অরিজিন: ৪১-৫০. গার্ডিয়া কমান্ডার ডিয়েগো গারজা

অরিজিন: ৪১-৫০. গার্ডিয়া কমান্ডার ডিয়েগো গারজা

অধ্যায় ৪১:

গার্ডিয়া কমান্ডার ডিয়েগো গারজা দ্রুত ফিরে গেল যুবরাজের অ্যাপার্টমেন্টে, তার হাতে মনিকা মার্টিনের কম্পিউটার ট্যাবলেটটা।

ট্যাবলেটটাতে একটি রেকর্ড করা ফোনকল আছে-হাঙ্গেরিয়ান রাবাই কোভেস ইয়েহুদা আর এক ধরণের অনলাইন হুইসেল ব্লোয়ার-এই ফোনালাপের মধ্যে এতটাই আৎকে ওঠার মতো বিষয় রয়েছে যে, গারজার জন্য খুব কম অপশনই এখন হাতে আছে।

হুইসেল ব্লোয়ারের অভিযোগ অনুসারে, এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের পেছনে ভালদেসপিনো জড়িত আছেন কী নেই তাতে কিছু যায় আসে না, গারজা জানে ফোনালাপটির রেকর্ডিং ছড়িয়ে পড়লে ভালদেসপিনোর সুনাম চিরতরের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে।

যুবরাজকে অবশ্যই সতর্ক করে দিতে হবে, এই বিপর্যয়ের হাত থেকে তাকে বাঁচাতে হবে।

এই খবরটা ছড়িয়ে পড়ার আগেই প্রাসাদ থেকে সরিয়ে দিতে হবে ভালদেসপিনোকে।

রাজনীতিতে পারসেপশনই সব-তথ্য-বিক্রেতারা ভালদেসপিনোকে একেবারে গুঁড়িয়ে দেবে। আজ রাতে কোনভাবেই বিশপকে হবু রাজার আশেপাশে ঘেষতে দেয়া যাবে না।

পিআর কো-অর্ডিনেটর মনিকা মার্টিন জোর তাগিদ দিয়ে বলেছে গারজাকে, যুবরাজ যেন এক্ষুণি একটা বিবৃতি দিয়ে দেন, নইলে এসবের সাথে। উনাকে জড়ানোর ঝুঁকিটা আরো বেড়ে যাবে।

মেয়েটার কথা ঠিক, গারজা জানে। এক্ষুণি হুলিয়ানকে টিভির পর্দায় হাজির করতে হবে আমাদেরকে।

উপরে ওঠার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ট্যাবলেটটার দিকে তাকালো গারজা।

ফ্রাঙ্কোইস্ট ট্যাটুর সাথে রাবাইর ফোনালাপের রেকর্ডিংটা কন্সপিরেসিনেট প্রকাশ করে দিলে প্রকারান্তরে তৃতীয় এবং চূড়ান্ত যে ব্যাপারটি ঘটবে সে বিষয়ে মনিকা মার্টিনের সতর্কতাটি সবকিছুর চেয়ে বেশি মানহানিকর।

একটা ডাটা কন্সটেলেশন, মেয়েটা ঠিক এই শব্দই ব্যবহার করেছিল-কন্সপিরেসি থিওরিস্টরা অসংখ্য বিচ্ছিন্ন আর বিক্ষিপ্ত ডাটা থেকে অ্যানালাইজ করে অর্থবহ কোন কিছু খুঁজে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। এটাকেই বলে কন্সটেলেশন।

তারা জোডিয়াক ছিটদের চেয়ে ভালো কিছু না! রাগে ফুঁসে উঠলো সে। আকাশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা তারাগুলোর মধ্য থেকেও এই গর্দভেরা পশু-পাখির আকৃতি খুঁজে বের করে থাকে!

দুর্ভাগ্যের কথা হলো, এই ট্যাবলেটে কন্সপিরেসিনেট-এর যে ডাটা আছে সেটা একটা দিকেই ধাবিত করবে কন্সটেলেশনওয়ালাদেরকে, আর প্রাসাদের জন্য সেটা মোটেও সুখকর কিছু হবে না।

কন্সপিরেসিনেট.কম

কিয়ার্শ হত্যাকা

এ পর্যন্ত যা জানা গেল

. এডমন্ড কিয়ার্শ তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারটি বিশপ আন্তোনিও ভালদেসপিনো, আল্লামা সাঈদ আল-ফজল আর রাবাই ইয়েহুদা কোভেস নামের তিনজন ধর্মিয়নেতার সাথে শেয়ার করেছিলেন।

. কিয়ার্শ এবং ফজল, উভয়ে নিহত হয়েছেন, রাবাই ইয়েহুদা কোভেস তার বাসার ফোনের জবাব দিচ্ছেন না। মনে হচ্ছে তিনি নিখোঁজ।

. বিশপ ভালদেসপিনো বেঁচে আছেন, তার কিছু হয়নি, তাকে শেষবার দেখা গেছে রাজপ্রাসাদের দিকে যেতে।

. কিয়ার্শের ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নেভির অ্যাডমিরাল লুই আভিলাকে-তার হাতের ট্যাটুটা তাকে অতিরক্ষণশীল ফ্রাঙ্কোইস্টদের একজন বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। (একজন সুপরিচিত রক্ষণশীল হিসেবে বিশপ ভালদেসপিনো নিজেও কি ফ্রাঙ্কোইস্ট?)

. সবশেষে, গুগেনহাইমের অভ্যন্তরে এক সোর্সের মতে, অতিথিদের তালিকা লক করে দেয়ার পরও এই খুনি লুই আভিলাকে শেষ মুহূর্তে রাজপ্রাসাদ থেকে অনুরোধ করে ঢোকানো হয়েছে। (প্রত্যক্ষদর্শির মতে, এ কাজটি যিনি করেছেন তিনি ভবিষ্যৎ রাণী অ্যাম্ব্রা ভিদাল।)।

কন্সপিরেসিনেট এই মূল্যবান তথ্যগুলো দিয়ে সাহায্য করার জন্য সিভিলিয়ান ওয়াচডগ monte@iglesia.org–এর কাছে কৃতজ্ঞ।

monte@iglesia.org?

গারজা ধরেই নিয়েছে ইমেইল অ্যাড্রেসটি ভুয়া। স্পেনে Iglesia.org হলো সবচাইতে সুপরিচিত ইভাঞ্জেলিক্যাল ক্যাথলিক ওয়েবসাইট, এটা যাজক, সাধারণ মানুষ আর ছাত্রছাত্রিদেরকে জিশুর শিক্ষা দেবার একটি অনলাইন কমিউনিটি। তথ্যদাতা ইচ্ছে করেই ওদের ডোমেইনকে ব্যবহার করেছে যাতে করে মনে হতে পারে অভিযোগগুলো এসেছে iglesia.org থেকে।

চালাক, ভাবলো গারজা। ভালো করেই জানে, এই সাইটের পেছনে যেসব ধার্মিক মানুষজন আছে তারা বিশপ ভালদেসপিনোর কট্টর ভক্ত। তাকে তারা খুবই শ্রদ্ধা করে থাকে। গারজা অবাক হয়ে ভাবলো, এই অনলাইন কন্ট্রিবিউটর আর রাবাইকে যে ফোন করেছিল তারা একই ব্যক্তি কিনা।

অ্যাপার্টমেন্টের দরজার সামনে এসে গারজা ভাবতে লাগলো, এরকম একটি খবর সে কিভাবে যুবরাজকে জানাবে। তারা খুব সাধারণভাবেই শুরু। করেছিল, তারপর আচমকা পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠলো যেন, রাজপ্রাসাদ একদল ভুতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। মন্তে নামের এক অদৃশ্য তথ্যদাতা? পরিস্থিতি আরো খারাপ, কেননা অ্যাম্ব্রা ভিদাল আর রবার্ট ল্যাংডনের ব্যাপারে কোন খবর গারজা এখনও পায়নি।

প্রেস যদি জানতে পারে আজকের রাতে অ্যাম্ৰা কী করেছে তাহলে আর রক্ষা নেই। ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন।

দরজায় নক না করেই ঘরে ঢুকে পড়লো কমান্ডার। যুবরাজ হুলিয়ান? লিভিং রুমের দিকে যেতে যেতে বলল সে। আপনার সাথে আমার একান্তে কথা বলতে হবে কিছুক্ষণ।

লিভিং রুমে ঢুকে গারজা থমকে দাঁড়ালো।

ঘরে কেউ নেই।

ডন হুলিয়ান? ডেকে উঠলো সে, কিচেনের দিকে চলে গেল। বিশপ ভালদেসপিনো?

পুরো অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজেও কাউকে পেলো না গারজা। যুবরাজ আর ভালদেসপিনো নেই।

সঙ্গে সঙ্গে যুবরাজের মোবাইলফোনে কল দিতেই চমকে উঠলো সে। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরেই রিংটা বাজছে, তবে সেই শব্দ খুবই মৃদু। আবারো কল দিলো গারজা। এবার রিং হবার যে শব্দটা শুনতে পেলো সেটা আসছে দেয়ালে টাঙানো একটি পেইন্টিংয়ের পেছন থেকে। সে জানে এই ছবিটার পেছনেই আছে একটা গোপন সিন্দুক।

হুলিয়ান তার ফোনটা সিন্দুকে রেখে দিয়েছেন?

গারজা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না, আজ রাতে যখন যোগাযোগ রাখাটা সবচেয়ে জরুরি তখনই কিনা যুবরাজ তার ফোনটা এভাবে রেখে গেলেন।

তারা গেছে কোথায়?

ভালদেসপিনোর ফোনে এবার কল দিলো গারজা, আশা করলো বিশপ তার ফোনের জবাব দেবেন। কিন্তু তাকে পুরোপুরি হতবাক করে দিয়ে আবারো ভোতা একটি রিং বাজার শব্দ হলো দেয়ালের ঐ সিন্দুকের ভেতর থেকেই।

ভালদেসপিনোও তার ফোনটা রেখে গেছেন এখানে?

একটা ভীতি জেঁকে বসলো গারজার ভেতরে, দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে গেল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। হলওয়ে দিয়ে যাবার সময় প্রায় দৌড়েই গেল সে, সেই সঙ্গে চিৎকার করতে করতে। তন্ন তন্ন করে উপরতলা-নিচতলা খুঁজে দেখলো।

তারা তো বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না!

গারজা যখন দম ফুরিয়ে অবশেষে দৌড়ানো থামালো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলো সাবাতিনির অভিজাত বিশাল সিঁড়ির গোড়াতে। হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল সে। তার হাতে থাকা ট্যাবলেটটা বন্ধ হয়ে গেছে এখন কিন্তু ওটার কালচে পর্দায় সে দেখতে পাচ্ছে তার মাথার উপরে, ছাদে আঁকা ফ্রেসকোটা।

পরিহাসটা তার কাছে একটু বেশিই নির্মম বলে মনে হলো। ফ্রেসকোটা গিয়াকুইন্তোর গ্র্যান্ড মাস্টারপিস-ধর্মকে রক্ষা করেছে স্পেন।

.

অধ্যায় ৪২

গালফস্ট্রিম জি৫৫০ আকাশে উঠতেই রবার্ট ল্যাংডন ডিম্বাকৃতির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে নিজের চিন্তাভাবনাগুলো জড়ো করার চেষ্টা করলো। বিগত দুটি ঘণ্টা যেন আবেগের এক ঘূর্ণিপাক ছিল-এডমন্ডের প্রেজেন্টেশন দেখার রোমাঞ্চ থেকে তার ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড সবই ঘটেছে এই সময়টাতে। এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটার রহস্য ল্যাংডনের কাছে আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে।

এডমন্ড কী এমন সিক্রেট প্রকাশ করতে চেয়েছিল?

আমরা কোথা হতে এলেম? কোথায় যাচ্ছি আমরা?

আজ রাতে এডমন্ডের সাথে স্পাইরাল ভাস্কর্যে যে কথা হয়েছিল সেটা ল্যাংডনের মনে পড়ে গেল : রবার্ট, যে আবিষ্কারটি আমি করেছি…তাতে এ দুটো প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব রয়েছে।

এডমন্ড দাবি করেছিল মানব-সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুটো প্রশ্নের সমাধান করতে পেরেছে সে। এডমন্ডের এই আবিষ্কারের খবরটা প্রকাশ যাতে

পায় সেজন্যে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তাহলে এটা প্রকাশ পেলে কতোটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতো?

ল্যাংডন কেবল নিশ্চিত করে জানে, এডমন্ড ইঙ্গত দিয়েছিল যে, এটা মানুষের অরিজিন আর নিয়তি সংক্রান্ত কিছু।

এডমন্ড কী এমন শকিং অরিজিন উন্মোচিত করেছে?

নিয়তির রহস্যটাই বা কী?

এডমন্ডকে দেখে খুবই আশাবাদি মনে হয়েছে, আর ভবিষ্যৎ নিয়েও যে সে খুব আশান্বিত সেটাও বোঝা গেছে। সুতরাং তার আবিষ্কারটি যে অ্যাপোক্যালিস্টিক কিছু না সেটা জোর দিয়ে বলা যায়। তাহলে এডমন্ড কী এমন অনুমাণ করতে পেরেছিল যে, ধর্মবেত্তারা এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো?

রবার্ট? গরম কফির কাপ নিয়ে হাজির হলো অ্যাম্ৰা। আপনি বলেছিলেন ব্ল্যাক কফি, তাই না?

হুম। ধন্যবাদ আপনাকে। কৃতজ্ঞচিত্তে কাপটা হাতে নিলো ল্যাংডন। আশা করলো তার চিন্তার জট খুলতে এই ক্যাফেইন কিছুটা সাহায্য করবে।

তার বিপরীতে বসে একটা নক্সা করা বোতল থেকে রেডওয়াইন পান করলো অ্যাম্ৰা। প্লেনে এডমন্ড শ্যাতু ক্রজ মদ রাখতো। এরকম জিনিস নষ্ট করার কোন মানেই হয় না।

জীবনে মাত্র একবার ত্রুজ চেখে দেখেছিল ল্যাংডন, ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের নিচে এক গোপন ওয়াইন সেলারে। বুক অব কেলস নামের একটি ইলুমিনেটেড পুস্তক নিয়ে তখন রিসার্চের কাজে গেছিল সে।

মদের বোতলটা দু-হাতে ধরে কোলের উপর রেখে ল্যাংডনের দিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা। আপনি একটু আগে বলেছিলেন এডমন্ড বোস্টনে গেছিল আপনাকে বিভিন্ন ধরণের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে?

হ্যাঁ, সেটা প্রায় বছরখানেক আগে। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে ধর্মগুলো যেসব কথা বলেছে, মানে আমরা কোত্থেকে এসেছি, সে-ব্যাপারে আগ্রহি ছিল সে।

তাহলে আমার মনে হচ্ছে এখান থেকেই আমরা শুরু করলে ভালো হয়, কী বলেন? মিস ভিদাল বলল। সে কী নিয়ে কাজ করছিল সেটা হয়তো আমরা জানতে পারবো।

আমিও আদি থেকেই শুরু করতে চাই, জবাবে বলল ল্যাংডন, তবে কী জানতে পারবো সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আমরা কোত্থেকে এসেছি। এ নিয়ে দুটো চিন্তাধারা রয়েছে-ধর্মিয় ব্যাখ্যায় বলা হয়, ঈশ্বর মানুষকে পুরোপুরি এই আকৃতিতেই সৃষ্টি করেছেন আর ডারউইনিয়ান মতবাদ বলে আমরা আদিম এককোষি প্রাণী থেকে ক্রমে বিবর্তিত হয়ে এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছি।

তাহলে কি এডমন্ডের আবিষ্কারটি তৃতীয় কোন সম্ভাবনার কথা বলছে? অ্যাম্ব্রা জিজ্ঞেস করলো। তার আবিষ্কারের এই পার্টটা কী হতে পারে? কী হবে, যদি তার কাছে প্রমাণ থেকে থাকে, মানুষ আদম আর হাওয়া থেকে যেমন আসেনি তেমনি ডারউইনের যে মতবাদ, সেভাবে বিবর্তিত হয়েও আসেনি?

ল্যাংডনকে স্বীকার করতেই হলো মানুষের উৎপত্তি নিয়ে এরকম কোন আবিষ্কার দুনিয়া কাঁপিয়ে দেবে। তবে সে কোনভাবেই বুঝতে পারছে না, আসলে এটা কী হতে পারে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ খুবই প্রতিষ্ঠিত একটি মতবাদ, বলল সে, কারণ এটা বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা ফ্যাক্টের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাতে পরিষ্কারভাবেই বলা আছে, কিভাবে প্রাণীকূল। বিবর্তিত হয়, পরিবেশের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেয় সময়ের। পরিক্রমায়। বিজ্ঞানের দুনিয়া তার এই মতবাদটিকে উদাত্তভাবেই গ্রহণ করে নিয়েছে।

তাই কি? অ্যাম্ব্রা বলল। আমি এমন অনেক বই দেখেছি যেখানে ডারউইনের মতবাদকে পুরোপুরি ভুল বলা হয়েছে।

উনি যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন, ফোনে উইনস্টনের কণ্ঠটা বলে উঠলো। এই ফোনটা এখন পাশের টেবিলের উপর রেখে রিচার্জ করা হচ্ছে। কেবলমাত্র বিগত দুই দশকে এ নিয়ে বিশটির মতো বই প্রকাশিত হয়েছে।

উইনস্টন যে তাদের সঙ্গে আছে এ কথাটা ল্যাংডন এতক্ষণ ভুলেই বসেছিল।

এই বইগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আবার বেস্টসেলার, যোগ করলো উইনস্টন। ডারউইন কী ভুল করেছেন…ডারউইনকে পরাভূত করা…ডারউইনের ব্ল্যাকবক্স…কাঠগড়ায় ডারউইন…ডারউইনের অন্ধকার

হ্যাঁ, কথার মাঝখানে বলে উঠলো ল্যাংডন। ভালো করেই জানে এসব বইতে ডারউইনকে ভুল প্রমাণিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি এরকম দুটো বই পড়েছিও।

ওগুলোতে কি বলেছে তারা? অ্যাম্ব্রা আরো জানতে চাইলো।

ভদ্রভাবে হাসি দিলো ল্যাংডন। সবটা তো আর বলতে পারবো না, তবে যে দুটো বই আমি পড়েছি সেগুলো খৃস্টধর্মের মৌলিক বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে। একটা বইতে এমনও দাবি করা হয়েছে, মাটির নিচে যেসব ফসিল পাওয়া যায় ওগুলো ঈশ্বর নিজেই রেখে দিয়েছেন আমাদের ধর্মবিশ্বাস পরীক্ষা করার জন্য।

অ্যাম্ব্রার চোখ কপালে উঠে গেল। ঠিক আছে, তাহলে তারা আপনার চিন্তাকে খুব একটা নাড়া দিতে পারেনি।

না, তাদের কথা আমাকে কৌতূহলি করে তুলেছিল, সেজন্যে আমি হারভার্ডের এক জীববিদ্যার প্রফেসরকে এইসব বইয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। হেসে ফেলল ল্যাংডন। এই প্রফেসর আর কেউ নন, প্রয়াত স্টিফেন জে. গুল্ড।

এই লোককে কি আমার চেনার কথা? অ্যাম্ব্রা জানতে চাইলো।

স্টিফেন জে. গুল্ড, উইনস্টন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো। একজন প্রখ্যাত। বিবর্তনবাদি এবং জীবাশ্মবিদ। তার পাঙ্কচুয়েটেড ইকুইলিব্রিয়াম থিওরি ফসিল রেকর্ডের কিছু গ্যাপকে যেমন ব্যাখ্যা করে তেমনি ডারউইনের বিবর্তনবাদকেও সমর্থন করে।

আমার কথা শুনে গুল্ড মুচকি হেসেছিলেন কেবল, বলল ল্যাংডন, তিনি বলেছিলেন, ডারউইনবিরোধি বেশিরভাগ বই-পুস্তকই ইনস্টিটিউট ফর ক্রিয়েশন রিসার্চ-এর মতো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই সংস্থাটি মনে করে বাইবেলের সব কিছু ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক দিক থেকে পুরোপুরি অভ্রান্ত-নির্ভুল।

এর মানে, উইনস্টন বলল, জ্বলন্ত অরণ্য কথা বলতে পারে, নূহ নবী একটামাত্র নৌকায় জগতের সমস্ত প্রানীকূলকে ঠাঁই দিতে পেরেছিলেন, এবং মানুষ লবনের স্তম্ভ হয়ে যেতে পারে।

সত্যি, ল্যাংডন বলল, তাছাড়াও ধর্মবহির্ভূত কিছু বইও রয়েছে যেখানে ঐতিহাসিক দিক থেকে ডারউইনকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে-ফরাসি প্রকৃতিবাদি জ-বাপ্তিস্ত লামার্কের তত্ত্ব চুরির অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যিনি প্রথম বলেছিলেন, প্রাণীরা তাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য রূপান্তরিত হয়ে থাকে।

এই ধরণের চিন্তাভাবনা অপ্রাসঙ্গিক, প্রফেসর, উইনস্টন বলল। ডারউইন কার কাছ থেকে চুরি করেছে কী করেনি তার সাথে বিবর্তনবাদের সত্য-মিথ্যা নির্ভর করে না।

এ নিয়ে আমিও কোন তর্ক করবো না, অ্যাম্ব্রা বলল। রবার্ট, আমি ধরে নিচ্ছি আপনি প্রফেসর গুন্ডকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা কোথা হতে এসেছি? আর তিনি নিঃসন্দেহে বলে দিয়েছেন, আমরা বানর থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষ হয়েছি।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন। আমি একটু অন্যভাবে বলতে চেয়েছিলাম এটা কিন্তু গুল্ড আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, সত্যিকারের বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই যে, বিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। প্রায়োগিক দিক থেকে, আমরা এই প্রক্রিয়াটি দেখতেও পাই। তার মতে আসল প্রশ্নটা হলো : কেন বিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল? কিভাবে এটার শুরু হলো?

তিনি কি এ ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন? অ্যাম্ব্রা জানতে চাইলো।

বলেছিলেন কিন্তু আমি সে-সবের কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে তিনি একটি থট এক্সপেরিমেন্ট করে নিজের বক্তব্যটা তুলে ধরেছিলেন। এটাকে বলে ইনফিনিট হলওয়ে। একটু থেমে কফিতে চুমুক দিলো ল্যাংডন।

হ্যাঁ, খুবই হেল্পফুল ইলাট্রেশন, ল্যাংডন কিছু বলার আগেই বলে উঠলো উইনস্টন। এটা অনেকটা এরকম : কল্পনা করুন আপনি হেঁটে যাচ্ছেন দীর্ঘ একটি হলওয়ে দিয়ে–এতটাই দীর্ঘ যে আপনার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় কোত্থেকে এসেছেন, কোথায় আপনি যাচ্ছেন।

উইনস্টনের জ্ঞানের বহর দেখে মুগ্ধ হলো ল্যাংডন, তার কথার সাথে সায় দিলো।

এরপর আপনি আপনার পেছনে, উইনস্টন বলল, অনেক পেছনে একটা বল মাটিতে বাউন্স করার শব্দ শুনতে পেলেন। ঘুরে যখন বলটার দিকে তাকালেন দেখলেন ওটা বাউন্স করতে করতে আপনার দিকেই আসছে। আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে আসছে ওটা। আপনাকে অতিক্রম করে চলে গেল সামনের দিকে। যেতেই থাকলো। এক পর্যায়ে বাউন্স করতে করতে আপনার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল বলটা।

ঠিক, হেসে ফেলল ল্যাংডন। বলটা বাউন্স করছে কিনা প্রশ্ন কিন্তু সেটা নয়। কারণ পরিষ্কার দেখা গেছে বলটা বাউন্স করেছে। আমরা এটা দেখতে পারি। প্রশ্নটা হলো : বলটা কেন বাউন্স করছে? কিভাবে ওটা বাউন্স করতে শুরু করলো? কেউ কি ওটাতে লাথি মেরেছিল? নাকি বলটা খুবই স্পেশাল কিছু, নিজে নিজেই বাউন্স করতে তার ভালো লাগে? এই হলওয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মটাই এমন কি যে, চিরকালের জন্য বলটা বাউন্স না করে উপায় নেই?

গুন্ড বলতে চেয়েছেন যেটা, উইনস্টন শেষে বলল, তা হলো, বিবর্তনবাদের মাধ্যমে আমরা সুদূর অতীতে যে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল সেটা দেখতে পাই না।

ঠিক বলেছো, ল্যাংডন বলল। আমরা কেবল দেখতে পাই এটা ঘটছে।

একই কথা কিন্তু বিগ ব্যাং থিওরির বেলায়ও খাটে, উইনস্টন বলল। কসমোলজিস্টদের কাছে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ নিয়ে অনেকগুলো ফর্মুলা রয়েছে-T-অতীতে এবং ভবিষ্যতে। কিন্তু তারা যখন ফিরে তাকায় কখন বিগ ব্যাং সংঘটিত হয়েছিল-যেখানে T হলো শূন্যের সমকক্ষ-তখন গণিতজ্ঞদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। অসীম তাপ আর ঘনত্বের রহস্যময় কোন কণার কথা বলে তারা।

ল্যাংডন আর অ্যাম্ব্রা মুগ্ধ দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকালো।

আবারো ঠিক বলেছো, প্রফেসর বলল। আর যেহেতু মানুষের মস্তিষ্ক অসীম ব্যাপারটাকে ভালোমতো বুঝে উঠতে পারে না তাই আজকাল বিজ্ঞানীরা কেবলমাত্র বিগ ব্যাং-এর পরে কী ঘটেছে তা নিয়েই আলোচনা করে-যেখানে T হলো শূন্যের চেয়ে বড় কিছু-যার ফলে গণিত আর রহস্যময় আধ্যাত্মিকতায় পরিণত হয় না।

ল্যাংডনের হারভার্ডে একজন নামকরা পদার্থবিদ তার মহাবিশ্বের উৎপত্তি। বিষয়ক সেমিনারে দর্শনবিভাগের ছেলেপেলেদের নিয়ে এতোটাই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, শেষে তিনি তার ক্লাসরুমের দরজায় একটা সাইন লাগাতে বাধ্য হোন।

আমার ক্লাসে, T> 0
যারা প্রশ্ন তুলবে T = 0,
দয়া করে তারা ধর্মিয় ডিপার্টমেন্ট ভিজিট করুন।

পান্সপারমিয়ার ব্যাপারটা কি? উইনস্টন জিজ্ঞেস করলো। এই মতবাদটি বলে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে অন্য কোন গ্রহের উল্কাপিণ্ড অথবা কসমিক ধূলো থেকে? পান্সপারমিয়াকে এই পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার বেলায় বৈজ্ঞানিকভাবে বেশ গ্রহণযোগ্য মতবাদ হিসেবেই দেখা হয়।

এটা যদি সত্যিও হয়ে থাকে, ল্যাংডন বলল এবার, এতে কিন্তু জানা যায় না কিভাবে এই মহাবিশ্বে প্রথম প্রাণের সূত্রপাত হলো। আমরা নিছক পথের উপরে পড়ে থাকা ক্যানে লাথি মেরে চলেছি, অগ্রাহ্য করে চলেছি বাউন্সি বলের উৎপত্তি কোত্থেকে হলো, আর এড়িয়ে যাচ্ছি বিশাল একটি প্রশ্নকে : কোত্থেকে প্রাণের আবির্ভাব হয়েছে?

উইনস্টন চুপ মেরে গেল।

মদে চুমুক দিলো অ্যাম্রা, তাদের দুজনের এইসব কথাবার্তা উপভোগ করছে সে।

গালফস্ট্রিম বিমানটি আকাশে থিতু হতেই ল্যাংডন ভাবতে শুরু করলো, এডমন্ড যদি সত্যি বহু প্রাচীন প্রশ্ন আমরা কোথা হতে এলাম-এর উত্তরটা পেয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সেটা পৃথিবীর জন্য কী রকম হতে পারে?

তারপরও এডমন্ডের মতে, এই প্রশ্নের জবাব নাকি বড় একটি সিক্রেটের কেবলমাত্র একটি অংশ।

সত্য যাই হোক, এডমন্ড তার আবিষ্কারের সবটাই একটা পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে রেখেছে-সাতচল্লিশ অক্ষরের একটি কবিতার পঙক্তি। সবকিছু যদি পরিকল্পনামতো এগোয়, ল্যাংডন আর অ্যাম্ব্রা খুব জলদিই এডমন্ডের বার্সেলোনার বাড়িতে গিয়ে এটা উদঘাটন করতে পারবে

.

অধ্যায় ৪৩

প্রায় এক দশক আগে এর সূচনালগ্ন থেকেই বেশির ভাগ অনলাইন ব্যবহারিকারির কাছেই ডার্ক ওয়েব একটি রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে। প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিন দিয়ে এতে প্রবেশ করা যায় না, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের এই নিষিদ্ধ আর অন্ধকার জগতে নামপরিচয় গোপন রেখে প্রবেশ করা যায় অভাবনীয় সব অবৈধ জিনিস আর সার্ভিসের মেনুতে।

এর শুরুটা হয়েছিল অবৈধ মাদকের প্রথম অনলাইন ব্ল্যাক মার্কেট সিল্ক রোড-এর হোস্টিং করার মধ্যে দিয়ে। এরপর থেকে ডার্ক ওয়েবে গড়ে ওঠে নিষিদ্ধ সাইটের বিশাল একটি নেটওয়ার্ক, যেখানে অস্ত্র থেকে শুরু করে, শিশু পর্নোগ্রাফি, রাজনৈতিক সিক্রেট, এমনকি পতিতা, হ্যাকার, স্পাই, সন্ত্রাসি আর পেশাদার খুনির মতো লোকদেরকে ভাড়া করার সুযোগও রয়েছে।

প্রতি সপ্তাহে ডার্ক ওয়েবে লেনদেন হয় কয়েক মিলিয়ন ডলার, আজ রাতে বুদাপেস্টের রুইন বারগুলোর সামনে এরকম একটি লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে।

নীল রঙের জিন্স প্যান্ট আর বেইজবল ক্যাপ পরা লোকটি চুপিসারে চলে এলো কাজিনজি স্ট্রিটে, শিকারের জন্য একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় অপেক্ষা করলো সে। এরকম মিশন তার জন্য রুটিরুজির বিষয় হয়ে উঠেছে গত পাঁচ বছর ধরে। আনফ্রেন্ডলি সলুশন, হিটম্যান নেটওয়ার্ক আর বেসামাফিয়ার মতো হাতেগোনা কিছু জনপ্রিয় নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই সে কেবল কাজ নিয়ে থাকে।

খুনি ভাড়া করার ইন্ডাস্ট্রিটা পরিণত হয়েছে বিলিয়ন ডলারের এক শিল্পে, আর দিন দিন সেটা বেড়েই চলেছে কারণ ডার্ক ওয়েবে ছদ্মবেশে দরাদরি করার নিশ্চয়তা আছে, এটার পেমেন্ট ট্রেস করা সম্ভব হয় না বিট কয়েনের মাধ্যমে লেনদেন করা হয় বলে। বেশির ভাগ হিট করা হয় ইস্যুরেন্স জালিয়াতি, খারাপ ব্যবসায়িক পার্টনারশিপ অথবা সমস্যা সঙ্কুল বিয়ের কারণে। কিন্তু এ কাজ যারা করে তারা কখনও নীতি-নৈতিকতা আর যুক্তি নিয়ে মাথা ঘামায় না।

কোন প্রশ্ন নয়, খুনি মনে মনে বলল। এটাই হলো আমার ব্যবসার অকথিত নিয়ম।

আজকের কাজটা সে পেয়েছে কয়েক দিন আগে। তার ছদ্মবেশি নিয়োগদাতা তাকে ১৫০০০০ ইউরো অফার করেছিল বৃদ্ধ রাবাইর বাড়ির বাইরে ওঁৎ পেতে থেকে অ্যাকশন-এ যেতে হবে। অ্যাকশন বলতে প্রয়োজনে লোকটার বাড়িতে অনুপ্রবেশ করে পটাসিয়াম ক্লোরাইডের ইনজেকশন দেয়াকে বোঝানো হয়েছে। এটা ইনজেক্ট করলে খুব দ্রুত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে মানুষ।

আজ রাতে অপ্রত্যাশিতভাবেই রাবাই মাঝরাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে সিটি-বাসে উঠে বসেছিলেন। খুনিও তার পিছু নেয়, এবং তার স্মার্টফোনে একটা এনক্রিপ্টেড প্রোগ্রামের সাহায্যে তার নিয়োগদাতাকে জানিয়ে দেয় সেটা।

টার্গেট বাড়ি থেকে বের হয়ে বার ডিস্ট্রিক্টের দিকে যাচ্ছে।

সম্ভবত কারোর সাথে দেখা করার জন্য?

তার নিয়োগদাতা সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিয়েছিল।

শেষ করে দাও।

এখন রুইন বার আর অন্ধকার গলিগুলোতে শুরু হয়ে গেছে নজরদারির এক ইঁদুর-বিড়াল খেলা।

*

রাবাই ইয়েহুদা কোভেস কাজিনজি স্ট্রিট দিয়ে যাবার সময় দম ফুরিয়ে রীতিমতো ঘেমে উঠেছেন। তার ফুসফুস যেন জ্বলে যাচ্ছে। সেই সাথে মনে হচ্ছে তার ব্লাডারটা বুঝি ফেটেই যাবে এখন।

আমার দরকার একটা টয়লেট আর একটু বিশ্রামের, ভাবলেন তিনি। বুদাপেস্টের সবচেয়ে বিখ্যাত রুইন বার হিসেবে পরিচিত বার সিমপ্লার সামনে একদল লোক জড়ো হয়েছে। এখানে আছে নানা বয়সি আর বিভিন্ন পেশার মানুষজন তাই তারা দ্বিতীয়বার রাবাইয়ের দিকে তাকিয়েও দেখলো না।

আমাকে একটু থামতে হবে, ঠিক করলেন তিনি। বারের দিকে এগিয়ে গেলেন এবার।

এক সময় অভিজাত বেলকনি আর লম্বা লম্বা জানালার চোখ ধাঁধানো একটি ম্যানশন ছিল এটি, বার সিমপ্লা এখন পুরোপুরি গ্রাফিতি নামের দেয়ালচিত্রে আবৃত। EGG-ESH-AY-GED-REH! লেখা একটি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন কোভেস।

কয়েক মুহূর্ত পরই তিনি বুঝতে পারলেন এটা আসলে হাঙ্গেরিয়ান শব্দ egészségedre-এর ফোনেটিক বানান-যার মানে চিয়ার্স!

ভেতরে ঢুকেই অবিশ্বাসের সাথে কোভেস দেখতে পেলেন বারটা বিশাল আকারের একটি ঘর। এখানকার দেয়ালগুলোও গ্রাফিটি দিয়ে ভরা, তবে সেই সাথে রয়েছে সোভিয়েত আমলের পোস্টার, ক্লাসিক্যাল ভাস্কর্য, হাঙ্গেরিয়ান লতা-পাতা। ঘরের ভেতরের বেলকনিগুলো লোকে পরিপূর্ণ। গানের তালে তালে নাচছে তারা। বাতাসে সিগারেট আর বিয়ারের গন্ধ। সবার সামনেই তরুণ-তরুণীরা চুমু খাচ্ছে একে অন্যেকে। বাকিরা এককোণে বসে আয়েশ করে হয় পাইপ খাচ্ছে নয়তো পালিনকা নামের স্থানীয় জনপ্রিয় ব্র্যান্ডিতে চুমুক দিচ্ছে।

কোভেস সব সময়ই পরিহাসের সাথে দেখে আসছেন, ঈশ্বরের সৃষ্টি সেরা জীব মানুষের ভেতরটা এখনও পশুই রয়ে গেছে। আমরা আমাদের শরীরকে সুখ দেই এই আশায় যে, আমাদের আত্মা সেটা অনুসরণ করবে। এরকমটি যারা করে তাদেরকে কাউসেলিং করে করে কোভেসের জীবনের বেশিরভাগ। সময় অতিবাহিত হয়েছে। এরা খাবার আর যৌনতা ছাড়া কিছুই বোঝে না। পাশবিক সুখ চায় শুধু। ইন্টারনেট আসক্তি আর সস্তা মাদকের কারণে দিন দিন তার কাজটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

কোভেসের এ মুহূর্তে যে পাশবিক সুখটা দরকার সেটা হলো রেস্টরুম। সেজন্যে যখন দেখতে পেলেন ওয়াশরুমের সামনে দশ জন লোক লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে তখন আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। রেগেমেগে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলেন তিনি। তাকে বলা হয়েছে ওখানে নাকি অনেকগুলো রেস্টরুম আছে। দোতলায় উঠে অনেকগুলো ঘরের গোলকধাঁধা পেরিয়ে রাবাই চলে এলেন ছোট্ট একটি বার অথবা সিটিং এরিয়ার সামনে। এক বারটেন্ডারকে রেস্ট রুমের কথা জিজ্ঞেস করলে সে একটা হলওয়ে দেখিয়ে দিলো। তার শেষ মাথায় আছে রেস্টরুমটা। বেলকনিগুলোর পাশ দিয়ে যেতে হয় ওখানে।

কোভেস দ্রুত এগোতে লাগলেন বেলকনিগুলোর সামনে দিয়ে, ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য একটা হাত রাখলেন রেলিংয়ে। যেতে যেতে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন প্রচুর সংখ্যক লোক চড়া মিউজিকের তালে তালে নেচে চলেছে।

তারপরই কোভেস সেটা দেখতে পেলেন।

থমকে দাঁড়ালেন কয়েক মুহূর্তের জন্য, তার রক্ত হিম হয়ে গেল।

লোকজনের ভিড়ের মধ্যে বেইজবল ক্যাপ পরা লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, তার দৃষ্টি কোভেসের দিকে নিবদ্ধ। অল্প কিছুক্ষনের জন্য তাদের মধ্যে চোখাচোখিও হয়ে গেল। এরপর প্যান্থারের মতো ক্ষিপ্রতায় মানুষের ভিড় ঠেলে উপরে উঠে আসতে শুরু করলো ক্যাপ পরা লোকটি।

বার সিমপ্লা খুনির কাছে খুবই পরিচিত একটি জায়গা। তাই খুব দ্রুত সে বেলকনিতে চলে আসতে পারলো যেখানে তার টার্গেটকে একটু আগে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।

কিন্তু রাবাই ওখানে নেই।

আমি তোমাকে অতিক্রম করিনি, খুনি ভাবলো, তার মানে তুমি এই ভবনের ভেতরেই আছো।

অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোরের দিকে তাকিয়ে খুনির মুখে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি। বুঝে গেল তার শিকার কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে।

করিডোরে প্রস্রাবের কটু গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। শেষমাথায় একটি কাঠের দরজা আছে।

খুনি হন হন করে এগিয়ে গেল সেদিকে, টোকা দিলো দরজায়।

কোন সাড়াশব্দ নেই।

আবারো নক করলো।

ঘরের ভেতর থেকে গম্ভির একটা কণ্ঠ গজগজ করে উঠলো।

বচসাসসান মেগ! ভদ্রকণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা করলো খুনি। পা দিয়ে জোরে জোরে শব্দ তুলে চলে গেল একপাশে, তারপর পরক্ষণেই ঘুরে পা টিপে টিপে চলে এলো দরজার কাছে। কান পেতে দরজার ওপাশের শব্দ শোনার চেষ্টা করলো সে। ভেতরে রাবাই উদভ্রান্তের মতো হাঙ্গেরিতে নিচু কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছে।

আমাকে একজন খুন করতে চাইছে! সে আমার বাড়ির বাইরে ছিল! এখন এই বারেও চলে এসেছে! প্লিজ, আমার জন্য সাহায্য পাঠান!

বোঝাই যাচ্ছে, তার টার্গেট ১১২ নাম্বারে ডায়াল করেছে। এটা আমেরিকান ৯১১-এর সমতুল্য বুদাপেস্টের একটি নাম্বার। তবে এরা খুব। দেরিতে রেসপন্স করে বলে দুর্নাম রয়েছে। তাসত্ত্বেও খুনি ভাবলো আর দেরি করা ঠিক হবে না।

পেছনে তাকিয়ে দেখলো সে একাই আছে এখানে। তার শক্তিশালি কাঁধটা দরজায় ঠেকিয়ে একটু পিছিয়ে গেল তারপর মিউজিকের বিটের সাথে তাল মিলিয়ে জোরে ধাক্কা দিলো সে।

প্রথম ধাক্কাতেই পুরনো আমলের দরজাটা খুলে গেল। খুনি ভেতরে ঢুকে বন্ধ করে দিলো দরজাটা। এবার সে শিকারের মুখোমুখি।

লোকটা ঘরের এককোণে জড়োসরো হয়ে আছেন, ভয়ে কাঠ হয়ে আছে একেবারে।

রাবাইর ফোনটা নিয়ে নিলো খুনি, কলটা কেটে দিয়ে টয়লেটে ফেলে দিলো সেটা।

তো-তোমাকে কে পাঠিয়েছে?! তোতলালেন রাবাই।

আমার কাজের সৌন্দর্যটাই হলো এমন যে, জবাব দিলো লোকটা, এটা জানার কোন উপায়ই থাকে না আমার।

বৃদ্ধলোকটা এখন হাসফাস করছেন, দর দর করে ঘেমে উঠছেন। হঠাৎ করেই দম ফুরিয়ে হাফাতে লাগলেন। তার চোখদুটো যেন কোটর থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসছে। দু-হাতে চেপে ধরে আছেন নিজের বুকটা।

সত্যি? খুনির ঠোঁটে হাসি। তার হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে?

বাথরুমের মেঝেতে বৃদ্ধ মানুষটি কুকড়ে পড়ে গেলেন, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। প্রচণ্ড ব্যথায় বুকটা দু-হাতে ধরে আছেন তিনি। চোখদুটো লাল টকটকে হয়ে আসছে। হঠাৎ করে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে রইলেন, তার ব্লাডার থেকে প্রস্রাব বের হয়ে ভেসে গেল জায়গাটা।

অবশেষে রাবাই নিথর হয়ে পড়ে রইলেন।

খুনি উপুড় হয়ে দেখলো তার টার্গেট নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিনা। কোন শব্দ নেই।

মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। যতোটা ভেবেছিলাম, তুমি আমার কাজ তারচেয়ে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে।

এ কথা বলেই খুনি দরজা খুলে বের হয়ে গেল।

*

রাবাই কোভেসের ফুসফুস বাতাস নেবার জন্য হাসফাস করে উঠলো।

এইমাত্র তিনি তার জীবনের সেরা পারফর্মেন্সটি দেখিয়েছেন।

প্রায় অচেতন হয়ে গেলেও নিথর হয়ে পড়ে থেকে খুনির পায়ের শব্দটা শুনতে পেলেন তিনি। বাথরুম থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছে সে। দরজা খোলার শব্দ হলো, তারপরই বন্ধ করার শব্দটা।

নিরবতা।

জোর করে আরো কয়েক সেকেন্ড পড়ে রইলেন কোভেস। তার আক্রমণকারি হলওয়ে দিয়ে চলে গেছে কিনা নিশ্চিত হতে চাইছেন। এরপর আর অপেক্ষা করতে না পেরে বুক ভরে বাতাস নিয়ে নিলেন রাবাই। যেন প্রাণ ফিরে পেলেন আবার। বাথরুমের এই কটু গন্ধও তার কাছে স্বর্গের মতো মনে হলো।

আস্তে করে চোখ খুলে তাকালেন তিনি। অক্সিজেনের অভাবে তার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আছে। মাথাটা একটু তুলতেই দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এলো। কিন্তু অবিশ্বাসের সাথেই তিনি দেখতে পেলেন বন্ধ দরজার সামনে একটা কালচে অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে।

তার দিকে তাকিয়ে হাসছে বেইজবল ক্যাপ পরা লোকটি।

বরফের মতো জমে গেলেন কোভেস। সে ঘর থেকে বেরই হয়নি।

বড় বড় পা ফেলে খুনি এগিয়ে এলো রাবাইর কাছে, শক্ত করে তার ঘাড়টা ধরে আবারো ফেলে দিলো মেঝেতে।

তুমি তোমার দম বন্ধ করে রাখতে পারো, খেঁকিয়ে উঠলো খুনি, কিন্তু হার্ট না। হেসে ফেলল সে। ভয়ের কিছু নেই। এ কাজে আমি তোমাকে বেশ সাহায্য করতে পারবো।

একটু পরই ঘাড়ের পাশে তীক্ষ্ণ সূঁচের মতো উষ্ণতা টের পেলেন কোভেস। তরল আগুন যেন তার গলা আর মাথায় ছড়িয়ে পড়লো। এবার যখন তার হৃদপিণ্ডটা থেমে গেল, তিনি বুঝতে পারলেন এটা একেবারে আসল।

ঈশ্বর আর মৃত ধার্মিকদের বসবাস যেখানে সেই শামায়িম-এর রহস্যে সারাটা জীবন উৎসর্গ করার পর রাবাই ইয়েহুদা কোভেস এখন বুঝতে পারছেন, সব প্রশ্নের উত্তর আর মাত্র একটি হৃদস্পন্দন থেকে দূরে আছে।

.

অধ্যায় ৪৪

জি ৫৫০ জেটের বড়সর রেস্টরুমের ভেতরে অ্যাম্ব্রা ভিদাল এখন একা সিঙ্কের। সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আয়নার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে হটওয়াটার দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছে হাতদুটো। আয়নায় যে চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে সেটা তার কাছেও অচেনা মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে।

কী করেছি আমি?

আরেক চুমুক মদ খেলো সে, কয়েক দিন আগেও যে পুরনো জীবনটা ছিল সেটা ফিরে পেতে ব্যাকুল এখন-কেউ চেনে না, সিঙ্গেল, জাদুঘরের কাজে ডুবে থাকা-তারপর হঠাৎ করেই সব কিছু নেই হয়ে গেল। হুলিয়ান তাকে প্রপোজ করার সাথে সাথেই বাষ্পের মতো উধাও হয়ে গেল সেই জীবনটা।

না, নিজেকে শুধরে দিলো সে। এটা উধাও হয়েছে যখন তুমি হ্যাঁ বলেছো তারপর থেকে।

আজকের রাতের হত্যাকাণ্ডটি তার যুক্তিবুদ্ধিতে মারাত্মক আঘাত হেনেছে। যে ভীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত সে।

আমি এডমন্ডের খুনিকে জাদুঘরে ঢুকতে দিয়েছি।

প্রাসাদের কেউ আমার সাথে চালাকি করেছে।

আর এখন আমি, অনেক বেশি কিছু জেনে ফেলেছি।

হুলিয়ান যে এই জঘন্য খুনের পেছনে জড়িত আছে তার কোন প্রমাণ নেই, এমনকি সে খুনের পরিকল্পনার কথা জানে কিনা সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তারপরও কথা থাকে, প্রাসাদের অভ্যন্তরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে অ্যাম্রা, নিজের চোখে দেখেছেও অনেক কিছু। সুতরাং তার সন্দেহ, যুবরাজকে অন্ধকারে রেখে কিংবা তার আশির্বাদ ছাড়া এসব কিছু করা সম্ভব নয়।

আমি হুলিয়ানকে অনেক বেশি বলে দিয়েছি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কাজের প্রয়োজনে বেশি সময় দিতে পারছিল না বলে অ্যাম্ব্রা মনে করেছিল তার ঈর্ষাকাতর ফিয়ান্সেকে একান্তে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশন সম্পর্কে বিস্তারিত খুলে বলা দরকার। এখন তার ভয় হচ্ছে, তার এই অকপটতা আর স্বচ্ছতা দেখানো প্রয়াসের কারণেই এরকম ঘটনা ঘটে গেছে।

পানির ট্যাপটা বন্ধ করে হাতদুটো শুকিয়ে নিলো অ্যাম্ব্রা। মদের বোতলে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তার সবটুকু পান করে নিলো সে। আয়নার দিকে তাকিয়ে একদম অচেনা একজন মানুষকে দেখতে পেলো-এক সময় আত্মবিশ্বাসি একজন মানুষ এখন অনুশোচনা আর লজ্জায় ডুবে আছে।

কয়েক মাসের মধ্যে আমি বেশ কিছু ভুল করেছি…

পেছনের সময়গুলোর কথা মনে করে সে ভাবলো, এছাড়া অন্য কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা। চার মাস আগে মাদ্রিদের এক বৃষ্টিস্নাত রাতে রেইনা সোফিয়া মিউজিয়াম ফর মডার্ন আর্ট-এর একটি তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল…

অতিথিদের বেশিরভাগই মিউজিয়ামের সবচাইতে বিখ্যাত শিল্পকর্ম পাবলো পিকাসোর এল গুয়ের্নিকা দেখার জন্য চলে এসেছিল ২০৬.০৬ নাম্বার রুমে। পঁচিশ ফিট দীর্ঘ পিকাসোর এই পেইন্টিংটা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়কার বাস্ক নামের একটি ছোট্ট শহরে যে বিভীষিকাময় বোমা বর্ষণ করা হয়েছিল তার উপরে আঁকা। অ্যাম্ব্রা অবশ্য মনে করে, এই পেইন্টিং এতটাই যন্ত্রণাদায়ক যে, এটা বেশিক্ষণ দেখা যায় না। ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্প্যানিশ স্বৈরাচার জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বর্বর শাসনামলের অত্যাচার আর নির্যাতনের বিভীষিকা ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

তাই সে তার প্রিয় শিল্পী মারুয়া মায়ের একটি শিল্পকর্ম দেখার জন্য নির্জন এক গ্যালারিতে গিয়েছিল। গালিশিয়ায় জন্ম নেয়া এই পরাবাস্তববাদি শিল্পীর সফলতা ত্রিশের দশকে স্পেনের নারীশিল্পীদের দ্বার উন্মোচনে ভূমিকা রাখে।

লা ভারভেনার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধদৃষ্টিতে ছবিটা দেখছিল অ্যাম্ৰা। জটিল সব সিম্বল দিয়ে একটি রাজনৈতিক স্যাটায়ার ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিতে। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটি ভারি কণ্ঠ শুনতে পায় সে।

এস কাসি গুয়াপা কমো তু, লোকটা বলেছিল। ছবিটা আপনার মতোই সুন্দর।

সিরিয়াসলি? পেছনে না ফিরেই অবাক হওয়ার ভঙ্গি থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পেরেছিল অ্যাম্ব্রা।

কুয়ে ক্রিস কুয়ে সিগনিফিকা? লোকটা বলে। এটা দিয়ে কী বুঝিয়েছে বলে মনে করেন আপনি?

আমার কোন ধারণাই নেই, মিথ্যে বলেছিল সে, আর সেটাও ইংরেজিতে। ভেবেছিল ইংরেজিতে জবাব দিলে লোকটা চলে যাবে। আমি শুধু এটা পছন্দ করি।

আমিও পছন্দ করি, লোকটা নিখুঁত ইংরেজিতে জবাব দিয়েছিল। মায়ো তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। দুঃখের বিষয় হলো, অনভিজ্ঞ চোখে পেইন্টিংটার বাহ্যিক সৌন্দর্য ঢেকে দেয় এর গূঢ় অর্থটাকে। একটু থেমেছিল লোকটা। আমার মনে হয় আপনার মতো একজন এরকম সমস্যা সব সময়ই মোকাবেলা করেন।

অ্যাম্ব্রা আক্ষেপ করে উঠেছিল। এসব কথাবার্তা কী মেয়েদের বেলায় সত্যি কাজ করে? ভদ্র একটা হাসি দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সে। স্যার, আপনি যে এটা বলেছেন সেটা আপনার বদান্যতা, কিন্তু

অ্যাম্ব্রা ভিদাল কথার মাঝপথেই জমে গিয়েছিল।

যে লোকটাকে তার সামনে দেখতে পাচ্ছে, বলতে গেলে তাকে টিভিতে, ম্যাগাজিনে সারাজীবন ধরেই দেখে আসছে।

ওহ্! অ্যাম্ৰা তোতলাতে শুরু করে। আপনি…

বেয়াদপ? হ্যান্ডসাম মানুষটা মজা করে বলল। গর্দভ বোকা? আমি দুঃখিত। আমার জীবনটা একেবারে ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দি, এসব বিষয়ে আমি তেমন একটা ভালো নই। হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সে। আমার নাম হুলিয়ান।

আমার মনে হয় আপনার নামটা আমি জানি, স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজার সাথে হাত মেলাতে মেলাতে আরক্তিম মুখে বলেছিল অ্যাম্ব্রা। তার ধারণার চেয়েও অনেক বেশি লম্বা, সেইসাথে মায়ারভরা চোখ আর আত্মবিশ্বাসি হাসি। আমি জানতাম না আজকের অনুষ্ঠানে আপনি আসবেন, অ্যাম্ৰা বলতে শুরু। করে, দ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি পারদো ম্যান-মানে গয়া, ভেলাকুয়েজ…ক্লাসিক এসব ঘরানার ছবি বেশি পছন্দ করেন।

আপনি বলতে চাচ্ছেন, রক্ষণশীল আর সেকেলে? উষ্ণ হাসি দিয়ে বলেছিলেন যুবরাজ। আমার মনে হয় আমার বাবার সাথে আপনি আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন। মায়ো আর মিরো আমার প্রিয় শিল্পী।

অ্যাম্ব্রা আর যুবরাজ সেদিন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিল। মানুষটা আর্টের উপরে ভালো জ্ঞান রাখে দেখে মুগ্ধও হয়েছিল সে। অবশ্য এই মানুষটা বেড়ে উঠেছে মাদ্রিদের রাজপ্রাসাদে, ওখানে স্পেনের সেরা শিল্পকর্মগুলো রাখা আছে। সম্ভবত তার নার্সারিতে এল গ্রেকোর অরিজিনাল ছবিটাই টাঙানো। থাকে।

আমি জানি এটা একটু বেশি আগ বাড়িয়ে করে ফেললাম, স্বর্ণের অ্যাম্বস করা বিজনেস কার্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন যুবরাজ, তবে আমি খুবই খুশি হবো আপনি যদি আগামিকালের একটি ডিনার পার্টিতে আমার সাথে যোগ দেন। কার্ডে আমার ব্যক্তিগত নাম্বারটা আছে। আমাকে শুধু জানালেই হবে।

ডিনারের দাওয়াত দিচ্ছেন? জোক করে বলেছিল অ্যাম্ব্রা। আপনি আমাকে ঠিকমতো চেনেনই না।

অ্যাম্ব্রা ভিদাল, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিলেন যুবরাজ। উনচল্লিশ বছর বয়স আপনার। সালামাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্ট হিস্ট্রির উপরে একটা ডিগ্রি আছে। আমাদের বিলবাওর গুগেনহাইম জাদুঘরের একজন ডিরেক্টর আপনি। সম্প্রতি লুই কোয়াইলসকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার ছিলেন। আমি স্বীকার করছি তার শিল্পকর্মে আধুনিক জীবনের যে ভীতিকর ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেগুলো অল্পবয়েসিদের জন্য উপযুক্ত নয়। তবে আপনি যে তার কাজগুলোকে বানস্কির সাথে তুলনা করেছেন সে-ব্যাপারে। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। আপনি কখনও বিয়ে করেননি। আপনার কোন সন্তান-সন্ততিও নেই। আর আপনাকে কালো পোশাকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়।

অ্যাম্ৰার মুখ হা হয়ে গেছিল। হায় ঈশ্বর। এরকম অ্যাপ্রোচ কি আসলেই কাজ করে?

আমার কোন ধারণাই নেই, তিনি বলেছিলেন হেসে। তবে আমার মনে হয় আমরা সেটা দেখে নিতে পারি।

ঠিক তখনই দু দু-জন গার্ডিয়া এজেন্ট উদয় হয় সেখানে। যুবরাজকে প্রহরা দিয়ে একদল ভিআইপি অতিথিদের মাঝে নিয়ে যায়।

কার্ডটা ধরে রাখার সময় অ্যাম্ব্রা ভিদালের মনে হয়েছিল, অনেক বছর এরকম কিছু সে ধরেনি। প্রজাপতি। যুবরাজ কি এইমাত্র আমাকে ডেট করার জন্য প্রস্তাব দিলেন?

অ্যাস্ত্রা ছিল বেশ লম্বা আর হালকা গড়নের এক টিনেজার। ছেলেরা তাকে বাইরে যাবার প্রস্তাব দিলে তাদের সমকক্ষ হিসেবেই মনে করতো। পরবর্তিতে তার সৌন্দর্য বিকশিত হলে অ্যাম্ব্রা হঠাৎ করেই যেন আবিষ্কার করে, পুরুষ মানুষ তার উপস্থিতিতে কেমন ভীতু হয়ে পড়ে। এলোমেলো কথা বলে, অতিরিক্ত আত্মসচেতন আর পুরোপুরি ভিন্ন একজন মানুষ হয়ে ওঠে তারা। কিন্তু আজ রাতে একজন সাহসি পুরুষ নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে তার সাথে কথা। বলেছে, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে। এটা নারীত্বের অনুভূতি দিয়েছে তাকে। নিজেকে অল্পবয়েসি তরুণী বলে মনে হয়েছে তার।

পরের দিন রাতে অ্যাম্রাকে তার হোটেল থেকে এক ড্রাইভার রাজপ্রাসাদে নিয়ে যায়, সেখানে দুই ডজন অতিথির সাথে যুবরাজের পাশে বসে সে।

অতিথিদের অনেকেই তাকে সোসাইটি পেজ আর পলিটিক্সের কারণে চিনতে। পারে। যুবরাজ তাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন একজন চমৎকার নতুন। বন্ধু হিসেবে। তারপর রাজকীয় ভোজের সময় শুরু হয় আর্ট নিয়ে আলাপ, তাতে অ্যাম্ব্রা বেশ ভালোমতোই অংশ নিতে পেরেছিল। তার এ-ও মনে হয়েছিল, এক ধরণের অডিশন নেয়া হচ্ছে তার। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এতে সে কিছুই মনে করেনি। বরং সে অভিভূত হয়েছিল।

ঐ রাতের শেষের দিকে হুলিয়ান তাকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, আশা করি আপনার ভালো লেগেছে। আপনার সাথে আবারও দেখা করতে পারলে আমার ভালো লাগবে। একটু হেসে আবার বলেছিলেন, বৃহস্পতিবার রাতে দেখা করলে কেমন হয়?

ধন্যবাদ আপনাকে, জবাবে বলেছিল অ্যাম্ব্রা, কিন্তু কাল সকালে আমার ফ্লাইট আছে, বিলবাওতে ফিরে যেতে হবে।

তাহলে আমিও আপনার সাথে যাবো, বলেছিলেন তিনি। এক্সানোবে রেস্টুরেন্টে কখনও গেছেন?

হেসে ফেলেছিল অ্যাম্ব্রা। এক্সানোবে হলো বিলবাওর সবচাইতে মনোলোভা একটি রেস্টুরেন্ট। সারা বিশ্বের শিল্পরসিকেরা ওখানে নিয়মিত যায়। রেস্টুরেন্টটা আভা-গারদে ডেকোর আর রঙ্গিন কুইজিন দিয়ে সজ্জিত। ওখানে ডিনার করলে মনে হয়, মার্ক শ্যাগালের ল্যান্ডস্কেপের সামনে বসে বুঝি ডিনার করা হচ্ছে।

তাহলে তো দারুণ হয়, অ্যাম্ব্রা বলেছিল।

এক্সানোবেতে বসে জমকালো ডিনার করার সময় হুলিয়ান রাজনৈতিক। আলাপ শুরু করে। তার বাবার ছায়া থেকে বের হয়ে আসার জন্য তাকে কী রকম রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে, বাবার অসুস্থতা এবং রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ব্যাপারটা যে তার উপরে ভীষণ চাপ। সৃষ্টি করছে–এসব কথা বলেন। অ্যাস্ত্রা তার মধ্যে নিষ্পাপ আর ঘেরাটোপে বন্দি এক বাচ্চা ছেলের প্রতিচ্ছবি, সেইসাথে ভবিষ্যতে একজন দেশপ্রেমিক নেতার মিশ্রন খুঁজে পেয়েছিল।

যে রাতে হুলিয়ানের সিকিউরিটি গার্ডরা সবার অলক্ষ্যে তার প্রাইভেট প্লেনে তুলে দেয়, অ্যাম্ব্রা জানতো সে পুরোপুরি ধরাশায়ি হয়ে গেছে।

তুমি তাকে তেমন একটা চেনোই না, নিজেকে বলেছিল অ্যাম্রা। আস্তে ধীরে এগোও।

পরবর্তি কয়েক মাস মনে হয়েছে কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার, কারণ অ্যাম্ৰা আর হুলিয়ান নিয়মিত দেখা করে গেছে ঐ সময়ে প্রাসাদে ডিনার করা, গ্রামের দিকে তাদের এস্টেটে পিকনিক করতে যাওয়া, এমনকি রাতের বেলায় ম্যাটিনি শোতে ছবি দেখাও বাদ দেয়নি। তাদের বোঝাঁপড়াটা ছিল সাবলিল। অ্যাম্ব্রা স্মরণ করতে পারে না এর আগে সে এতটা সুখি কখনও ছিল কিনা। হুলিয়ানের মধ্যে যে সামান্য একটু সেকেলে ভাব আছে সেটা অ্যাম্ব্রার কাছে ভালোই লাগতো। প্রায়ই হাত ধরতো তার, সুযোগ পেলেই আলতো করে চুমু খেতো, কিন্তু কখনওই প্রচলিত রীতিনীতির যে সীমানা সেটা লঙ্ঘন করেনি। অ্যাম্ব্রা তার

এই আদব-কায়দাকে সাধুবাদই দিতো।

তিন সপ্তাহ আগে, এক রবিবার সকালে গুগেনহাইম জাদুঘরের আসন্ন একটি প্রদশনির উপরে এক টিভি প্রোগ্রামে অংশ নিতে মাদ্রিদে গিয়েছিল অ্যাম্ব্রা। আরটিভিইর তেলেদিয়ারিও অনুষ্ঠানটি সারা দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখে থাকে, এরকম একটি লাইভ অনুষ্ঠানে যেতে অ্যাম্রার মধ্যে কিছুটা উদ্বিগ্নতা কাজ করলেও, সে জানতো এর ফলে তার জাদুঘরটি ব্যাপক ন্যাশনাল কাভারেজ পাবে।

ঐ শোয়ের আগের দিন রাত্তোরিয়া মালাতেস্তায় হুলিয়ানের সাথে অ্যাম্ব্রা ডিনার করার পর সবার অলক্ষ্যে চলে গেছিল এল পারকুয়ে দেল রিতেরোতে। পরিবারের লোকজন বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাসি-ঠাট্টা করছে, দৌড়াদৌড়ি করছে এসব দেখে পরম শান্তি পেয়েছিল, কয়েক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গেছিল সে।

বাচ্চা-কাচ্চা পছন্দ করো তুমি? তোদিনে তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছিল।

ভীষণ পছন্দ করি ওদের, সততার সাথেই জবাব দিয়েছিল সে। এমনকি আমি কখনও কখনও এও ভাবি, আমার জীবনে একমাত্র যে জিনিসটার অভাব অনুভব করি সেটা হলো এই বাচ্চা-কাচ্চা।

চওড়া হাসি দিয়েছিলেন হুলিয়ান। বুঝতে পারছি তোমার অনুভূতিটা।

সে সময় হুলিয়ান তার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়েছিলেন। অ্যাম্রাও বুঝতে পারছিল যুবরাজ কেন এ প্রশ্ন করেছে। একটা চাপা ভীতি জেঁকে ধরেছিল তাকে। মাথার ভেতরে কণ্ঠস্বরটা চিৎকার করে বলেছিল, তাকে বলে। দাও! বলে দাও।

বলার চেষ্টা করলেও মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয়নি তার।

তুমি কি ঠিক আছো? হুলিয়ান জানতে চেয়েছিলেন উদ্বিগ্ন হয়ে।

হেসেছিল অ্যাম্ব্রা। তেলেদিয়ারো শোটা নিয়ে চিন্তায় আছি আসলে। একটু নাভাস বলতে পারো।

চিন্তা কোরো না। তুমি বেশ ভালোই করবে। আবারো হাসি দিয়ে আস্তে করে অ্যাম্ৰার ঠোঁটে চুমু খেয়েছিলেন হুলিয়ান।

পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটায় অ্যাম্ব্রা টেলিভিশনের ঐ শোয়ে উপস্থিত। বুঝতে পারলো অন-এয়ারে তিন তিনজন চমৎকার তেলেদিয়ারা উপস্থাপকের সাথে আলাপ করতে তার বেশ ভালোই লাগছে। গুগেনহাইম নিয়ে আলোচনায়। সে এতটাই মশগুল ছিল যে, খেয়ালই করেনি তার সামনে আছে কতোগুলো। টিভি ক্যামেরা, আর পঞ্চাশ লক্ষ দর্শক সরাসরি তাকে দেখছে।

গ্রাসিয়াস, অ্যাম্রা, ভে মুই ইস্তারেসান্তে, একটা সেগমেন্ট শেষ হলে মেয়ে উপস্থাপিকা বলেছিল। উন গ্রন প্লাসার কনোসার্তে।

অ্যাম্ৰা মাথা নেড়ে তাকে ধন্যবাদ জানায়, ইন্টারভিউটা শেষ হবার পথে তখন।

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো ঐ মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে সেগমেন্টটা আবার শুরু করলো দর্শকদের উদ্দেশ্যে কথা বলার মাধ্যমে। আজ সকালে, আমাদের এই তেলেদিয়াররা অনুষ্ঠানে একটি চমক আছে। আমাদের স্টুডিওতে এ মুহূর্তে তিনি অবস্থান করছেন। আমরা চাই তাকে এখানে নিয়ে আসতে।

তিনজন উপস্থাপকই দাঁড়িয়ে পড়েন তখন। সেটে প্রবেশ করে এক অভিজাত পুরুষ। স্টুডিওর সব দর্শক তাকে দেখামাত্র লাফিয়ে ওঠে, প্রবল করতালি আর উফুল ধ্বণিতে মুখরিত করে তোলে চারপাশ।

অ্যাম্ৰাও উঠে দাঁড়িয়েছিল, একেবারে হতবুদ্ধিকর হয়ে পড়েছিল সে।

হুলিয়ান?

যুবরাজ হুলিয়ান দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে তিনজন উপস্থাপকের সাথে করমর্দন করেন। এরপর তিনি অ্যাম্ৰার পাশে বসে একটা হাত রাখেন তার কাঁধে।

আমার বাবা সব সময়ই ছিলেন ভীষণ রোমান্টিক, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে স্প্যানিশে বলতে লাগলেন তিনি। আমার মা মারা গেলেও তাকে তিনি ভালোবেসে গেছেন। আমি তার এই রোমান্টিসিজমটা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি যখন কোন মানুষ তার ভালোবাসা খুঁজে পায় সেটা সে সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারে। অ্যাম্রার দিকে তাকিয়ে উষ্ণ হাসি দিয়েছিলেন তিনি। আর তাই…

অ্যাম্ব্রা বুঝে গিয়েছিল কী ঘটতে যাচ্ছে, এই অবিশ্বাস্য ঘটনায় অসাড় হয়ে পড়েছিল সে। না! হুলিয়ান! তুমি কী করছো?

সবাইকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজা হাটু গেড়ে বসে তার সামনে। অ্যাম্ব্রা ভিদাল, আমি তোমাকে একজন যুবরাজ হিসেবে নয়, শুধুমাত্র। ভালোবাসার একজন মানুষ হিসেবে বলছি। রহস্যময় হাসি দিয়েছিলেন তিনি। এসময় ক্যামেরা ছুটে এসেছিল তাদের ক্লোজআপ দৃশ্যটা নেবার জন্য। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?

দর্শক আর উপস্থাপক, সবাই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। অ্যাম্ব্রা বুঝতে পারছিল সারা দেশের লক্ষ-কোটি দর্শক তার দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মুখ আরক্তিম হয়ে উঠেছিল, হঠাৎ করেই তার মনে হতে লাগে মাথার উপরে থাকা স্টুডিওর বাতিগুলো যেন তার গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে। হুলিয়ানের দিকে তাকাতেই তার হৃদস্পন্দন লাফাতে শুরু করে। হাজারটা চিন্তা এসে ভর করে তার মাথায়।

তুমি কী করে পারলে আমাকে এরকম একটি অবস্থায় ফেলে দিতে?! মাত্র কদিন আগে আমাদের পরিচয় হয়েছে। আমার অনেক কথা আছে যা তোমাকে এখনও বলা হয়নি…এমন কিছু কথা যা সবকিছু বদলে দেবে!

অ্যাম্ব্রার কোন ধারণাই ছিল না ওভাবে কতোক্ষণ সে নিচুপ দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু শেষে উপস্থাপকদের একজন হেসে বলে ওঠেন, আমার বিশ্বাস মিস ভিদাল তব্দা খেয়ে গেছেন! মিস ভিদাল? একজন হ্যান্ডসাম যুবরাজ হাটু গেড়ে সারা দুনিয়ার সামনে আপনার প্রণয় প্রার্থনা করছেন!

সম্মানজনকভাবে এ পরিস্থিতি থেকে বের হবার পথ খুঁজতে থাকে অ্যাম্ব্রা। ঘরে পিনপতন নীরবতাটা টের পায় সে। ভালো করেই জানতো ফাঁদে পড়ে গেছে। একটামাত্র উপায়েই এই মুহূর্তটার সমাপ্তি ঘটতে পারে। আমি আসলে বিশ্বাসই করতে পারছি না, এই রূপকথার সমাপ্তিটা এরকম সুখকর হবে। একটু রিল্যাক্স বোধ করে উষ্ণ হাসি দিয়ে হুলিয়ানের দিকে তাকায় সে। অবশ্যই আমি তোমাকে বিয়ে করবো, যুবরাজ হুলিয়ান।

পুরো স্টুডিওটা করতালিতে ফেঁটে পড়ার উপক্রম হয়েছিল।

হুলিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে অ্যাম্ব্রার হাতটা ধরে তাকে জড়িয়ে ধরেন। অ্যাম্ব্রার তখন মনে হচ্ছিলো, এর আগে তারা কখনও এরকম দীর্ঘ সময়ব্যাপি একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরেনি।

দশ মিনিট পর, তারা দু-জন বসে ছিল লিমোজিনের পেছনের সিটে।

মনে হচ্ছে তোমাকে বেশ চমকে দিয়েছি, হুলিয়ান বলেন। আমি সরি। একটু রোমান্টিক হবার চেষ্টা করেছিলাম। তোমার প্রতি আমার খুবই তীব্র অনুভূতি-

হুলিয়ান, কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে ওঠে অ্যাম্ব্রা। আমারও তোমাকে বেশ ভালো লাগে, তোমার প্রতি তীব্র অনুভূতি রয়েছে কিন্তু তুমি আমাকে একটি অসম্ভব অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলে ওখানে! আমি কখনও কল্পনাও করিনি তুমি এত দ্রুত আমাকে প্রপোজ করে বসবে। আমরা একে অন্যেকে খুব ভালো করে চিনিও না। আমার অতীত নিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা তোমাকে বলার আছে-

তোমার অতীতের কোন কিছু নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না।

কিন্তু এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। অনেক বেশিই ঘামাতে হবে।

হুলিয়ান হেসে মাথা ঝাঁকিয়েছিল। আমি তোমাকে ভালোবাসি। সুতরাং এসবে কিছু যায় আসে না। তারপরও যদি মনে করো বলা দরকার, বলতে পারো।

অ্যাম্ব্রা তাকে ভালোমতো দেখে নেয় কয়েক মুহূর্ত। ঠিক আছে তাহলে। তাদের কথাবার্তা এভাবে গড়াবে এটা সে কোনভাবেই চায়নি। কিন্তু এখন আর কোন উপায় ছিল না। তাহলে বলছি, হুলিয়ান। আমি যখন ছোট্ট একটি মেয়ে ছিলাম তখন আমার ভয়ঙ্কর একটা ইনফেকশন হয়েছিল। প্রায় মরতেই বসেছিলাম আমি।

ঠিক আছে।

বাকি কথাগুলো বলার আগে অ্যাম্ব্রার মনে হচ্ছিলো তার ভেতরটা বুঝি ফাঁপা হয়ে গেছে। এরফলে আমার বাচ্চা নেবার স্বপ্নটা…কী আর বলবো, সারাটা জীবন স্বপ্ন হয়েই থাকবে।

বুঝলাম না।

হুলিয়ান, নির্বিকার কণ্ঠে বলেছিল সে। আমি বাচ্চা নিতে পারবো না। ছোটবেলার ঐ অসুখটা আমাকে বন্ধ্যা করে দিয়েছে। আমি সব সময় সন্তান চেয়ে আসছি কিন্তু নিজের জন্য এরকম কিছু পাবার উপায় নেই আমার। আমি সরি। আমি জানি এটা তোমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তুমি একটু আগে এমন এক মেয়েকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছো, যে তোমাকে কোন সন্তান। দিতে পারবে না। কোন উত্তরাধিকার দিতে পারবে না।

হুলিয়ানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় এ কথা শোনার পর।

তার চোখে চোখ রেখে অ্যাম্ৰা তাকে দিয়ে কথা বলাতে চেয়েছিল। হুলিয়ান, এটা এমন একটা মুহূর্ত যখন তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে, সব ঠিক আছে। এটা এমন একটা মুহূর্ত যখন আমাকে বলবে, এতে কিছু যায় আসে না। যাই হোক না কেন, তুমি আমাকে ভালোবাসো।

এরপরই সেটা হয়েছিল।

হুলিয়ান আস্তে করে তার থেকে একটু সরে বসেন।

তখনই অ্যাম্ব্রা বুঝে যায়, সব শেষ।

.

অধ্যায় ৪৫

গার্ডিয়া ডিভিশনের ইলেক্ট্রনিক সিকিউরিটির অবস্থান রাজপ্রাসাদের বেজমেন্টে জানালাবিহীন কতোগুলো ঘরে। ইচ্ছেকৃতভাবেই প্রাসাদের বিশাল গার্ডিয়া ব্যারাক আর আরমোরি থেকে এই ডিভিশনটি আলাদা করে রাখা হয়েছে। এর হেডকোয়ার্টারে রয়েছে কয়েক ডজন কম্পিউটার কিউবিকল, একটা টেলিফোন সুইচবোর্ড আর একদেয়াল ভর্তি সিকিউরিটি মনিটর। আটজনের একটি কর্মিবাহিনী, যাদের সবার বয়স পয়ত্রিশের নিচে, তাদের কাজ একটাই-রাজপ্রাসাদের স্টাফ এবং গার্ডিয়া রিয়েলের জন্য নিরাপদ কমিউনিকেশন্স নেটওয়ার্কের ব্যবস্থা করা। সেইসাথে প্রাসাদের নিরাপত্তার জন্য ইলেক্ট্রনিক সার্ভিল্যান্স সাপোর্ট দেয়ার কাজটাও তারা করে থাকে।

আজ রাতেও অন্যসব দিনের মতো বেজমেন্টের ঘরগুলো গুমোট, মাইক্রোওয়েভে নুডলস গরম করা হচ্ছে, পপকর্ন ভাজা হচ্ছে। বেশ শব্দ করেই গুঞ্জন করছে ফ্লুরোসেন্ট বাতিগুলো।

এখানেই আমি আমার অফিসটা রাখার কথা বলেছিলাম তাদেরকে, ভাবলো মার্টিন।

টেকনিক্যালি, পাবলিক রিলেশন্স কো-অর্ডিনেটর-এর পদটি গার্ডিয়ার না হলেও কাজের প্রয়োজনে মার্টিনকে শক্তিশালি কম্পিউটারে অ্যাকসেস থেকে শুরু করে টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ স্টাফদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়। এজন্যে ইলেক্ট্রনিক সিকিউরিটি ডিভশনটা তার কাছে নিজের বলে মনে হয় না। উপরে তার অফিসটা অপেক্ষাকৃত কম যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত।

আজ রাতে, মার্টিন ভাবলো, আমার দরকার হবে টেকনোলজির প্রায় সবকিছু।

বিগত কয়েক মাস ধরে তার প্রধান কাজ ছিল, প্রিন্স হুলিয়ান যে ধীরে ধীরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হচ্ছেন ক্ষমতার সেই পালা বদলের ব্যাপারগুলো নিয়ে। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অনেকেই এখন সোচ্চার। এরকম পালা বদলের সময় সেটা আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠছে।

স্প্যানিশ সংবিধানের মতে রাজতন্ত্র হলো স্পেনের ঐক্য আর স্থায়ীত্বের প্রতীক। কিন্তু মার্টিন জানে, এ মুহূর্তে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার মতো কিছু আরনেই স্পেনে। ১৯৩১ সালে সেকেন্ড রিপাবলিক রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়। এরপর জেনারেল ফ্রাঙ্কো সব ওলটপালট করে দেয়, ১৯৩৬ সালে গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত হয় দেশটা।

যদিও বর্তমান সময়ে রাজতন্ত্র পুণপ্রতিষ্ঠিত করাকে অনেকেই উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে অভিহিত করে থাকে, তারপরও উদারপন্থিরা এখনও পূর্বের রাজাদেরকে তাদের অত্যাচারি শাসন আর ধর্মিয়-সামরিক অতীতের জন্য নিন্দা করে থাকে। তারা প্রতিদিনই স্মরণ করিয়ে দেয়, পুরোপুরি আধুনিক বিশ্ব হতে গেলে স্পেনকে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

এই মাসে মনিকা মার্টিনের মেসেজটায় রাজাকে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যিনি সত্যিকার অর্থে কোন ক্ষমতা ভোগ করেন না। দেশের রাজা যখন দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান এবং সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে অধিষ্ঠিত তখন এসব কথা ধোপে টেকানো খুবই কঠিন।

রাষ্ট্রপ্রধান, ভাবলো মার্টিন, এমন একটা দেশের যেখানে চার্চ আর রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ নিয়ে সব সময়ই বিতর্ক চলে আসছে। অসুস্থ রাজার সাথে বিশপ ভালদেসপিনোর সখ্যতা-বন্ধুত্ব সেকুলার আর উদারপন্থিদের জন্য বহুঁকাল থেকেই চক্ষুশূল হয়ে আছে।

আর আছেন যুবরাজ হুলিয়ান, সে ভাবলো।

মার্টিন জানে তার এই চাকরির জন্য যুবরাজের কাছে সে ঋণী কিন্তু এই মানুষটাই আজকাল তার কাজ খুব কঠিন করে দিয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে যুবরাজ যে কাণ্ডটা করেছেন, পাবলিক রিলেশন্সের দিক থেকে দেখলে সেরকম কোন বিপর্যয় সে জীবনেও দেখেনি।

ন্যাশনাল টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে যুবরাজ হুলিয়ান হাটু গেড়ে বসে হাস্যকরভাবেই অ্যাম্ৰা ভিদালকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। অ্যাম্ব্রা ভিদাল সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে যে বিব্রতকর মুহূর্তটার সৃষ্টি হতো সেটা কল্পনা করলেও তার গা শিউড়ে ওঠে। ভাগ্য ভালো, এরকম কিছু ঘটেনি। মহিলা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন।

দুভার্গের ব্যাপার হলো এই বিপর্যয়ের পরই অ্যাম্ৰা ভিদাল যুবরাজের জন্য অস্বস্তি বয়ে আনেন। এই মাসে তার কিছু কাজকারবার আর আচার আচরণ মার্টিনের গণসংযোগের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে।

আজ রাতের ঘটনায় অ্যাম্ব্রা ভিদালের উপস্থিতি মনে হচ্ছে এসব দুশ্চিন্তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। বিলবাওতে যে ঘটনা ঘটে গেছে সেটার ফলাফল কতোটা মারাত্মক হতে পারে সে সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই। বিগত কয়েক ঘণ্টা ধরে কন্সপিরেসি থিওরিওয়ালারা দুনিয়া তোলপাড় করে ফেলছে। এরমধ্যে কেউ কেউ বিশপ ভালদেসপিনোর জড়িত থাকার হাইপোথিসিসও দিয়ে যাচ্ছে।

সবচাইতে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, গুগেনহাইমের খুনিকে নাকি শেষ মুহূর্তে প্রাসাদ থেকে ফোন করে অতিথিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই একটুকরো খবরটি এমন এক কন্সপিরেসি থিওরির জন্ম দিচ্ছে যে, অসুস্থ শয্যাশায়ি রাজা আর বিশপ ভালদেসপিনো ষড়যন্ত্র করে ভার্চুয়াল দুনিয়ার উপদেবতা আমেরিকান হিরো এডমন্ড কিয়ার্শ, যিনি বেশ কিছুদিন ধরে স্পেনে বসবাস করে আসছেন, তাকে হত্যা করেছে।

এটা ভালদেসপিনোকে শেষ করে দেবে, ভাবলো মার্টিন।

সবাই একটু মন দিয়ে শোনো! কন্ট্রোল রুমে ঢুকেই গারজা বলে উঠলো। যুবরাজ আর বিশপ ভালদেসপিনো এই প্রাসাদের কোথাও আছেন! সবগুলো সিকিউরিটি ক্যামেরা চেক করে তাদের অবস্থান খুঁজে বের করো এক্ষুণি!

কমান্ডার এবার মার্টিনের অফিসের সামনে এসে শান্তকণ্ঠে যুবরাজ আর বিশপের উধাও হয়ে যাবার খবরটা জানালো তাকে।

উনারা নেই মানে? অবিশ্বাসে বলে উঠলো মার্টিন। উনারা উনাদের ফোন যুবরাজের সিন্দুকে রেখে গেছেন?

কাঁধ তুলল গারজা। যাতে করে আমরা তাদেরকে ট্র্যাক করতে না পারি।

কিন্তু তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, বলল মার্টিন। যুবরাজকে এক্ষুণি একটা স্টেটমেন্ট দিতে হবে। আর বিশপের কাছ থেকে উনি যতো দূরে থাকবেন তোই মঙ্গল। নতুন খবরগুলোর সবই জানিয়ে দিলো সে গারজাকে।

এবার গারজারই অবাক হবার পালা। এগুলো সবই মনগড়া কথা। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনভাবেই ভালদেসপিনো থাকতে পারেন না।

হয়তো সেটাই, কিন্তু খুনটা মনে হচ্ছে ক্যাথলিক চার্চের সাথে সম্পর্কিত। একটু আগে কেউ একজন ঐ খুনি আর চার্চের সর্বোচ্চ মহলের সাথে একটা কানেকশান খুঁজে পেয়েছে। আপনি একটু দেখুন। কন্সপিরেসিনেট-এর লেটেস্ট আপডেটটা দেখালো মার্টিন। এখানেও হুইসেল ব্লোয়ার হিসেবে কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে monte@iglesia.org নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। এটা কয়েক মিনিট আগে লাইভে গেছে।

উপুড় হয়ে আপডেটটা পড়ে নিলো গারজা। পোপ! আৎকে উঠলো সে। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। আভিলার সাথে পোপের ব্যক্তিগত—

পড়তে থাকুন।

পড়া শেষ হলে গারজা মনিটরের সামনে থেকে একটু সরে দাঁড়ালো, পিটপিট করতে লাগলো তার চোখ। যেন দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে।

ঠিক তখনই একটা পুরুষ কণ্ঠ ডেকে উঠলো কন্ট্রোল রুম থেকে। কমান্ডার গারজা? আমি উনাদেরকে লোকেট করতে পেরেছি!

গারজা আর মার্টিন দ্রুত উঠে চলে গেল এজেন্ট সুরেশ ভাল্লার কিউবিকলের দিকে। এই ভারতীয় বংশোদ্ভুত সার্ভিলেন্স স্পেশালিস্ট একটা মনিটরের দিকে ইঙ্গিত করলো, ওটাতে দু-জন মানুষকে দেখা যাচ্ছে-একজনের পরনে বিশপের আলখাল্লা আর অন্যজনের গায়ে ফর্মাল সুট। তারা একটি বৃক্ষশোভিত পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

পুবদিকের বাগানে, সুরেশ বলল। দুই মিনিট আগের এটা।

তারা প্রাসাদ থেকে বের হয়ে গেছে?! বলে উঠলো গারজা।

একটু দাঁড়ান, স্যার। ফুটেজটা ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে বিভিন্ন ক্যামেরা থেকে পাওয়া ফুটেজের মাধ্যমে বিশপ আর যুবরাজের গতিবিধি অনুসরণ করে অবশেষে দেখা গেল, তারা দু-জন বাগান থেকে বের হয়ে আবদ্ধ একটি প্রাঙ্গনের দিকে যাচ্ছে।

তারা যাচ্ছে কোথায়?!

তারা কোথায় যাচ্ছে সে সম্পর্কে মার্টিনের বেশ ভালো ধারণাই আছে। সে এটাও খেয়াল করেছে, ভালদেসপিনো চালাকি করে একটু ঘুরপথে ওখানে গেছেন যাতে করে মেইন প্লাজায় থাকা মিডিয়া ট্রাকগুলোর নজরে না পড়েন তারা।

যেমনটা সে ভেবেছে, ভালদেসপিনো আর হুলিয়ান আলমুদেনা ক্যাথেড্রালের দক্ষিণ দিককার প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকেছেন।

দৃশ্যটা দেখে চুপ মেরে গেল গারজা। তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে, এইমাত্র কী দেখেছে সেটা তার বোধগম্য হচ্ছে না। আমাকে পোস্ট করে যেতে থাকো, অবশেষে বলল সে, মার্টিনকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে গেল ইশারায়।

কেউ যাতে তাদের কথা শুনতে না পায় সেরকম দূরত্বে গিয়ে ফিসফিস করে গারজা বলল, আমার কোন ধারণাই নেই, বিশপ কী বুঝসুঝ দিয়ে যুবরাজকে প্রাসাদের বাইরে নিয়ে যেতে পারলেন, তা-ও আবার তাদের ফোনদুটো ফেলে রেখে। তবে এটা পরিষ্কার, ভালদেসপিনোর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সে সম্পর্কে যুবাজের কোন ধারণাই নেই। এটা যদি তিনি জানতেন তাহলে তার কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন।

আমারও সেটাই মনে হচ্ছে, মার্টিন বলল। কিন্তু আমার অনুমাণ করতে খারাপ লাগছে, বিশপের শেষ চালটা কী হতে পারে…সে থেমে গেল।

কি, বলো? জানতে চাইলো গারজা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মার্টিন। মনে হচ্ছে ভালদেসপিনো এইমাত্র খুবই মূল্যবান একজন জিম্মিকে নিজের কজায় নিয়ে নিলেন।

*

প্রায় ২৫০ মাইল উত্তরে, গুগেনহাইম জাদুঘরের আর্টিয়ামের ভেতরে এজেন্ট ফনসেকার ফোনটা হঠাৎ করেই বেজে উঠলো। বিশ মিনিটে এ নিয়ে ছয়বার। কলার আইডির দিকে তাকাতেই নড়েচড়ে উঠলো সে।

সি? জবাব দিলো, তার হৃদপিণ্ড রীতিমতো লাফাচ্ছে।

ফোনের অপর প্রান্তের কণ্ঠটা স্প্যানিশে শান্ত ভঙ্গিতে বলল। এজেন্ট ফনসেকা, তুমি নিশ্চয় জানো, স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণী আজ রাতে বিশাল বড় একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছে। ভুল মানুষের সাথে জড়িয়েছে নিজেকে, আর এখন সেটা রাজপ্রাসাদের জন্য মারাত্মক বিব্রতকর ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোন ক্ষতি যাতে না হয়, সেজন্যে তাকে যতো দ্রুত সম্ভব প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে আসো।

আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, মিস ভিদালের বর্তমান অবস্থান আমাদের জানা নেই।

চল্লিশ মিনিট আগে এডমন্ড কিয়ার্শের নিজস্ব প্লেনটা বিলবাও এয়ারপোর্ট থেকে বার্সেলোনার পথে রওনা দিয়েছে, কণ্ঠটা জানালো। আমার বিশ্বাস মিস ভিদাল সেই প্লেনেই আছে।

আপনি এটা কিভাবে জানতে পারলেন? ফনসেকা একটু তেঁতে উঠলেও সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিলো।

তুমি যদি তোমার কাজটা ঠিকমতো করতে, তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলা হলো ফোনের ওপাশ থেকে, তাহলে তুমিও এটা জানতে পারতে। আমি চাই, তুমি আর তোমার পার্টনার এখনই তাকে অনুসরণ করো। তোমাদের জন্য একটা মিলিটারি প্লেন রেডি করে রাখা আছে বিলবাও এয়ারপোর্টে।

মিস ভিদাল যদি ঐ প্লেনে থেকে থাকে, ফনসেকা বলল, তাহলে তার সঙ্গে সম্ভবত ঐ আমেরিকান প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডনও আছেন।

হ্যাঁ, সে-ও আছে, কলার রেগেমেগে বলল। আমি জানি না, ঐ লোক কিভাবে মিস ভিদালকে তার সিকিউরিটি পরিত্যাগ করাতে রাজি করালো, পালাতে উদ্বুদ্ধ করলো। তবে এটা পরিষ্কার, মি. ল্যাংডন একটা বোঝা। তোমার মিশন হলো, মিস ভিদালকে খুঁজে বের করে এখানে নিয়ে আসা, এরজন্যে প্রয়োজনে বল প্রয়োগের দরকার হলে সেটাও করবে।

আর ল্যাংডন যদি তাতে নাক গলায়?

দীর্ঘক্ষণ কোন কথা বলল না ফোনের অপর পাশের কণ্ঠটা। যতোটা কম কোলাটেরাল ড্যামেজ করা সম্ভব করবে, জবাবে বলল কলার, তবে এই সঙ্কটটা এতই মারাত্মক যে, প্রফেসরের কিছু হলেও সেটা মেনে নেয়া হবে।

.

অধ্যায় ৪৬

কন্সপিরেসিনেট.কম

ব্রেকিং নিউজ

কিয়ার্শের কাভারেজ মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলোতেও প্রচার করা হচ্ছে।

আজ রাতে এডমন্ড কিয়ার্শের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘোষণাটি অনলাইনে প্রচার হতে শুরু করলে বিস্ময়করভাবে সেটা ত্রিশলক্ষ দর্শককে আকর্ষণ করে। হত্যাকাণ্ডের পর কিয়ার্শের সংবাদ অবশ্য সারাবিশের মেইনস্ট্রিম টিভি নেটওয়ার্ক গুলোতেও লাইভ সংবাদে ঠাই করে নিয়েছে। বর্তমানে এর দর্শক সংখ্যা আনুমানিক আট কোটি।

.

অধ্যায় ৪৭

কিয়ার্শের গালফস্ট্রিম বিমানটি বার্সেলোনা অভিমুখে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করতেই রবার্ট ল্যাংডন তার কফিটুকু শেষ করে নিলো। প্লেনে এডমন্ডের সংগ্রহে থাকা বাদাম, রাইস কেক নিয়ে এসেছিল অ্যাম্রা, তারা দুজনে সেগুলোর কিছুটা খেয়েও নিয়েছে, নিরামিষি খাবারগুলোর উচ্ছিষ্টের দিকে তাকালো সে। সবগুলোর স্বাদ তার কাছে একই রকম মনে হয়েছে।

টেবিলের ওপাশে অ্যাম্ৰা তার দ্বিতীয় গ্লাস রেডওয়াইনটা শেষ করেছে। এইমাত্র। তাকে বেশ রিল্যাক্স দেখাচ্ছে এখন।

আমার কথাগুলো শোনার জন্য ধন্যবাদ, তার কথা শুনে তাকে একটু লজ্জিত মনে হলো। অবশ্য, আমি কারোর সাথেই হুলিয়ানের ব্যাপারে কোন কথা বলিনি।

বুঝতে পেরে ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। হুলিয়ান কিভাবে টিভি প্রোগ্রাম চলার সময় তাকে অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে বিয়ের জন্য প্রস্তাব। দিয়েছিল সে কাহিনী একটু আগে শুনেছে। তার কোন উপায়ই ছিল না, ল্যাংডনও এমত পোষণ করলো। ন্যাশনাল টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত অনুষ্ঠানে স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেবার ঝুঁকিটা সে নিতে পারেনি।

এটা ঠিক, আমি যদি জানতাম হুলিয়ান আমাকে এত তাড়াতাড়ি প্রস্তাব দেবে, বলল অ্যাম্ৰা, তাহলে আমি তাকে বলতাম আমার পক্ষে কখনও মা হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যেভাবে সে প্রস্তাব দিয়েছে, কিছুই করার ছিল না। মাথা ঝাঁকালো অ্যাম্ৰা। বিষণ্ণচোখে প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। আমি ভাবতাম তাকে আমি পছন্দ করি। জানি না, হয়তো এর কারণ

একজন লম্বা, হ্যান্ডসাম যুবরাজ? একটু বাঁকাহাসি দিয়ে বলল ল্যাংডন।

সশব্দে হেসে উঠলো অ্যাম্ৰা। ফিরে তাকালো তার দিকে। সে নিজেও এটা জানে। আমি জানি না, আমার কাছে তাকে ভালো মানুষ বলেই মনে হয়েছে। হয়তো নির্দিষ্ট একটি ঘেরাটোপে বড় হয়েছে কিন্তু বেশ রোমান্টিক-এডমন্ডের খুনের সাথে জড়িত থাকতে পারে সেরকম কেউ বলে মনে হয়নি।

ল্যাংডনও তাই মনে করে। এডমন্ডের হত্যাকাণ্ড থেকে যুবরাজ তেমন কোন ফায়দা লুটতে পারবেন না। তাছাড়া যুবরাজ যে এরকম ঘটনার সাথে জড়িত তার কোন শক্ত প্রমাণও নেই-কেবলমাত্র প্রাসাদ থেকে একটা ফোন করে খুনি আভিলাকে অতিথিদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার ব্যাপারটা বাদ দিলে। এখন মনে হচ্ছে বিশপ ভালদেসপিনোই সন্দেহের তালিকায় এক নাম্বারে আছেন। তিনি এডমন্ডকে অনুষ্ঠানটি না করার জন্য হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন, কারণ তিনি ভালো করেই জানতেন এই ঘোষণাটি এ বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলোর উপরে কতোটা বিরূপ প্রভাব ফেলতো। কতোটা ক্ষতি করতো।

আমি অবশ্যই হুলিয়ানকে বিয়ে করতে পারবো না, শান্তকণ্ঠে বলল অ্যাম্ৰা। আমি শুধু ভাবছি, আমার সন্তান জন্ম দিতে না পারার অক্ষমতার জন্য সে হয়তো নিজে থেকেই এনগেজমেন্টটা বাতিল করে দেবে। তার পূর্বপুরুষেরা চারশত বছর ধরে রাজত্ব করে যাচ্ছে। তার বংশগতির এই ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ করার কারণ হতে চাই না আমি।

মাথার উপরে স্পিকারটা শব্দ করে উঠলো। পাইলট ঘোষণা দিলো বার্সেলোনায় ল্যান্ড করা হবে এখনই।

যুবরাজের চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালো অ্যাম্রা, কেবিনটা পরিষ্কার করতে শুরু করলো সে। টেবিলটা মুছে বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো ডিসপোজ বিনে ফেলে দিলো।

প্রফেসর, টেবিলের উপরে রাখা এডমন্ডের ফোন থেকে বলে উঠলো উইনস্টন, আমার মনে হয় আপনাদের জানা দরকার, অনলাইনে এখন নতুন খবর ভাইরাল হয়ে গেছে-বিশপ ভালদেসপিনো আর খুনি অ্যাডমিরাল আভিলার মধ্যে যে গোপন একটি লিঙ্ক আছে সেটার শক্তিশালি প্রমাণ পাওয়া গেছে।

খবরটা জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো ল্যাংডন।

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো আরো খবর আছে, উইনস্টন যোগ করলো। আপনি নিশ্চয় বিশপ ভালদেসপিনো, নামকরা এক রাবাই আর সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক ইমামের সাথে কিয়ার্শের গোপন মিটিংটার কথা জানেন। এই তিনজনের মধ্যে ইমামকে দুবাইর মরুভূমিতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। আর কিছুক্ষণ আগে বুদাপেস্ট থেকে খবর এসেছে, রাবাই ইয়েহুদা কোভেসও হৃদরোগে। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

খবরটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ল্যাংডন।

ব্লগাররা এরইমধ্যে এরকম সময় কাকতালিয়ভাবে তাদের মৃত্যু হওয়াটাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করে দিয়েছে, বলল উইনস্টন।

অবিশ্বাসে মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন। যেভাবেই দেখা হোক না কেন, বিশপ ভালদেসপিনোই এখন পৃথিবীর একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যে জানে এডমন্ড কিয়ার্শের আবিষ্কারের কথাটি।

*

গালফস্ট্রিম জি৫৫০ বার্সেলোনার সাবাদেল এয়ারপোর্টের রানওয়েটা স্পর্শ করতেই প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে কোন পাপারাৎজি কিংবা প্রেসের উপস্থিতি দেখতে না পেয়ে অ্যাম্ব্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

এডমন্ডের মতে, ভক্তদের এড়িয়ে যাবার জন্য সে বার্সেলোনার এল-পার্ত এয়ারপোর্টে না নেমে এই ছোট্ট জেটপোর্টটাই বেছে নিতো।

সত্যি বলতে, এটা আসল কারণ ছিল না, অ্যাম্ব্রা জানতো।

সত্যি হলো, এডমন্ড মনোযোগ আকর্ষণ করতে ভালোবাসতো, সুতরাং তার প্লেনটা সাবাদেল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করাটা ছিল এক ধরণের অজুহাত, সে আসলে চাইতো এখান থেকে তার প্রিয় টেসলার মডেল এক্স পি৯০ডি স্পোর্টস কারটা চালিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে। বলা হয়ে থাকে, টেসলা এবং স্পেস এক্স-এর মালিক, আরেক বিলিওনার ইলন মাস্ক নিজে এডমন্ডের হাতে গাড়িটার চাবি তুলে দিয়েছিলেন উপহার হিসেবে। শোনা যায়, এডমন্ড নাকি একবার তার পাইলটকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিল, একমাইল দীর্ঘ রানওয়েতে গালফস্ট্রিম বনাম টেসলার একটা রেস খেলার জন্য। কিন্তু পাইলট সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি।

এডমন্ডকে আমি খুব মিস করবো, বিষণ্ণ হয়ে ভাবলো অ্যাম্রা। এটা সত্যি, খুব উন্নাসিক আর দুর্মুখ হলেও মানুষটার কল্পনাশক্তি ছিল অসাধারণ। আজ রাতে তার সাথে যা ঘটে গেছে সেটা তার মতো মানুষ প্রত্যাশা করে না। এখন কেবল তার আবিষ্কারটি উন্মোচন করে তাকে সম্মান জানাতে পারি।

প্লেনটা যখন এডমন্ডের সিঙ্গেল-প্লেন হ্যাঙ্গারে ঢোকানোর পর ইঞ্জিন বন্ধ করা হলো তখন বাইরে তাকিয়ে চারপাশে শান্ত স্বাভাবিক পরিবেশ দেখতে পেলো অ্যাস্ত্রা। স্পষ্টতই, সে আর প্রফেসর ল্যাংডন রাডারের আওতায়ই ফ্লাই করেছে।

প্লেনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতেই অ্যাম্ব্রা গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো, মাথাটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো সে। দ্বিতীয় গ্লাস মদ্যপান না করলেই ভালো হতো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে এখন। হ্যাঙ্গারের সিমেন্টের মেঝেতে পা রাখতেই একটু হড়কে গেল সে, কিন্তু ল্যাংডনের শক্তহাত তার কাঁধটা ধরে ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করলো তাকে।

ধন্যবাদ, প্রফেসরের দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল সে। মনে হচ্ছে দুই কাপ কফি পান করে ভদ্রলোক বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

আমাদেরকে যতোটা সম্ভব দ্রুত সবার অলক্ষ্যে চলে যেতে হবে, বলল ল্যাংডন, দেখতে পেলো হ্যাঙ্গারের এককোণে কালো চকচকে এসইউভি গাড়িটা পার্ক করা আছে। মনে হয় এই গাড়ির কথাটাই বলেছিলেন আমাকে?

সায় দিলো অ্যাম্ৰা। এডমন্ডের গোপন প্রেম।

অদ্ভুত লাইসেন্স প্লেট দেখছি।

গাড়িটার অভিজাত নাম্বারপ্লেটের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

E-WAVE

তো, সে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো, এডমন্ড আমাকে বলেছিল, গুগল আর নাসা সম্প্রতি D-Wave নামের যুগান্তকারি একটি সুপারকম্পিউটার উদ্ভাবন করেছে-এটা এ বিশ্বের অন্যতম প্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটার। সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেসব জটিল কথা আমার মাথায় ঢোকেনি-কী সব বলছিল, সুপারপজিশন আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স সৃষ্টি করেছে সম্পূর্ণ নতুন জাতের একটি মেশিন। যাই হোক, এডমন্ড আমাকে বলেছিল, সে চায় এমন একটি কম্পিউটার বানাতে যেটা D-Wave-কেও ছাড়িয়ে যাবে। এই নতুন কম্পিউটারের নামও ঠিক করে রেখেছিল সে-E-Wave।

E মানে এডমন্ড, ল্যাংডন আমুদে ভঙ্গিতে বলল।

আর E অক্ষরটি D অক্ষরের এক ধাপ সামনে থাকে, অ্যাম্ব্রা ভাবলো। ২০০১: স্পেস ওডিসির বিখ্যাত HAL নামের কম্পিউটারের গল্পটা এডমন্ড যে তাকে বলেছি সে-কথা মনে পড়ে গেল। আরবান লেজেন্ড বলে, IBM নামটি নাকি এজন্যে রাখা হয়েছে, কারণ এটা HAL-এর প্রতিটি অক্ষর থেকে এক ধাপ এগিয়ে আছে।

গাড়ির চাবিটা? ল্যাংডন জানতে চাইলো। আপনি বলেছিলেন, এডমন্ড ওটা কোথায় লুকিয়ে রাখতো সেটা আপনি জানেন।

ও কোন চাবি ব্যবহার করতো না, এডমন্ডের ফোনটা তুলে ধরলো অ্যাম্রা। গত মাসে আমরা এখানে যখন এসেছিলাম তখন সে আমাকে এটা বলেছিল। ফোনে থাকা টেসলার অ্যাপটা ওপেন করে সামোন কমান্ড সিলেক্ট করলো এবার।

সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঙ্গারের কোণে রাখা এসইউভিটার হেডলাইট জ্বলে উঠলো, সেই সঙ্গে কোন প্রকার শব্দ না তুলেই আস্তে করে এগিয়ে এসে তাদের পাশে থেমে গেল টেসলার ইলেক্ট্রিক গাড়িটা।

ল্যাংডন ঘাড় উঁচিয়ে তাকিয়ে থাকলো। সে-ড্রাইভিং গাড়িটার কর্মকাণ্ড দেখে সে বিচলিত হয়ে পড়েছে।

ভাববেন না, তাকে আশ্বস্ত করলো অ্যাম্ৰা। আমি নিজে ড্রাইভ করে এডমন্ডের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাবে আপনাকে।

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ল্যাংডন গাড়িতে উঠতে যাবার সময় লাইসেন্স প্লেট নাম্বারটা দেখে জোরে হেসে ফেলল।

অ্যাম্ৰাও জানে কী কারণে প্রফেসর হেসে ফেলেছে-এডমন্ডের লাইসেন্স প্লেটে লেখা আছে : তারছেঁড়ারাই এই পৃথিবীর মালিক হবে।

ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলা, গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল ল্যাংডন, আর যাই হোক, এডমন্ডের কোন গুনের মধ্যে পড়ে না।

ও ওর গাড়িটা ভীষণ পছন্দ করতো, ল্যাংডনের পাশে বসে বলল অ্যাম্ৰা। পুরোপুরি ইলেক্ট্রিক আর ফেরারির চেয়েও দ্রুত গতির।

হাই-টেক ড্যাশবোর্ডের দিকে চোখ যেতেই কাঁধ তুলল ল্যাংডন। আমি আসলে ঠিক গাড়ি পাগল নই।

হেসে বলল অ্যাম্ব্রা। সমস্যা নেই, হয়ে যাবেন।

.

অধ্যায় ৪৮

আভিলার উবার গাড়িটা অন্ধকারে ছুটে যাবার সময় সে অবাক হয়ে ভাবলো, নৌবাহিনীতে থাকার সময় কতোবার সে বার্সেলোনার বন্দরে নোঙর করেছিল।

তার ঐ জীবনটা এখন মনে হয় এক জনম দূরের ব্যাপার। আর সেটা শেষ হয়েছে সেভিয়াতে আগুনের লহমায়। ভাগ্য হলো নির্দয় আর দুবোর্ধ এক রক্ষিতা। তারপরও তার মধ্যে এক ধরণের রহস্যময় স্থিতি রয়েছে। যে ভাগ্য তার হৃদয়টাকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিল সেভিয়ার ক্যাথেড্রালে, সেই একই ভাগ্য তাকে এখন দ্বিতীয় জীবন দান করেছে-একেবারে ভিন্ন ধরণের এক ক্যাথেড্রালের আশ্রমের চারদেয়ালের মধ্যে।

পরিহাসের বিষয় হলো, যে লোকটা তাকে ওখানে নিয়ে গেছিল সে মাকো নামের একজন ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট।

পোপের সাথে মিটিং? কয়েক মাস আগে তার ট্রেইনার মাকো যখন তাকে প্রস্তাব দেয় তখন আভিলা বলেছিল। আগামিকাল? রোমে?

আগামিকাল…তবে সেটা স্পেনে, জবাবে বলেছিল মাকো।

পোপ এখানে থাকেন? আভিলা তার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন লোকটা বদ্ধ উন্মাদ। মিডিয়া তো কিছুই বলেনি, হিজ হলিনেস স্পেনে আছেন এখন।

একটু আস্থা রাখুন, অ্যাডমিরাল, হেসে বলেছিল মাকো। যদি না আপনি কাল অন্য কোথাও চলে যান।

নিজের আহত পায়ের দিকে তাকিয়েছিল আভিলা।

আমরা নয়টার দিকে রওনা দেবো, মাকো বলতে থাকে। আমি কথা দিচ্ছি, আমাদের ছোট্ট এই ভ্রমণটা রিহ্যাবের চেয়ে কম যন্ত্রণা দেবে আপনাকে।

পরদিন আভিলা তার নেভির ইউনিফর্ম পরে একজোড়া ক্লাচ হাতে নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল। নেভির এই পোশাকটা তার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল মাকো নিজে। মাকোর পুরনো একটি ফিয়াট গাড়িতে করে তারা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়। আভেনিদা দে লা রাজ্জা দিয়ে যখন গাড়িটা শহর ছেড়ে উঠে আসে হাইওয়ে এন৪-এ তখন আভিলা উৎসুক হয়ে উঠেছিল।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? একটু অস্বস্তির সাথেই জিজ্ঞেস করেছিল সে।

রিল্যাক্স, হেসে বলে মার্কো। আমার উপর ভরসা রাখুন। মাত্র আধঘণ্টার পথ।

আভিলা জানতো এই হাইওয়ে এন-৪-এর আশেপাশে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত পথের চারপাশে কিছুই নেই। খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছে সে, এমন ভাবনাও পেয়ে বসে তাকে। আধঘণ্টা ভ্রমণের পর তারা এসে পৌঁছায় এল তরবিস্কাল নামে ভুতুরে এক শহরে-এক সময় সমৃদ্ধ একটি গ্রাম, যার বর্তমান বাসিন্দার সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। এ আমাকে কোথায় নিয়ে এলো?!

আরো কয়েক মিনিট গাড়ি চালানোর পর হাইওয়ে থেকে নেমে উত্তর দিকে এগোতে লাগলো মাকো।

আপনি কি এটা দেখতে পাচ্ছেন না? বহু দূরের একটি কৃষিজমির দিকে ইঙ্গিত করে বলে মাকো।

আভিলা কিছুই দেখতে পায়নি। হয় এই তরুণ ট্রেইনার হেলুসিনেশনে ভুগছে নয়তো আভিলার দৃষ্টিশক্তি কমে এসেছে বয়সের কারণে।

দারুণ না এটা?

প্রখর রোদে চোখ কুঁচকে তাকায় আভিলা। অবশেষে দেখতে পায় কালচে রঙের একটি আকার মাটি থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটু কাছে এগোতেই অবিশ্বসে চোখদুটো বিস্ফোরিত হয়ে যায় তার।

এটা…একটা ক্যাথেড্রাল?

এরকম আকার-আকৃতির ভবন মাদ্রিদ কিংবা প্যারিসে দেখা যায়। আভিলা। বলতে গেলে সারাটা জীবন সেভিয়াতেই কাটিয়ে দিয়েছে তারপরও তার জানা ছিল না এরকম বিশাল ফাঁকা এক জায়গায় একটা ক্যাথেড্রাল রয়েছে।

যতো কাছে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের গাড়িটা তোই মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছে কক্সেটি। এর চারপাশ ঘিরে থাকা বিশাল বড় সিমেন্টের দেয়ালটি আভিলাকে ভ্যাটিকান সিটির কথা মনে করিয়ে দিলো।

মেইন রাস্তা ছেড়ে ক্যাথেড্রালে যাবার ছোট্ট একটি অ্যাকসেস রোড ধরে এবার এগোতে লাগলো মাকো। সামনে দেখা গেল একটি বিশাল আর উঁচু লোহার দরজা। সেখানে আসতেই গাড়ি থামিয়ে পাশে একটি গ্লোভ বক্স থেকে লেমিনেটেড কার্ড তুলে নিয়ে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের রাখে মার্কো।

একজন সিকিউরিটি গার্ড এগিয়ে এসে কার্ডটা দেখে গাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়েছিল। মাকোকে দেখে চওড়া একটা হাসি দেয় লোকটা। বিয়েনভেনিদোস, বলে সেই গার্ড। কুয়ে তাল, মাকো?

তারা দু-জন করমর্দন করলো এবার। অ্যাডমিরালকে লোকটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো মাকো।

আ ভেনিদো অ্যা কনোসার আল পাপা, গার্ডকে বলল মাকো। সে এসেছে পোপের সঙ্গে দেখা করতে।

মাথা নেড়ে সায় দিলো গার্ড, সম্ভ্রমের সাথে আভিলার ইউনিফর্মে থাকা মেডেলগুলো দেখলো, তারপর হাত নেড়ে ভেতরে ঢোকার জন্য ইশারা করলো সে। বিশাল গেটটা খুলে গেলে আভিলার মনে হলো সে মধ্যযুগের কোন প্রাসাদে প্রবেশ করছে।

ধাপে ধাপে উপরে উঠে যাওয়া আটটি পেঁচানো টাওয়ারসহ গোথিক কাথেড্রালটি তার সামনে আবির্ভূত হলো। প্রতিটারই তিনিটি স্তরে তিনটি করে বেল টাওয়ার রয়েছে। তিনটি বিশাল আকারের গম্বুজ মিলে এর মূল কাঠামোটি তৈরি হয়েছে। বাইরের দিকটা গাঢ় বাদামি আর সাদা পাথরে তৈরি, ফলে এটাকে একটু আধুনিক ছাপ দিয়েছে।

আভিলা চোখ নামিয়ে প্রবেশ পথের দিকে তাকালো, সমান্তরালভাবে তিনটি রাস্তা চলে গেছে ভেতরে। প্রতিটি রাস্তার পাশে পামগাছের সারি। পুরো জায়গাটা বিভিন্ন ধরণের গাড়িতে ভরে আছে দেখে খুবই অবাক হলো সেলাক্সারি সেডান, দামি বাস, কাদায় ঢাকা মপেড. ..যতো ধরণের যানবাহন আছে তার সবই দেখা যাচ্ছে।

মাকো সবগুলো রাস্তা বাদ দিয়ে সোজা চলে গেল চার্চের সামনের প্রাঙ্গনের দিকে, ওখানে এক সিকিউরিটি গার্ড তাদেরকে দেখতে পেয়ে নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো, তারপর হাত নেড়ে পাশের একটি খালি পার্কিং স্পটের দিকে ইশারা করলো গাড়ি রাখার জন্য।

আমাদের একটু দেরি হয়ে গেছে, বলল মাকো। চলুন, জলদি ভেতরে ঢুকে পড়ি।

আভিলা কিছু বলতে গেলেও বলতে পারলো না, তার কথা গলার কাছে এসে আটকে গেল।

চার্চের সামনে একটা সাইন দেখতে পেয়েছে সে :

ইগলেসিয়াকাতোলিকা পালমারিয়ানা

হায় ঈশ্বর! ভড়কে গেল আভিলা। আমি এই চার্চ সম্পর্কে শুনেছি! মাকোর দিকে তাকালো সে, নিজের হৃদস্পন্দনটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। এটা আপনার চার্চ, মাকো? চেষ্টা করলো তার কণ্ঠটা শুনে যেন মনে না হয় সে ভড়কে গেছে। আপনি একজন পালমারিয়ান?

মাকো হেসে ফেলল। আপনি শব্দটা এমনভাবে বললেন যেন ওটা কোন রোগ-বালাইর নাম। আমি খুবই ধার্মিক ক্যাথলিক, যে বিশ্বাস করে রোম বিপথে চলে গেছে।

চার্চের দিকে আবারো তাকালো আভিলা। মাকো যে বলেছিল পোপকে সে চেনে সেই অদ্ভুত দাবির আসল রহস্য এবার উন্মোচিত হয়েছে তার কাছে। এই পোপ স্পেনে থাকে।

কয়েক বছর আগে টিভি নেটওয়ার্ক ক্যানাল সুর পালমারিয়ান চার্চের কিছু সিক্রেট উন্মোচন করার উদ্দেশে লা ইগলেসিয়া অসকুরা নামের একটি ডকুমেন্টারি দেখিয়েছিল। এরকম অদ্ভুত একটি চার্চের অনুসারির সংখ্যা যে দিন দিন বেড়েই চলেছে, সেটা বাদ দিলেও এমন একটি চার্চের অস্তিত্ব রয়েছে। শুনেই আভিলা রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেছিল।

লোককাহিনী মতে, স্থানীয় কিছু মানুষ কাছের একটা মাঠে পর পর কয়েকদিন রহস্যময় কিছু দেখার কথা দাবি করার পর পালমারিয়ান চার্চটা প্রতিষ্ঠা করা হয়। কথিত আছে, কুমারি মাতা মেরি তাদের সামনে আবির্ভূত হয়ে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, ক্যাথলিক চার্চ অধর্ম আর আধুনিকতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাসকে রক্ষা করা দরকার।

কুমারি মেরি পালমারিয়ানদেরকে রোমের বর্তমান পোপকে অস্বীকার করে বিকল্প একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। বর্তমান পোপকে ভুয়া পোপ বলেও তিনি অভিহিত করেছিলেন। ভ্যাটিকানের পোপ যে বৈধ পন্টিফ নয়, এটা পরিচিত সেদেভাকান্তিজম নামে-এই বিশ্বাস মতে, সেন্ট পিটারের আসন আক্ষরিক অর্থেই খালি হয়ে গেছে।

পালমারিয়ানরা দাবি করে তাদের কাছে প্রমাণ আছে আসল পোপ নাকি স্বয়ং তাদের প্রতিষ্ঠাতা ক্লেমেন্তে দোমিনগুয়েজ ফি গোমেজ, যিনি নিজের নামটা নিয়েছেন পোপ সপ্তদশ গ্রেগরির কাছ থেকে। মেইনস্ট্রিম ক্যাথলিকদের কাছে এই পোপ গ্রেগরি এন্টিপোপ হিসেবে পরিচিত, যদিও তার সময়েই পালমারিয়ান চার্চের প্রসার বাড়তে থাকে ক্রমান্বয়ে। ২০০৫ সালে পোপ গ্রেগরি যখন ইস্টার মাস্-এ সভাপতিত্ব করার সময় মারা গেলেন তার সমর্থকেরা এরকম সময় মৃত্যুবরণ করাটাকে ঈশ্বরের তরফ থেকে একটি অলৌকিক ঘটনা বলে প্রচার করে। তাদের স্থির বিশ্বাস, এই লোকের সাথে স্বয়ং ঈশ্বরের সংযোগ ছিল।

এখন আভিলা বিশাল চার্চটার দিকে তাকিয়ে ভবনটিকে অশুভ না ভেবে পারলো না।

বর্তমান যে-ই এন্টিপোপ হোক না কেন, তার সাথে আমার দেখা করার কোন ইচ্ছে নেই।

পাপাসি নিয়ে তাদের সাহসি দাবি ছাড়াও পালমারিয়ান চার্চের বিরুদ্ধে ব্রেনওয়াশ করা, কাল্টজাতীয় ভয়ভীতি দেখানোসহ এমনকি বেশ কিছু রহস্যময়। হত্যাকাণ্ডেরও অভিযোগ রয়েছে। ব্রিজিত ক্রসবি নামের চার্চের এক সদস্য আয়ারল্যান্ডের একটি পালমারিয়ান চার্চ থেকে নাকি পালাতে সক্ষম হয়নি বলে তার পারিবারিক উকিল দাবি করেছিল।

আভিলা তার নতুন বন্ধুর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চায়নি, তবে আজকের ভ্রমণটা যে এরকম কিছু হবে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি সে। মাকো, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল সে, আমি খুবই দুঃখিত, আমার মনে হচ্ছে না আমি এটা করতে পারবো।

আপনি যে এমনটা বলতে পারেন সেরকম কিছু আমার আগেই মনে হয়েছিল, জবাবে বলেছিল মাকো, তাকে দেখে অবাক মনে হয়নি। আমি স্বীকার করছি, আমি নিজেও যখন প্রথমবার এখানে এসেছিলাম আমারও একই রকম অনুভূতি হয়েছিল। আপনার মতো আমিও নানান রকমের গালগল্প আর গুজব শুনেছি। তবে আপনাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি, এসবই ভ্যাটিকানের ঘৃণ্য প্রচারণা ছাড়া আর কিছু না।

আপনি কি তাদেরকে এজন্যে দোষ দিতে পারেন? অবাক হয়ে ভেবেছিল আভিলা। আপনার এই চার্চ তাদেরকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে!

আমাদেরকে এক্সকমিউনিকেট করার জন্য রোমকে কিছু কারণ দেখাতে হবে, তাই এইসব মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়েছে তারা। অনেক বছর ধরেই পালমারিয়ানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করে যাচ্ছে ভ্যাটিকান।

একেবারে বিরাণ একটি জায়গায় এরকম বিশাল একটি ক্যাথেড্রাল আরেকবার দেখে নেয় আভিলা। তার মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল। আমি আসলে বুঝতে পারছি না, বলেছিল সে। আপনাদের সাথে ভ্যাটিকানের কোন সম্পর্ক নেই, তাহলে এত টাকা আসে কোত্থেকে?

মাকো কথাটা শুনে হেসে ফেলেছিল। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যে গোপনে অনেকেই পালমারিয়ান অনুসারি, তাদের সংখ্যার কথা জানতে পারলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। স্পেনের অনেক রক্ষণশীল ক্যাথলিক চার্চ আছে। যারা রোমের উদারপন্থি পরিবর্তনগুলোকে অনুমোদন করে না, ভালো চোখে দেখে না। তারা আমাদের মতো ঐতিহ্যবাহি মূল্যবোধ লালন করে যেসব চার্চ, সেগুলোতে নীরবে নিভৃতে টাকা-পয়সা দিয়ে থাকে।

জবাবটা অপ্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু আভিলার কাছে সেটা সত্য বলেই মনে হয়। সে নিজেও জানে ক্যাথলিক চার্চগুলোর মধ্যে দিন দিন কোন্দল আর বিভক্তি বেড়েই চলেছ্যোরা মনে করে চার্চকে আধুনিক হতে হবে নইলে শেষ। হয়ে যাবে, আর যারা বিশ্বাস করে চার্চের আসল উদ্দেশ্য হলো পরিবর্তনের মাঝেও দৃঢ়ভাবে সমুন্নত থাকবে, তাদের মধ্যে বিবাদ ক্রমশ জোরদার হচ্ছে এখন।

বর্তমান পোপ একজন অসাধারণ ব্যক্তি, মাকো বলেছিল। আমি তাকে আপনার গল্পটা বলেছি, তিনি বলেছেন, আপনার মতো একজন উচ্চপদস্থ মিলিটারি অফিসারকে এখানে স্বাগত জানাতে পারলে চার্চের জন্য অনেক সম্মানের ব্যাপার হবে। তিনি সার্ভিসের পর আপনার সাথে একান্তে দেখাও করতে চান। উনার পূর্বসুরির মতো উনিও ঈশ্বরকে খুঁজে পাবার আগে একজন মিলিটারি অফিসার ছিলেন। আপনি কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন সেটা উনি ভালোমতোই বুঝতে পারেন। আমি সত্যি বিশ্বাস করি, উনার দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো আপনাকে শান্তি খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।

মাকো গাড়ির দরজা খুলে দিলেও আভিলা বসে থেকে সামনের বিশাল কাঠামোটির দিকে চেয়ে থাকে আর অপরাধবোধে ভোগে এইজন্যে যে, কোন কিছু না বুঝেই সে এই লোকগুলো সম্পর্কে বাজে ধারণা পোষণ করেছে। সত্যি বলতে, তার কাছেও মনে হয়েছে, পালমারিয়ান চার্চের বিরুদ্ধে গুজব ছাড়া আর কিছু শোনেনি। তবে এটাও তো ঠিক, ভ্যাটিকানের বিরুদ্ধেও অনেক কেলেংকারির অভিযোগ রয়েছে। উপরন্তু আভিলার নিজের চার্চ ঐ হামলার পর তাকে কোন রকম সাহায্যই করতে পারেনি। তোমার শত্রুদেরকে তুমি ক্ষমা করে দাও, নান তাকে বলেছিল। আরেক গাল বাড়িয়ে দাও।

লুই, আমার কথা শুনুন, মাকো নিচুকণ্ঠে বলে। আমি জানি আপনাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য আমি একটুখানি চালাকির আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেটা করেছি সৎ উদ্দেশ্যেই…আমি চেয়েছি এই লোকটার সাথে আপনি দেখা করেন। উনার আইডিয়া আমার জীবন নাটকিয়ভাবে বদলে দিয়েছে। আমার পা হারানোর পর আপনি এখন যে অবস্থায় আছেন ঠিক সে অবস্থায়ই পড়ে গেছিলাম আমি। আমিও মরতে চেয়েছিলাম। অন্ধকারে তলিয়ে গেছিলাম পুরোপুরি। কিন্তু এই মানুষটা আমাকে আমার জীবনের একটি উদ্দেশ্য ঠিক করে দিয়েছেন। শুধু একবার তার কথা শুনুন।

আভিলা তারপরও দ্বিধান্বিত ছিল। আপনি আপনার উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছেন জেনে খুশি হলাম, মাকো। কিন্তু আমার মনে হয় আমি আমার মতো করেই ভালো থাকবো।

ভালো থাকবেন? হেসে উঠেছিল সেই তরুণ। এক সপ্তাহ আগে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেছিলেন! আপনি মোটেও ভালো নেই, বন্ধু।

তার কথা সত্যি, আভিলা জানতো, আর এক সপ্তাহ পর আমার থেরাপি শেষ হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে যাবো আমি, আবারো হয়ে পড়বো একা আর লক্ষ্যহীন।

আপনি কীসের ভয় পাচ্ছেন? মাকো জানতে চেয়েছিল। আপনি একজন নেভাল অফিসার। একেবারে পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষ, যিনি একটা জাহাজকে কমান্ড করেন! আপনি কি ভয় পাচ্ছেন পোপ আপনার ব্রেইনওয়াশ করে ফেলবেন দশ মিনিটের মধ্যে? অথবা আপনাকে জিম্মি হিসেবে আটকে রাখবে ওখানে?

আমি যে কীসে ভয় পাচ্ছি সেটা আমি নিজেও জানি না, আভিলা ভেবেছিল। আহত পা-টার দিকে তাকিয়ে খুবই তুচ্ছ আর অক্ষম বলে মনে হয়েছিল নিজেকে। জীবনের বেশিরভাগ সময় সে হুকুম তামিল করে কাটিয়ে দিয়েছে। অন্যের কাছ থেকে হুকুম শোনাটা তার জন্য কতোটুকু ভালো হবে সে-ব্যাপারে তার মধ্যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল।

ঠিক আছে, সমস্যা নেই, মার্কো অবশেষে বলেছিল। সিটবেল্টটা আবারো বেধে নিয়েছিল সে। আমি দুঃখিত। বুঝতে পারছি আপনি খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছেন। আপনাকে কোনরকম চাপ দিতে চাইনি আমি। গাড়িটা স্টার্ট দেবার জন্য উদ্যত হয় সে।

নিজেকে বোকা মনে হয়েছিল আভিলার। মাকে বলতে গেলে নিছক একটা বাচ্চা ছেলে। আভিলার বয়সের এক তৃতীয়াংশ, একটা পা নেই, শারীরিকভাবে অক্ষম লোকদের সাহায্য করার চেষ্টা করে সে। আর আভিলা কিনা তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে অকৃতজ্ঞতা আর সন্দেহ করার মধ্য দিয়ে।

না, বলেছিল আভিলা। আমাকে ক্ষমা করবেন, মাকো। এই লোকের কথা শুনতে পেলে আমি নিজেকে সম্মানিত বোধ করবো।

.

অধ্যায় ৪৯

এডমন্ডের টেসলা মডেল এক্সের উইন্ডশিল্ডটা বেশ প্রশস্ত। ল্যাংডনের মাথার পেছনে, গাড়ির ছাদের সাথে সেটা মিশে গেছে। ফলে তার কাছে মনে হচ্ছে। একটা ভাসমান কাঁচের বুদবুদের ভেতরে বসে আছে বুঝি।

উত্তর-বার্সেলোনার বনেবাদারের মাঝে চলে যাওয়া হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে ল্যাংডন। ১২০ কিলোমিটার গতিতে গাড়িটা চালাতে পেরে সে খুবই অবাক হলো। গাড়ির নিঃশব্দ ইঞ্জিন আর লিনিয়ার এক্সসেলেরেশনের ফলে প্রতিটি গতিই তার কাছে একই রকম লাগছে।

তার পাশের সিটে বসে আছে অ্যাম্রা, গাড়ির ড্যাশবোর্ডে থাকা বিশালাকারের কম্পিউটারটা দিয়ে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করে যাচ্ছে সে। সারাবিশ্বে এ মুহূর্তে কোন্ ব্রেকিং নিউজটা ছড়িয়ে পড়ছে সেটা ল্যাংডনকে জানিয়ে দিচ্ছে। ইন্টারনেটের সুবিশাল জগতে একটা গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে যে, পালমারিয়ান চার্চের এন্টিপোপের কাছে নাকি বিশপ ভালদেসপিনো ওয়্যারের মাধ্যমে তহবিল পাঠিয়ে আসছিলেন-এই পোপের সাথে আবার রক্ষণশীল কারলিস্টদের সঙ্গে মিলিটারি বন্ধন আছে, আপাত দৃষ্টিতে যাদেরকে এখন শুধুমাত্র এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যার অভিযোগেই সন্দেহ করা হচ্ছে না, এমন কি সাঈদ আল-ফজল আর রাবাই ইয়েহুদা কোভেসের মৃত্যুর জন্যেও দায়ি করা হচ্ছে।

জোরে জোরে পড়ে শোনালো অ্যাম্ব্রা, এটা পরিষ্কার, সব মিডিয়া থেকে এখন একটাই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে : এডমন্ড কিয়ার্শের আবিষ্কারটি কী এমন হুমকি সৃষ্টি করতো যে, সুপরিচিত একজন বিশপ আর রক্ষণশীল ক্যাথলিক গোষ্ঠিকে তার ঘোষণাটি থামিয়ে দেবার জন্য হত্যা করার মতো পদক্ষেপ পর্যন্ত নিতে হলো?

ভিউয়ারের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে…অবিশ্বাস্য গতিতে, মনিটর থেকে মুখ তুলে বলল অ্যাম্ৰা। এই সংবাদের ব্যাপারে জনগণের আগ্রহ নজিরবিহীন…মনে হচ্ছে সারা দুনিয়া মুখিয়ে আছে এটা জানার জন্য।

তৎক্ষণাৎ ল্যাংডন বুঝতে পারলো, সম্ভবত এডমন্ডের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সমগ্র মিডিয়ার অ্যাটেনশন, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা কিয়ার্শের শ্রোতাদের সংখ্যা যেভাবে হু হু করে বাড়ছে সেটা তার কল্পনারও অতীত। এ মুহূর্তে মরে গিয়েও এডমন্ড পৃথিবীর সবার আলোচনার মধ্যমণি হয়ে উঠেছে।

এই বোধোদয়টা ল্যাংডনকে তার লক্ষ্যের ব্যাপারে আগের চেয়ে আরো বেশি দৃঢ় প্রতীজ্ঞ করে তুলল-এডমন্ডের সাতচল্লিশ সংখ্যার পাসওয়ার্ডটা খুঁজে বের করে তার প্রেজেন্টেশনটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা।

হুলিয়ান এখন পর্যন্ত কোন স্টেটমেন্ট দেয়নি, অ্যাম্রাকে একটু বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। রাজপ্রাসাদ থেকে কোন টু শব্দও করা হয়নি। এটা তো আমার মাথায় ঢুকছে না। তাদের পিআর কো-অর্ডিনেটর মনিকা মার্টিনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, প্রেস কোন তথ্য বিকৃত করার আগেই এই মেয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সেই তথ্য শেয়ার করার উদ্যোগ নিয়ে থাকে। আমি নিশ্চিত, সে হুলিয়ানকে স্টেটমেন্ট দেবার জন্য তাগাদা দিচ্ছে।

ল্যাংডনেরও মনে হলো অ্যাম্ব্রা ঠিকই বলছে। মিডিয়া যেভাবে প্রাসাদের ধর্মিয় উপদেষ্টাকে এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত করার অভিযোগ করে যাচ্ছে, সেকথাটা বিবেচনায় নিলে হুলিয়ানের উচিত এ সম্পর্কে পরিষ্কার একটি বক্তব্য দেয়া। নিদেনপেক্ষ এটাও বলা যেতে পারে, প্রাসাদ এই অভিযোগের ব্যাপারটি তদন্ত করে দেখছে।

বিশেষ করে, ল্যাংডন যোগ করলো, আপনি যদি এটা মাথায় রাখেন, দেশের ভবিষ্যৎ রাণী এডমন্ড কিয়ার্শ গুলিবিদ্ধ হবার সময়ে তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আপনিও তো টার্গেট হতে পারতেন, অ্যাম্ৰা। যুবরাজের অন্তত এটুকু বলা উচিত, আপনি যে নিরাপদে আছেন তার জন্য তিনি স্বস্তি বোধ করছেন।

আমার মনে হয় না সে স্বস্তিতে আছে, সোজাসাপ্টা বলে দিলো সে। ব্রাউজ করা থামিয়ে সিটে হেলান দিলো এবার।

ল্যাংডন তার দিকে তাকালো। তাতে আর কী আসে যায়, আপনি যে নিরাপদে আছেন তাতে আমি খুশি। আমি নিশ্চিত নই, আজ রাতের ব্যাপারটা একা একা সামলাতে পারতাম কিনা।

একা? গাড়ির স্পিকারে একটা কণ্ঠ যেন প্রতিবাদ করে বলে উঠলো। কতো সহজেই না আমরা সবকিছু ভুলে যাই!।

উইনস্টনের এমন রাগের বর্হিপ্রকাশ দেখে হেসে ফেলল ল্যাংডন। উইনস্টন, এডমন্ড কি সত্যি তোমাকে ডিফেন্সিভ আর ইনসিকিউর হওয়ার মতো করে প্রোগ্রাম করেছে?

না, বলল উইনস্টন। উনি আমাকে প্রোগ্রাম করেছেন অবজার্ভ করা, শেখা আর মানুষের আচার-আচরণ অনুকরণ করার জন্য। আমার বলা কথাটা আসলে ঠাট্টা ছিল-এডমন্ড আমাকে এটা আয়ত্ত করতে উৎসাহ দিতেন। ঠাট্টা তামাশা প্রোগ্রাম করা যায় না…এটা শিখে নিতে হয়।

তাহলে বলতেই হয়, তুমি ভালোমতোই শিখছো।

আসলেই? সত্যি জানতে চাইলো উইনস্টন। সম্ভবত আপনি এটা আবার বলতে পারেন?

সশব্দেই হেসে ফেলল ল্যাংডন। যেমনটা বলেছি, তুমি ভালোমতোই শিখছো।

অ্যাম্ব্রা এবার ড্যাশবোর্ডের ডিসপ্লের ডিফল্ট পেজে ফিরে গেল-স্যাটেলাইট ইমেজ সংবলিত একটি নেভিগেশন প্রোগ্রাম আছে, তাতে রয়েছে অতি ক্ষুদ্র অ্যাভাটার নামের একটি বিন্দু, সেটার মাধ্যমে তাদের গাড়িটা দেখতে পাচ্ছে। সে। ল্যাংডন দেখতে পাচ্ছে তারা এখন কলসেরোলা পর্বতমালায় আছে, এগিয়ে যাচ্ছে বার্সেলোনায় যাবার জন্য যে পথটি আছে সেই হাইওয়ে বি-২০র দিকে। স্যাটেলাইট ফটোতে তাদের অবস্থানের একটু দক্ষিণে অস্বাভাবিক কিছু একটা চোখে পড়লো ল্যাংডনের-ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একটি শহরের মাঝখানে বিশাল বড় একটি বনাঞ্চল। সবুজ জায়গাটিকে বিশাল বড় একটি অ্যামিবার মতোই দেখাচ্ছে।

এটা কি পার্ক গুয়েল? জিজ্ঞেস করলো সে।

স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো অ্যাম্ব্রা। ঈশ্বরের চোখ।

এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে যাবার সময়, উইনস্টন যোগ করলো, এডমন্ড প্রায়ই ওখানে থামতেন।

ল্যাংডন তাতে অবাক হলো না। পার্ক গুয়েল আন্তোনি গদির বিখ্যাত একটি মাস্টারপিস-এই একই স্থপতির আর্টিস্টিক কাজ এডমন্ড তার ফোন কেসেও ব্যবহার করেছে। গওদিও অনেকটা এডমন্ডের মতই, ভাবলো ল্যাংডন। যুগান্তকারি একজন ভিশনারি ছিলেন তিনি, প্রচলিত কোন নিয়মই মানতেন না।

প্রকৃতির একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে আন্তোনিও গওদি তার আর্কিটেকচারাল অনুপ্রেরণা পেতেন জৈবিক আর প্রাণীজ আকার থেকে, ঈশ্বরের প্রাকৃতিক জগৎকে ব্যবহার করে তিনি এমন সব তরল জৈবিক কাঠামোর ডিজাইন করতেন, যেগুলোকে দেখলে মনে হতো মাটি থেকে বুঝি আপনাআপনিই গজিয়ে উঠেছে। প্রকৃতিতে কোন সরল রেখা নেই, গওদি একবার বলেছিলেন। সেজন্যে তার কাজেও খুব কমই সরলরেখার দেখা পাওয়া যায়।

তাকে প্রায়শই জীবন্ত স্থাপত্য এবং জৈব ডিজাইন-এর জনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গওদি তার ভবনগুলোর বাইরের অংশ ঢাকার জন্য কাঠ, লোহা আর কাঁচের এমন সব টেকনিক উদ্ভাবন করেছিলেন যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি।

এমন কি আজকের দিনেও, গদির মৃত্যুর একশ বছর পরও সারা পৃথিবী থেকে অসংখ্য পর্যটক বার্সেলোনাতে আসে তার অনন্য আধুনিক কাজগুলো দেখার জন্য। তার কাজের মধ্যে অসংখ্য পার্ক, সরকারি ভবন, ব্যক্তিগত ম্যানশনসহ সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ বার্সেলোনার বিশাল ক্যাথলিক ব্যাসিলিকা সাগ্রাদা ফামিলিয়া অন্যতম, যার সুউচ্চ সামুদ্রিক স্পঞ্জসদৃশ চূড়াগুলো শহরটির স্কাইলাইনে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। সমালোচকেরা এটাকে আর্টের ইতিহাসে এরকম কোন কাজ কখনও দেখা যায়নি বলে অভিহিত করে থাকে।

গওদির সারগাদা ফামিলিয়ার দুঃসাহসিক দৃশ্যটার কথা ভাবলেই ল্যাংডন সব সময়ই বিস্মিত হয়-এমন সুবিশাল একটি ব্যাসিলিকা, ১৪০ বছর পরও যার। নির্মাণ কাজ পুরোপুরিভাবে শেষ করা যায়নি।

আজ রাতে গাড়ির মনিটরে গদির পার্ক গুয়েলের স্যাটেলাইট ইমেজের দিকে চোখ যেতেই কলেজ জীবনে প্রথমবার সেখানে যাওয়ার স্মৃতিটা মনে পড়ে গেল ল্যাংডনের।

গওদির সবকিছুই খুব পছন্দ করতো এডমন্ড, উইনস্টন বলতে লাগলো, বিশেষ করে কনসেপ্ট হিসেবে তার জৈব আর্টের ব্যবহার করাটাকে।

এডমন্ডের আবিষ্কারের কথাটা আবারো মনে পড়ে গেল ল্যাংডনের। প্রকৃতি। জৈব। সৃষ্টিতত্ত্ব। গদির বিখ্যাত বার্সেলোনা পানোত-এর কথা মনে পড়ে গেল তার–এক ধরণের ষড়ভূজাকৃতির টাইল যা কিনা শহরের ফুটপাতে ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি টাইলেই একই রকম পেচানো ডিজাইন আপাত দৃষ্টিতে দেখলে অর্থহীন বলেই মনে হবে কিন্তু সেগুলো নির্দিষ্টভাবে সাজালে চমকে যাবার মতো একটি প্যাটার্ন চোখে পড়ে-পানির নিচের এমন একটি দৃশ্য যেটা প্লাঙ্কটন, অণুজীব আর সামুদ্রিক ঘাসের প্রতিচ্ছবির মতো।

গওদির প্রিমর্ডিয়াল স্যুপ, ল্যাংডন ভাবলো এডমন্ডকে যে জীবনের সূচনা নিয়ে কৌতূহলি করে তুলেছিল তার সাথে তার এই বার্সেলোনা শহরে চলে আসাটা একেবারেই খাপে খাপ খেয়ে যায়। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান বলে, পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি হয়েছিল একটি প্রিমর্ডিয়াল স্যুপের মধ্যেই। পৃথিবীর প্রথমদিককার সমুদ্রগুলো ছিল বেশ উত্তপ্ত, অনেকটা আগ্নেয়গিরির তরল লাভার মতোই। সেই তরলে ছিল অসংখ্য সমৃদ্ধ রাসায়নিক উপাদান। ওগুলো একে অন্যের সাথে মিশে, বিরামহীন বজ্রপাতের আঘাত আর ঝড়ের কবলে পড়ে…হঠাৎ করেই অণুজীবের উৎপত্তি ঘটায়। আর সেটাই এই পৃথিবীর প্রথম এককোষি প্রাণীর উন্মেষ।

অ্যাম্রা, ল্যাংডন বলল, আপনি তো জাদুঘরের একজন কিউরেটর-আপনি নিশ্চয় এডমন্ডের সাথে প্রায়ই আর্ট নিয়ে কথা বলতেন। সে। কি কখনও আপনাকে বলেছে, গওদির নির্দিষ্ট কোন বিষয়টি তাকে বেশি ভাবাতো?

একটু আগে উইনস্টন যেটার কথা বলেছে, জবাব দিলো সে। প্রকৃতি যেন নিজেই সৃষ্টি করেছে, তার এরকম আর্কিটেকচার অনুভূতি। গওদির নক্সা করা ভবনের খোপগুলো দেখলে মনে হয় সেগুলো বুঝি বাতাস আর বৃষ্টির ফলে। সৃষ্টি হয়েছে, তার স্তম্ভগুলো দেখলে মনে হয় ওগুলো মাটি থেকে গজিয়ে উঠেছে আর টাইলগুলো অনেকটা আদিম সামুদ্রিক প্রাণের মতোই লাগে। কাঁধ তুলল সে। কারণ যা-ই হোক না কেন, এডমন্ড গওদিকে এতটাই শ্রদ্ধা করতো যে থাকার জন্য স্পেনে চলে আসে সে।

তার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো ল্যাংডন। সে জানে পৃথিবীর অনেক দেশেই এডমন্ডের বাড়ি থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরে স্পেনেই থিতু হয়েছে। আপনি বলতে চাচ্ছেন, গওদির আর্টের কারণে এডমন্ড এখানে চলে। এসেছে?

আমার তা-ই মনে হয়, অ্যাম্ব্রা বলল। একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্পেনে কেন? সে আমাকে বলেছিল, একটি অনন্য জায়গা ভাড়া করার সুযোগ পেয়েছে এখানে-এমন একটি জায়গা যা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আমি ধরে নিয়েছিলাম সে তার অ্যাপার্টমেন্টের কথাটাই বলছে।

তার অ্যাপার্টমেন্টটা কোথায়?

রবার্ট, এডমন্ড কাসা মিলাতে থাকতো।

একটু আৎকে উঠলো ল্যাংডন। কাসা মিলা?

এক এবং অদ্বিতীয় কাসা মিলা, সায় দিয়ে বলল। গত বছর সে টপফ্লোরের পুরোটাই ভাড়া নিয়ে নেয় তার পেন্থাউজ অ্যাপার্টমেন্ট হিসেবে।

কথাটা হজম করতে একটু বেগ পেতে হলো ল্যাংডনকে। কাসা মিলা গওদির ডিজাইন করা বিখ্যাত ভবনগুলোর একটি-একেবারেই অরিজিনাল একটি ভবন, যার বহুস্তরবিশিষ্ট সম্মুখ ভাগ আর পাথরের বেলকনিগুলো দেখতে খোদাই করা পাহাড়ের মতো লাগে। বর্তমানে এটার জনপ্রিয় নাম হলো লা পেরেরা্যার অর্থ পাথরের গুহা।

টপ ফ্লোরটা কি গওদির জাদুঘর না? অনেক আগে সেখানে যাবার কথাটা মনে পড়তেই জানতে চাইলো ল্যাংডন।

হ্যাঁ, জবাবটা উইনস্টনই দিলো। কিন্তু এডমন্ড ইউনেস্কোকে ডোনেশন দিয়েছিলেন, ফলে ওই ভবনটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি স্থাপনা হিসেবে সুরক্ষিত করা হয়েছে। সেই সাথে তারা একমত পোষণ করেছে যে, সাময়িকভাবে সেটা বন্ধ করে দিয়ে তাকে ওখানে দু-বছর বসবাস করার। অনুমতি দেয়া হবে। হাজার হোক, এই বার্সেলোনায় গদির এরকম কাজের কোন ঘাটতি নেই।

গওদির কাসা মিলার ভেতরে থাকতো এডমন্ড? বিভ্রান্ত হলো ল্যাংডন। সে মাত্র দু-বছরের জন্য এখানে এসেছে থাকতে?

উইনস্টন বলে উঠলো, এডমন্ড কাসা মিলার স্থাপত্যের উপরে শিক্ষামূলক একটি ভিডিও-ও বানিয়েছিলেন। দেখার মতো একটা জিনিস ওটা।

ভিডিওটা আসলেই চমৎকার, সায় দিয়ে বলল অ্যাম্ৰা। সামনের দিকে ঝুঁকে স্ক্রিনে ব্রাউজ করলো সে। একটা কিবোর্ড ভেসে উঠলো পদায়, তাতে টাইপ করলো : Lapedrera.com। আপনার এটা দেখা উচিত।

আমি গাড়ি চালাচ্ছি, জবাবে বলল ল্যাংডন।

স্টিয়ারিং কলামের দিকে ঝুঁকে একটা ছোট্ট লিভার ধরে খুব দ্রুত দুটো টান দিলো অ্যাম্ৰা। ল্যাংডন টের পেলো তার হাতে ধরে থাকা স্টিয়ারিংটা জমে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও খেয়াল করলো গাড়িটা এখন নিজে নিজেই চলছে। একেবারে নিখুঁতভাবে দুই লেনের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা।

অটোপাইলট, সে বলল। একটু ভড়কে গেল ল্যাংডন, হাতটা স্টিয়ারিং থেকে না সরিয়ে পারলো। পা-টাও সরিয়ে আনলো ব্রেকের উপর থেকে।

রিল্যাক্স। তার কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করলো। ম্যানুয়াল ড্রাইভিংয়ের চেয়ে এটা অনেক বেশি নিরাপদ।

অনিচ্ছায় নিজের হাতদুটো কোলের উপরে রাখলো প্রফেসর।

এই যে, হেসে বলল সে। কাসা মিলার ভিডিওটা এখন দেখতে পারেন।

ভিডিওটা শুরু হয়েছে নাটকিয় একটি শটের মধ্য দিয়ে। খুব নিচু হয়ে, মাত্র কয়েক ফিট উপর দিয়ে সমুদ্রের উপর দিয়ে একটা হেলিকপ্টার ছুটে যাচ্ছে যেন। সামনে উদ্ভাসিত হলো একটা দ্বীপের মতো ভূখও নিচের জলরাশির প্রবল ঢেউয়ের একশ ফিট উপরে পাথরের একটি পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

পাহাড়ের গায়ে কিছু লেখা ভেসে উঠলো :

লা পেরেরা গওদি সৃষ্টি করেননি।

পরবর্তি ত্রিশ সেকেন্ড ধরে ল্যাংডন দেখে গেল পানির ঢেউ আছড়ে পড়ে পড়ে সেই পাহাড়টাকে খোদাই করে ফেলছে, ধীরে ধীরে সেটা রূপান্তরিত হয়ে গেল কাসা মিলাতে। এরপর জলরাশিরে স্রোত এর ভেতরে ঢুকে অসংখ্য ফাপা জায়গা আর বিশাল বিশাল ঘর তৈরি করে ফেলল, জলপ্রপাতগুলো তৈরি করলো সিঁড়ি আর পানির প্রবাহ তৈরি করলো কার্পেটিং মেঝে।

অবশেষে ক্যামেরা সমুদ্র থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে গিয়ে কাসা মিলার ছবিটা ফুটিয়ে তুলল-গুহা-বিশাল এক পর্বত খোদাই করে বানানো হয়েছে।

-লা পেরেরা-
প্রকৃতির একটি মাস্টারপিস।

ল্যাংডনকে এটা মানতেই হলো ড্রামা করার ব্যাপারে এডমন্ডের প্রবল ঝোঁক ছিল। কম্পিউটার-জেনারেটেড এই ভিডিওটা দেখে বিখ্যাত ভবনটি আবার দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলো সে।

সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে অটোপাইলট মোডটা বন্ধ করে গাড়িটা আবারো চালাতে শুরু করলো ল্যাংডন। আশা করি আমরা যা খুঁজছি সেটা এডমন্ডের অ্যাপার্টমেন্টে পাবো। পাসওয়ার্ডটা খুবই দরকার আমাদের।

.

অধ্যায় ৫০

কমান্ডার ডিয়েগো গারজা তার চারজন সশস্ত্র গার্ডিয়া এজেন্ট নিয়ে প্লাজা দে লা আরমেরিয়ার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেল, গ্রিলের বেড়ার ওপাশে জড়ো হওয়া মিডিয়ার লোকজনদের দিকে চেয়েও দেখলো না। তারা সবাই তাদের ক্যামেরা বারের ওপাশ থেকেই তার দিকে তাক করে রেখেছে, চিৎকার করে তাকে মন্তব্য করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।

তারা অন্তত দেখতে পাচ্ছে কেউ পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।

সে যখন তার দলটা নিয়ে ক্যাথেড্রালে প্রবেশ করতে যাবে দেখতে পেলো দরজাটা লক করে রাখা–এরকম সময় এটাই স্বাভাবিক-দরজায় জোরে জোরে আঘাত করলো গারজা।

কোন সাড়াশব্দ নেই।

আবারো আঘাত করে গেল।

অবশেষে লক্ খোলার শব্দ হতেই দরজাটা খুলে গেল। ক্লিনিংয়ের কাজ করে যে মেয়েটা সে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। ছোটখাটো একটা সশস্ত্র দল দেখে সঙ্গত কারণেই ভড়কে গেল সে।

বিশপ ভালদেসপিনো কোথায়? জানতে চাইলো গারজা।

আমি. ..জানি না, মেয়েটা জবাব দিলো।

আমি জানি বিশপ এখানেই আছেন, জোরে বলল গারজা। তার সঙ্গে আছেন যুবরাজ। তাদেরকে তুমি দেখোনি?

মেয়েটা মাথা ঝাঁকালো। এইমাত্র এসেছি আমি। শনিবার রাতে এখানে ক্লিনিংয়ের কাজ করি–

গারজা মেয়েটাকে সরিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে, তার লোকদেরকে অন্ধকার ক্যাথেড্রালের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিলো সে।

দরজাটা লক করে রাখা, ক্লিনিংয়ের কাজ করা মেয়েটাকে বলল গারজা। তারপর এখান থেকে সরে যাও।

এ কথা বলেই অস্ত্রটা কক করে নিলো, তারপর সোজা চলে গেল ভালদেসপিনোর অফিসের দিকে

*

প্লাজার অপর পাশে প্রাসাদের বেইজমেন্টের কন্ট্রোল রুমে মনিকা মার্টিন ওয়াটার কুলারের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেটে দীর্ঘ একটা টান দিলো। স্পেনের উদারপন্থি রাজনীতিকোভ সারাদেশসহ প্রাসাদের অফিসে ধুমপান করা নিষিদ্ধ করলেও আজ রাতে প্রাসাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অপরাধের বিস্তর অভিযোগ তোলা হচ্ছে তাতে করে একটুখানি ধুমপান করাটা সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই। দেখবে।

তার সামনে থাকা একটি র‍্যাকে একসারি টেলিভিশন চলছে, তবে সবগুলোই মিউট করে রাখা। এই টিভিগুলোতে দেখা যাচ্ছে পাঁচটি নতুন টিভিস্টেশন এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচার করে যাচ্ছে, বিভৎস সেই দৃশ্যটার কিছু অংশ দেখাচ্ছে একটু পর পরই। অবশ্য এই দৃশ্য দেখানোর আগে প্রতিটি টিভি চ্যানেলই একটি সতর্কীকরণ প্রচার করছে।

সাবধান : যে ক্লিপটি দেখানো হবে সেটা সব দর্শকদের জন্য যথার্থ না-ও হতে পারে।

বেহায়ার দল, ভাবলো সে। এইসব সতর্কীকরণ দেখিয়ে তারা আসলে বোঝাতে চাইছে তারা খুবই সংবেদনশীল। আদতে এগুলো দেখানো হয় আরো

বেশি দর্শক টানার জন্য, যাতে কেউ অন্য চ্যানেলে সুইচ না করে।

মার্টিন সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের দিকে তাকালো। বেশিরভাগ চ্যানেলই ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের ফেনিয়ে তোলা তত্ত্বকে ব্রেকিং নিউজের মর্যাদা দিয়ে প্রচার করছে এখন। টিভির নিচে স্ক্রলে লেখাগুলো বলছে :

ফিউচারিস্টকে চার্চ হত্যা করেছে?

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারটি চিরতরের জন্য হারিয়ে গেল?

খুনিকে ভাড়া করেছে রাজপরিবার?

তোমাদের তো সংবাদ প্রচার করার কথা, গজ গজ করে উঠলো সে। প্রশ্নাকারে জঘন্য সব গুজব ছড়ানোর কথা নয়।

মার্টিন সব সময়ই বিশ্বাস করে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ। সেজন্যে এরকম কাল্পনিক আর গুজব টাইপের সংবাদ দেখলে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে সে।

এমন কি স্বনাধন্য সায়েন্স চ্যানেলগুলোও বর্তমানে একই কাজ করছে। তারা তাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে : এটা কি সম্ভব, পেরুর এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছে মহাকাশ থেকে আসা বহির্জীবেরা?।

না! টিভিগুলোর উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো মার্টিনের। এটা কোনভাবেই সম্ভব হতে পারে না! গাধাদের মতো প্রশ্ন করা বন্ধ করো!

একটা টেলিভিশনে সে সিএনএন-এর সংবাদের দিকে তাকালো। সত্যি বলতে তারাই কেবল এসব হট্টগোলের মধ্যে নিজেদের জড়ায়নি। বরং শ্রদ্ধা জাগানোর মতো কাজ করছে।

এডমন্ড কিয়ার্শের স্মরণে।

পয়গম্বর। দূরদ্রষ্টা। উদ্ভাবক।

রিমোটটা হাতে নিয়ে ভলিউম বাড়িয়ে দিলো মার্টিন।

যিনি ভালোবাসতেন শিল্পকলা, টেকনোলজি আর নতুন নতুন জিনিসের উদ্ভাবন, বিষণ্ণ বদনে সংবাদ উপস্থাপক বলে চলেছে। তিনি প্রায় আধ্যাত্মিকভাবেই যেন ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন, আর এ কারণেই ঘরে ঘরে তার নামটা সুপরিচিত হয়ে ওঠে। তার কলিগদের মতে, কম্পিউটার বিজ্ঞানের উপরে করা এডমন্ড কিয়ার্শের প্রায় সবগুলো ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে।

কথা সত্যি, ডেভিড, তার সহ-উপস্থাপিকা মেয়েটি বলল। তার নিজের ব্যাপারে বলা ভবিষ্যদ্বাণীটিও যদি সত্যি হতো তাহলে বেশি খুশি হতাম।

আকাইভ থেকে তারা এবার একটা ফুটেজ দেখাতে শুরু করলো। দৃঢ় আর সূর্যের তাপে পোড়ানো তামাটে চেহারার এডমন্ড কিয়ার্শ একটা প্রেস কন্সফারেন্স করছে নিউইয়র্কের রকফেলার সেন্টারের ফুটপাতে। আজ আমি ত্রিশ বছরের এক যুবক, বলল সে। আমার গড় আয়ু মাত্র আটষট্টি বছর। যাইহোক, ভবিষ্যতে অগ্রসর মেডিসিন আর টেকসই টেকনোলজির কারণে, আমি অনুমাণ করছি একশ দশতম জন্মদিন দেখে যেতে পারবো। সত্যি বলতে কি আমি এ ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসি যে, নিজের একশ দশতম জন্মদিনের পার্টির জন্য এরইমধ্যে রেইনবো রুম-ও ভাড়া করে রেখে দিয়েছি। মুচকি হেসে বিল্ডিংয়ের উপরের দিকে তাকালো কিয়ার্শ। একটু আগে আমি আশি বছর পরের বিলটা পরিশোধ করেছি-ততোদিনে মূল্যস্ফীতি যতো বাড়বে সেই হিসেব করেই।

উপস্থাপিকা গম্ভীরভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে এলো টিভি পর্দায়। পুরনো একটা প্রবাদ আছে, মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক।

কতোই না সত্য, উপস্থাপক ভদ্রলোক বলল এবার। কিয়ার্শের মৃত্যুর সাথে সাথে তার আবিষ্কারের ধরণটা নিয়েও নানা রকম অনুমাণ করা শুরু হয়ে গেছে। ক্যামেরার দিকে তাকালো সে। আমরা কোথা হতে এসেছি? কোথায় যাচ্ছি? দুটো চমকপ্রদ প্রশ্ন।

আর এই প্রশ্নের জবাব পাবার জন্য, উপস্থাপিকা বলল রোমাঞ্চের সাথে, আমাদের সাথে এ মুহূর্তে যোগ দেবেন দু-জন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব-ভারমন্টের সুপচিরিত এক যাজক এবং ইউসিএল-এর প্রখ্যাত এক জীববিজ্ঞানী। তারা কী বলেন সেটা জানার জন্য আমরা ফিরে আসছি একটা ব্রেকের পরই।

মার্টিন অবশ্য জানে তারা কী বলবে-দুই মেরুর দু-জন মানুষ, তা-না হলে তো আপনাদের শো-তে তাদেরকে নিয়েই আসতেন না। কোন সন্দেহ নেই, যাজক মহিলা বলবেন : আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টি, তার কাছ থেকেই এসেছি, আবার ফিরে যাবো তারই কাছে। আর জীববিজ্ঞানী এর জবাবে বলবেন, আমরা বানর থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষে পরিণত হয়েছি। আর আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাবো এক সময়।

তাদের কথায় কিছুই প্রমাণিত হবে না, শুধু আমরা যারা দর্শক আছি তারা। হাইপ ওঠ কোন কিছু দেখা ছাড়া।

মনিকা! সুরেশ প্রায় চিৎকার করেই বলল কাছ থেকে।

চট করে ঘুরে দাঁড়ালো মার্টিন, দেখতে পেলো ইলেক্ট্রনিক সিকিউরিটির ডিরেক্টর রীতিমতো দৌড়ে ছুটে এসেছে তার দিকে।

কী হয়েছে? জানতে চাইলো মনিকা মার্টিন।

বিশপ ভালদেসপিনো এইমাত্র আমাকে ফোন দিয়েছিলেন, দম ফুড়িয়ে হাপাচ্ছে সে।

সঙ্গে সঙ্গে টিভিটা মিউট করে দিলো মনিকা। বিশপ তোমাকে কল দিয়েছেন? তিনি কি বলেছেন এসব কী হচ্ছে?!

মাথা ঝাঁকালো সুরেশ। আমি এটা জিজ্ঞেস করিনি, তিনিও বলেননি। তিনি আমাকে কল করেছিলেন, আমাদের ফোন সার্ভারটা একটু চেক করে দেখার জন্য।

বুঝলাম না।

তুমি তো জানোই কন্সপিরেসিনেট রিপোর্ট করেছে, প্রাসাদের ভেতর থেকে কেউ নাকি আজকের অনুষ্ঠানের ঠিক আগে দিয়ে ফোন করেছিল গুগেনহাইমে-অ্যাম্ব্রা ভিদালকে অনুরোধ করে বলেছিল আভিলার নামটা অতিথিদের তালিকায় ঢোকানোর জন্য?

হ্যাঁ। আমি তোমাকে সে ব্যাপারে খোঁজ নিতেও বলেছিলাম।

যাই হোক, বিশপও সেরকম অনুরোধই করেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, আমি যেন লগ থেকে খুঁজে বের করে দেখি ঐ কলটা প্রাসাদের কোত্থেকে করা হয়েছে, যাতে করে কে কাজটা করেছে সেটা খুঁজে বের করা যায়।

মার্টিনকে একটু বিভ্রান্ত লাগলো। কারণ স্বয়ং বিশপকেই এ কাজের জন্য সন্দেহ করা হচ্ছে।

গুগেনহাইম থেকে বলা হয়েছে, সুরেশ বলতে লাগলো, আজ রাতে অনুষ্ঠানের ঠিক আগে দিয়ে তাদের ফ্রন্ট ডেস্ক মাদ্রিদের রাজপ্রসাদের প্রাইমারি নাম্বার থেকে একটি কল পায়। এটা তাদের ফোন লগে আছে। কিন্তু সমস্যাটা এখানেই। ঐ একই সময়ে আমাদের এখান থেকে কোন ফোন কল করা হয়েছিল কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে আমি আমাদের সুইচবোর্ডের লগটা চেক করে দেখেছি, মাথা ঝাঁকালো সে। কিছু নেই। একটা কলও করা হয়নি। কেউ না কেউ প্রাসাদ থেকে গুগেনহাইমে করা কলের রেকর্ড ডিলিট করে দিয়েছে।

কলিগের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো মার্টিন। ওটাতে অ্যাকসেস আছে কার?

ভালদেসপিনোও আমার কাছে এটা জানতে চেয়েছেন। তাই আমি তাকে সত্যিটাই বলেছি। তাকে বলেছি, হেড অব ইলেক্ট্রনিক সিকিউরিটি হিসেবে আমিও রেকর্ডটা ডিলিট করতে পারতাম, কিন্তু সেটা আমি করিনি। এছাড়া একমাত্র যে ব্যক্তি রেকর্ডটাতে অ্যাকসেস করতে পারেন তিনি হলেন কমান্ডার গারজা।

মার্টিন চেয়ে রইলো কথাটা শুনে। তুমি মনে করছো গারজা এ কাজ করেছেন? আমাদের ফোন রেকর্ড ট্যাণ্ডার্ড করেছেন উনি?

তেমনটাই মনে হচ্ছে, বলল সুরেশ। গারজার কাজই হলো প্রাসাদকে সুরক্ষিত করা, সুতরাং এখন যদি এটা নিয়ে কোন রকম তদন্ত করা হয় তাহলে দেখা যাবে এরকম কল এখান থেকে করাই হয়নি। টেকনিক্যালি, আমাদেরকে এটা অস্বীকার করতেই হতো। সুতরাং রেকর্ডটা ডিলিট করার মানে প্রকারান্তরে প্রাসাদকে সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে দেয়ারই নামান্তর।

বাঁচিয়ে দেয়া? মনিকা জানতে চাইলো। কলটা যে এখান থেকে করা হয়েছে সে-ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই! সে-কারণেই অ্যাম্ৰা অতিথিদের তালিকায় ঐ খুনি আভিলার নাম অন্তর্ভূক্ত করেছেন। আর গুগেনহাইম ডেস্ক এটা ভেরিফাই করে দেখেছে যে

সত্যি, কিন্তু এটা জাদুঘরের ফ্রন্ট ডেস্কের এক তরুণী কথা, যেটা কিনা পুরো রাজপ্রসাদের বিরুদ্ধে যায়। আমাদের রেকর্ডমতে এরকম কোন কল করার ঘটনা আসলে ঘটেইনি।

সুরেশের সহজ-সরল হিসেবটা মার্টিনের কাছে একটু বেশি আশাবাদি বলে মনে হচ্ছে। আর তুমি এসব কথা ভালদেসপিনোকে বলে দিয়েছো?

কথাগুলো তো সত্যি। আমি তাকে বলেছি, গারজা কলটা করেছে কি করেনি সেটা জানি না তবে তিনি এটার রেকর্ড ডিলিট করে দিয়েছেন প্রাসাদকে রক্ষা করার জন্যই। একটু থামলো সুরেশ। তবে আমি বিশপের কলটা শেষ করার পরই বুঝতে পারলাম অন্য একটা ব্যাপার আছে।

সেটা কি?

টেকনিক্যালি, তৃতীয় আরেকজনেরও সার্ভারে অ্যাকসেস রয়েছে। ঘরের চারপাশে নার্ভাস ভঙ্গিতে তাকালো সে, তারপর আরেকটু কাছে এসে বলল, যুবরাজ হুলিয়ানের কাছে আমাদের সব সিস্টেমে প্রবেশ করার কোডগুলো রয়েছে।

মার্টিন চেয়ে রইলো। কী হাস্যকর কথা বলছো!

জানি কথাটা শুনতে ওরকমই লাগে, বলল সে, কিন্তু ঐ কলটা যখন করা হয় তখন প্রিন্স প্রসাদের অ্যাপার্টমেন্টেই ছিলেন…একদম একা। খুব সহজেই তিনি সেটা করতে পারেন, তারপর সার্ভারের লগ থেকে মুছে ফেলতে পারেন রেকর্ডটা। সফটওয়্যারটা চালানো খুবই সহজ। আর যুবরাজকে মানুষ যতোটা ভাবে তিনি আসলে তার চাইতেও অনেক বেশি টেকনোলজি বোঝেন।

সুরেশ, মার্টিন চটেই গেল এবার, তুমি কি সত্যি মনে করো যুবরাজ হুলিয়ান, স্পেনের হবু রাজা একজন খুনিকে গুগেনহাইমে পাঠিয়েছেন এডমন্ড কিয়ার্শকে হত্যা করার জন্য?

আমি জানি না, বলল সে। আমি কেবল বলতে চাচ্ছি, এটা সম্ভব। যুবরাজ কেন এরকম কাজ করতে যাবেন?!

ভুলে গেছো, অ্যাম্ব্রা আর যুবরাজ যে একসাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সময় কাটাচ্ছেন সেইসব নিয়ে প্রেসের বাজে খবরগুলো তোমাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে? তিনি অ্যাম্ব্রার বার্সেলোনার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিভাবে চলে এসেছিলেন?

ওরা কাজ করছিল! ওটা নিছক কাজের ব্যাপার ছিল!

রাজনীতি মানেই কী দেখা গেল সেটা, সুরেশ বলল। তুমিই আমাকে এটা শিখিয়েছিলে। তুমি আমি দু-জনেই জানি, যুবরাজের প্রকাশ্যে, জনসম্মুখে বিয়ের প্রস্তাব দেয়াটা তিনি যেরকমটা মনে করেছিলেন সেরকমভাবে কিন্তু কাজ করেনি।

সুরেশের ফোন বিপ্ করে করে উঠলে ইনকামিং মেসেজটা পড়ে দেখলো সে। সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাসের কালো মেঘে ঢেকে গেল তার চেহারা।

কী হয়েছে? জানতে চাইলো মার্টিন।

কোন কথা না বলে সুরেশ ঘুরেই দৌড়াতে শুরু করলো সিকিউরিটি সেন্টারের দিকে।

সুরেশ! সিগারেটটা ফেলে দিয়ে মার্টিনও তার পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলো। তারা দুজনেই পৌঁছে গেল সুরেশের সিকিউরিটি টিমের একটি ওয়ার্কস্টেশনে, সেখানে তার টেকনিশিয়ান একটি অস্পষ্ট সারভিল্যান্স টেপ চালাচ্ছে।

আমরা কী দেখছি? জানতে চাইলো মার্টিন।

ক্যাথেড্রালের পেছন দিক দিয়ে বের হবার দরজাটা, টেক ছেলেটা বলল। পাঁচ মিনিট আগের ভিডিও এটা।

মার্টিন আর সুরেশ ঝুঁকে ভিডিওটা দেখলো। যাজকের এক তরুণ সহকারি ক্যাথেড্রালের পেছন দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি কয়ে মেয়র এর দিকে। ওখানে একটা পুরনো আর ট্যাপখাওয়া ওপেল সিডান গাড়ির দরজা খুলে উঠে পড়লো সে।

ঠিক আছে, মার্টিন ভাবলো, মাস শেষ হবার পর সে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, তো কী হয়েছে?

পর্দায় দেখা যাচ্ছে সেই ওপেল গাড়িটা একটু সামনে গিয়েই ক্যাথেড্রালের পেছন দিককার গেটের কাছে থামলো-ঠিক এই গেটটা দিয়েই সহকারি ছেলেটা একটু আগে বেরিয়ে এসেছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গেট দিয়ে দুটো অবয়ব বেরিয়ে এলো, একটু উপুড় হয়ে তড়িঘরি ঢুকে পড়লো গাড়ির পেছনের সিটে। সেই দু জন প্যাসেঞ্জার আর কেউ নন-বিশপ ভালদেসপিনো আর যুবরাজ হুলিয়ান। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই।

কিছুক্ষণ পরই ওপেলটা চলে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত