে তাকে দ্য গডস আর্কিটেক্ট উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
জবাবে একটা চতুর হাসি ফুটে উঠেছিল এডমন্ডের চেহারায়, যেন গোপন কোন তথ্য জানা আছে তার, কিন্তু সেটা তখনই বলতে চাইছে না সে।
কিয়ার্শের আরেকটি গুপ্ত রহস্য, ল্যাংডন ভাবলো, তার ক্যান্সারের ব্যাপারটার মতন।
যদি সাগ্রাদা ফামিলিয়াতে গিয়ে এডমন্ডের ধার দেয়া বইটা পাইও আমরা, অ্যাম্ব্রা বলল, তবে প্রতিটা পাতা উল্টিয়ে সঠিক পঙক্তিটা বের করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এরকম অমূল্য একটা বইয়ে নিশ্চয়ই কলম দিয়ে দাগায়নি সে।
অ্যাম্ব্রা, শান্তভাবে হেসে বলল ল্যাংডন, কার্ডটার অপর পিঠে কী লেখা আছে দেখুন।
কার্ডটা উল্টে অপর পাশের লেখাটা পড়লো ও।
আবারও অবিশ্বাসের ছাপ ভর করলো তার চেহারায়। তবে এবার আশাতুর দৃষ্টিতে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে।
যেমনটা বলছিলাম আমি, ল্যাংডন এখনও হাসছে, আমাদের ওখানে যাওয়া উচিত।
হঠাৎ করেই অ্যাম্ব্রার মুখটা কালো হয়ে গেল আবার। আমরা যদি পাসওয়ার্ডটা খুঁজে পাইও বলা শুরু করলো সে।
কোন লাভ হবে না, কারণ উইনস্টনের সাথে যোগাযোগ হারিয়েছি আমরা, তার মুখের কথাটা শেষ করে দিলো ল্যাংডন।
হ্যাঁ!
আমার বিশ্বাস সেই সমস্যারও সমাধান করতে পারবো আমি।
সন্দেহের দৃষ্টিতে ল্যাংডনের দিকে তাকালো অ্যাম্বু, বুঝতে পারলাম না।
উইনস্টনকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। মানে, মূল কম্পিউটার যেটা তৈরি করেছিলো এডমন্ড নিজে। যদি দূর থেকে উইনস্টনের সাথে যোগাযোগ করতে না পারি আমরা, তাহলে তার কাছে যেতে হবে।
অ্যাম্ব্রা এমন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো যেন পাগলের প্রলাপ বকছে সে।
আপনি আমাকে বলেছিলেন, এডমন্ড এক গোপন জায়গায় উইনস্টনকে তৈরি করেছে।
হ্যাঁ, কিন্তু সেটা তো পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে হতে পারে।
না, বার্সেলোনাতেই সেটা। কারণ এখানেই থাকতত এডমন্ড, ওর কর্মস্থলও এখানেই। সিন্থেটিক ইন্টেলিজেন্স মেশিন ওর সর্বশেষ প্রজেক্টগুলোর একটি। আর ক্যান্সারে ভুগছিল ও, বেশি দৌড়ঝাঁপ করাও সম্ভব হতো না ওর পক্ষে। তাই আমার ধারণা উইনস্টনকে আশপাশেই কোথাও তৈরি করেছে এডমন্ড।
রবার্ট, আপনার ধারণা যদি ঠিকও হয়, তবুও আমি বলবো, খড়ের গাঁদায় সুঁই খোঁজার মত হবে ব্যাপারটা। বিশাল এক শহর বার্সেলোনা। এখানে-
উইনস্টনকে খুঁজে বের করতে পারবো, ল্যাংডন বলল, সে ব্যাপারে। নিশ্চিত আমি। হেসে নিচের বার্সেলোনা শহরের দিকে নির্দেশ করলো সে। আপনার শুনে হয়তো অদ্ভুত লাগবে। কিন্তু ওপর থেকে বার্সেলোনা শহরকে দেখে একটা জিনিস মাথায় এসেছে আমার…
কথাটা না শেষ করে আবারো বাইরে তাকালো সে। একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন আমাকে? আগ্রহি স্বরে বলল অ্যাম্ব্রা।
ব্যাপারটা আরো আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার, জবাবে বলল ল্যাংডন। উইনস্টনের একটা ব্যাপার শুরু থেকেই খোঁচাচ্ছিল আমাকে। এতক্ষণে ওটা ধরতে পেরেছি আমি।
গার্ডিয়া রিয়েলের এজেন্টদের দিকে একবার তাকিয়ে সামনে ঝুঁকে এসে প্রায় ফিসফিস করে অ্যাম্ব্রার উদ্দেশ্যে বলল, আমার ওপর ভরসা রাখুন, মিস ভিদাল। আমার বিশ্বাস উইনস্টনকে খুঁজে বের করতে পারবো আমি। কিন্তু পাসওয়ার্ডটা না জানতে পারলে উইনস্টনকে পেলেও কোন লাভ হবে না। সেজন্যে কবিতার পঙক্তিটা বের করতে হবে আমাদের। সাগ্রাদা ফামিলিয়াই আমাদের মূল ভরসা এখন।
অনেকক্ষণ ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে থাকলো অ্যাম্ব্রা। এরপর লম্বা করে একবার শ্বাস নিয়ে সামনের সিটে বসে থাকা এজেন্টের উদ্দেশ্যে বলল, মি. ফনসেকা! দয়া করা পাইলটকে বলুন যাতে আমাদের সাগ্রাদা ফামিলিয়ার কাছে নামিয়ে দেয়।
ঘুরে তার দিকে তাকালো এজেন্ট ফনসেকা, মিস ভিদাল, আপনাকে আগেও বলেছি, আমাদের ওপর নির্দেশ আছে।
এজেন্ট ফনসেকা, তার কথার মাঝেই বলে উঠলো স্পেনের হবু রাণী, আমাদের এখনই সাগ্রাদা ফামিলিয়াতে নিয়ে যান, নতুবা এখান থেকে ফেরার পর আমার প্রথম কাজ হবে আপনাকে চাকরি থেকে অব্যাহতির ব্যবস্থা করা।
.
অধ্যায় ৬২
কন্সপিরেসিনেট.কম
ব্রেকিং নিউজ
গুপ্তঘাতক কাল্ট জড়িত।
আমাদের তথ্যদাতাকে (monte@iglesia.org) আবারো ধন্যবাদ, কিছুক্ষণ আগে আমাদের তিনি জানিয়েছেন, এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যাকারী একজন অতি সংরক্ষনশীল, গোপন খ্রিস্টিয় সংগঠন-পালমেরিয়ান চার্চের সদস্য! লুই আভিলাকে পালমেরিয়ানদের জন্যে নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজ চালিয়ে আসছিল অনেক দিন যাবত। আর এবার এই প্রাক্তন সামরিক সদস্যকে পালমেরিয়ান চার্চ কাজে লাগিয়েছে এডমন্ড কিয়াকে হত্যা করতে। তার হাতের ভিক্টর ট্যাটুর রহস্যও বোঝা গেল এবার।
ট্যাটু
এই ফ্রাঙ্কোইস্ট প্রতীকটি পালমেরিয়ান চার্চের সদস্যরা নিয়মিত ব্যবহার করে আসছে। স্প্যানিশ জাতীয় দৈনিক, এল পাইস-এর মতে পালমেরিয়ানদের নিজস্ব পোপও আছে। আর তারা ইতিহাসের ঘৃণ্য শাসক- ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো এবং এডলফ হিটলারকে সেইন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে।
আমাদের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? নিজে খোঁজ নিয়ে দেখুন।
এসবের শুরু ১৯৭৫ সালে। ক্লেমেন্তে ডমিনগেজ নামের একজন ইলুরেন্স ব্রোকার হঠাৎই একদিন দাবি করে বসে, সে স্বপ্নে দেখেছে জিশু নিজে তাকে পোপ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। তাই নিজেকে সপ্তদশ গ্রেগরি বলে আখ্যায়িত করে পোপের আসন গ্রহণ করে তৎকালীন ইস্যুরেন্স কর্মি, অবশ্যই ভ্যাটিকানের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। নিজের কার্ডিনালও নিয়োগ দেন তিনি। নোম প্রত্যাখান করে তাকে।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই অনুসারি বাড়তে থাকে এই এন্টিপোপের। দুর্গ সদৃশ একটা চার্চ তৈরি করে তারা। এল পালমার দে এয়া নামের এই চার্চকেই তাদের হেডকোয়ার্টার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এখান থেকেই পরিচালিত হয় তাদের সব কার্যকলাপ। রোম এবং ভ্যাটিকান কর্তৃক প্রত্যাখাত হওয়া সত্ত্বেও সংরক্ষণশীল ক্যাথলিকরা পালমেরিয়ান চার্চে ভিড় জমাতে শুরু করে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
বিশপ ভালদেসপিনো সম্পর্কে ও চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে পেয়েছি আমরা। ধারণা করা হচ্ছে আজকে রাতের ঘটনার সাথে জড়িত তিনি।
.
অধ্যায় ৬৩
যোগ্য রাণীই পেতে যাচ্ছে স্পেন, ভাবলো ল্যাংডন।
কিছুক্ষণ কথা বলেই গার্ডিয়া রিয়েল এজেন্টদের হেলিকপ্টারের মুখ সাম্রাদা ফামিলিয়ার দিকে ঘোরাতে বাধ্য করেছে অ্যাম্ব্রা ভিদাল। এরপর এজেন্ট ডিয়াজের কাছ থেকে তার ফোনটা নিয়ে ব্রাউজারে ঢুকে প্রধান শিরোনামগুলো দেখছে এখন।
ধুর, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল সে, ওদের এত বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাকে অপহরণ করেননি আপনি, কাজ হলো না। শুনতেই পারেনি আমার কথা।
হয়তো আরো কিছুক্ষণ সময় লাগবে এব্যাপারে লিখতে, ল্যাংডন বলল। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ছাদের ঘটনাটার পর এখনও দশ মিনিটও পার হয়নি।
নাহ, যথেষ্ট সময় পেয়েছে তারা, জবাবে বলল অ্যাম্ব্রা। এখানে কাসা মিলার ওপর হেলিকপ্টার ভেসে থাকার ভিডিও দেখতে পাচ্ছি আমি।
এত তাড়াতাড়ি? ল্যাংডনের মাঝে মাঝে মনে হয় যে পৃথিবীটা বুঝি আগের চেয়ে অনেক বেশি বেগে ঘোরে এখন। এই তো কিছুদিন আগেও ব্রেকিং নিউজ পেতে পরদিন সকালের খবরের কাগজের জন্যে অপেক্ষা করতে হতো।
আরেকটা কথা, কৌতুকের সুরে বলল অ্যাম্ব্রা, গত এক ঘন্টায় আমার এবং আপনাকে নিয়ে লেখা প্রতিবেদনগুলো অনেকবার দেখা হয়েছে। ইন্টারনেটে।
আপনাকে অপহরণ করাটা একদমি উচিত হয়নি আমার, একই স্বরে জবাব দিলো ল্যাংডন।
সবচেয়ে বেশিবার যে প্রতিবেদনটা দেখা হয়েছে সেটাও কিন্তু এডমন্ডের। সাথেই জড়িত। দেখুন এটা, এই বলে ফোনের স্ক্রিনটা ল্যাংডনের দিকে তাক করলো অ্যাম্ব্রা।
ইয়াহু! হোমপেজের সেরা দশ প্রতিবেদনের প্রথমটা দেখা যাচ্ছে সেখানে
১. এলেম আমরা কোথা থেকে?/ এডমন্ড কিয়ার্শ
এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনের বিষয়টা পুরো পৃথিবীর মানুষকে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এডমন্ড দেখলে খুশি হতো ভীষণ, ভাবলো ল্যাংডন।
কিন্তু লিঙ্কটায় ক্লিক করে যা লেখা দেখলো তাতে ভাবনাটা উবে যেতেও সময় লাগলো না। বিষয়টা সম্পর্কিত বেশিরভাগ প্রতিবেদনই লেখা হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব আর গ্রহান্তরের আগন্তুকদের নিয়ে।
এডমন্ড এটা দেখলে অপমানিত বোধ করতো।
ল্যাংডনের মনে আছে, একবার একটা টিভি অনুষ্ঠানে গিয়ে সেখানে উপস্থিত দর্শকদের ওপর একদম রেগে যায় এডমন্ড। বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতা নামের সেই অনুষ্ঠানে এডমন্ড বলে যে, এত বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও মানুষ যে কেন নিজেদের সৃষ্টির ব্যাপারে এলিয়েনদের টেনে আনে, সেটা মাথায় ঢোকে না আমার!
ফোনটা নিয়ে স্ক্রল করতে করতে অবশেষে সিএনএন লাইভে একটা লিঙ্ক পেলো সে, যেটার শিরোনাম, কী আবিষ্কার করেছিলেন এডমন্ড কিয়ার্শ?
সেই লিঙ্কটায় ক্লিক করে ফোনটা এমনভাবে ধরলো যাতে অ্যাম্ব্রাও দেখতে পায়। ভিডিওটা শুরু হলে ভলিউম বাড়িয়ে দিলো যেন হেলিকপ্টারের শব্দ ছাপিয়ে ওরা শুনতে পায় কী বলা হচ্ছে সেখানে। একজন সিএনএনের উপস্থাপিকাকে দেখা গেল পর্দায়, তাকে এর আগেও দেখেছে ল্যাংডন, আমাদের সাথে এখন যোগ দেবেন নাসার অ্যাস্ট্রোবায়োলজিস্ট ডক্টর গ্রিফিন বেনেট, বলল সে। এডমন্ড কিয়াৰ্শ কী আবিষ্কার করেছিল সে ব্যাপারে কিছু ব্যক্তিগত ধারণা আছে তার। হ্যালো, ডক্টর বেনেট।
জবাবে চশমা পরিহিত বিজ্ঞানী কেবল বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লেন একবার, বললেন, আমাকে আমন্ত্রন জানানোর জন্যে ধন্যবাদ। শুরুতেই বলে নিচ্ছি, এডমন্ডকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম আমি। তার মৃত্যু গোটা বিজ্ঞান জগতের জন্যে এক আঘাত স্বরূপ। আশা করি তার মৃত্যু থেকে শক্তি পাবো আমরা, রুখে দাঁড়াতে পারবো কুসংস্কারাচ্ছন চিন্তাধারার বিরুদ্ধে। গুজব শুনেছি, কয়েকজন এখনও কাজ করে যাচ্ছেন ওর আবিষ্কার সবার জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে, সেটা যেন সত্যি হয়।
অ্যাম্ব্রার দিকে চকিতে একবার তাকালো ল্যাংডন, আমাদের কথা বলছে।
মাথা নেড়ে সায় জানালো সে।
আপনি একা নন, অনেকেই সেটা আশা করছে, ড. বেনেট, উপস্থাপিকা বলল। আপনি কি বলতে পারবেন, এডমন্ড কিয়ার্শের আবিষ্কারের বিষয়বস্তু কী হতে পারে?
একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী আমি, ড. বেনেট বলা শুরু করলেন, তাই শুরুতেই কিছু কথা বলে নিতে চাই, সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকালেন তিনি, পৃথিবীর বাইরে প্রাণের ব্যাপারে অনেক ধরণের ভ্রান্ত ধারণা, ভুয়া তত্ত্বের প্রচলন আছে। যেমন ক্রপ সার্কেলের ব্যাপারটা পুরোটাই ধোঁকা, এলিয়েনদের ব্যবচ্ছেদ করার ছবিগুলো ফটোশপ ছাড়া কিছুই না। পিরামিড তৈরিতেও মহাজাগতিক কোন শক্তি কাজ করেনি। এই পৃথিবীর মানুষ তৈরি করেছে ওগুলো। আর এলিয়েনদের দ্বারা অপহৃত হবার ঘটনাগুলো ডাহা। মিথ্যা।
এতটা নিশ্চিত কিভাবে হচ্ছেন আপনি? মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো উপস্থাপিকা।
খুব সাধারণ কিছু যুক্তির মাধ্যমে, বিরক্তি ভর করলো ড. বেনেটের চেহারায়, যদি এমন কোন জীবসত্ত্বার অস্তিত্ব আসলেই থেকে থাকে, যারা কয়েক আলোকবর্ষ ভ্রমণ করে এই পৃথিবীতে এসেছে, তবে তারা কখনোই কাউকে অপহরণ করে সময় নষ্ট করবে না। কোন দেশের সরকারের সাথেও চুক্তিতে যাবার দরকার নেই তাদের। যাদের কাছে পৃথিবীতে আসার মত প্রযুক্তি আছে, গোটা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রন নিতে কোন বেগ পেতে হবে না তাদের।
বেশ, অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে হেসে বলল উপস্থাপিকা, মি. কিয়ার্শের আবিষ্কারের সাথে এসবের কী সম্পর্ক?
আমার ধারণা আজ রাতে এডমন্ড কিয়ার্শ ঘোষণা করতে যাচ্ছিলেন যে জীবনের উৎপত্তি পৃথিবীতে নয়, মহাশূন্যে।
সাথে সাথে অনুষ্ঠানটার ব্যাপারে আগ্রহ কমে গেল ল্যাংডনের। মহাবিশ্বের বাইরে প্রাণের ব্যাপারে কিয়ার্শের কেমন ধারণা ছিল সেটা জানা আছে তার।
কিভাবে সেটা ধারণা করলেন আপনি?
একমাত্র এটাই যুক্তিযুক্ত উত্তর বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। আমরা ইতিমধ্যেই এটার প্রমাণ পেয়েছি যে, গ্রহ থেকে গ্রহের মধ্যে পদার্থের বিনিময় ঘটে গ্রহাণুর মাধ্যমে। পৃথিবীতে মঙ্গল এবং শুক্রগ্রহ থেকে আগত পদার্থের পাশাপাশি এমন অনেক পদার্থের অস্তিত্ব মিলেছে যার উৎস জানা যায়নি। সেক্ষেত্রে বলা যায় যে মহাকাশ পাড়ি দিয়ে কোন এক সময় ভিন গ্রহের পাথর বা উল্কাপিন্ড এসে পতিত হয়েছিল পৃথিবীতে, সেগুলো থেকেই হয়তো জীবের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ অণুজীব আকারে এখানে এসে পৌঁছায় জীবন।
কিন্তু এই তত্ত্ব তো গত কয়েক যুগ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে, কোন প্রমাণ মেলেনি এটার স্বপক্ষে। এডমন্ড কিয়ার্শের মত একজন প্রতিভাবান প্রযুক্তিবিদ কিভাবে এরকম একটা ব্যাপার প্রমাণ করবেন? এটা তো অ্যাস্ট্রোবায়োলজির আওতায় পড়ে, কম্পিউটার সায়েন্সের আওতায় না।
সেক্ষেত্রেও কিছু যুক্তির কথা বলবো আমি, ডক্টর বেনেট বললেন জবাবে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই দাবি করে আসছে, মানব জাতি যদি দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে চায় তবে তার একমাত্র উপায় হচ্ছে পৃথিবীর পাশাপাশি অন্য কোথাও বসতি গড়ে তোলা। কারণ এই পৃথিবীর যতদিন টিকে থাকার কথা তার অর্ধেক ইতিমধ্যেই পার হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে সূর্য একটা রেড জায়ান্টে পরিণত হবে এবং পৃথিবীকে গ্রাস করে নেবে। যদি এর আগে কোন গামা রে বিস্ফোরন কিংবা গ্রহাণুর সাথে ধাক্কায় পৃথিবী ধ্বংস না হয় আর কি। এই কারণেই মঙ্গল গ্রহে আউট পোস্ট নির্মাণের নকশা করা হচ্ছে যাতে মহাবিশ্বের আরো গভীরে গিয়ে নতুন বসতিস্থাপনের খোঁজ করতে পারি আমরা। সেখানে টিকে থাকার উপায় আবিষ্কারের চেষ্টাও কিন্তু করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন ডক্টর বেনেট, এরপর বললেন, তবে অন্য একটা উপায়েও করা যেতে পারে কাজটা। আমরা যদি কোনভাবে একটা ক্যাপসুলে মানুষের জিন সংরক্ষিত করে মহাকাশে ছেড়ে দিতে পারতাম এই আশায় যে দূরবর্তি কোন গ্রহে গিয়ে সেখানে হয়তো জীবের উদ্ভব ঘটাবে সেটা, তাহলে কিন্তু মন্দ হতো না। এখনও এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি, সেটা মানছি। কিন্তু এখানে মানব জাতির টিকে থাকার কথা বলছি আমরা, তাই যে কোন সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কেই আলোচনা করা যেতে পারে। আর এটা যদি আমরা বিবেচনা করতে পারি তাহলে আমাদের চেয়েও অনেক উন্নত কোন জীবসত্ত্বার অস্তিত্ব যদি থেকে থাকে মহাবিশ্বে, তারাও এই ব্যাপারটা বিবেচনায় নিতে পারে, তাই না?
ল্যাংডন এবার ধরতে পারছে, আলোচনা কোন দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন ড. বেনেট।
এই ব্যাপারটাই বিবেচনায় রেখে, ড. বেনেট বললেন, এডমন্ড কিয়ার্শ হয়তো এমন কিছু আবিষ্কার করেছিল যেটায় প্রমাণিত হবে যে, মহাবিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিল। এ ব্যাপারে আমার এবং এডমন্ডের মধ্যে কয়েক বছর আগে তর্কও হয়েছিল। মহাবিশ্ব থেকে অণুজীবের মাধ্যমে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে পৃথিবীতে এটা মানতে রাজি ছিল না এডমন্ড। কারণ অনেকের মতে সেও এটা বিশ্বাস করতো, কোন গ্রহাণু পৃথিবীতে প্রবেশের পর যে পরিমাণ বিকিরণ এবং তাপের সম্মুখীন হয়, জিনগত কোন উপাদান সেই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, একসময় এমন প্রযুক্তি অবশ্যই আবিষ্কৃত হবে যেটার সাহায্যে এরকমটা করা সম্ভব হবে।
ঠিক আছে, একটু বিভ্রান্ত শোনালো উপস্থাপিকার গলা, যদি কেউ এরকম প্রমাণ আবিষ্কার করে, মহাবিশ্বের অন্য কোন এক প্রান্ত থেকে কোন কিছুর মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছে…পরের কথাটা বলার আগে কিছুক্ষণ সময় নিলো উপস্থাপিকা, তাহলে সেটার অর্থ দাঁড়ায় মহাবিশ্বে একা নই আমরা, কিন্তু সেই সাথে এটাও…
কি? এই প্রথম হাসি ফুটলো ডক্টর বেনেটের মুখে।
প্রমাণিত হয় যে, যারা সেই কিছু একটা পাঠাবে তারাও…আমাদের মতনই…মানুষ!
হ্যাঁ, আমারও প্রথমে এই ধারণাই হয়েছিল, ড. বেনেট বললেন। কিন্তু এডমন্ড আমাকে সেই ধারণা থেকে সরে আসতে বাধ্য করে।
অর্থাৎ এডমন্ড কিয়ার্শের মতে যারা এই মনুষ্য বীজ-আপাতত এই নামেই ডাকি ব্যাপারটাকে-পাঠিয়েছিল তারা মানুষ নয়? সেটা কিভাবে সম্ভব, যেখানে বীজগুলো এমনভাবে তৈরি যাতে মানুষের সৃষ্টি হয়?
মানুষ এখনও তার চূড়ান্ত চেহারায় পৌঁছায়নি, মহাকাশ বিজ্ঞানী জবাব দিলেন, এডমন্ড এমনটাই বলেছিল।
দুঃখিত, বুঝতে পারছি না।
এডমন্ড বলেছিল, এই মনুষ্য বীজ তত্ত্ব যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে মানুষ এখনও তার চূড়ান্ত চেহারায় বিবর্তিত হতে পারেনি। বিবর্তনের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে বড়জোর।
সিএনএন উপস্থাপিকার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
কোন উন্নত জীবসত্তা কখনও এমন জিনগত উপাদান পাঠাবে না, যেটার চূড়ান্ত পরিণতি হবে মানুষ। কারণ তাহলে শিম্পাঞ্জীদের জিন পাঠাতে অসুবিধে কোথায়-ঠিক এমনটাই বলেছিল ও। এরপর আমাকে গোঁড়া খ্রিস্টান বলে পরিহাসও করে। কারণ হিসেবে বলে, খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসি কারো পক্ষেই কেবল এটা ধারণা করা সম্ভব যে মানবজাতিই এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু।
বেশ, ডক্টর বেনেট, আলোচনা যেদিকে এগোচ্ছে সেটা যে পছন্দ হচ্ছে।
উপস্থাপিকার তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আপনার মূল্যবান। মতামত আমাদের জানানোর জন্যে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
শেষ হয়ে গেল অনুষ্ঠানটা। সাথে সাথে ল্যাংডনের দিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা, বলল, রবার্ট, এডমন্ড যদি এমন প্রমাণ পেয়ে থাকে যে মানুষ হচ্ছে আধা বিবর্তিত কোন জাতি, তাহলে বড় একটা প্রশ্নের জন্ম দেয় সেটা কিসে বিবর্তিত হচ্ছি আমরা?
হ্যাঁ, ল্যাংডন বলল, আমার বিশ্বাস ঠিক এই ব্যাপারটাই আজ রাতে প্রেজেন্টেশনের শুরুতে অন্যভাবে উপস্থাপন করে এডমন্ড, যাচ্ছি কোথায় আমরা?
ওর প্রেজেন্টেশনের দ্বিতীয় প্রশ্ন, অবাক স্বরে বলল অ্যাম্ব্রা।
ঠিক। এলেম আমরা কোথা থেকে? যাচ্ছিই বা কোথায়? নাসার যে বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার দেখলাম, আমরা তার ধারণা এই প্রশ্ন দুটিরই উত্তর। পেয়েছে এডমন্ড।
আপনার কি ধারণা, রবার্ট? এরকম কোন কিছুই কি আবিষ্কার করেছিল ও?
ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করতে লাগলো ল্যাংডন। ড, বেনেটের বলা কথাগুলো আগ্রহোদ্দীপক হলেও এডমন্ড কিয়ার্শের সাথে যায় না ওগুলো। বরাবরই খুব সহজ এবং পরিষ্কার যুক্তিতে বিশ্বাসি ছিল সে, যেমনটা হওয়া উচিত একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানীর। আর এরকম একটা ব্যাপার প্রমাণ করবে কিভাবে এডমন্ড? পুরনো কোন বীজ বাহকের সন্ধান পেয়েছিল সে? বা কোনভাবে। যোগাযোগের উপায় খুঁজে পেয়েছিল ভিনগ্রহের প্রাণীদের সাথে? কিন্তু এগুলো। অতি কল্পনার পর্যায়ে পড়ে যায়, আর এরকম কিছু হলেও একদম হঠাৎ করেই আবিষ্কৃত হবার কথা সেটার।
এডমন্ড তো বলেছিল, ব্যাপারটা নিয়ে অনেক মাস যাবত কাজ করেছে সে।
আমি আসলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না, অবশেষে বলল ল্যাংডন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা এডমন্ডের আবিষ্কারের সাথে মহাবিশ্বের অন্য কোথাও থেকে প্রাণের আগমনের কোন সম্পর্ক নেই। হয়তো একদমই ভিন্ন কিছু আবিষ্কার করেছিলো সে।
অবাক অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো অ্যাম্ব্রার চেহারায়। সেটা জানার একটাই উপায় আছে, বলে জানালার বাইরে নির্দেশ করলো সে।
তাদের সামনে জ্বলজ্বল করছে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার বিশাল উঁচু গম্বুজগুলো।
.
অধ্যায় ৬৪
আড়চোখে প্রিন্স হুলিয়ানের দিকে তাকালো বিশপ ভালদেসপিনো। এখনও নির্বিকার ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন স্পেনের রাজকুমার। ওপেল সেডান গাড়িটা মৃদু গুঞ্জন তুলে এগিয়ে চলেছে ঐ-৫০৫ হাইওয়ে ধরে।
কি ভাবছে সে? নিজেকেই জিজ্ঞেস করলেন ভালদেসপিনো।
গত প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে একটা কথাও বলেননি প্রিন্স হুলিয়ান। মাঝে মাঝে শুধু প্যান্টের পকেটে হাত দিচ্ছেন স্মার্টফোনটা বের করে আনার জন্যে, কিন্তু প্রতিবারই ওটার অনুপস্থিতিতে বিরক্তিতে কুঁচকে গেছে তার চেহারা।
ফোনটা প্রাসাদে রেখে আসা হয়েছে।
আরো কিছুক্ষণ তাকে কিছুই জানানো যাবে না, ভালদেসপিনো ভাবলেন।
ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা সহকারি যাজক এখনও ক্যাসিতা দেল প্রিন্সিপের উদ্দেশ্যে গাড়ি চালাচ্ছে, কিন্তু শিঘ্রই তাকেও জানাতে হবে, তাদের গন্তব্যস্থল অন্য কোথাও।
এ সময় হুলিয়ান হঠাৎ জানালার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সহকারি যাজকের কাঁধে একবার টোকা দিয়ে বলল, রেডিওটা চালু করুন, খবর শুনতে চাই আমি।
তরুণ যাজক প্রিন্সের নির্দেশ পালন করার আগেই বিশপ ভালদেসপিনো সামনে ঝুঁকে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, এখনই রেডিও চালু করার। দরকার নেই। আরো কিছুক্ষণ নীরবতায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত আমাদের।
অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন প্রিন্স হুলিয়ান।
আমি দুঃখিত, সাথে সাথে বললেন ভালদেসপিনো, অনেক রাত হয়েছে। এসময় নীরবতাই কাম্য সবার জন্যে।
এতক্ষণ চুপচাপ বসে সবকিছু নিয়ে চিন্তা করার অনেক সময় পেয়েছি, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন প্রিন্স হুলিয়ান, এখন আমি জানতে চাই, কী চলছে আমার দেশে। প্রাসাদ থেকে এভাবে সবার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে চলে আসাটা ঠিক হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে এখন সন্দেহ হচ্ছে আমার।
উচিত কাজটাই করেছি আমরা,তাকে আশ্বস্ত করলেন ভালদেসপিনো। আর আপনি যে আমাকে ভরসা করেছেন সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ। তরুণ যাজকের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে রেডিওর দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি, খবর শোনা যাক তাহলে। রেডিও মারিয়া এস্পানা ছাড়ুন, অন্যান্য রেডিও স্টেশন গুলোর তুলনায় এই ক্যাথলিক রেডিও স্টেশনটাকে ভরসা করেন ভালদেসপিনো। অন্তত উল্টাপাল্টা কিছু বলবে না তারা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সংবাদ পাঠকের কণ্ঠ ভেসে এলো গাড়ির স্পীকার থেকে। এডমন্ড কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন এবং তার হত্যাকান্ডের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা চলছে। পৃথিবীর সবগুলো স্টেশনেই নিশ্চয়ই এখন এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা চলছে। নিজের নাম যাতে না শোনা যায় সেই প্রার্থনা করতে লাগলেন ভালদেসপিনো।
সৌভাগ্যবশত সেই মুহূর্তে আলোচনা শুরু হলো কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনের খ্রিস্টধর্ম বিরোধি আলোচনা নিয়ে এবং স্পেনের তরুণ সমাজের ওপর সেটা কিরকম প্রভাব ফেলবে তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করলো সংবাদ পাঠক। কিছুক্ষণের মধ্যেই বার্সেলোনা ইউনভার্সিটিতে দেয়া কিয়ার্শের একটা বক্তৃতা সম্প্রচার করা শুরু করলো রেডিও মারিয়া এস্পনা। তার উদ্ধত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো স্পিকারে।
আমাদের অনেকেই নিজেদের অবিশ্বাসি হিসেবে স্বীকার করতে ভয় পাই, ছাত্রছাত্রিদের উদ্দেশ্যে বলল কিয়ার্শ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিরীশ্বরবাদ হচ্ছে শুধুমাত্র সত্যটাকে মেনে নেয়া।
কয়েকজন ছাত্রছাত্রি হাত তালি দেয়ার শব্দ শোনা গেল।
আসলে এই অবিশ্বাসি শব্দটা থাকাই উচিত না। কই, কেউ তো কখনও কাউকে অরসায়নবিদ বা অপদার্থবিদ বলে ডাকে না।
এবার আগের চেয়ে তালির শব্দ একটু জোরে শোনা গেল।
তবে এটা আমার কথা না, কিয়াশ বলল, নিউরোসায়েন্টিস্ট স্যাম হ্যারিস বলেছেন এগুলো। আর আপনারা যদি তার লেটার টু এ ক্রিশ্চিয়ান ন্যাশন বইটা না পড়ে থাকেন, তবে যত দ্রুত সম্ভব সেটা পড়ে নেবেন।
বিরক্তিতে কুঁচকে গেল ভালদেসপিনোর ভু জোড়া। স্যাম হ্যারিসের এই বইটা মূলত আমেরিকানদের জন্যে লেখা হলেও স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হবার পর এখানেও জনপ্রিয় হয় সেটা।
আপনাদের মধ্যে কে কে এখনও প্রাচীন দেবতা-জিউস, অ্যাপোলো কিংবা ভালকানের কথা বিশ্বাস করেন? জিজ্ঞেস করলো এডমন্ড। কিছুক্ষণের নীরবতা। এরপর হাসিমাখা কণ্ঠে সে বলল, একজনও না? বেশ। তাহলে যায়।
এটা বলা যায় যে, আমরা সেই সব দেবতাদের সাপেক্ষে অবিশ্বাসি, এটুকু বলে থামলো এডমন্ড, এরপর বলল, আর আমি সেই সব দেবতাদের সাথে। ঈশ্বরেও অবিশ্বাসি।
এবারও তালির আওয়াজ ভেসে এলো।
বন্ধুরা, আমি কিন্তু দাবি করছি না, ঈশ্বর বলে কারও অস্তিত্ব নেই। আমি শুধু আপনাদের বোঝাতে চাইছি, এই জগতের সৃষ্টির পেছনে যদি দৈব কোন শক্তির হাত থেকে থাকে তবে তারা আমাদের সৃষ্টি করা এই ধর্মের সংজ্ঞা নিয়ে নিশ্চিত হাসাহাসি করছে।
সবাই হেসে উঠলো তার কথায়।
ভালদেসপিনোর এখন মনে হচ্ছে, রেডিও চালু করে ভালোই হয়েছে। হুলিয়ানের এটা শোনা উচিত ছিল। কিয়ার্শের মত কারও কথায় এতজন মানুষের হাত তালি দেয়ার অর্থ হচ্ছে খ্রিস্ট ধর্মের শত্রুরা এখন আর অলস বসে নেই, বরং তারা বিশ্বাসিদের বিশ্বাস চূর্ণ করার চেষ্টায় নেমেছে।
আমি একজন আমেরিকান, কিয়া বলল, আর আমি খুবই গর্বিত যে এমন একটা দেশে জন্ম আমার যেটা প্রযুক্তিগতভাবে পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত এবং এখানকার প্রগতিশীলতা অন্যান্য দেশের জন্যে উদাহরণ স্বরূপ। তাই আমি যখন একটা জরিপে দেখলাম, আমেরিকার অর্ধেক মানুষ বিশ্বাস করে। অ্যাডাম এবং ইভের অস্তিত্ব ছিল এবং তারাই এই পৃথিবীর জাত,গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের পূর্বপুরুষ, তখন বিরক্ত না হয়ে পারিনি।
আবারও হাসির আওয়াজ।
কেন্টাকির একজন যাজক, পিটার লারুফা জনসমক্ষে ঘোষণা দিয়েছেন যে, বাইবেলের কোথাও যদি লেখা থাকে দুই যোগ দুই হচ্ছে পাঁচ, তবে সেটাও নির্দ্বিধায় মেনে নেবেন তিনি।
হাসির শব্দ।
হাসাটা সহজ, কিন্তু এর একটা ভয়ঙ্কর দিকও আছে। যারা এসবে বিশ্বাস করে তাদের অনেকেই বড় বড় ডাক্তার, আইনজীবি, শিক্ষক এবং দেশের সর্বোচ্চ স্তরের চাকরিজীবি। আমেরিকার নামকরা কংগ্রেসম্যান, পল ব্রাউনকে আমি বলতে শুনেছি-বিবর্তন এবং বিগ ব্যাঙ হচ্ছে ডাহা মিথ্যা কথা, অবিশ্বাসিদের চক্রান্ত। আমার বিশ্বাস পৃথিবীর বয়স নয় হাজার বছর এবং ছয় দিনের মধ্যে সেটা তৈরি হয়েছে এটুকু বলে কিছুক্ষণ সময় নিলো এডমন্ড, এরপর যোগ করলো, ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে কংগ্রেসম্যান পল ব্রাউন গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, মহাকাশ এবং প্রযুক্তি কমিটির একজন সদস্য এবং তাকে যখন কয়েক লক্ষ বছর আগের ফসিল আবিষ্কারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয় তখন তিনি বলেন, ঈশ্বর এগুলো আমাদের বিশ্বাস কতটা মজবুত তা পরীক্ষা করার জন্যে পৃথিবীতে রেখে দিয়েছেন।
এরপর হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল কিয়ার্শের কণ্ঠস্বর, এসব ছাইপাঁশ বলে পার পেয়ে যাবার সময় ফুরিয়েছে। স্কুল এবং চার্চ থেকে আমাদের আগামী প্রজন্মকে যে মিথ্যা শিক্ষা দেয়া হয় তাও বন্ধ করতে হবে, এবার আর তালির আওয়াজ ভেসে এলো না। মানবজাতিকে মন থেকে শ্রদ্ধা করি আমি। প্রত্যেকটা মানুষ এক অপার সম্ভাবনার খনি। আর আমার বিশ্বাস খুব শিঘ্রই আমরা এমন পরিবেশে বসবাস করবো, ধর্ম নয় বিজ্ঞানের রাজত্ব থাকবে।
হুল্লোড় পড়ে গেল উপস্থিত সবার মধ্যে।
যথেষ্ট হয়েছে, বিশপ ভালদেসপিনো রাগতস্বরে বললেন, বন্ধ করে দাও।
তার কথানুযায়ি কাজ করলো সহকারি যাজক।
অখণ্ড নীরবতায় আঁধারের বুক চিড়ে সামনে এগোতে লাগলো গাড়িটা।
*
ত্রিশ মাইল দূরে হাঁপাতে থাকা সুরেশ ভাল্লার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মনিকা মার্টিন। কেবলই দৌড়ে এসে তার হাতে একটা ফোন গুঁজে দিয়েছে লোকটা।
লম্বা কাহিনী, বলল সুরেশ, কিন্তু ভালদেসপিনোর ফোনের এই মেসেজটা পড়ো আগে।
কি? আরেকটু হলে হাত থেকে ফোনটা প্রায় ফেলেই দিয়েছিল মনিকা, এটা বিশপ ভালদেসপিনোর ফোন? এটা কিভাবে তোমার
পরে বলছি, আগে পড়ো।
আর কথা না বাড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মেসেজটা পড়লো মনিকা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেড়ে গেল তার হৃৎস্পন্দন, ঈশ্বর! বিশপ ভালদেসপিনো তাহলে-
বিপজ্জনক।
কিন্তু…এটা তো অসম্ভব। এই মেসেজটা কে পাঠিয়েছে বিশপকে?!
সেটা বোঝা যাচ্ছে না, সুরেশ বলল, কিন্তু বের করার চেষ্টা করছি।
আর ভালদেসপিনো এই মেসেজটা ডিলিট করেননি কেন?
তাও জানি না, সুরেশ বলল, হয়তো প্রয়োজনবোধ করেননি। তার ফোনের গত কয়েকদিনে আসা মেসেজগুলো বের করারও চেষ্টা করবো আমি। কিন্তু তার আগে তোমাকে দেখানোটা জরুরি মনে করেছি। এ ব্যাপারে একটা। আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে হবে তোমাকে।
মোটেও না! মনিকা বলল, দেশের মানুষের কাছে তো এটা প্রকাশ করাই যাবে না।
আমরা প্রকাশ না করলেও খুব বেশিক্ষন ব্যাপারটা চাপা থাকবে বলে মনে হয় না, সুরেশ monte@iglesia.org-এর ব্যাপারে খুলে বলল মনিকা মার্টিনকে।
চোখ বন্ধ করে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো মনিকা। সবাই যদি এটা জানতে পারে, স্পেনের রাজার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর বিশপ ভালদেসপিনো এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি জড়িত তাহলে কী হবে সেটা কল্পনা করতেও ভয় হচ্ছে ওর।
সুরেশ, চোখ খুলে ফিসফিসিয়ে বলল মার্টিন, এই monte কে সেটা খুঁজে বের করতে হবে তোমাকে যত দ্রুত সম্ভব। সেটা পারবে না তুমি?
চেষ্টা করে দেখবো, অতটা আশাবাদি মনে হলো না সুরেশকে।
ধন্যবাদ, বিশপের ফোনটা সুরেশকে ফেরত দিয়ে দ্রুত দরজার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো মনিকা। আর আমাকে মেসেজটার একটা স্ক্রিনশট পাঠাও, ঘাড় ঘুরিয়ে বলল।
কোথায় যাচ্ছো তুমি?
জবাব দিলো না মনিকা মার্টিন।
.
অধ্যায় ৬৫
বার্সেলোনা শহরের পুরো এক ব্লক জুড়ে অবস্থিত লা সাগ্রাদা ফামিলিয়া বা ব্যাসিলিকা অব হলি ফ্যামিলি। এত বিশাল আকৃতি হওয়া সত্ত্বেও স্থাপনাটাকে দেখলে মনে হয় যেন স্রেফ ভেসে আছে টাওয়ারগুলোসমেত।
টাওয়ারগুলোর উচ্চতা আবার ভিন্ন ভিন্ন। পুরো কাজ শেষ হবার পরে সবচেয়ে লম্বা গম্বুজটার উচ্চতা হবে প্রায় ৫৬০ ফিট, যা কিনা ওয়াশিংটন মনুমেন্ট থেকেও উঁচু। তখন গোটা পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু চার্চের মর্যাদা পাবে সাগ্রাদা ফামিলিয়া। ভ্যাটিকানের সেইন্ট পিটারস ব্যাসিলিকা থেকেও একশ ফিট উঁচু এটা।
সাগ্রাদা ফামিলিয়া মূলত তিনটি ফ্যাসেডে বিভক্ত। পূর্বদিকের রঙিন ন্যাটিভিটি ফ্যাসেড দেখলে অনেকটা ঝুলন্ত উদ্যানের কথা মনে পড়বে। পাথর খোদাই করে অনেক গাছপালা, জীবজন্তু এবং মানুষের আদল দেয়া হয়েছে এই দিকটায়।
পশ্চিমের প্যাশন ফ্যাসেড আবার এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সেদিককার নক্সা করা হয়েছে পেশীতন্ত্র আর হাড়ের আদলে। আর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত গ্লোরি ফ্যাসেড উঠে গেছে অনেকটা খাড়া স্তম্ভের মত। এই ফ্যাসেডের নিচের অংশ উপস্থাপন করে অশুভ শক্তি, মূর্তি, পাপ এবং অনৈতিকতা। কিন্তু যতই ওপরে ওঠা যায় সেসব রূপান্তরিত হয় পূণ্য এবং মহত্বের সংকেতে।
এই মূল তিনটি ফ্যাসেড বাদেও ছোট ছোট বেশ কয়েকটি ফ্যাসেড এবং টাওয়ার ঘিরে রেখেছে গোটা স্থাপনা। ওগুলোকে যদি হঠাৎ কেউ দেখে তবে মনে হবে যেন কাদামাটির দিয়ে কোন স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে মাঝপথে হাল ছেড়ে দেয়া হয়েছে অথবা গলে পড়ছে অংশগুলো। একজন নামকরা সমালোচক সাগ্রাদা ফামিলিয়ার নিচের অর্ধেক সম্পর্কে বলেন যে, ওটা দেখতে অনেকটা পচতে থাকা গাছের গুঁড়ির মতন যেখান থেকে জন্ম নিয়েছে ব্যাঙের ছাতার মত কিছু চূড়া।
গওদি সাগ্রাদা ফামিলিয়ার নক্সায় বিভিন্ন ধর্মিয় ভাস্কর্যের পাশাপাশি প্রকৃতির অনেক কিছুর আদলে কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত মূর্তিও জুড়ে দিয়েছিলেন। যেমন অনেক স্তম্ভের নিচে দেখা মিলবে কচ্ছপের মূর্তির-এমনকি দেয়ালের গায়ে বড় বড় পাথরের তৈরি শামুক এবং ব্যাঙেরও দেখা মিলবে।
এ তো গেল বাইরের নক্সার কথা, কিন্তু সাগ্রাদা ফামিলিয়ার মূল বিস্ময়ের দেখা মিলবে যখন সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকা হবে। পর্যটকদের প্রায়ই মুখ হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সেখানে। প্রথমেই চোখ কাড়বে ২০০ ফিট লম্বা থামগুলো আর ছাদের নিখুঁত জ্যামিতিক নক্সা যে কাউকে নিয়ে যাবে এক ঘোরের মধ্যে। গদি চেয়েছিলেন যাতে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার ভেতরের নক্সা দেখলে গভীর বনের কথা মনে পড়ে যে কারোর। যেখানে উঁচু উঁচু গাছ উঠে গেছে প্রায় আকাশ অবধি। মনে হবে যেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে উপাসনা করতে আসা হয়েছে, যেমনটা করা হতো প্রাচীন আমলে।
স্বভাবতই এরকম একটা অদ্ভুত নক্সার স্থাপত্য যেমন সমীহ কুড়ায় তেমনি অনেকে সমালোচনা করতেও ছাড়ে না। লেখক জেমস মিচনারের মতে, আমার দেখা সবচেয়ে অদ্ভুত দর্শন দূর্গগুলোর একটি।
নক্সার মত সাগ্রাদা ফামিলিয়ার ফান্ডিংয়ের ব্যাপারটাও বেশ অদ্ভুত। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে তৈরি হচ্ছে গোটা চার্চ। ভ্যাটিকান কিংবা অন্য ক্যাথলিক সংস্থাগুলো থেকে কোন অর্থ সহায়তা দেয়া হয় না। প্রায়শই কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। মূল স্থপতির মৃত্যু, একটা গৃহযুদ্ধ এবং কাতালান সন্ত্রাসিদের বেশ কয়েকবার আক্রমণ সত্ত্বেও অনেকটা অবিশ্বাস্যভাবেই টিকে আছে গোটা স্থাপনাটি। এমনকি কাছ দিয়ে একটা পাতালট্রেন সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলেও টিকে গেছে সাগ্রাদা ফামিলিয়া। শুধু টিকেই আছে তা নয়, বাড়ছে প্রতিদিন।
গত দশকে অবশ্য চার্চের ফান্ড ফুলে ফেপে উঠেছে। এর প্রধান কারণ। প্রতি বছর প্রায় চল্লিশ লক্ষ পর্যটক স্থাপনাটা দেখতে আসে বেশ ভালো অঙ্কের টিকেট কেটে। সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে, ২০১৬ সালে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার স্থপতি আন্তোনি গওদির মৃত্যু শতবার্ষিকীতে জনসাধারণের জন্যে খুলে দেয়া হবে চাৰ্চটা। জোরেসোরে কাজও চলছে সেই লক্ষ্যে।
আশি বছর বয়স্ক ফাদার জোয়াকিম বেনা সাগ্রাদা ফামিলিয়া চার্চের মূল যাজক। চশমা পরা সৌম্যদর্শন বয়স্ক ভদ্রলোকের চেহারায় সবসময় খেলা করে হাসি। তার স্বপ্ন, চার্চের কাজ পুরোপুরি দেখে যাবেন।
আজকে অবশ্য নিজ অফিসে হাসছেন না ফাদার বেনা। চার্চের কাজের জন্যে অনেক রাত পর্যন্ত এমনিতেও জেগে থাকতে হতো তাকে, কিন্তু আজ কম্পিউটারের সামনে বসে সাক্ষি হয়েছেন বিলবাওয়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের।
এডমন্ড কিয়াশ মারা গেছে।
হয়তো অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু গত তিন মাসে কিয়ার্শের সাথে এক বন্ধুত্বপরায়ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার। এডমন্ড যখন নিজে থেকে উৎসাহি হয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা ডোনেশন হিসেবে দিতে চায় চার্চের ফান্ডে, অবাক না হয়ে পারেননি ফাদার বেনা। হবেনই বা না কেন? তার মত একজন স্বঘোষিত নাস্তিক চার্চের জন্যে টাকা দিচ্ছে এটা বিশ্বাস করতে যে কারোরই কষ্ট হবার কথা। তবুও না করতে পারেননি ফাদার বেনা, কারণ টাকার অঙ্কটা অনেক বেশি ছিল এবং তা সাগ্রাদা ফামিলিয়ার নির্মাণকাজ তরান্বিত করতে সাহায্য করবে।
হঠাৎ ডোনেশন দিতে চাচ্ছে কেন? ভেবেছিলেন ফাদার বেনা, জনসমক্ষে নিজের অর্থের প্রাচুর্যতা দেখানোর জন্যে নাকি আলোচনায় আসার জন্যে?
ডোনশনের বদলে শুধু একটা অনুরোধ করেছিল বিখ্যাত ফিউচারিস্ট।
মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন ফাদার বেনা। শুধু এটুকুই দাবি তার?
ব্যাপারটা আমার জন্যে ব্যক্তিগত, কিয়ার্শ বলেছিল তাকে, আশা করি আমার কথাটা রাখবেন আপনি।
মানুষকে ভরসা করতে ভালোবাসেন ফাদার বেনা, তবুও ঠিক সেই মুহূর্তে কিয়ার্শের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মূল উদ্দেশ্য খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন তিনি এবং সফলও হয়েছিলেন। কিয়ার্শের স্বতস্ফূর্ততার মধ্যে ক্লান্তির ছাপ দেখেছিলেন। এডমন্ডের কোটরাগত চোখ এবং ভগ্ন শরীর তার ধারণাকে আরো পাকা করেছে।
এডমন্ড কিয়ার্শ কোন দুরারগ্য রোগের সাথে লড়ছে।
বেনা ভেবেছিলেন, হয়তো আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে ধর্মের পথে দান করতে চাচ্ছে এডমন্ড কিয়ার্শ। যে ঈশ্বর সম্পর্ক সবসময় কটুক্তি করে এসেছে সেই ঈশ্বরের সাথে ভাবের চেষ্টা।
বিখ্যাত খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক সেন্ট জনের কথা মনে হয়েছিল ফাদার বেনার। যিনি তার পুরো জীবন নিবেদিত করেছিলেন অবিশ্বাসিদের ধর্মের। পথে আনতে। যদি কিয়ার্শের মতন একজন অবিশ্বাসি ধর্মের পথে দান করে পূণ্য কামাতে চায় তবে তাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করাটা অনুচিত বলে মনে হয়েছিল তার।
তাছাড়া তিনি যে পদে চাকরি করছেন, চার্চের ফান্ড ভারি করার সুযোগটা হাতছাড়া করা ঠিক হতো না। সহকর্মিরা যদি তাকে জিজ্ঞেস করতো, কেন এডমন্ডের ডোনেশন গ্রহণ করা হয়নি তখন দেয়ার মত ভালো কোন জবাব থাকতো না তার কাছে। কী বলতেন? আগে অনেক উলটাপালটা বক্তব্য দিয়েছে সে, এইজন্যে ডোনেশন অনুমোদন করিনি-তার নিজের কাছেও খোঁড়া শুনিয়েছিল যুক্তিটা।
অবশেষে এডমন্ডের দাবি মেনে নিয়ে তার সাথে উষ্ণ করমর্দন করেন তিনি।
সেটা তিন মাস আগের কথা।
আজ রাতে অন্যান্য অনেকের মতনই গুগেনহাইম থেকে সম্প্রচারকৃত কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন দেখতে বসেছিলেন তিনি। প্রথমে অবশ্য বিরক্ত হচ্ছিলেন এডমন্ডের তার ধর্মকে অস্বীকার করার চেষ্টায়। পরে যখন এডমন্ড তার গোপন আবিষ্কার উন্মোচনের কথা বলে তখন আগ্রহি হয়ে উঠেছিলেন ভীষণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্য সবার মত আতঙ্কিত চেহারায় সাক্ষি হতে বাধ্য হন এক হত্যাকাণ্ডের। কম্পিউটারের সামনে থেকে আর সরেননি অনেকক্ষণ।
এই মুহূর্তে চার্চের বিশাল হলরুমে গওদির প্রাকৃতিক বন-এর নিচে বসে আছেন চুপচাপ। তবে অন্য সময়কার মত প্রশান্ত হচ্ছে না মন।
কী এমন আবিষ্কার করেছিল এডমন্ড? কে মারলো তাকে?
চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করলেন ফাদার বেনা। কিন্তু ঘুরে ফিরে কেবল দুটো প্রশ্নের কথা মনে হচ্ছে।
এলেম আমরা কোথা থেকে? যাচ্ছিই বা কোথায়?
ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছি আমরা! জোরে ঘোষণা করলেন বেনা, তার কাছেই ফিরে যাবো।
ঠিক এই সময় প্যাশন ফ্যাসেডের ছাদ গলে একটা আলোর রেখা এসে পড়লো ব্যাসিলিকার ভেতরে।
অবাক হয়ে জানালার কাছে ছুটে গেলেন ফাদার। আকাশ থেকে কিছু একটা নামছে চার্চের পাশে। সদর দরজা দিয়ে বের হতেই মনে হলো যেন। বাতাসের তোড়ে উড়ে যাবেন। একটা হেলিকপ্টার!
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে হেলিকপ্টারটাকে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার প্রতিরক্ষা বেষ্টনির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে নামতে দেখলেন তিনি।
বাতাস এবং শব্দ কমে আসার পর হেলিকপ্টারের ককপিট থেকে চারজন আগন্তুককে লাফিয়ে নামতে দেখলে ফাদার বেনা। সামনের দুজনকে চিনতে কোন বেগ পেতে হলো না। তাদেরকে আজ রাতেই কিছুক্ষণ আগে কম্পিউটারের পর্দায় দেখেছেন তিনি। একজন হচ্ছেন স্পেনের হবু রাণী, মিস অ্যাম্ব্রা ভিদাল, অপরজন হারভার্ডের সিম্বলজির প্রফেসর ল্যাংডন। তাদের পেছনে ব্লেজার পরিহিত দুজন লোক। ব্লেজারের গায়ে মনোগ্রাম দেখা যাচ্ছে।
তাদের দেখে যা বুঝলেন-অ্যাম্ব্রা ভিদালকে অপহরণ করেননি প্রফেসর। ল্যাংডন। স্বেচ্ছায় আমেরিকান প্রফেসরের পাশাপাশি হেঁটে আসছেন মিস অ্যাম্ব্রা ভিদাল।
ফাদার! আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল অ্যাম্ব্রা, এরকম পবিত্র একটা জায়গায় এভাবে হট্টগোল সৃষ্টি করার জন্যে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনার সাথে খুব জরুরি কথা আছে আমাদের।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও বন্ধ করে নিলেন ফাদার বেনা। কেবল মাথা নাড়লেন একবার।
আমরা দুঃখিত, ফাদার, হেসে তার উদ্দেশ্যে বলল রবার্ট ল্যাংডন। আপনার কাছে হয়তো গোটা ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকছে। আপনি কি আমাদের চিনতে পারছেন?
অবশ্যই, অবশেষে বললেন তিনি, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম…।
ভুয়া তথ্য দেয়া হয়েছে প্রাসাদ থেকে, অ্যাম্ব্রা বলল, সবকিছু ঠিকঠাক আছে।
ঠিক তখনই চার্চের বাইরের পোস্টের দু-জন সিকিউরিটি গার্ড এগিয়ে আসতে লাগলো তাদের দিকে। হেলিকপ্টারটা নামতে দেখে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে গেছে তারা। ফাদার বেনাকে দেখে তার দিকে ছুটে আসতে লাগালো গার্ড দু-জন।
সাথে সাথে ব্লেজার পরিহিত লোক দুজন ঘুরে হাত সামনে দিয়ে তাদের থামার নির্দেশ দিলে থেমে গেল তারা। ফাদারের দিকে তাকালো নির্দেশের আশায়।
তত্ এস্তা বে! কাতালান ভাষায় বললেন বেনা। তরনিন আর সেট লক। সব ঠিকঠাক। তোমরা পোস্টে ফিরে যাও।
কিন্তু অনিশ্চয়তার ছাপ দূর হলো না গার্ডদের চেহারা থেকে।
সান এলস মিউস কনভিদাস, আগের চেয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন বেনা। কনফিও এন লা সেভা দিসক্রেসিও। তারা আমার অতিথি। আশা করি তোমরা মুখ বন্ধ রাখবে তাদের আগমনের ব্যাপারে।
মাথা দুলিয়ে বিপরীত দিকে ঘুরে ফিরে যেতে লাগলো গার্ড দুজন।
ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞচিত্তে বলল অ্যাম্ব্রা।
আমি ফাদার জোয়াকিম বেনা, তিনি বললেন, দয়া করে খুলে বলবেন কি সবকিছু?
রবার্ট ল্যাংডন সামনে এগিয়ে এসে হাত মেলালো তার সাথে। ফাদার বেনা, আমরা একটা দুষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজ করছি, যেটার মালিক এডমন্ড কিয়ার্শ, এটুকু বলে পকেট থেকে একটা নোট কার্ড বের করে তার হাতে দিলো ল্যাংডন, এই কার্ডে লেখা আছে, চার্চের কাছে ধার হিসেবে দেয়া হয়েছে বইটা।
চারজনে দলটি হঠাৎ আগমনে কিছুটা ধাঁধাঁর মধ্যে পড়ে গেলেও লিনেন কাগজের কার্ডটা দেখার সাথে সাথে চিনতে পারলেন ফাদার বেনা। ঠিক এরকম একটা কার্ড কয়েক সপ্তাহ আগে বইটার সাথে তাকে দিয়েছিল এডমন্ড কিয়ার্শ।
দ্য কটি ওয়ার্কস অব উইলিয়াম ব্লেক।
চার্চে বিশাল অঙ্কের ডোনেশন দেয়ার বদলে এডমন্ডের সাথে তার চুক্তি হয়েছিল যে, বইটা সাগ্রাদা ফামিলিয়া ব্যাসিলিকার ক্রিপ্টে, মানে ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষ প্রদর্শনী করা হবে।
খুবই অদ্ভুত একটা অনুরোধ।
কার্ডের পেছনে কিয়ার্শ বাড়তি একটা অনুরোধ করেছিল। সেখানে লেখা আছে, প্রদর্শনীর সময় সবসময় যেন বইটার ১৬৩ নম্বর পৃষ্ঠা খোলা থাকে।
.
অধ্যায় ৬৬
অ্যাডমিরাল আভিলা এই মুহূর্তে সাগ্রাদা ফামিলিয়া থেকে পাঁচ মাইল উত্তর পশ্চিমে চলন্ত একটি গাড়ির ভেতর থেকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। সেখানে বালেরিক সাগরে প্রতিফলিত হচ্ছে বার্সেলোনার শহরতলীর আলো।
অবশেষে! বয়স্ক নাভাল অফিসার মনে মনে ভাবলেন। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে রিজেন্টকে ফোন দিলেন, এমনটাই কথা হয়েছিল তাদের মধ্যে।
একবার রিং হবার পরেই রিজেন্টের গলার স্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে। অ্যাডমিরাল আভিলা? কোথায় আপনি এখন?
শহর থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে।
সময়মতো পৌঁছেছেন আপনি। এই মাত্র একটা দুর্ভাগ্যজনক খবর পেলাম আমি।
কী খবর? খুলে বলুন।
আমাদের বিশ্বাসের ওপর যে শ্বাপদটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার মাথা ছেটে ফেলতে আপনি সক্ষম হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আমরা যেমনটা ভয় করছিলাম, লম্বা লেজটা এখন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কী করতে হবে এখন আমাকে? আভিলা জিজ্ঞেস করলো।
জবাবে রিজেন্ট যা বলল, সেটা শুনে অবাক না হয়ে পারলো না আভিলা। ও ভাবেনি যে আজ রাতে আর কারও প্রাণ নিতে হবে তাকে। কিন্তু রিজেন্টেস আদেশ শিরোধার্য। আমি তো একজন সাধারণ সৈনিক বৈ কিছু নই, নিজেকে মনে করিয়ে দিলো সে।
মিশনটা সহজ হবে না, রিজেন্ট বললেন, যদি আপনি ধরা পড়েন তবে কর্তৃপক্ষকে আপনার হাতের ট্যাটুটা দেখাবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ছাড়া। পেয়ে যাবেন তাহলে। সব জায়গায় আমাদের লোক আছে।
ধরা পড়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার, ট্যাটুটার দিকে তাকিয়ে বলল আভিলা।
বেশ, রিজেন্টের কণ্ঠে আবেগের লেশমাত্রও নেই, সবকিছু ঠিকঠাক মত চললে খুব শিঘ্রই মারা যাবে তারা দুজন আর আমাদের কাজও শেষ হবে।
লাইন কেটে দেয়া হলো ওপাশ থেকে।
এই নীরবতার মাঝেই অনেক দূরে উজ্জ্বল আলোর ছটা চোখে পড়লো আভিলার। অনেকগুলো উঁচু নিচু গম্বুজ দাঁড়িয়ে আছে আকাশের বুক চিড়ে।
সাগ্রাদা ফামিলিয়া, মনে মনে ভাবলো সে, উদারপন্থি ক্যাথলিসিজমের আদর্শ নিদর্শন। হাজার বছরের খ্রিস্টিয় বিশ্বাসের পাশাপাশি এখানে স্থান দেয়া হয়েছে বিজ্ঞান, প্রকৃতি এবং নস্টিক চিন্তাভাবনাকে।
একটা চার্চের দেয়ালে কিনা গিরগিটির ভাস্কর্য।
পুরো পৃথিবী জুড়ে ঐতিহ্যের যে অবমূল্যায়ন তা অনেকের মতনই আতঙ্কিত করে তুলেছে আভিলাকে। কিন্তু নতুন একদল বিশ্বনেতাদের আবির্ভাব ঘটেছে যারা যে কোন মূল্যে এই অবমূল্যায়ন রোধে বদ্ধপরিকর। পালমেরিয়ান চার্চের প্রতি তার একাত্মতা এবং সপ্তদশ পোপ ইনোসেন্টের সাহচর্য তাকে তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটাকে নতুন আলোয় দেখতে সহায়তা করেছে।
আমার স্ত্রী এবং সন্তান যুদ্ধে নিহত হয়েছে, আভিলা ভাবলো, ঈশ্বর এবং ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে অশুভ শক্তির যুদ্ধ। ক্ষমা করে দেয়াই পরিত্রাণের একমাত্র উপায় নয়।
পাঁচ দিন আগে গভীর রাতে একটা মেসেজ আসার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আভিলার। এত রাতে কে মেসেজ পাঠালো, বিরক্ত স্বরে বলেছিল সে। এরপর ফোনটা হাতে তুলে নেয় মেসেজ প্রেরকের পরিচয় জানার জন্যে।
সংরক্ষিত নম্বর-নম্বরের জায়গায় এই কথাটা ভাসতে দেখে সে।
চোখ কচলিয়ে মেসেজটা পড়ে সে।
আমার ব্যাংক ব্যালেন্স দেখবোর।
টেলিমার্কেটিংয়ের নতুন কৌশল ভেবে বিরক্ত হয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখে সে। উঠে গিয়ে পানি খায় এক গ্লাস। কিন্তু খচখচ করতে থাকা মনটাকে শান্ত করার জন্যে অবশেষে ল্যাপটপ খুলে ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে ঢোকে। ভেবেছিল খুব অল্প পরিমাণ টাকা হয়তো দেখতে পাবে, তার শেষ সঞ্চয়টুকু। কিন্তু তার অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তার।
এটা কিভাবে সম্ভব!
চোখ কিছুক্ষণ বন্ধ করে রেখে আবার অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স যেখানে লেখা থাকে সেদিকে তাকায় সে।
কোন হেরফরে হয়নি টাকার পরিমাণের।
কাঁপা কাঁপা হাতে মাউস নাড়তে শুরু করে সে। এক অজ্ঞাত অ্যাকাউন্ট থেকে এক ঘন্টা আগে পাঠানো হয়েছে এক লক্ষ ইউরো।
কার কাজ এটা?!
এসময় ফোন বেজে উঠলে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে যায় তার।
সংরক্ষিত নম্বর। কিছুক্ষণ ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থেকে কলটা রিসিভ করে সে।
হ্যালো?
ওপাশ থেকে কাস্তিলান স্প্যানিশে কথা বলে ওঠে কেউ, শুভ সন্ধ্যা, অ্যাডমিরাল। আপনাকে পাঠানো উপহারটা সম্পর্কে এতক্ষণে নিশ্চিত হয়েছে নিশ্চয়ই?
এইতো…হ্যাঁ, জড়ানো স্বরে বলে সে। কে বলছেন?
আমাকে রিজেন্ট বলে ডাকতে পারেন আপনি, জবাব আসে। একই বিশ্বাসে বিশ্বাসি আমরা। গত দু বছর ধরে যে চার্চে নিয়মিত যাতায়াত করছেন আপনি সেটার সদস্য। আপনার বিশ্বস্ততা এবং একাগ্রতা সম্পর্কে অবগত আছে সবাই। একটা দারুণ সুযোগ আপনাকে দিতে চাই আমরা। সরাসরি ঈশ্বরের হয়ে কাজ করার সুযোগ মিলবে আপনার।
ঘুম ছুটে যায় আভিলার চোখ থেকে। হাত প্রচণ্ড ঘামতে থাকে তার।
আপনাকে যে টাকাটা দেয়া হয়েছে সেটা প্রথম মিশনের জন্যে অগ্রিম, বলা হয় তার উদ্দেশ্যে, যদি মিশনটা পালনে রাজি হন আপনি, তাহলে আপনাকে কথা দিচ্ছি আরও উচ্চপদে স্থান পাবেন কিছু দিনের মধ্যেই, এটুকু বলে কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন রিজেন্ট, বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু আমাদের চার্চে একটা নির্দিষ্ট যাজকতন্ত্র মেনে চলা হয়। সেটার একদম ওপরের পর্যায়ে আপনাকে পাওয়া আমাদের জন্যে সৌভাগ্যের হবে।
প্রস্তাবটা লোভনীয় ঠেকলেও সাবধানী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো আভিলা, মিশনটা কী? আর আমি যদি রাজি না হই?
কোন সমস্যা হবে না। মুখ বন্ধ রাখার শর্তে টাকাটা রেখে দিতে পারেন আপনি। চলবে?
একটু বেশিই উদার হয়ে গেল না?
আপনাকে পছন্দ করি আমরা। সাহায্য করতে চাই। তবে আগেই সাবধান করে দিচ্ছি…পোপের দেয়া এই মিশনটা কিন্তু সহজ হবে না,। কিছুক্ষণের নীরবতার পরে আবারো বললেন রিজেন্ট, রক্তারক্তিও ঘটতে
পারে।
শক্ত হয়ে গেল আভিলার পুরো শরীর। খুনোখুনি?
অ্যাডমিরাল, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ঈশ্বরের যুদ্ধ চলছে এখন। আর যুদ্ধে তো হতাহত থাকবেই, নাকি?
বোমা বিস্ফোরণের স্মৃতিটা ফিরে এলো, যেটায় শেষ হয়ে গিয়েছিল ওর পুরো পরিবার। আমি দুঃখিত। যে মিশনে হতাহতের সম্ভাবনা আছে সেটা বোধহয় আমাকে দিয়ে-।
পোপ নিজে আপনার কথা সুপারিশ করেছেন, অ্যাডমিরাল, রিজেন্ট বললেন শান্তস্বরে, আর এই মিশনে যে আপনার মূল লক্ষ্য…সে-ই কিন্তু আপনার পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর জন্যে দায়ি।
.
অধ্যায় ৬৭
মাদ্রিদের রাজ প্রাসাদের নিচতলায় অবস্থিত অস্ত্রাগারে ঢুকলে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে। লাল রঙের দেয়ালে ঝুলছে কারুকাজ করা ট্যাপেস্ট্রি। সেগুলো জুড়ে স্পেনের ঐতিহাসিক সব যুদ্ধের দৃশ্য। পুরো ঘরে প্রায় একশটিরও বেশি হাতে তৈরি বর্ম, বল্লম এবং আগের রাজাদের ব্যবহৃত অস্ত্র শোভা পাচ্ছে। আসলে অস্ত্রাগার না বলে জাদুঘর বললেই বেশি মানাবে। সম্পূর্ণ যুদ্ধের সাজে সজ্জিত সাতজন ঘোড়সওয়ারেরও দেখা মিলবে, অবশ্য ম্যানেকুইন ওগুলো।
এখানে আমাকে বন্দি করে রাখবে ওরা? অবাক হয়ে ভাবলো কমান্ডার গারজা। চারিদিকে একবার চোখ বোলালো সে। প্রাসাদের সবচেয়ে সুরক্ষিত রুমগুলোর এটা একটা। কিন্তু গারজার ধারণা ওকে অপমান করার জন্যে ইচ্ছে করে এখানে বন্দি করা হয়েছে।
প্রায় দুই যুগ আগে এখানেই নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছিল তাকে। রয়্যাল গার্ডের প্রধানের দায়িত্ব নেবার আগে প্রাথমিক সাক্ষাৎকারটাও এখানেই হয়েছিল।
আর আজ কিনা গারজাকে নিজের লোকদের হাতেই বন্দি হতে হলো। আমাকে হত্যারকাণ্ডের মূল চক্রান্তকারি বলা হচ্ছে? বিশপকে আমি ফাঁসিয়েছি? বানোয়াট অভিযোগগুলোর কথা ভাবতই মেজাজ সপ্তমে চড়ে যাচ্ছে।
রয়্যাল গার্ডের সবচেয়ে উঁচু পদ তার। অর্থাৎ তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেয়ার মত একজনই আছে প্রাসাদে। যুবরাজ হুলিয়ান।
নিশ্চিত ভালদেসপিনোর প্ররোচনায় এ কাজ করেছে সে, ভাবলো গারজা। বিশপ বরাবরই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ। আর আজ রাতে ডামাডোলের সুযোগ নিয়ে যে কোন উপায়ে নিজের গদি বাঁচাতে বদ্ধপরিকর লোকটা। সেজন্যেই গারজাকে ফাঁসিয়েছে সে, আর এখন আমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে যাতে মুখ খুলতে না পারি।
হুলিয়ান এবং ভালদেসপিনো যদি হাত মেলায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করার থাকবে না গারজার। আর এই পরিস্থিতিতে তাকে সাহায্য করার মত একমাত্র মানুষটা জারজুয়েলা প্রাসাদের একটা ঘরে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন।
স্পেনের রাজা।
নিশ্চয়ই নিজের ছেলে আর ভালদেসপিনোর বদলে আমাকে সাহায্য করবেন না তিনি, নিজেকে বোঝালো গারজা।
বাইরে থেকে বিক্ষোভকারিদের আওয়াজ ভেসে আসছে। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে ক্রমশ। তারা যে শ্লোগান দিচ্ছে সেটা শুনে কান গরম হয়ে গেল তার।
স্পেন এলো কোথা থেকে? স্পেন যাচ্ছে কোথায়?
কিয়াৰ্শ আজ রাতে যে দুটো প্রশ্ন করেছিল সেটাকেই নিজেদের মত করে। সাজিয়ে নিয়েছে তারা। স্পেনের রাজতন্ত্র বিরোধিদের জন্যে আজ রাতটা পোয়াবারো।
বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের অনেকেই আগেকার আমলে রাজাদের নিপীড়নের উদাহরণ টেনে দাবি করে যেন রাজতন্ত্র ভেঙে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয় স্পেন। গত শতকে যেমন রাজতন্ত্র বাতিল করা হয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ডসহ পঞ্চাশটিরও বেশি দেশে। এমনকি ইংল্যান্ডেও এমন দাবি জানানো হচ্ছে, বর্তমান রাণীর মৃত্যুর পর যেন রাজতন্ত্র ভেঙে দেয়া হয়।
আর আজকের গন্ডগোলের সুযোগ নিয়ে এই দাবিটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ঠিক প্রিন্স হুলিয়ানের অভিষেক গ্রহণের আগ দিয়ে।
এই সময় অস্ত্রাগারের সামনের দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো একজন রয়্যাল গার্ড এজেন্ট। তার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো গারজা, একজন আইনজীবি চাই আমি।
আর আমার দরকার স্বীকারোক্তি, মনিকা মার্টিনের পরিচিত কণ্ঠস্বরটা কানে আসলো তার। গার্ডের আড়াল থেকে বেরিয়ে তার দিকে হেঁটে আসলো সে, কমান্ডার গারজা, কেন আপনি এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যাকারীদের সাথে হাত মিলিয়েছেন?
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তার দিকে তাকালো গারজা, আজ কি সবাই একসাথে পাগল হয়ে গেছে?
আমরা জানি, বিশপ ভালদেসপিনোকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন আপনি! মনিকা বলল, আর প্রাসাদ থেকে একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে আপনা স্বীকারোক্তি প্রকাশ করতে চাই আমরা।
কোন জবাব দিলো না কমান্ডার।
হঠাৎ রয়্যাল গার্ডের এজেন্টের দিকে ঘুরে মনিকা বলল, কমান্ডারের সাথে একান্তে কথা বলতে চাই আমি।
বিভ্রান্ত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো সেই এজেন্ট।
আবার গারজার দিকে ঘুরে চিৎকার করে উঠলো মনিকা, এখনই স্বীকারোক্তি চাই আমার!।
আমার কাছ থেকে কোন স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারবে না তুমি, ভাবলেশহীনভাবে বলল গারজা। যা করিনি সেটা কেন স্বীকার করতে যাবো আমি? সব অভিযোগ মিথ্যে।
বিচলিত দৃষ্টিতে একবার দরজার দিকে তাকালো মনিকা। এরপর গারজার কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বলল, সেটা জানি আমি…এখন আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
.
অধ্যায় ৬৮
কন্সপিরেসিনেট.কম
ব্রেকিং নিউজ
এন্টিপোপ…পালমেরিয়ানদের অদ্ভুত নিয়ম কানুন…
পালমেরিয়ানদের অদ্ভুত কেচছা-কাহিনী শুনতে তৈরি তো আপনি?
এখন আমরা এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিত যে অ্যাডমিরাল লুই আভিলা পালমেরিয়ান চার্চের একজন নিবেদিতপ্রাণ সদস্য এবং গত কয়েক বছর ধরেই তাদের সাথে জড়িত তিনি।
অ্যাডমিরাল আভিলার পরিবারের সবাই নিহত হয় সেভিয়ার চার্চে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায়। সেই দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বেঁচে যান অ্যাডমিরাল। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আভিলাকে গ্রাস করে নেয় অবসাদ। কিন্তু এরপরে তাকে সেই অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় পালমেরিয়ান চার্চ। অনেক জায়গায় নিজমুখে আভিলা স্বীকার করেছেন, পোপের সাহচর্য না পেলে হয়তো সুস্থ জীবনে ফিরতে পারতেন না তিনি।
পালমেরিয়ান চার্চ সম্পর্কে তথ্য জানতে ক্লিক করুন এখানে।
আপনাদের হাতে তথ্য তুলে দিচিছ আমরা। সেটা বিশ্বাস। করা কিংবা অবিশ্বাস করা আপনাদের ব্যাপার।
তবে অনলাইনে পালমেরিয়ানদের সম্পর্কে, তথ্য পাওয়া যায় সেগুলোর বেশিরভাগই এতটাই অদ্ভুত যে কোনটা সত্য আর কোনটা কল্পনা-সেটা বিচার করার দায়িত্ব আপনাদের ওপরই ছেড়ে দিলাম আমরা। তবে নিচের তথ্যগুলো আমাদের পাঠিয়ছে monte@iglesia.org। আর আজ রাতে আমরা দেখেছি তার সরবরাহ করা কোন তথ্যই ভুল নয়। তবে আমরা দাবি করছি না নিচের এই তথ্যগুলো পুরোপুরি সত্য। এর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দেখানোর পূর্ণ অধিকার আছে আপনাদের।
পালমেরিয়ান
পালমেরিয়ান পোপ ক্লেমেন্তে ১৯৭৬ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় তার চোখের দুই মণি হারান। সেই থেকে তার চোখের পাতা সেলাই করে বন্ধ করে দেয়া হয়। ক্লেমেন্তের দুই তালুতে দুটি ক্ষতস্থান আছে যেখান থেকে রক্ত ঝরে যদি কোন স্বর্গীয় আদেশ পান তিনি।
পালমেরিয়ান পোপদের অনেকেই স্প্যানিশ সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। পালমেরিয়ান চার্চের সদস্যদের নিজ পরিবারের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতে হয় এবং চার্চের ভেতরে পাশবিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যুও হয়েছে অনেকের
পালমেরিয়ানদের বিরত থাকতে হয়, ১. অপালমেরিয়ানদের লেখা কোন বই পড়া থেকে, ২. নিজের পরিবারের কারও বিয়ে কিংবা শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে যাওয়া থেকে (যদি না তারাও পালমেরিয়ান হয়), ৩. সমুদ্রসৈকত, বক্সিং ম্যাচ, নাচের অনুষ্ঠান কিংবা ক্রিসমাস ট্রি দেখা যাচ্ছে এমন কোন স্থান থেকে।
পালমেরিয়ানদের নতুন সদস্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্র হচ্ছে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, আমেরিকা, কানাডা এবং আয়ারল্যান্ড।
.
অধ্যায় ৬৯
ফাদার বেনার পেছন পেছন সাগ্রাদা ফামিলিয়ার বিশাল দরজার দিকে এগোলো ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা। ব্রোঞ্জের তৈরি দরজাটা দেখে বরাবরের মতনই অবাক হয়ে গেল ল্যাংডন। মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো সে।
পুরোটা জুড়ে সংকেত লিপি, মনে মনে ভাবলো ল্যাংডন। নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত প্রায় আট হাজার তিনটি অক্ষর কোন শূন্যস্থান ছাড়া লাইনের পর লাইনে এম্বস করা। আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মনে হলেও ল্যাংডনের জানা আছে।
যে শব্দগুলো আসলে খ্রিস্টের দুর্দশার কথা কাতালান ভাষায় বর্ণনা করেছে।
প্যাশন ফ্যাসেডের ওপরের দিকে তাকালে বিখ্যাত ভাস্কর জোসেপ মারিয়ার তৈরি কতগুলো ভাস্কর্য চোখে পড়বে। বিশেষ করে জিশুর ক্রুশবিদ্ধ অবস্থার একটি ভাস্কর্য সবার মনোযোগ টানতে বাধ্য। দেখলে মনে হয় যেন। যে কোন মুহূর্তে প্রবেশরত দর্শনার্থীদের ওপর পড়ে যাবে সেটা।
প্রবেশদ্বারের কাছে পৌঁছে গোটা চার্চের সবচেয়ে বিস্ময়কর ভাস্কর্যটা চোখে পড়লো ল্যাংডনের। বিস্ময়কর না বলে ভয়ংকর বললেও বোধহয় ভুল হবে না। জিশুর বিশাল একটা মূর্তি। যেটাতে একটা পিলারের সাথে দড়ি দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তাকে, চাবুকাঘাত করার পর।
আলফা এবং ওমেগা
দরজার ওপরে দুটো গ্রিক অক্ষর শোভা পাচ্ছে। আলফা এবং ওমেগা।
শুরু এবং শেষ, অ্যাম্ব্রা ফিসফিসিয়ে বলল অক্ষরদুটো দেখে, এডমন্ডের সাথে যায় ব্যাপারটা।
মাথা নেড়ে সায় জানালো ল্যাংডন, অ্যাম্ব্রা কী বলতে চাচ্ছে ধরতে পেরেছে সে। আবারো সেই একই প্রশ্ন, এলেম আমরা কোথা থেকে? যাচ্ছিই বা কোথায়?
ফাদার বেনার সাথে ভেতরে ঢুকে পড়লো ওদের চারজনের দলটা। দরজা বন্ধ করে দিলেন বয়স্ক যাজক।
এরপর ফাদার বেনার মুখ থেকে এডমন্ড কিয়ার্শ সম্পর্কে অদ্ভুত একটা গল্প শুনলো ওরা। বিশাল অঙ্কের ডোনেশন দেয়ার কথা থেকে শুরু করে ভূগর্ভস্থ আন্তোনি গদির সমাধির পাশে উইলিয়াম ব্লেকের বইটা প্রদর্শন করার শর্ত পর্যন্ত সব খুলে বললেন ফাদার।
একদম চার্চের কেন্দ্রে, কৌতূহল বেড়ে গেল ল্যাংডনের।
এডমন্ড কি আপনাকে বলেছিল, কেন এমনটা চাচ্ছিল সে? অ্যাম্ব্রা জিজ্ঞেস করলো।
মাথা নাড়লেন বেনা। আমাকে তিনি বলেন গওদির প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি হবার মূল কারণ তার মা পছন্দ করতেন এই বিখ্যাত স্থপতির কাজ। আবার উইলিয়াম ব্লেকেরও ভক্ত ছিলেন তিনি। তার পরলোকগত মায়ের প্রতি সম্মান স্বরূপ গওদির সমাধির কাছে উইলিয়াম ব্লেকের ভলিউমটা প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন এডমন্ড। আমার কাছেও কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল।
এডমন্ড তো এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি কখনও, ভাবলো ল্যাংডন। তাছাড়া একটা কনভেন্টে থাকাকালীন মৃত্যু হয়েছিল পালোমা কিয়ার্শের। একজন স্প্যানিশ নানের পক্ষে একজন ইংরেজ কবির (তাও উইলিয়াম ব্লেক) কাজ পছন্দ করার যুক্তিটা কতটা গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্ন থেকেই যায়। পুরো গল্পটা বানোয়াটও হতে পারে।
আর আমার কেন যেন মনে হয়েছিল…মি. এডমন্ড হয়তো কোন জটিল রোগে ভুগছিলেন, ফাদার বেনা বললেন।
টাইটেল কার্ডটার পেছন দিকে নির্দেশনা দেয়া আছে, ব্লেকের বইটা কিভাবে প্রদর্শন করতে হবে, বলল ল্যাংডন। ১৬৩ নম্বর পৃষ্ঠা খোলা রাখতে বলা হয়েছে না?
হ্যাঁ।
আপনি কি বলতে পারবেন, ঠিক কোন কবিতাটা আছে সেই পৃষ্ঠায়? আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন।
কোন কবিতাই নেই সেই পৃষ্ঠায়, বেনা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন।
জি?!
বইটাতে ব্লেকের সব কাজ আছে। তার আঁকা সব ছবি এবং কবিতা। ১৬৩ নম্বর পৃষ্ঠা জুড়ে আছে একটা ছবি।
চোখে অস্বস্তি নিয়ে অ্যাম্ব্রার দিকে তাকালো ল্যাংডন। তেতাল্লিশ অক্ষরের একটা পঙক্তি দরকার আমাদের, কোন ছবি নয়!
ফাদার, অ্যাম্ব্রা বলল, আমরা কি সেটা দেখতে পারি?
কিছুক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেলেন বয়স্ক যাজক, ভবিষ্যৎ রাণীর অনুরোধ রক্ষা করাটাই উচিত বলে মনে হলো তার কাছে। সমাধিস্থলে যাবার পথটা এদিকে, এই বলে চার্চের মাঝখানে ওদের নিয়ে এলেন তিনি। রয়্যাল গার্ডের এজেন্টরাও আসলো পিছু পিছু।
স্বীকার করছি, বেনা বললেন, একজন নাস্তিকের কাছ থেকে ডোনেশন নেয়ার কথা শুনে প্রথমে দ্বিধায় পড়ে যাই আমি। কিন্তু তার মার সবচেয়ে প্রিয় উইলিয়াম ব্লেকের আঁকা ছবিটার প্রদর্শন করতে বলাতে কোন দোষ খুঁজে পাইনি-বিশেষ করে সেটা যখন ঈশ্বরের ছবি।
ল্যাংডনের মনে হলো যেন কানে ভুল শুনছে সে। আপনি কি এইমাত্র এডমন্ডকে নিয়েই কথা বলছিলেন? ও বলেছে ঈশ্বরের ছবি প্রদর্শন করতে?
মাথা নেড়ে সায় জানালেন ফাদার বেনা। আমি ভেবেছিলাম আরোগ্য কামনার আশায় ঈশ্বরের সাথে ভাব করার চেষ্টা করছেন এডমন্ড, লম্বা করে শ্বাস নিলেন যাজক, বললেন, তবে আজকে রাতে ওর প্রেজেন্টেশনটা দেখার পর অবশ্য সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
ল্যাংডন কল্পনা করার চেষ্টা করলো, ব্লেকের কোন ছবিটা প্রদর্শন করতে বলেছিল এডমন্ড।
চার্চের মূল অংশে পৌঁছে ল্যাংডনের মনে হলো যেন এই প্রথম এখানে এসেছে সে। আসলে এর আগে যে কয়বার সে এখানে এসেছিল, প্রতিবারই দিনের বেলায়। সূর্যের আলো চার্চের ভেতরে প্রবেশ করে রঙিন আলোকছটায় বিচ্ছুরিত করছিল চারপাশ।
কিন্তু রাতের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সারি সারি পিলার উঠে গেছে ওপরে। দৃশ্যটা কেমন যেন অপার্থিব।
দেখে শুনে পা ফেলবেন, ফাদার বললেন, যেখানে যতটা সম্ভব টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করি আমরা। ল্যাংডনের জানা আছে ইউরোপের বড় বড় সব চার্চে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হয় লাইটিঙে।
ধীরে ধীরে ওদের চার্চের গভীরে নিয়ে যেতে লাগলেন ফাদার বেনা। যতই ভেতরে যাচ্ছে অন্ধকার তত জেঁকে বসছে। প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এখন। একটা পেনলাইট বের করে ওদের সামনে আলো ধরলো এজেন্ট ডিয়াজ। ওদের পাশে একটা পেঁচানো সিঁড়ি চার্চের মাঝখান থেকে ওপরে উঠে গেছে।
এটাই বিখ্যাত সাগ্রাদা স্পাইরাল, ভাবলো ল্যাংডন। এটা বেয়ে কখনও ওপরে ওঠার সাহস হয়নি ওর।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের করা পৃথিবীর ২০টি বিপজ্জনক সিঁড়ির তালিকার মধ্যে এটার অবস্থান তৃতীয়। এর ওপরে জায়গা পেয়েছে শুধুমাত্র কম্বোডিয়ার অ্যাঙ্কর ভাট মন্দিরের সিঁড়ি এবং ইকুয়েডরের ডেভিলস কড্রন জলপ্রপাতের পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া একটা পাথুরে সিঁড়ি।
সিঁড়িটার প্রথম কয়েকটা ধাপের দিকে তাকালো ল্যাংডন। প্যাঁচ খেতে খেতে উঠে গেছে ওপরের অন্ধকারে।
সমাধিকক্ষের প্রবেশপথটা একটু সামনে, এই বলে চার্চের মূল বেদির বামপাশে ইঙ্গিত করলেন ফাদার বেনা। কিছুদূর সামনে এগোনোর পর ল্যাংডন দেখলো, মেঝের এক অংশ ফুড়ে সোনালি আভা বের হচ্ছে।
সমাধিকক্ষ।
একটি বাঁধানো সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো পাঁচজনের দলটা।
আপনারা দুজন এখানেই থাকুন, রয়্যাল গার্ডদের উদ্দেশ্য বলল। অ্যাম্ব্রা, আমরা নিচ থেকে কাজ সেরে আসছি।
ফনসেকাকে দেখে মনে হলো না খুশি হয়েছে নির্দেশটা শুনে কিন্তু কিছু বলল না সে।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল ফাদার বেনা, অ্যাম্ব্রা এবং ল্যাংডোন।
*
এই ক্ষণিকের বিরতিটা দরকার ছিল এজেন্ট ডিয়াজের জন্যে। স্নায়ুর ওপর ক্রমাগত চাপের কারণে কিছুটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো তার বেশ খানিকক্ষণ ধরেই। তাছাড়া অ্যাম্ব্রা ভিদাল এবং এজেন্ট ফনসেকা যেভাবে একে অপরের দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকাচ্ছিল তাতে ওর ভয় হচ্ছিল যে কখন বেফাঁস কিছু বলে বসে কেউ একজন।
গার্ডিয়া এজেন্টরা শুধুমাত্র কমান্ডার গারজা বাদে অন্য কারো কাছ থেকে চাকরি চলে যাওয়ার হুমকি শুনতে অভ্যস্ত নয়।
গারজার গ্রেফতার হবার ব্যাপারটা এখনও খোঁচাচ্ছে ডিয়াজকে। ফনসেকাও তাকে পরিষ্কার করে বলেনি, কে মিথ্যে বিবৃতিটা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল মনিকা মার্টিনকে।
ব্যাপারটা একটু জটিল, তাকে বলেছিল ফনসেকা, যত কম জড়াবে এসবের সাথে, ততই মঙ্গল তোমার জন্যে।
কার নির্দেশে হচ্ছে এসব? ডিয়াজ ভাবলো, প্রিন্স হুলিয়ান? কিন্তু তার তো এমন কোন কিছুর নির্দেশ দেয়ার কথা না যেটাতে অ্যাম্ব্রা ভিদালের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। তাহলে কি ভালদেসপিনো? তার কি আসলেও এত ক্ষমতা আছে?
আসছি আমি, বাথরুমে যাবার কথা বলে চার্চের সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো এজেন্ট ফনসেকা। সে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার আগে ডিয়াজ খেয়াল করলো, পকেট থেকে ফোন বের করে কথা বলা শুরু করেছে লোকটা।
এই আলো আঁধারিতে একা একা সবার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে অস্বস্তিকর ভাবটা আবার ফিরে এলো ডিয়াজের। তাছাড়া ফনসেকার ব্যবহারও সুবিধের মনে হচ্ছে না।
.
অধ্যায় ৭০
ভুগর্ভস্থ ক্রিপ্টটা বেশ গভীরে। তবে সিঁড়িটা বেশ প্রশস্ত হওয়াতে নিচে নামতে কোন বেগ পেতে হলো না ওদের। প্রায় তিনতলা পরিমাণ ধাপ পেরিয়ে অবশেষে গন্তব্যস্থলে পৌঁছুলো।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় ক্রিপ্ট, ভাবলো ল্যাংডন। আগেরবার এসে যেরকম দেখেছিল ঠিক তেমনই আছে বিশাল জায়গাটা। প্রায় একশোজন উপাসক একসাথে বসে উপাসনা করতে পারবে এখানে। চকচকে মোজাইকের। মেঝে থেকে ওপরে উঠে গেছে অনেকগুলো পিলার। আর সেগুলোর গায়ে লতানো বৃক্ষের মত নক্সা। এখানেও প্রকৃতির ছোঁয়া।
ধূপের গন্ধ নাকে আসলো ল্যাংডনের। গোটা সমাধিকক্ষে কেমন যেন একটা শীতলতা বিরাজ করছে। এত বড় একটা জায়গা তাও মাটির এত গভীরে, একমাত্র গদির বলেই সম্ভব হয়েছে।
সিঁড়ির থেকে নেমেই একটু বামে তাকালে চোখে পড়বে একটা ধূসর রঙের বিশাল পাথরের স্ল্যাব। সেটার চারদিকে জ্বলছে অনেকগুলো প্রদীপ। পাথরের গায়ে খোদাই করা লেখাটা পড়লো ল্যাংডন।
বিখ্যাত স্থপতির শেষ আশ্রয় হয়েছে তার সেরা সৃষ্টির নিচে এই পাতালকক্ষে। কেন যেন এই মুহূর্তে এডমন্ডের কথা মনে পড়লো ল্যাংডনের। সমাধিটার ওপরে সজ্জিত কুমারি মেরির ভাস্কর্যটার দিকে তাকালো সে।
এটা কী করে সম্ভব?!
অদ্ভুত চিহ্নটাকে ভালো করে দেখার জন্যে সামনে এগিয়ে গেল ল্যাংডন।
অদ্ভুত চিহ্নটা
এমনটা খুব কমই হয় যে দেখামাত্র কোন সাংকেতিক চিহ্ন চিনতে পারছে না সে। গ্রিক ল্যামডা অক্ষরটা চিনতে অবশ্য অসুবিধে হচ্ছে না তার, কিন্তু খ্রিস্টধর্মের সাথে তো এই অক্ষরের কোন সম্পর্ক নেই। বরং ল্যামডা হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রতীক। এর ব্যবহার পদার্থবিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ এবং কসমোলজিতে। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ঠেকছে ল্যামড়ার ওপরের ক্রুশচিহ্নটা।
বিজ্ঞান সমর্থিত ধর্ম? এরকম কোন কিছু আগে কখনো দেখেনি ল্যাংডন।
প্রতীকটা দেখে অবাক হয়ে গেলেন? ফাদার বেনা জানতে চাইলেন ওর কাছে। শুধু আপনি না, অনেকেই জিজ্ঞেস করে এটার ব্যাপারে। আসলে এটা পাহাড়চূড়ায় একটা ক্রুশকে উপস্থাপন করছে। একটু আধুনিকায়নের চেষ্টা বলতে পারেন।
ক্রুশ
আরেকটু সামনে ঝুঁকে প্রতীকটার তিনপাশে তিনটি ছোট ছোট তারা দেখতে পেলো ল্যাংডন।
এরকম অবস্থানে তিনটা তারা, ল্যাংডন ভাবলো। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল ওর, কারমেল পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত কুশটা! এটা একটা কারমেলাইট ক্রুশ।
ঠিক ধরেছেন। গওদি শুয়ে আছেন কারমেল পাহাড়ের কুমারি মেরির নিচে।
গওদি কি একজন কারমেলাইট ছিলেন? এটা বিশ্বাস করতে ল্যাংডনের কষ্ট হচ্ছে যে গওদির মতন আধুনিকতাবাদি একজন কিনা বারোশ শতাব্দির এক কট্টরপন্থি ক্যাথলিক সংগঠনের অনুসারি।
অবশ্যই না, হেসে জবাব দিলেন বেনা। কিন্তু তার শেষ দিনগুলোতে যারা তাকে সেবা-যত্ন করেছিল তারা ছিল ক্যারমেলাইট। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ক্যারমেলাইট গোষ্ঠির কয়েকজন নান তার সাথে থেকে তার দেখাশোনা করতেন। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তার খেয়াল রেখেছিলেন তারা। আর মৃত্যুর পরেও যে তারা গওদির খেয়াল রাখছেন তেমনটা বোঝানোর জন্যেই এই কুশটা খোদাই করা হয়েছে এখানে।
বেশ, ছোট্ট করে বলল ল্যাংডন। মনে মনে নিজেকে ভর্ৎসনা করছে এরকম নিরীহ একটা প্রতীককে অন্য কিছু ভাবার জন্যে। হয়তো আজ রাতের সব উদ্ভট জল্পনা কল্পনার ফসল এটা।
ওটাই কি এডমন্ডের বইটা? অ্যাম্ব্রার কণ্ঠ শুনে সম্বিত ফিরে পেলো ল্যাংডন।
ঘুরে দেখলো, গওদির সমাধির ডানদিকে ইঙ্গিত করছে সে। কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে জায়গাটা।
হ্যাঁ, ফাদার বেনা জবাব দিলেন, আমি দুঃখিত, এখানটায় ঠিকমতো আলো পড়ে না।
ডিসপ্লে কেসটার দিকে এগিয়ে গেল অ্যাম্ব্রা। ল্যাংডন আর ফাদার বেনাও এগোলে সেদিকে। একটা বিশাল পিলারের ছায়ায় উইলিয়াম ব্লেকের বইটা রাখা হয়েছে।
ওখানে সাধারণত চার্চের বিভিন্ন তথ্যসমৃদ্ধ পুস্তিকা রাখা হতো আগে, বললেন বেনা, কিন্তু আমি এডমন্ডের বইটাকে জায়গা দেয়ার জন্যে ওগুলোকে অন্যখানে সরিয়ে দিয়েছি।
অ্যাম্ব্রার পাশে চলে এসে কাঁচের ডিসপ্লে কেসটার ভেতরে তাকালো। ল্যাংডন। উইলিয়াম ব্লেকের সমস্ত কাজের প্রাচীন ভলিউমটা শোভা পাচ্ছে। ভেতরে। ১৬৩ নম্বর পৃষ্ঠাটা দেখা যাচ্ছে আবছা আলোয়।
ফাদার বেনা ওদের যেমনটা বলেছিলেন, পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে ব্লেকের আঁকা একটা ছবি। ল্যাংডন আগে থেকেই এ বিষয়ে ভাবছিলো, কোন ছবিটা দেখতে হতে পারে তাকে। কিন্তু যেটা দেখলো সেটার কথা কল্পনাতেও আসেনি তার।
The Ancient of Days, ছবিটা চিনতে পেরেছে ল্যাংডন। ১৭৯৪ সালে আঁকা হয়েছিল এটা।
ফাদার বেনা যে এটাকে ঈশ্বরের ছবি বলে অভিহিত করেছেন সেটা ভেবে একটু অবাকই হলো ল্যাংডন। অবশ্য খ্রিস্টধর্মে যেভাবে ঈশ্বরকে চিত্রিত করা হয় তার সাথে মিল আছে এই ছবির সাদা চুল-দাড়ির বয়স্ক গম্ভীর লোকটার, স্বর্গ থেকে মেঘের মাঝ দিয়ে মতের দিকে নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে আছে সে। তবে ফাদার বেনা যদি এ নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতেন তবে জানতে পারতেন, ছবিটা আসলে উইলিয়াম ব্লেকের রচিত পুরাণ ইউরিজেন-এর কেন্দ্রিয় চরিত্র। ছবিতে ইউরিজেনকে দেখা যাচ্ছে স্বর্গ থেকে একটা বিশাল কম্পাস নিয়ে মতপানে ধরে আছে। প্রকৃতির বৈজ্ঞানিকতার প্রতি সম্মান স্বরূপ এই ১৭৯৪ সালে জলরঙে ছবিটি এঁকেছিলেন উইলিয়াম ব্লেক।
ছবিটার শিল্পশৈলি এতটাই আধুনিক যে কয়েক শতাব্দি পর বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংস তার নিজের একটি বইয়ের প্রচ্ছদে স্থান দিয়েছিলেন সেটাকে। নিউ ইয়র্কের রকফেলার সেন্টারে একটি বিশাল ভাস্কর্যেও দেখা মিলবে কম্পাস হাতে ইউরিজেনের একটি প্রতিলিপি। ভাস্কর্যটির নাম- উইজডম, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড।
আবারো ব্লেকের বইটার দিকে তাকালো ল্যাংডন। কেন এত কাঠখড় পুড়িয়ে এটাকে এখানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে এডমন্ড সেটা ভাবতে লাগলো। খ্রিস্ট ধর্ম বিশেষ করে ক্যাথলিকদের প্রতি তার যে রাগ সেটা থেকে?
নিজের বিপুল ঐশ্বর্যকে কাজে লাগিয়ে এডমন্ড এমন একটা খ্রিস্টধর্ম বিরোধি চিত্রকে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার মত চার্চে।
তীব্র বিদ্বেষ এবং রাগ থেকেই হয়তো, ভাবলো ল্যাংডন। এডমন্ড। বরাবরই নিজের মার মৃত্যুর জন্যে কট্টরপন্থি ক্যাথলিকদের ধর্মান্ধতাকে দায়ি করে এসেছে।
অবশ্য এটা আমার ভালোমতোই জানা আছে, ছবিটা খ্রিস্টানদের ঈশ্বরকে উপস্থাপন করছে না, ফাদার বেনা বললেন এই সময়ে।
অবাক হয়ে বয়স্ক যাজকের দিকে তাকালো ল্যাংডন, ওহ? শুধু এটুকুই। বলতে সক্ষম হলো সে।
হ্যাঁ, এ ব্যাপারে কোন রাখঢাক করেনি এডমন্ড। তাছাড়া ব্লেকের ধর্মিয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ধারণা আছে আমার।
তবুও এখানে ছবিটা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন আপনি?
প্রফেসর, মৃদু হেসে বললেন বেনা, এটা সাগ্রাদা ফামিলিয়া। এখানে গওদি একাত্ম করেছেন ঈশ্বর, প্রকৃতি এবং বিজ্ঞানকে। এই ছবিটার বিষয়বস্তুর সাথে আগে থেকেই পরিচিত আমরা। অবশ্য সবাই আমার সাথে একমত নন, কিন্তু প্রগতিশীলদের সংখ্যাও কিন্তু একেবারে কম নয় আমাদের মাঝে, এটুকু বলে বইটার দিকে নির্দেশ করলেন তিনি, তবে আমি খুশি যে মি. এডমন্ড টাইটেল কার্ডটা ডিসপ্লের ভেতরে রাখার ব্যাপারে কিছু বলেননি। নাহলে ব্যাপারটা অন্যদের কাছে ব্যাখ্যা করা আমার জন্যে বেশ কষ্টদায়ক হতো, বিশেষ করে তার আজ রাতের প্রেজেন্টেশনের পর, গম্ভীর হয়ে উঠলেন তিনি, আপনারা যা খুঁজছিলেন সেটা তো মনে হয় পাননি?
না, ফাদার। আমরা উইলিয়াম ব্লেকের কবিতার একটা পঙক্তির খোঁজ করছি।
টাইগার টাইগার, বার্নিং ব্রাইট? ফাদার বেনা বললেন, ইন দ্য ফরেস্ট অ দি নাইট?
ফাদার বেনা যে ব্লেকের লেখা সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতার প্রথম পঙক্তিটা জানেন এটা শুনে অবাক হয়ে গেল ল্যাংডন, হাসি ফুটলো তার মুখে। এই কবিতাটায় জিজ্ঞেস করা হয়েছে, যে ঈশ্বর ভয়ংকর বাঘের সৃষ্টি করেছেন তিনিই কি আবার নিরীহ ভেড়ার সৃষ্টিকর্তা?
ফাদার বেনা? অ্যাম্ব্রা ডাক দিলো বয়স্ক যাজককে, আপনার কাছে ফোন বা ফ্ল্যাশলাইট হবে?
না, দুঃখিত। আন্তোনি সমাধির পাশ থেকে একটা প্রদী নিয়ে আসবো?
খুব ভালো হয় তাহলে, আন্তরিক স্বরে বলল অ্যাম্ব্রা।
দ্রুত পায়ে প্রদীপ আনতে গেলেন বেনা।
তিনি যাওয়ার সাথে সাথে ল্যাংডনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল অ্যাম্ব্রা, রবার্ট! এডমন্ড ছবিটার জন্যে এই পাতাটা ভোলা রাখতে বলেনি!
মানে? তার কথা মাথায় ঢুকলো না ল্যাংডনের। এখানে তো ছবিটা ছাড়া আর কিছুই নেই।
ইচ্ছে করে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে সে।
বুঝছি না আমি, ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল ল্যাংডন।
এডমন্ড ১৬৩ নম্বর পৃষ্ঠা প্রদর্শন করতে বলেছে কারণ তেমনটা হলে ১৬২ নম্বর পৃষ্ঠাও খোলা থাকবে ডিসপ্লের ভেতরে!।
ছবিটা থেকে বামে দৃষ্টি সরালো ল্যাংডন। আবছা আলোয় ঠিকমতো না বোঝা গেলেও এটুকু ধরতে পারলো যে, কয়েক লাইন লেখা শোভা পাচ্ছে সেখানে, পুরোটাই হাতে লেখা।
এ সময় প্রদীপটা হাতে নিয়ে ফিরে এসে সেটা অ্যাম্ব্রার হাতে দিলেন ফাদার বেনা। ওটা বইয়ের ওপর ধরলো সে। এবার পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ল্যাংডন, কিন্তু যা দেখলো তাতে দম আটকে যাবার জোগাড় হলো ওর।
এই পৃষ্ঠায় ব্লেকের নিজ হাতে লেখা একটা খসড়ার প্রতিলিপি ছাপানো হয়েছে। মার্জিনের পাশে কিছু আঁকাঝোকাও রয়েছে। লেখাটা কোন কবিতার স্তবক বলে মনে হচ্ছে।
*
ফনসেকার এতক্ষণে ফিরে আসার কথা।
নিজের পকেটের ফোনটা যখন ভাইব্রেট করে উঠলো এজেন্ট ডিয়াজ ভাবলো, ফনসেকাই ফোন দিয়েছে হয়তো। কিন্তু স্মার্টফোনটা পকেট থেকে বের করে ডিসপ্লেতে যার নাম দেখলো সেটা আশা করেনি সে।
মনিকা মার্টিন।
গণসংযোগ বিভাগের কোঅর্ডিনেটরের তার সাথে কী কাজ থাকতে পারে সেটা বোধগম্য হলো না তার। আর কোন কাজ যদি থেকেও থাকে তবে সরাসরি ফনসেকাকে ফোন দেয়ার কথা মনিকা মার্টিনের।
হ্যালো, কলটা ধরে বলল সে, ডিয়াজ বলছি।
এজেন্ট ডিয়াজ, আমি মনিকা মার্টিন। আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন একজন।
কিছুক্ষণ পর একটা পরিচিত গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে, এজেন্ট ডিয়াজ, আমি কমান্ডার গারজা। মিস ভিদাল ঠিকঠাক আছেন নিশ্চয়ই?
জি, কমান্ডার, গারজার কণ্ঠস্বর শুনেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিয়াজ, একদম ঠিক আছেন মিস ভিদাল। আমি আর এজেন্ট ফনসেকা আছি তার সাথে। এখন আমরা
ফোনে জায়গার নাম বলার দরকার নেই, গারজা বললেন, মিস ভিদাল যদি ওখানে নিরাপদে থেকে থাকেন, তবে তাকে সেখানেই রাখার ব্যবস্থা করো। অন্য কোথাও যাবে না। এজেন্ট ফনসেকাকে ফোন দিয়েছিলাম একটু আগে, কিন্তু রিসিভ করেনি সে। ও আছে এখন তোমার সাথে?
এতক্ষণ ছিল, স্যার। কিন্তু একটা ফোন করার জন্যে।
অপেক্ষা করার মত সময় নেই আমার হাতে। প্রাসাদে বন্দি করা হয়েছে। আমাকে। মিস মার্টিন অর ফোনটা ধার দিয়েছে বলে তোমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছি। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। অপহরণের ব্যাপারটা যে সাজানো সেটা নিশ্চয়ই জানা আছে তোমাদের। ব্যাপারটা ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছে মিস ভিদালকে।
সেটা আমাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে, মনে মনে বলল ডিয়াজ।
আর আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটাও মিথ্যে।
সেটা বুঝতে পেরেছিলাম স্যার, কিন্তু
মিস মার্টিন এবং আমি ভাবার চেষ্টা করছি কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়। যতক্ষন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্তে না পৌঁছাই আমরা, স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণির নিরাপত্তার পুরো দায়িত্ব তোমাদের। মনে থাকবে?
অবশ্যই, স্যার। কিন্তু কে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিটা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন?
সেটা ফোনে তোমাকে বলতে পারছি না আমি। যা বললাম সেটা করো, মিস ভিদালকে বিপদ এবং গণমাধ্যম কর্মিদের থেকে দূরে রাখো। দরকার হলে মিস মার্টিন যোগাযোগ করবে তোমাদের সাথে।
লাইন কেটে দেয়া হলো ওপাশ থেকে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ যা শুনলো সেটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো ডিয়াজ।
ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখার সময় ওর পেছন দিক থেকে একটা মৃদু শব্দ কানে আসলো তার। কাপড়ের সাথে কাপড়ের ঘষা লাগার শব্দ। তৎক্ষণাৎ ঘুরতে যাবে এই সময় সাঁড়াশির মত দুটো হাত চেপে বসলো তার ঘাড়ে। চেষ্টা করেও লৌহ কঠিন হাতটা ছাড়াতে পারলো না সে।
চিৎকার করার আগেই নিজের ঘাড় মটকানোর শব্দটা কানে আসলো ডিয়াজের।
এরপর সব অন্ধকার।